একুশ শতকে কবিতার আমি-সত্তা

কবির ‘আমি-সত্তা’র বহুবিধ রূপান্তর/ প্রতিসরণ ঘটায় কবিতার ডিকশন। তখন সেটি হয় কবিতার পারসোনা। এই ‘আমি-সত্তা’ ক্লাসিক জগতে ছিল নৈর্ব্যক্তিক, গ্রন্থিক বা নিছক অলংকারপ্রণেতা-রূপে। কিন্তু ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসসঞ্জাত ‘আমিত্ব’ বোধই হয়ে উঠল – আজ পর্যন্ত, কবিতার সংতত্ত্ব বা প্যারাডাইম। এই আমি-সত্তা রোম্যান্টিক পর্বে বৈপস্নবিক ও তুঙ্গ রূপ নেয়, কবিতার পারসোনা হয়ে সরাসরি কবিতায় প্রোথিত হয়, দৃশ্যমান হয়। এই সত্তারূপী আমি-র দার্শনিক-সাংস্কৃতিক-মনোদৈহিক ও স্থানগত মুখশ্রী আছে, আছে জটিল ও নিত্য জায়মান রূপ। রোম্যান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় : Emphatically such a being, lives,/ An inmate of the active Universe; আমি বাইরের জগতের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে সংঘাতদ্বন্দ্বে জড়িত এবং অপার বাসনার অচরিতার্থতায় কখনো বিরহী-বিষাদিত, কখনো বিচ্ছিন্নতাকামী, কখনোবা ‘তুমি’ বা অন্য সত্তার সঙ্গে মিলনপ্রত্যাশী। বাংলা কবিতায় এই সংঘাতশীল বিরহী ‘আমি’র সর্বাত্মক পরিচর্যা-পরিস্রুত-বিনির্মাণ ঘটেছে আমাদের রোম্যান্টিক-দর্শনভাবুক রবীন্দ্রনাথে। ‘আমি’ই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার আধেয়। আর আধুনিক কবিরা ‘আমি-সত্তা’কে অস্তিত্ব-সংকটের গোপন গহবরে ফেলে দিয়ে এর অনাবৃত মুখচ্ছবি দেখতে চাইলেন; রূপ নয়, স্বরূপই তাঁদের অন্বিষ্ট হলো, নিরীক্ষণের  বিষয় হলো।  তাঁরা নিজেদের আমত্মঃবৈশেষিকতা (intra-subjectivity) নিয়ে কবিতায় আমির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে দিলেন সার্বভৌমত্ব। এই ‘আমি’ বিরহী না হয়ে হলো বিবাগি,  দিশা-বিদিশাগ্রস্ত; উন্মূল, নিঃসঙ্গ এবং আততিময়।

প্রশ্ন উঠল, প্রতীচ্য বলয়ে চর্চিত উত্তর-আধুনিক পর্বে এসে যা বিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পসাহিত্যের ফেনোমেনা হয়ে আছে। আধুনিকতা এখনো শেষ হয়নি বা উত্তর-আধুনিকতা হচ্ছে আধুনিকতারই পরিণত রূপ – এমন ব্যাখ্যাও মনে রাখা আবশ্যক। আর্থ-সমাজকাঠামো, বিশ্বায়ন এবং জ্ঞানকা–র দ্রম্নত পরিবর্তনশীল সময়পটে ‘আমি’র দার্শনিক-সাংস্কৃতিক, এমনকি মনোদৈহিক রূপকাঠামো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, হচ্ছে। ব্যক্তি এখন ব্যক্তিত্বহারা, অণুসদৃশ, কখনো প্রায় -অদৃশ্য, বহুতর ছদ্মবেশী! রচনাকর্মের কর্তৃসত্তাকে বলা হচ্ছে মৃত, নিলীন; সৃজনশিল্পকে বলা হচ্ছে নিছক টেক্সট যার আওতায় পোস্টার দেয়াললিখন পর্যন্ত অন্তর্ভূত। এই, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এদেশে কবিতার ‘আমি-সত্তা’ কীভাবে এসব তত্ত্ব-প্রতর্কের বা রূপান্তরশীল বাস্তবতার মোকাবেলা করছে? এটি এক জটিল প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যাকে ফুকো বলেন – ‘এক্ষণ’ – সেই অবস্থায় কবিতায় কীভাবে নিজ-নিজ কবিব্যক্তিত্ব সত্তা-রূপ ধারণ করছে, কবিতার ডিকশনে রূপ নিচ্ছে? এবং তাতে ব্যক্তিকবির আত্মা আবিষ্কৃত/ অবিকল থাকছে, না বিকল্পায়নের ছলনায় মুখোশ করে তুলছে মুখশ্রীকে – সেটিই অনুসন্ধানের বিষয়।

 

দুই

এদেশে পঞ্চাশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত, এমনকি আশির দশকের মাঝামাঝিতেও কবিতার পারসোনা জড়িয়ে থাকত স্বদেশ-ভাষা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সংক্ষোভে-গঠমানতায়। জাতিগত-আত্মার সন্ধানই ছিল কবিদের প্যারাডাইম। অবশ্য মানবিক বেদনা-বাসনা-প্রেম-সৌন্দর্যবোধ ইত্যাকার কাব্যিকতাও ছিল ওই প্যারাডাইমে অঙ্গীভূত। এই জাতিগত আত্মা কখনো সমবেত, জমায়েতাবিষ্ট, কখনো-বা একলা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকতে চাইত অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায়-সংগ্রামে-আন্দোলনে জাতিতাত্ত্বিক। বলা বাহুল্য এই জাতিতাত্ত্বিক আত্মায় ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রকাশের অভিশ্রম্নতি।

তিরিশবাহী আধুনিকতার চেতনা ও আঙ্গিকেই এঁরা আত্মপরিচয় সন্ধানের ব্যাকুলতায় ভাষা ও স্থানচিহ্নে স্বতন্ত্র হতে চাইলেন। কবি আহসান হাবীব যেমন নিজেকে জড়াতে চান ঐতিহ্যিক প্রাকৃতিকতায়, শিকড়ায়নে। তাঁর এই বাসনায় আছে প্রত্যাবর্তনের ঈপ্সা, আর এই ঈপ্সার উৎসে আছে এদেশের ইতিহাস, সময়খ-, আধুনিকতার নিজস্ব স্বর এবং শহুরে জীবনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপরীতে অবস্থানের বাসনা। কবিতাটির অংশবিশেষ –

 

আসমানের তারা সাক্ষী

সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই

 

নিশিরাইত বাঁশবাগানের বিস্তর জোনাকি সাক্ষী

সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী

পুবের পুকুর, তার ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থিরদৃষ্টি

মাছরাঙা আমাকে চেনে

আমি কোনো আগন্তুক নই

 

খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই

আমি কোনো আগন্তুক নই।

(‘আমি কোনো আগন্তুক নই’)

কবির ‘আমি-সত্তা’র এই প্রত্যাবর্তন-বাসনার ভাষা যতই সরল হোক তা নির্দেশ করে তাঁর দিশাহীন চিত্তের স্থানিকতায় লগ্ন হওয়ার ব্যর্থতাও। আধুনিকেরা আর নিজের প্রাকৃতিক উৎসে ফিরতে পারে না।

প্রতিভাশালী কবিদের একটি নিজস্ব স্বর যেমন থাকে, তেমনি থাকে কল্পনাকুশল ও নান্দনিক ডিকশন সৃষ্টির ক্ষমতা। এই ডিকশন আত্মভূত করে নেয় ঐতিহ্যিক উলিস্নখন-রূপকল্প, সামাজিক ভাষা এবং তা থেকে আবিষ্কার করে নেয় নিজের ভাষা। সবকিছুর সমবায়ে তৈরি হয় নিজ ডিকশন, তাতে কবিসত্তারও বিনির্মাণ ঘটে, আত্মমুক্তির ঝরনাও উৎসায়িত হয় চিত্তকন্দর থেকে। তারপর কবিতার জননক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এসবই ঘটে ইতিহাস-সময়ের পটে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সারবত্তা ও স্বাধীন বোধের এষণায়, যেটি সংবেদনশীল কবিদের স্নায়ুম-লীতে সর্বদাই কম্পিত, স্পন্দিত হতে থাকে। জীবনানন্দ কবিতাজনন বিষয়ে বলেন :

(যাঁরা কবি) তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে … মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায় – একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতো জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতাজননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়।

(কবিতার কথা, ১৯৫৬)

জীবনানন্দ দৃশ্যমান-পৃথিবীর আড়ালে অন্য-এক পৃথিবীর দৃশ্যমান আলো-অন্ধকার দেখতে পেতেন। তিনি ভেঙেছেন ফেনোমেনাকে, আমি-সত্তাকে নীরবতার গহবরে উপুড় করে ঢেলে দিয়ে অন্য বাস্তবতার রেখা-চিহ্ন দেখেছেন। যেখানে আমি-সত্তার কোনো লিঙ্গ নেই, শুধুই আছে আততিময় স্তব্ধতা। এটি যেন বাইরের পৃথিবীর সংঘাতদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত আমি-সত্তার ভিতরমুখী দিশাময়তা, এক ধরনের স্ব-অতিক্রমণ। মিশেল বাকেটের ভাষায় : That the self is built on conflict and tension rather than  being an essential or given. একটু পিছিয়ে গিয়ে এ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা পাঠ করা যাক :

১. একটা সামান্য কবিতা লিখতে মনটাকে কীরকম করে নিঙড়ে বের করতে হয় যারা পড়ে তারা বোধহয় কিছুই বুঝতে পারে না।

২. আজকাল কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখসম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে।

দুটি বয়ানেই আমির আত্মিক ও মনোদৈহিক – সৃষ্টির প্রসববেদনা আর সুখানন্দের অনুভূতি আছে। আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথ কবিতা-গানে আত্মসত্তা ও জগৎসত্তাকে মিলিয়ে নেওয়ার বাসনাতাড়িত হয়ে
রূপ-রূপান্তরের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হন মানবসত্তাধারী ‘আমি’তে। এই যে বিশ্বসত্তাযুক্ত মানবসত্তা তা আমি-সত্তারই সম্প্রসারণশীল রূপ। আর তাতে পদে পদে চিহ্নিত হতে-থাকা তাঁর সৃজনশীল দার্শনিকতা – ‘আমারই চেতনার রঙয়ে পান্না হল সবুজ’-এর বোধে স্থিতপ্রজ্ঞ থাকার ভাবুকতা। শেষ লেখা (১৯৪১) কাব্যে যদিও রবীন্দ্রনাথ ‘প্রথম দিনের সূর্য’ (১১ নং) কবিতার আমি-সত্তার স্বরূপকে শনাক্ত করতে পারেননি, হয়ে রইলেন অজ্ঞেয়বাদী – ‘কে তুমি!’ এই জিজ্ঞাসার কোনো জবাব মেলেনি।

 

শামসুর রাহমানের আধুনিকতায় রয়েছে রোমান্টিক রহস্যবাদ ও স্বদেশলগ্নতার  দ্বৈততা। তাঁর গদ্যভাষণে লক্ষ করি কবিতাজননের রোমান্টিক প্রবণতা :

কবিতা লেখার সময় কোনো এক রহস্যময় কারণে আমি শুনতে পাই চাবুকের তুখোড় শব্দ, কোনো নারীর আর্তনাদ, একটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, কিছু পেয়ারা গাছ, বাগানঘেরা একতালা বাড়ি, একটি মুখচ্ছবি, তুঁতগাছের ডালের কম্পন, ঝিঁকিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি,  ঘুমন্ত সহিস, ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, বারবার।

(‘ভূমিকা’, ১৯৭৬)

এই কবির চারপাশের দৃশ্যমান জগতের দৃষ্টিশ্রম্নতিকল্পই জোগায় ডিকশন, ধ্বনিব্যঞ্জনা, চিত্রলতা; তিনি দৃশ্যমান জগৎ ভেঙে দেন না, প্রতিসরিত করেন। রাহমানের কবিতায় তাই ধ্বনিকেন্দ্রিকতা (logocentrism) বেশি থাকে, আমি-সত্তাই দ্রষ্টার ভূমিকা পালন করে অর্থাৎ এলিয়টের ভাষায় অনুঘটক হয়; কিন্তু আমির স্বরকে চিহ্নহীন করে না।

 

তিন

সত্তা প্রসঙ্গে জ্ঞানবিদ্যার কাছে হাত পাততে হয়। কারণ দর্শন ও কবিতার সম্পর্ক অন্যোন্যনির্ভর। দার্শনিক কিয়ের্কেগাদ নান্দনিক বৃত্তিকে প্রথম স্তরে রাখেন, তারপর নৈতিকতা ও চরম উৎকর্ষরূপে থাকে আধ্যাত্মিকতা। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট অধ্যাত্মবৃত্তিকে ভেবেছেন মানুষের সত্তায় প্রোথিতরূপে (inbuilt)।

