মরিচপোড়া

আমি যখন বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সূর্য তখন মধ্যগগন থেকে অল্প একটু হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চারদিকে ঝাঁঝাঁ সোনা গলানো রোদ। আমিও এসেছি বহু পথ অতিক্রম করে। কত হবে? হাজার লাখ ক্রোশ। মাপজোখ নেই। আমি কিছুটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। যদিও রোগ, শোক, জরা আমাকে তেমন একটা ছুঁতে পারে না। তারপরও এই নশ্বর পৃথিবীর সবকিছুই যেহেতু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমিই বা অবিনশ্বর থাকি কী করে।

আমি যখন গৃহটিতে প্রবেশ করলাম মিতুজা তখন ঘরের ডুয়া লেপাপোছায় ব্যস্ত। বালতিতে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ তৈরি করে সেগুলো দিয়ে লেপাপোছার কাজটি করছিল সে। গৃহের মূল ফটকে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে একরাশ দমকা বাতাস এসে আমাকে অনেকটা উড়িয়ে নিয়ে দাঁড় করাল উঠোনের একেবারে মাঝখানে। সেই ঘূর্ণিবায়ুযুক্ত বাতাস রাজ্যের সব ধুলাবালি, ময়লা উড়িয়ে নিয়ে ফেলল মিতুজার চোখে-মুখে।

তপ্ত রোদের উত্তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি আশ্রয় নিলাম উঠোনের এক প্রান্তে নিমগাছের ছায়ায়। আমার পদসঞ্চার ছিল লঘু ও নিঃশব্দ। বাতাসে কিছুর সঞ্চার ঘটলে বায়ুতরঙ্গে তার কম্পন হয়। কিন্তু সেই কম্পন মিতুজা অবধি পৌঁছাল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। গ্রীষ্মের এ-দাবানলে গ্রামটি পুড়ে ছাই হচ্ছিল যেন। চোখের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে গিয়ে এই প্রথম মিতুজা আমার দিকে তাকানোর সুযোগ পেল।

শান্ত দুই চোখ যেন দুটি পদ্মকোরক। আমাকে দেখেও তার মধ্যে তেমন ভাবচাঞ্চল্যের উদয় হলো না। ভাবলেশহীন ও নির্লিপ্ত। ভাবে মনে হচ্ছে, যেন এ-সময়টায় আমার এখানেই থাকার কথা ছিল। মিতুজা আগের মতোই ডুয়া লেপায় মগ্ন রইল।

আমি ভেবেছিলাম আমাকে দেখে সে হয়তো চমকে উঠবে, ঝটকা খাবে। বিশেষ করে আমার মৃত পাখির মতো বিবর্ণ চোখদুটো দেখে কিংবা অশ্বত্থগাছের ঝুরির মতো জট-পাকানো লম্বা চুল – যেগুলো কাঁধ ছেড়ে আরো বেশ খানিকটা নিচে নেমে এসে আমার বক্ষ ছুঁয়েছে, সেগুলো দেখে। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। মিতুজার স্বামী এন্তাজ শেখ দীর্ঘদিন প্রবাসী। প্রায় বছর দুয়েক ধরে সে কাজ করে আরবদেশে, একটি আতরের কারখানায়।

শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক দেবরকে নিয়ে তার সংসার। শ্বশুর ময়েজ শেখ সম্পন্ন গৃহস্থ। জমি-জিরাত আছে বিশ-বাইশ বিঘার মতো। সব বিষয়-আশয় বর্গা দিয়ে গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়ানোই তার প্রধান কাজ। মিতুজার দেবর মন্তাজ শেখ বিএ পাশ করে বর্তমানে বেকার।

ঘোড়াদহ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির জন্য লাখ দুয়েক টাকা ঘুস দিয়ে রেখেছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু চাকরিটা হবে হবে করেও হচ্ছে না অজানা কোনো কারণে। মিতুজার শাশুড়ি জোমেলা খাতুন ধীরস্থির বৈষয়িক হলেও বেশ মেজাজি মানুষ।

আমাকে আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মিতুজা কি আমায় তুলবে না ঘরে নিয়ে?

