প্রাকজন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি সুধীরলাল চক্রবর্তী রজনী গো যেও না চলে

উনিশশো বিশে জন্ম, উনিশশো বাহান্নোতে বিদায় – মোটে বত্রিশ বছরের জীবন। এই সংক্ষিপ্ত আয়ুর কারণেই হয়তো গানের নেশায় মজেছিলেন শৈশবে – সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল মাত্র এগারো-বারো বছর বয়সে। এই সীমিত আয়ুরেখার ভেতরেই তাই একটি অসমাপ্ত জীবন যেন একধরনের পূর্ণতা পেয়েছিল। সুরের ভুবনে যে অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল দুই দশকেরও কম সময়ে, তাতে আশ্চর্য হতে হয়। এই বিস্ময়-জাগানো সুরসাধকের নাম সুধীরলাল চক্রবর্তী।

 

দুই

আধুনিক বাংলা গান বলতে যা বোঝায়, তার জন্ম মোটামুটি তিরিশের দশকে। এই আধুনিক গান আত্মপ্রকাশ করে মূলত গ্রামোফোন ও বেতারের কল্যাণে এবং তা আরো বিসত্মৃত হয় চলচ্চিত্র ও নানা অনুষ্ঠানের মঞ্চ-পরিবেশনায়। ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন রসের’ এই গান ‘প্রধানত কাব্যধর্মী’ এবং এর ‘সুর রাগাশ্রয়ী’। তার আগে প্রায় শুরু থেকেই বাংলা গানের ক্ষেত্রে গ্রামোফোনে ছিল মূলত ভক্তিগীতির প্রায় একক প্রভাব। পরে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত, কিছু পরে অতুলপ্রসাদ এবং আরো পরে নজরুলের গান গ্রামোফোনে-বেতারে-মঞ্চে-আসরে-বাসরে পরিবেশিত হতে থাকে। বাংলা গানের এই পরম্পরায় আধুনিক গানের আবির্ভাব ঘটেছে। এর  পেছনে নজরুলের একটা সরাসরি প্রভাব ও প্রেরণার কথা কবুল না করে উপায় নেই। গানের বাণী-সুর ও গায়নশৈলীতে একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এলো। গীতিকার, সুরস্রষ্টা ও গায়ক যাঁরা এলেন – পঞ্চকবির পরে তাঁরা নতুন এক গানের যুগ সৃষ্টি করলেন – বাংলা গানের ক্ষেত্রে তার ফল হলো দূরপ্রসারী ও স্থায়ী এবং বিকশিত হলো গানের এই ধারা। নজরুলের সমসময়ে গান রচনায় এগিয়ে আসেন যাঁরা, কেউ তাঁর বন্ধু, কেউ সংগীত-সতীর্থ, কেউবা স্নেহভাজন অনুজপ্রতিম – তুলসী লাহিড়ী, হীরেন বসু, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, প্রণব রায়, শৈলেন রায় প্রমুখ এবং আরো কিছু পরে পবিত্র মিত্র ও মোহিনী চৌধুরী এবং এইসব গান গাওয়ার জন্যে কিছু শিল্পীও তৈরি হয়। সুর-যোজনায় নিমগ্ন হন পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মন, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, দুর্গা সেন, শৈলেশ
দত্তগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সুবল দাশগুপ্ত এবং আরো কেউ কেউ। নতুন চেতনা-মেজাজ-রুচিতে সিক্ত হয়ে যে আধুনিক বাংলা গানের জন্ম হলো – তার রূপায়ণে বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য-আবেদন-লোকপ্রিয়তার নিরিখে যেসব শিল্পীর নাম করতে হয় তাঁদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কানন দেবী-কমলা ঝরিয়া-যূথিকা রায়-জগন্ময় মিত্র-সুধীরলাল চক্রবর্তী-রবীন মজুমদার-সত্য চৌধুরী-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

 

তিন

দেশভাগের ফলে ফরিদপুর অঞ্চল বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ– পড়ে। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ – এই চারটি মহকুমা নিয়ে ফরিদপুর জেলা গঠিত হয়েছিল। পরে দেশের সব মহকুমা জেলায় পরিণত হলে ফরিদপুর চারটি জেলায় বিভক্ত হয়। টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর ও গোপালগঞ্জ সদর – এই পাঁচটি থানার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে গোপালগঞ্জ জেলা। এর মধ্যে কোটালীপাড়া সবচেয়ে প্রাচীন অঞ্চল – ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ শাসনের আগে পরগণা হিসেবে চিহ্নিত ছিল এই অঞ্চল – পরে কালক্রমে প্রশাসনিক ‘থানা’য় রূপান্তরিত হয়, বর্তমানে ‘উপজেলা’ হিসেবে পরিচিত। এই কোটালীপাড়ার বালিয়াভাঙা গ্রামে ১৯২০ সালে সংগীতশিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তীর জন্ম। বালিয়াভাঙার চক্রবর্তী-পরিবার ধনে-মানে-শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে সুখ্যাত ছিল। পিতা গঙ্গাধর চক্রবর্তী ফরিদপুর কালেক্টরেট অফিসে চাকরি করতেন। বাড়িতে ও কোটালীপাড়ায় গান-বাজনার আবহ ছিল। এই
সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ সুধীরলাল ছেলেবেলা থেকেই গান-বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হলেও লেখাপড়ায় মন ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব বেশিদূর এগোয়নি। বালিয়াভাঙার খুব কাছের গ্রাম ছিল উনশিয়া – এই গ্রামেই ছিল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষের নিবাস। বালিয়াভাঙার চক্রবর্তী ও উনশিয়ার ভট্টাচার্য-পরিবারের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক, সুধীরলাল যখন কলকাতায়, তখনো অক্ষুণ্ণ ছিল। কবি সুকামেত্মর অনুজ, পরে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক – ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসচর্চার অন্যতম পুরোধা-গবেষক-লেখক-সারস্বত- চারুকলাপত্রিকার সম্পাদক, অশোক ভট্টাচার্য মাঝেমধ্যেই সুধীরলালের কাছে আসতেন।

যাই হোক, সংগীতমনস্ক সুধীরলালের নাবালক অবস্থায়
গুরু-ধরে গান-শেখার যোগাযোগটা কীভাবে হলো সে-বিষয়ে নানা মত নানা কথা আছে – অনেকটা অনুমান-আন্দাজে কেউ কেউ এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। কারো কারো ধারণা, বহরমপুরের কোনো এক জমিদারবাড়িতে প্রখ্যাত সংগীতগুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী বালক সুধীরলালের গান শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হন। তিনিই নাকি সুধীরলালকে কলকাতায় আসতে বলেন। বহরমপুরের জায়গায় উত্তরপাড়ার কথাও শোনা যায়। আবার এ-জনশ্রম্নতিও আছে যে, গিরিজাশঙ্কর কোটালীপাড়ার জমিদারবাড়িতে এক জলসায় আমন্ত্রিত হয়ে যান, সেখানে সুধীরলালের গান শুনে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং তাঁকে কলকাতায় গিয়ে দেখা করতে বলেন।

গিরিজাশঙ্করের কথায় উৎসাহিত হয়ে সুধীরলাল কলকাতা আসেন – ওঠেন উত্তর কলকাতার গড়পারে মামার বাড়িতে – তখন তাঁর বয়স দশ-এগারোর বেশি হবে না। মামার সঙ্গে একদিন গিরিজাশঙ্করের ৭৮/১ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে পৌঁছে যান। গিরিজাশঙ্কর বেশ ভালোভাবে বালককে বাজিয়ে নেন। সুধীরলাল সেই পরীক্ষায় উতরে যান। কিন্তু গ্রামের অতটুকু ছেলে গড়পার থেকে হ্যারিসন রোডে কী করে রোজ আসা-যাওয়া করবে! শিক্ষা বা রেওয়াজের সুবিধার জন্যে কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন। সেজন্যে গুরু গিরিজাশঙ্কর সিদ্ধান্ত নিলেন সুধীরলাল তাঁর হ্যারিসন রোডের বাড়িতেই থাকবেন। সেখানে আরো দু-একজন শিক্ষার্থী আগে থেকেই ছিলেন। এইভাবে সুধীরলালের সংগীতজীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হলো।

 

চার

সুধীরলাল চক্রবর্তীর সংগীতপ্রতিভা ছিল সহজাত। গুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছ থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের যে-শিক্ষা গ্রহণ করেন তা ছিল তাঁর সংগীতজীবনের পরম পাথেয়। গিরিজাশঙ্কর নিজে ভারতবিখ্যাত ওস্তাদ ও প–তদের কাছে ধ্রম্নপদ-ধামার-ঠুমরি-খেয়ালের তালিম নিয়েছিলেন – তাঁদের মধ্যে নাম করতে হয় বদল খাঁ, মুজঃফর খাঁ, মৈজুদ্দীন খাঁ, মহম্মদ আলী খাঁ, বড়ে মুন্নে খাঁ, নবাব ছম্মন সাহেব, ইনায়েত হোসেন খাঁ, ভাইয়াসাহেব গণপতরাও, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর। অর্জিত সংগীতজ্ঞান তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যোগ্যতা অনুসারে কমবেশি তাঁরা তা গ্রহণও করেছিলেন। তাঁর বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান শিষ্যদের নামের তালিকা একেবারে ছোট নয়, যেমন – জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তারাপদ চক্রবর্তী, এ.টি. কানন, যামিনীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সুখেন্দু গোস্বামী, চিন্ময় লাহিড়ী, সুনীল বসু, রথীন চট্টোপাধ্যায়, বীরেশ রায়, দেবীপ্রসাদ ঘোষ, নুটু মুখোপাধ্যায়, বনবিহারী মল্লিক, বিশে^শ^র ঘোষ, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দাস, নিলীনা সেন (নয়না দেবী), ইভা গুহ, রেণুকা মোদক, শান্তিলতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি দাস, নিখিলচন্দ্র সেন এবং অবশ্যই সুধীরলাল চক্রবর্তী। এঁদের মধ্যে উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্ষেত্রে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তারাপদ চক্রবর্তী, এ.টি. কানন ও চিন্ময় লাহিড়ী সবচেয়ে বেশি নাম ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। অন্য শিষ্যদের কারো কারোর কৃতির টুকরো খবর মেলে নানা পত্র-পত্রিকায়। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ১৯৪১ চারদিন ধরে এলাহাবাদে ‘প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত-সঙ্গীত সম্মিলন’। মাসিক সঙ্গীত-বিজ্ঞান প্রবেশিকা পত্রিকায় এই সম্মিলনের যে-খবর প্রকাশিত হয় তা থেকে জানা যায় : ‘কলিকাতা হইতে সঙ্গীতবিশারদ শ্রীযুক্ত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর সুযোগ্য ছাত্র শ্রীযুক্ত শৈলেন্দ্রনাথ  বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমান সুধীরলাল চক্রবর্তী, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রলাল রায় (ভাতখ– কলেজ, কলিকাতা), কুমারী রেণুকা সাহা, ঝর্ণা সাহা, প্রোঃ আলী আহম্মদ খাঁ, প্রোঃ মুনেশ্বর দয়াল, কুমারী মঞ্জুলিকা ভাদুড়ী, কুমারী কবিতা মিত্র প্রভৃতি যোগদান করিয়াছিলেন। শৈলেনবাবুর ‘জৌনপুরী’র খেয়াল, ‘ভৈরবী’র ঠুংরী ও ‘শঙ্করা’র খেয়াল অত্যন্ত সুমধুর হয়। শ্রীমান সুধীরলাল চক্রবর্তীর বসন্ত রাগের খেয়াল গানটিও বিশেষ উলেস্নখযোগ্য।’ (১৭ বর্ষ ৮ সংখ্যা/ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭; পৃ ৩৮৪)

এরও প্রায় বছর ছয়েক আগে একবার শিশিরকুমার ইন্সটিটিউটের সাহায্যার্থে রঙমহল রঙ্গমঞ্চে এক বিরাট জলসার আয়োজন হয়েছিল। ‘সঙ্গীত সম্মিলনী’র অধ্যক্ষ সংগীতগুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর ছাত্রছাত্রীরা ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে সুধীরলাল চক্রবর্তী গান গেয়ে রৌপ্যপদক পেয়েছিলেন (সঙ্গীত-বিজ্ঞান প্রবেশিকা, ১১ বর্ষ ৪ সংখ্যা/ শ্রাবণ ১৩৪১)। ওই সময়ে সুধীরলালের বয়স ছিল মোটে চোদ্দো – এর মাত্র দু-তিন বছর আগে গান শিখতে শুরু করেন।

প্রিয় শিষ্য সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রতি গুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর স্নেহ ও মনোযোগ ছিল আলাদা রকমের। তখন সবে সুধীরলাল গ্রাম থেকে কলকাতা এসে গিরিজাশঙ্করের হাওলায় গান-শেখা শুরু করেছেন, একদিন তিনি সুধীরলালকে দেখিয়ে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ শিষ্য নিখিলচন্দ্র সেনকে বললেন : ‘নিখিল, নূতন কলিকাতায় এসেছে। তুমি ওর হাত ধরে ধরে সব জায়গা দেখাবে। ছেলেটির গলা বড় মিষ্টি।’ (শোকোচ্ছ্বাস : নিখিলচন্দ্র সেন স্মরণিকা, কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর ১৯৮২। ‘স্মরণে নিখিলচন্দ্র সেন’, বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। নিখিল সেন অক্ষরে অক্ষরে গুরুর নির্দেশ পালন করেছিলেন।

