জীবননন্দ দাশ, অন্যরকম বিস্ময়

এক
শাহাদুজ্জামানকে ধন্যবাদ, তাঁর একজন কমলালেবু গ্রন্থটি (প্রথমা, ঢাকা ২০১৭) পড়ার পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে জটিল ও অগম্য এক কবির কবিতার অনেক দূরায়ত গ্রন্থিগুলো খুলে গেল। এই গ্রন্থি-উন্মোচনের সূত্র যত না তাঁর কবিতার অমত্মঃসলিল কাব্যধারার অর্থোদ্ধার, তারচেয়ে অনেক বেশি এই নির্জন ও একাকী মানুষটির জীবনের ভেতর-পর্দা খুলে দেখা। ঠিক এই কাজটিই করেছেন শাহাদুজ্জামান। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় কথা বলেছেন সংকেতে, খোলা চোখে সে-সংকেত প্রায়শ আমাদের আয়ত্তের বাইরে রয়ে গেছে। শাহাদুজ্জামান যেন এক রহস্যভেদী, কবির জীবনের গল্পের সঙ্গে কবিতার সে-সংকেত মিলিয়ে আমাদের কাছে একই সঙ্গে কবিতা ও কবিকে নিকটতর করেছেন। আমার জানা মতে বাংলা ভাষায় এর আগে এমন বই লেখা হয়নি।
শুরুতে একটি প্রয়োজনীয় বিতর্ক সেরে নিতে চাই। শাহাদুজ্জামান বইটিকে উপন্যাস বলেছেন। আমার তাতে আপত্তি, এটি পড়তে উপন্যাসের স্বাদ পাওয়া যায় বটে; কিন্তু সেটি শাহাদুজ্জামানের রচনাশৈলীর গুণে। গঠনগতভাবে একজন কমলালেবু উপন্যাস নয়, এটি একটি সাহিত্যচরিত, ইংরেজিতে লিটারেরি বায়োগ্রাফি। এই দুইয়ের তফাৎ নির্দেশ করা অপ্রাসঙ্গিক নয়, অতএব সে-কথা থেকেই আলোচনা শুরু করা যাক।
কথাসাহিত্য বা ফিকশনের শুরু কোথায়, সে-প্রসঙ্গে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একসময় মন্তব্য করেছিলেন, তিনদিন পর ঘরে ফিরে জোনাহ বউকে বললেন তার বিলম্বের কারণ – এক তিমি মাছ তাঁকে গিলে ফেলেছিল। এই তিনদিন বাধ্য হয়ে তাঁকে তিমির পেটেই কাটাতে হয়েছে। ‘যেদিন জোনাহ বউকে এই গল্প শোনান, সেদিন থেকেই কথাসাহিত্যের শুরু।’
বাইবেলের এক পরিচিত কাহিনি নিয়ে বলা কথাটা কতটুকু মাস্টারসুলভ, কতটা পরিহাস জানি না, তবে মার্কেজের কথার মোদ্দা অর্থ, ‘ফিকশনের’ শুরু কল্পনায়, শেষও কল্পনায়। সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত ফিকশনও আদতে কাল্পনিক। যদি শুধু সত্য ঘটনার বিবরণ প্রদানই লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তিনি বড়জোর উত্তম সাংবাদিক হিসেবে আমাদের নজর কাড়বেন। অথবা পরিশ্রমী গবেষক হিসেবে আমাদের চোখে সম্মানিত হবেন। সেই একই গল্প যখন লেখকের কল্পনার গভীরতায় রঞ্জিত হয়, কাহিনির বহিরঙ্গ ভেদ করে বর্ণিত চরিত্রসমূহের অন্তর্জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে, তা উপন্যাস হয়ে ওঠে। উভয়েরই রসদ ঘটিত বাসত্মবতা, কিন্তু – সালমান রুশদি যেমন বলেছেন – বাসত্মব (রিয়েল অর্থে) এবং বাসত্মবিক (রিয়েলিস্টিক অর্থে) এক নয়। লেখকের কাজ বাসত্মব উদ্ধার নয়, তাঁর কাজ নির্মিত কাহিনিকে বাসত্মবিক করে তোলা। বস্ত্তত, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, লেখক যে-সত্য উদ্ধার করেন, কল্পিত হলেও তা সত্যের চেয়েও অধিক সত্য। একই কথা বলেছেন আলবেয়ার কাম্যু – ‘ফিকশন হচ্ছে সেই অসত্য যাকে আশ্রয় করে আমরা সত্যে পৌঁছাতে পারি।’
জীবনীগ্রন্থ – বায়োগ্রাফি অর্থে – কোনো ব্যক্তির জীবনের নির্মোহ ও বস্ত্তনিষ্ঠ বিবরণ। এতে কল্পনার উপাদান যে থাকে না তা নয়। তবে জীবনী-লেখকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা বস্ত্তনিষ্ঠতা। যে-সত্য তিনি জানেন না তাকে সত্য বলে চালাবেন, এটি আমরা চাই না। আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি লেখক নিজেই অনেক সত্য-মিথ্যা হয় যোগ করেছেন, নয়তো বিয়োগ। আত্মজীবনী হিসেবে সেটি লেখকের নিজস্ব অগ্রাধিকার, তাঁর প্রিরোগেটিভ। আর সাহিত্যিকের জীবনী হলে তো কথাই নেই। সৈয়দ শামসুল হক এই প্রিরোগেটিভকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন যে নিজের আত্মজীবনী – অথবা স্মৃতিকথা – তার নাম দিয়েছেন প্রণীত জীবন। জীবন অথবা সাহিত্যচরিতের ক্ষেত্রে এই স্খলন আমরা মেনে নেব বলে মনে হয় না, যদিও তার উদাহরণ মোটেই বিরল নয়।
