লাল শার্ট

দ্বিতীয়বারের মতো আরমানকে ফিরে যেতে হলো। সে তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র অন্তুকে নিয়ে গ্রামে এসেছিল বাবা-মাকে শহরে নিয়ে যেতে। আগেরবার বাবা সোলায়মান মিয়া শেষ মুহূর্তে এসে মত পালটালেন। তিনি বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে শহরে ছেলের সংসারে থাকতে রাজি নন। তাছাড়া দুই-তিনদিনের বেশি শহরের জীবন তাঁর ভালোও লাগে না। চারদিকে কেমন দমবন্ধ পরিবেশ! একবার আরমানের জোরাজুরিতে এক মাস শহরে ছিলেন। তার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। আরমানের মায়ের চোখের ছানি অপারেশন করা হয় তখন। চক্ষু-বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, অপারেশনের সাতদিন পরই আপনারা গ্রামে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আরমান যেতে দেয়নি। ডাক্তারের নাম করে বলেছিল এক মাস ঢাকায় থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজন হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায়।

সোলায়মান মিয়ার কাছে অ্যাপার্টমেন্টের জীবন মনে হয় জেলখানার মতো। বন্দিজীবন। যদিও জেলখানা তিনি কখনো দেখেননি, গল্প শুনেছেন। পাশের গ্রাম হাটপাঙ্গাসীর লোকমান সিঁধ কেটে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে সাতদিন জেল খেটে এসেছে। লোকমানের জেলখাটা সেবারই প্রথম নয়। চুরি করতে গিয়ে সে জেল খেটেছে একাধিকবার। একদিন হাটপাঙ্গাসীর বাজারে নিতাইলালের চায়ের দোকানে অনেক মানুষের ভিড় দেখে সোলায়মান মিয়া এগিয়ে গিয়ে দেখেছিলেন, সদ্য জেল খেটে আসা লোকমান তার জেলজীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই একজন চোরের কথা শুনছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সোলায়মান মিয়াও তাদের দলে মিশে গিয়েছিলেন।

জেলখানা থেকে যখন-তখন বের হওয়া যায় না। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অবশ্য ইচ্ছা হলে বের হওয়া যায়। কিন্তু বের হয়ে যাবেন কোথায়? রাস্তায় হাঁটার উপায় নেই, ট্রাফিক জ্যাম, খানাখন্দে ভরা ফুটপাতে গিজগিজ করে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

একদিন নাতি অন্তুর জন্য চকলেট কিনতে বেরিয়েছিলেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়ে উলটো দিক থেকে দ্রুতগতিতে হেঁটে আসা এক তরুণের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে তার হাঁটুর অনেকটা জায়গা ছিলে গিয়েছিল। খানিকটা রক্তও বের হয়েছিল, কিন্তু অল্পের জন্য হাত-পা ভাঙেনি। এরপর আরমান বলেছিল, বাবা, তুমি একা বাইরে বের হবে না। কোথাও যেতে হলে আমার সঙ্গে যাবে।

কিন্তু পুত্রের সময় কোথায়? সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করতে হয়। ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে মতিঝিল থেকে পল্লবীর বাড়িতে ফিরতে রাত আটটা-নয়টা বেজে যায়। রোকেয়া সরণিতে মেট্রো রেলের কাজ চলায় কখনো কখনো রাত দশটাও হয়ে যায়। শুক্রবারের অপেক্ষায় বসে থাকেন সোলায়মান মিয়া। কিন্তু প্রায়ই শুক্রবারেও অফিসের ট্যুরে বাইরে যেতে হয় আরমানকে। বউ-বাচ্চাকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারে না সে। একদিন ছেলের বউ বলল, সপ্তাহে একটা মাত্র ছুটির দিন। সেদিনও যদি নিজের বাবাকে নিয়ে পার্কে গিয়ে বসে থাকো তাহলে আমার তো ঘরে বসে পচে মরা ছাড়া উপায় নেই।

আরমান বলল, প্রতিদিন তো বাবাকে নিয়ে পার্কে যাই না। মাত্র দুদিন গিয়েছি। বাবা একটু খোলা বাতাসে নিশ্বাস নিতে চায়। অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে বেচারা সারাদিন বন্দি হয়ে থাকে। অন্তু পার্কে দৌড়াদৌড়ি করতে পছন্দ করে। তোমাকেও তো কতবার বলেছি আমাদের সঙ্গে যেতে, তুমি যাওনি। এখন শুধু শুধু অভিযোগ করছ!

শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে পার্কে ঘুরতে যাওয়ার কিছু নেই। তুমি বেশি করে তোমার বাবাকে নিয়ে নিশ্বাস নিতে থাকো। কথাগুলো চিৎকার করেই বলল মুনিয়া।

মুরগির খাঁচার মতো ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট। পাশের রুম থেকে প্রতিটি শব্দ সোলায়মান মিয়ার কানে এলো। স্ত্রী রূপচান বিবিকে তিনি বললেন, আরো থাকবা ছেলের বাড়ি? শখ মিটছে তোমার?

রূপচান বিবি কথার কোনো উত্তর দেননি। সেদিন সন্ধ্যায় সোলায়মান মিয়া ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, কালই আমাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকব না।

আরমানের বুঝতে বাকি থাকেনি যে, মুনিয়ার কথাগুলো শুনে বাবা মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই এ-বিষয়ে আর কোনো কথা না বলে পরদিন তাদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সে।

ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় সোলায়মান মিয়া তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর কখনো ছেলের বাড়িতে আসবেন না। নিজের বাড়িতেই বাকি জীবনটা পার করে দেবেন। আসার আগে অবশ্য অন্তু তাঁকে ধরে কাঁদতে শুরু করেছিল। সে তার দাদাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। একপর্যায়ে সোলায়মান মিয়াও চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, দাদাভাই, তুমি তোমার বাবার সঙ্গে গ্রামে আমাদের দেখতে যাইও। তোমাকে আমি পুকুর থাইকা লাল পদ্মফুল তুইলা দিমু।

অন্তু লাল পদ্ম খুব পছন্দ করে। গ্রামে গেলেই দাদাকে বলবে, আমাকে লাল পদ্মফুল এনে দাও।

অন্তু তার দাদার অসম্ভব ভক্ত। সারাক্ষণ গুটুরগুটুর করে দাদার সঙ্গে কথা বলে। দাদার ঘাড়ে চড়ে বসে। দাদির সঙ্গে কিন্তু এতো খাতির নেই। নাতির জন্য তাই প্রায়ই মন পোড়ে সোলায়মান মিয়ার।

 

দুই

সোলায়মান মিয়ার তিন পুত্রের মধ্যে আরমান সবার ছোট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স। অন্য দুই পুত্র কোনোরকমে কলেজ পাড়ি দিয়ে আর পড়াশোনা করেনি। আরমানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সোলায়মান মিয়াকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি। শুরুর দিকে কিছু টাকা-পয়সা দিতে হয়েছিল। তারপর থেকে আরমান টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়েছে। উলটো মাঝে মাঝে বাবাকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছে। সোলায়মান মিয়াকে হিমশিম খেতে হয়েছে মেজো ছেলের আবদার মেটাতে। কোনোরকমে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আর পড়ালেখা করল না সে। মাথায় ভূত চাপল বিদেশ যাওয়ার। বাবাকে বলল, জমি বিক্রি করে টাকা দাও। ছয় মাসে তোমাকে যা টাকা পাঠাব সেটা দিয়ে দ্বিগুণ জমি কিনতে পারবে।

সোলায়মান মিয়া ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনটা আবাদি জমি বিক্রি করে ছেলেকে ওমান পাঠালেন। এখন সামান্য জমিজমা যা আছে সেটা বর্গা দেওয়া। লোক রেখে নিজে চাষ করার মতো শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য কোনোটাই তাঁর নেই।

