একজন সৈনিক, তার মাতৃভূমি ও মা

[১৫ আগস্ট ১৯৪৫]
আকিয়ুকি নোসাকা
অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ
মহাসাগরে জাপানের বহুদূর দক্ষিণে একফালি বালুময় দ্বীপ, এর একদিকে সাগর আর একদিকে গহিন বন, এরই বেলাভূমিতে পড়ে ছিল এক জাপানি সৈনিকের মৃতদেহ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জাপানি সেনাবাহিনী এই দ্বীপে নেমেছিল এবং আরো দূর দক্ষিণে আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য এই দ্বীপটিকেই তারা অবতরণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করত। পরে আমেরিকার সামরিক বাহিনী যখন প্রতি-আক্রমণ শুরু করল দ্বীপটি তখন কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল : এখানেই উড়োজাহাজ রাখা হয়েছে। এখানেই ওঠানামা করেছে, দ্বীপটির ডোবার কোনো লক্ষণ ছিল না।
কিন্তু নিশ্ছিদ্র বনাকীর্ণ অঞ্চল দ্বীপটিকে বসবাসের অনুপযোগী করেছিল, তাই আমেরিকার সামরিক বাহিনীর এখানে নামার আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া ওরা জাপানের কাছাকাছিই এগিয়ে যাচ্ছিল, আরো গুরুত্বপূর্ণ দুটি দ্বীপ সাইপান ও আয়ো জিমাতেই নামতে লাগল। এদিকে জাপান সেনাবাহিনীকে অবিরাম যৌথবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে হচ্ছিল, এই দ্বীপে ফেলে যাওয়া তিনশো সৈনিকের জন্য তারা কিছু করতে পারছিল না। খাবার ও অস্ত্র নিয়ে আসতে চেষ্টা করেনি তা নয়, কিন্তু দ্বীপের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছাতেই আক্রান্ত হয়েছে শত্রম্নসেনার হাতে – ওরা দ্বীপের চারপাশের আকাশপথ ও সমুদ্রপথের প্রহরায় ছিল।
শত্রম্ন-মিত্র উভয়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে বছরের ভালো সময়টা সৈনিকেরা শামিত্মতেই কাটাল – গোলাগুলি নেই, বিস্ফোরণ নেই। কিন্তু এরপর ওরা আর এক যে ভয়ংকর শত্রম্ন – ক্ষুধা – শীঘ্র তার মুখোমুখি হলো।
খাবার যখন ওদের কাছে পৌঁছাল না, ওরা বুঝতে পারল আর কোনো আশা নেই এবং শেষ চেষ্টা হিসেবে জঙ্গল পরিষ্কার করতে শুরু করল, বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরে, পশুপাখি শিকার করে কোনোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগল। কাজটা সহজ ছিল না, গাছগুলো সব গায়ে গায়ে শক্তভাবে লাগানো, আবার ভাইন আর আইভি লতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। একজন মানুষ তিন ঘণ্টা কাজ করলে তবেই দশ মিটার জায়গা পরিষ্কার করে এগোতে পারত।
এরা প্রত্যেকে একা হয়ে গেল, কেবল নিজের কথাই ভাবতে লাগল। কেউ জানে না কাল কী হবে, কী আছে ভাগ্যে! কপালগুণে কেউ একটা টিকটিকি পেয়ে গেলে কাউকে না দিয়ে গোপনে লুকিয়ে ফেলত। ওদের একজন মারা গেলে তার ভাগটা, যতটুকুই হোক অন্যরা পাবে, আর তাতেই সবার মনে নিঃশব্দ আনন্দের বাতাস বয়ে যেত। ক্ষুধা ওদের হীনম্মন্য করেছিল, মানবেতর প্রবৃত্তিগুলো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল।