গুরুগৃহে খুব নিষ্ঠা ও মনোযোগের সঙ্গে সুধীরলাল সংগীতশিক্ষায় নিজেকে সমর্পিত করেন। গুরুও তাঁকে উজাড় করে তাঁর সংগীতবিদ্যা দান করেন। অল্প সময়েই সুধীরলাল  আয়ত্ত করেন উচ্চাঙ্গসংগীতের নানা অঙ্গের কলাকৌশল। এ-বিষয়ে তিনি কতটা পারঙ্গম হয়ে ওঠেন সে-বিষয়ে জানা যায় : ‘দেশ পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষও মাঝে মাঝে গিরিজাবাবুর গান শুনতে তাঁর বাড়িতে আসতেন। একটা ঘটনা এখানে উলেস্নখযোগ্য। সাগরময়বাবু গিরিজাবাবুর বাড়িতে এসে তাঁর গান শুনতে চাইলেন। গিরিজাবাবু তাঁকে জানালেন যে তাঁর শরীর সুস্থ যাচ্ছে না, তিনি গাইতে পারছেন না। তখন তিনি এক প্রতিভাবান শিষ্যকে ডেকে আনালেন। খাঁকি রঙয়ের হাফপ্যান্ট পরা এই প্রতিভাবান শিষ্যর নাম সুধীরলাল চক্রবর্তী। সুধীরলাল সাগরময়বাবুকে খেয়াল ও ঠুংরি গান গেয়ে শোনালেন।’ (শারদীয় দেশ, ১৪০৩। ‘বাঙালির গিরিজাশঙ্কর’ : সুপ্রিয় বাগচী; পৃ ৬১০)। শিষ্য সুধীরলালের প্রতি গুরু গিরিজাশঙ্করের আস্থা ও স্নেহ কতখানি ছিল এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়।

সুধীরলাল গুরুগৃহে কতদিন ছিলেন, কত সময় ধরে গুরুর কাছে গান শিখেছিলেন, সে-সবের খাঁটি খবর পাওয়া ভারি মুশকিল। সুধীরলাল গুরু গিরিজাশঙ্করের কাছে খেয়াল-ঠুমরি-ভজনের তালিম নেন। গুরুর কল্যাণে সুধীরলাল অল্প বয়সেই বেতার, জলসা, ঘরোয়া আসর ও মিউজিক কনফারেন্সে গান গেয়ে নাম করেন। খুব অন্তরঙ্গ অবলোকন থেকে গুরু-শিষ্য সংবাদের খানিকটা জানার সুযোগ মেলে গিরিজাশঙ্করের দৌহিত্র সুপ্রিয় বাগচীর জবানিতে :

‘সুধীরলাল চক্রবর্তী খুব ছেলেবেলা থেকেই গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে খেয়াল, ঠুংরি, ভজন গান শিক্ষা করেছিলেন। গিরিজাশঙ্কর তাঁকে খুব স্নেহ করতেন ও বহু আসরে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সুধীরলালের কণ্ঠটি ছিল অত্যন্ত সুরেলা। খুব শীঘ্র গান তুলতে তাঁর জুড়ি [মেলা] ছিল ভার। এলাহাবাদ মিউজিক কমপিটিশন ও অল বেঙ্গল মিউজিক কমপিটিশনে সুধীরলাল অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর গান শুনে গিরিজাশঙ্কর অত্যন্ত খুশী হন।

‘এখানে একটা ঘটনার উলেস্নখ না করে পারছি না। একবার রেডিওতে সকালবেলায় সুধীরলালের গান ছিল। সকাল ৮-৩০ মিনিটের প্রোগ্রাম। সুধীরলাল তখন গিরিজাবাবুর বাসায়
থাকতেন। সকাল ৭-৩০ মিনিট পর্যন্ত সুধীরলালের দেখা নেই। গিরিজাবাবু অস্থির হলেন। খানিকক্ষণ পরে সুধীরলাল উপস্থিত হলে গিরিজাবাবু প্রথমে তাঁকে একটু তিরস্কার করলেন। তখনকার দিনে রেডিওর প্রোগ্রাম live হত। আগে থেকে টেপ করা হত না। যা হোক, গিরিজাবাবু সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়মটা টেনে নিয়ে বিলাসখানি টোড়ির ওপর বিখ্যাত গান ‘এ ছত্র নেহে যে মাই’ গানটি সুধীরলালের কণ্ঠে তৈরি করে দিলেন। গান প্রস্ত্তত হয়ে গেলে সুধীরলাল গার্সটিন পেস্নসে রেডিও অফিসে চলে গেলেন। গান যথারীতি ৮-৩০টার সময় অনুষ্ঠিত হল। গিরিজাবাবু বাড়িতে বসে রেডিওতে সুধীরলালের গান শুনে খুবই খুশি হয়েছিলেন। গানের চলন ও তান এত সুন্দর হয়েছিল যে যাঁরা রেডিওতে সুধীরলালের ঐ গান শুনেছেন, তাঁরাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।’

(শারদীয় দেশ, ১৪০৩; পৃ ৬১২)।

কোমলে-কঠোরে মেশানো মানুষ ছিলেন গিরিজাশঙ্কর। প্রচ- মেজাজি, আবার পাশাপাশি অতিশয় স্নেহকাতর। মানুষ হিসেবে গিরিজাশঙ্কর কেমন ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁর এক শিষ্য বলেছিলেন : ‘তাঁর দুর্বাসা মুনির মতো রাগ ছিল, কিন্তু অন্তরটা ছিল অত্যন্ত কোমল ও নরম। তিনি যথার্থই সঙ্গীতপাগল ছিলেন।’ (শারদীয় দেশ, ১৪০৩; পৃ ৬১২)। সংগীতের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, নিয়মনিষ্ঠ, আন্তরিক ও কর্তব্যসচেতন। গিরিজাশঙ্করের যে-কজন শিষ্য তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন এবং যাঁদের সম্পর্কে উচ্চাশা ছিল, সুধীরলাল ছিলেন তাঁদের অন্যতম। দূর-গ্রাম থেকে আসা এই সংগীতমনস্ক মেধাবী বালককে তিনি নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সংগীতগুরু, অভিভাবক ও সেইসঙ্গে মরমি দিশারি। গিরিজাশঙ্কর সমন্তানের মতোই ভালোবাসতেন সুধীরলালকে। দীর্ঘদিন বাসের ফলে সুধীরলাল এই পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন।

উচ্চাঙ্গসংগীত ছিল গিরিজাশঙ্করের ধ্যান-জ্ঞান-অস্তিত্ব – তার রূপ-রস শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মনোযোগী সুধীরলাল খুব অল্প সময়েই  গুরুর দান যোগ্যতার সঙ্গে ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। গুরুর হাত ধরে নানা আসরে-বাসরে, মজলিশ-মাহফিলে যাওয়ার সুযোগ মিলেছিল। গুরুর কল্যাণে ও নিজের মেধায় বেতারের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। কলকাতা ছাড়িয়ে ভারতের সংগীতকেন্দ্রগুলোতেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। গুরু আশান্বিত হন, বাংলা মুলুকে উপেক্ষিত মার্গসংগীত এক তরুণ বাঙালি সংগীতগুণীর মাধ্যমে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সম্মানের এক বড়ো আসন পাবে। কিন্তু তরুণ শিষ্য প্রাজ্ঞ গুরুর আকাঙক্ষা পূরণে একনিষ্ঠ হতে পারেননি। এর বাইরে সংগীতজগতের যে রঙিন হাতছানি ছিল, তা তিনি নানা কারণে উপেক্ষা করতে পারলেন না। জীবিকার প্রয়োজনে, নামের মোহের কারণে, প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর তৎপরতার ফলে ধীরে ধীরে গুরুর স্নেহের বন্ধন শিথিল হতে থাকে – বিচ্ছেদ আসন্ন হয়ে ওঠে। এই মর্মান্তিক আঘাতের ফলে গুরু-শিষ্য দুজনেরই অন্তরের অবিরল রক্তক্ষরণের কথা কেউ বলে যাননি। এ-বিষয়ে সামান্য আভাস পাওয়া যায় বর্তমানে সুধীরলালের একমাত্র জীবিত ছাত্র দেবব্রত দাশের (৮৪) সাক্ষ্যে। ২০১৮ সালের ২ মে ও ১৫ জুলাই তারিখে দেবব্রত দাশের কলকাতার বাসায় সুধীরলাল চক্রবর্তী সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হয়। তিনি দুই কিস্তিতে তাঁর গুরু সম্পর্কে সংক্ষেপে তাঁর স্মৃতিচারণাও আমাকে লিখে দেন। তাঁর আলাপচারিতা ও স্মৃতিচর্চা থেকে জানা যায়, গিরিজাশঙ্করের শরীর যখন নানা রোগে একেবারে বিপর্যস্ত, বহুকাল আগেই স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি মজলিশ-মাহফিলে সংগীত পরিবেশন ছেড়ে দেন, শুধু বাড়িতে শিষ্যদের গান-শেখানোর বিষয়টা টিকে ছিল, কিন্তু শেষদিকে তাও আর সম্ভব হচ্ছিল না। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও ভেঙে পড়েছিল। সুধীরলাল ততদিনে  উচ্চাঙ্গসংগীতের বলয় থেকে সরে গিয়ে আধুনিক গানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে তাঁর পরিচিতি ও নামও বেশ ছড়াচ্ছিল। কিন্তু শুদ্ধসংগীতের ভাণ্ডারি ও কাণ্ডারি গিরিজাশঙ্কর শিষ্যের এই বিচ্যুতিতে আহত হয়েছিলেন। সুধীরলালেরও স্বাধীন আবাসের প্রয়োজন দেখা দিলো। গুরু গিরিজাপ্রসন্ন তাঁর আর-এক প্রিয় শিষ্য নিখিলচন্দ্র সেনকে আবারো সুধীরলালের দায়িত্ব দিলেন। নিখিল সেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জীবিত ও প্রয়াত সুধীরলালের প্রতি গুরু-নির্দেশিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। নিখিলচন্দ্র কালীঘাট অঞ্চলের ৫৪ সদানন্দ রোডের নিবারণচন্দ্র গুহের বাড়ির একটি ঘরে সুধীরলালের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। গুরুর স্নেহাশ্রয় থেকে দূরে সরে এলেও সুধীরলাল
তাঁকে কখনো বিস্মৃত হননি – খ্যাতির কালেও এর মূলে গুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর দান-অবদানের কথা সবিনয়ে কবুল করতে কখনো দ্বিধা করেননি। ১৯৪৮-এ গুরু গিরিজাশঙ্কর ইহলোক
ত্যাগ করেন, – মাত্র চার বছর পর শিষ্য সুধীরলালও পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।

 

পাঁচ

গুরুগৃহ থেকে বেরিয়ে এসে সুধীরলালের সংগীতজীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। প্রথম পর্ব ছিল শুধু শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুশীলনের পর্ব। এবারে একসঙ্গে অনেক পর্যায়ের কাজ শুরু হলো : ১. গানের শিক্ষকতা, ২. আধুনিক গান ও উর্দু-হিন্দি গজল-গীতের চর্চা, ৩. বেতার ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ৪. গ্রামোফোন রেকর্ডে
শিল্পী-সুরকার ও প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন, ৫. নানা আসর-বাসর-জলসায় অংশগ্রহণ।

কালীঘাটের সদানন্দ রোডে সুধীরলালের নতুন আবাসে গৃহকর্তার কন্যা নীলিমা গুহ হাসিকে (বিয়ের পর নীলিমা ঘোষ নামে পরিচিত) গান শেখাতে শুরু করেন। সুধীরলাল এখানে বেশ কিছুকাল ছিলেন। ধীরে ধীরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে জায়গার অভাব দেখা দেয়। তখন নিখিলচন্দ্র সেন ৩ জনক রোডে, বর্তমান লেক মলের ঠিক পিছনের একটি বাড়ির নিচের তলার একটি প্রশস্ত ঘর ভাড়া করে সেখানে সুধীরলালকে নিয়ে যান। সারাদিন চলতো ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা – পাশাপাশি সংগীতজগতের অনেক গুণী মানুষকেও দেখা যেত সুধীরলালের ঘরে – আসতেন দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, কালীপদ সেন, প্রকাশকালী ঘোষাল, সত্যজিৎ মজুমদার, কালোবরণ দাস, দেবেশ বাগচী, সমেন্তাষ মুখোপাধ্যায়, নীহারবিন্দু সেন (গীতবিতানের অধ্যক্ষ), মহম্মদ জাকির হোসেন, মহম্মদ কাদের হোসেন, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, পবিত্র মিত্র, মোহিনী চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও উঠতি গায়ক-গায়িকার দল। ওই বাড়ির অপরদিকে ছিল শিল্পীদের কাছে সুপরিচিত রাধুর চায়ের দোকান, সেখানে সারা দিনরাত আড্ডা চলতো শিল্পী-গীতিকার-সুরকার-সমঝদার সংগীতজগতের নানা গুণী মানুষের। সুধীরলালকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক জমজমাট সাংগীতিক আবহ।