গ্রিক লেখক পস্নুটার্ক, যাঁকে পৃথিবীর প্রবীণতম জীবনীকার ভাবা হয়, তিনিও যে সত্যের সঙ্গে বিসত্মর কল্পনার ফানুস মিশিয়েছেন, তাঁর বিখ্যাত জীবনসমূহ (ইংরেজিতে লাইভস) সে-কথার প্রমাণ। পস্নুটার্ক নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি জীবনী লিখছেন – ইতিহাস নয়। আর গ্রন্থবদ্ধ জীবনীসমূহ ‘বস্ত্তনিষ্ঠ’ করার প্রয়োজনেই তিনি কল্পনা ব্যবহার করেছেন। গ্রিক নৃপতি আলেকজান্দারের জীবনীর ভূমিকায় পস্নুটার্ক জানিয়েছেন, হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে সে-কাহিনি উদ্ধারের বদলে আলেকজান্দারের কোনো একটি কথা, এমনকি তাঁর একটি দীর্ঘশ্বাস মানুষটিকে জানার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমার মনে হয়, পরবর্তীকালে যাঁরা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লিখেছেন, পস্নুটার্কের এই যুক্তিকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। যেমন, তলসত্ময়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। তলসত্ময় ইতিহাস লেখেননি, লিখেছেন ইতিহাসকে ভিত্তি করে পৃথিবীর সেরা একটি উপন্যাস। একই মাপকাঠি ব্যবহার করে বোধহয় এ-কথা বলা যায় যে, নথি হিসেবে পস্নুটার্কের জীবনীসমূহ যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, তারা মোটেই প্রামাণ্য নয়, ফলে তার ঐতিহাসিক মূল্য বিতর্ক-ঊর্ধ্ব নয়। পক্ষান্তরে, আধুনিক জীবনীগ্রন্থের প্রধান শক্তিই হলো তার প্রামাণিক চরিত্র। রিচার্ডসনের লেখা তিন খ–র পিকাসো অথবা প্রশান্ত পালের নয় খ–র অসমাপ্ত রবিজীবনী তাই অনায়াসে প্রামাণিক ইতিহাসের মর্যাদা বহন করে। প্রতিটি তথ্যের, এমনকি প্রতিটি উদ্ধৃতির সূত্র তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। কল্পনার ব্যবহার যে নেই তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে-ফর্ম তাঁরা অনুসরণ করেছেন, তার প্রয়োজনেই কল্পনার মইটুকু তাঁরা মাঝেমধ্যে ধার করেছেন। সত্যি বলতে কী, প্রশান্ত পাল তেমন ধার গ্রহণের প্রয়োজনও বোধ করেননি।
এ-কথার অর্থ এই নয়, ‘জীবনী’ গ্রন্থ হিসেবে নন্দিত হলেই তাকে নির্ভেজাল সত্য বলে মেনে নিতে হবে। প্রকৃত ইতিহাস যেমন প্রকৃত সত্যের অবিকৃত উদ্ধার নয়, জীবনীও উদ্ধারকৃত জীবনের সকল অধ্যায়ের বিবরণ নয়। ইতিহাসবিদ যেমন, জীবনীকারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দের ধারণা ও প্রয়োজন-অপ্রয়োজন দ্বারাই পরিচালিত হন। সত্য উদ্ধার লক্ষ্য
হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা দুজনই ইতিহাসকে বিকৃত করেন – কখনো কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো বা অজ্ঞাতসারে। জেমস বসওয়েলের লেখা স্যামুয়েল জনসনের জীবনী, অনেকের বিবেচনায়, প্রথম আধুনিক জীবনীগ্রন্থ। বসওয়েল জনসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, ফলে আঠারো শতকের এই প্রধান লেখকের জীবনের অনেক তথ্যই তিনি জানতেন। এই জ্ঞান বইটির গুরুত্ব নির্মাণে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব বইটিকে কণ্টকিতও করেছে। এখন আমরা জানি, নিজের বন্ধুর প্রতি আনুগত্যস্বরূপ বসওয়েল শুধু সেসব তথ্য গ্রন্থভুক্ত করেছেন যা তাঁর বিবেচনায় জনসনকে মহান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। বসওয়েল জনসনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বকে সাহিত্যিক হিসেবে নিজের স্বীকৃতি আদায়ে ব্যবহার করেছিলেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। সত্যের সঙ্গে কল্পনার দূষণ ও তথ্যের নির্বাচিত ব্যবহারের কারণে পরবর্তী সময়ে একজন মার্কিন লেখক সকল জীবনীকারকে ‘স্কাউন্ড্রেল’ নামে এককথায় বাতিল করেছিলেন।
সাহিত্যচরিত উপরিউক্ত দুই সাহিত্যধারা থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র, এমন কথা বলি না। সাহিত্যচরিত অনিবার্যভাবেই কোনো সাহিত্যিকের জীবনী। সাহিত্যচরিতকারের লক্ষ্য একদিকে তাঁর অবলোকিত লেখকের জীবনকাহিনি নির্মাণ, যে-কাজে তিনি যাপিত জীবনের প্রামাণিক তথ্যসমূহ অন্য সকল জীবনীকারের মতোই যথাসম্ভব বিশ্বসত্মতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। কিন্তু তাঁর কাজ সেখানে থেমে থাকে না। ব্যবহারিক তথ্যের পাশাপাশি সেই লেখকের রচিত সাহিত্যকেও তিনি ব্যবহার করেন তাঁর অপ্রকাশিত-অনবলোকিত অন্তর্জীবনের ওপর টর্চবাতিটি মেলে ধরার জন্য। অন্য কথায়, একই সঙ্গে দুটি রচনাধারা অনুসরণ করতে হয় সাহিত্যচরিতকারকে – মাইকেল বেনটন যাকে বলেছেন লাইফ ন্যারেটিভ ও লিটারেরি ন্যারেটিভ। এই দুই সমান্তরাল রচনাধারার কারণে কেউ কেউ সাহিত্যচরিতকে উপন্যাস ও প্রামাণিক জীবনীর মাঝামাঝি – হাইব্রিড – একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দুইয়ের মিশ্রণের ফলে আমরা একদিকে লেখকের জীবনী পাই, সঙ্গে পাই তাঁর সাহিত্য। ধরা যাক শেক্সপিয়রের সাহিত্যজীবনীর