বোশেখের হাওয়ার মর্মর শোনা যায় নিমগাছে। বাতাসের তোড়ে জলপাই রঙের দু-চারটা নিমফল লুটায় মাটিতে। চড়ুই আর শালিকের চূর্ণকণ্ঠ ভেসে আসে আশপাশের কোনো বৃক্ষ থেকে। বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়গুলোতে কে যেন গাছপালার ডাল, কা- কাটছে দা দিয়ে, তারই মড়মড় আর্ত-আওয়াজ শোনা যায় দূর থেকে। নিমগাছে বসা একটি দাঁড়কাক ঈষৎ তন্দ্রা-জড়ানো কণ্ঠে ডেকে ওঠে কর্কশ শব্দে।

ঘর লেপার জীর্ণ কাপড়, বালতি, ঝাঁটা জিনিসগুলো নিকোনো উঠানের একপাশে রেখে মিতুজা আমার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ওকে অনুসরণ করতে। আমিও পিদিম থেকে বেরিয়ে আসা জিনের মতো ওর পিছু নিলাম।

হাঁটার সময় লক্ষ করলাম মিতুজা পদক্ষেপ ফেলছে এলোপাতাড়ি। অনেকটা অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে। যেন টাল সামলানোটাই ওর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আকৃতিতে মিতুজা কিছুটা পৃথুলা গোছের। কিছুটা বলা আসলে ঠিক হলো না। অপরিসীম কঠিন স্বাস্থ্য। গায়ের রং গাঢ় তাম্রাভ। অনেকটা খেজুরের গুড়ের মতো; কিন্তু সুন্দর মুখশ্রী। কুঞ্চিত ঘন চুলের রাশি পেছনদিকে অনেক দূর পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। দুই চোখে যেন নধর ভাবাবেশ।

মিতুজার গাঢ় নীল জমিনের ওপর লাল পেড়ে শাড়িটার জায়গায় জায়গায় কাদামাটির ছোপ ছোপ দাগ। চাপকলের হাতলটা ধরে বারকয়েক চেপে ঘর্মাক্ত মুখটি আপাতত ধুয়ে নিল সে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল – ‘ইবার কও কেমন আছো মংলু। তোমার আসতি এত দেরি হলি যে। আমি তো মেলা দিন ধইরে তোমার ধ্যান করতিছিলাম।’

আমি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললাম – ‘বাহ্ বেশ তো, আমার নাম তুমি জানলে কী করে মিতুজা?’

– ক্যান ছোটবেলায় মা তোমার কথা কত কয়ছে। মরার দুদিন আগেও আমার হাত দুইডে ধইরে মা কলো – মারে আমি তোক এতিম কইরে চইলে যাচ্ছি। কিন্তু বিপদে-আপদে তুই মংলুক স্মরণ করিস। দেখপি ও ঠিক চইলে আসপি। আমারে মতো মানষির জন্যি মংলুই হচ্ছে একমাত্র অবলম্বন, আমারে শেষ আশ্রয়।

আমি কণ্ঠে উচ্ছ্বাস তুলে বললাম – ‘তোমার মা সালেহা বেগম একজন মানুষ ছিলেন বটে। রাজেন্দ্রানীর মতো ছিল তার চেহারা। গৌরবর্ণ, ঠিক যেন কুমড়ো ফুলের মতো গায়ের রং। তোমার মায়ের যেমন ছিল সাহস তেমনি বুদ্ধি। সারাক্ষণ হাসিখুশি। সহাস্য মুখেও তার সে কী দৃঢ়তা। আমি এসব দেখেছি বলেই বলছি।’

– তা তুমি ঠিকই কচ্ছো মংলু। মায়ের ছিল বুকভরা সাহস আর মাথাভর্তি বুদ্ধি। সুনসান নিশুতি রাতে যখন ভূতের ভয়ে আমরা লালশালু দিয়ে মোড়া লেপের তলায় পলায়ে থাকতেম, চুপি চুপি আমার কানের কাছে মুখটা আইনে মা তখন চাপা গলায় বইলত – ‘ভূত আমার পুত, শাকচুন্নি আমার ঝি, কলেমা কালাম বুকে আছে, করবি আমার কী।’ আমিও মায়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতাখান বারবার মনে মনে পড়তেম – ভূত আমার পুত …। তোমাক আমি কী কব মংলু, এই কবিতাখানি মন্ত্রের মতো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ডর সব কোথায় যে উধাও হয়া যাত।