আমরা সার্ত্রের সত্তাবাদ সম্পর্কে কথা বলছি না, কারণ তাঁর নিবিড় সংযোগ যতটা না কবিতার সঙ্গে তারও বেশি কথাশিল্পের সঙ্গে, তবু বলা যায় তাঁর ব্যাখ্যাত সত্তার প্রশ্নটিও একই সঙ্গে
দার্শনিক-মানবিক, এই মানবিকতাই কবিতার অন্বিষ্ট। যদিও কবিতা দর্শনশাস্ত্র নয়, তবু কবিদের অভিজ্ঞতার বোধে দার্শনিক অভিজ্ঞান ও তার অন্বেষণ থাকেই। বড় কবির ক্ষেত্রে তো বটেই। কারণ তাঁরা সময়ধৃত মানবিক প্রশ্নগুলির জবাব খোঁজেন। কবির জগৎনির্ভর অভিজ্ঞতাবাহী অস্তিত্ব-অন্বেষায় অনুধ্যানী (Ontological quest)। শেষ পর্যন্ত এই অন্বেষা দার্শনিক জীবনজিজ্ঞাসায় স্ফটিকায়িত হয়, যাকে বলা হয় বোধি, ঘটাকাশ, প্রজ্ঞাপারমিতা, অনুসন্ধানাত্মিকা অন্তঃকরণ বৃত্তিজাত পরিজ্ঞান। যদিও দার্শনিকেরা কবিতাকে বলেন নিচের স্তরের আবেগ আর দর্শন হচ্ছে উচ্চস্তরের মননবুদ্ধি অর্থাৎ বুদ্ধি ঊর্ধ্বতন, আবেগ অধস্তন। কিন্তু ক্লাসিক যুগ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত জীবনদর্শন শুধুই আবেগস্তরে থাকেনি; তা বৌদ্ধিক
চিন্তাবোধি রূপেই উদ্ভাসিত হয়েছিল। কবি এজরা পাউন্ড তো কবিতার শিরদাঁড়া রূপে যে-চিত্রকল্পের কথা বলেছেন তাও আবেগ ও বুদ্ধির যৌগপদ্য, তাৎক্ষণিক বিন্দুবদ্ধ মিলন। আর উত্তর-আধুনিকেরা তো আবেগকে রাখতে চান যুক্তিবুদ্ধির ওপরে।

 

একুশ শতকে এসে কবিতায় ‘আমি-সত্তা’র সন্ধান কী আদৌ পরিলক্ষ্যেত হয়? হলে তার রূপই-বা কেমন? কিভাবে ডিকশনে সেই রূপ ধরা পড়ে? এইসব প্রশ্নের পৃষ্ঠপটে আছে স্থানচিহ্ন, সময়ের অন্ত:স্রোত, নান্দনিকতার ঐতিহ্য ও সমকালীনতা, আছে একাত্তর-পরবর্তী – বিশেষ করে নববইয়ের দশক থেকে ঘূর্ণমান নানা পরিকল্প ও তত্ত্বের কাব্যায়ন, যার অধিকাংশই আমদানি হয়েছে প্রতীচ্য ভায়া ওপার বাংলা থেকে। আমরা দেখি, এসবের ডামাডোলে নববইয়ের কবিরা নিজ প্রতিভা ও কবিতার সারবত্তাকে স্বকীয়ত্ব দিতে পেরেছেন। এবং একুশ শতকে তাঁরা হয়েছেন পরিণত ও আত্মপরিচয়ে কেউ কেউ স্বরাট। সাহিত্যকে শুধু টেক্সট হিসেবে গণ্য করার যে-তত্ত্ব তা লেখকের সৃজনক্ষমপ্রজ্ঞাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস কি-না তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন আছে। অন্তত, আমাদের প্রস্তাবিত ‘আমি-সত্তা’র প্রসঙ্গে কথাটি জরুরি। উক্ত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করে না কীভাবে কবিতার পারসোনায় রূপান্তরিত হয় বা  প্রতিসরিত হয় ব্যক্তি-আমি ও তাঁর জগৎ।

এই তত্ত্বের আড়ালে কী উঁকি দিচ্ছে আর্থ-রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভিন্ন ধরন, পুরানোর ভাঙন আর নান্দনিকতা থেকে শিল্পসাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করার কারসাজি? না-কি তা বড় একটা পরিসর গড়তে চায় যেখানে স্বীকৃত হবে যুদ্ধস্বর, অপর, মিশ্রসংস্কৃতি, পপুলার কালচার, ভোগ্যপণ্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি?

আমরা কবিতাকে শৈল্পিক সৃজনকাজ বলেই ধরে নেব এবং কবিকে ভাবব এর স্রষ্টা – অধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, মানবিক কর্তৃসত্তা  হিসেবের প্রতীচ্যের তাত্ত্বিক পল দ্য মান (১৯১৯-১৯৮৩) সাহিত্যের ‘অগসত্ম্য যাত্রা’র (সালাউদ্দিন, ২০১৮) পথ তৈরি করেছিলেন, অস্বীকার করেছিলেন আর্ট ও নান্দনিকতা। আমরা বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে বলব যে শিল্পসাহিত্য সৃষ্টিকাজটি মানুষের অপরিহার্য ও আবশ্যকীয় মৌলবৃত্তি, তার elan vital, elemental force of mind, তার সত্তার সরব-নীরব অস্তিত্ব। কেননা আমাদের জীবনে ইতিহাসের অবসান ঘটেনি এবং এখনো ইতিহাস বিনির্মাণের ধারাবাহিকতা চলমান – অন্তত, জাতিতাত্ত্বিক সত্তার বয়ান তো এখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোরই দায়-দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। এই ইতিহাস প্রাকৃতায়নে, সমাজ-সময় প্রতিবেশে এবং মানবিক বীক্ষায় তৈরি করে চলছে মানুষেরা। আর কবির আত্মপটও এই সময়-ইতিহাসের অংশ ও উৎসরণ হয়েই থাকছে।

এই আমি’র স্বরূপ নিয়ে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ কী বলছে দেখা যাক :

আম (সীমায়িত গতির আশ্রয় যাহাতে)-এর গতিশীলতা যাহাতে (সেই সত্তা বা ব্যক্তি)র … অহং বা তেজের একটি রূপ হল আম। সেই আম-এর যখন আত্মোপলব্ধি ঘটে, তখন  তার প্রকাশ ঘটায় ‘আমি’ বলে, আত্মস্বরূপের এই ‘ব্যক্ততার’ কারণেই সে ব্যক্তি।

(কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, পৃ ৪১)

