বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে টনি মনিসনের কথাশিল্প

আপনাকে আমেরিকার ‘জাতীয় ঔপন্যাসিক’ বলা হয়। আপনাকে ‘আমেরিকার বিবেক’ও বলা হয়। মূলত ওয়াল্ট হুইটম্যান ছাড়া আরেকজন লেখককে চিমত্মা করা কঠিন যাঁর নাম জাতীয়ভাবে এত উচ্চকিত স্বরে উচ্চারিত হয়। আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, এটি আপনাকে লেখার জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? এরকম বিরাট সাফল্য কি একদিক থেকে পায়রার খোপের জীবনে পরিণত করে না?
উত্তরে তিনি বললেন, ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আমি কিছুটা বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। কিন্তু স্রষ্টাকে ধন্যবাদ, সে-সময়ে আমি প্যারাডাইস লিখছিলাম। এই পুরস্কারের জন্য আমাকে আহামরি কিছু করতে হয়নি। এখন আমি শুধু ভালো জিনিসগুলো গ্রহণ করি। আমার একটা ফরমায়েশি কাজের কথা মনে পড়ে। তবে আমি শুধু ভালোগুলোই গ্রহণ করি।’

এই ভালোর সঙ্গে থাকা সাহিত্যিকের নাম টনি মরিসন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, সম্পাদক এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক। পেয়েছেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। অর্জনের খাতায় আরো যোগ করেছেন ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ পদক, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। টনি মরিসনের জন্ম আমেরিকার ওহাইও অঙ্গরাজ্যের লরেইনে ১৯৩১ সালে। এরি লেইকের কাছে উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট এই শিল্পশহরটিতে তখন মূলত ইউরোপিয়ান, মেক্সিকান ও কৃষ্ণাঙ্গদের বসবাস ছিল। টনির বাবা জর্জ ওফোর্ড ও মা সারাহ উইলিস ওহাইওর দক্ষিণাঞ্চল থেকে বর্ণবাদ এড়াতে এবং অধিকতর সুবিধার আশায় উত্তরে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই টনি অত্যন্ত মেধাবী। শৈশবে তাঁর নাম ছিল ক্লোয়ি অ্যান্তনি ওফোর্ড। ক্লাসের মধ্যে তিনিই শুধু প্রথম গ্রেডে পড়তে পারতেন। ১৯৪৯-এ ভর্তি হন ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৩ সালে। অনেকেই তাঁর প্রথম নাম ‘ক্লোয়ি’ ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারায় মধ্যনামের সংক্ষেপ ‘টনি’কেই প্রথম-নাম হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৫৫-তে স্নাতকোত্তর পাশ করেন নিউইয়র্কের ইথাকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে। এরপর চাকরি নেন হিউস্টনের টেক্সাস সাউদার্ন ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৫৭ সালে ফিরে আসেন হাওয়ার্ডে ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে। এখানে দেখা হয় জ্যামাইকান প্রকৌশলী হ্যারল্ড মরিসনের সঙ্গে। পরের বছর বিয়ে করেন তাঁরা। নামের শেষ অংশে যোগ হয় স্বামীর নাম। শিক্ষকতা ও পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি ছোট এক লেখকদলে যোগ দেন। টনির প্রথম গল্প একটি কালো মেয়েকে নিয়ে, স্রষ্টার কাছে যে প্রার্থনা করত নীল চোখের জন্য, কারণ তার ধারণা, সাদা মেয়েদের মতো নীল চোখই শুধু সুন্দর।
এই নীলের প্রেমে মগ্নতা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে নির্মাণ করেছেন বিশ্ববিজয়ের উপন্যাস। যে-কারণে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রামেত্ম ছড়িয়ে আছেন নিরন্তর লেখনীর মাধ্যমে। বাস্তবতা হলো, নীলের চেয়েও ঘন নীল টনি মরিসন। কৃষ্ণাঙ্গী এই