মেজো ছেলে আবরার প্রথম কয়েক মাস কিছু টাকা পাঠানোর পর একদিন ফোন করে বাবাকে জানাল আর টাকা পাঠাতে পারবে না। কারণ আসার আগে কোম্পানি যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিল এসে দেখে তার অর্ধেকও নেই। তার ওপর গত মাস থেকে সুযোগ-সুবিধা আরো কমিয়ে দিয়েছে।

এখন টাকা তো পাঠায়ই না, বাবা-মায়ের খোঁজখবরও ঠিকমতো নেয় না। ছয় মাসে একবার হয়তো ফোন করে।

বড় ছেলে খুলনায় একটা এনজিওতে পিয়নের কাজ করে। তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। নিজের সংসারই চলে না, বাবা-মাকে কী সাহায্য করবে? মাঝে মাঝে উলটো সে-ই এসে এটা-সেটা নিয়ে যায়।

আরমান প্রতিমাসে বেতন পেয়েই বাবার জন্য কিছু টাকা পাঠায়। সে বুঝতে পারে এই টাকা যথেষ্ট নয়। আবার এরচেয়ে  বেশি পাঠালে নিজের সংসারে টানাপড়েন শুরু হবে। বাবা-মা ঢাকায় আরমানের সঙ্গে থাকলে তার জন্যও ভালো হয় দুটো কারণে। এক. বাবাকে আলাদা করে টাকা পাঠাতে হবে না। দুই. বাবা-মা তার চোখের সামনে থাকবে। সারাটা জীবন তাঁরা কষ্ট করেছেন। জমিজমা বিক্রি করে ছেলেদের পড়ালেখা করিয়েছেন। এখন তাঁদের একটু শান্তির জীবন দিতে চায় আরমান। তাই বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে চায়। কিন্তু সোলায়মান মিয়া কিছুতেই রাজি নন।

আরমান একটা বিদেশি কোম্পানিতে হিসাবরক্ষকের কাজ করে। তার নিজের এবং দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার জন্য বাবা-মা যে কষ্ট করেছেন সেটা নানাভাবে পীড়া দেয় তাকে। তাই সে চায় বাবা-মাকে নিজের কাছে রেখে যদি তাদের ঋণ কিছুটা শোধ করা যায় (যদিও সে জানে বাবা-মায়ের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না)। শেষ জীবনে অন্তত তাঁরা একটু আরাম-আয়েশ করুন।

কিছুদিন পর আরমান তার মা রূপচান বিবিকে দিয়ে বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোরবানির ঈদের সময় আরমান স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে গ্রামে আসে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে। সে-সময় আরমানের চাপাচাপিতে মুনিয়া শ্বশুরকে তাদের সঙ্গে শহরে গিয়ে থাকার কথা বলে। আরমানের ধারণা মুনিয়া বললে বাবা হয়তো রাজি হতে পারে। সোলায়মান মিয়া পুত্রবধূকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। তাছাড়া তিনি বুঝতে পারেন, আরমান জোর করে মুনিয়াকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়েছে।

রূপচান বিবি চান শহরে গিয়ে পুত্রের সঙ্গে থাকতে। গ্রামের একঘেয়ে জীবন তাঁর এখন আর ভালো লাগে না। ষাট বছর বয়সেও তাঁকে পাকঘরে তিনবেলা রান্না করতে হয়। সামান্য জমিজমা থেকে যে ফসল আসে সেগুলোর দেখভাল করতে হয়। ধান শুকানো থেকে শুরু করে গরু-বাছুরের লালনপালন সবই তাঁকে দেখতে হয়। রূপচান বিবির বয়স হয়েছে। এগুলো এখন তিনি করতে পারেন না। সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত।

