ছিটকিনি : একটি চারু-চলচ্চিত্র

ছি টকিনি – সাজেদুল আউয়াল-নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তিনি একজন অগ্রজ চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। এদেশের
নাট্য-আন্দোলনেও রয়েছে তাঁর দীর্ঘ পরিক্রমা। তাঁর রচিত প্রথম কাব্যনাটক ফণিমনসা। ১৯৮০ সালে নাটকটি মঞ্চায়নকালে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল, যার রেশ এখনো রয়ে গেছে। এদেশে চলচ্চিত্র-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রভূত অবদান। চলচ্চিত্র-বিষয়ে রয়েছে তাঁর অনেক গ্রন্থ, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাঁর পিএইচ.ডি পর্যায়ের অভিসন্দর্ভ ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র : সমাজবাস্তবতা ও নির্মাণভাবনা। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে ২০১২ সালে। বর্তমানে তিনি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ এবং বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে।

চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর সূচনা ১৯৯৯ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্ভানার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘ সময় নিয়েছেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র নির্মাণে। ২০১৭ সালে তিনি নির্মাণ করেছেন ছিটকিনি – নিজের কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্যে। ছিটকিনির কাহিনিরেখার ধরন-গড়ন দুই-ই একটু ভিন্ন রকমের। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সর্বপ্রামিত্মক জনপদ পঞ্চগড়ে জমি খুঁড়ে পাথর আহরণ-সংক্রান্ত অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এর আখ্যানভাগ – যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক, লোকজ ও নির্মাতার ব্যক্তিগত কিছু অনুষঙ্গ। সাজেদুল আউয়ালের দক্ষ তদারকিতে সবকিছু মিলেমিশে যেতে পেরেছে নির্মিত চলচ্চিত্রের শরীরে। তাতে করে চলচ্চিত্রটি হয়ে উঠেছে কিছুটা ‘সিনেমা ভ্যারিতে’ ও কিছুটা ‘নব্যবাস্তববাদী চলচ্চিত্রধারা’ সংবলিত। এই ধারাদ্বয় প্রধানত দাবি করে, স্থানীয় কাহিনি-দ্বন্দ্ব-সংলাপ, লোকেশন শুটিং, ঘটনাকে প্রামাণ্যকরণের প্রচেষ্টা, প্রাকৃতিক আলোতে দৃশ্যধারণ, টাইপেজ চরিত্রের ব্যবহার, অপেশাদার অভিনয়শিল্পীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি – যার প্রায় সবই আলোচ্য চলচ্চিত্রে পরিলক্ষ্যেত হয়।

এ-চলচ্চিত্রে পাথর উত্তোলনের প্রেক্ষাপটে ওপরের স্তর থেকে    তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অথনৈতিক যে-বিসত্মৃতি তার ডিটেইলস আমরা যেমন পাই, তেমনি পেয়ে যাই এই অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে সরকারি সহযোগিতা-অসহযোগিতা, দুর্নীতি, পুরনো পরিবহন ব্যবস্থার (রেল) বিকল্প হিসেবে নতুন ব্যবস্থার উত্থান এবং সংশিস্নষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার নিত্যনৈমিত্তিকতা। তাছাড়া এক বিধবা নারী-পাথরশ্রমিক ময়মুনা ও পঞ্চগড় রেলস্টেশনের যক্ষ্মাক্রান্ত এক কর্মচারী কফিলের পরস্পরের কাছে আসার আকুতির কাহিনি তো আছেই। অনেকটা যেন ডকুমেন্টেশনের মোড়কে ফিকশন অথবা ফিকশনের মোড়কে ডকুমেন্টেশন। নির্মাতার সমাজসচেতনতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। এ-কারণেই আমরা চলচ্চিত্রের কাহিনিরেখা বিস্তারের পাশাপাশি পঞ্চগড়ের চমৎকার নিসর্গ ও পারিপার্শ্বিকতার ডিটেইলসের চিত্রায়ণ দেখতে পাই ছিটকিনিতে।

ছিটকিনি উপকরণটি নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে চিন্তা-উদ্রেককারী কিছু বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন নির্মাতা। যেমন কফিল ময়মুনাকে বলে যে, বাইরে থেকে তালা খুলে ঘরে ঢুকতে তার আর ভালো লাগে না, কেউ যদি ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে দিত তাহলে বাঁচার একটা আনন্দ সে পেত। বোঝা যায় ঘর বাঁধার একটা বাসনা তার মনে বাস করে। অন্যদিকে পাথরশ্রমিকদের সর্দারও চায়, সে দরজায় টোকা দিলে ময়মুনা যেন ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে দেয় – তাহলে ময়মুনার কাজ এখানে পাকা, নইলে ছাঁটাই করা হতে পারে।  দুজনের দুভাবে ময়মুনাকে পাওয়ার আকাঙক্ষা ছিটকিনি উপকরণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন নির্মাতা। ছিটকিনি এখানে সম্পর্কের, অনুভূতির, লালসার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্যোতক হিসেবে কাজ করে।