সুধীরলালের কাছে যাঁরা গান শিখেছিলেন সেই তালিকা কম দীর্ঘ নয়। নানা সূত্রে শিক্ষার্থী হিসেবে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন : উৎপলা ঘোষ (পরে সেন), শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অপরেশ লাহিড়ী, গায়ত্রী বসু, বাণী ঘোষাল, নীতা সেন (বর্ধন), শচীন গুপ্ত, সোহরাব হোসেন, মাধবী ব্রহ্ম, বিনয় অধিকারী, বীরেশ্বর ভট্টাচার্য, অনন্তদেব মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, অশোক মজুমদার, প্রণব দাশগুপ্ত, দেবব্রত দাশ প্রমুখ। এখানে বর্ণিত কিছু নামের উলেস্নখ করে বিমান মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন : ‘… কত নাম বলব! এঁরা সবাই কোন না কোন সময় সুধীরলালের কাছে অল্পবিস্তর তালিম নিয়েছেন, শিখেছেন। এক একটা গান তো এঁদের একেকজনকে চিরকেলে শিল্পীর প্রতিষ্ঠা দিয়েছে …।’

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, সিতাংশুশেখর ঘোষ। তৃ-স : কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৫, পৃ ২১০)

ঢাকার সম্পন্ন-সম্ভ্রান্ত রায়বাহাদুর পরিবারের মেয়ে উৎপলা ঘোষ (পরে সেন) ঢাকা বেতারকেন্দ্র চালু হওয়ার পরের বছরেই (১৯৪০) মাত্র ষোলো বছর বয়সে ঢাকা বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। উৎপলার সঙ্গে সুধীরলালের প্রথম দেখা এই ঢাকা বেতারেই। তাঁর মধ্যে সংগীতপ্রতিভার পরিচয় পেয়ে সুধীরলাল তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। নিজের হাতে গড়ে তোলেন উৎপলাকে – তাঁর সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার ভিতও গড়ে দেন পরম যত্নে। উৎপলার প্রতি তাঁর কিছু দুর্বলতার কথা কেউ কেউ উলেস্নখ করলেও এ-বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সুধীরলালের ছাত্র দেবব্রত দাশ। যাই হোক, সুধীরলালের সুপারিশে ছাত্রী উৎপলা সেনের গানের একটি রেকর্ড বের হয় ১৯৪৪ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে। যে-কোনো কারণেই হোক, এর আগের বছরে প্রকাশিত উৎপলার প্রথম রেকর্ড তেমন চলেনি। সুধীরলালের সুর-যোজনায় প্রণব রায়ের লেখা ‘একহাতে মোর পূজার থালা’ ও  অনিল ভট্টাচার্যের  কথায় ‘বনফুল জাগে পথের ধারে’ এই দুটি গান নিয়ে রেকর্ড বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই তা শুধু জনপ্রিয়ই হলো না, সূচনাপর্বেই উৎপলা সেন জাতশিল্পীর স্বীকৃতিও পেয়ে গেলেন। বিশেষ করে কথা-সুর-গায়কীর গুণে ‘একহাতে
মোর পূজার থালা’ ঘরে ঘরে বাজতে লাগলো। এর পর থেকে ১৯৫০-এর আগ-পর্যন্ত হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে সুধীরলালের সুরে উৎপলার কণ্ঠের এই রেকর্ডগুলোর হদিস মেলে :

‘ওগো ফুলের বনে’ ও ‘ভুলেছি তোমারে প্রিয়’ : দুটি গানই লিখেছিলেন অনিল ভট্টাচার্য : এইচ ১১৪৩, মে ১৯৪৫।

‘চলে যাওয়া নয়’ ও ‘যদি ভুল ভেঙে যায়’ : গান দুটির গীতিকার প্রণব রায় : এইচ ১১৬২, সেপ্টেম্বর ১৯৪৫।

‘তুমি আমারে চেয়েছ বলে প্রিয়’ ও ‘প্রিয় তোমার আমার মিলন শুধু একজনমের নয়’ : দুটি গানেরই রচয়িতা প্রণব রায় : এইচ ১২০২,  মে ১৯৪৬।

‘মোর কাননে বসন্ত এলো’ : গীতিকার – গোরা মুখোপাধ্যায় ও ‘প্রথম মিলনে তোমার’ : গীতিকার – দীপা মুখোপাধ্যায় : এইচ ১২৮১, অক্টোবর ১৯৪৭।

সুধীরলালের সুরে ও পবিত্র মিত্রের কথায় উৎপলা সেনের – ‘জীবনের পথে শুধু কেন ফুল ঝরানো’ ও ‘তুমি কেন বাঁশীর সুরে দূর হতে কাছে ডাকো’ – এই গান দুটির রেকর্ড (এইচ১৪৭৬) বের হয় হিন্দুস্থান থেকে ১৯৫০-এর পূজার রেকর্ড হিসেবে। সুধীরলালের সুরে উৎপলা রেকর্ডে অনেক গানই গেয়েছিলেন – মনে পড়বে প্রণব রায়ের কথায় ‘যদি ভুল ভেঙে যায়’, ‘তুমি আমারে চেয়েছ বলে’, অনিল ভট্টাচার্যের কথায় ‘নয়নে ঘনালো’ এইসব গানের কথা। মৃত্যুর কিছু আগে পবিত্র মিত্রের কথায় ও সুধীরলালের সুরে গুরু-শিষ্যার দ্বৈতকণ্ঠে দুটি গান ধারণ করা হয়, সেই রেকর্ড (এইচ ১৫৩০) বের হলো সুধীরলালের মৃত্যুর পর ১৯৫২-এর সেপ্টেম্বরে ওই হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকেই – ‘কেন গো ঝরা ফুলে’ ও ‘যদি নভে ওঠে চাঁদ’। এই যুগল-গানও সমাদর পেল সংগীতরসিক শ্রোতাদের কাছে। আর সুধীরলালের মৃত্যুর চার মাস পরে আগস্ট ১৯৫২-তে তাঁর সুরারোপিত পবিত্র মিত্রের লেখা দুটি গানের রেকর্ড (এন ৮২৫২০) বের হয় উৎপলা সেনের কণ্ঠে। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত গান দুটির বাণীতে যেন সুধীরলালের অকালে চলে যাওয়ার বিচ্ছেদ-বিরহ-বেদনার সুর ছড়িয়ে আছে। প্রথম গানটির শুরু এইরকম :

কেন জাগে শুকতারা আজো ঐ দূর নভে।

নয়ন প্রদীপ ব্যথার বায়ে নিভে যায় ওগো যবে \

এই গানের শেষ অন্তরায় শূন্যতার হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে :

আমার মনের আকাশে আজি

ব্যথার বাঁশরী ওঠে গো বাজি

শুধু কি আমার ভুবন ভরি’

বেদনা জড়ায়ে রবে গো \

দ্বিতীয় গানটিও ওই একই সুরে বাঁধা :

এলো কি শাঙন, এলো কি আমার মনে

ওগো কাঁদি যে শুধু গোপনে।

মন চলে গো অভিসারে

সেতো নাহি – চাহি যারে

সে কি ছিল গো স্বপনে মোর

মুছে গেল জাগরণে।

– এই জোড়া-গান যেন সুধীরলালের অকাল প্রয়াণে তাঁর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত। গান দুটি সম্পর্কে এইচএমভির ক্যাটালগে (আগস্ট ১৯৫২) উলেস্নখ করা হয়েছিল : ‘স্বর্গীয় শিল্পী ও সুরকার সুধীরলালের সুরের রঙে রঞ্জিত, শিল্পী উৎপলা সেনের কণ্ঠ-আলিম্পনে চিত্রিত বিরহী মনের দরদ গাথা।’ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ১৯৫২ সালের আগস্টে প্রকাশিত মাসিক রেকর্ড-তালিকার প্রচ্ছদ সাজানো হয়েছিল প্রয়াত সুধীরলাল চক্রবর্তী ও উৎপলা সেন এই দুই গুরু-শিষ্যার ছবি দিয়ে।

শ্যামল মিত্র ছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। গুরু তাঁকে সযত্নে-সস্নেহে তৈরি করেছিলেন। শ্যামল মিত্রের প্রতিষ্ঠার পেছনে সুধীরলালের প্রয়াস ও অবদানের কথা বারবার স্মরণ করতে হয়। সুধীরলালের সুরে ১৯৫১-এর জুনে তাঁর গানের রেকর্ড (‘শোন শোন ওগো কাছে এসো’ এবং ‘বন্ধু গো জানি এসেছিলে পথ ভুলে’ : এন ৩১৩৪৩) বের হয় এইচএমভি থেকে। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে রেকর্ডের জন্যে সুধীরলাল তাঁর বন্ধু পবিত্র মিত্রের লেখা ‘স্মৃতি তুমি বেদনার/ আজিও কাঁদিছে হারানো স্বপন/ হৃদয়ের বেদিকায়’ ও ‘আশা বাঁধে ঘর’ এই গান দুটিতে সুর দিয়ে তাঁকে শিখিয়ে দেন। কিন্তু সে-রেকর্ড (এন ৮২৫৩৩) প্রকাশিত হয় সুধীরলালের মৃত্যুর পর সে-বছরের শারদ-অর্ঘ্য হিসেবে। শোকাচ্ছন্ন শ্যামল মিত্র অত্যন্ত দরদ গিয়ে গান দুটি, বিশেষ করে ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’, গেয়েছিলেন – এ যেন ছিল প্রয়াত গুরুর প্রতি তাঁর অন্তরের গভীর প্রদেশের একান্ত শ্রদ্ধা-নিবেদন। মর্মস্পর্শী আবেদনের এই গানটিই শ্যামলকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। এর দীর্ঘ সতেরো বছর পর ১৯৬৯ সালে শ্যামল মিত্র আবার রেকর্ড করলেন দুখানা গান (‘তুমি শুধু বলে যাও’ : পবিত্র মিত্র ও ‘তোমার জীবনে চাই না কাঁটা হতে’ : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) গুরু সুধীরলালের বহু আগে করা সুরে –
সে-রেকর্ড (এন ৮৩৩০৭) বের হলো এইচএমভি থেকে। পরে সুরকার হিসেবেও শ্যামল জনপ্রিয় হয়েছিলেন, সেখানেও গুরু সুধীরলালের প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

ছাত্রী গায়ত্রী বসু রেকর্ড করবেন বলে সুধীরলাল ‘কেন এলে মধুরাতে গো’ ও ‘জীবনসায়রে নিরাশার ঢেউ’ এই গান দুটির সুর করেন; কিন্তু সে-রেকর্ড (জিই ২৪৬৬৩) বের হয়  ১৯৫৩-এর মার্চ মাসে – তার প্রায় এক বছর আগে সুধীরলাল চলে যান। গায়ত্রী বসুর তৃতীয় রেকর্ড (জিই ৭৫৩৭) – ‘মোর মনবনে দোলা লাগে’
ও ‘কেন মিছে ফিরে চাও’ – সুধীরলালের সুরেই প্রকাশ পায় ১৯৪৯-এর জুলাই মাসে। সুধীরলালের মৃত্যুর পর তাঁরই অন্যতম প্রধান শিষ্য শ্যামল মিত্রের কাছে গায়ত্রী বেশ কিছুকাল গান শিখেছিলেন।

সুধীরলালের সুরেলা কণ্ঠের পরিশ্রমী আর-এক ছাত্রী ছিলেন নীতা বর্ধন  (সেন)। ‘ওগো নয়নে আবির দিও নাকো শ্যামরায়’ – এই গানটিতে সুরারোপ করেন সুধীরলাল। এই গানটি সুধীরলালের কাছ থেকে শিখে গিরিজাশঙ্করের শিষ্য সেকালের এক গুণী উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী উমাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় আসরে-বাসরে গেয়ে খুব নাম করেন। পরে নীতা বর্ধন এই গানটির সঙ্গে ‘বাজে গো বাঁশরী’ যোগ করে রেকর্ড করেন। গান দুটি লিখেছিলেন পবিত্র মিত্র – আর রেকর্ডটি (এসসি ৭৫) বের হয় ভারত রেকর্ড থেকে। নীতা বর্ধনের গাওয়া প্রথম গানটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে সুধীরলালের সুরে নীতা বর্ধন আরো গান রেকর্ড করেন। আরো পরে গুরুর মৃত্যুর পর নীতা বর্ধন সুরকার হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন।

নজরুলের গানে নিমগ্ন হওয়ার আগে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় মূলত আধুনিক গানেরই চর্চা করেছেন এবং তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতির মূলেও রয়েছে এই অঙ্গের গান। তাঁর গানের প্রথম গুরু পিতৃব্য রত্নেশ^র মুখোপাধ্যায়। এরপর নানাজনের কাছে গান শিখেছেন। সুধীরলাল চক্রবর্তী তাঁর শেষ-পর্যায়ের গুরু। তাঁর গানে যে রাগপ্রধানের বৈশিষ্ট্য, তা আয়ত্ত করেছিলেন সুধীরলালের কাছ থেকে। ১৯৪৯-এর জুনে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের করে এইচএমভি। এর বছরখানেক পরে সুধীরলালের সুরে ও পবিত্র মিত্রের কথায় (‘ঘুমায়ো না সহেলি গো’ ও ‘গানের সুরে কাহারে ওগো’) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের যে-রেকর্ড (এন ৩১২১৪ : জুলাই ১৯৫০) বের হয় তা শ্রোতার কাছে সমাদর পেয়েছিল।

