দেহজমিতে মনোভূমি

মানবদেহের বাইরের অঙ্গ দেখে তার ভেতরে কী ঘটছে যথার্থভাবে আমরা কি দেখতে পারি? আর মনের তো কোনো সীমানা হয় না। দেহ-মন মিলেই মানুষ তার অস্তিত্বকে খুঁজে পায়, আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে। দেহ ও মনকে ঘিরে আমাদের যে-অস্তিত্ব সেটিও যেন মাঝেমধ্যে ভুলে যাই আমরা। সৃজনশীল মানুষের ক্ষেত্রে আত্মানুসন্ধান আরেকটি সৃজন-প্রক্রিয়ার বিষয়। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান নিজেকে খুঁজেছেন তাঁর চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে।
বলছিলাম শিল্পীর সর্বশেষ চিত্রপ্রদর্শনী নিয়ে। তিন দশক আগে কুড়ির কোঠায় ভরপুর তারুণ্যে চীন থেকে চারুশিল্পে উচ্চশিক্ষ নিয়ে ওয়াকিলুরের জার্মানিযাত্রা। সেই প্রবাসকালে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান নিজেকে খুঁজেছেন। শিল্পের আলোয় চিত্রপটের চৌহদ্দিতে নিজের নানামুখী ভাবনাকে জড়ো করেছেন। কেমন করে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেকে, নিজের শিল্পভাবনাকে। সেই স্মৃতি ও চিত্রকর্ম শিল্পী মেলে ধরেছিলেন ঢাকার লালমাটিয়ায় দৃক গ্যালারিতে ‘দেহ জমি-মনোভূমি’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে।
প্রবাসজীবনের একাকিত্ব, শেকড় ছেড়ে থাকার অনিশ্চয়তা, জৈবিক জীবনের ক্লেদ, অনভ্যস্ত সংস্কৃতি যাপন – এসবের প্রতিক্রিয়ায় সে-সময় শিল্পী নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছেন। নিজের দেশের শিল্প-ঐতিহ্যের ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিল তাঁর হৃদয়। তাই তাঁর এই কাজগুলোতে আমরা প্রাচ্যের পট, সরা, তান্ত্রিকশিল্পের ভাষা, মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের রূপ-রস পেয়ে যাই। ভারতীয় চিত্রকলার রূপ, গৌতম বুদ্ধ ও ফকির লালন শাহ্র দর্শন যেন মিলে গিয়েছিল ওয়াকিলের চিত্রপটে! তাঁর সে-সময়কার কাজে বাংলার নদী-মাটি-জলের সরল ফর্ম যেমন দেখা যায়, তেমনি দেহতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব এসব কিছুর উপস্থাপন ঘটেছে ক্ষুদ্র আয়তনের এগ টেম্পারায়। আশির দশকের গোড়ায় শিল্পী শহিদ কবীর তাঁর ছাত্রদের এই এগ টেম্পারা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। ওয়াকিলও শিখেছেন।
এগ টেম্পারায় সহজ-সাবলীলতার সঙ্গে ভাব প্রকাশ করা যায়। শিল্পী ওয়াকিল সেটি উপলব্ধি করে প্রবাসজীবনে এই মাধ্যমটি নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর চিত্রপটে মানুষের দেহজমিনের ভেতরকার কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। বিভিন্ন প্রতীকের আশ্রয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, মনোজাগতিক নানা বিষয়কে তুলে ধরেছেন। ভাঙা নৌকার ওপর ভাঙা পাঁজরের নৌকা-আরোহীর দেহকাঠামো, ওপরে কালচে আকাশে ঘোলা চাঁদ মানবমন আর প্রকৃতির রহস্যময়তাকে তুলে ধরেছে। এছাড়া শিল্পী নানা প্রতীক প্রয়োগ করে দেহমনের তল খুঁজতে কিংবা বুঝতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর চিত্রকর্মের অভ্যন্তরে প্রাণপাখি, আত্মমগ্ন বাউলের দেহভঙ্গিমায় যেমন বাউল সাধনার রূপ পাওয়া যায়, তেমনি বাংলার ভাটিয়ালি সুরের নিবিড় আবেশ মেলে।