রাতে ঘুমানোর আগে রূপচান বিবি একটা পান মুখে দিয়ে সোলায়মান মিয়ার পাশে গিয়ে বসে বলেন, ছেলেটা এত কইরা ধরছে! বউমাও যেতে বলতেছে। তুমি রাজি হয়ে যাও। যে-কয়টা দিন আল্লাহপাক হায়াত দেন ছেলে নাতিপুতিরে নিয়া একসঙ্গে            থাকতে চাই।

সোলায়মান মিয়া পুত্রবধূর কিছুদিন আগের কথাগুলো মনে করিয়ে দিলে রূপচান বিবি বলেন, মানুষ বদলাইতে কতক্ষণ? তাছাড়া বয়স কম, কী বলতে কী বইলা ফালাইছিল। তুমি এইসব মনে রাইখো না। তোমার নিজের মেয়ে হইলে কি ফালায়া দিতে পারতা? আরমান এতো কইরা বলতেছে, তুমি রাজি হইয়া যাও। সারাজীবন তো কষ্ট করলাম। শেষ বয়সে একটু আরাম কইরা থাকি।

সোলায়মান মিয়া বলেন, আমি বাপদাদার ভিটা ছাইড়া কোত্থাও যামু না। আর শহরে গিয়ে ছেলের বউয়ের চোক্ষের শূল হইতে চাই না। তোমার আরামের দরকার হইলে তুমি গিয়া থাকো।

রূপচান বিবি আর কোনো কথা না বলে মন খারাপ করে ঘুমাতে যান।

 

তিন

এক বছর পরের ঘটনা। আরমান পুত্র অন্তুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে বাবা-মাকে নিয়ে যেতে। সোলায়মান মিয়া তাঁর মত পালটেছেন। তিনদিন ধরে রূপচান বিবি কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করছেন। অন্তুর বয়স এখন সাত। সেও দাদিকে
এটা-সেটা হাতের কাছে এনে দিচ্ছে। পুকুরপাড়ে কাছারিঘরে বসে সোলায়মান বর্গাদারদের সঙ্গে কথা বলছেন। ফসলাদি বিক্রি করে কীভাবে তাঁর কাছে টাকা পাঠাবে সেসব বিষয়ে কথা হচ্ছে। নতুন আলু উঠলে আবুল মিয়াকে দিয়ে এক বস্তা আলু যেন শহরে ছেলের বাসায় পাঠিয়ে দেয় তাও বললেন তিনি। আরমানকে ডেকে তার বাড়ির ঠিকানা কাগজে লিখে দিতে বললেন। বাড়ির নিরাপত্তার কথা ভাবলেন। তারপরই তাঁর মনে পড়ল নতুন তালা কেনা হয়েছে। একসেট চাবি তাহলে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে রেখে যাওয়া যাবে।

রাতে ছেলে ও নাতিকে নিয়ে আরাম করে খেয়ে উঠলেন সোলায়মান মিয়া। দাঁত খিলাল করতে করতে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ান তিনি। আরমান তার ঘরে ঘুমাতে চলে যায়। যাওয়ার সময় বাবাকে বলে যায় তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে। সকাল সকাল রওনা হতে হবে। রূপচান বিবির মন ফুরফুরা। সকাল হলেই শহরে রওনা হবেন। তাঁর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে। হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে বানানো পান দিয়ে গেলেন সোলায়মান মিয়াকে। যাওয়ার সময় বললেন, তাড়াতাড়ি ঘুমাইতে আসেন।

সোলায়মান মিয়া পান মুখে দিয়ে পায়চারি করছেন। আজ তাঁর মনটা ভীষণ খারাপ। কাল সকালে নিজের বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শহরে যেতে হচ্ছে পুত্রের সংসারের বোঝা হতে। সারাজীবন স্ত্রীর কথার কোনো মূল্য দেননি তিনি। নিজের খেয়ালখুশিমতো চলেছেন। তাই এবার রূপচান বিবির ইচ্ছার মূল্য দিতে তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসন।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে সোলায়মান মিয়া লক্ষ করলেন, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আসছে। চারদিকে অমাবস্যার মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগল। নির্ঘাত রাতে বৃষ্টি হবে। ঘরে ঢুকে রূপচান বিবিকে বললেন, জানালা-দরজা ভালো কইরা বন্ধ কইরা দাও। রাতে মনে হয় বৃষ্টি হইবো।