অনন্তদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুধীরলালের খুব একনিষ্ঠ সংগীতশিষ্য। প্রথম থেকেই তিনি গান শিখেছেন সুধীরলালের কাছে। তাঁর সংগীতপ্রতিভার পরিচয় পেয়ে সুধীরলাল তাঁর
রেকর্ড-প্রকাশে আগ্রহী হন। পবিত্র মিত্রের লেখা দুটি গানে সুর-যোজনা করে তিনি কলম্বিয়া থেকে অনন্তদেবের রেকর্ড (জিই ৭২৫৪ : জুন ১৯৪৯ : ‘যে দিন রব না আমি’ ও ‘এ তো ভাললাগা’) করান। একবছর পর (জুলাই ১৯৪৯) ওই একই গীতিকারের রচনায় (‘মালাখানি ফিরে দাও গো’ ও ‘তোমারে পড়ে গো মনে’) ও সুধীরলালের সুরে অনন্তদেবের দ্বিতীয় রেকর্ড (জিই ৭৫৩৬) বের করে কলম্বিয়া। সুধীরলালের আর-এক খ্যাতিমান শিষ্য শচীন গুপ্ত গুরুর সুরে ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় দুটি রেকর্ড করেন মেগাফোন থেকে (‘তখনও আকাশে ছিল গো আঁকা’ ও ‘কেন খেলাছলে শুধু স্বর্গ গড়িতে চাওয়া’ : জেএনজি ৫৮৯৬, অক্টোবর ১৯৪৭) এবং কলম্বিয়া থেকে (‘তব নামে জ্বালা দীপ নিভে গেছে’ ও ‘মোর অশ্রম্নসাগর
কিনারে রয়েছে’ : জিই ৭৪২৫, ডিসেম্বর ১৯৪৭)। রেকর্ড দুটির গানগুলো শ্রোতাদের আনুকূল্য পেয়েছিল। সুধীরলালের শিষ্যস্থানীয় অপরেশ লাহিড়ী তাঁর সুরে গান গেয়ে, ‘ভালবাসা যদি অপরাধ হয়’,  নাম করেছিলেন। একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, বেসিক রেকর্ডেই মূলত কাজ করেছেন সুধীরলাল।

ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সুধীরলালের স্নেহ-প্রীতি, মনোযোগ ও কর্তব্যবোধ ছিল অসাধারণ। তাঁদের জন্যে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নানাজনকে অনুরোধ-সুপারিশ করার দায় তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে বহন করতেন।

প্রিয় ছাত্রী উৎপলা ঘোষের (সেন) রেকর্ড বের করার জন্যে সুধীরলাল গিয়ে ধরলেন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার  চ-ীচরণ সাহাকে। সুধীরলাল বললেন, ‘বড় ভাল গায়’ – ‘কণ্ঠটি বড় মিষ্টি’। সুধীরলাল ছিলেন হিন্দুস্থান রেকর্ডেরই বাঁধা শিল্পী – চ-ীচরণ তাঁকে খুব স্নেহও করতেন। একেবারে আনকোরা শিল্পী উৎপলার রেকর্ড বাজারে কেমন চলবে সে-বিষয়ে চ-ীচরণের কিছু সন্দেহ ছিল। কিন্তু সংগীত-জহুরি সুধীরলাল আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। উৎপলা ঘোষের (সেন) রেকর্ড – একপিঠে ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’ ও অন্যপিঠে ‘বনফুল
জাগে পথের ধারে’ গান নিয়ে বের হলো। অসামান্য জনপ্রিয় হলো নতুন শিল্পীর রেকর্ড। এই গান সম্পর্কে বিমান মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন : ‘এখনো লোকে শুনতে চায়, শুনে আশ মেটে না।’

এই উৎপলা সেনকেই সুধীরলাল একদিন নিয়ে গেলেন পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে। দুজনের মধ্যে নিবিড় শ্রদ্ধা-ভক্তি ও  স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সংগীতজগতের একজন জানাচ্ছেন : ‘তাই তিনি অনায়াসে ছাত্রী উৎপলা সেনকে পঙ্কজদার কাছে নিয়ে গিয়ে বলতে পারলেন – মেয়েটি গায় ভাল, গলা ভাল। পঙ্কজদা, যদি ছবিতে উৎপলাকে গাওয়ার সুযোগ করে দেন।’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২১০)। এ-ধরনের দৃষ্টান্ত আরো আছে। তাঁকে কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সাক্ষ্য এইরকম : ‘এই সুধীরলাল অত বড় সুরকার কিন্তু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্যে তাঁর যে কি ভালবাসা, আগ্রহ বা ভাবনা-চিমন্তা, তা এখনকার দিনে ভাবা যায় না।’

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০৯)

 

ছয়

১৯৩৫-৩৬ সাল নাগাদ সুধীরলাল চক্রবর্তী কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি সংগীতগুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর বাড়িতে থেকে তাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিতেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই গিরিজাশঙ্করের হাতে-গড়া এই অসাধারণ কিশোর-শিল্পী গুরুর কল্যাণেই বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। সুধীরলাল বেশ অল্প বয়সেই বেতারে ও নানা জলসায় গান গেয়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সুধীরলালের বেতারে সংগীত-পরিবেশনের ব্যাপারে গুরু গিরিজাশঙ্কর কতখানি তৎপর ও মনোযোগী ছিলেন, সে-বিষয়টি বেতারের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার অনুষঙ্গে আগে উলেস্নখ করা হয়েছে। বেতারে তিনি মূলত খেয়াল ও ঠুমরি পরিবেশন করতেন – শিক্ষানবিশি পর্বের পর সেই পরিবেশনা নিয়মিত হয়। সংগীতগুণী ও সমঝদারেরা মন্তব্য করেছেন : ‘অনেকেই জানে না, সুধীরলাল কতো উঁচু মানের খেয়াল, ঠুংরি গায়ক ছিলেন’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০৮)। পরে বেতারে রাগপ্রধান ও আধুনিক গানও গেয়েছেন। আমৃত্যু কলকাতা বেতারের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল।

১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সূচনা থেকেই সুধীরলাল শিল্পী হিসেবে এর সঙ্গে জড়িত হন। প্রথম পর্যায়ে খেয়াল, ঠুমরি, গজল এবং পরে আধুনিক ও রাগপ্রধান গান পরিবেশন করতেন। ১৯৪০-এ পবিত্র মিত্র ঢাকা বেতারে যোগ দেন অনুষ্ঠান প্রযোজক-নির্দেশক হিসেবে, পাশাপাশি ঘোষক ও অভিনয়শিল্পীর কাজেও যুক্ত ছিলেন। সুধীরলালের সঙ্গে প্রায় সমবয়স্ক পবিত্র মিত্রের অন্তরঙ্গ সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। সংগীতের প্রতি পবিত্র মিত্রের গভীর অনুরাগ ও আকর্ষণ ছিল। সুধীরলাল তাঁকে গান লিখতে অনুপ্রেরণা জোগান। এইভাবে একজন খ্যাতিমান গীতিকারের জন্ম হয়। সুধীরলাল ১৯৪২ সালে ঢাকা বেতারকেন্দ্রে সংগীত প্রযোজক হিসেবে বাঁধা মাইনের চাকরিতে যোগ দেন এবং নাগাড়ে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এখানে  কাজ করেন। অবশ্য এই সময়কালে কলকাতার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিন্ন হয়নি। কলকাতা বেতারের অনুষ্ঠানে যেমন অংশ নিতেন, আবার তেমনি গ্রামোফোন রেকর্ডের কাজও করতেন। কলকাতায় কাজের চাপ বাড়তে থাকে, তাই চাকরি ছেড়ে ঢাকা থেকে ফিরে এসে ওই ১৯৪৫ সালেই কলকাতা বেতারের সংগীত প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য শতব্যস্ততাতেও কলকাতা ও ঢাকা বেতার কেন্দ্রে তাঁর সংগীত-পরিবেশনায় কখনো ছেদ পড়েনি।

 

সাত

সুধীরলাল জীবনের প্রায় অন্তিমপর্বে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত হন। মাত্র দুটি ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করেন : গরবিনী (১৯৫০) ও সুনন্দার বিয়ে (১৯৫১)। কেউ কেউ জাগরণ নামে আর-একটি ছবির কথা উলেস্নখ করেন, কিন্তু ১৯৪৭-এর অক্টোবরে মুক্তিপ্রাপ্ত বিভূতি চক্রবর্তী পরিচালিত এ-ছবিটির সংগীত পরিচালকের নাম পাওয়া যায় না। জাগরণ ছবিতে গান লিখেছিলেন সুধীরলালেরই ঘনিষ্ঠ তিন গীতিকার – প্রণব রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ ও নরেশ্বর ভট্টাচার্য।

জাগরণ না হলে, গরবিনীই সুধীরলালের সংগীত পরিচালনায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত এ-ছবিতে অভিনয় করেছিলেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, বিকাশ রায়, রেণুকা রায়, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, কেতকী দত্ত প্রমুখ শিল্পী। গরবিনীর গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ও প্রণব রায়। এই ছবিতে প্রণব রায়ের কথায় গায়ত্রী বসু দুটি গান গেয়েছিলেন – ‘যদি নতুন করে দেখো’ ও ‘যদি না আসে ফাগুন’ (জিই ৭৮৪২, ১৯৫০)।

সুধীরলালের সংগীত পরিচালনায় শেষ ছবি সুনন্দার বিয়ে মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পাঁচ মাস আগে, ১৯৫১-এর ২০ নভেম্বর। সুধীর সরকার-পরিচালিত এই ছবির বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী ছিলেন ছবি বিশ্বাস, বিকাশ রায়, তুলসী চক্রবর্তী, রাজলক্ষ্মী দেবী, ছায়া দেবী, অনুভা গুপ্ত। এই ছবিতে গান লিখেছিলেন সুধীর সরকার ও পবিত্র মিত্র। সুনন্দার বিয়েতে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ, শ্যামল মিত্র, গায়ত্রী বসু ও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিমার এই ছবিতে গান গাওয়ার নেপথ্য-কথা হিসেবে জানা যায় : ‘দক্ষিণ কলকাতায় ‘মিলনচক্র’ নামের একটি ক্লাবে প্রতি মাসে ঘরোয়া আসর বসত। সেখানে এক আসরে কিশোরী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শোনেন সুধীরলাল। মুগ্ধ হন। তখন সুনন্দার বিয়েতে প্রতিমাকে  দিয়ে একটি গান গাওয়ান – ‘উছল তটিনী আমি, তুমি সুদূরের চাঁদ’। গানটি প্রতিমাকে পরিচিতি দিয়েছিল।’ সুনন্দার বিয়ে ছবিতে গায়ত্রী বসুর দুটি গান ছিল : ‘ভুল নয় ফুল এ যে’ (সুপ্রীতি ঘোষের সঙ্গে : কথা – পবিত্র মিত্র) ও ‘লুট্ লে লুট্ লে পেয়ারে’ (কথা – সুধীর সরকার : এন ৩১৩৬৩, ১৯৫১)। এই  ছবিতে সংগীত পরিচালনায় সুধীরলাল খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন। বন্ধু পবিত্র মিত্র ছিলেন অন্যতম গীতিকার, গান গেয়েছিলেন তাঁর দুই প্রিয় ছাত্রছাত্রী এবং তাঁর জহুরি-চোখ আবিষ্কার করেছিল এক সম্ভাবনাময়ী শিল্পীকে।

 

আট

সুধীরলাল চক্রবর্তী ছিলেন এক অসাধারণ সংগীত-প্রতিভা। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় মাত্র বত্রিশ বছরের জীবনে কী বিপুল অর্জন তাঁর! জলসা, বেতার ও গ্রামোফোন – এই তিন মাধ্যমে তাঁর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে। জলসার স্মৃতি কবেই গেছে হারিয়ে – বেতারের কৃতিও বিলীন – গ্রামোফোনের কীর্তিগাথাই শুধু ধূসর হলেও সংরক্ষিত আছে।

