জীবন থেকে নেয়া স্বাধীনতার সূচনাপাঠ

আহাদ আদনান
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যতের ভূত নামে একটি ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড় পাওয়ার পরও সুকৌশলে এটি দর্শকের কাছ থেকে অন্ধকারে রাখা হলো। এর অপরাধ, কিছু সংলাপে সরকার এবং কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক কটাক্ষ (প্রকাশ্য সমালোচনা নয়) ছিল। ‘লঘু পাপে’ ‘গুরু দ-’ আর কি। এ-খবরটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর একটি নাম জ্বলে ওঠে, জীবন থেকে নেয়া। অন্তর্জাল ঘেঁটে জানলাম এর মুক্তির অর্ধশতাব্দী দোরগোড়ায়। কী ছিল সেই ছবিতে? আমাদের নতুন প্রজন্ম কতটুকু জানে এ-বিষয়ে?
জীবন থেকে নেয়া মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। ‘পাকিস্তান’ নামের উদ্ভট স্বদেশটা আমাদের তিক্ত ‘পরদেশ’ হতে শুরু করেছে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই পরিবর্তনে বিপস্নবের দানা বাঁধছে। সেই ২১ ফেব্রম্নয়ারি পার হয়ে গেছে আঠারো বছর আগে। ‘প্রভাতফেরি’র মাঝে আমাদের লুকিয়ে থাকা ক্ষক্ষাভের আগুন ঠিকরে বেরোয়। এই ফেব্রম্নয়ারি, প্রভাতফেরি যে সেলুলয়েডের ফিতায় ফুটে উঠতে পারে, কে ভেবেছিল তা জহির রায়হানের আগে?
সাধারণত সিনেমার গল্প শুরু হয় প্রথম দৃশ্য থেকে। এই ছবির গল্প বলা এরও আগে, কুশীলবদের নাম প্রদর্শনের সময়। একটি দেশ, একটি সংসার, একটি ‘চাবি’র গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র। ‘একটি দেশ’ আর ‘একটি আন্দোলন’ কথা দুটি দিয়েই যেন তৎকালীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল হুংকার শুনতে পাই। ভবিষ্যতের ভূত কিংবা হীরক রাজার দেশের মতো রূপক কটাক্ষ নয়, একেবারে চাঁছাছোলা সেস্নাগান এখানে।
‘একটি দেশ’ কথাটি কেটে দেওয়ার চাপ ছিল সেন্সর বোর্ডের কাছ থেকে। অবশ্য কাঁচির আঘাত আসতে পারত আরো ডজনখানেক দৃশ্যে। এর চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে নিষিদ্ধ করার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার গল্প পরে বলছি। আগে ছবিটি আরেকবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রথম দৃশ্যে আনোয়ার হোসেন ব্যানার লিখছেন ‘অমর একুশে’। একজন বাঙালি মাত্রই ‘একুশ’ কথাটা জানে। ঠিক বিপরীতভাবে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি (এবং এদেশীয় পাকিস্তানিমনা) চাইবে একুশ কথাটি মুছে দিতে। সেন্সর বোর্ডের কাছে নিষিদ্ধ শব্দ ছিল এই ‘অমর একুশে’। ‘সারাটা জীবন তো তোমার দেশ দেশ করে জেলখানাতে কাটল। বেরিয়ে আসতে না আসতে আবার শুরু করেছ?’ এই সংলাপ দিয়ে পরাধীন দেশের কোনো ছবি তার গল্প বলা শুরু করতে পারে, ভাবতেও অবাক লাগে। আর পরেই বোনকে বোনের দুধভাত খাওয়ানোর দৃশ্য। আমার কেন যেন পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গার কথা মনে পড়ে। বাঙালির সেই চিরাচরিত আবেগ। তিন ভাইবোন যখন সরকারিভাবে ‘আপাত নিষিদ্ধ’ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ রেওয়াজ করবে তখন ফ্রেমের এক কোনায় দ্বিধান্বিত আমজাদ হোসেনকে পাবেন। তিনি আমাদের মাঝে কিছু সিদ্ধান্তহীন ভীতু, রক্ষণশীল চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন প্রায় পুরো ছবি জুড়ে। কিন্তু একেবারে সেই রক্ষণশীল বাঙালিও কিন্তু মিছিলে মিশে যায়, গুলি খায়, শহিদ হয়। ঠিক একাত্তরের গল্প। অথচ এক বছর আগেই অনাগত ভবিষ্যতের গল্প কী করে বলে গেলেন জহির রায়হান?