কথা। পৃথিবীসেরা এই নাট্যকারের জীবনের অনেক তথ্যই ধোঁয়াটে। আধুনিক জীবনীকারেরা সেই অভাবটুকু পূরণের জন্য তথ্যানুসন্ধান করেন তাঁর রচিত সাহিত্যে। বলা হয়, সব লেখকই বস্ত্তত একটি গল্প বা কবিতা লেখারই চেষ্টা করেন, যা তাঁর নিজের গল্প। খোলা চোখে সে-ধাঁধা উদ্ধার সম্ভব হয় না, সেজন্য প্রয়োজন পড়ে একজন সাহিত্য-রহস্য সন্ধানীর। জনাথন বেইটের দি জিনিয়াস অব শেক্সপিয়র যেমন। যে উপমা বা রূপক শেক্সপিয়র ব্যবহার করেছেন, বেইট আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন কীভাবে সেখানেই ধরা রয়েছে এই নাট্যকারের নিজের জীবনের মন্ত্রগুপ্তি।
সাহিত্যচরিত বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের জীবনী ও জীবন অভিন্ন নয়, এই কথাটা মাথায় রাখা জরুরি। উদাহরণত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো কোনো জীবনীগ্রন্থ নয়; কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের জীবন অনুসরণ করে এই মানুষটিকে উদ্ধারের সচেতন একটি প্রচেষ্টা রয়েছে। এ-গ্রন্থ রচনায় সুনীল তথ্যের লক্ষণীয় বিকৃতি না ঘটিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথের মনোজগৎ নির্মাণ করেছেন। এই নির্মাণে তিনি পুরোপুরি নির্ভর করেছেন কল্পনার ওপর। সে-কারণে এটি একটি উপন্যাস, একে কেউ জীবনচরিত বলে না। এখানে রবীন্দ্রনাথের জীবন রয়েছে, তাঁর জীবনী নয়।
আগেই বলেছি, সাহিত্যচরিতকার নিজের কল্পনার বদলে অবলোকিত চরিত্রের রচিত সাহিত্যকর্মকে ব্যবহার করেন, একদিকে মানুষ হিসেবে তাঁর অন্তর্জগৎ নির্মাণে, অন্যদিকে যাপিত জীবনের ঘটনাসমূহের আলোকে সেই লেখকের সাহিত্যকর্মের অগম্য ইঙ্গিতসমূহ বোধগম্য করাতে। বলা বাহুল্য, কাজটি সাহিত্যচরিতকার সম্পন্ন করেন যদৃচ্ছ বা আরবিট্রারিলি। তিনি আলোচিত লেখকের পূর্ণ জীবন অথবা সমগ্র সাহিত্যজীবন পুনর্নির্মাণ করেন না। তাঁর কাজটি ইতিহাসভিত্তিক ঔপন্যাসিকের যদৃচ্ছ কল্পনার সঙ্গে তুলনীয়, যদিও গুণগতভাবে এই দুইয়ের স্পষ্ট তফাৎ রয়েছে। ঔপন্যাসিকের প্রকৃত ঘটনাবলির ওপর নিঃশর্ত বশ্যতার কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। কন্যার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ সত্যি কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তার অবিকল তথ্য উদ্ধারে কোনো আগ্রহ তাঁর নেই, শুধু তার একটি বিশ্বাসযোগ্য পুনর্নির্মাণেই তিনি সন্তুষ্ট। কিন্তু সাহিত্যচরিতকার যখন সেই একই মুহূর্ত নির্মাণে ব্রতী হন, প্রমাণযোগ্য রসদ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন সমসাময়িক সময়ে লেখকের রচিত সাহিত্য, কোনো স্মৃতিতথ্য অথবা ভিন্ন কোনো নথি। ডিটেকটিভের মতো তিনি সেই সাহিত্য ও নথিতে ‘ক্লু’ খোঁজেন। এই কাজের পুরোটাই চরিতকারের ব্যক্তিগত নির্বাচন-বিয়োজন দ্বারা নির্ধারিত। সেই কারণে সাহিত্যচরিতের প্রকৃত গুরুত্ব যত না তার প্রামাণিক মূল্যের জন্য, তারচেয়ে অনেক বেশি সাহিত্য মূল্যায়নের জন্য।
বলা বাহুল্য, এই পদ্ধতি অনুসরণে বিপদ রয়েছে। ইতিহাসের সকল ঘটনার ও সকল ব্যক্তির ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের কিছু পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা অনুমান কাজ করে। সাহিত্যচরিতের ক্ষেত্রেও এ-কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। সকল সাহিত্যচরিতই এক অর্থে আমাদের চোখে ‘হিরো’। তাদের ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে একধরনের আগাম ধারণা দ্বারাই আমাদের অধিকাংশ বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা পরিচালিত হয়। সাহিত্যচরিতকারই বা এই নিয়মের ব্যতিক্রম কেন হবেন? নিজের অনুসরিত ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠায় তিনি সম্ভবত সে-‘সত্য’কে প্রত্যায়িত করেন, যা তাঁর মনে আগে থেকেই স্থান করে নিয়েছে। একজন মার্কিন গবেষক এই প্রবণতার নাম দিয়েছেন ‘বায়োমিথোলজি’।
এ-কথা বলা বাহুল্য নয় যে, বাংলায় লিটারেরি বায়োগ্রাফির কোনো চল নেই। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনকথা বা প্রশান্ত পালের রবিজীবনীতে রবীন্দ্রনাথের জীবনের কাহিনি হয়তো আছে, কিন্তু সে কেবল সালতামামি। জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে সেতু নির্মাণের কোনো সচেতন চেষ্টা নেই। গোলাম মুরশিদ দুটি চমৎকার লিটারেরি বায়োগ্রাফি লিখেছেন – মধুসূদন ও নজরুল। উভয় গ্রন্থেই জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা রয়েছে। জীবনানন্দকে নিয়ে ক্লিনটন সিলির এ পোয়েট অ্যাপার্ট এখন বাংলায় অনূদিত হয়েছে, সেটিও চমৎকার সাহিত্যজীবন। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই কাজটা করেছেন গবেষকের প্রেষণা দ্বারা পরিচালিত হয়ে। পাঠক হিসেবে আমি সেখানে উপন্যাসের আনন্দ ও উত্তেজনা অনুভব করিনি, ঠিক যে অনুভূতি ও আনন্দ শাহাদুজ্জামানের বই পড়ে আমি পেয়েছি।
শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবুর বৈশিষ্ট্য এখানে যে, তিনি যোগ্যতার সঙ্গে জীবনী ও সাহিত্য – এই দুই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছেন। এই দুইয়ের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারের ফলে গ্রন্থটি উপন্যাস হয়নি বটে কিন্তু উপন্যাস পড়ার স্বাদ তাতে মেলে। এই গ্রন্থের ‘মেটা ন্যারেটিভ’ নির্মাণে তিনি ঐতিহাসিক – প্রামাণিক অর্থে – তথ্যের ওপর নির্ভর করেছেন। কোথাও কোনো ফুটনোট ব্যবহার করেননি সে-কথা ঠিক, কিন্তু আগ্রহী পাঠকের পক্ষে ব্যবহৃত তথ্যের সূত্র উদ্ধারে সহায়ক নির্দেশিকা ঠিকই রেখে গেছেন। কিন্তু শুধু
সন-তারিখ মিলিয়ে জীবনী নির্মাণ করলে জীবনানন্দকে বোঝা যাবে না, যে-কবিতা তিনি লিখেছেন তার পেছনে যে অশ্রম্ন ও দীর্ঘশ্বাস রয়েছে, সেটি জানাও প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটাতে শাহাদুজ্জামান আশ্রয় নিয়েছেন তিন ধরনের ‘ক্লু’র – কবির ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠি ও অপ্রকাশিত গল্প-উপন্যাস। প্রথম দুই ক্লু অবশ্যই প্রামাণিক, শুধু
তৃতীয়টি প্রস্তাবনামূলক বা ইন্টারপ্রেটিভ।
কোনো কবি অথবা ঔপন্যাসিককে নিজের কথা বলতে কেন ইঙ্গিতের আশ্রয় নিতে হয়? প্রথমত, এটি শিল্প হিসেবে সাহিত্যের চরিত্র, সে একটি আড়াল চায়। অন্য কারণ, কবি অথবা লেখক
নিজেই নিজেকে আবৃত রাখতে চান। নিজের অপূর্ণতা, ব্যর্থতা ও পরাজয়-গস্নানি তাঁকে অবশ্যই আক্রান্ত করে, সে-গস্নানির কথা উচ্চৈঃস্বরে বলার মতো নয়। তাই তাঁকে এক ধরনের চাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়। এই যে সাহিত্যের ধাঁধা, পাঠকের সঙ্গে সে-কাজটুকু লেখক অনেক সময় করেন সচেতনভাবে, কখনো বা অনবচেতনভাবে। জীবন ও সাহিত্যকে সমান্তরালভাবে অনুসরণের মাধ্যমে যে-জীবনচরিত শাহাদুজ্জামান পুনর্নির্মাণ করেছেন তাতে এই চেতন-অবচেতনার দূরত্ব কিছুটা হলেও ঘুচেছে।
দুই
জীবনানন্দ দাশকে আমরা কবি হিসেবেই চিনি, যদিও তাঁর মৃত্যুর পর উদ্ধারকৃত খসড়া থেকে আমরা জানি তাঁর অপ্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের সংখ্যাও বিপুল। উভয়ক্ষেত্রেই তিনি রয়ে গেছেন ভীষণ রকম ‘ব্যক্তিগত’। তাঁর রচনার কোনো ‘পাবলিক ভয়েস’ যে নেই তা নয়, প্রথমদিকের অনেক কবিতাতেই দেশ-সমাজ-সংসার নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ও উত্তেজনার প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু কবি হিসেবে সেসবের জন্য কেউ আমরা জীবনানন্দকে চিহ্নিত করি না। আমাদের কাছে তিনি পরিচিত সেই বিপন্ন বিস্ময়ের কবি হিসেবে, যাঁর পরিচয় সর্বদা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কাছে ধরা পড়ে না, অথচ যাঁর অধরা তন্ময়তা আমাদের নিরন্তর বিদীর্ণ করে।
কেমন ছিলেন জীবনানন্দ, কবিতার জগতেই বা কীভাবে এলেন, গ্রন্থের শুরুতেই এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্নের উত্তরে শাহাদুজ্জামান জানাচ্ছেন, শৈশবে জীবনানন্দের অবলম্বন ছিলেন মা কুসুমকুমারী। মায়ের উৎসাহে স্কুলের খাতায় কবিতা লিখলেও কবিতার আসল সিন্দবাদ তাঁর ঘাড়ে চেপেছে অনেক পরে। ‘কুসুমকুমারীই তাকে হাঁস মায়ের মত ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন কবিতার হাঙরভরা সমুদ্রের পথে।’ কবিতার পথ যে একটি অন্বেষণ – একটি দীর্ঘ যাত্রা – এবং সে-যাত্রা খুব কুসুমাসত্মীর্ণ নয়, গোড়াতেই লেখক আমাদের সে-কথা জানিয়ে দেন।
এ-কথা এখন আর কোনো গোপন রহস্য নয় যে, জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা ব্যর্থতায় ও হতাশায় আকীর্ণ। এই জীবনের দুটি দিক – কামহীনতা ও প্রেমহীনতা। প্রথম জীবনে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া শোভনা – যার ডাকনাম বেবি – তার সঙ্গে একতরফা প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন জীবনানন্দ। তাকে জীবনে পাননি; কিন্তু মনের ভেতর অহোরাত্রি লালন করেছেন। অন্যদিকে কলেজপড়ুয়া তরুণী লাবণ্যের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগে জীবনানন্দের যে-বিয়ে তা মধুর হয়নি। বিয়ের পরপরই জীবনানন্দ তাঁর কলেজের চাকরিটি হারান। খাদে পড়ে যান তিনি। অসন্তুষ্ট স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সহবাসও কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় তাঁর লেখা গল্প ‘আঘ্রাণের শীত’। এক ব্যর্থ বেকার স্বামী ও তার অসহিষ্ণু স্ত্রীর গল্প। এই গল্পের অর্থ শাহাদুজ্জামান আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন এভাবে :