অর্থাৎ ব্যক্তি-আমিই সময়-ইতিহাস-সমাজলগ্ন হয়ে সত্তাধারী হয় এবং থাকে পরিবর্তনশীল জগৎযুক্ত। প্রতিমুহূর্তে এই সত্তা জগতের সম্মুখীন হয়, অপরের সান্নিধ্যে-সংঘাতে আসে অর্থাৎ ‘আমি’ অবশ্যই জগৎ-অভিমুখী আর একই সঙ্গে সৃজনশীল ভাবুক। এই সৃজনশীল আমি’ প্রথমে থাকে অভিজ্ঞতাতীত যা প্রতি পদে অভিজ্ঞতাধ্বস্ত ‘আমি’র সম্মুখীন হতে থাকে, দ্বান্দ্বিকতায় বিশিস্নষ্ট/ সংশিস্নষ্ট হতে থাকে। এই আমির স্থানিকতা আছে (spatial of situation), যা ঠিক বস্ত্তর অবস্থানগত স্থানিকতার মতো নয়। ‘আমি-সত্তা’ বস্ত্ত ও মানবাভিজ্ঞতার মধ্যদিয়েই অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং একই সঙ্গে অর্থ তৈরিও করে। এই হয়ে ওঠাই সার্ত্রের being যা আসলে চেতনক্রিয়াই শুধু নয়, নিজেকে আবিষ্কারেরও শর্তযুক্ত। এই চেতনক্রিয়া (conscious act) নিজেকেই আবার অন্বেষণের বিষয় করে। আর এটাই শিল্পসাহিত্যের রূপাঙ্গিকে ‘আমি’ রূপে বিম্বিত হয়, শিল্পের পারসোনা – এই নামে সংজ্ঞায়িত হয়।

 

প্রতীচ্যের পোস্টমডার্নিজম, ডিকনসট্রাকশন, ডেথ অব দ্য অথর – ইত্যাকার তত্ত্ব উত্তর-আধুনিক পরিসরে ঢুকে আছে। বিশ শতকের নববইয়ের দশকে যার একটি স্থানীয় রূপ ও চর্চার ধারা দেখা গিয়েছিল। যেখানে অন্তর্বয়িত হয়েছিল প্রাকৃতায়ন, আধুনিক-পূর্ব ঐতিহ্য, লোকায়ত আঙ্গিক, ভাষা এবং কবিতাকে টেক্সট ভাবা শুরু হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি কি একুশ শতকের গত দুটি দশকে অব্যাহত আছে? উত্তর-আধুনিকরা আত্মসত্তাকে স্বীকার করতে চায়নি – এ-কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তির আত্মপরিচয় ও ‘এক্ষণ’কে মেলানোর প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ‘আমি’ সত্তার পরিচিতির ক্ষেত্রে শ্রেণি পরিচিতি ছাড়াও সামাজিক নির্মাণের ক্ষেত্রে এখন লিঙ্গ, প্রজাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, বৃত্তি ইত্যাদি সূত্রের গুরুত্ব বাড়ছে। এখন আর আত্মসত্তা কোনো বিশুদ্ধ বিষয়ী হয় না, তা হয় বহুমিশ্র, সংকরধর্মী; এমনকি যন্ত্র ও প্রযুক্তিকেও প্রভাবক হিসেবে সত্তার অন্তর্গত করা হচ্ছে। বস্ত্তত এখন আত্মপরিচয় এমন একটা ‘বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া’ যার স্বীকৃতি রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত। আমরা এখন অনেক বেশি রাজনৈতিক-সত্তা। এ অর্থেই ’৪৭-৭১-এর কবিরা আত্মপরিচয়ের খোঁজে বা বিনির্মাণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-
সাংস্কৃতিক বলয়ে বিচরণশীল ছিলেন। আধুনিকতার যেসব  লক্ষণ যেমন রাষ্ট্র সিভিল সোসাইটি আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য – তার পালা এখনো ফুরায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান শতকে এসব কীভাবে কবিতাগত হচ্ছে? কোন তাৎপর্যে? কতটুকু নান্দনিকতায়? কী শিল্পধরনে? এটাই আমাদের বিবেচ্য।

লক্ষণীয়, কয়েক বছর ধরেই আত্মপরিচয়কে তত্ত্ববিশ্ব (conceptual world)-এর বিষয় হিসেবে আর দেখা হচ্ছে না, বরং কথনবিশ্ব (narrated world) রূপে দেখা হচ্ছে। কবিতাও কথনক্রিয়া,
তা আর অলৌকিক রসের উৎসারণ নয়। (প্রলয়ঙ্কর, ২০১৮) ফুকো তাঁর ‘(the culture of for the self)’ বক্তৃতায় ১৯৮৩
সালেই স্বীকার করে বলেছিলেন আত্মসত্তার সামাজিক নির্মাণ এবং ব্যক্তিগত মৌলিকতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই গড়ে ওঠে বর্তমান। তারই জের টেনে বর্তমানে দেখা হচ্ছে আমি-সত্তার এই সামাজিক নির্মাণের সঙ্গে আরো বহু প্রকরণকে জড়িয়ে পরিবর্তনশীল বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করে। এটা অভিনব কোনো কথা নয়। ব্যক্তি কীভাবে তার আত্মপরিচিতি খুঁজে পেতে পারে তার সন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখব যে ‘আমি-সত্তা’ বিশিষ্ট প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যুত্তরের উৎস।’  অর্থাৎ উৎসারণ নয়, উৎস। প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যুত্তয়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকে আমি-সত্তার গঠন, মানবিকতা, কেন ও কীভাবে সে প্রতিক্রিয়া ধারণ করছে, কীভাবে প্রত্যুত্তয়ের উৎসকে ভিতরে লালন করছে! প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মুক্ততার দিকটি কী হবে? কারণ মুক্ততাই তো কবিতার অভিপ্রায়! এই ক্ষেত্রে কবি আশ্রয় করেন ‘প্রত্যাখ্যানের কবিত্ব’ এবং নীরবতার বলয়ে নিজেকে গোপন করেন। এই ধারা তো আমাদের কবিতায় দীর্ঘকালীন, সেই চর্যাপদ থেকেই। যতই রূপক, প্রতিরূপক বা প্রচ্ছদাশ্রয়ে আত্মগোপন করা হোক না কেন আমি-সত্তাকে শেষ পর্যন্ত সামাজিক বিনির্মাণের সঙ্গে লিপ্ত থাকতেই হয়। প্রত্যাখ্যান ও নীরবতাও একভাবে সামাজিক অন্বয়-অনন্বয়ের যুগপৎ প্রেষণা। কবিতার এটাই হচ্ছে অশেষ দ্বান্দ্বিকতা, ক্রিয়াশীল বাস্তবতায় সৃজনশীল থাকার যূথবদ্ধ সংলগ্নতা।

