সন্জীদা খাতুনের নজরুল

পিয়াস মজিদ
নজরুল মানস  সন্জীদা খাতুন  নবযুগ প্রকাশনী
ঢাকা, ২০১৮  ২২০ টাকা

রবীন্দ্রবিশারদ সন্জীদা খাতুন যখন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন, তখন তা আমাদের কৌতূহলের কারণ হয়। নজরুল মানস বইয়ের প্রকাশনা তাই শুধু
লেখক-গবেষক সন্জীদা খাতুনের ব্যতিক্রমী বই-ই হয় না, একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে আমাদের সাহিত্য-ইতিহাসেরও এক
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
দুই
কবি নজরুল ছিলেন সন্জীদার পারিবারিক সদস্যপ্রায়। পিতা কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের প্রিয় ‘মোতিহার’। সন্জীদা স্কুল ফাইনালের পর প্রথিতযশা নজরুল সংগীতশিল্পী সোহরাব হোসেনের কাছে টানা তিন বছর নজরুলগীতি চর্চা করেছেন। তবে এই বই স্মৃতির অধিক বিশেস্নষণ। প্রাক্কথনে বলছেন লেখক –
পিতা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন নজরুল-প্রেমিক। বড়দি যোবায়দা মির্যা নজরুল কাকার কোলেপিঠে উঠে আদর পেয়েছেন, গান শিখেছেন, শৈশবে কাকার কোলে বসে আসরে গান গেয়েছেন। … বাঙালিত্বের চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য নজরুলভাবনাও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে থেকেছে। এক্ষেত্রেও নজরুলের গানের সার্বিক পরিচিতি এবং সাংগীতিক বিবেচনা এবং সেই অনুধাবনের চেষ্টা, উপস্থিত ‘নজরুল মানস’ গ্রন্থের বিষয়।
এ-বইকে আমাদের সেই পরিপ্রেক্ষক্ষতেই বিবেচনা করতে হবে।
নয়টি অধ্যায়ে বিন্যসত্ম বইটি ধারণ করেছে বিচিত্র নজরুলকে। ব্যক্তি নজরুলের পরিসরের পাশাপাশি তাঁর কবিতা, গান, গল্প, প্রাবন্ধিক গদ্যগুচ্ছ, পত্রাবলি, নজরুলচর্চার বই ইত্যাদি বহু কোণে আলো ফেলেছেন তিনি। আর সেই আলোর পথরেখা প্রকৃত
নজরুল-আবিষ্কারের এক বৃহৎ আলোকপর্বের অভিযাত্রা-চিহ্ন যেন। এই অভিযাত্রায় লেখকের দৃষ্টি নিবদ্ধ যে বিশেষ দিকে তা হলো, মুগ্ধের বদলে মুক্তদৃষ্টির নজরুল। ‘নজরুল অহিফেন’মুক্ত নজরুলকে পেতে এ-বই হতে পারে বিশেষ সহায়ক।
‘সবার কবি নজরুল/ পারিবারিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রারম্ভিক প্রবন্ধে নজরুল ও মোতাহার মানসের উদ্ভাসন দেখতে পাই। বিশেষত নজরুলগীতির সংখ্যা নিয়ে পিতা মোতাহার হোসেনের উচ্ছ্বসিত ধারণা তুলে ধরেন এবং তাঁর পিতার নজরুল-উচ্ছ্বাস যে একটু অধিক মাত্রারই ছিল, তা বলতে ভোলেননি। নজরুলের প্রয়াণকালে ছাত্রী সন্জীদা খাতুনের শান্তিনিকেতনবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনে এসেছে সবার কবি নজরুল-আবাহনের প্রকৃত চিত্র –