আরমান ছেলে অন্তুকে নিয়ে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রূপচান বিবি জানালা-দরজা সব বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে গেলেন। সারাদিন গোছগাছ করতে অনেক ধকল গেছে। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন।

সোলায়মান মিয়ার ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছেন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেইসঙ্গে মেঘের গর্জন। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ সোলায়মান মিয়ার খুবই ভালো লাগে। ঘোরলাগা একধরনের বাদ্যবাজনার মতো মনে হয় তাঁর কাছে। ছোটবেলায় তাঁর বয়সের সবাই যখন বৃষ্টিতে ভিজে বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলত অথবা টিলো এক্সপ্রেস বা দাড়িয়াবান্ধা – তখন তিনি টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে আসতেন। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতেন না। আজো সেই ভালোলাগা আগের মতোই আছে।

শৈশবের কথা ভাবতে ভাবতে কখন তন্দ্রায় চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে বুঝতে পারেননি সোলায়মান মিয়া। বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি দেখলেন তাঁর বাবা বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে ঘরে ঢুকেছেন। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। মাথায় সাদা গোল টুপি। লম্বা দাড়িতে মেহেদির রং লাগানো। চোখে সুরমা দেওয়া। সোলায়মানকে বলছেন, বউমাকে ডাকো। একটা লুঙ্গি আর গামছা দাও। সোলায়মান রূপচানকে ডাকছেন কিন্তু তার ঘুম ভাঙছে না। তাঁর প্রচ- রাগ হচ্ছে। শ্বশুর বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর সে কিনা জন্মের ঘুম ঘুমাচ্ছে! এতো করে ডাকার পরও তার ঘুম ভাঙছে না। কী রকম বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে। মেয়েমানুষের ঘুম হবে পাতলা। সামান্য শব্দও যেন টের পাওয়া যায়। ঘুমুবে, কিন্তু কান দুটো থাকবে খাড়া। অথচ রূপচান কি না ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে! তিনি নিজেও বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করছেন; কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে উঠতে পারছেন না। এর মধ্যে তাঁর বাবা ভেজা কাপড়ে আরেকটু কাছে এসে বললেন, সোলায়মান, তুমি নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ? বাপদাদার ভিটা ছেড়ে চলে যাবে? তোমার মা শুনলে খুবই কষ্ট পাবে।

সোলায়মান মিয়া জিজ্ঞেস করলেন, মা কোথায়?

তোমার মা ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে তুমি নাই সে খুব কষ্ট পাবে। তোমার দাদাও এসেছে। দেখো দেখো।

সোলায়মান মিয়া তাকিয়ে দেখেন, লাঠিতে ভর দিয়ে তাঁর দাদাও তাঁর দিকে হেঁটে আসছেন। তিনিও বৃষ্টিতে ভিজে এসেছেন। বাবা বলছেন, সোলায়মান তোমার দাদাকে একটা গামছা দাও, দেখছো না তাঁর শরীর কাঁপছে।

তিনি উঠে দাদাকে ধরতে যেতে চাইছেন, কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। তাঁর কষ্ট হচ্ছে। দাদা বলছেন, আমাদের ছেড়ে শহরে চলে যাবি দাদাভাই? বাপদাদার ভিটা ছাড়তে নাই।

সোলায়মানের বাবাও একই কথা বলছেন, বাপদাদার ভিটা ছাড়তে নাই। তুমি শহরের বন্দিজীবনে পা দিও না।

দাদা লাঠিতে ভর দিয়ে দু-কদম হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলেন। সোলায়মান মিয়া দাদাকে ধরার জন্য লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছেন।

শব্দে রূপচান বিবির ঘুম ভেঙে গেল। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে আপনার? এইরকম কইরতাছেন ক্যান? বাতি জ্বালামু?