আমি বললাম – ‘সে সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো দেখছি তোমার মায়ের রূপের ছিটেফোঁটাও পাওনি।’ মিতুজা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘তা অবশ্যি ঠিক। আমি হয়েছি বাপজানের মতো।’ হাতদুটো আমার দিকে সম্প্রসারিত করে মিতুজা বলল – ‘দেখিছো মংলু আমার হাতগুলো কেমন হাঁড়ির তলার মতো। আচ্ছা থাক এখন এসব কথা। চাঁদনি রাতে উঠানে পাটি বিছিয়ে মা আর আমি শুইয়ে শুইয়ে যখন গল্প করতেইম, মা তখন তোমার কথা অনেক কতো। মায়ের সাথ তোমার দারুণ ভাব ছিল, তাইনে মংলু। মা নাকি ডাকলিই তুমি চইলে আসতে।’

আমি মুখে ঈষৎ হাসি তুলে বললাম – ‘সে তো আমাকে আসতেই হতো। কেন, এই যে তুমি আমাকে স্মরণ করলে আমি কি না এসে পারলাম। ডাকার মতো করে ডাকলে তো ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়। কি ঠিক বলিনি মিতুজা? আর আমি তো কোথাকার কোন মহামহোপাধ্যায়।’

– শোনো হয়েছে কী একবার। তোমার মায়ের ইলিশ মাছের প্রতি ছিল ভীষণ দুর্বলতা। ইলিশ মাছ পছন্দ না হয়েই বা কী উপায়! তোমার মায়ের আসল বাড়ি তো সেই পদ্মাপাড়ে। রাজবাড়ী জেলার পাংশায়। তোমার বাবা সেই পাংশার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন পাবনার ঘোড়াদহ গ্রামে। এ যেন জলের মাছ ডাঙ্গায় তোলার মতো অবস্থা। নতুন বউ, মুখ ফুটে ইলিশ মাছের কথা কাউকে বলতে পারে না।

তোমার দাদিও ছিলেন দজ্জাল ও কিপ্টে ধরনের মানুষ। যদিও সপ্তাহে দু-একদিন ইলিশ মাছ কেনা হয় বটে; কিন্তু তোমার মায়ের কপালে ইলিশের উচ্ছিষ্ট – কানকো, ল্যাজ এগুলো ছাড়া তো জোটে না কিছুই। তখন ছিল ঘোর বর্ষাকাল। শ্রাবণ কী ভাদ্র হবে। সুজানগরের হাট থেকে তোমার বাবা বেশ বড়মাপের এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনে আনলেন। ইলিশ জোড়ার সে কী সৌন্দর্য! রুপার মতো চকচক করছিল মাছদুটো।

পেট ও পিঠে হালকা গোলাপি আভা, মাথার ওপর চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো জাত জহুরি নীলমণি হীরে কেটে বসিয়ে দিয়েছে চোখে। সেই ইলিশ দেখে তোমার মায়ের জিহবা লকলক করতে লাগল। তিনি ভাবতে লাগলেন কী করে উদরপূর্তি করা যায় ভাজা ইলিশ দিয়ে। শাশুড়ি তো দেবে না এক টুকরোও খেতে। তোমার দাদি তোমার মাকে বললেন – সালেহা, যা তো মা গোটা একটা ইলিশ ভেজে আন জলদি।

সন্ধ্যার পরপরই তোমার মা বসলেন ইলিশ মাছ ভাজতে। মাছের সে কি সুগন্ধ। মনে হয় আধমাইল দূর থেকেও সেই মাছের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মাছ তো নয় যেন ননির চাপ কেটে ভাজা হচ্ছে কড়াইয়ে। ইলিশ মাছের গন্ধে ভুড়ভুড় করতে লাগল চারপাশ। সব বাড়ি ক্রমশ হয়ে উঠল ইলিশময়। তোমার মা নিজেকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারলেন না। এক টুকরো, দু-টুকরো করে একসময় সম্পূর্ণ মাছটিই খেয়ে ফেলেছেন তিনি। কাঁসার বড় থালাটিতে পড়ে রইল শুধু ল্যাজ আর ছোট ছোট দু-এক টুকরো মাছ।

হঠাৎ তোমার মায়ের খেয়াল হলো, সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোন ফাঁকে তিনি মাছগুলো সব খেয়ে নিয়েছেন বুঝতেও পারেননি। এখন কী উপায়। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল আমার। তোমার মায়ের এমন বিপদে আমি না এসে পারি? কিছু সময় পর তোমার দাদি রসুইঘরে এসে তো একেবারে আগুন। মাছের টুকরোগুলো সব গেল কোথায়? তিনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন – সোয়া কেজি ওজনের মাছের আর সব কোথায় বউমা?