সুধীরলালের ততদিনে কলকাতার গানের জগতে বেশ নাম ফুটেছে জলসা আর বেতারের সৌজন্যে। উচ্চাঙ্গসংগীতের গুণী শিল্পী ও শিক্ষক আচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর প্রিয় ছাত্র, অসাধারণ সুর-যোজনার ক্ষমতা তাঁর আয়ত্ত, আকর্ষণীয় সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী সুধীরলালের কথা তো আর হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির চ-ীচরণ সাহার কানে না গিয়ে পারে না। চ-ীচরণ একদিন সুধীরলালকে অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির অফিসে ডেকে পাঠালেন। সেই থেকে হিন্দুস্থান রেকর্ডের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক রচিত হলো – সুধীরলাল হয়ে উঠলেন হিন্দুস্থানের প্রায় বাঁধা শিল্পী ও সুরকার। পরে তাঁর নিজের রেকর্ড ও তাঁর সুরারোপিত অন্যের কণ্ঠের রেকর্ড এইচএমভি, কলম্বিয়া, ভারত, মেগাফোন বা পাইওনিয়ার রেকর্ড থেকে প্রকাশ পেলেও হিন্দুস্থানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। সুধীরলালের প্রথম রেকর্ড (এইচ ৭৪০) বের হয় এই হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকেই ১৯৩৯ সালের পূজার গান হিসেবে – তাঁর নিজের সুরে আর দেবেশ বাগচীর কথায় ‘রজনী গো যেও না চলে, এখনো যায়নি লগন’ ও ‘ভালবেসেছিনু আলেয়ারে’। ভাবলে একটু বিস্মিতই হতে হয়, রেকর্ডে প্রথম আত্মপ্রকাশের সময় সুধীরলালের বয়স ছিল মাত্র উনিশ। খানিক বিরতি দিয়ে জানুয়ারি ১৯৪১-এ নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায় ও অনুপম ঘটকের সুরে সুধীরলাল রেকর্ড করলেন এই দুখানা গান (এইচ ৮৭৫) – ‘শুকনো পাতা ঝ’রে যায়’ ও ‘সন্ধ্যামালতী বনে’। এই ১৯৪১ সালের মার্চেই বীণাপাণি ও সুধীরলাল যৌথকণ্ঠে রেকর্ড করেন ‘যত রং বনে বনে’ ও ‘ওরে আয় আয়’ এই গান দুখানি – গীতিকার ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তবে গীতরচয়িতার নাম সম্পর্কে কিছু সংশয় আছে। এরপরে বের হলো রাগপ্রধান বাংলা গানের রেকর্ড (&এইচ ১০৫৮) – ‘গান গেয়ে মোর দিন কেটে যায়’ ও ‘তুমি ছিলে তাই’ – প্রথম গানটির গীতিকার তারক ঘোষ, দ্বিতীয়টির শঙ্কর গুপ্ত এবং দুটি গানেরই সুরকার ছিলেন অনুপম ঘটক। ‘বনভূমি শ্যামায়িত আকাশ মেঘ মেদুর’ ও ‘ছাইল অম্বর ঘন মেঘে’ এই গান দুটি রেকর্ড হয়ে বেরোনোর একটু আলাদা গল্প আছে। এ-দুটি গান হিন্দুস্থান থেকে রবীন মজুমদার প্রথমে রেকর্ড করেন, টেস্ট-রেকর্ডও অনুমোদিত হয়, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে-রেকর্ড আর বের হয়নি – পরে গান দুটি সুধীরলাল আবার রেকর্ড (এইচ ১০৯৬) করেন এবং তা বাজারমাত করে। এরপর সুধীরলালের কণ্ঠে যে দুটি আধুনিক গানের রেকর্ড হয় (এইচ ১১৭১) তা রচনা করেছিলেন প্রণব রায় এবং সুর-যোজনা করেন দুর্গা সেন – ‘মিলনের গান তোমার আমার নয়’ ও ‘প্রথম দিনের প্রথম সে পরিচয়’। হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ১৯৪৮-এর আগস্টে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির একটি রেকর্ড (এইচ ১৩৪৮) প্রকাশ করে। এই বৃন্দগানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, সুপ্রভা সরকার, রবীন মজুমদার, উৎপলা সেন, সুধীরলাল চক্রবর্তী ও আরো কয়েকজন শিল্পী। ১৯৪৮-এর শারদ-অর্ঘ্য হিসেবে সুধীরলালের দরদি কণ্ঠের যে রেকর্ড (এইচ ১৩৪২) প্রকাশ পায় তা অসামান্য সমাদর ও জনপ্রিয়তা লাভ করলো – ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়’ ও ‘এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা’ – গান দুটি লিখেছিলেন পবিত্র মিত্র ও সুর করেছিলেন সুধীরলাল নিজেই। গ্রামোফোন রেকর্ডের গীতিকার হিসেবে পবিত্র মিত্রের আবির্ভাব ডিসেম্বর ১৯৪৫-এ ভারত রেকর্ডে, মাঝে কলম্বিয়ায়, তারপর তাঁর লেখা গান হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে রেকর্ড হয়। এই তিন জায়গাতেই
সুর-যোজনার দায়িত্বে ছিলেন সুধীরলাল। হিন্দুস্থান রেকর্ডে (এইচ ১৪০৩) সুধীরলাল এরপর নিজের সুরে গাইলেন ‘তোমার রূপের মাধুরী’ ও ‘এ দুটি নয়ন’ – যথাক্রমে নিহারবিন্দু সেন ও পবিত্র মিত্রের লেখা গান। এরপর থেকে সুধীরলাল হিন্দুস্থান এবং অন্যত্রও মূলত পবিত্র মিত্রের লেখা গানই সুর করেছেন ও গেয়েছেন। যেমন ১৯৪৯-এর পূজার গান হিসেবে যে-রেকর্ড বেরোলো – ‘কেন ডাকো পিয়া পিয়া’ ও ‘আঁখি তারে ভোলে যদি মন কেন ভোলে না’ – ‘কাওয়ালি’ নামে চিহ্নিত গান দুটির গীতিকার পবিত্র মিত্র ও সুরকার সুধীরলাল। অভিন্ন গীতরচয়িতার কথায় ও নিজের সুরে ১৯৫০-এর পূজায় বের হলো সুধীরলালের এই রেকর্ডগীতি (এইচ ১৪৮৭) – ‘আমি তোমার কেহ নহি’ ও ‘আপনারে ভুলে যাই’। হিন্দুস্থানে সুধীরলালের
শেষ-রেকর্ডিং পবিত্র মিত্রের কথায় তাঁর নিজের সুরে প্রিয়-শিষ্যা উৎপলা সেনের সঙ্গে এই দ্বৈতসংগীত দুটি – ‘যদি নভে ওঠে চাঁদ’ ও ‘কেন গো ঝরা ফুলে’। রেকর্ডটি (এইচ ১৫৩০) সুধীরলালের মৃত্যুর পর ১৯৫২-এর পূজায় প্রকাশিত হয়।

পাইওনিয়ার রেকর্ডে নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায় যে-রেকর্ডটি (এনকিউ ১৫৬) সুধীরলাল করেছিলেন তাও জননন্দিত হয়েছিল – গান দুটি হলো : ‘মোর আঁখির ভাষা’ ও ‘তোমার পূজার ফুল’। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে খুব সামান্যই গান গাওয়ার অবকাশ পেয়েছিলেন সুধীরলাল। এইচএমভি থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় মে
১৯৫১-তে পবিত্র মিত্রের কথায় ও নিজের সুরে – ‘তুমি কত দূরে কোন গহন আঁধারে’। এই রেকর্ডের অপর পিঠের গানটি ছিল সুধীরলালের ছাত্রী নীতা বর্ধনের। ১৯৫১-তেই এইচএমভির লেবেলে প্রকাশ পায় এই রেকর্ডটি – ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে’ ও ‘ও তোর জীবনবীণা আপনি বাজে’। প্রণব রায়ের কথায় ও নিজের সুরে গাওয়া গান দুটি – বিশেষ করে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ স্মরণীয় হয়ে আছে। এই গানটির সুরসৃষ্টির পেছনে একটি ছোট্ট গল্প আছে – সেটি বলেছেন সুধীরলালের ছাত্র দেবব্রত দাশ : ‘একদিন সন্ধ্যায় ‘মেলোডি’র সুশীল চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর দোকানে বসে গল্প করছেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। এমন সময় সেখানে হাজির হলেন গীতিকার প্রণব রায়, সঙ্গে একটুকরো কাগজে একটা গান লিখে এনে গানটা সুধীরলালকে পড়ে শোনালেন। সুধীরলাল সঙ্গে সঙ্গেই উঠেপড়ে বাড়ির দিকে চলতে লাগলেন, সঙ্গে প্রণব রায়। সুধীরলালের একখানা ঘর ৩নং জনক রোড, লেক মার্কেটের পেছনে, মানে রাসবিহারীর ‘মেলোডি’ থেকে পায়ে হেঁটে ৪/৫ মিনিটের পথ। ঘরে এসেই হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গানটা গাইতে লাগলেন। প্রণব রায় শুনেই বললেন, ‘সুধীর, আগামীকালই গানটা রেকর্ড করে ফেল্।’ তার ৩/৪ দিন বাদেই গানটা রেকর্ড হলো এবং ইতিহাস হয়ে রইল ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ (‘গুরুদেব সুধীরলাল চক্রবর্তীর চরণে প্রণাম নিবেদন’ : অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, কলকাতা, ২ মে ২০১৮)।

সংগীতশিল্পী হিসেবে সুধীরলাল চক্রবর্তীর যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই স্মৃতিকথা বা আত্মচরিত লিখেছেন, কিন্তু খুব সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই সুধীরলালের কথা উলেস্নখ করেননি। তাঁর কৃতী ছাত্রছাত্রী বা কাছের মানুষ কেউই তাঁর জীবন বা সংগীত নিয়ে কোনো আলোকপাত করেননি। সামান্য দু-চারজন বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর সাংগীতিক মেধা ও প্রতিভা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন মাত্র। বিমান মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায় : ‘… উনি [সুধীরলাল চক্রবর্তী] মস্ত বড় সুরকার …। তবে তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো আত্মপ্রকাশ, অবশ্যই গায়ক হিসেবে। ওঁর প্রথম রেকর্ডের গানটাই ওর পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তার সুরটা এত সুন্দর ছিল যে আমি এখনো সেটা,  সময় সময় নিজের মনেই গাই – ‘রজনী গো যেও না চলে, এখনো যায়নি লগন’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০৮)। একই কথকের কাছ থেকে আরো জানা যায় : ‘সুধীরলাল মহলা দিচ্ছেন, বারবার গাইছেন, ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়’। সঙ্গে বাজছে একটা বেহালা, একটা গীটার আর তবলা।  নীরদ-দা রেকর্ডে গানটা টেক করলেন। কয়েক লক্ষ কপি বিক্রী হয়েছিল এই রেকর্ডটা, ভাবা যায়’।

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ১০৮)।

আধুনিক বাংলা গান নিয়ে বলতে গিয়ে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির একজন সংগীতরসিক শব্দযন্ত্রী নীরদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রসঙ্গক্রমে যা বলেছেন তা উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘প্রশ্ন আসছে আধুনিক গান নিয়ে। … তখনকার দিনে যেসব গান হয়েছে এবং সেগুলি যেভাবে কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে পরিবেশিত তা সত্যিই একটা পরম সম্পদ ছিল। কিন্তু তখনকার আধুনিক সঙ্গীত বেশির ভাগ ছিল লিরিক প্রধান। তখন যেসব কবি ছিলেন – অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধকুমার পুরকায়স্থ, শৈলেন রায় প্রভৃতি – তাঁরা যখন লিখতেন এবং সেই সঙ্গীত যখন পরিবেশিত হত আমরা দেখতাম বাণীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে সুরকাররা সুর করতেন। … যার জন্যে আমরা দেখতে পাই কয়েকটি গান – কে. এল. সাইগল করে গেছেন – অতি অল্প – মোটে দুটি গান আছে। বহু গান নিবেদন করেছেন আমাদের শচীনকর্তা। … সুধীরলাল চক্রবর্তীর নামও এখানে আমরা উলেস্নখ করতে পারি। তিনিও একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবোদ্ধা ছিলেন – এবং তাঁর নিবেদিত যে গানগুলি আছে – যেমন ‘‘খেলাঘর মোর’’ ইত্যাদি – সেগুলি পরম সম্পদ’ (‘একটি রেকর্ড প্রতিষ্ঠানের আদি যুগ’ : নীরদ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশ, সাপ্তাহিক, কলকাতা, ১৬ পৌষ ১৩৮৯/ ১ জানুযারি ১৯৮৩; পৃ ১৮)।

খেয়াল বা ঠুমরির রেকর্ড করে যেতে পারেননি সুধীরলাল, করলে উচ্চাঙ্গসংগীতে তাঁর অধিকার কতটুকু তা স্পষ্ট জানা যেত। বেতারের আর্কাইভ্সে তা সংরক্ষিত থাকার কথা – সেগুলো কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করলে এক অসাধারণ সাংগীতিক সম্পদের সঙ্গে শ্রোতাসাধারণের পরিচিত হওয়ার সুযোগ মিলতো। খেয়াল-ঠুমরি না হলেও সুধীরলাল বেশকিছু হিন্দি-উর্দু গীত ও গজল রেকর্ড করে গেছেন। সেসবের সন্ধান ও তালিকা-প্রস্ত্ততও কারো উদ্যোগে হয়নি। অন্তত একটি গজল-গীতের ইতিহাস সামান্য জানা যায়। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। সুধীরলালের প্রতি গানের জগতের বিশিষ্ট-প্রখ্যাত ব্যক্তিদের স্নেহানুরাগ কেমন ছিল তা বেশ বোঝা যায় কিছু কিছু ঘটনায়। ‘খানে দো জারা’ ও ‘টুট চুকে হ্যায়’ – এই গজল দুটিতে খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক দুর্গা সেন সুরারোপ করেন। প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন জগন্ময় মিত্রকে দিয়ে এটি গাওয়াবেন। কিন্তু পরে মত পালটে সুধীরলাল চক্রবর্তীকে দিয়ে রেকর্ড করান এবং তা ‘সুপারহিট’ হয়। অবশ্য দুর্গা সেন পরে অভিমানী জগন্ময়ের জন্যে নতুন গজল তৈরি করেন – ‘হ্যয় মেরা প্রেম অ্যনুধা’ ও ‘উলফত্ কি স্যযা দো’ – এই রেকর্ডও খুব জনপ্রিয় হয়।

