কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের আত্মজীবনী এক উপমহাদেশের আত্মস্রোত

সাহিত্যকর্ম বা তাঁর স্রষ্টা প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই সময়ের অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই অনুষঙ্গে প্রশ্নটি হয়ে থাকে – তিনি কোন সময়ের লেখক? বা তাঁর অমুক উপন্যাসটি কোন সময়ের? বাস্তবতার অনুধাবন বা বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতার কথাই বলুন না কেন, এটা তো সত্য যে, সাহিত্যের প্রবহমানতার স্রোতকে বুঝতে হলেও বিষয়টির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। আর তা আমরা লেখকের কাহিনি-বর্ণিত সময়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখকের জীবনের সময় তথা লেখকের কলমের উপস্থিতির সময় সমুদয় বিষয় মাথায় নিয়ে ভাবতে বা বিশ্লেষণ করতে চাই। অনুসন্ধানের এই প্রবণতা নতুন নয়, তথাকথিতই বলা যায়। অবশ্য লক্ষ রাখতে হবে, তথাকথিত শব্দটিকে এক্ষেত্রে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয়ে পর্যবসিত করার কোনো অবকাশ নেই, কেননা লেখক, তাঁর লেখা এবং তাঁর সময়, সবকিছুকে মাথায় রেখেই পাঠকে এগিয়ে যেতে হয়। তা না হলে সঠিক পঠন বা অনুসন্ধানই অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। যাই হোক এ-বিষয়টি আজ গুরুত্বপূর্ণ তবে আমার এই আলোচনার মুখ্য বিষয় না হলেও প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ বটে। কেননা আমি কথা বলতে চাইছি সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানকে নিয়ে। তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে তাঁর কর্ম আর ব্যক্তি রিজিয়া রহমানের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সময়ের প্রসঙ্গটিকে মাথায় নিয়েই এগোতে চাই।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বা সামগ্রিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ষাটের দশকটির গুরুত্ব আজ অবধি বহুল গুরুত্বের। এই যে ষাটের দশক, এই সময়টাকেই বা কী করে একটি ফুলস্টপে দেখানো সম্ভব। এই দশক প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধার ‘ষাটের দ্বৈরথ’ প্রবন্ধটি থেকে উল্লেখ্য, ‘কারে বলা যায় ষাটের দশক? সন তারিখ ধরে এপাশ ওপাশে মিলিয়ে ১৯৫৯-এর একত্রিশে ডিসেম্বরের পর আগত যে কোনও দিন যা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে সত্তর হয়ে একাত্তরের পথে মুক্তিযুদ্ধের দিকে চলে গেছে। এক বাক্যে এটুকু বলে ষাটের দশককে মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায় বটে, কিন্তু তাতে শুধু কথাসাহিত্যিক প্রবণতা কেন, কোনও কিছুই ধরা পড়ে না। আবার সবই তো ধরা থাকে সময়ের মাপে।’