তোমার মা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ভূত দেখার মতো ভয়ার্ত চোখেমুখে তিনি শাশুড়িকে বললেন – আমি তখন সবেমাত্র কড়াইয়ে মাছ ছেড়েছি। হেঁসেলের জানালার ওপাশ থেকে কে যেন খোনা গলায় বলল – আঁমায় এঁকটা মাঁছ দিঁবি? খাঁবো। আমি তো ভয়ে একেবারে কাঠ। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক টুকরো মাছ ছুড়ে দিলাম জানলার গরাদ দিয়ে। ওপাশ থেকে খাওয়ার চপচপ আওয়াজ শোনা গেল স্পষ্ট।

তারপর আবার বলল – দিঁবি আঁরেক টুঁকরো। যঁদি নাঁ দিঁস তঁবে তোঁর বঁংশ নিঁর্বংশ কঁরে ছাঁড়ব। এভাবে বেশ কয়েক টুকরো মাছ দেওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো এর তো একটা বিহিত করা দরকার। তা না হলে যক্ষ্মীবুড়িটা হয়তো সিন্দাবাদের ভূতের মতো অচিরেই চেপে বসবে এই সংসারে। একবার মনে হলো ডাকি আপনাকে; কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম যক্ষ্মীবুড়িটা যদি ওর লম্বা হাত দিয়ে আমার ঘাড় মটকে দেয়।

ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি আঁটলাম মনে মনে। মাছ ভাজার খুন্তিটার যে দিকটা তীক্ষন সে দিকটা ঢুকিয়ে দিলাম তোলা উনুনের জ্বলন্ত আগুনের ভেতর। ওটা ততক্ষণে তেতে লালবর্ণ ধারণ করেছে। অন্যদিকে যক্ষ্মীবুড়িটাও জানলার ওপাশ থেকে মাছের জন্য আবার তাগাদা দিচ্ছে। আমি বললাম – বড় করে হাঁ করো এবার। তোমার মুখে আমিই মাছ তুলে দিচ্ছি। যখনই যক্ষ্মীবুড়িটা হাঁ করেছে অমনি আগুনে লাল হওয়া খুন্তিটা ঢুকিয়ে দিলাম ওর মুখে। যক্ষ্মীবুড়িটা বিকট এক চিৎকার করে ছুটে পালাল।

তোমার মায়ের মুখে এসব শুনে তোমার দাদি তো হতবাক। কী বলছে সালেহা এসব! হইচই হট্টগোল শুনে বাড়ির সবাই ততক্ষণে রসুইঘরে এসে হাজির। তোমার মায়ের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সবাই ছুটল জানালার ওপাশের জঙ্গলে। সেখানে সত্যি সত্যি দেখা গেল একটা দাঁড়কাক মরে পড়ে আছে ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তারপর সবাই মিলে তোমার মায়ের সাহস ও বুদ্ধির সে কী প্রশংসা! ধন্য ধন্য রব চারদিকে।

মিতুজার সঙ্গে এভাবে হাস্য পরিহাসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচলটা ঈষৎ সরে যেতেই আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মধ্যপ্রদেশ বেশ খানিকটা স্ফীত হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বেও আমি ওর পদক্ষেপ ও চলাফেরা লক্ষ করেছি খুব সতর্কতার সঙ্গে। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম – ‘নিজের এতবড় সর্বনাশ কী করে করলে মিতুজা? তোমার শরীরের ভেতরে তো মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আরেকটি শরীর।’