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০৯-১০)।

শচীন দেববর্মন-জগন্ময় মিত্র-সুধীরলাল চক্রবর্তী – এই তিনজনকে অখিলবন্ধু ঘোষ আধুনিক বাংলা গানের প্রধান রূপকার বিবেচনা করতেন। অখিলবন্ধু একবার কথায় কথায় তাঁর অনুরাগীদের বলেছিলেন : ‘তোরা আমার গান এত শুনতে চাস কেন? আমরা যাঁদের গান শুনে গাইতে শিখেছি তাঁদের গান শোন্, ওঁরাই তো আধুনিক বাংলা গানের বাবা, জ্যাঠা, কাকা – শচীন দেববর্মন, জগন্ময় মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তী’।

(‘গুরুদেব সুধীরলাল চক্রবর্তীর চরণে প্রণাম নিবেদন’)।

 

নয়

সুরস্রষ্টা ও সংগীত-পরিচালক হিসেবে সুধীরলাল চক্রবর্তীর কৃতির কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। হিন্দুস্থান রেকর্ড, পাইওনিয়ার রেকর্ড, ভারত রেকর্ড, মেগাফোন, কলম্বিয়া ও এইচএমভির রেকর্ডের গানে তিনি সুর দিয়েছেন। তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে উৎপলা সেন, শ্যামল মিত্র, গায়ত্রী বসু, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নীতা বর্ধন, অনন্তদেব মুখোপাধ্যায়, শচীন গুপ্ত তাঁর সুরে রেকর্ড করেছেন।  সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া আরো যাঁরা সংগীতজগতে খুব নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সুধীরলালের সুরে গান গেয়েছেন – রেকর্ড করেছেন, যেমন : হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা রায় (দত্ত), সুপ্রভা সরকার, পান্না কাওয়াল (পান্নালাল বসু), অখিলবন্ধু ঘোষ। যাঁরা সংগীতের ভুবনে খুব একটা প্রতিষ্ঠা পাননি, অকালেই হারিয়ে গেছেন যেসব শিল্পী, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ সুধীরলালের প্রেরণায় তাঁরই সুরে ও তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করেছেন : কুমারী সবিতা সিং, পূরবী দেবী, মাধবী ঘোষ, কুমার প্রদ্যোৎনারায়ণ প্রমুখ। এখানে বলা প্রয়োজন, সবগুলো গানেরই রচয়িতা ছিলেন সুধীরলালের অভিন্নহৃদয় বন্ধু পবিত্র মিত্র।

‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’ ও ‘আলেয়ার মত কেন তারে কাছে ডাকা’ – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই রেকর্ডটি (জিই ৭৬১১) বের হয় ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে কলম্বিয়া থেকে। ওই কলম্বিয়াই বের করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এই রেকর্ডটি (জিই ৭৩৮২) ১৯৪৮-এর পূজায় – ‘কেন তুমি চলে যাও গো’ ও ‘কার বাঁশী বাজে আজ ঘুম ভাঙা রাতে’। হেমন্ত ও সন্ধ্যার আলাদা করে পরিচয় দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। গীতা রায় (তখনো দত্ত হননি), পরে বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবিতে গান গেয়ে বিখ্যাত হন – ‘বৃন্দাবনে শ্যাম নাই ফুলে মধু নাই’ ও ‘রজনী পোহাল সখি, কৃষ্ণ কোথা বল’, তাঁর এই গান দুটি নিয়ে এইচএমভি ১৯৫১ সালের পূজার রেকর্ড (এন ৩১৩৮৬) প্রকাশ করে। সুপ্রভা সরকার রেকর্ড ও চলচ্চিত্রে আধুনিক-ভজন-কীর্তন এসব গান গাইলেও তাঁর প্রকৃত সিদ্ধি ও পরিচিতি নজরুলের গানে। সুপ্রভা হিন্দুস্থান থেকে আধুনিক গানের যে রেকর্ডটি (এইচ ১৫৩৩) বের করেন, তার সুরারোপ সুধীরলাল করলেও তা প্রকাশ পায় তাঁর মৃত্যুর পরে (শারদ-অর্ঘ্য ১৯৫২)। পান্না কাওয়াল নামে কাওয়ালি গান গেয়ে খুব নাম-যশ পেয়েছিলেন পান্নালাল বসু। তাঁর জন্যে বন্ধু পবিত্র মিত্রকে দিয়ে বাংলায় কাওয়ালি ধাঁচের গান লিখিয়ে সুধীরলাল তাতে কাওয়ালির সুর দেন। পান্না কাওয়ালের সেই কাওয়ালি গানের রেকর্ড (এইচ ১৪৯২)
১৯৫০-এর পূজায় বের হয় হিন্দুস্থান থেকে – ‘আমাকে ভুলিতে’ ও ‘নয়ন কেন ওঠে’। অখিলবন্ধু ঘোষ আগস্ট ১৯৫০-এ পবিত্র-সুধীরলালের কথা ও সুরে গেয়েছেন ‘আমার সপরিবারে’ ও ‘মরমিয়া বাঁশী’ –  সে-রেকর্ড (এইচ ১৪৮৮) বের হয় হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে। সুধীরলালের সুরসৃষ্টির বৈচিত্র্যের পরিচয় এখানে পাওয়া যায়। সুধীরলাল নানা ধরনের আরো অনেক গানে সুরারোপ করেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুর আগে বা পরে রেকর্ড হয়নি। এমন কিছু অপ্রকাশিত গান বর্তমানে সুধীরলালের একমাত্র জীবিত ছাত্র দেবব্রত দাশের সংগ্রহে আছে।

সুধীরলাল সুরস্রষ্টা হিসেবে কেমন ছিলেন এবং তাঁর  গান-শেখানোর পদ্ধতি কীরকম ছিল সে-সম্পর্কে কেউ কেউ সামান্য আলোকপাত করেছেন। তাঁর ছাত্র দেবব্রত দাশ বর্তমান প্রবন্ধকারের অনুরোধে গুরু সুধীরলাল সম্পর্কে সংক্ষেপে দুই কিস্তির স্মৃতিচারণা লিখে দেন, তা থেকে জানা যায় : ‘সুধীরলাল চক্রবর্তী ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালোবাসতেন এবং প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা ভাবে, তার গলার রেঞ্জ অনুযায়ী গান শেখাতেন। গানটি শুধু গলায় সম্পূর্ণভাবে তোলার পর তবেই হারমোনিয়ামের সঙ্গে গাইতে দিতেন। সুধীরলালের সৃষ্ট গানগুলির মধ্যে থাকত শাস্ত্রীয় রাগসংগীতের সব রকমের বৈশিষ্ট্য – আলাপ, তান, গমক, মীড়, মুড়কী, আশ্ ইত্যাদি। ছুটতানের চলন এমনভাবে ব্যবহার করতেন সুরের মধ্যে যা বারবার গানগুলি গাওয়ার ফলে গলায় রেওয়াজের কাজও হয়ে যেত, এইজন্যই বলতেন গানগুলো বারে বারে গাইতে। তাঁর সবচেয়ে স্বর্ণময় সৃষ্টি গানের সঞ্চারী যা দুটি অন্তরাকে ধরে রাখার কি অপূর্ব মেলবন্ধন! আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল গানের মধ্যে মাঝেমাঝে শের ব্যবহার করার এবং তালফেরতার চলন। এককথায় সুধীরলালকে বলা যায় বাংলা আধুনিক গানের এক নতুন সৃষ্টিকর্তা। সুধীরলাল সৃষ্টি করেছিলেন সম্পূর্ণ একটি নিজস্ব ঘরানা’ (‘আমার গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তী স্মরণে’ : অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, কলকাতা, ১৫ জুলাই ২০১৮)। আর-এক জায়গায় দেবব্রত দাশ বলেছেন : ‘সুধীরলাল চক্রবর্তীকে আধুনিক বাংলা গানে ধ্রম্নপদী মাদকতার মিশ্রণের অগ্রদূত বলা যায়। সুধীরলাল যে ঠুংরি গানের অলংকার ব্যবহার করেছেন আধুনিক গানে, তা তাঁর গুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছেই শেখা। সুধীরলালের গানে সঞ্চারীর মধ্যে ছিল এক আবেগ যা এক বিরল প্রতিভাসম্পন্ন সুরকারের মাদকতার সুর, যা আজকাল একেবারেই হারিয়ে গেছে। আরেকটি জিনিস ছিল বাংলা গানে (দুটি অন্তরাকে বেঁধে রাখা সুরের বাঁধনে) শের দিয়ে গাওয়া। বাংলা কাওয়ালী-অঙ্গের গানও সৃষ্টি করেছেন তিনিই প্রথম। যেমন কণ্ঠস্বর তেমনি গানের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের ক্ষমতা তাঁর ছিল’ (গুরুদেব সুধীরলাল চক্রবর্তীর চরণে প্রণাম নিবেদন)। সুরকার ও শিল্পী হিসেবে সুধীরলালকে যাঁরা স্নেহ করতেন ও তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে নাম করতে হয় পঙ্কজকুমার মল্লিক, দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, চিন্ময় লাহিড়ী, সুখেন্দু গোস্বামী, প্রণব রায় ও আরো কেউ কেউ।

সুধীরলালের সুরকৃতি সম্পর্কে উত্তরকালের আর-এক বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অনুপ ঘোষাল, তাঁর গানের ভুবনে বইতে যে-কথা বলছেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ : ‘রাগসঙ্গীত ভেঙে সুধীরলাল যে সমস্ত সুর রচনা করেছিলেন বাংলা ও হিন্দিতে সে সব গানে ছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর ‘মেলোডি’। সে অপূর্ব স্বাদ সঙ্গীতপ্রেমিক বাঙালির কাছে ছিল অভূতপূর্ব। সুরসাগর হিমাংশু দত্তের পর সুধীরলাল চক্রবর্তী হলেন বাঙলার আরেক ব্যক্তিত্বময় সুরস্রষ্টা যিনি ক্ষণিক  সময়ের জন্য এ জগতে অবস্থান করলেও কর্মের উজ্জ্বল্য নিয়ে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন’ (জয়তী গঙ্গোপাধ্যায়ের তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত : কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৪; পৃ ১২৭)।

যিনি প্রতিভাবান সুরকার, তাঁর গায়কসত্তার বিকাশ সাধারণত ঘটে না – নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে এমন ধারণা পোষণ করেছেন বিমান মুখোপাধ্যায়। তিনি ব্যতিক্রম হিসেবে মাত্র তিনজনের কথা উলেস্নখ করেছেন, যাঁরা এই দুই ক্ষেত্রেই মনোযোগী ও সফল : ‘আমি দেখেছি, সব বড় ট্রেনাররাই যখন সুর করছেন, গান বাঁধছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেরা গান গাওয়া থেকে সরে এসেছেন। একজন পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই দুজনই সঙ্গীত পরিচালনা আর গায়ক-শিল্পী হিসেবে গান গাওয়া – দুটোই বজায় রেখেছিলেন। আর সুধীরলাল চক্রবর্তী অবশ্য এরকম কিছু কিছু করেছেন। অন্য সুর-শিল্পীদের এরকম করতে, বড় একটা দেখিনি’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ৯২)।

বাংলার বিশিষ্ট সংগীত-ব্যক্তিত্ব সমেন্তাষ সেনগুপ্ত তাঁর স্মৃতিকথায় ‘আধুনিক বাংলা গান’ প্রসঙ্গে আলোচনাসূত্রে প্রতিনিধিত্বশীল সুরকার ও গায়কদের কথা উলেস্নখ করেছেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ‘শ্রেষ্ঠ সুরকারদের’ তালিকায় নাম রেখেছেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর এবং ওই সময়কালের ‘কয়েকজন শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের শিল্পীদের’ মধ্যেও তাঁর বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন সুধীরলাল