এ-চলচ্চিত্রের কাহিনিরেখার শেষে দেখা যায়, ময়মুনা তার কাজ টিকিয়ে রাখা ও কফিলের পাশে থাকার জন্য একরাতে সর্দারের জন্য ছিটকিনি খুলতে বাধ্য হয়। কিন্তু সকালে তার সন্তান অনন্তকে নিয়ে কাজে যাওয়ার পথে দেখে যে, কফিলের লাশ খাটিয়ায় করে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ময়মুনা তার ত্যাগের কথা, কষ্টের ব্যথা অব্যক্ত রেখে কাজের এলাকার দিকে এগিয়ে যায় – আবার কাজশেষে সন্তানসহ রেললাইন ধরে কফিলের বাগানঘরের পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরে চলে।

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী নারীদের অসহায়ত্ব-স্বাধীনতাহীনতা-নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন নির্মাতা মাত্র কয়েকটি চরিত্রচিত্রণের মাধ্যমে। ঘটনার তেমন বিসত্মৃতিও নেই – এই পরিমিতি নির্মাতার চলচ্চিত্রবোধের পরিচায়ক। ছিটকিনির চিত্রনাট্য সুগ্রথিত। প্রথমাংশেই পরিবেশ ও চরিত্রগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। সংলাপও প্রধানত স্থানীয় ও ঘরোয়া প্রকৃতির, যা চলচ্চিত্রটির উলিস্নখিত চলচ্চিত্র ধারাদ্বয়ের বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে; তাতে করে ঘটনাখ-সমূহকে মেকি বলে মনে হয় না।

পঞ্চগড় স্টেশনটি ছিটকিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র। স্টেশনটিকে ঘিরেই পুরো চলচ্চিত্র গড়ে উঠেছে। নির্মাতা প্রচুর ডিটেইলসের মধ্য দিয়ে স্টেশনটিকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি আলোকপাত করেছেন রেলওয়ে অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত দিকের ওপর। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা ও সংশিস্নষ্টদের দুর্নীতির কারণে এদেশের সম্ভাবনাময় খাতটির চরম দুরবস্থার করুণ একটি চিত্র পুরো চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়। আমাদের রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থার টানাপড়েনের চিত্র বাংলাদেশের আর কোনো চলচ্চিত্রে এত বিসত্মৃতভাবে উঠে আসেনি। একটি প্রস্তাবও সামনে এনেছেন নির্মাতা – পুরনো স্টেশন ভবনগুলো ভেঙে নতুন স্টেশন নির্মাণের সময় পুরনোগুলো সংরক্ষণের বিষয়ে। খুবই যুক্তিসংগত প্রশ্ন। কারণ এসব পুরনো ভবনের সঙ্গে যুক্ত অনেক ইতিহাস। এগুলো ঐতিহ্যভবনও বটে। একেকটা ছোট ছোট জাদুঘর যেন। অনেক দেনদরবার করে চট্টগ্রাম স্টেশনের পুরনো ভবনটি রক্ষা করা গেলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় সব স্টেশনের পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে।

সাজেদুল আউয়াল প্রসঙ্গক্রমে স্টেশনমাস্টার তথা বড়বাবু ও কফিলের ঘরোয়া সংলাপে নিয়ে আসেন পুরনো নিদর্শনসমূহ সংরক্ষণের বিষয়টি। একটি দৃশ্যে দেখা যায় কফিলের কাঁধে হাত রেখে বড়বাবু স্টেশনের সারি সারি প্রাচীন মেহগনি গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন। ক্যামেরা তাদের অনুসরণ করে। কফিল তখন বলে : হুনছি স্টেশনটা ভাঙি নতুন করি দুতলা স্টেশন বানাইবো, হাছা নি? বড়বাবু বলেন, কথাটা সত্যিই। কফিল বলে : না ভাঙি রাখি  দিলে অয় না? পাশে নয়া একটা বানাইলেই তো অয়! বড়বাবু বলেন : ঠিক, তাতে সময়ের একটা চিহ্ন থেকে যেত। জানো, একসময় এই স্টেশন থেকে বছরে কোটি টাকা আয় হতো। সব ওই পাথরের জন্য। ওয়াগনভরা পাথর দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। এখন তো ট্রাকে করেই বেশিরভাগ পাথর যায়। কফিল নিচু স্বরে বলে : এরকম চুপচাপ নিরালা স্টেশন কোথাও দেখছি না, বড়বাবু। কথা বলতে বলতে দুজন একটা মেহগনি গাছের কাছে এসে দাঁড়ায়। বড়বাবু গাছে হাত রেখে বলে : হয়তো এই মেহগনি গাছগুলোও কেটে ফেলবে! … অনেকটা বছর কাটালাম – কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে! চলো। দুজন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এরকম সংলাপ থেকে শুধু যে দুটি চরিত্রের মনমানসিকতারই প্রকাশ ঘটছে তা-ই নয়, বাস্তবতার একটা সরল উপস্থাপনের পরিচয়ও পাওয়া যায়।