জীবনানন্দ গল্পে লিখেছেন গ্রামে ফিরে শস্য খেতে উজ্জ্বল রোদে মৌমাছিদের দেখার অভিজ্ঞতার কথা। প্রশ্ন করেছেন, তাদের উজ্জ্বল চঞ্চল জীবন সত্যি না মুখোশ, কারণ তিনি তো দেখেছেন মৌমাছিকে দাঁড়কাকে ঠুকরে খাচ্ছে। জীবনানন্দ জানিয়ে দিচ্ছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা বীভৎসতা, নির্মমতার খোঁজ তিনি পেয়েছেন। পতঙ্গের জীবনের আনন্দকেও তিনি সন্দেহ করছেন, তার মনে হচ্ছে এসবই মুখোশ। জীবন জগৎ সবকিছুর মধ্যেই একটা গভীর অসহায়ত্ব আছে, আছে আশ্রয়হীনতা।
এ-রকম উদাহরণ পুরো বইটিতে অসংখ্য। কবিতার কোমল ও নির্জন বহিরাবরণে যে-সত্য আমরা উদ্ধারে ব্যর্থ হই, গল্প-উপন্যাসের উদাহরণে শাহাদুজ্জামানের ব্যাখ্যা তা আমাদের উপলব্ধির নিকটতর করে।
জীবনানন্দের ব্যক্তিগত চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য, শাহাদুজ্জামানের বিবরণ পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, তিনি যুবা বয়স থেকেই যৌনতাড়িত ছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে সেক্সুয়ালি রিপ্রেসড। তাঁর কবিতার ও গল্প-উপন্যাসের একটা প্রধান ভাব-বিষয় পুরুষের প্রেমহীনতা। এর সঙ্গে যুক্ত করুন কামহীনতা। এই দুই ভা-ারই যখন শুকিয়ে যায়, কী থাকে পুরুষের জীবনে? জীবনানন্দের ডায়েরিতে তার উত্তর রয়েছে। শাহাদুজ্জামান জীবনানন্দের ডায়েরি থেকে এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন : ‘back aching after much night through corruption, so a morning।’ শাহাদুজ্জামান ধরিয়ে না দিলে আমরা হয়তো বুঝতেই পারতাম না জীবনানন্দ ‘করাপশন’ বলতে স্বমেহনের কথা বলছেন।
এটি কোনো বৈকল্য কিনা জানি না, সে-বিতর্ক এখানে অর্থহীন, তবে জীবনানন্দের কবিতায় যে অস্থিরচিত্তের ছায়া ধরা পড়ে, কখনো কখনো তা বৈকল্যের পর্যায়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি বিবেচনা করা যাক। এই কবিতাটি জীবনানন্দের সেরা কবিতার অন্তর্গত। কী তার অর্থ, তা নিয়ে আমরা এখনো বিতর্ক করি। শাহাদুজ্জামান এই বিতর্ক থেকে তর্ককে ছেঁটে ফেলেছেন। প্রায় স্কুলশিক্ষকের মতো এই কবিতার গোপন সুড়ঙ্গপথে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তার অন্তর্চরিত্র। একটি শিকারের গল্প, যেখানে ঘাই হরিণী একটি টোপ, যাকে ব্যবহার করে শিকারি পুরুষ-হরিণকে ডেকে আনে। প্রেম ও কামের প্রাবল্যে ছুটে আসে যে-হরিণ, সে নিহত হয় শিকারির গুলিতে। এই গল্প কি জীবনানন্দের নিজের জীবনের? শাহাদুজ্জামান প্রশ্নের আকারে এ-প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
‘জীবনানন্দের জীবনে ঘাই হরিণী নামক টোপ তাহলে কোনটি? শোভনার প্রেম, লাবণ্যের রূপ নাকি কবিতা ও সাহিত্য সৃষ্টির ইচ্ছা? সেসব হরিণীর ডাকে বাসত্মবে কোনো চিতাবাঘের ভয় না করে তিনি ছুটে গেছেন সেই দিকে, তারপর কোথাকার কোন অদৃশ্য শিকারি তাকে পরিণত করেছে এক বেকার, চালচুলাহীন, অকর্মণ্য মেসবাসীতে।’
বাঙালির কাছে জীবনানন্দ সবচেয়ে পরিচিত তাঁর রূপসী বাংলা পর্যায়ের কবিতাগুলোর জন্য। বিস্ময়ের কথা, এই কবিতাগুলো, যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি, এমন একসময়ে লেখা যখন কবি বেকার, স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে কলকাতায়। কীভাবে সম্ভব এমন দুর্যোগময় সময়ে রূপসী বাংলার মতো পেলব, প্রায় অবাসত্মবরকম সুন্দর কবিতা লেখা? শাহাদুজ্জামান তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
‘নিরালম্ব এই কলকাতার জীবনে এ সময় হঠাৎ তাঁর মনের আশ্রয় হয়ে উঠল বাংলার প্রকৃতি। তিনি কলকাতার মেসের ঐ কংক্রিটের নিরেট বেকার জীবন থেকে মনে মনে ছুটি নিয়ে হাজির হলেন তাঁর আজন্ম চেনা নিমপাখি, বইচি, জলাঙ্গির দেশে। প্রকৃতির ভেতর তিনি যেন খুঁজে পেলেন বেঁচে উঠবার, বেঁচে থাকবার নতুন প্রেরণা।’