ওরা প্রজাপতি পর্যন্ত খেত, সত্যি-মিথ্যে জানিনে শুনেছি পাউডারের মতো লাগে। মেঠো ইঁদুরগুলো মুরগির মাংসের কাছাকাছি আর শুয়োপোকা একটু তেতো।
ওদের মধ্যে যারা দুর্বল তারা শুকিয়ে যেতে যেতে কাগজে ঢাকা কংকালের মতো হলো এবং মারাও গেল একের পর এক।
ওরা এ-দ্বীপে এসেছিল শত্রম্ন প্রতিহত করতে, শত্রম্নসংখ্যায় ভীত হয়ে মৃত্যুবরণ শোচনীয় সন্দেহ নেই; কিন্তু তবু সে মৃত্যু হয় যুদ্ধরত অবস্থায় আর তখন, ‘আমি দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করছি’, এই বোধটা কাজ করে।
কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর মধ্যে বীরোচিত কিছু ছিল না। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সৈনিকেরা ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সঙ্গে একদানা চাল নিয়ে ঝগড়া করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিল। কোনো আশাই যখন রইল না কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গেল, অন্যরা আত্মহত্যার উপায় চিন্তা করতে লাগল।
ছ-মাসের মধ্যে তিনশো সৈনিকের সংখ্যা নেমে এলো দুশো পঞ্চাশে আর তারপর আপনমনে জ্বলে জ্বলে নিঃশেষিত প্রদীপের মতো একের পর এক দ্রম্নত মারা যেতে শুরু করল। ১৯৪৫-এর গ্রীষ্মে মাত্র পাঁচজন বেঁচে রইল এবং তারাও প্রত্যেকে আলাদা হয়েই থাকল।
এই পাঁচজন বেঁচে থাকার অধ্যবসায়ে বেঁচে রইল, আশ্চর্য দ্রম্নততায় সাপ, ব্যাঙ, মাছ ধরতে দক্ষ হলো এবং যত সামান্যই হোক হিংসাত্মকভাবে অপরের চোখের আড়াল করে মজুদ করে রাখতে লাগল।
এদের মধ্যে কনিষ্ঠতম সৈনিকটি জেলে পরিবারের সন্তান, ওর জীবন কেটেছিল সাগরপারেই। ও জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাগরের লতাপাতা আর গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মাছ ধরতে পারত। এই সুবিধার জন্য যতদিন ওর শক্তি ছিল শহরে লালিত সৈনিকদের মতো ওকে অনাহারে থাকতে হয়নি। কিন্তু তারপর বহুদিন ধরে এক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া চলতে লাগল, ও আর সাগরে যেতে পারছিল না, তখন ঘুমিয়ে সময়টা পার করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, ইতোমধ্যে ওর সযত্নে শুকানো লুকিয়ে রাখা মাছ পচে গেল।
আবহাওয়া শান্ত হলো; কিন্তু ততদিনে ওর শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়ল যে সাঁতরে বেশি দূর যেতে পারল না, আর তাই অল্পই ধরতে পারছিল। তারপর কেবল যখন ভালো হয়ে উঠছে তখন আবার একটা ঝড় এলো। অন্য সবার চেয়ে ও ভালো ছিল ঠিকই কিন্তু তারপর আসেত্ম আসেত্ম শুকিয়ে যেতে লাগল, সাগরপারে ভেসে আসা লতাপাতা খেয়েই বেঁচে রইল। কিন্তু একসময় কুড়িয়ে নেওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে গেল আর সেই থেকে জঙ্গলের সামান্য দূরে একটি গাছের ছায়ায় কেবলই শুয়ে থাকতে লাগল।