যেহেতু আমি-সত্তার আকার গঠন করে দেয় – লাকঁরে মতে, আমাদের ভাষাকাঠামো, মূর্তমান ভাষার গঠনের মধ্যেই ওই সত্তা নিজেকে চিনে নয়, সনাক্ত করে, ভাঙচুর করে। তাই আমি-সত্তা সর্বদাই সংঘাতশীল থাকে, তা কোনো ‘শাশ্বত; সর্বজননীন সারসত্তা নয়।’ বিশুদ্ধ অহংও নয়, জগৎও নয় আর বিশুদ্ধ বিষয়। অর্থাৎ উত্তর আধুনিকদের ভাবনায় আমি-সত্তা সর্বদাই অস্থির, অনির্দিষ্ট, অস্বীকৃতি ও বিচ্যুাতর মধ্য দিয়েই নিজের পরিচিতিকে হন্যে হয়ে খোঁজে। আবার লৈঙ্গিক  সূত্রে পুরুষের আমি-সত্তায় ফাঁক থেকে যায়, যেহেতু নারীর ব্যক্তি-সত্তার প্রশ্নটি সামাজিকভাবে শূন্য বা অস্বীকৃত থাকে। পুরুষের আমি-সত্তার পরিচয়ে থাকে দখলদারিত্ব, উচ্চমন্যতা ও ভোগের মনস্তত্ত্ব-যা উৎসারণ  সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রবাহ থেকে। প্রশ্ন উঠছে, নারীর আত্মপরিচিতি কী এই উচ্চমন্যতার সংস্কৃতিকে মেনে নিয়ে বিকচ হতে পারে? আমরা কবিতার আমি-সত্তা নিয়ে কথা বলছি বটে, তবে এর বলয়ে যে পুরুষসত্তা, শ্রমজীবীর সত্তা, নারীসত্তা, ধর্মসত্তা ইত্যাকার বর্গ (যার কথা আগেই আমরা বলেছি) রয়ে গেছে তার সঙ্গে বোঝাপড়া বা সমন্বয় কীভাবে হবে? কারণ কবিতার আমি-সত্তা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হলেও নিজেকে যখন সাবজেক্টরূপে দেখে তখন অন্যান্য বর্গের অবস্থান কি অবজেক্ট রূপে দেখা দেয়? পুরুষরচিত কবিতায় নারী তো অবজেক্টরূপেই প্রতীকায়িত হয়।

এখানে আমাদের ক্লাসিক্যাল আত্মসত্তার একপাক্ষক্ষক জ্ঞানতত্ত্বের ‘শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক নির্মাণ-পদ্ধতি’ থেকে সরে আসা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ভাবতে হবে আমি-সত্তায় বহুমাত্রিক প্রক্রিয়াকে, বহুবর্ণিল প্রকাশকে, নানা বর্গের সঙ্গে সম্পৃক্তায়নের জটিলতাকে। অর্থাৎ বর্তমানপটে আমি-সত্তার যেমন আছে বহুরকম লগ্নতার দায়, তেমনি আছে সংঘাতেরও সমস্যা, এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো এবং একের সঙ্গে অন্যের পারক্যবোধ। ‘উচ্চ-নীচ বা উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট ভেদ’  সমাজে  আজও কর্তৃত্ব  করছে। তার ওপর আত্মসত্তাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গেলে এই পণ্যনির্ভর ভোগবাদী সমাজে-আমরা আমি-সত্তার কোনো বিশুদ্ধ রূপ খুঁজে পাব না, আসলে বিশুদ্ধ বলে কিছু হয় না। একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতায় এইসব বর্গ, উচ্চ-নীচ বোধ, পরস্পরের মধ্যে প্রতর্ক, ক্ষমতাদ্বন্দ্ব, জাতিসত্তা-ভাষিক পরিস্থিতি ইত্যাদি প্রসঙ্গের যে অন্তর্ঘাত আছে, জঙ্গমতা আছে তাতে আমি-সত্তা পিছলে যাচ্ছে কিনা তাও ভাববার বিষয়। আমরা মনে রাখব যে আমি-সত্তা কোনো প্রতিবর্তী সত্তা নয়, তা ব্যক্তিরই ব্যক্তিত্ব-নির্মিতির রূপ, তার নানা প্যারাডাইমের জটাজাল।

 

চার

তাই কবিতায় লক্ষ করা যায় দোদুল্যমানতা, আমি যেন নিরুপায় হয়ে হতে চায় আমরার সঙ্গে ঐকাত্ম্য, কারণ  এছাড়া তাঁর সংযুক্তির অন্য পন্থা নেই। একটি উদ্ধৃতি;

গরম ভাতের ভেতর বাঁশবনের লুকানো ছায়া

একটু একটু করে বাড়ছে

…   …   …

ভাতের ওপর লাফ দিয়ে চড়ে বসেছিল শর্তহীন দুঃশাসন

…  …  …

অনন্ত কাল ধরে জ্বলছে যে চুলা

আমরা তার নির্বাক দর্শক ব্যতীত নিকটাত্মীয় নই –

আমাদের একদিকে ক্ষুধা অন্যদিকে অগাধ ক্ষমতা

মধ্যপ্রাচ্যের রাখাল কিংবা নির্মাণ শ্রমিকের মতো

সম্মুখে সদা দোদুল্যমানতা

(ওবায়েদ আকাশ, ‘দোদুল্যমানতা’)

এখানে আমি-সত্তা আমরার মধ্যে দ্রবীভূত, ক্ষুধা ক্ষমতার আদিসত্যের কাছে সমর্পিত, চিহ্নক হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাখাল, নির্মাণ শ্রমিক উন্নয়নের প্যারাডাইম। আমি-সত্তা এখানে একদিকে সভ্যতার শিকার, আরেকদিকে নিরুপায় দর্শক। আরেক ধরনের কবিতায় দেখি কবিতার উড়াল পাখিকে খুঁজে ফেরার মরমি কাব্যকুহক ও তার রহস্য উন্মোচনের ডিকশন, সেখানে আছে নান্দনিক আমি-সত্তার দৃষ্টিলোক;

… কিন্তু আমি তো ডেকেছি তাকে সারাজীবনের

দুঃখের জাঙ্গাল ভেঙে প্রান্ত থেকে প্রামেত্মর ভিতরে

সে দেয়নি ধরা পেছন সে ফেরেনি বারেক

তবু তার নাম বলে কিছু নেই। আছে অস্পষ্ট মুখাবয়ব, ধবল

রকমের অস্পষ্টতা কুয়াশা আড়ষ্ট চুলে

হাসিশূন্য ঠোঁট হয়তো হেসেছে হয়তো বা কখনোই হাসেনি

…  …  …

বোধ হয় তাই সে উড়াল পাখি

জনমের হিজিবিজি

পাখি তুই যে আমার…

(বায়তুল্লাহ কাদেরী,  ‘কাব্যকুহক’)

 