ছিটকিনির আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এ-চলচ্চিত্রে একটি রেলস্টেশনের প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন প্রামেত্মর মানুষের সন্নিবেশ দেখানো হয়েছে। বিষয়টি উঠে এসেছে পঞ্চগড় রেলস্টেশন ও পাথর উত্তোলনশিল্পকে কেন্দ্র করেই। স্থানীয় কিছু চরিত্র পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, কিছু অন্য জেলার ভাষায়, কারণ তারা এখানকার নয়। পুরো বিষয়টি চলচ্চিত্রটির বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বাংলা ভাষার যে সৃষ্টিশীল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য এটি নির্মাতা বিভিন্ন জেলার চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এর মাধ্যমে একটি রেলস্টেশনের বাচিক আবহটাও সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হতে পেরেছে। বাচিক ডিটেইলসের ভূমিকা পালন করেছে এই ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ। অভিনয়শিল্পীরা আঞ্চলিক সংলাপগুলো বলেছেনও ভালো, যা সচরাচর শোনা যায় না। শুধু এ-কারণে অনেক চলচ্চিত্র রীতিমতো হাস্যকর হয়ে পড়তে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা বিষয়বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট, নান্দনিক ভূবৈচিত্র্য আমরা চলচ্চিত্রে সাধারণত তুলে ধরি না। সাজেদুল আউয়াল এ-বিষয়েও নজর দিয়েছেন। তিতাসপাড়ের মানুষ হয়েও শিল্পীসুলভ এষণায় চলচ্চিত্রায়িত করেছেন মহানন্দার পাড়ে অবস্থিত পঞ্চগড়কে তার প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক-আর্থনীতিক-সামাজিক অবয়বসহ।

কিছু মন্তাজ বেশ অর্থবোধক। দৃশ্যগত মন্তাজ ও শব্দগত মন্তাজ – দুই-ই ব্যবহার করেছেন নির্মাতা এক্ষেত্রে। যেমন দৃশ্যগত পর্যায়ে মন্তাজ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কফিলের মৃত্যুদৃশ্যে লাল-সবুজ পতাকার ব্যবহার চারুশিল্পের পর্যায়েই পড়ে। রং দিয়ে নির্মাতা জীবন ও মরণের রূপক তৈরি করেছেন : রেলপুশ ট্রলিতে চড়ে এক কফিল লাল পতাকা নাড়তে নাড়তে চলে যাচ্ছে – আরেক কফিল রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে সবুজ পতাকা হাতে তাকে বিদায় জানাচ্ছে। জায়গাটি কবিতার মতো – চারু-চলচ্চিত্রের লক্ষণাক্রান্ত।

আরেকটি দৃশ্যে কফিল কাগজে পাখির ছবি এঁকে অনন্তকে রং করতে বলে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো নির্মাতা কফিলের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙক্ষার প্রতি ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। এই ছবি আঁকা ও রং করার বিষয়টি যে কফিল আর অনমেত্মর মধ্যে বহুদিন ধরে চলছে, তা বোঝানোর জন্য অনন্তদের ঘরের পুরনো দেয়ালে একটি রং করা ছবিও সেঁটে দিয়েছেন নির্মাতা। ছবির ঠিক নিচেই একটি পুরনো ট্রাঙ্ক। একটি দৃশ্যে দেখা যায় অনন্ত তার মায়ের সঙ্গে বের হওয়ার সময় সেই ট্রাঙ্ক খুলে মার্বেল বের করছে – তখন তার বাবার একটি শার্ট তার নজরে পড়ে। শার্টটি নাকের কাছে নিয়ে সে তার বাবার ঘামের গন্ধ শোঁকে, ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নীরবে নির্মাতা বাবাকে কন্সট্রাক্ট করেন। বেশ অর্থবহ দৃশ্য, ডিটেইলস তো বটেই। এ-ধরনের ছোট ছোট কাজ যেন অনেকটা পেইন্টিংসে শিল্পীর স্ট্রোকের সমতুল্য। এরকম অনেক ছোট ছোট স্ট্রোক আছে, যেগুলো ছিটকিনির প্রাণ।