খাজনার বোঝা কাঁধে নিয়ে নুইয়ে পড়ছে কংকালসার এক ব্যক্তি। নিচে লেখা ‘খাজনা, ট্যাক্সের বোঝা’। আরেক ব্যানারে লেখা ‘সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ’। ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘কৃষক মজদুর এক হাও’, ‘বাঁচার মত বাঁচতে চাই’, ‘১১ দফা মানতে হবে’। আরেকটি ছবিতে হাত, চোখ বাঁধা যুবক। প্রভাতফেরির এই দৃশ্যগুলো অভাবনীয়।
‘একুশে ফেব্রম্নয়ারি, সেটা আবার কী?’ ঠিক যেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের কণ্ঠস্বর। রওশন জামিল খুব সম্ভবত তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আমরা আজ চলচ্চিত্রে শক্তিশালী নারী চরিত্রের অভাব নিয়ে আলোচনা করি। অথচ এই ছবির প্রাণ যেন এই নারী চরিত্র। পুরোটা ছবি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন নেতিবাচক চরিত্রের রওশন জামিল। এই চরিত্র ‘মিলিটারির মত রাইট লেফট করে’, খালি পায়ে প্রভাতফেরি নিয়ে কটাক্ষ করে, কথায় কথায় মাইনে কেটে নেয়, গান গাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, নতুন বউকে স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, বিপস্নবীকে চোর-ডাকাত গালি দেয়।
‘এই সংসার আমার। এই চাবিকাঠি হাতে রাখার জন্য যা কিছু করার দরকার তাই আমি করব।’ মিলিয়ে নিন ‘একটি দেশ, একটি সংসার’ কথাটির সঙ্গে। এর জবাবও আছে রাজ্জাকের কণ্ঠে।
‘কে বলেছে এটা তোর সংসার? এটা আমাদের সংসার … যেতে হলে তুই যাবি, আমি যাব কেন? … খবরদার ছোট ছোট করবি নে, ছোট কিরে? গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। যে বাড়ির একটা লোক তাকে পছন্দ করে না, তবু জোর-জবরদস্তি করে সবার ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে। এই সংসারে অনেক দিন রাজত্ব করেছিস তুই, আর না।’
খান আতাউর রহমানের লেখা, সুর করা, কণ্ঠ দেওয়া ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ কি শুধুই হাস্যরসাত্মক গান? ‘দিকে দিকে বাজল যখন শিকল ভাঙার গান, আমি তখন চোরের মত হুজুর হুজুর করায় রত, চাচা আপন বাঁচা বলে বাঁচিয়েছি প্রাণ। আসলে যে বাঁচার নামে আছি মরে।’ এই কথাগুলো বিবেককে কি আজো নাড়া দেয় না?
ছবির পরতে পরতে আছে বিপস্নবের দীক্ষা। ছবিটি শুধুই ছবি নয়, যেন এক আদর্শলিপি।
‘কী পেয়েছি আর কী দিয়েছি, তার হিসেব করতে গেলে তো আর দেশকে ভালোবাসা যায় না। দেশকে ভালোবাসতে হয় নিঃস্বার্থভাবে। দেনা-পাওনার হিসেব নিয়ে যারা ব্যসত্ম থাকে তারা সর্বনাশ করছে।
সেই মান্ধাতার আমলের আইনগুলো তোমরা কতদিন চালাবে? নতুন আইন তৈরি করতে পারো না? এমন আইন তৈরি করো যাতে এদেশের মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত পেট ভরে খেতে পারে।’
‘দেশে অবিচার হলে, অত্যাচার হলে আপনারা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।’
‘দেশ আর ঘর সে তো একই কথা। … ঘরে ঘরেও আন্দোলন করতে হবে।’
আছে ঘরে লাগানো পোস্টার। একজনের শাসন চলবে না। গু-ামি বন্ধ করো।
আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীত তখন শুধুই একটি রবীন্দ্রসংগীত। অর্থাৎ আরেকটি নিষিদ্ধ ব্যাপার। ‘আমার সোনার দেশের সোনার মাটিকে কলঙ্কিত হতে দিতে চাই না বলেই তো দেশ দেশ করি। মাটির কথা বলি।’ এই সংলাপের পর যখন বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’, আজো চোখ সজল হয়ে ওঠে।
মহাকবি ইকবালের একটি গানের দুর্দান্ত ব্যবহার আছে এই ছবিতে। গানের কয়েকটি কথা খেয়াল করুন।
ছোট পাখিদের ঈগলের সাথে যুদ্ধে লড়িয়ে দাও।
জনতাই হবে দেশের মালিক, ওই আসে সেই জামানা।
যে-দেশের বুকে পায় না চাষিরা পেটের ক্ষুধার অন্ন,
সেই দেশের প্রতি শস্যকণায় আগুন লাগিয়ে দাও।
সেন্সর বোর্ডকে তাতিয়ে দিতে আর লাগে কী!