এ হচ্ছে একালীন কাব্যপ্রেরণারূপী উড়াল পাখিকে নিয়ে মরমি ভাবনা। এর অনুষঙ্গে যেন চকিতে উঁকি দেয় আমাদের বাউল গানের দ্যোতনা। কবিতাপাখির খোঁজে কবির পারসোনা অবশ্য রূপক ভেঙে দিয়ে স্বকীয় হতে চাইছে নিজের ডিকশনে। কবিতার রহস্যবর্ণিল সেই বহুকালীন ভাবনারই নতুন করে উদ্বোধন ও রূপশোভা তৈরি হলো। অথচ উলিস্নখিত কবির লোহিত প্রজন্ম কাব্যগ্রন্থ কিংবা আমি পক্ষেগোত্র নামের অগ্রন্থিত পা-ুলিপির অংশ কবিতায় (কবিতাগুলি গ্রন্থিত হয়েছে তাঁর কাব্যসমগ্র (২০১৭) গ্রন্থে আত্মসত্তার চিহ্নক হয়েছে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্যারাডাইম। প্রজন্ম লোহিত কাব্যের দীর্ঘ কবিতামালা জুড়ে আছে মানুষ-প্রজাতির বাসস্থান এই পৃথিবীর ক্রমায়ত লোহিত বর্ণ-ধারণের কথনবিশ্ব – মঙ্গলগ্রহের মতো মৃত গ্রহে পরিণতির শঙ্কা ও সতর্কতা। আবার নিজেদের জাতিসত্তার প্রশ্নে কবি কীভাবে নিজ প্রজন্মকে দেখেন?

একজন আমি

ক্রীতদাসে পুরিপূর্ণ

ঘর

অসংখ্য রোদের মাথা ককেশীয় কর্কশের ছায়া,

কলোনির কলতানে কালো সৈনিকের নড়াচড়া

ঝিমধরা মাঝি ঝিরঝিরে পানি ভেঙে

উদাস নৌকাকে

বলস্নরিত চুলিস্ন করে –

ঢোকায় তামার বৈঠা,…

(বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, ‘প্রজন্ম লোহিত’)

 

যন্ত্রবিজ্ঞান ও পরিবেশের বৈকল্যে একজন ‘আমি’রূপী  মানুষ যেন হয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বহীন। দুঃখভারে বিপর্যস্ত, পৃথিবীর জন্যে কবি শঙ্কিত – ‘দুঃখ হোক দুন্দুভির মতো অতি উচ্চ/ উচ্চ হোক দুঃখের মতো লঘু-পুচ্ছ/ রকেটের টেরিকাটাচোখ/ মানবীর প্রণামে পচুক/কালীদহগ্রহে।’ প্রনাম ও কালীদহ শব্দে ঐতিহ্যিক লগ্নতা আছে, আছে ‘মানবী’ অনুষঙ্গে মুক্ততার অভিলাষ, পুরো কাব্যটি বিচিত্র ভাবতবঙ্গের আবর্তলীলা – আমরা শুধু ইঙ্গিত করছি কবির চিন্তা ও পারসোনার দিকে। অতিপ্রযুক্তি আর জীবনের বিরোধ নিয়ে কবি যেন ওরাকল উচ্চারণ করছেন বর্তমান-বেদিতে দাঁড়িয়ে। তেমনি আমি পক্ষেগোত্র; কাব্যেও পাই আমি-সত্তার স্থানিক-ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পটে নিজের পরিচিতিগত অস্তিত্ব হারিয়ে পাখির মতো এক ডাল থেকে আরেক ডালে বাস করার বাস্তবতা – আমি পক্ষেগ্রোত্র

… দেখুন দিকি আবারো

 

আবারো ওড়াল/ একই গাছে … পুচ্ছ তুলে … পায়ু, দেখিয়ে আবারো ওড়াল …।’ জাতিগত আত্মপরিচিতির ধারাবাহিক বিলগ্নতাই এখানে পরিস্ফুট। এভাবে ব্যক্তি তার পরিচয় হারিয়ে উন্মূল হয়, তার
স্থান-চিহ্ন, সংস্কৃতি ধর্ম এলোমেলো হয়ে যায়। এসবই বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। জীবনের স্বাভাবিক বিবর্তন নয়। কবিতার পারসোনা যেমন অতীতে নীড় নারীশস্য হারিয়ে উদাসীন বা পলায়ণপর হয়ে বাস্তবতা থেকে চলে যেত মরমিয়া জগতে, যেমনিটি আমরা বলি আবহমান প্রকৃতি বা ঐতিহ্য তাতে রয়ে গেছে কত ক্ষতি-ক্ষত লাঞ্ছনা, কত রক্ত পিচ্চিল পদচ্ছাপ, কত বিলগ্নতা। (দ্রষ্টব্য, আকতার, ২০০৫), তেমনি করে একুশ শতকের
আমি-সত্তা সেই ইতিহাসকে বুঝে নিয়ে এখনো আত্মপরিচিতির দ্বিধায় যখন দিশাহীন হয় কবিতার পারসোনা তখন শুধু আর বর্তমানে, দৈশিক হয়ে থাকে না, তা যুক্ত হয়ে যায় মিথে, সংস্কৃতিতে, বিশ্বায়নের ডামাডোলে, যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে। কাজেই শুদ্ধসত্তার দার্শনিকতা এখন অনেকটাই নির্লক্ষয়, এমনকি যাঁরা আঞ্চলিক ভাষার মরমিয়া কবিতার ধারায় এখনও কবিতা লিখছেন তাঁদের মধ্যেও মরমিয়ার আঙ্গিকটাই প্রধান, সত্তা নির্মাণের গন্তব্য বিদিশাগ্রস্ত। তবে পথের দিশা নিয়ে কবিদের ভাবনা অবসিত হয় না কখনো। এরকম কবিতা লেখেন মুজিব ইরম, এমনকি অগ্রজ কবি মহীবুল আজিজকেও দেখি একুশ শতকে এসে লিখলেন – ভরসানামা নামের কাব্যগ্রন্থ। চলিস্নশটি বয়াৎসদৃশ কবিতায় তিনি ‘গুরু’র রূপকে আত্মদর্শননামা রচনা করেন যেখানে ব্যক্তি-আমি গুরুর কৃপাপ্রার্থী, এই গুরু কী  কোনো এক ‘তুমি’?