সোলায়মান মিয়া খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, কিচ্ছু হয়নি। তুমি ঘুমাও। এরপর তিনি নিজেও ঘুমাতে গেলেন। বাইরে তখনো অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

 

চার

সকালে ঘুম থেকে উঠে সোলায়মান মিয়া আরমানকে ডেকে বললেন, বাবা, আমাকে তুমি মাফ কইরা দাও। আমি বাপদাদার ভিটা ছাইড়া কোত্থাও যাইতে পারুম না। তুমি ফিরা যাও।

রূপচান বিবি কিছুক্ষণ পরপর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। তিনি কোনো কথা বলছেন না। তিনি জানেন সোলায়মান মিয়া এককথার মানুষ। দুনিয়াটা ভেঙে টুকরা টুকরা হতে পারে কিন্তু সোলায়মান মিয়ার কথার নড়চড় হবে না।

আরমান বাবার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, তুমি কেন মাফ চাইবে? আমি তোমাকে আর কখনো জোর করব না। তোমার যখন যেটা ভালো মনে হয় করবে। যদি কখনো আবার মত বদলাও তাহলে আমাকে জানাবে। এরপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

আরমান চলে যাওয়ার সময় সমস্যা দাঁড়াল অন্য একটা। অন্তু কোনোভাবেই দাদুকে ছেড়ে যাবে না। দুই হাত দিয়ে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে আছে। সে দাদুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে যায়। সোলায়মান মিয়া বললেন, অন্তু কয়েকদিন এইখানে থাকুক। তুমি আগামী সপ্তাহে আইসা নিয়া যাইও।

আরমান বাবার কথার ওপর কোনো কথা বলতে পারল না। কিন্তু মুনিয়াকে জিজ্ঞেস না করে অন্তুকে রেখে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আবার জিজ্ঞেস করলে মুনিয়া যদি রেখে যেতে নিষেধ করে তাহলে আরেক সমস্যা তৈরি হবে। বাবার ইচ্ছাকে অমান্য করা হবে। তারচেয়ে এই মুহূর্তে জিজ্ঞেস না করাই ভালো। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পর যা হওয়ার হবে। আরমানের এও মনে হচ্ছে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসছে না শোনার পর অন্তুর বিষয়টা নিয়ে মুনিয়া খুব বেশি বাড়াবাড়ি নাও করতে পারে।

ছেলেকে আদর করে বিদায় নিল আরমান। যাওয়ার সময় বলল, দাদা-দাদুকে বেশি বিরক্ত করবে না। তাঁদের কথা শুনবে। আগামী শুক্রবার এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

রূপচান বিবির অসম্ভব মন খারাপ হলো। স্বামীর ওপর প্রচ- রাগে অভিমানে দুপুরে কোনো কিছুই মুখে দিলেন না।

 

পাঁচ

অন্তু দাদার হাত ধরে সমস্ত পাড়া ঘুরে বেড়ায়। মনের আনন্দে পাড়ার অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বাড়ির উঠানে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। কখনো হাঁস-মুরগির পেছনে দৌড়াতে থাকে তাদের ধরার জন্য। মায়ের কড়া শাসন না থাকায় সে স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে দুষ্টুমির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। দাদি একদিন একটু বকা দিয়েছিলেন বলে রাগ করে তাঁর চুনের কৌটায় পানি ঢেলে দেয়।

গতকাল দাদার সঙ্গে হাটে গিয়েছিল অন্তু। সেখান থেকে একগাদা খোরমা, খাগড়াই, তালমিছরি কিনে এনেছে। যদিও এগুলো খাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। একটা লাটিম কিনেছে সে; কিন্তু এটা ঘোরাতে পারে না বলে মন খারাপ। পাশের বাড়ির একটা ছেলে তার চেয়ে দুবছরের বড়। সে সুতা পেঁচিয়ে লাটিম ছুড়ে মারতে পারে। লাটিম ঘুরতে থাকে আর অন্তুর সে কী আনন্দ!