ক্ষুধা কল্পনার জন্ম দেয় – অবশ্যই খাবার নিয়ে, তবে তা মহাসমারোহের খাবার নয়, ও স্বপ্ন দেখত একেবারেই সাধারণ খাবারের যেমন ওর নানি যে ঝালপিঠে ভাজত এলাকার মন্দিরের উৎসবে সেই কথা।
কাজ করতে করতে অপরিচ্ছন্ন হাতে ময়দায় জল দিয়ে গোলা করত নানি, তারপর গরম তাওয়ায় গোলা ঢেলে গোল করে ভেজে কুঁচো চিংড়ির শুঁটকি আর সবুজ জলজ লতাপাতা দিয়ে ওপরে লম্বা করে সস ঢেলে দিত, সেই সুস্বাদু সসটা রুটির ওপর পড়ছে আর গরম তাওয়ায় সামান্য ঝলসাচ্ছে – সুগন্ধটা পরিষ্কার ওর নাকে এসে লাগত।
আবার সেই যে গ্রামের এক প্রামেত্ম এক বুড়ো বসত পদ্মমূল, গাজর আর মিষ্টি আলু দিয়ে ভাজা ছোট্ট ছোট্ট টেম্পুরা নিয়ে, ওকে পাঠানো হতো সেই টেম্পুরা কিনতে। বুড়ো মানুষটার নাক ঝরত, প্রায়ই সে কুঁচো কুঁচো ভাজা ময়দার গোলা ছুড়ে দিত আর ওটা ওরা মিসো সুপে মিশিয়ে খেত।
মিসো সুপের বাটিতে সেগুলো ভাসছে – স্পষ্ট আসত ওর চোখে, – আর সুপের ওপরটা তেলতেলে হয়ে গেছে। ভাজা সার্ডিনের স্বাদটাও ওর জিভে আসত; সিন নদীতে জালে আটকে পড়া সার্ডিনের বোঝা টেনে টেনে ক্লান্ত জেলেরা জাল থেকে কিছু মাছ থাবা দিয়ে উঠিয়ে মাথাটা ছিঁড়ে ফেলে সাগরের জলে ধুয়ে নিয়ে গিলে ফেলত, মাছ কিন্তু তখনো মরেনি। শীতের সময় ওরা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরত। ওদের জন্য প্রস্ত্তত থাকত মিষ্টি, গরম ধেনো মদ আর মিসো সুপ – ওপরে ভাসত ছোট্ট ছোট্ট ভাজা ময়দার গোলা, খেয়ে আঙুলের ডগা পর্যন্ত গরম হয়ে উঠত। আবার সেই মুলোর কুঁচি ছড়ানো তখন তখন পেষা চালের গুঁড়োর পিঠে, তারপর বার্লির ছাতু, ভুট্টার খই আর দোকানের মুচমুচে ঝাল নিমকি – খাবারগুলো চোখের এত কাছে মনে হতো যেন ও হাত বাড়ালেই ধরতে পারে। –
ওর বাবা অল্প বয়সে জাহাজডুবিতে মারা গিয়েছিল আর মায়ের কাজের চাপ ছিল খুব বেশি; ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার কিছুদিনের মধ্যেই নিউমোনিয়া হয়ে মা-ও মারা গেল। তারপর গ্রামে ও আত্মীয়স্বজনদের একহাত থেকে একহাতে গিয়ে পড়েছিল, তাই পারিবারিক জীবনের বাসত্মবিক কোনো স্মৃতি ওর ছিল না।
সেই ছোটবেলা থেকেই ও নিজের আয়ের পয়সা দিয়ে নিজের জলখাবার কিনতে অভ্যসত্ম হয়েছিল আর সেইসব কথাই ওর চোখে স্পষ্ট ভাসছিল।
দিনে দিনে এত দুর্বল হয়ে পড়ছিল যে মুখের ওপর থেকে মাছি তাড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল। গালদুটো কুঁচকে, চোখ পিটপিট করে মাছির হাত থেকে রেহাই পেতে চাইত। আর খাবারের কথা ভাবছিল না, মনটা ব্যাকুল হচ্ছিল জাপানে ফিরে যাবার জন্য। যে-গ্রামে বেড়ে উঠেছিল সেখানেই যে যেতে হবে তা নয়, জাপানের যেখানেই হোক

… তখন ওর একটাই চাওয়া – ও যেন নিজের দেশের মাটিতে মরতে পারে।