শিল্পীর আরেক অনুপ্রেরণা ওপার বাংলার শিল্পী গণেশ পাইন। কতক বিষয় ও ধরন তাঁর চিত্রের মতো মনে হলেও ওয়াকিলের অধিকাংশ কাজেই রয়েছে ভিন্নতা। রং ব্যবহারে শিল্পী অতি নাটকীয়তার পথে যাননি ঠিক, তবে গোধূলি আভার স্নিগ্ধ আলো-আঁধারি রূপ ফুটিয়ে তুলতে যে-রং শিল্পী প্রয়োগ করেছেন তা প্রাচ্য মনস্তত্ত্বের নাটকীয়তাকে তুলে এনেছে।
চিত্র-উপাদানের সূত্র ধরে আমরা দেখতে পাই, কৃষিপ্রধান বাংলার ঘর-গার্হস্থ্য, স্থাপনা, অধ্যাত্মবাদ, কামভাব, প্রেম কীভাবে জায়গা নিয়েছে। যেমন, ‘দেহজমি – মনোভূমি-৮’ ছবিতে মাটির ঘর, বারান্দায় যোগাসনে ভাবুক ফিগর; ‘দেহজমি – মনোভূমি-৬’-এ প্রেমকলায় মত্ত যুগল ফিগর দেহতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের বর্ণনাত্মক গল্পকে বিবৃত করে। এ-অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-বেদনা, সুখ-অলসতা, রহস্যময় নানা চিন্তা-চৈতন্য, সংসার বন্ধন এবং সংসার বন্ধনত্যাগী সন্ন্যাসব্রত পালনের নানা পাঠ আমরা পেয়ে যাই ওয়াকিলুর রহমানের চিত্রকর্ম থেকে।
যৌবনের প্রথমভাগে ওয়াকিল ইউরোপের মাটিতে তাঁর শিল্পকর্মে যে ঐতিহ্যের সন্ধান, আত্ম-আবিষ্কারের চেতনায় লালন এবং বাউল দর্শনের চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেছিলেন, তা আমাদের দূরের নয় বরং পরম্পরা শিল্পভাষার বেশ কাছের। পরে তাঁর ভাবনায় অনেক বাঁকবদল ঘটেছে; নিজের বক্তব্য নির্মাণে যত নিবিষ্ট হয়েছেন, তত অনিশ্চয়তা কমেছে, স্বকীয়তা এসেছে। তারপরও তাঁর সে-সময়ের এই চিত্রভাষা এ-সময়ে এতটুকু মস্নান হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে আমাদের প্রায় সমসাময়িক শিক্ষর্থী ছিলেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। আঁকাআঁকিতে তাঁকে নিবিষ্ট থাকতে দেখেছি সে-সময়। অ্যাকাডেমিক রীতির বাইরে ছবি এঁকে, ভাস্কর্য গড়ে, আড্ডায়-আলোচনায় সচেতন সমাজমনস্ক শিল্পভাবনায় আবিষ্ট সতীর্থদের নিয়ে গত শতকের আশির দশকে সময় নামে যে শিল্পী গ্রম্নপ গড়ে উঠেছিল, ওয়াকিল ছিলেন তার অন্যতম উদ্গাতা। বাংলাদেশের আধুনিক সমকালীন শিল্প-আন্দোলনে এর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। শিল্পশিক্ষর্থে তাঁর চীনযাত্রা, এ-দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্য শিল্পী নিসার হোসেন ও শিশির ভট্টাচার্য্য ভারতে উচ্চশিক্ষ নিতে যাওয়ায় দলের কার্যক্রমে সাময়িক ছেদ পড়ে। নববই দশকের শেষদিক থেকে এই শিল্পদলবদ্ধতায় ছেদ পড়লেও এর সদস্যশিল্পীরা তাঁদের চর্চার মাধ্যমে আমাদের সমকালীন শিল্পে নিজেদের স্বকীয় জায়গা করে নিয়েছেন।
ওয়াকিলুর রহমানের এ-প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজগুলো পূর্ব জার্মানিতে শিল্পীর প্রবাসকাল ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে আঁকা। ছোট কুঠুরির স্বল্পায়তনে কাজ করতে গিয়ে নিজের শেকড় নিয়ে সজাগ ছিলেন তিনি। নৌকা ও মানুষ এঁকেছেন – ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’ গানের প্রেরণায়। নৌকা ও জনপারাপার এই দুইয়ের মিলনে যে জীবনজিজ্ঞাসার তৈরি হয়, তাতে দেখার সঙ্গে অদেখার অনুভবও থেকে যায়।
মানব অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা, গভীর ভাবব্যঞ্জনা ও অতৃপ্তির শূন্যতায় অঙ্কিত অবয়বে পেট, পাঁজর, স্তন শূন্য বিবরে ঢুকে গেছে। শিল্পীর প্রবাসকালে খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় – এই লালনদর্শন তাঁকে প্রাণিত করেছিল। পরে তাঁর কাজ বদলে গেছে।
৩ মে শুরু হয়ে এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে গত ৩১ মে।