মিতুজা আঁচলটি ঠিক করতে করতে বলল – ‘এজন্যই তো তোমার শরণাপন্ন হয়েছি মংলু। তুমিই পারো আমায় এ-বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।’ আমি বললাম, ‘কেন? তুমি জানো না বুঝি, তোমার এতবড় ক্ষতিটা কে করল?’ মিতুজা মাথা নিচু করে বলল, ‘জানব না কেন। কিন্তু এই গৈ-গেরামে আমার জানার কি মূল্য আছে বলো। আমার কি সে-কথা মুখ ফুইটে বলার উপায় আছে। তাহলি তো গেরামের লোক আমাক অসতী ভাববি। আমিই তখন হবনে কলংকিনী। পথ আমি নিজেই খুঁইজে নেব মংলু, তুমি শুধু আমার পাশে থাইকো।’ আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘তোমাদের মতো নিগৃহীতাদের পাশে থাকাই তো আমার বড় কাজ। চিন্তা করো না; আমি আছি তোমার পাশে।’

কয়েকদিনের মধ্যেই মিতুজার আচরণ ও কথাবার্তায় অসংলগ্নতা দেখা গেল। প্রতিদিনই মূর্ছা যাচ্ছে দু-একবার করে। মুখে অদ্ভুত সব কথাবার্তা। যে-মিতুজা সাত চড়েও রা কাড়ে না সেই মিতুজার মুখ দিয়ে ছুটছে অশ্রাব্য সব গালি। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকার সময় কেউ তার সেবাশুশ্রূষা করতে চাইলে মিতুজা তার বাপ-মা তুলে গালাগাল শুরু করে দেয়। প্রতিবেশীরা আড়ালে-আবডালে ফিসফাস করতে লাগল – মিতুজাকে আসলে ভূতে ধরেছে। ভূত-সংক্রান্ত সংবাদগুলো সাধারণত কই মাছের মতো কানে হাঁটে। দু-একদিনের মধ্যে সব গ্রামে চাউর হয়ে গেল মিতুজার ভূতগ্রস্ত হওয়ার সংবাদ।

শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই ভাবতে লাগলেন, কী করা যায় মিতুজাকে নিয়ে। গ্রামের প্রবীণতমজন আক্কাস মোল্লা ফয়েজ শেখকে পরামর্শ দিলেন অতিসত্বর মিতুজাকে ওঝা-বদ্যি দেখাতে। ঘোড়াদহ গ্রামে প্রসিদ্ধ কোনো ভূততাড়ানিয়া নেই। একজনের কাছে খবর পাওয়া গেল হেকমত কবিরাজ নামে পাশের গ্রাম পাকুন্দিয়ায় ভালো একজন ভূততাড়ানিয়া আছে। আরো জানা গেল, যত বড় বজ্জাত ভূত-প্রেতই হোক না কেন, হেকমত কবিরাজের কাছে তা ডালভাত। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, দুর্বল কিসিমের ভূত হেকমত কবিরাজকে দেখেই পলায় ঊর্ধ্বশ্বাসে। রোগীর চিকিৎসাপত্রও করতে হয় না তেমন।