রূপসী বাংলা পর্যায়ের এই কবিতাগুলো অবশ্য ভিন্ন অর্থ নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়। আমার বিবেচনায় জীবনানন্দ প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছেন নারী হিসেবে। আমরা জানি – শাহাদুজ্জামান সে-কথার বিসত্মর উদাহরণ দিয়েছেন – তাঁর মধ্যে নারী ও তার দেহে আত্মসমর্পণের গভীর বাসনা ও বশ্যতা কাজ করত। জীবনে সর্বদা সে-সুযোগ ঘটেনি, কবিতায় প্রকৃতির শরীরে সে আত্মসমর্পণ নির্মাণ করলেন। রোমানিটক পিরিয়ডের অধিকাংশ কবি, যেমন কিটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও বায়রন, তাঁদের কবিতায় নারী ও প্রকৃতি সমার্থক হয়ে এসেছে। সাহিত্যবোদ্ধারা একে বলেছেন প্রকৃতির ‘ফেমিনাইজেশন’। রূপসী বাংলায় জীবনানন্দ সেই ধারাটিকেই আরো খানিকটা সম্প্রসারিত করলেন।
বিষয়টিকে আরো খানিকটা ভেঙে দেখা যাক। জীবনানন্দের কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে প্রকৃতি, এ-কথা আমরা অনেকেই বলি। এমনকি বুদ্ধদেবের মতো শিক্ষক-কবিও জীবনানন্দকে প্রকৃতির কবি বলেছেন। আমি বলতে চাই, প্রকৃতি নয়, জীবনানন্দের কবিতার প্রধান বিষয় নারী – অথবা আরো স্পষ্ট করে বলি, নারীর শরীর। তিনি কেবল প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন সে-শরীরের নিষিদ্ধ উত্তেজনা নিজ মনোজগতে পুনর্নির্মাণ করতে। আর এই প্রক্রিয়াটি তিনি আহরণ করেছেন ইউরোপীয় রোমান্টিক ধারা থেকে।
শুরু থেকেই জীবনানন্দের কবিতার কেন্দ্রে ‘আমি’। অর্থাৎ ব্যক্তি। আমাদের কবিতার যে সামাজিক স্বরের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তাতে এই আত্মনিমগ্নতা নতুন। ইউরোপীয় কবিতায় নয়। উনিশ শতকের শিল্প-বিপস্ন­বের পর যে আধুনিকতার উদ্ভব, তার দুটি প্রকাশ – এক নগরায়ণ, দুই আত্মকেন্দ্রিকতা, যা প্রায়শই ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতায় পর্যবসিত হয়। মানুষ যত নাগরিক হয়েছে, ততই সে আত্মকেন্দ্রিক, নির্জন ও জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঠিক যেমন জীবনানন্দ, যাঁর কাব্যভাবনার দুই প্রধান প্রেরণা রোমান্টিক যুগের কিটস ও সিম্বোলিস্ট আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ইয়েটস। জীবনানন্দের কবিতার প্রকৃতি-প্রেম, যাকে আমরা ইন্দ্রিয় জিগীষা নামে অভিহিত করতে পারি, তা তিনি আহরণ করেছিলেন এই দুই কাব্যধারা থেকে। তাঁর ইউরোপীয় পূর্বসূরিদের মতো জীবনানন্দও প্রকৃতিকে নির্ভর করেছেন নিজের মনোচেতনার বর্ণনায়, যার কিছুটা আরোপিত, কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধূসর, বিবর্ণ ও ঝরেপড়া পাতা অথবা পালক, এসব প্রকৃতি থেকে আহরিত, অথচ তার ব্যবহার হয়েছে কবির নিজের জীবন – ও মনোজগৎ – বর্ণনায়, সেই মনোচেতনার মানচিত্র নির্মাণে।
তোমারি নিজের ঘরে চলে যাও, বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে
অথবা ঘাসের পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালবেসে।
(‘নিরালোকে’)
এর সঙ্গে তুলনা করুন ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কথাগুলো :
Nature never did betray
The heart that loved her.
নারীকেই তিনি স্পর্শ করতে চান; কিন্তু সে-নারী অধরা। অগত্যা তাঁকে আশ্রয় করতে হয় প্রকৃতিকে, যার ভেতর তিনি নারীদেহের কোমল সোঁদা গন্ধ খুঁজে পান। প্রকৃতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে না, আশ্রয় দেয়।
পৃথিবীর বেদনার মত মস্ন­vন দাঁড়ালাম
হাতে মৃত সূর্যের শিখা
প্রেমের খাবার হাতে ডাকিলাম
অঘ্রাণের মাঠের মৃত্তিকা
হয়ে গেল
নাই জ্যোৎস্না – নাই মলিস্নকা।
(‘মনোবীজ’)
কী প্রবল বুভুক্ষা নিয়ে জীবনানন্দ নারীর শরীর স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন, শাহাদুজ্জামান তার প্রমাণ হিসেবে ডায়েরি ও গল্প-উপন্যাসের একাধিক উদাহরণ আমাদের দিয়েছেন, সে-কথা আগেই বলেছি। কবিতায় সে-ক্ষুধার প্রকাশ ঘটেছে অতি সংগোপনে, বহুসত্মরবিশিষ্ট ইঙ্গিতময়তায়। ডায়েরি তাঁর ‘অলটার ইগো’, এখানে তিনি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। গল্প-উপন্যাস, যা তিনি চক্ষুর আড়ালে রেখেছেন বরাবর, সেখানেও ইঙ্গিতের আশ্রয় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ কখনো এই লেখা পড়বে, এমন একটি গোপন বাসনা তিনি নিশ্চয় লালন করেছেন, অন্যথায় দেশভাগের সময় বরিশাল থেকে তোরঙ্গ বোঝাই করে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন না। কিন্তু এখন নয়, যে মনোভঙ্গ ও ক্ষুধার বিবরণ সেসব গল্প-উপন্যাসে লিপিবদ্ধ করেছেন, এই মুহূর্তে তা কেবলই নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যে-অব্যাহত আততি তাঁকে গ্রাস করেছিল, সম্ভবত তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার এ ছিল এক কলাকৌশল, ডিফেন্স মেকানিজম। শাহাদুজ্জামান বলেছেন, গল্পগুলো যেন তাঁর জীবনের গোপন ডকুমেন্টেশন।