সেদিন বোলপুরের পথের মোড়ে মোড়ে নজরুলের জন্য সভা হয়েছিল। শোকের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে নজরুলের জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করেছিলাম সর্বামত্মঃকরণে। কলকাতার বেতারেও নজরুলকে নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান, আলোচনা, স্মৃতিচারণা হয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল, নজরুল নিতান্ত মুসলমানের এবং মুসলিম কবি মাত্র নন।
(পৃ ১৪)
‘আবেগ-উচ্ছ্বসিত নজরুল’ প্রবন্ধে নজরুলের কবিতা, গান, গদ্যরচনা ও পত্রে আবেগ-উচ্ছ্বাসের খোঁজখবর করে আমাদের ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন লেখক। বিশেষ করে বিদ্রোহ ও প্রেম – দুইয়েই তাঁর চূড়াস্পর্শী আবেগের বয়ান করেছেন।
রবীন্দ্রসংগীতের গুণী গায়িকা ও সাধিকা যখন নজরুলগীতি নিয়ে তাঁর ভাবনা লিপিকৃত করেন ‘নজরুলসঙ্গীত’ শীর্ষক প্রবন্ধে, তখন তা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। সকালবেলার প্রশান্ত রাগিণীতে, ছন্দে চঞ্চল করে নাচিয়ে তুলবার নজরুলি প্রতিভাতে মুগ্ধ তিনি। তাঁর গানে প্রেম আর বিরহ-ব্যাকুলতাকে ব্যাখ্যা করেন তিনি। প্রত্যক্ষ শ্রম্নতির অভিজ্ঞতায় কয়েকটি নজরুলগীতির মূল্য যাচাই করেন। যেমন ‘আমার নয়নে নয়ন রাখি পান করিতে চাও কোন অমিয়’ শীর্ষক নিম্নকণ্ঠ সুর ও প্রেমনিষিক্ত গান নীলুফার ইয়াসমীনের কণ্ঠে কী রূপে বেজে উঠেছে, তার ব্যাখ্যা করেন শ্রোতার আসরে রেকর্ড শুনে। অতঃপর তাঁর প্রত্যাশা –
নজরুলের গানের এই শিল্পসাফল্য নজরুলসংগীতের সাধকদের ঐকান্তিক অনুধাবনের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশিস্নষ্ট শিল্পীদের মনোযোগ নজরুলের সৃষ্টিকে প্রাণচঞ্চল করে তুলবে, এই আশাতেই বসতি সংগীতপ্রেমীদের।
(পৃ ২৯)
এ-বইয়ের প্রাচীনতম রচনা ‘নজরুল কাব্যে আধুনিকতা : প্রেম ও নারী’। অর্ধশতাব্দী আগে ১৯৬৮-তে লেখা এই প্রবন্ধ বিশেস্নষণের প্রজ্ঞা ও ভাবনার সূক্ষ্মতা বিস্ময়-জাগানিয়া। আগে বলা হয়েছে, মুগ্ধের বদলে মুক্তদৃষ্টিতে সন্জীদা খাতুনের নজরুল-অবলোকন। তাই নজরুলের আধুনিকতা তাঁর কাছে ‘সন্ধান সাপেক্ষ’, নজরুলের নারীভাবনায় বৈপরীত্য লেখককে বিস্মিত করে –
যে-কবি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন উপলক্ষক্ষ আন্তরিক আবেগে
বলেছেন :
আপনা ভুলিয়া বিশ্বপালিকা নিত্য-কালের নারী
করিছে পুরুষ জেল-দারোগার কামনার তাঁবেদারী!