এ যেন দশ লক্ষ চাওয়ার মধ্যে একটা যদিবা পূর্ণ হয়; কিন্তু তারপরও এ চাওয়া পূর্ণ করার জন্য ও বিভিন্ন উপায় ভাবতে লাগল। জঙ্গলের একটা গাছ কেটে ভেলা তৈরি করতে পারে তারপর ভেলাটাকে কুরোশিও মহাসমুদ্রের খরস্রোতে ছেড়ে দিলে ওকে তো নিয়ে যাবে দেশে! গানের কলি মনে পড়ল : ‘একলা এক ডাব আপন ঠিকানা ছেড়ে বহুদূরে ভেসে এসে এক সৈকতে উঠেছে।’ একবার জেলে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে খরস্রোতের ভয়ংকর শক্তির অভিজ্ঞতা ওর হয়েছিল আর নিশ্চয়ই একই রকম হবে কুরোশিও স্রোত।
এই তো! এটাই আমি করব। স্বস্তিতে কোমল হলো ওর মুখের ভাব। ভেলা তৈরির জন্য যে শক্তি আর যন্ত্রপাতি লাগে তার কোনোটাই ওর ছিল না; কিন্তু তারপরও ও কীভাবে জাপানের দিকে যাত্রা করবে সেকথাই ভাবতে লাগল, যেন ভেলা প্রস্ত্ততই ছিল।
প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ও যে কুরোশিও স্রোতের কথা পড়েছিল তা ওর ভালো মনে ছিল। আর অস্পষ্টভাবে হলেও প্রশান্ত মহাসাগরের ছবিটা মনে ছিল, তীর এঁকে দেখানো ছিল উষ্ণ ও শীতল স্রোত প্রবাহগুলো, কিন্তু লেখাপড়া করতে ওর একটুও ভালো লাগত না, সবসময় কেবল কমিক আর রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ত আর ভূগোল পড়তে বসলেই ওর দিবাস্বপ্ন শুরু হয়ে যেত।
ইস্, কেবল পড়াশুনোটা যদি করতাম, মন খারাপ করে ও ভাবল এবং ভেলার কথা ভুলে গিয়ে জাপানের দিকে ধাবিত অতিথি পাখি কীভাবে ধরা যায় সেকথা ভাবতে লাগল … যদি ভাইন লতা দিয়ে একটা ঝুড়ি বানাতে পারে তবে কটা পাখি বইতে পারবে ওকে? শুকিয়েই গেছে শরীরটা, একশ পাখি হলেই তো যথেষ্ট, পাখি ধরার জন্য মাছ গাঁথতে হবে বড়শিতে, ছোটবেলায় দেখেছে বড়রা ওভাবেই কালো বালুহাঁস ধরত; কতদিন লাগতে পারে জাপানে পৌঁছাতে? হঠাৎ আনন্দ হলো ওর যেন দেশে পৌঁছেই গেছে, ও হেসে উঠল।
ঝুড়িটা সম্ভবত দুলবে। ওদের যখন জাহাজে উঠিয়ে এই দ্বীপে আনা হয়েছিল তখন সাগরের প্রচ- ঢেউয়ে জাহাজ দুলছিল এবং ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ও। কথাটা মনে হতেই অনুভব করল যেন ওর শরীরটা বাতাসে ভাসছে আর সামান্য অসুস্থও বোধ করছিল। চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পরে আর সহ্য করতে পারছিল না এবং তারপরই ভয়ংকর ভারী বোধ করছিল; কিন্তু শরীরটা তখনো দুলছে বলেই মনে হচ্ছিল।
চারদিকটা দেখার জন্য মাথাটা সামান্য তুলেছিল আর তখনই ভয়ানক শব্দে কোথা থেকে যেন এক উড়ন্ত বড় নৌকো এসে একশ মিটার দূরে জলে নামল।
রাবার ডিঙিতে এক নাবিক সৈকতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘এই যে, সব ঠিক আছে তো? তোমাকে জাপানে নিয়ে যাব আমরা।’ স্বপ্ন যে তবে সত্যি হলো। উড়ন্ত নৌকোর মধ্যে এই টাইপ-২ সবচেয়ে বড় আর জাপানে একসঙ্গে অনেক তৈরি হয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াতে এ-নৌকো ব্যবহার হতো। সৈনিক একবার মাত্র একটা দেখে এর অপূর্ব নির্মাণকৌশলে বিস্মিত হয়েছিল। ওর মতো একজন নিম্নপদস্থ সৈনিকের জন্য এ-নৌকো এসেছে, এতে আশ্চর্য হবার আগেই দ্রম্নত ওকে তুলে নেওয়া হলো নৌকোয়, ওখানেই সোনালি বিনুণির দড়ি ঝোলানো এক অ্যাডমিরাল নোনতা পিঠে ভাজছিলেন, তার সামনে ও সৈনিকের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল, আর ওকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে অ্যাডমিরাল সম্মানসূচকভাবে ভাজা পিঠেটা ক্রিসেনথিমাম ক্রেস্ট বসানো খবরের কাগজে মুড়ে ওর হাতে তুলে দিলেন, বললেন, ‘মহামান্য সম্রাটের উপহার।’
সৈনিক ভাবল, ইস্! সম্রাটের ভাজা পিঠেটায় সস দেওয়া নেই কিন্তু তবুও ভক্তিভরে পিঠেটা হাতে নিল আর কামড় দিতে যাবে এমন সময় পরিষ্কার জোরালো কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘শত্রম্ন হামলা করেছে।’ উড়ন্ত নৌকো তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দ্রম্নত কেবল ঘুরতেই লাগল আর ঘুরতেই লাগল, তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। দুঃখে ভেঙে পড়া মনে সৈনিক যেই ভাবছে এবার কী শেষে মরেই যাচ্ছি, তখনই এক বিশাল কচ্ছপ সামনে হাজির হলো।
কচ্ছপটা বলল, ‘পিঠেটা আমাকে দাও, তুমি যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাব।’ কচ্ছপটাকে দেখে মনে হলো, ওর অনেক বয়স হয়েছে, খোলসটা সামুদ্রিক লতাপাতায় ঢাকা। সৈনিক হাত বাড়িয়ে দিতেই কচ্ছপটা সামনের দুটো পায়ে নিপুণভাবে পিঠেটা নিয়ে নিল। খাওয়া শেষ করেই সৈনিক যাতে ওর খোলসের ওপর বসতে পারে সেইভাবে ঘুরে দাঁড়াল।
‘তোমাকে ড্রাগন দেবতার প্রাসাদে নিয়ে গেলে কেমন হয়?’
‘না, আমি তো জাপানে যেতে চাই।’
‘আহা! সে তো আমার জন্যে বেশ দূর হয়ে যায়।’
‘কিছুদূর যেতে পারলেই হবে। দূর থেকেও যদি আমার দেশের পাহাড়গুলো দেখতে পাই তাতেই আমার ভালো লাগবে।’
ঝাঁকে ঝাঁকে মাছেরা চলেছিল আবাস ত্যাগ করে, মনে হচ্ছিল যেন কাগজ কেটে তৈরি, বিদ্যুৎ ঝলকের মতো দুপাশে সরে গিয়ে কচ্ছপের যাবার পথ করে দিচ্ছিল। এত কাছে মাছগুলো, খালি হাতেই ধরতে পারত সৈনিক; কিন্তু ওরা যে কচ্ছপের বন্ধু তাই ও বিরত রইল। ওরা জলের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে তো কোনো অসুবিধে হলো না। মায়ের বলা পরির গল্প মনে পড়ল সৈনিকের – এভাবেই তবে উরোশিমা তারো ড্রাগন প্রাসাদের রাজকন্যার কাছে পৌঁছেছিল। শৈশবে শোনা গল্পের কথা মনে পড়ে আনন্দ হচ্ছিল, আরো মনে পড়ল কচ্ছপকে পিঠে দেওয়া অনেকটা সেই পিচ বয় মোমোতারোর গল্পের মতো।
‘আর যেতে পারব না আমি, খুব ক্লান্ত লাগছে, কাছেই একটা দ্বীপ আছে ওখানে নিয়ে যাই তোমাকে।’ হঠাৎ করেই চারপাশটা হালকা হয়ে গেল আর জল ভেদ করে ওপরে উঠে আসতেই চোখ ঝলসানো সূর্যালোকে ও যেন নিশ্চিতই এক দ্বীপের সীমারেখা অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল।