পাটক্ষেত, ধানক্ষেতে দাদার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে অন্তু। দাদাকে চোখ বন্ধ করতে বলে খানিকটা দূরে লুকিয়ে থাকে সে। দাদা দেখেও না দেখার ভান করে খুঁজতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, দাদা ভাই, আমি তোমাকে খুঁইজা পাইতাছি না। কোথায় তুমি? বাইর হয়্যা আসো দাদাভাই।

দাদার পরাজয়ে খুশিতে অন্তু দৌড়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে মহাআনন্দে দিন কাটতে থাকে তার।

একদিন দুপুরে খাওয়ার পর সোলায়মান মিয়া ও রূপচান বিবি দুজনেই শুয়েছেন। সকাল থেকেই সোলায়মান মিয়ার শরীরটা
ভালো না। অন্তু বাড়ির উঠানে খেলছে। সাধারণত তাঁরা কেউই দুপুরে ঘুমান না। আজ সোলায়মান মিয়া ঘুমিয়ে পড়েছেন। রূপচান বিবিরও চোখটা লেগে এসেছে। স্বপ্ন দেখছিলেন একটা। বিরান প্রান্তরে তিনি একা। কখন এসেছেন এখানে, কীভাবে এসেছেন কিছুই মনে করতে পারছেন না। শূন্য প্রান্তরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সোলায়মান মিয়া কোথায়? কী করবেন এখন রূপচান বিবি? এরকম ভাবনার মাঝে হুট করেই অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে, ঘুম ভেঙে গেল তার।

রূপচান বিবি উঠে এসে দেখেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। খানিকটা আলো আছে এখনো। তিনি অন্তুকে উঠানে না পেয়ে আশপাশে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। দু-একজন পাড়ার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে তারাও কেউ কিছু বলতে পারে না। রূপচান বিবি দৌড়ে এসে সোলায়মান মিয়াকে ঘুম থেকে ওঠান। আশপাশের বাড়িঘরে খুঁজতে থাকেন তাঁরা; কিন্তু কোথাও অন্তু নেই। দাদা-দাদি দুজন পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটছেন। গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। তারাও খোঁজাখুঁজি করছে। বাড়ির পাশে ধানক্ষেত, পাটক্ষেত থেকে শুরু করে স্কুলের মাঠে, কোথাও অন্তু নেই। সোলায়মান মিয়াকে একজন এসে খবর দিলো, বাড়ির পুকুরে কী যেন একটা ভেসে আছে।

সোলায়মান মিয়া দৌড়ে পুকুরের পাড়ে চলে এলেন। পশ্চিম কোনায় অনেক পদ্মফুলের মাঝে লাল কিছু একটা ভেসে আছে। দুপুরে গোসলের পর অন্তুকে লাল শার্ট পরিয়ে দিয়েছিলেন রূপচান বিবি। আগের দিন হাট থেকে শার্টটা কিনে দিয়েছিলেন সোলায়মান। মুহূর্তের মধ্যে দুই-তিনজন পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে তুলে আনল অন্তুকে।

পানিতে পেট ফুলে আছে। অন্তুর অসাড় শরীর ঝাঁকিয়ে  নাক-পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করছে কেউ একজন। নাক-মুখ দিয়ে অনেক পানি বেরও হলো। সোলায়মান মিয়া বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আছেন তাঁর আদরের নাতিকে। হঠাৎ লক্ষ করলেন শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো শব্দ নেই। মাথাটা ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে আছে। প্রলাপ বকছেন রূপচান বিবি। এর মধ্যে কেউ একজন ডাক্তার ডেকে আনল। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলল, অনেকক্ষণ আগেই অন্তুর মৃত্যু হয়েছে।

দূরে কোথাও তখন বিকট শব্দে একটা বাজ পড়ল।