আর বিদ্রোহী কবির ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গান তো অনেকেরই মুখস্থ। ছবির একেকটি গান যেন ইতিহাস।
আরেকটি শিক্ষা আছে এই ছবিতে। দুষ্টের অভিজ্ঞতার কাছে ভালোর অনভিজ্ঞতাহেতু পরাজয়। সাময়িক পরাজয়। তাই বুঝি দুধভাতের বোন বিষের গস্নাসের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ায়।
শেষের দিকে আদালতে খান আতাউর রহমানের দুটি সংলাপ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
‘ও বাড়িতে দুটো দল আছে। এক দলে বাড়ির সবাই, আরেক দলে এই মহিলা একা। এই মহিলা পুরো পরিবারের উপর ডিক্টেটরি শাসন চালান। ওই বাড়িতে কারো কোনো স্বাধীনতা নেই।’
‘হিটলারও ভুল করেছিল। তুমিও ভুল করলে। সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না। সত্যের জয় হবেই।’
শুটিং চলাকালেই এই ছবি একবার আর্মি দ্বারা আক্রান্ত হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জহির রায়হান এবং রাজ্জাককে। পরে জহির রায়হান বন্ড দিয়ে এলেন, যদি এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তবে তার দায়ভার তিনি বহন করবেন।
এবার সেন্সর বোর্ডের গল্প। প্রথমে ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও মেজর মালেক সেন্সর ছাড়পত্র না দেওয়ার চেষ্টা করে।
তবে দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শক আগেই তাদের খায়েশ জানতে
পেরে মিছিল শুরু করে দেয়। ফলে সামরিক সরকার বাধ্য হয় ছবিটি মুক্তি দিতে। কিন্তু মুক্তির প্রথম দিনই সারাদেশে হইচই পড়ে যায়। প্রথম দিনই নিষিদ্ধ হলো প্রদর্শনী। সব সিনেমা হল থেকে আর্মি জব্দ করে নিয়ে গেল সিনেমার রিল। পরদিন সেন্সর বোর্ড আবার বসে সিনেমাটি দেখতে।
জহির রায়হান আর আমজাদ হোসেন গেলেন সেন্সর বোর্ডের সদস্য নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখের কাছে। আমজাদ হোসেন বললেন, ‘স্যার আপনার উপরে সবকিছু। আপনি প্লিজ কালকে যাবেন।’ উনি বললেন, ‘আমি অসুস্থ। হাই প্রেসার তাই যেতে পারবো না।’ আমজাদ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার সারাদেশ আপনার দিকে তাকিয়ে।’ পরদিন শাইখ সাহেব গেলেন সেন্সর বোর্ডে। বোর্ডে উপস্থিত অল পাকিস্তান সেন্সর মেম্বার। রাও ফরমানসহ বাকি সদস্যরা ছবিটি দেখলেন। ছবিশেষে চেয়ারম্যান সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কী মনে করে আসকার ইবনে শাইখকে বললেন, ‘আপনি বলেন।’ তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্যার পবিত্র কোরআনে কোনো মিথ্যে কথা বলা নেই। মিথ্যে কথা বলবার কোনো সুযোগও সেখানে দেয়া হয়নি। জহির হয়তো ভুল করে একটা সত্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে। এই সত্যকে আমি কিভাবে মিথ্যা বলি!’ কেউ আর কোনো কথা বলল না। ছবিটি মুক্তি পেল। তবে প্রজেকশন শেষে রাও ফরমান জহিরকে বললেন, ‘ছবিটি ছেড়ে দিলাম। বাট আই উইল সি ইউ।’
রাজনৈতিক ছবির আলোচনা করতে গেলে মাথায় রাখতে হয় ঐতিহাসিক তথ্য। যেমন সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা। তেমনি জীবন থেকে নেয়ার সাথে জড়িয়ে আছে ঊনসত্তরের আন্দোলন, ১১ দফা, শহিদ আসাদ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে হীরক রাজার দেশ প্রযোজনা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। যারা আজ ভবিষ্যতের ভূত আটকে দেয়। আর আমরা জীবন থেকে নেয়া থেকে কী শিক্ষা নিয়েছি। ২০১৯-এর ১০ এপ্রিল যখন আমি ছবিটির কথা স্মরণ করছি, তখন শুনছি দুদিন পর থেকে নাকি দেশের সব হল বন্ধ হয়ে যাবে। এও সম্ভব?
জীবন থেকে নেয়া আগামী বছর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করবে। আশা করি সরকারিভাবে এই পূর্তি পালন করা হোক। আমাদের মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই নাম। ছবিটির শেষের দিকের একটি দৃশ্যে আনোয়ার হোসেন যখন একটি নতুন শিশুকে পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘মুক্তি, মুক্তি’, আমরাও বারবার মুক্তির দিশা পেয়ে যাই।