আরো কাছে এগিয়ে যেতে সৈনিক হতাশ হলো নারকেল গাছ দেখে। জাপান তো এখনো বহুদূরে। তবে এই দ্বীপে বেশ কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছিল আর ওর দিকে স্বাগতভঙ্গিতে হাতও নাড়ছিল। কুচকুচে কালো মানুষগুলোর কানে মাকড়ি, হাতে বর্শা। ওরা ডেকে বলল, ‘এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করে আছি আমরা।’
সৈনিক দ্বীপে নামতেই কচ্ছপ সাগরে অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্বীপবাসীরা ওকে নিয়ে গেল তালপাতা ছাওয়া একগুচ্ছ কুঁড়েঘরের দিকে আর ও মহাবিস্ময়ে দেখে সবচেয়ে বড় ঘরটাতে মাথায় মুকুট পরা বড় বড় গোল চোখের এক জাপানি ছেলে।
মনে মনে সৈনিক ভাবছিল ওকে যেন আগে কোথায় দেখেছে আর তখুনি ছেলেটি বলে উঠল, ‘আমি তো ড্যানকিচি, রোমাঞ্চ উপন্যাসের নায়ক।’ একে পরিচিত মনে হবে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। সেই ছোটবেলাতে টেলিভিশনে কার্টুন দেখাত ড্যানকিচির ওপর।
সৈনিককে নারকেলের দুধ, আনারস আর কলা খেতে দিয়ে ড্যানকিচি বলল, ‘তুমি আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করেছো, তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, তোমার যতদিন ইচ্ছে এখানে থাক।’
‘ধন্যবাদ, আমাকে যে জাপানে ফিরতে হবে’, জোর দিয়ে বলল সৈনিক।
‘বিশেষ কোনো কাজ আছে তোমার ওখানে?’ কী উত্তর দেবে, কথা হারিয়ে গেল সৈনিকের, কেন যে জাপানে ফিরে যেতে চাইছিল তাই তো নিশ্চিত জানত না। ওর বাবা-মা মারা গিয়েছিল আর জেলের জীবন যে কত কঠিন এতটাই কঠিন যে সৈনিক হতে পেরে ও যেন মুক্তি পেয়েছিল আর আশাতীতভাবে কত নতুন জায়গা দেখা হয়েছিল সৈনিক হয়ে।
‘জাপান আমার মাতৃভূমি, তাই আমি ওখানে ফিরে যেতে চাই। আমি শুনতে চাই মানুষ আমার ভাষায় কথা বলছে। আমার দেশের পাহাড় আর নদীর জন্য মনটা কাঁদে।’
‘কিন্তু আমাদের এখানে তো কেবল ছোট্ট নৌকো আছে।’
‘ওই ওতেই, ওই ক্যানোতেই হবে, দয়া করে একটা দাও আমাকে, আমি নিজেই চালিয়ে চলে যাব দেশে।’
তখুনি রাজি হলো ড্যানকিচি, ওর জন্য একটা প্রস্ত্তত করে দেবার আদেশ দিলো।
‘আবার এসো’, বলে ড্যানকিচি বিদায় দিতে সৈনিক মাথা নেড়ে ওদের নির্দেশিত পথে বৈঠা চালাতে শুরু করল।
রাত নামল, জ্বলজ্বলে ধ্রম্নবতারা ঝিকমিক করে উঠল, সৈনিক ধ্রম্নবতারা লক্ষ করে অদম্য আগ্রহে বৈঠা বেয়ে চলতে লাগল।
দ্বিতীয় রাতে তিমি মাছের মতো বিশাল এক বস্ত্ত ওর পথে উঠে এলো। আসলে এক ডুবোজাহাজ। ও বিস্ময়ে তাকিয়েছিল আর ততক্ষণে বন্দুক বসানো ধাতুর সত্মম্ভটা ওর দিকে ঘুরে এলো।
‘না, না আমি শত্রম্ন নই, আমি জাপানি সেনাবাহিনীর প্রথম শ্রেণির নিম্নপদস্থ একজন সৈনিক।’
তখন দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন নৌবাহিনীর পোশাকে উঁচু কলার শোভিত কঠিনদর্শন এক মানুষ – অন্ধকারেও পরিস্ফুট ছিল তার কাঠিন্য, তিনি অত্যন্ত গম্ভীরভাবে দুই পা ছড়িয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়ালেন।
‘আমি ক্যাপ্টেন টাকেডা। তুমি এখানে কী করছ?’