ময়েজ শেখ ছুটলেন হেকমত কবিরাজের সন্ধানে। হেকমত কবিরাজ পাকুন্দিয়া গ্রামে প্রায় বছরদশেক ধরে বসবাস করলেও তার আদি নিবাস নেত্রকোনার তাহিরপুরে। এখানে তার ব্যবসার প্রসার ভালোই। ময়েজ শেখকে দেখেই হেকমত বলল – ‘রোগী কি মাইয়া না পোলা?’ ময়েজ শেখ কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘হুজুর ভূতে ধইরেছে আমার বড় ছাওয়ালের বউ’ক।’ লোটার পানি মুখে পুরে কুলকুচি করতে করতে কবিরাজ বলল, ‘বউয়ের বয়স কত?’ ‘ষোলো-সতেরো।’ ‘কয়দিন হইছে?’ ‘এই তো চাইর-পাঁচ দিন।’ ‘মাইয়ার আচার-আচরণ কেমন?’ ময়েজ শেখ খুলে বললেন সব। ‘হুম, বুঝলাম। না দেইখা বুঝতে পারতেছি না কোন কিসিমের ভূত। চোরাচুন্নি, দেও, কানাভুলা নাকি ঝেঁয়ো ভূত। এগুলার একটা হইলে অবশ্য তেমন সমস্যা নাই। কিন্তু নিশিভূত কিংবা কন্ধকাটা হইলে শরীলের ঘাম ঝরাইতে হইব অনেক।’ ময়েজ শেখ প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘হুজুর অনেক সুখ্যাতি শুইনে আপনের কাছে আইসলেম, যেভাবেই হোক আমার এই উপকারখান আপনার করতিই হবি।’ হেকমত কবিরাজ বলল, ‘তাইলে শোনেন, আমি ভূতছাড়ানির এসব কাজ-কারবার শিখছি কামরূপ-কামাখ্যা থাইক্যা। আমায় বয়স ছিল তখন কম। অনেক কুফরি কালাম শিখছিলাম। সেগুলা একসময় প্রয়োগ করতাম। আমার পায়জামার দুই পকেটে দুইটা ভূত থাকত। এক পকেটে একটা নিশিভূত, অন্য পকেটে কন্ধকাটা। কন্ধকাটা মানে বুঝতে পারছেন তো?’ ময়েজ শেখ মাথা নাড়েন, ‘না বুঝবের পারি নেই।’ ‘আরে কন্ধকাটা মানে হইল যার ঘাড়ের মাথা কাটা পড়ছে সেই কিসিমের ভূত। আমার পোষা ভূত দুইটা দিয়া অন্য ভূতদের দৌড়ানি দিতাম। এখন বয়স হইছে, সেসব কুফরি কালাম আর ব্যবহার করি না। নামাজ কালাম ধরছি বহু বছর আগে। ভূতগুলা আমার এতটাই ভক্ত ছিল যে, আমি আদেশ করলে জয়ইন্তা পাহাড় থাইক্যা আমার জন্য কমলা ছিঁড়া নিয়ে আসত। তাজা পাতা দেইখা সবাই স্বীকার করত এখন গাছ থাইক্যা তোলা কমলা।

আবার কখনো হিমালয় পর্বত কিংবা অন্য দেশ থাইক্যা কাঁচা এলাচি আইনা দিত। এখন সোজা পথেই ভূত তাড়াই। আইজ তো সন্ধ্যা হইয়া গেছে। নাম-ঠিকানা রাইখা যান, কাল সকালে হাজির হইয়া ভূতের গোষ্ঠী উদ্ধার কইরা আসমু। টেনশনের কারণ নাই। ও ভালো কথা, কিছু জিনিসপত্র কিনন লাগব, এক হাজার এক টাকা নজরানা রাইখা যান। বাদবাকি এক হাজার ভূত খেদানোর পর দিবেন।’

পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ময়েজ শেখের বাড়িতে তুলকালাম কা-। ভূততাড়ানি দেখতে জমায়েত হয়েছে শখানেকের মতো লোক। ময়েজ শেখ যে-ঘরটায় থাকেন সেই ঘরের বারান্দায় চাল ঘেঁষে বিশাল এক নারিকেল গাছ আকাশ ছুঁয়েছে। সেই গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা মিতুজা। একটু দূরে শীতল পাটির ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসেছে হেকমত কবিরাজ। তার সামনে টুকিটাকি কিছু জিনিস – একটা বড় কাচের বোতল, সরিষার তেল, ধুতুরা পাতা, ঝাঁটা, গামছা, ধূপ ও তিনটা রক্তরঙা লম্বা লম্বা শুকনা মরিচ। ছোট একটা মালসায় ধরানো হয়েছে আগুন। জায়নামাজে বসে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগল হেকমত কবিরাজ।

উপস্থিত মানুষজনের উদ্দেশে সে বলল – ‘আপনাদের মইধ্যে যারা যারা আয়াতুল কুরসি জানেন, তারা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়েন। এই ভূতটা মনে হইতাছে খুবই খবিস কিসিমের ভূত। সম্ভবত কন্ধকাটা। আয়াতুল কুরসি পড়লে ভূতের শক্তি আসেত্ম আসেত্ম কইমা আসব।’ হেকমত কবিরাজ ময়েজ শেখকে উদ্দেশ করে বলল – ‘কাউরে দিয়া কয়েক কলসি পানি আনান শেখ মিয়া।’ হেকমত জায়নামাজ থেকে উঠে মিতুজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যদিকে আমি গোবেচারা মংলু হেকমত কবিরাজের কেরামতি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে আশ্রয় নিলাম বারান্দার টিনের চালে।