সবই ধরা থাকে সময়ের মাপে বা সবই যথাযথভাবে ধরে রাখতে পেরেছেন যে-কথাসাহিত্যিকরা তাঁদেরই সময় মনে রাখে। রিজিয়া রহমানের সাহিত্যকর্মের ভেতর দিয়েই সে-সত্যতা খুঁজে পেতে পারি। মনে রাখা প্রয়োজন, এই ষাটের দশকে লিখতে শুরু করা বা তখন থেকে লিখছেন বর্তমান বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিকদের দেশের বিচারে কোন দেশের সাহিত্যিক হিসেবে ধরব? তখন বাংলাদেশ তো স্বাধীন নয়, একটি স্বাধীন দেশের জন্ম-যন্ত্রণার সবটুকু সময় পেরিয়ে এই সময়ের সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে যে-সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন, তা-ই মূলত পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্য। সেই হিসাবে এ-সময়টিও বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা প্রসঙ্গে রিজিয়া রহমান যে-কথাটি বলেছিলেন সে-প্রসঙ্গ বাংলাদেশের কথাসাহিত্য প্রসঙ্গেও উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘ব্রিটিশ আমলে আমরা ছিলাম মুসলমান, তারপর হলো কী, সবাই বলা শুরু করল বাঙ্গালী মুসলমান। পরে হলো পাকিস্তান, আমরা হয়ে গেলাম পূর্ব-পাকিস্তানি। তখন আমরা লিখতাম, ‘উই আর ইস্ট পাকিস্তানি’। এরও পর ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর আমরা বাঙালি হয়েছি। তো এত দেরিতে যখন বাঙালি হয়েছি, রবীন্দ্রচর্চা তো দেরিতেই শুরু হবে। … আমরা অনেক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি।’
রিজিয়া রহমানের এই বিশ্লেষণকে মাথায় রেখে বলতে চাই – যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে-দেশটি আমরা পেয়েছি, যে-ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার জন্মপরিচয় নিয়ে আজ এই বাংলাদেশ, সেই দেশের কথাসাহিত্যের শুরু যাঁদের হাত দিয়ে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্য তথা ১৯৭১ সালের পর এই ভূখ–র মানুষের জীবন নিয়ে আবর্তিত আখ্যান নির্মাণে তিনি অগ্রগণ্য একজন কলমযোদ্ধা। তাঁর গল্প-উপন্যাসে রাজনীতি-ইতিহাস-নৃতত্ত্ব-মুক্তিযুদ্ধ নানা অনুষঙ্গে দৃশ্যত খুঁজে পাওয়া যায় বাংলার জনমানুষের আখ্যান। কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান বং থেকে বাংলা, রক্তের অক্ষর, একাল চিরকাল, সূর্য সবুজ রক্ত, উত্তরপুরুষ, অলিখিত উপাখ্যান, আবে-রওয়াঁ, উৎসে ফেরা, একটি ফুলের জন্য, বাঘবন্দি, ঘর ভাঙা ঘর, শিলায় শিলায় আগুন ইত্যাদি উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর এই উপন্যাসগুলোতে বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় নানা আঙ্গিকে, সেখানে রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি যেমন দৃশ্যত, তেমনি জীবন ও মূল্যবোধের জায়গাটি স্পষ্ট। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্রকে তিনি ধারণ করেছেন সুনিপুণ ভাষায়। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো আলোচনা হবে। আজ আমি সে-প্রসঙ্গে যাব না। আজ যেতে চাই তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের কাছে।
বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনী লেখার প্রবণতা খুব বেশিদিনের নয়, মূলত উনিশ শতকে এর শুরু বলে ধরা হয়। যদিও মধ্যযুগে আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে ভণিতার মাধ্যমে আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চ-ীমঙ্গল কাব্যে নিজের আত্মপরিচয়ের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভণিতায়, তবে সেগুলো আত্মজীবনী নয়। আবার বিশ্বের বিখ্যাত আত্মজীবনীর তালিকায় রয়েছে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, যা মাত্র ১৫ বছর বয়সের