ক্যাপ্টেন টাকেডা? সৈনিক তো আগে তার নাম শুনেছিল। ও তখন ডুবোজাহাজটাকে ভালো করে দেখতে লাগল, সামনে-পেছনে ছ-টা বন্দুক সাজানো, সত্মম্ভটা আক্রমণাত্মকভাবে বেরিয়ে এসেছে আর এটা নিশ্চয়ই উড়ন্ত ডুবোজাহাজ শাওয়া রাইডার থেকে ফুজি। ঠিকই তো, এটাই তো ক্যাপ্টেন টাকেডার বড় ভাই প্রফেসর টাকেডার তৈরি, তাই না?
সৈনিক চিৎকার করে বলল, ‘আমি জাপানি, আমাকে সাহায্য করুন।’ একটা মই নেমে এলো ওর দিকে।
‘আমরা দক্ষিণে যাচ্ছি আমেরিকাওয়ালাদের খতম করতে। শেষ পর্যন্ত বাগে পেয়েছি ওদের।’ সৈনিকের হাতে একটি পুরু দলিল এগিয়ে দিয়ে আরো বললেন, ‘দেখো কী ক্ষমতা এই ছোট্ট জাহাজের।’ ওখানে ছিল জাহাজটির ওড়ার ক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ৪৫০ কিলোমিটার, জলের নিচের গতি ২৫ নট (১ নট = ১৮৫২ মিটার) আর জলের ওপর ৫০ নট।
তাহলে এতটা সম্ভব হয়েছে! সৈনিক জানতে চাইল, ‘আয়োকি বিমও কি পাওয়া গেছে?’
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় শাওয়া রাইডারস এই নতুন অস্ত্রের কথা ও জেনেছিল, কথাটা মনে পড়াতে ও জানতে চাইল; অস্ত্রটার কথা পড়ে কি যে দ্রম্নত হয়েছিল নাড়ির গতি।
‘অবশ্যই! আয়োকি বিম দিয়েই তো আমরা গ্রম্নম্যান আর লকহিডকে আকাশপথ থেকে নামিয়ে দেব।’
কিন্তু ফুজি দক্ষিণে গেলে তো সৈনিক জাপান থেকে আরো দূরে চলে যাবে। ‘ক্যাপ্টেন, আমি যে আমার দেশে, জাপানে ফিরে যেতে চাই, আমাকে কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দিলেই হবে, যে কোনো জায়গায়।’
সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন টাকেডা কেবল সাহসীই ছিলেন না, তার হৃদয়ও ছিল। ‘ঠিক আছে তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা যেভাবেই হোক করব আমরা, যুদ্ধে আছি তাই কোথাও নামতে পারব না, জানাজানি হয়ে যাবে, শত্রম্নবাহিনীর লোক তো আছে, আমরা উড়ন্ত অবস্থায় থাকতেই তুমি প্যারাসুটে নেমে যেও।’
শেষ পর্যন্ত দেশে যাচ্ছে ও। উড়ন্ত জাহাজ থেকে একেবারে নিশ্চিমেত্ম ও হালকা বাতাসে লাফিয়ে নেমে পড়ল। শান্তভাবে ভেসে চলছিল কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, এমনকি পায়ের নিচের জমিও না। ফুজি জাহাজ তো রকেট থেকে নীলচে আগুনের তীর ছুটিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে। আবার ওর মনটা খারাপ হতে লাগল – সত্যিই কি ধীর গতিতে ভেসে নিচে নামছে, নাকি বাতাস ওকে অন্য পথে নিয়ে চলেছে!