(আমার সঙ্গীত ও আনুষঙ্গিক জীবন : সমেন্তাষ সেনগুপ্ত। কলকাতা, মাঘ ১৩৯২, পৃ ৪৩-৪৪)।

সেকালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সুরস্রষ্টা সাবিত্রী ঘোষ সংক্ষেপে শিল্পী-সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তীর যে-মূল্যায়ন করেছেন তাও উলেস্নখ করার মতো। বাংলা গানের পূর্বসূরি সুরকারদের আলোচনা শেষে তিনি বলেছেন : ‘এরপর সুরের আকাশে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র নাম তাঁর সুধীরলাল চক্রবর্তী – চল্লিশের দশকে  সুরকার হিসেবে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। সুধীরলাল বাংলা আধুনিক গান সুর-সংযোজনা করে খ্যাতি লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে সুধীরলাল কিন্তু উচচাঙ্গসংগীত শিল্পী ছিলেন। তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নিয়েছেন সংগীতসম্রাট গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে এবং রাগ-রাগিণী সংমিশ্রণে বাংলা আধুনিক গানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, সুধীরলাল সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। … ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ … গানটির বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন গীতিকার প্রণব রায় আর সে গান সুরে সঞ্জীবিত করে তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন সুধীরলাল এবং স্বকণ্ঠে disc-record-এ পরিবেশন করে শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। … এত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সুধীরলালকে অসময়ে এ ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছে, তা নাহলে আমরা ওর কাছ থেকে সুরের আরও ভাল ফসল পেতাম। তবুও বলবো ওর সুরের মধ্যে আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে’ (যুগসন্ধিক্ষণের বাংলা গানের বাণী ও সুরের ধারা : কলকাতা, আষাঢ় ১৪১৫, পৃ ৫৪-৫৫)।

সুধীরলাল চক্রবর্তীর সাংগীতিক জীবনের একটি অজানা দিকের কথা প্রকাশ পেয়েছে সংগীতগুণী বিমান মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। সুধীরলাল যে দক্ষ তবলাবাদক ছিলেন, তাঁর ‘গুণে’র এই তথ্যটি এতকাল অনেকের কাছে অজ্ঞাতই ছিল। এখন জানা যাচ্ছে : ‘… তখনকার প্রায় সব শিল্পীই ভালো তবলা বাজাতেন। ভালো গাইয়ে হতে গেলে তবলা শিখতে হোত, মোটামুটি বাজাতেও পারতে হোত – না হলে চলত না। ভীষ্মদেব বলো, কি রাইচাঁদ, সুবল দাশগুপ্ত বলো – সবাই অসাধারণ তবলা বাজাতেন। সুধীরলাল চক্রবর্তীকেও আমি দেখেছি – কি ভালো তবলা বাজাতেন। মনে পড়ছে, হিন্দুস্থান কোম্পানীতে একটা অর্কেস্ট্রার রেকর্ড হয়েছিল, অর্কেস্ট্রার কম্পোজিশন করেছিলেন খুব সম্ভব গোপাল লাহিড়ী (তুলসী লাহিড়ীর ভাই …)। আর সেই সমবেত বাদনের সঙ্গে তবলা বাজিয়েছিলেন সুধীরলাল এবং দারুণ বাজিয়েছিলেন’ এবং এই সূত্রেই আর-এক জায়গায় তিনি জানিয়েছেন : ‘কাগজে কাগজে সেই অর্কেস্ট্রার দলের ছবি বেরিয়েছিল, তাতে তবলচি সুধীরলালের ছবি আমার যথেষ্ট মনে আছে’

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০২, ২০৮)।

 

দশ

সংগীতজগতের দুজন মানুষ সুধীরলাল চক্রবর্তীর জীবনে আগাগোড়া গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন : একজন নিখিলচন্দ্র সেন, অপরজন পবিত্র মিত্র।

নিখিলচন্দ্র সেন ছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের গুণী শিল্পী ও শিক্ষক। বেতারে ও নানা মজলিশে উচ্চাঙ্গসংগীত-ভজন-গীত-রাগপ্রধান-আধুনিক-শ্যামাসংগীত – মূলত এইসব গান গাইতেন। জন্ম ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। সংগীতশিক্ষা উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে। এখানেই সুধীরলাল চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় এবং গুরুর নির্দেশে অভিভাবকের মতো সুধীরলালের দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ। সেই সম্পর্ক সুধীরলালের মৃত্যু পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। তিনি সুধীরলালকে খুব বড়ো সংগীতপ্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর অনুরক্ত এক ঘনিষ্ঠজন মন্তব্য করেছেন : ‘… সুধীরলালের গান তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। সেই জন্যেই নিখিলদার গানের  ব্যঞ্জনা, অভিব্যক্তি ও ভঙ্গীতে সুধীরলালের প্রভাব ছিল বেশী’ (শোকোচ্ছ্বাস, ‘শিল্পী নিখিলদা – মানুষ নিখিলদা’ : বিমান ঘোষ)। সুধীরলালের
সুখে-দুঃখে, অসুস্থতায়-প্রয়োজনে নিখিল সেন ছিলেন তাঁর প্রধান সহায় ও প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী – এই নির্ভরতা সুধীরলালকে সংগীতসাধনায় বড়ো সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছিল।

১৯৪২ সালে সুধীরলাল চক্রবর্তী ঢাকা বেতারকেন্দ্রে সংগীত প্রযোজক হিসেবে কাজে যোগ দেন। তার দু-বছর আগে পবিত্র মিত্র ঢাকা বেতারের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট হন – অনুষ্ঠান প্রযোজনা তাঁর মূল কাজ হলেও ঘোষক ও নাট্যশিল্পী হিসেবেও তাঁর কাজের পরিধি বাড়ে। এখানেই দুজনের পরিচয় হয় এবং অল্প সময়েই গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। পবিত্র মিত্রের জন্ম ঢাকা শহরেই। পিতা পেশায় আইনজীবী হলেও সংগীতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও অধিকার ছিল। পিতার সংগীতানুরাগ বর্তেছিল পুত্রের ওপর। কিছু চর্চাও করেছিলেন, কিন্তু গানের চাইতে নাটকের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। যেহেতু সংগীতের আবহে মানুষ, তাই সুধীরলাল তাঁকে
গান-লেখায় উৎসাহ জোগালেন। ১৯৪৫-এ সুধীরলাল ঢাকা বেতার ছেড়ে এসে কলকাতা বেতারকেন্দ্রে যোগ দেন। এই সালেই পবিত্র মিত্র গ্রামোফোন রেকর্ডের গীতিকার হিসেবে অভিষিক্ত হন সুধীরলালের সৌজন্যে। দেশভাগের কারণে ১৯৪৭ সালে পবিত্র মিত্রকে সপরিবার কলকাতায় চলে আসতে হয়। কলকাতায় উদ্বাস্ত্ত-জীবনে তিনি বন্ধু সুধীরলালের উদার ও আন্তরিক সহযোগিতা লাভ করেন – হিন্দুস্থান রেকর্ড, এইচএমভি ও কলম্বিয়াতে গীতিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন এবং পাশাপাশি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে নাট্যশিল্পী হিসেবে যোগদানের সুযোগ পান। গীতিকবি হিসেবে অল্পদিনেই পবিত্র মিত্র গ্রামোফোন রেকর্ডের জনপ্রিয় গীতিকার হিসেবে স্থান করে নেন। শিল্পী ও সুরকার সুধীরলালের সঙ্গে গীতিকার পবিত্র মিত্রের খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। সুধীরলাল সবচেয়ে বেশি পবিত্র মিত্রের লেখা গানে সুর করেছেন ও গেয়েছেনও। তাঁর লেখা কোনো কোনো গানে সুধীরলালের আসন্ন মৃত্যুর ছায়া পড়েছে বলে সেইসব গান একধরনের শোক-শিল্পে পরিণত হয়েছে। সুধীরলালের অকাল প্রয়াণে সাথিহারা পবিত্র মিত্র শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন। গান লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, কেননা সুধীরলালই ছিলেন তাঁর প্রধান প্রেরণা। তাঁর বাণী তো সুধীরলালের সুরের জাদুতেই পদ্মের মতো ফুটে উঠতো। সুধীরলাল ছাড়া তাঁর গানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সৌন্দর্য, আবেগ ও আবেদন আর
কেই-বা আবিষ্কার করতে সমর্থ হবে! যাক, তাঁর গুণগ্রাহীদের অনুরোধে বেশ কিছুকাল পরে তিনি আবার গান লিখতে শুরু করেন। সেইসব গানে সুর দিতে এগিয়ে আসেন সুধীরলালের প্রিয় ছাত্র শ্যামল মিত্র এবং আরো কিছু খ্যাতিমান সুরকার – সেসব গানের বেশিরভাগই রেকর্ড করেছিলেন সুধীরলালের শিষ্য-শিষ্যা ও তাঁর পরিম-লের শিল্পীরা। পবিত্র মিত্রের গান কে সুরারোপ করবেন আর কেইবা গাইবেন, এ-বিষয়ে তাঁর একটা মতামত অনেক সময়ই থাকতো এবং তাতে সুধীর-পরিম-লের শিল্পী-সুরকারেরা প্রাধান্য পেতেন।

 

এগারো

সুধীরলাল চক্রবর্তীর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অল্পই জানা যায়। সম্ভবত নিজের কথা বলতে তিনি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। আর কাছের মানুষদের কেউ হয়তো এসব বিষয়ে কৌতূহলও দেখাননি। তা না হলে এতো নিকট-সময়ের একজন খ্যাতিমান মানুষের পারিবারিক ইতিবৃত্ত, তাঁর গ্রামের জীবনের কথা, কলকাতাবাসের সময়ে গানের জগতের বাইরের জীবনের তথ্য তো প্রায় কিছুই জানা যায় না। তাঁর সংগীত-সতীর্থদের স্মৃতিচর্চাতেও তিনি শোচনীয়ভাবে অনুপস্থিত।

সুধীরলাল ছিলেন সজ্জন, বিনয়ী, মার্জিত, মিষ্টভাষী, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী – এককথায় আগাগোড়া ভদ্রলোক। সুধীরলাল শান্ত স্বভাবের স্নিগ্ধ মনের মানুষ ছিলেন – কখনোই উত্তেজিত হতেন না, রাগও ছিল না। সংগীতজগতের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ‘মেলোডি’তে জোর-আড্ডা হতো – তাতে খোশমেজাজের, ঠাট্টা-তামাশার, হাসি-হুলেস্নাড়ের এক ভিন্ন সুধীরলালকে খুঁজে পাওয়া যেত। একবারে সাদাসিধে
থাকতেন – বাইরে বেশির ভাগ সময়ে সাদা পাঞ্জাবি-ধুতি, কখনো শার্ট থাকতো গায়ে – আর বাড়িতে ঘরোয়া পোশাক ছিল হাতাঅলা গেঞ্জি ও লুঙ্গি। ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই কথা বলতেন পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়। এ-বিষয়ে তাঁর দোসর ছিলেন ঢাকায় জন্ম নেওয়া গীতিকার-বন্ধু পবিত্র মিত্র। দুজনই শেকড়ের টান অনুভব করেছেন নিত্য-নিয়ত – দেশ ছেড়ে গেলেও আপন ভুবনের ভাষা ভুলে যাননি।

কলকাতার জীবন বরাবর অভাবে কেটেছে। কিন্তু এ-নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ বা আফসোস ছিল না। সুধীরলাল ও আরো কারো কারো কথা বলতে গিয়ে বিমান মুখোপাধ্যায় উলেস্নখ করেছেন : ‘… ওই চল্লিশের দশকে ওরা কেবল গান কি করে ভালো গাইব, তাই নিয়ে রগড়ে পড়ে থাকত – অন্য কোন চটকদারীর পরোয়াই করত না। তাই ওঁদের কারুরই সাংসারিক অবস্থা কোনদিন ফেরেনি, যেমন ভবানী দাস তেমনই সুধীরলাল – দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্রে্যই তাঁদের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে,
পৃ ২০১-১১)। সুধীরলাল কেমন অল্পতেই তুষ্ট থাকতেন, সেই বিবরণও মেলে বিমান মুখোপাধ্যায়ের সূত্রে। সুধীরলাল তখন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। একদিন হিন্দুস্থানের মালিক চ-ীচরণ সাহার কাছে খুব সংকোচের সঙ্গে কিছু টাকা তিনি চাইলেন। চ-ীচরণ সুধীরলালের স্বভাব বেশ ভালোই জানতেন, কেন তাঁর টাকার প্রয়োজন তাও অজানা ছিল না। ধমক-টমক দিয়ে কিছু টাকা সুধীরলালকে ধরিয়ে দিলেন। বিমান মুখোপাধ্যায় বলছেন : ‘ঠিক কতো টাকা সেদিন চ-ীদা দিয়েছিলেন তা এখন আর মনে পড়ছে না, তবে ছিল নেহাৎই কম। সুধীরলাল বিনা বাক্যেই চলে গেলেন। এইটুকুতেই সন্তুষ্ট। জাতশিল্পী  এঁদের এই জন্যেই বলে, দিনকালটাই তখন এইরকম ছিল’ (বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ১০৮)।

 