মিতুজার অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে কবিরাজ বলল – ‘আমি জানি তুই কে। তুই ক্যান ওরে ধরছস? ও তোর কী ক্ষতি করছে।’ মিতুজা মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ করতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘ছাড় আমাক। আমাক ছাইড়ে দে।’ হেকমত ঝাঁটাটি হাতে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু দোয়া-দরুদ পড়ে ঝাঁটাটিতে ফুঁ দিয়ে গুনে গুনে সাতটা বাড়ি দিলে মিতুজার শরীরে। না কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু গরম সরিষার তেল ঢুকিয়ে দেওয়া হলো মিতুজার নাক দিয়ে।

মিতুজা ঝাঁজের আতিশয্যে শুধু হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো শব্দ করল দু-তিন দফা। প্রতিক্রিয়া এতটুকুই। কবিরাজ উৎফুল্ল হয়ে উঠল কিছু সময়ের জন্য – ‘মনে হইতাছে হ্যাঁচির সঙ্গে ভূতটাও বাহির হইয়া আসব এবার।’ না, এবারো বিফল হলো কবিরাজ। মিতুজার ঘাড় থেকে ভূত বিতাড়িত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আগের মতোই অবনত মুখ। হেকমত কবিরাজ এবার মিতুজার দেবর মন্তাজকে চোখ দিয়ে ইশারা করল নতুন গামছা দিয়ে মিতুজার মুখম-ল বেঁধে ফেলতে। মন্তাজও সঙ্গে সঙ্গে চাবি-দেওয়া পুতুলের মতো গামছা দিয়ে বেঁধে দিলো ওর মুখ। কবিরাজ কলসি থেকে এবার পানি ঢালতে লাগল মিতুজার চোখে-মুখে।

মিতুজা হাঁসফাঁস করতে লাগল কোরবানির ঈদে জবাই করা গরুর মতো। দু-তিন কলস পানি উজাড় হলো ঠিকই কিন্তু লাভ হলো না কিছু। কবিরাজ এবার পড়াপানি মিতুজার শরীরে ছিটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভালোয় ভালোয় মাইয়াডারে ছাইড়া যা কইতাছি। নইলে কিন্তু তোর কপালে খুব খারাপ আছে। ক তুই যাবি কি যাবি না? তুই যদি চইল্যা যাছ তইলে তোর নামে ভোগ চড়ামু। ঘোড়াদহ গ্রামের শেষ মাথায় যে শ্যাওড়া গাছটা আছে সেখানে অমাবস্যা রাইতে তোর জন্য সোয়া পাঁচ সের চাউল, একশ এক টাকা, আর একটা কালো রঙের মুরগি রাইখা আসমু। তুই এখন ওর শরীর থাইক্যা নাইমা যা।’

মিতুজা এই প্রথম ভালো করে কথা বলল, ‘না, আমি নামব না। আমি ওর শরীরে থাকপো। আমি ওর কোনো ক্ষতি কইরবের আসি নেই। আমি ওর পেটের ভেতর যে বাচ্চা আছে সেটাক বাঁচাবের আইছি।’ পেটের ভিতর বাচ্চা! হেকমত কবিরাজ যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। ‘দেখ হেঁয়ালি করিস না। উল্টাসিধা বইলা আমারে ভুলাইতে পারবি না।’ মুখের চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলল কবিরাজ।’

 

‘আমি মিছে কথা কচ্চিনে। সত্যি সত্যি ওর পেটে বাচ্চা।’ এই কথা বলেই মিতুজা তার পরনের শাড়িটির বুকের আঁচল সরিয়ে দিলো। সমবেত লোকজনের মধ্যে কয়েকজন হইহই করে উঠল। সত্যিই তো মিতুজার পেটটা ফুলে উঠেছে বেশ খানিকটা। এ কী বলছে মিতুজা! স্বামী থাকে আবুধাবি অথচ পেটে বাচ্চা! উপস্থিত অনেকের চোখ এবার গিয়ে পড়ল মন্তাজের ওপর। মন্তাজকে বাইরে থেকে যতটা সাদাসিধে গোবেচারা মনে হয়, আসলে তো দেখা যাচ্ছে ও একটা বদের হাড্ডি। বড়ভাই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অথচ ভাবিকে নিয়ে ফুর্তিতে ব্যস্ত। মানুষের গুঞ্জনগুলো পরিণত হলো শোরগোলে।