কালি ধোয়া প্রায়ান্ধকার আকাশে চলতে চলতে শেষে ওর ঘুম পেয়ে গেল। একটু যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন ওর স্পষ্ট বোধ হলো ওকে কেউ বহন করছে; শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বাজছিল ওর কানে। চোখ তুলে দেখে সাদা কাপড়ে জড়ানো ওর শরীর আর সত্যিই এক বিশালাকায় পাখি ওকে লম্বা ঠোঁটে বয়ে নিয়ে চলেছে।
ও, বক! যত রকম যানবাহনে ও এতটা পথ এসেছিল তার মধ্যে এবারই ওর সবচেয়ে সহজ লাগছিল, আর এই প্রথমবার সত্যিই মনে হলো যে ও জাপানে এবং ওর মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারছে। ছোটবেলায় মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল বক পাখিরা নবজাতক শিশুদের মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়। তার মানে তো ও মায়ের কাছেই চলেছে এবং ছোট্ট শিশুটি হয়েই।
বকের ঠোঁটের ভেতর ঝুলন্ত অবস্থায় একটু একটু দুলছিল – তাকিয়ে দেখে নিচে জাপান মানচিত্রের মতো বিছিয়ে আছে, মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুজি পাহাড়।
শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছি তবে। ফিরে এসেছি আমার দেশে! আবেগে বুকটা ফুলে উঠল ওর। মা কোথায়? বক যখন নামতে শুরু করেছে ও তখন নিচে ঝুঁকে মাকে খুঁজতে লাগল।
বড় দ্রম্নত নামছিল বকটা, মাথা ঘুরতে লাগল সৈনিকের, নিজেকে সামলে রাখতে পারছিল না, তাই দুহাতে হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরে গুটিয়ে রইল আর মাথাটা নিচু হয়ে পড়ল। এবার চোখ খুলে মাকে দেখতে পেল। মা, মা, ও চিৎকার করে ডাকল, মা!
১৫ আগস্টে সাগরবেলায় পড়ে ছিল অনাহারে মৃত এক সৈনিক; তার মাথাটা জাপানের দিকে আর গোটানো শরীরটা ঠিক যেন
মাতৃজঠরে শিশু।
চামড়া ঢাকা হাড় ক-খানা ছিল কেবল, কিন্তু মুখে অপরিমেয় প্রশামিত্ম, যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন ছিল না।

লেখক পরিচিতি
১৯৩০ সালে জাপানে আকিয়ুকি নোসাকার জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের হাত থেকে তিনি নিজে বেঁচে গেলেও পিতামাতাকে হারিয়েছিলেন এবং ফলস্বরূপ তাঁর ভগ্নিরও মৃত্যু হয়।
তিনি ‘ভস্মোত্থিত প্রজন্ম’-এর একজন সদস্য এবং ২০১৪ সালেও বলেছেন, ‘এখনো আমার ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্তরণ হয়নি।’ তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি গীতিকবি ও গায়ক ছিলেন। রাজনীতিবিদ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। ২০১৫ সালে এই ভস্মোত্থিত স্ফুলিঙ্গের মৃত্যু হয়।
এই গল্পটি The Cake Tree In The Ruins নামক গল্পগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। এই গল্পের পটভূমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট সম্রাট হিরোহিতোর রেকর্ডকৃত ভাষণ রেডিওর মাধ্যমে জাপানের উদ্দেশে সম্প্রচারিত হয়; ওই ভাষণে তিনি যৌথবাহিনীর কাছে জাপানের আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন। সেজন্য এই দিনটি যুদ্ধবিরতির দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং প্রতিবছর জাপানে এদিনটি শহিদ যোদ্ধাদের স্মরণে উদ্যাপিত হয়ে থাকে।