তাঁরই রচনায় সেই কামনারই বিজয় বৈজয়মত্মী উড্ডীন দেখলে বড় খটকা লাগে। অথচ কবির মানবতার প্রেরণাও যেমন সত্য, তেমনই নিবিড় সত্য অনুভব মুদ্রিত দেখতে পাই তাঁর
এই কামনা-প্রবণতায়। কবি বড়ই impulsive। যার জন্য যখন-মনে-যে-অনুভূতি-আসে তা প্রকাশের দায় খেয়াল না রেখে – প্রচলিত প্রথার তিল-পরিমাণ তোয়াক্কা না করে অবাধে কলম ছুটিয়ে চলেছেন। সেই গুণেই বাসত্মবিক, অনুভূতির একান্ত মানবিক আবেদন আধুনিক কবিতার দিশারি। কিন্তু ভোগের পাত্রী হিসেবেই দেখেছেন তিনিও নারীকে।
(পৃ ৩৭)
আবার নজরুলকে তাঁর অনন্য সারল্য ও অকপটতার আলোকেও তিনি বিচার করেন বলে প্রবন্ধের অন্তিমে বলতে পারেন –
… প্রেমের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে সরল সবল আত্মপ্রকাশের ফলে নজরুলকে আমরা আধুনিক বলে স্বীকার করি। তাঁর এই অকপট আচরণে তাঁকে কোথাও কোথাও অশালীন মনে হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু আপন অনুভূতির বিশ্বসত্ম বিবরণ দানের নির্ভীকতা দিয়েই তিনি পরবর্তীদের শক্তি সাহস যুগিয়েছেন আধুনিক ভুল-ভ্রান্তিজড়িত নিতান্ত মানবিক অনুভূতির প্রকাশে।
(পৃ ৪২-৪৩)
সাম্প্রতিক সময়ে রচিত প্রবন্ধ ‘রাক্ষুসী’ মূলত নজরুলের এই শিরোনামের গল্পের নিবিড় ব্যবচ্ছেদ। এই গল্প-বিশেস্নষণ নজরুলের অন্যান্য গল্প সম্পর্কে সন্জীদার বিশেস্নষণ-প্রত্যাশী করে তোলে আমাদের।
‘যুগ-সৃষ্টির বাণী’ প্রবন্ধে যুগবাণীর (প্রথম সংস্করণ ১৯২২, স্বাধীন ভারতীয় সংস্করণ ১৯৪৯) বই নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এই বইভুক্ত ‘নবযুগ’, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’ প্রবন্ধদুটোর পটভূমি নজরুল রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্তির সংগত দাবি উত্থাপন
করেছেন –
দুটি প্রবন্ধের পিছনে সমসাময়িক কোনো ঘটনার তাড়না আছে কিনা, স্পষ্ট হয় না। রচনার তারিখ থাকলে সে তথ্য সন্ধান করে জানা সম্ভব হতো। নজরুল রচনাবলীর গ্রন্থপরিচয়ে প্রবন্ধ ধরে ধরে পরিচিতি দেওয়া হলে পাঠকের কাছে বিষয়গুলো অধিক পরিস্ফুট হয়ে উঠতো। যুগবাণীর প্রবন্ধগুলো পড়তে গিয়ে এসব কথা অনিবার্যভাবে মনে হয়। নজরুলের রচনাগুলোকে প্রথমেই একত্র সংবদ্ধ করবার স্বাভাবিক প্রেরণা পরিচিতি দেওয়ার ব্যাপারে আগে মন দেওয়া যায়নি হয়তো। এখন কিন্তু পরিচিতিগুলো সংকলনের সময় হয়েছে। আমার তো মনে হয়, উপযুক্ত গবেষকরা নজরুলের প্রতিটি গ্রন্থ ধরে যাবতীয় জ্ঞাতব্য সংগ্রহ করে এক একটি গ্রন্থের যথাযথ সম্পাদনা করলে নজরুল গবেষণা অগ্রসর হতে পারতো। আর, তাতে নজরুলকে নিয়ে যে কেবলই উচ্ছ্বাস করা হচ্ছে, এই অপবাদ ঘুচবার পথ খুলতো।
(পৃ ৫২-৫৩)