শব্দগত পর্যায়েও মন্তাজ সৃষ্টির নজির বিদ্যমান। সংলাপ, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, চাপকলের শব্দ প্রভৃতি দিয়ে নানাধরনের মন্তাজ সৃষ্টি করা হয়েছে। কফিল ও বড়বাবুর সংলাপে ‘ছুটি’ শব্দটি কয়েক জায়গায় এসেছে। কফিল যখন মোটরট্রলিতে চড়ে লাইন ইনস্পেক্ট করতে চলে, তখন চালককে কফিল বলে যে, তার খালি মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করে। চালক জানতে চায় সে কেন যাচ্ছে না। কফিল জানায় যে, লাইন ইনস্পেক্ট করার জন্য আরেকজন না এলে তার ছুটি নেই। আরেক জায়গায় বড়বাবুর কাছে জানতে চায়, তার ছুটির চিঠি এসেছে কি না। বড়বাবু উত্তরে বলে : চিঠি? না। চলচ্চিত্রের শেষের দিকে দেখি যে, মরণের মধ্য দিয়ে তার ছুটি মেলে। এই সূক্ষ্ম জায়গাগুলো একধরনের চারুভাবনাজাত বলেই মনে হয়।

চাপকলের শব্দও সেই ভাবনার ফসল – কয়েকটি দৃশ্যের আবহে এ-শব্দ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে কফিলের মৃত্যুর পর ময়মুনা যখন শিশুপুত্র অনন্তকে নিয়ে স্টেশনের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরে চলেছে, তখন সে আর কারো হাতে চাপকলের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায়, কফিলের ঘরবাগানের দিকে ফিরে তাকায়, কফিলের কথা মনে পড়ে তার। অস্ফুটস্বরে কেঁদে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে চলে সে। এ-দৃশ্য দর্শকমনে একটু চাপা দীর্ঘশ্বাস তৈরি করে বইকি। দৃশ্য ও শব্দগত মন্তাজের এরকম ব্যবহারের কারণেই চলচ্চিত্রটিকে চারু-চলচ্চিত্র বলা চলে।

এ-চলচ্চিত্রে লোকজ সংস্কৃতির কয়েকটি আঙ্গিক (মলুয়াপালা, পঞ্চগড়ের লোকগান, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) ব্যবহার করা হয়েছে। সত্যিকারের পালা পরিবেশনকারী ও বাউল গানের মানুষদেরই রেখেছেন নির্মাতা, যিনি শুরুতেই পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষায় ‘বন্ধু ধন ধনরে, এতই গোসা কেনে তোমার শরীলে’ শীর্ষক গানটি বেলচা দিয়ে টুকরিতে বালু ভরতে ভরতে খালি গলায় গান তিনি (সাজাহান বাউল) এবং যিনি রেলস্টেশনের পস্ন্যাটফর্মে অন্ধ ফকিরের ভূমিকায় ‘নব গৌর হেরে গো, আমার প্রাণ কি যে করে গো, অ সই মন চলে না গৃহে যেতে, পারি না আর কুল রাখিতে’ কীর্তনাঙ্গের গানটি গেয়েছেন – দুজনেই সত্যিকারের বাউল। আমাদের লোকজ
সংস্কৃতির ডকুমেন্টেশন বলা চলে নির্মাতার এই উদ্যোগকে। মলুয়াপালা ও পালা পরিবেশনকারী দিলু বয়াতির পরিবেশনরীতিও চলচ্চিত্রটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে – এখানেও ডকুমেন্টেশনের বিষয়টি ক্রিয়াশীল; ‘সিনেমা ভ্যারিতে’ বা ‘নব্যবাস্তববাদী চলচ্চিত্রধারা’র এক বৈশিষ্ট্য তো এটাই। পালা এবং চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানদুটি ডাইরেক্ট টেকে গৃহীত যা বাস্তব অনুভূতি দেয়। বস্ত্তত লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নির্মাতার একটা বহুমাত্রিক ইন্টারঅ্যাকশন ঘটতে দেখা যায়
এ-চলচ্চিত্রে।