 

উত্তর নাই দক্ষিণ নাই শূন্য হস্তখানা,

গুরু আমায় বলো, কোনটা সঠিক কোনটা মানা\

 

আমি তোমায় ভুলে দেখতে গেলাম রঙের দুনিয়া,

আকাশ ছুঁইতে গেলাম প্রাণ-বন্ধুর লাগিয়া।

দিলটা আমার হইলো ফানা-ফানা।

গুরু আমায় বলো, কোনটা সঠিক কোনটা মানা।

আমি সোনা ভাইব্যা চান্দি কিনলাম খোলা বাজার থেইক্যা,

এখন শিক্ষা হইলো মরণ-ফাঁদে ঠেইক্যা।

শূন্য হইলে আমার বালাখানা।

গুরু আমায় বলে, কোনটা সঠিক কোনটা মানা\

(‘গুরুদক্ষিণা’)

 

এই গুরু আর কিছু নয়, কবির আমি-সত্তার আত্মদর্শী অভিধা মাত্র। কবির সকল যাপন শেষে শূন্যতা দর্শনে গুরুর
শরণপ্রার্থী হয়। আঙ্গিকটা আঞ্চলিক ভাষার ওপর দাঁড়ালেও কবিতার পারসোনা এখানে সত্তাজিজ্ঞাসু। শূন্যতার যে-দর্শন প্রতিস্বরিত হয় তা কি বৌদ্ধবাদী শূন্যতা? না-কি উত্তরাধুনিক শূন্যতাদর্শ?। এই কাব্যগ্রন্থটি কবির কাব্যিক ব্যায়াম মাত্র নয়, ঐতিহ্যমান্যতা ও আত্মার পরিচয় সন্ধানকল্পও বটে।

 

পাঁচ

আধুনিকেরা আবিষ্কার করেছিল আমির বিকল্প রূপে নানা ইজম। পরাবাস্তববাদ তেমনি এক শক্তিশালী, অপ্রতিহত ইজম যা আজো কবিতায় চর্চিত। যে দুর্বোত্যতার অভিযোগ উঠেছিল আধুনিকতার বিরুদ্ধে, বিশেষ করে পরাচেতনার পরাক্রমে, যা যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবতাকে তছনছ করে অবচেতন আর নির্জ্ঞান অতলে প্রবেশ করেছিল, যা দেখি জীবনানন্দের কাব্যময়তায়, তার সুচারু দৃষ্টান্ত একুশ শতকেও দুর্লভ নয়। পরাচেতনা স্বয়ংক্রিয় লিখন ও তা দৃশ্যমান রূপজগৎকে ভাঙে। বিগত ষাটের দশকে সচেতনভাবে পরাবাস্তব কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। অদ্ভুত, কিমাকার, বিসদৃশ উপমা-উপমানের মধ্যেই তাঁর সচেতন কবিতা লিখন সক্রিয়
থাকায় প্রকৃত পরাবাস্তবের চেতনারূপ তাতে ফোটেনি। একুশ শতকে দেখি, এমনকি নববইয়ের দশকেই শুরু, কবি চঞ্চল আশরাফ পরাবাস্তব কবিতার দুর্বোধ্য জগৎকে নান্দনিক ক্রিয়ার অংশ করে নিচ্ছেন, তাঁর মধ্যে অদ্ভুত বিকট চিত্রচ্ছবি নেই, বরং কথনবিশ্বের পরাজগৎ সৃষ্টির প্রয়াস আছে, যেখানে তিনি কখনো আমিহারা হন না। শূন্যতা এবং নিজের ডিকশনে শব্দের ইউনিট গড়ে তোলেন, বলা যায় ভিন্ন সংস্থান রচনা করেন। একটি উদাহরণ :

 

সেখানে ভোরের জন্য অনিদ্র জানালাগুলি হাওয়ার ম্যান্টেল হয়ে

দূর-উঁচু আকাশের গায়ে লেগে থাকে

তার আলোর তলায় পাহাড়ের কম্পন, উপত্যকায় লুণ্ঠিত সিসিফাস,

শিশুর পেচ্ছাপ ত্বকে মেখে আয়নায় ডুবে থাকা রূপসীরা,

সেই ভিড় থেকে আসো তুমি, চলে যাও বিকেলের ট্রেনে চেপে

তোমার সঙ্গে আমি স্টেশনে যাই, দেখি রেললাইন গোধূলির

দিকে

 

হয়েছে উধাও

মধ্যাহ্নের শেষ সোনালি পাথর হলো আকাশে আকাশে

স্নায়ুর ভিতরে রহস্যের ডাক;

(‘অনিদ্র জানালা’)

 

আমির অভিমুখ তুমির দিকে ফেরানো, আমিই কর্তৃসত্তা – তুমির অন্বেষণে রূপসীর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে-আসা নিজের রূপসীকে দেখেন। আদৌ কি দেখেন? তার স্নায়ুর ভিতরের রহস্য আমিকে তাড়া করে – বীভৎস চিত্রকল্পে নয়, মধ্যাহ্নের সোনালি মেঘের রূপচ্ছবিতে। কিন্তু সে মেঘ আকাশ জুড়ে পাথর হয়ে যায় আর আমি-সত্তা সে-চোখের পাথরে তার প্রথম ক্রন্দনকে ন্যস্ত করে। জলের উৎসাহ, অরণ্যের আলোড়ন, হারানো ঘুড়ির গল্প এবং অনিদ্র জানালা – এরকম
রূপক-সমাসোক্তির ইউনিট রচনা করে করে কবি তাঁর ‘প্রথম ক্রন্দন থেকে সব’ মেঘপাথরে গচ্ছিত রাখেন। এখানে রূপকের নির্মোকে আসলে অনিদ্র স্নায়ুম-লি নিয়ে কবিতার পারসোনা ‘তুমি’র জন্যে রচনা করে পরা-অপরা দৃশ্যচ্ছবি – ‘নশ্বর পাতায় আঁকা অমরতার দৃশ্যরাশি’ শেষ পর্যন্ত তুমিকেই দেওয়া হলো। কবিতাটি দীর্ঘ, সবটাই কবির কথন আর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ঘোরাফেরার অন্তর্মুখী, নিবিড় সাঙ্গীতিক উচ্চারণ। স্নায়ু ও ফেনোমেনাকে কীভাবে বিভ্রমের আতশকাচের তলায় রেখে কবিতার ডিকশন রচনা করতে হয় তা যেন এই কবিতাটিতে রূপান্বিত হলো। তাঁর ভাষা প্রাণ-রাসায়ণিক, কখনো সাইকিক।

কখনো-বা আমি-সত্তা ‘তুমি’র মধ্যে নয়, নিজেরই প্রকৃত গন্তব্য মনে করে ও ঘর খুঁজে বেড়ায়। অনেক সন্ধান, অবিরাম চলায় সে কী কখনো পৌঁছায় কোথাও! না কী নিজেকেই হারায় অথবা ভুল-সত্তার মুখোমুখি হয় বারংবার? উত্তর-আধুনিকেরা বলছে সত্তাকে কোথাও পাওয়াই যায় না, সত্য দর্শনের মুহূর্তে হয়তো ব্যক্তি দেখে সে অন্য ঠিকানায় চলে গেছে, নিজেরই মতো অন্য কাউকে দেখছে, অথবা সেই গন্তব্যে পৌঁছাতেই পারছে না; পারলেও নিজের প্রতিরূপ দেখে সেখানে – দার্শনিক হাইডেগার সত্তার সত্যদর্শনের জন্যে যে মুহূর্তের মুখোমুখি (gaze) হওয়ার কথা বলেন সেই সময়টি যেন এখন আর পাওয়াই যায় না। বিশেষ মুহূর্তটাই তো অনিশ্চিত :