এই ডকুমেন্টেশনের অংশ হিসেবেই শাহাদুজ্জামান বহুপঠিত ও আলোচিত সফলতা-নিষ্ফলতা উপন্যাসের দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এ-উপন্যাসের অন্তর্চরিত্র নিয়ে তাঁর অভ্যাস-বিরুদ্ধ অ্যাকাডেমিক আলোচনাতেও অংশ নিয়েছেন। ব্যর্থ, অসম্পূর্ণ ও আহত মানুষ হিসেবে জীবনানন্দকে বুঝতে এ-উপন্যাসটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ-উপন্যাস নিয়ে কেতকী কুশারী ডাইসনের গবেষণাগ্রন্থ
সে-কথার প্রমাণ। তাঁর আরেকটি গল্প ‘সঙ্গ-নিঃসঙ্গ’, যার উদাহরণ শাহাদুজ্জামান ব্যবহার করেননি, আমাদের প্রতিপাদ্য অনুধাবনে আরো অধিক অর্থপূর্ণ বলেই মনে হয়। তার কয়েকটি লাইন পড়া যাক :
তোমার মনে আছে কিনা জানি না, তুমি এখানে থাকিতেও আমার নিজের ঘরের ভিতর একটা জলের কলসি সব সময়েই রাখিতাম; তৃষ্ণা পাইলে নিজেই গড়াইয়া নিয়া জল খাইতাম, তোমাকে কোনদিন জল ঢালিয়া দিতে অনুরোধ করি নাহ। তুমিও অনুগ্রহ করিয়া ঢালিয়া দিয়াছ বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু ইহাই আমার ভাল লাগিয়াছে। এখনো যখন মনে হয়, বুঝিতে পারি, তোমার সঙ্গ আমাকে গভীর নিঃসঙ্গতার নিস্তার দিয়াছিল। সেই নিস্তারের পথে এখনো চলিতেছি। চিরকালই চলিব। … অবিশ্যি, আট বছর আগে আমার অন্য ধারণা ছিল। তখনো আমি বিবাহ করি নাই। মনে হইত বধূকে দিয়া পা টিপাইয়া লইব, কপালে চুল বিলাইয়া দিবে সে, পাখা দিয়া বাতাস করিবে। আরো কত কি। কিন্তু তুমি যখন আসিলে, দেখিলাম এসব কিছুই করিলে না তুমি। আমিও চাহিলাম না। ধীরে ধীরে হৃদয়ের ভেতরে সাপ-খেলানো বাঁশীর সুর কেমন যেন বাজিয়া উঠিল আমার ভিতরে। বুঝিতে পারিলাম না, এই সুর কাহার নিকট হইতে আসে। দিন-রাত্রির ভিতর হইতে, গ্রামের পথের প্রান্ত হইতে, এই সুর কে পাঠায় ভাবিয়া অবাক হইতাম।
কবি যে সারাজীবন ভালোবাসার এক সাগ্রহ ও সস্নেহ হাতের অপেক্ষায় ছিলেন, এই গল্পে সে-কথা স্পষ্ট। কবিতাতেও সে-প্রমাণ রয়েছে, যদিও তার প্রকাশ কিছুটা ধোঁয়াটে। উদাহরণ হিসেবে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির কথা ভাবা যাক। এই কবিতার প্রধান সুর প্রতীক্ষার ও প্রার্থনার। ‘বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন? পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’ পাখির নীড় কেন? কারণ কবি আশ্রয় খুঁজছেন – শুধু ভালোবাসার প্রশ্রয় নয়, আশ্রয়ের নির্ভরতা, যার খোঁজে মনের জাহাজে তিনি সারাবিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি পাতা, প্রতিটি পত্রকুট গভীর যত্নে আহরণ করে পাখি নির্মাণ করে তার কুটির। সেখানে কেবল আশ্রয় মেলে তাই নয়, মেলে আস্থা। মেলে ভালোবাসার চাদর।
বাসত্মব জীবনে সেই ভালোবাসা বা আশ্রয় কোনোটাই মেলেনি, মিলেছে এক কল্পিত বনলতা সেন। হোক না কল্পিত, তার জন্য
যে-ব্যাকুলতা তা মোটেই কল্পিত নয়। এই যে আশ্রয় ও আস্থার বুভুক্ষা, তার অবশ্যই একটি জৈব-শারীরিক চেহারা রয়েছে। জীবনানন্দের আগে বাংলা ভাষায় কেউ সেই জৈব প্রয়োজনের কথা এত কোমল ও তীব্রভাবে প্রকাশ করেনি। এজন্য কবিকে কম ধিকৃত হতে হয়নি। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির কথা ভাবুন। অবসন্ন পুরুষের শরীরে যে ঘাই হরিণীর ডাক শোনা যায়, শুধু একজন একাকী ও একাকী একজন পুরুষের পক্ষেই সম্ভব সে-ডাকের অর্থ উদ্ধার। অথবা সম্ভব তার বেদনার ও নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে সংহতি অর্জন।
দোনলার শব্দ শুনি
ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো একা একা শুয়ে থেকে
অন্য সকল কবিতার চেয়ে এই ‘ক্যাম্পে’ কবিতায়, আমার বিবেচনায়, প্রকৃত জীবনানন্দ ধরা পড়েন অনেক বেশি প্রবলভাবে। উপেক্ষিত একাকী পুরুষ, যার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো একা একা শুয়ে থেকে। জীবনানন্দের ডায়েরির সূত্রে এখন আমরা বলতে পারি, জীবনানন্দ অসুখী ছিলেন, এই অসুখের একটি বড় উপসর্গ ছিল শরীরী ক্ষুধা।
তোমার শরীর –
তাই নিয়ে এসেছিল একবার – তারপর – মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা – হয়েছে মলিন
চক্ষু এই – ছিঁড়ে গেছি – পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন রাত্রি গেছে কেটে!