ছিটকিনির কাস্টিংও খানিকটা উলিস্নখিত চলচ্চিত্রধারাদ্বয় ধরনের। অবিরত চেনামুখ দর্শনের ক্লামিত্ম থেকে নির্মাতা মুক্তি দিয়েছেন দর্শককে। এতে করে চরিত্রগুলো অধিকতর বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে, পটভূমি ও ঘটনার সঙ্গে তো গেছেই। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, রুনা খান চেনামুখ হলেও চলচ্চিত্রমাধ্যমে তাঁদের কমই দেখা যায়। বিশেষ করে ভাস্বরের অভিনয়-প্রতিভা দেখার সুযোগ কমই পেয়েছেন দর্শক। পার্টনার চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেছেন তিনি তাঁর স্বল্প উপস্থিতিতে। ভালো কাজ করেছেন রুনা খান (ময়মুনা), মাহমুদুল ইসলাম মিঠু (সরদার), মানস বন্দ্যোপাধ্যায় (মক্কেল), রুবলী চৌধুরী (আম্বিয়া)। নির্মাতা নিজে স্টেশনমাস্টারের (বড়বাবু) চরিত্রে মানানসই অভিনয়ই করেছেন। সরদারের চেলার ভূমিকায় জহিরুজ্জামান (রহমত) যে অভিনয় করছেন তা মনেই হয়নি। এই চরিত্রটি নিশ্চিতভাবেই টাইপেজ চরিত্রমাফিক। ময়মুনার ছেলে অনমেত্মর চরিত্রে আপন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছে। শিশুশিল্পীর কাছ থেকে অভিনয় বের করে নেওয়া বেশ কঠিন কাজ। এ-কাজটি নির্মাতা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন। তবে পৃথকভাবে উলেস্নখের দাবি করে আমিনুর রহমান মুকুলের অভিনয়। কফিলের চরিত্রে তিনি যে-ধরনের কাজ করেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মৃত্যুদৃশ্যে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। ময়মুনা আর অনমেত্মর প্রতি তাঁর টান, বড়বাবুর সঙ্গে সখ্য, নির্জন রেলস্টেশনের জন্য নিঃসঙ্গ-যক্ষ্মাক্রান্ত কফিলের মায়া, মায়ের কাছে যাওয়ার আকুলতা – খুবই বিশ্বাস্য করে তুলেছেন তিনি তাঁর অভিনয়শৈলী দিয়ে।

চলচ্চিত্রের ভাষার অনেক সুপ্রযুক্ত প্রয়োগ লক্ষণীয় ছিটকিনিতে। ক্যামেরা-অ্যাঙ্গেল, সংলাপ-শব্দ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে বহু বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ দেখা যায়। পঞ্চগড়ের বিস্তীর্ণ সমতলের ল্যান্ডস্কেপ চমৎকার কিছু লং শটের মাধ্যমে ধরেছেন চিত্রগ্রাহক পঙ্কজ পালিত। ক্রেন শটগুলোও বেশ দৃষ্টিনন্দন। কিছু কিছু কম্পোজিট শটও পেইন্টিংসুলভ কম্পোজিশন দ্বারা সংগঠিত। আউটডোরের নান্দনিক পটভূমি পঙ্কজ পালিতের পরিশ্রমী চিত্রগ্রহণে বেশ ভালোভাবেই ধরা পড়েছে। তবে দু-একটি জায়গায় আউট অব ফোকাস কি অনবধানজনিত? বিশেষ করে দ্বিতীয় গানটির সময়। সাবাব আলী আরজুকৃত আবহ সংগীতও পরিবেশানুগ। পরিমিত সংগীতখ–র ব্যবহার ঘটনাকে বাস্তবতার কাছাকাছি থাকতে সাহায্য করেছে। সামির আহমেদের সম্পাদনা স্টোরি-স্পেসে গতি এনে দিয়েছে। কাটিং পয়েন্টের ট্রানজিশনগুলো সুচারুভাবেই সম্পাদিত হয়েছে। তবে কিছু অ্যাঙ্গেলের পুনরাবৃত্তি চোখে লেগেছে। বিশেষ করে রেললাইনের দৃশ্যগুলোতে। তাছাড়া মলুয়াপালার দৃশ্য-সংগঠন ক্ষেত্রে আরো কিছু শট-ডিভিশন দাবি করে।

ভিন্ন ধাঁচের গল্পকে ভিন্ন ধারায় উপস্থাপনার জন্য সাজেদুল আউয়ালকে সাধুবাদ দিই। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজস্ব ধারা তৈরি করতে চান বলেই মনে হয়। কথাটা এজন্য বলা যে, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগী হয়েও ঋত্বিকের কোনো প্রভাবই নিজের কাজে রাখেননি বা পড়েনি। ভবিষ্যতে তাঁর কাছ থেকে চারুধর্মী চলচ্চিত্র পাওয়ার আশা করা যায় বইকি।