‘গদ্যরচনায় নজরুল-মানস’ শীর্ষক সন্দর্ভপ্রতিম প্রবন্ধটি নজরুল-বিবেচনার অন্যতম সেরা রচনার মর্যাদা দাবি করতে পারে অনায়াসে। বিশেষত গদ্যশিল্পী নজরুলের মানস আবিষ্কারে এই সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি তুলনারহিত। এই রচনা মূলত তাঁর প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং অভিভাষণের আলোকে লেখা। যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্রমঙ্গল এই প্রবন্ধের পরিসরে আলোচিত হয়েছে সবিস্তারে। নজরুলের ভাষা সম্পর্কে কতক লেখকের উদ্দেশ্যমূলক প্রশংসাকে তিনি নেতিবাচক হিসেবে শনাক্ত করেন যাঁরা মনে করেন – ‘যাবনী-মিশাল’ দোভাষী পুঁথির ভাষাকে নজরুল বাংলা সাহিত্যে বিশেষত গদ্যে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।’ তাঁদের এই ভ্রান্ত মনোভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করে সন্জীদা খাতুন প্রতিষ্ঠা করেন নজরুলের ভাষাব্যবহারের প্রকৃত সত্য –
মুসলিম সমাজে চর্চিত দোভাষী পুঁথির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ থেকেই নজরুল ভাষায় ঐ মিশাল দেন, অতি নিশ্চিতভাবে তা বলার যুক্তি পাওয়া যায় না। ভাষাসচেতন নজরুল আপন সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্যের উপযুক্ত ভাষা সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন, এইমাত্র বলা যাবে। মুসলমানের ভাষা আর হিন্দুর ভাষা নিয়ে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বিবেচনা নজরুল নিজেও কখনো পছন্দ করতেন না, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত পড়বার পর এই মন্তব্য নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করা যায়। সকল বাঙালির জন্য শক্তিশালী গদ্যভাষায় নজরুল তাঁর বক্তব্য তুলে ধরে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
(পৃ ৮৪-৮৫)
সূফী জুলফিকার হায়দার-রচিত নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়ের (প্রথম প্রকাশ ভাদ্র ১৩৭১, বাংলা একাডেমি) আলোচনায় তিনি গ্রন্থটিকে নজরুলচর্চায় সবিশেষ মূল্যবান মনে করেন –
এই রচনাটির বৈশিষ্ট্য এই যে আন্তরিকতার রসে সিক্ত করে লেখক নানান্ ঘটনা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে যেসব মন্তব্য করেছেন তার সারবত্তা সম্বন্ধে চিন্তা জাগবার আগেই মন
মজে যায়।
(পৃ ৮৮)
নজরুলজীবনের অজানা অধ্যায় উন্মোচনে এর গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি লেখকের মুক্তদৃষ্টিতে ধরা পড়ে জুলফিকার হায়দারের সীমাবদ্ধতাও। তিনি বলতে বাধ্য হন –
কবির অসুস্থতার কারণ আলোচনা করতে গিয়ে যেমন, তেমনি অসুস্থ মানসিকতার লক্ষণ অসুস্থতার পূর্বেকার ব্যবহারে কিছু ছিল কিনা আলোচনা করতে গিয়েও লেখক ভারি এক আশ্চর্য কথা বলেছেন। বিংশ শতাব্দীর এতখানি পথ অতিক্রম করে আসবার পরও এ-যুগের কোনো মানুষ বিশেষত সাহিত্যিকের পক্ষে এ উক্তি বড় আশ্চর্য ঠেকে। লেখক লিখছেন – ‘তিনি (অর্থাৎ নজরুল) অনেক কথা বলতেন যা সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়। … তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলতেন যে, তিনি হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্মের সমন্বয় ঘটাবেন।’ এ উক্তি নজরুলের স্বভাবসঙ্গত দুঃসাহসিক বটে – কিন্তু এর মধ্যে মস্তিষ্কের বিকার কোথায় পাওয়া গেল – বোঝা মুশকিল।
(পৃ ৯৫)