 

বাড়ি ফিরছি –

কুয়াশা উড়াতে উড়াতে,

আসলে বাড়ি নয়, গন্তব্যে

গন্তব্যে ফিরছি কত বছর ধরে

একা, একদম একা।

 

আসলে গন্তব্য নয়, ফিরছি অনির্দিষ্ট এক ঠিকানায় –

এই ঠিকানাটা কেউ একজন ভুল করে ফেলে গিয়েছিল,

আমি হয়তো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম,

সেই ঠিকানাটা নিজের ভেবে

আমি যাত্রা শুরু করেছি…

 

কার দিকে যাত্রা? মানুষ কি তবে ভুল ঠিকানা লেখা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে? সেই ঠিকানা কি কোনো এক ‘তুমি’র দিকেই যাত্রার দিশায় কবিকে পথে নামায়? কবিতাটির শেষে একজন ভুল তুমিকেই নিজের ‘তুমি’ বলে বিভ্রান্ত হয়।

 

এরপর ফিরতে থাকি নিজের কাছে

আমিও শেষ পর্যন্ত ফিরছি নিজেরই কাছে

সেটাও কয়েক লাখ বছর যাবত

ফিরতে ফিরতে হয়তো যাকে আমি নিজ ভেবেছি সেও আর

নিজ থাকবে না

হয়ে যাবে অন্য কেউ।

(মিহির মুসাকী, ‘আমি অন্য কারো হয়ে কথাগুলো বলছি’)

 

কবিতাটির শিরোনামই ইঙ্গিত করে, পারসোনা কখনো এই আমি-সত্তাকে পাচ্ছে না। এই সন্ধান, যাত্রা, আত্মার অভিমুখিতা – সবকিছুর মধ্যে অন্তর্নিহিত ঐতিহ্যিক মরমিপনা আছে, তবে তা যেন উত্তর-আধুনিক সত্তা-দর্শনের অনির্দিষ্টতায় আপতিক। এ সূত্রেই নববইয়ের এবং একুশ শতকের দুই দশকের কবিদের কারো কারো মধ্যে ঐতিহ্য-সংস্কৃতির রূপান্তরিত ব্যবহার লক্ষণীয়। কিন্তু তাতে মিশে থাকে হাইডেগার-কথিত গেজ, আত্মসত্তা-দর্শনের মুহূর্ত। জীবনানন্দ হাজার বছর পথ হেঁটে বনলতা সেনকে অন্ধকারপটে দেখতে পেয়েছিলেন। সেটা ছিল আধুনিকতার অভিলক্ষ্য, অনুসন্ধেয় চিত্রবোধি। একুশ শতকে কবি তার যাত্রা ও যাপনে অন্য কোনো ভুল সত্তা হয়ে যান। নিজের প্রকৃত সত্তার দেখা কখনো পান না। কোনো ‘তুমি’কে তো পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উত্তর-আধুনিকতায় এটাই বলা হচ্ছে যে আমরা ভিন্ন পথে, ভিন্ন গন্তব্যে বা গন্তব্যহীনতায় চলে যাই মাত্র। সত্তার মুখশ্রী কখনো অবলোকন করা যায় না, সত্তার রূপ অবৈকল্য নয়, তা বহুমিশ্র, বহুলভাবে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই কবিতাটি সারল্যমাখা দ্যোতিত করছে আমি-সত্তার অনিশ্চয়তার অনির্দিষ্টতা – তার কোনো পুরাণ নেই, ইতিহাস নেই, নেই কোনো বিশুদ্ধ আমি নামের মরীচিকা দর্শনের ইলিউশনও।

তবু কি আমি-সত্তা তিরোহিত হয়? না, তা ইতিউতি দানা বাঁধতে চায় নানা রূপক-প্রতিমায়-সংস্কারের অভ্যাসে। নিজেকে স্থাপন করে নানা ভঙ্গিমায়, বহুতলিক হয়ে উঠতে চায় – কখনো শব্দমোহে, কখনো কাব্যিক সংস্কারবোধে। শব্দার্থের বিপর্যয় আর শব্দসম্মোহে কখনো আমি-সত্তা কবিতা লিখনে সচেতনভাবেই প্রয়াসী হয়েছে। সারল্যকে কঠিন করে তোলার চেষ্টা লক্ষ করা যায়, যিশুর মতো আত্মনিগ্রহের উচ্চারণও শোনা যায়। এতে বর্তমানতা আছে, নেই আমির প্রসারণশীলতা, প্রায়ই মেটাফোর মেটানমি হয়ে যায়। থাকে শুধু আমি-সত্তার বিপরীত বাস্তবতায় সৃজনশীলতার আক্ষিপার্তি। কোনো ভিশন বা দার্শনিকতা সত্তাজিজ্ঞাসা নেই, নেই সাইকিক ভাষা।

 

এই আলোচনায় আমরা একেবারে অধুনাতন প্রতিভাশীলিত, সম্ভাবনায় প্রজ্বলিত কবিদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিনি। সে-আলোচনা বারান্তরে। শুধু এটুকু বলা যে, জাতিসত্তার আমিত্ববাদী প্রকল্প থেকে কবিরা এখন সরে এসেছেন মুহূর্তের ন্যানো আঙ্গিকে, কথনবিশ্বে, শুধুই কবিতার শিরদাঁড়ায়, যেখানে আমি-সত্তার একক দখলিস্বত্ব আর দাবি করা হচ্ছে না। প্রশ্ন এই, তবু কী পারসোনা নেই? আছে, দিনের আলোর গভীরে রাতের তারার মতো বা জীবনানন্দের বিকেলের নক্ষত্রের মতো কোনো না কোনো দৃশ্যান্তরে – যা কোনো কেন্দ্রে পুঞ্জীভূত নয় – আকাশময় ছড়ানো।

 

গ্রন্থপঞ্জি

১. সালাউদ্দিন আইয়ুব, পল দ্য মান : সাহিত্যের অগসত্ম্যযাত্রা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০১৮।

২. কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী সম্পাদিত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ভাষাবিন্যাস, কলকাতা ১৪১৭।

৩. বেগম আকতার কামাল, কবিতার নান্দনিকতা প্রাচীন ও মধ্যযুগ, প্যাপিরাস ঢাকা ২০০৫।

৪. প্রলয়ঙ্কর ভট্টাচার্য, ‘আত্মপরিচয়ের দিগদিগন্ত : একটি দার্শনিক প্রতিবেদন’ (প্রবন্ধ), বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা, বাংলা বিভাগ যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বাবিংশাশতি সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৮।

৫. Michel Foucalty The Archeology of Knowledge, Editions Gillimard, 1967.

৬. Martin Heidegger, Being and Time, trns, John Macquarie, John Stanbaugh, 1927.