প্রবল সুরাসক্ত ছিলেন সুধীরলাল। সুর ও সুরা – দুটোর প্রতিই সমান আকর্ষণ ছিল তাঁর। গুরু গিরিজাশঙ্করের আশ্রয়ে থাকার সময়েই সুরাপানে তাঁর হাতেখড়ি হয় গুরুভাই নিখিলচন্দ্র সেনের উদ্যোগে। অবশ্য সে-সময়ে এই কাজটি লুকিয়ে-চুরিয়েই করতে হতো। গুরুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর সুধীরলালের মদ্যপান অবাধ ও অপরিমিত হয়ে ওঠে। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। অভুক্ত অবস্থাতেও পেটে পড়তো কারণবারি। এই অনিয়ম ও অমিতাচার তাঁর জীবনের দৈনন্দিন কার্যাবলির অন্তর্গত হয়ে পড়েছিল। আর কাজ আদায়ের ফন্দিতে কেউ কেউ সুধীরলালের জন্যে মনপসন্দ সুরার বোতলও উপহার হিসেবে আনতেন। আর তাঁর জীবনে অপ্রাপ্তির বেদনাও কিছু ছিল – হয়তো তা ভোলার জন্যেও কখনো কখনো সুরার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হতো। হয়তো বা কোনো প্রিয়জনের ফিরিয়ে দেওয়ার আঘাত ভুলতে গিয়েও সুরার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয় সুধীরলালকে। বাংলার সাহিত্য-সংগীত-অভিনয়জগতের অনেক প্রতিভাবান বা প্রতিশ্রম্নতিশীল মানুষই সুরাসক্ত হয়ে নীরব আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছেন। সুধীরলাল সেই দীর্ঘ-তালিকার একটি বেদনাবিদ্ধ হাহাকারমথিত নাম।

 

বারো

সুধীরলালের পরিজনহীন নিঃসঙ্গ জীবন বেশ কেটে যাচ্ছিল। তাঁর ফাই-ফরমাশ খাটার জন্যে গ্রামের বাড়ি থেকে বিমল ঘটক নামে এক ভাগনেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। বন্ধুদের, বিশেষ করে নিখিলচন্দ্র সেনের চাপে পড়ে বিয়ের কথা ভাবতে হয়। মেয়ে-দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের সব ব্যবস্থাই নিজে থেকে এই নিখিল সেনই করেন। পাত্রীর বাড়ি ঢাকা জেলায় – নাম মীরা দেবী। পাত্রীর দিদির শ্বশুরবাড়ি ছিল কলকাতার মোটামুটি কাছেই উত্তরপাড়ায় – সেখানেই সুধীরলাল-মীরার বিয়ে হয় ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে। খুব সাধারণভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় – বরযাত্রী হিসেবে পাত্রের খুব কাছের মানুষ সংগীতজগতেরই কয়েকজন গিয়েছিলেন। নতুন বউ নিয়ে সুধীরলাল তাঁর স্বল্পপরিসরের জনক রোডের বাসাতেই ওঠেন। বিয়ের পর মাত্র মাসতিনেক সুধীরলাল সুস্থ ছিলেন।
স্নিগ্ধ-সুশ্রী ও গৃহকর্মনিপুণা স্ত্রীর কল্যাণে তিনি এই সীমিত সময়টুকুতে দাম্পত্যজীবনের যথার্থ সুখ, আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করেছিলেন। আর মৃত্যুকাল পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় প্রায় তিনমাস স্ত্রীর নিপুণ সেবা তাঁকে শারীরিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে না পারলেও মানসিক শান্তি হয়তো দিয়েছিল।

 

তেরো

দীর্ঘকালের অনিয়ম ও অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে সুধীরলাল বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুখের বীজ আগেই শরীরে প্রবেশ করেছিল, ১৯৫২ সালের গোড়ার দিকে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে – তিনি বিছানা নেন। রোগটা দুরারোগ্য – লিভার সিরোসিস। শিল্পী-সুরকার সুধীরলালের সব সাংগীতিক কর্মকা- থেমে রইলো – গান-শেখানো, গান-গাওয়া, সুরসৃষ্টি। অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যেতে লাগলো। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে থেকে রক্তবমি শুরু হলো – চেতন-অবচেতনের মধ্যে আসা-যাওয়া চললো – অবস্থা তখন সংকটাপন্ন। এই অবস্থায় মৃত্যুর দুদিন আগে কলকাতার শম্ভুনাথ প–ত হাসপাতালে সুধীরলালকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কালান্তক ব্যাধি তাঁকে মুক্তি দিলো না – ১৯৫২  সালের ২০ এপ্রিল ভোর চারটায় হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হয় – মাত্র ৩২ বছর বয়সে চিরকালের জন্যে গান থেমে গেল সুধীরলালের। মৃতদেহ নিয়ে আসা হলো জনক রোডে তাঁর আবাসে। তাঁর
সুহৃদ-শুভাকাঙক্ষীরা একে একে এসে শ্রদ্ধা জানালেন প্রয়াত শিল্পীকে। ওইদিনই কেওড়াতলা মহাশ্মশানে সুধীরলালের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় বেলা ১২টা নাগাদ। সেদিনের কথা স্মরণ করে সুধীরলালের একমাত্র জীবিত ছাত্র দেবব্রত দাশ জানিয়েছেন : ‘আজও চোখ বুজলে স্পষ্ট ভেসে ওঠে কেওড়াতলা শ্মশানে (তখন কাঠের চিতা ছিল) মৃতের সৎকারের সব বন্দোবস্ত করতে চোখের জলে ব্যস্ত ছিলেন নিখিলচন্দ্র সেন ও চিন্ময় লাহিড়ী – যার সাক্ষী হয়ে আছেন এবং ছিলেন বহু বিখ্যাত শিল্পীর দল’ (গুরুদেব সুধীরলাল চক্রবর্তীর চরণে প্রণাম নিবেদন)। আর অপরদিকে সুধীরলালের সদ্যবিধবা সান্তবনারিক্ত-শোককাতর পত্নী মীরা দেবীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় উত্তরপাড়ায় তাঁর দিদির বাড়িতে। এইভাবে মর্মন্তুদ সমাপ্তি ঘটলো বাংলা গানের আধুনিকপর্বের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের।

 

চোদ্দো

সুধীরলাল চক্রবর্তীর স্মৃতিরক্ষার দায় কেউ বহন করেননি – একমাত্র তাঁর ছায়াসঙ্গী নিখিলচন্দ্র সেন ছাড়া। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই কর্তব্য তাঁর সীমিত সাধ্য নিয়েও পালন করে গেছেন। সুধীরলালের মৃত্যুর পর তিনি গড়ে তোলেন ‘সুধীরলাল স্মৃতিবাসর’। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুধীরলালের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন, সুধীরলালের গীত ও সুর-যোজিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গানের প্রচার এবং তাঁর স্মরণে একটি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা। এই কাজ প্রায় এককভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে নিখিল সেন করে গেছেন। তাঁর এই প্রয়াস সম্পর্কে তাঁর এক গুণগ্রাহী বলেছেন : ‘সুধীরলালকে নিখিলদা যে কতটা ভালবাসতো তার পরিচয় পাওয়া গেল সুধীরলালের তিরোধানের পর। তখন  জানলাম সংগঠক নিখিল সেনকে। বছরের পর বছর কী অসীম নিষ্ঠা, অক্লান্ত পরিশ্রম সহকারে সুধীরলাল স্মৃতিসভার আয়োজন করতো নিখিলদা, সমসাময়িক শিল্পী ও সঙ্গীতপ্রেমিকদের আশাকরি সেকথা স্মরণে আছে নিশ্চয়’ (শোকোচ্ছ্বাস, ‘শিল্পী নিখিলদা – মানুষ নিখিলদা’)।

সুধীরলালের সঙ্গে নিখিল সেনের যে আত্মিক সম্পর্ক এবং তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার প্রয়াস সম্পর্কে যে-তথ্য মেলে তা উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘সুধীর নিখিলদাকে পেয়ে উদ্ভাসিত, নিখিলদা সুধীরের শ্রদ্ধা পেয়ে উলস্নসিত। নিখিলদার যত স্নেহ তত শাসন, যত আদর তত বকুনি, যত আকর্ষণ তত বিকর্ষণ, আর সুধীরেরও যত ভক্তি তত অমান্য, যত আবদার তত অত্যাচার, যত ভয় তত বেপরোয়া। নিবিড় করে সুধীরকে বুকে টেনে তাকে বিকশিত করার শত চেষ্টা নিলেন নিখিলদা। সুধীর গিরিজাবাবুর আশীর্বাদে ও দীক্ষায় সঙ্গীতজগতে বাঙ্গালীর গর্ব হয়ে উঠলো আর নিখিলদার  হোলো অহঙ্কার। অকালে সুধীরলাল ঝরে গেল। নিখিলদা চূর্ণ-বিচূর্ণ হৃদয়ে সুধীরের হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, কিন্তু তিনি ভুললেন না তার শ্রদ্ধা-মমতার স্মৃতি। প্রিয় সুধীরকে বাঁচিয়ে রাখলেন আজীবন তার সঙ্গীত পরিবেশন করে এবং ‘সুধীরলাল স্মৃতিবাসর’ প্রতিষ্ঠা করে’

(শোকোচ্ছ্বাস, ‘স্মরণে নিখিলচন্দ্র সেন’)।

কিন্তু আর্থিক সংকট ও সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে ১৯৮২ সালে নিখিলচন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর ‘সুধীরলাল স্মৃতিবাসরে’র কার্যক্রম ধীরে ধীরে কমে আসে এবং একসময়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে
থাকতে সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এইভাবে খোদ কলকাতায় বাংলা গানের এককালের যুবরাজের স্মৃতিরক্ষার প্রয়াস নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

 

পনেরো

মাত্র বত্রিশ বছরের জীবনে কী অসাধারণ অর্জন সুধীরলালের – সংগীতের নানা পথে রেখে গেলেন স্থায়ী ছাপ – তাঁর সংগীত-প্রয়াসে নিজেকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘একাধারে একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী, আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয় গায়ক, প্রতিষ্ঠিত সুরকার, সুদক্ষ তবলিয়া, উচ্চাঙ্গের শিক্ষক’ হিসেবে

(বিমানে বিমানে আলোকের গানে, পৃ ২০৯)।

‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়’, ‘এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা যত কিছু পরাজয়’, ‘আঁখি তারে ভোলে যদি মন কেন ভোলে না’, ‘কেন ডাকো পিয়া পিয়া’, ‘রজনী গো যেও না চলে, এখনো যায়নি লগন’, ‘গান গেয়ে মোর দিন কেটে যায়’, ‘তুমি কত দূরে কোন গহন আঁধারে’, ‘এ দুটি নয়ন পলকে’, ‘ছাইল অম্বর ঘন মেঘে’, ‘বনভূমি শ্যামায়িত আকাশ মেঘ মেদুর’, ‘প্রথম দিনের প্রথম সে পরিচয়’, ‘ভালবেসেছিনু আলেয়ারে’, ‘ও তোর জীবনবীণা’, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে’ – সুধীরলাল চক্রবর্তীর এই কালজয়ী গানগুলো স্বর্ণযুগের সংগীত-স্মৃতিকাতর বাঙালিকে চিরকালই স্পর্শ করবে।

আধুনিক বাংলা গানের অনন্য রূপকার – সৃজন-বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র মেধার অধিকারী – সুরের ভুবনে বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব সুধীরলাল চক্রবর্তীর জন্মের একশো বছর পূর্ণ হবে সামনের বছরে (২০২০)। স্মরণীয় সুধীরলালের প্রাকজন্মশতবর্ষে আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা।

 

গ্রন্থঋণ

বিমানে বিমানে আলোকের গানে, সিতাংশুশেখর ঘোষ, তৃ-স, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৫।

আমার সঙ্গীত ও আনুষঙ্গিক জীবন, সমেন্তাষ সেনগুপ্ত, কলকাতা, মাঘ ১৩৯২।

যুগসন্ধিক্ষণের বাংলা গানের বাণী ও সুরের ধারা, সাবিত্রী ঘোষ, কলকাতা, আষাঢ় ১৪১৫।

তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি, জয়তী গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৪।

বাঙালির কলের গান, আবুল আহসান চৌধুরী, ঢাকা, নভেম্বর ২০১২।

বিশ শতকের বাংলা ছবি, তপন রায়-সম্পাদিত, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০১।

 

পত্রিকা ও পুস্তিকাঋণ

সঙ্গীত-বিজ্ঞান প্রবেশিকা, মাসিক, কলকাতা : শ্রাবণ ১৩৪১ ও অগ্রহায়ণ ১৩৪৭।

শারদীয় দেশ, কলকাতা, ১৪০৩।

দেশ, সাপ্তাহিক, কলকাতা : ১৬ পৌষ ১৩৮৯।

হিজ মাস্টার্স ভয়েস : বাংলা রেকর্ড তালিকা, কলকাতা, আগস্ট ১৯৫২।

শোকোচ্ছ্বাস : নিখিলচন্দ্র সেন স্মরণিকা, কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর ১৯৮২।

গুরুদেব সুধীরলাল চক্রবর্তীর চরণে প্রণাম নিবেদন, দেবব্রত দাশ, অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, কলকাতা, ২মে ২০১৮।

আমার গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর স্মরণে, দেবব্রত দাশ, অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, কলকাতা, ১৫ জুলাই ২০১৮।

 

ব্যক্তিঋণ

দেবব্রত দাশ : সুধীরলাল চক্রবর্তীর একমাত্র জীবিত ছাত্র, কলকাতা।

শোভনলাল সাহা : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ও ইনরেকো, কলকাতা।

তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : সংগীতগুণী ও লেখক, হাওড়া।

অমিত গুহ : সূরজ শ্রম্নতি সদন, কলকাতা।

স্বপন সোম : সংগীতশিল্পী ও সংগীতগবেষক, কলকাতা।

সঞ্জীব কুমার মুখার্জী : আধিকারিক, হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ও ইনরেকো, কলকাতা।