‘পত্রাবলি’তে কাজী নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক শেষ লেখায় লেখক নজরুলের পত্রগুচ্ছে উৎকীর্ণ বিদ্রোহী, সংস্কারক এবং প্রেমী মানসের আবিষ্কার করে চলেন। উৎকলন করেন পত্রগুচ্ছের এমতো কালোত্তীর্ণ কথামালা –

  • ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি বা কবিতা বাঁচেও না জন্মও লাভ করতে পারে না। (আন্ওয়ার হোসেনকে লেখা পত্র)
  • যদি-সত্যিকারের সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে। (ইব্রাহীম খাঁকে লেখা পত্র)
  • … বেতারের গাইয়ে গুণীজন যাঁরা আমার গান দয়া করে গেয়ে থাকেন, তাঁরা আর একটু দয়া করে গানগুলোর মোটামুটি সুর ও গানের কথা জানবার কষ্ট স্বীকার করেন না।
    (নবশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত পত্র)
  • আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা।
    (নার্গিসকে লেখা পত্র)
  • তুমি এই আগুনের পরশমাণিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না – আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না – আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।
    (নার্গিসকে লেখা পত্র)
  • যে দেবতাকে পূজা করব – তিনি পাষাণ হন তা সওয়া যায়, কিন্তু তিনি যেখানে আমার পূজার অর্ঘ্য উপদ্রব বলে পায়ে ঠেলেন, সেখানে আমার সান্তবনা কোথায় বলতে
    পারো …?
    (কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা পত্র)
    ফজিলাতুননেসাকে উদ্দেশ করে বলা এ-পত্রকথার শেষে সন্জীদা খাতুনের এমতো বিষাদ-বক্তব্য এই বইকে নিয়ে আসে এক দুঃখী সমাপনে –
    এই প্রত্যাখ্যান আর অবমাননার দুঃসহ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল নজরুলকে। ‘তাঁকে’ বুকে পেয়েছিলেন বলে জানালেও, শেষ অবধি অবমাননা/ অসম্মানের কাঁটাই বড় হয়ে উঠেছে। তবু স্বীকার করতে হবে অতল-গভীর এবং উত্তাল প্রেমের এই অভিজ্ঞতা নজরুলের বিশেষ প্রাপ্তি বটে। সেইখানে নজরুল ধন্য হয়েছেন।
    (পৃ ১১২)
    লেখক সন্জীদা খাতুন শেষ পর্যন্ত সেই প্রেমী নজরুলের অবয়ব ফুটিয়ে তোলেন আমাদের মানস-মহলে, যিনি প্রেম পেতে এসেছিলেন, প্রেম দিতে এসেছিলেন; কিন্তু সেই প্রেম পেলেন না বলে প্রেমহীন এই পৃথিবীতে নীরব অভিমানে বিদায় নিলেন। আবার লেখকেরই ভাষ্যমতে ‘অতল-গভীর এবং উত্তাল প্রেমের অভিজ্ঞতা’ নজরুলকে ধন্য করেছিল, পরিণত করেছিল সোনার মানুষে; যা দিয়ে তিনি বাজিয়েছেন বিদ্রোহের বাঁশি, আগুনের বীণা আর শাশ্বত ধূমকেতু। ‘পাবলিক নজরুলে’র আড়ালে চাপা পড়া অন্তরঙ্গ নজরুলকে বুঝতে গেলে ‘পত্রাবলি’তে কাজী নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধটি এভাবে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে।

তিন
সন্জীদা খাতুনের নিজস্ব নতুন চিন্তা, প্রগতিশীল দর্শন, স্বচ্ছ প্রকাশভঙ্গি আর নির্ঝরতুল্য ভাষারীতি তাঁর অন্যান্য বইয়ের মতো নজরুল মানস বইয়েও সমান পরিস্ফুট। এ-বই গবেষক হিসেবে তাঁকে আরো এক বিশিষ্ট মাত্রায় উত্তীর্ণ করে এবং খ–ত নজরুলচর্চার যুগে প্রকৃত নজরুল-আবিষ্কারের অন্বেষী করে তোলে পাঠককে।