এক কিশোরীর লেখা ডায়েরি। যা সে লিখেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, পরিবারের সঙ্গে আত্মগোপন করে লুকিয়ে থাকার সময়কার কথা। আনার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা ডায়েরিটি পেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের এযাবৎকালে লিখিত যে-আত্মজীবনী আমরা পেয়েছি তার বেশিরভাগেই দেখা যায় তাঁদের ছেলেবেলার কথা। যেমন রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা, শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন তাঁর বাল্যস্মৃতি, জসীমউদ্দীন লিখেছেন জীবনকথা, প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন আত্মকথা, আশাপূর্ণা দেবী লিখেছেন প্রথম প্রতিশ্রম্নতি, বিনোদিনী দাসী লিখেছেন আমার কথা, মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন আমার জীবনী। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর জীবদ্দশায় অনেক আগেই লিখে ফেলেছিলেন তাঁর অর্ধেক জীবন নামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন ন হন্যতে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি লিখেছেন এক জীবনে নামে। রিজিয়া রহমানের জীবনকালেই আমরা দুটো আত্মজীবনীকে প্রকাশিত আকারে পেয়েছি। একটি নদী নিরবধি, অন্যটি প্রাচীন নগরীতে যাত্রা। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ হিসেবে বইদুটোর নামলিপি একেবারেই ভিন্নরকম। নাম দেখে শুরুতেই ভেবে নেওয়া যায় না, এটা আত্মজীবনী। কিন্তু তিনি তাঁর আত্মজীবনীই লিখেছেন, আবার পড়তে পড়তে মনে হতে পারে – কোনো উপন্যাস পড়ছি কি? এমনটা অনুভূত হয়েছিল তাঁর নদী নিরবধি বা প্রাচীন নগরীতে যাত্রা পড়তে গিয়ে। অন্যদিকে রিজিয়া রহমানের সঙ্গে গত ফেব্রম্নয়ারিতে এক আলাপচারিতায় জানতে পারি, তিনি আরো একখ- আত্মজীবনী লিখেছেন, যা এখনো বই আকারে প্রকাশ পায়নি। তিনি জানান তাঁর আত্মজীবনীর তৃতীয় খ–র নাম দেন দুঃসময়ের স্বপ্ন সিঁড়ি। প্রশ্ন করেছিলাম, নামটা এমন কেন? তিনি জানান, ‘একাত্তরের সময়ের ঘটনা। এখন বলো কেন? এটা শুরু করেছি ’৭০-এর ইলেকশন থেকে, ওটা বেসিক্যালি আমার পারিবারিক কাহিনি।’
শুরুতেই আমি সময়ের প্রসঙ্গে বলেছিলাম, রিজিয়া রহমান বলছেন, তৃতীয় খ- লিখেছেন ১৯৭১ সালের সময়কে কেন্দ্র করে, যদিও বলছেন তাঁর পরিবারের কাহিনি। কথা সত্য, তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের কথা, পরিবারের কথা লিখেছেন; কিন্তু কিছু কিছু সময় থাকে যে-সময়গুলোতে একজন ব্যক্তিমানুষের জীবন, তাঁর পরিবারের জীবন বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, সেই সময়ের রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিচ্ছবিই হয়ে ওঠে তাঁর সামগ্রিক উপস্থাপনার মাধ্যমে, যা আমি তাঁর প্রকাশিত দুটো আত্মজীবনীতে পেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, লেখক রিজিয়া রহমানের জীবনে তিনি যে তিনটি পর্বকাল পেরিয়েছেন, আমি বলতে চাইছি তাঁর জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৯৩৯ সালে। তাঁর কৈশোর কেটেছে ব্রিটিশ শাসনে, তিনি পেরিয়েছেন পাকিস্তানি শাসন, বাংলাদেশের জন্ম-যুদ্ধ থেকে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ তাঁর দেখা। একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখা নয়, একজন লেখক-বুদ্ধিজীবীর চোখে তিনি দেখেছেন নিজের জীবনটাকেও। দেশত্যাগ আর দেশভাগের যে মানবিক বিপর্যয়, তা তাঁর নিজের জীবনেরও একটি অধ্যায়।