হেকমত কবিরাজ ময়েজ শেখকে বলল, ‘ছেলের বউ তো আপনার পোয়াতি। গর্ভবতী মাইয়ারে এত কষ্ট দেওন যাইব না। এইবার একটা শেষ চিকিৎসা দিমু যদি ভূত শরীল থেইক্যা নামে তো ভালো, না নামলে বিপদ আছে। এর আগে জানতে হইব এই বাচ্চার বাপ কেডা।’ কবিরাজ আবার মিতুজার কাছে গিয়ে মন্ত্র পড়তে লাগল আর বলতে লাগল, ‘ক এই বাচ্চার বাপ কেডা। যদি না কস তাইলে কিন্তু এই যে বোতলডা দেখতাছোস এইডার মধ্যে ঢুকাইয়া চিরদিনের জন্য মাটির নিচে পুঁইতা রাখমু।’ নাহ মুখ দিয়ে মিতুজার কোনো কথা নেই। কবিরাজ এবার শুকনো মরিচ তিনটি মালসার আগুনে পুড়িয়ে আবার ধরল ওর নাকে।

পোড়া মরিচের ঝাঁঝে মিতুজার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। খক্খক্ করে কাশতে লাগল মিতুজা। মুখ দিয়ে কথা বেরোতে লাগল, ‘আর অত্যাচার করিস না কবিরাজ। মিতুজার সর্বনাশ করেছে ওই ময়েজ শেখ। মাস তিনেক আগে একদিন রাতের বেলা জোর কইরে ঢুইকে মিতুজাক নষ্ট কইরেছে ওই ময়েজ। ওর ঘাড় মটকাবের জন্যই আমি ভর কইরেছি মিতুজার শরীলে।’ উপস্থিত মানুষজন তো একেবারে হতবাক।

ভূতের মুখে এ কী কথা! যৌবনকালে ময়েজ শেখ অনেক আকাম-কুকাম করে থাকলেও যৌবনের এমন পড়ন্ত বিকেলেও যে এমন আচরণ করবেন, সেটা সবার চিন্তারও বাইরে। শখানেক মানুষের প্রায় শদুয়েক চোখ গিয়ে পড়ল ময়েজ শেখের দিকে। ময়েজ শেখকে দেখাচ্ছে একেবারে ফ্যাকাসে। মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকা ছাড়া তার আর কী করণীয় তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।

হেকমত কবিরাজ আবার পোড়া মরিচ ধরল মিতুজার নাকে। মিতুজা কাশতে লাগল ভয়ানকভাবে। কবিরাজ বলল তিনি, ‘তাড়াতাড়ি শরীল থ্যাইকা নাইমা যা, আর যাওনের আগে চিহ্ন স্বরূপ ওই যে নিমগাছটা আছে ওইটার একটা ডাল ভাইঙা রাইখ্যা যা।’

অন্যদিকে বারান্দার টিনের চালের ওপর বসে বসে আমি তামাশা দেখছিলাম আর হা হা করে হাসছিলাম। ভাবছিলাম মিতুজার এত ক্ষমতা কোথায় যে নিমগাছের ডাল ভেঙে সে নিজের জীবন রক্ষা করবে। অথচ হেকমত কবিরাজের অত্যাচার আমি আর সইতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম কী করা যায়, ঠিক তখনই লক্ষ করলাম নারিকেল গাছটার মাথায় এককাঁদি নারিকেল।

ওগুলোর মধ্যে আবার দু-তিনটে একেবারে ঝুনা হয়ে আছে। আলতো করে একটু বাতাসের ছোঁয়া লাগতেই বড় আকারের একটি ঝুনা নারিকেল গাছ থেকে সোজা ভূপাতিত হলো হেকমত কবিরাজের মাথায়। হেকমত কবিরাজও সঙ্গে সঙ্গে চিৎপটাং। মানুষজন সব চেঁচিয়ে উঠল। এবার তাহলে সত্যি সত্যি ভূত নেমে গেল মিতুজার শরীর থেকে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ঘোড়াদহ গ্রামে আমার কাজ এখানেই শেষ। কিন্তু আমাকে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে অন্য কোনো গ্রামে নতুন কোনো মিতুজার খোঁজে। সেখানে হয়তো কোনো নিগৃহীতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার জন্য।