‘বনলতা সেন’ নিয়ে একটি বিচিত্র সমালোচনার সূত্রপাত করেছেন শাহাদুজ্জামান। কলকাতায় বেকার জীবনের এক পর্যায়ে লেখা এই কবিতাটি নিয়ে শাহাদুজ্জামান শুধু এই কথা বলেই সেরেছেন যে, পৃথিবীর নানা দিগন্ত হাজার বছর ধরে চষে বেড়ানো এক পথিক নাটোরের এক নারীর কাছে আশ্রয় পেয়েছিল, পাখির নীড় যেমন তার আশ্রয়, সে-নারীর চোখ হয়ে দাঁড়ায় সে-রকম আশ্রয়।
এর বিপরীতে ক্লিনটন সিলি শুধু কবিতার পশ্চাৎপটই বিবেচনা করেননি, কবিতার গঠন ও তার শৈল্পিক কলাকৌশল নিয়েও প্রায় তিন পাতা ব্যয় করেছেন। এই ব্যাখ্যা শাহাদুজ্জামানের কাছ থেকেও প্রত্যাশিত ছিল। বিস্ময়ের কথা হলো, সে-আলোচনায় না গিয়ে আকবর আলি খানের লেখার ব্যাখ্যা নিয়ে প্রায় তিন পাতা ব্যয় করেছেন তিনি। আকবর আলি খান উদ্ধার করেছেন বনলতা সেন আসলে একজন বারবনিতা, নাটোরেই তার বাস। শাহাদুজ্জামান তাঁর সে-কথার অলক্ষিক সমর্থনে নানা তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন, কবে কখন জীবনানন্দ দাশ নিজে বেশ্যাবাড়ি গেছেন, তাঁর কোন গল্পে বেশ্যাবাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ আছে, সেসবের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, এই কবিতার অন্তর্গত হিরণ্ময়তা, বোধের অন্তরালে বেদনার যে-নিঃসরণ, এমন একটি অর্থহীন ব্যাখ্যা হাজির করে আকবর আলি খান ও শাহাদুজ্জামান উভয়েই তাকে হরণ করেছেন।
সেই তুলনায় ‘আট বছর আগে’ কবিতাটি নিয়ে শাহাদুজ্জামানের আলোচনা ‘মাস্টারলি’। পাণ্ডিত্য তাঁর লক্ষ্য নয়, এই বইয়ের কোথাও তিনি সে-চেষ্টা করেননি। তাঁর লক্ষ্য কবিকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে জীবনানন্দের কবিতার মর্মার্থ উদ্ধার। ‘আট বছর আগে’ কবিতাটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি আত্মহত্যার গল্প, কিন্তু কোনোক্রমেই আত্মহত্যার স্বপক্ষে কবিতা এটি নয়। জীবনানন্দ নিজে বলেছেন, এটি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প নয়, একটি ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ মাত্র। কিন্তু অনুমান করা যায় গভীর বেদনাবোধে তাড়িত হয়ে আত্মহননের কথা হয়তো তিনি নিজেও ভেবেছিলেন, কিন্তু
সে-পথে অগ্রসর হননি। উলটো, এই কবিতায় জীবনের পক্ষেই রায় দিয়ে গেছেন। যেন ক্লাসরুমের ছাত্রদের বুঝিয়ে বলছেন, এইভাবে শাহাদুজ্জামান কবিতার ব্যাখ্যায় বলছেন :
আত্মহত্যা করা মানুষটাকে কবি ব্যঙ্গ করছেন, তাকে বলছেন তুমি মর্গে গিয়ে পচে মর, আমি বরং ঐ অন্ধ প্যাঁচার কাছে যাই। যে কিনা অশত্থ নামের সংসার-বৃক্ষে বসে এখনো ইঁদুর খোঁজে।
এই কবিতার ব্যাখ্যা জীবনানন্দ নিজে দিয়েছেন, দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। একজন বিদেশি, এডয়ার্ড ডিমকও দিয়েছেন, যা এঁদের তুলনায় ভিন্ন। ডিমকের ভাষ্যে, জন্ম ও মৃত্যু তাৎপর্যার্থে অভিন্ন, ভারতীয় দর্শন চিন্তার এই কথাটি এক প্রতীকী আড়ালে প্রকাশ করেছেন জীবনানন্দ দাশ। এই বক্তব্যের সূত্র হিসেবে ডিমক উপনিষদের একটি শেস্নাক উদ্ধৃত করেছেন, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, আমি খাদ্য, আমি খাদ্য, আমি খাদ্যের খাদক। অন্য কথায়, যা খাদ্য সেই খাদক। ডিমকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কবি শুধু একবার মর্গ শব্দটি ব্যবহার করেন, যা মৃত্যুর সমার্থক। অন্যথায় তাঁর ব্যবহৃত শব্দ হলো লাশকাটা ঘর। লাশকাটা ঘরে মৃত পুরুষটি অপেক্ষা করে শব ব্যবচ্ছেদের। আর সে-ব্যবচ্ছেদের লক্ষ্য জীবনকে দীর্ঘায়িত করার সম্ভাবনার অন্বেষণ। ডিমক স্মরণ করেছেন, মৃত্যুর এক অর্থ অন্ধকার, কিন্তু এই অন্ধকারেই প্যাঁচা খুঁজে নেয় তার শিকার ইঁদুরকে, যে-ইঁদুর তার জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। অন্ধকারের কোনো রং নেই, অথচ সেই অন্ধকারেই জোনাকি আলো ছড়ায়। তার মানে যাই জীবন, তাই মৃত্যু।
গ্রন্থের শেষাংশে শাহাদুজ্জামান যত্নের সঙ্গে জীবনানন্দের জীবনের শেষ বছর দুয়েকের বিবরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর কাছ থেকেই প্রথম জানলাম, ট্রামে চাপা পড়ে মৃত্যুর একটি আভাস কবি আগেই পেয়েছিলেন। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ট্রামে এক ব্যক্তির আহত হওয়ার কথা শুনে কিছুটা উন্মত্তের মতো ছোট ভাইয়ের বাসায় হাজির হয়েছিলেন। পরপর দুদিন। এর দুদিন পর, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে নিজেই ট্রামের ক্যাচারে আটকে পড়ে আহত হলেন কবি। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এক সপ্তাহ পর, ২২ অক্টোবর তিনি চলে গেলেন। আমাদের মনের প্রশ্নটি তুলে ধরেছেন শাহাদুজ্জামান : এ কি অ্যাক্সিডেন্ট, না আত্মহত্যা?
এ-গ্রন্থের সবচেয়ে সুন্দর অনুচ্ছেদ লিখিত হয়েছে গ্রন্থের অন্তিমে, জীবনানন্দের মৃত্যুর বর্ণনায়। লজ্জা নেই বলতে, লাইন কয়েকটি পড়তে গিয়ে আমি চোখের জল সামলাতে পারিনি। শুধু কবির জীবনের ও নিজ গ্রন্থের এই অন্তিম পর্যায়ে এসেই শাহাদুজ্জামান কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। এই ‘পোয়েটিক লাইসেন্সের’ ফলে তথ্যের কোনো বড় হেরফের হয়েছে এ-কথা মনে হয় না। বরং বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবির অন্তিম মুহূর্তের এ-বিবরণ আমাদের একটি কঠিন ও নির্জন বাসত্মবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।
পুরো পথ ঘুরে আবার রাসবিহারীর মোড়ে এসেছেন তিনি। বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম একটা প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মত দ্রম্নত ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। ট্রাম দ্রম্নত এগিয়ে আসছে, তিনিও এগিয়ে যাচ্ছেন।
চমৎকার, সত্যি চমৎকার।

১৫ মে ২০১৯
নিউইয়র্ক