রিজিয়া রহমান তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খ–র নাম দেন নদী নিরবধি, যেখানে শুরু অংশের শিরোনাম ‘অভিবাসী আমি’, যেখানে তিনি তাঁর উত্তর-প্রজন্মের কণ্ঠ দিয়ে প্রকাশ করলেন সংলাপ, ‘মানুষ তো চিরকাল পৃথিবীর প্রান্ত থেকে প্রামেত্ম অভিবাসন তৈরি করে চলেছে, মানুষ আসলে অনন্তকালের অভিযাত্রী।’ লেখক জানান, কথাটা বলেছে অপু, সে রিজিয়া রহমানের বড়ভাইয়ের ছেলে, যে আমেরিকা থেকে ছুটি কাটাতে এসেছে ঢাকায়। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাঁদের পরিবার একটার পর একটা অভিবাসন ঘটিয়েছেন ভারতবর্ষে। তাঁর পূর্বপুরুষের আগমন ঘটেছিল মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান থেকে। সুফি-দরবেশের সহযাত্রী হয়ে হায়াত মাহমুদ খান নামক তুর্কিভাষী ধার্মিক পুরুষ এসেছিলেন এই ভারতবর্ষে। সম্ভবত সমরখন্দে ছিল তাঁর আদি নিবাস। এই হায়াত মাহমুদ খানের অষ্টম পুরুষ মুন্সী আব্দুল খালেক ছিলেন রিজিয়া রহমানের দাদা। আর তাঁর একমাত্র পুত্র ডা. আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক রিজিয়া রহমানের বাবা। এই পরিবার দিল্লি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসে এবং দেশভাগের পর অপসনে ডা. আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক পূর্ব বাংলায় থিতু হন। সেই পরিবারের সদস্য বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক তাঁর আত্মজীবনী শুরু করেছেন ‘অভিবাসী আমি’ শিরোনামে, যেখানে রয়েছে আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের ছেলের বয়ান। বিষয়টির নির্মাণশৈলী বলে দেয় এই আত্মজীবনী শুধু কোনো এক রিজিয়া রহমানের আত্মকথাই নয়, এটা একটা ইতিহাসেরও বয়ান বটে।
অন্যদিকে রিজিয়া রহমানের মা মরিয়ম বেগম ছিলেন ঢাকা জেলার শাইনপুকুর জমিদার পরিবারের মেয়ে। তাঁর মা ছিলেন আধুনিক এক মানুষ। তাঁদের পারিবারিক-সাংস্কৃতিক পরিম-ল সম্পর্কে বেশ একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ নদী নিরবধি ও প্রাচীন নগরীতে যাত্রা পাঠে। অভিবাসন মানুষের যে আদি এবং সহজাত সে-বিষয়টি ব্যক্তিজীবনের আলোকে যেমন তুলে ধরেছেন রিজিয়া রহমান, যাকে নিয়ে মার্কিন গবেষক ও লেখক ক্লিনটন বুথ সিলি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, প্রসঙ্গ ‘সিরিয়াস সাহিত্য : দ্য প্রোজ ফিকশন অব বাংলাদেশ’জ রিজিয়া রহমান’ শিরোনামে। যেখানে বাংলাদেশ, বাঙালির আত্মপরিচয় বিষয়ে ঘুরেফিরে এসেছে রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের নানা আখ্যান। তাঁর রচনায় বাঙালির আত্মসত্তা এবং জাতীয়তাবাদের পট-পরিবর্তনের বিষয়টি স্পষ্টত হয়ে ওঠে। এমন একজন শক্তিমান লেখকের ছেলেবেলাটা কেমন ছিল? কী দেখে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে-সময়টাকে তাঁর দৃষ্টিতে দেখার এবং ইতিহাসের আলোকে তা উপলব্ধি করার অবকাশ পাঠকের মিলবে। ছেলেবেলার স্মৃতিতে তিনি লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কৈশোরের সময়, দেশভাগ। তিনি লিখেছেন, ‘আমার শৈশবের স্মৃতিতে সশব্দে বিরাজ করছে যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ। সেখানে কান পাতলে এখনো যেন শুনতে পাই সাইরেনের বিকট চিৎকার, বোমার গগনবিদারী আওয়াজ, জাপানি বোমারু বিমানের গুটগুট শব্দ আর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের ঘন ঘন কড়া ধমক। এখনো মনের অবচেতনের গভীরে কুণ্ডলী পাকায় শিশুকালের রাতগুলোর ব্ল্যাক আউটের ঘুটঘুটে অন্ধকার। … এর মাঝেই থাকে আমাদের খেলার জগৎ। ‘অল ক্লিয়ারের’ সাইরেন বেজে উঠলেই ঘরের দরজা-জানালা খুলে যায়। আমরা ছুটে যাই বাইরে। খেলার সাথীদের সঙ্গে কালো কাঁকর বিছানো রাস্তায়, মাঠে, বাড়ির সামনের সিঁড়িতে স্পীন্টার কুড়োই।’
তিনি আরো লিখেন, ‘খেলতে খেলতে গান গাই –
‘সা গা মা পা ধা নি
বোম ফেলেছে জাপানি’ …
সে-গানে আমাদের জাপানি আর ব্রিটিশ বন্ধুরাও সুর মেলাতে চেষ্টা করে। আমরা কজন বাঙালি, জাপানি আর ব্রিটিশ শিশু মাঠময় ছুটোছুটি খেলি, ফড়িং ধরতে ট্রেঞ্জে নামি। বিশ্বজুড়ে বেজে চলে বিধ্বংসী যুদ্ধের দামামা, আমাদের সেই আন্তর্জাতিক শিশুচক্রের ভুবনটিতে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটে না তাতে।
বিশ্ববিখ্যাত কালজয়ী লেখক লিও তলস্তয়ের বিখ্যাত সেই গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ চিলড্রেন আর ওয়াইজার দ্যান দেয়ার এলডারস পড়েছিলাম বড়ো হয়ে। মনে পড়ছিল আমাদের শিশুবয়সের কলকাতাকে, ভবানীপুরকে যেখানে যুদ্ধবাদী বয়োজ্যেষ্ঠ পৃথিবীর বিপরীতে আমরা শিশুরা গড়ে নিয়েছিলাম সখ্য আর শামিত্মর আনন্দময় বিভাজনহীন ভুবন।’
নিজের জীবনকে এত সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে যখন কেউ উপস্থাপন করছে, তখন তা আর কেবল আত্মস্মৃতিই থাকে না, একটা সময়ের অমূল্য আখ্যান হয়ে ওঠে। তাঁর আত্মজীবনীতেই ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগের দৃশ্যকল্প যেমন পাই, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানি হয়ে ওঠার সামাজিক বিশ্লেষণটাও খুঁজে পাওয়া যায়।
তাঁর আত্মজীবনী থেকে – ‘ভারত উপমহাদেশের মানচিত্র তখন আর অখ- নেই। রাজকীয় ইংরেজ লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন নামে এক ক্ষমতাধর তাকে অনভ্যস্ত ছুরিতে কেক কাটার মতো করে কেটে তিন টুকরো করে ফেলেছে। … বাবার পূর্বপুরুষের দেশ পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনায়। সেখানেই তার জন্ম। ডাক্তারি পাশ করার পর ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসের ডাক্তার হয়ে বদলির চাকরিতে ঘুরেছেন বিভিন্ন হাসপাতাল। … দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বদলি হলেন ফরিদপুর শহরের সদর হাসপাতালে। তার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের পিছুটানটি অস্বীকার করা সহজ ব্যাপার নয়, তবু মায়ের মত অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্বের সপক্ষেই নিজের নামের স্বাক্ষর দিলেন বাবা। খুশি হলেন মা। তিনি পূর্ববঙ্গের মেয়ে।’ এই যে ভাগ হয়ে যাওয়া দেশ, যে-দেশ নিজের ছিল ক্রমশ তা বিদেশ হয়ে যাওয়া, কাঁটাতার আর তার পারমিশনের বেড়াজালে ছিন্ন হওয়া মানুষেরা কী করে নিজেদের আবার নতুন দেশের অধিবাসী করেছে বা কী করে বাপ-দাদার ভিটার স্মৃতি থেকে নিজেকে আড়াল করতে অভ্যস্ত হতে থাকল, লেখক রিজিয়া রহমানের আত্মজীবনীতে তাঁর পরিবার-পরিজন-আত্মীয়জনের কথা যখন পড়ছি, তখন আমি মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আখ্যানও পড়ছি।
তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল ফরিদপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে। এরপর পড়েছেন ফরিদপুর ঈশানচন্দ্র হাই স্কুলে। এরপর আবার ফিরে এসেছেন ফরিদপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে। তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খ- প্রাচীন নগরীতে যাত্রা, যেখানে ঢাকা শহরের যাত্রাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাসের জীবনটি সেখানে ততটা আসেনি, যতটা এসেছে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় নানা সময় বেড়াতে বা বেড়াতে এসে দীর্ঘ সময় থাকার গল্প। মূলত এই খ-টি শেষে তিনি দেখিয়েছেন ফরিদপুর, চাঁদপুরের জীবন শেষ করে এবার ঢাকার জীবনের উদ্দেশে যাত্রা। এ অংশে ভাষা-আন্দোলনের সময়টাকে আমরা পেয়ে যাব। যখন লেখক রিজিয়া রহমান ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি লিখেন, ‘আটচল্লিশ বা পঞ্চাশে কিংবা বাহান্নতে এসব অনুধাবন করার বোধশক্তি পূর্ণ হয়নি আমার। কিন্তু আজকের পরিণত বয়সের বোধ দিয়েই আমার সেই
শৈশব-কৈশোরের ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করতে আর অসুবিধা হয় না। … পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পর আমাদের দেশে সমত্মানদের নামকরণে উর্দু-ফারসি নামের হিড়িক পড়েছিল, সেটি থমকে গেল। শুরু হলো বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার থেকে কবিত্বময় শব্দকে নামকরণের জন্য নির্বাচনের পালা। উজ্জ্বল, দীপ্ত, বর্ষা, শ্রাবণী, লাবণী, প্রবাল, শুক্তি, মুক্তি ইত্যাদি শ্রম্নতিমধুর বাংলা শব্দ নামকরণে প্রাধান্য পেতে শুরু করল। পাকিস্তানি আমলের প্রাথমিক পর্যায়ে আমার তিন বোনের নাম রাখা হয়েছিল খুরশীদা, মাসুদা ও খালেদা। বাহান্নর পরে জন্ম নেওয়া আমাদের সবার ছোট বোনটির নাম রেখে ফেললাম – রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে ‘দোদুল’ শব্দটি বেছে নিয়ে।
উৎসব-অনুষ্ঠানের শিরোনামও বদলে গেল। ‘ওয়ালিমা’ হলো ‘বউভাত’। ‘পান-চিনি’র বদলে এলো ‘পাকা-কথা’ (এখন যাকে বলা হয় এনগেজমেন্ট)। ফিরে এলো পহেলা বৈশাখ উদযাপন। ফিরে এলো বাঙালিজীবনে রবীন্দ্রনাথ বিপুল সম্ভারে। পোশাকে-আশাকেও বাঙালিত্বের প্রবণতা প্রাধান্য পেল।’
লেখক রিজিয়া রহমানের বেড়ে ওঠার সময় আর পারিবারিক জীবনের নিছক আত্মস্মৃতি এটা নয়, বরং এটি উপমহাদেশের ভাঙন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোতে কী করে ভিন্ন নামে বদলে যায় জীবন, এমনকি এই যে বাংলাদেশ, এই দেশটা হয়ে-ওঠার গল্পও এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘটনাবহুল সময়ের পর্বে পর্বে শৈল্পিক উপস্থাপনা আর নদীর মতো বহতা জীবনের পাঠ, সহসা ভুল হবে, এটা আত্মজীবনী? নাকি কোনো উপন্যাস? যা আমার ভূখ–র ইতিহাসও বটে।