কথাশিল্পীর উপন্যাস অনেকটা কবিতার মতো সুখপাঠ্য; কৃষ্ণাঙ্গ দাসের জীবনঝংকার আছে তাঁর রচনায়। নোবেল, পুলিৎজার সব আগেই হয়ে গেছে। সহাস্য টনি মরিসনকে কখনো সরাসরি না দেখলেও লেখকচোখে কল্পনায় তাঁকে দেখে মনে হয়েছে – ছন্দিত জীবনের জন্য নিবেদিত মানুষ ছিলেন তিনি। না হলে তাঁর লেখনীতে এত প্রেম-ভালোবাসা-অভিজ্ঞতা কীভাবে এসেছে? লা লিজিয়ঁ দ্য অনর যেবার তিনি পেয়েছিলেন, সেবার কাগজগুলো লিখেছে – শিল্পকলারসিক ফরাসি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। সেই সম্মানে সম্মানিত হলেন টনি মরিসন। সেই টনি মরিসন, ১৯৯৩ সালে যাঁর উপন্যাস দ্য ব্ল‍ুয়েস্ট আই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। নোবেল যখন জেতেন, তখন কৃষ্ণাঙ্গী এই লেখিকার বয়স খুব একটা বেশি ছিল না। নোবেলজয়ী তাঁর এ-উপন্যাসের নামটির বাংলা করলে হয় ‘নীলের চেয়েও ঘন নীল।’ নিজে আফ্রিকার মানুষ; কিন্তু তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে ছন্দিত-নন্দিত বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনকথা। যদিও বলা হয়ে থাকে, সকল বিষয়ের পাশাপাশি তাঁর রচনায় উঠে আসে সেই কালো মানুষদের দিনলিপি। নোবেলজয়ী দ্য ব্ল‍ুয়েস্ট আই উপন্যাসে যেমন দাসত্বের অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় গভীরে কেঁদে চলা এক নারীর মর্মন্তুদ কাহিনি লিখে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন টনি। তারপরেও তাঁর রচনা বড় সুখপাঠ্য, অনায়াস। অতি সহজে বুকের গভীরে শিকড় বুনে দেয় তাঁর গল্প বলার ভাষা, কবিতার চালে যার চলন বড় ছন্দময়। একজন নিবেদিত পাঠক হিসেবে বলব – টনি মরিসনের বিলাভড উপন্যাসটা ১৯৮৮ সালে পুলিৎজার জিতে নেয়। তারপর ’৯৩-তে নোবেল, এরপর লা লিজিয়ঁ দ্য অনার।
ওহাইওর এক দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের ছোট্ট মেয়েটি কীভাবে গোটা বিশ্বের হৃদয় জিতে নিয়েছেন তাঁর লেখনীতে? প্রশ্ন উঠতে পারে সবার মনে, উত্তরে বলব – গত শতাব্দের সেরা মার্কিন লেখিকা টনি মরিসনের নিজের জীবনটাও উপন্যাসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
টনি মরিসন অবশ্য নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় যে আমি যখন বড় হয়ে উঠছিলাম তখন আমি এই দুটো শব্দ – কালো এবং নারীবাদী, দুটোকেই একত্রে মিলিয়ে ফেলেছিলাম, কারণ আমি এমনসব কৃষ্ণাঙ্গ নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম যারা খুবই কষ্টসহিষ্ণু এবং উদ্যমী ও যারা সবসময় স্বপ্ন দেখত তারা কাজ করে অর্থোপার্জন করছে এবং বেশি বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে না এবং ঘরসংসারও একই সঙ্গে পরিচালনা করছে। তাদের কন্যাসমত্মানের কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল ভীষণ ভীষণ বেশি, এবং তা থেকে কোনো ছাড় ছিল না আমাদের; এটা আমার কাছে কখনো মনে হয়নি যে, এটা একটা নারীবাদী কার্যক্রম। আপনি জানেন, আমার মা সেই ছোট্ট শহরে মাত্র খুলেছে এমন একটা থিয়েটারে হেঁটে হেঁটে যেতেন শুধু এ-কারণে যে, কর্তৃপক্ষ যেন জনগণকে
কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ এভাবে পৃথক না করে ফেলে। এবং যত তাড়াতাড়ি এটা খুলল, সে ওটাতে সবচেয়ে প্রথম গেল, এবং দেখল অভ্যর্থনাকারী তাকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে কোথায় বসায়, এবং কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে কোনো সমস্যা যদি হয় চারদিকে সে দেখে নিয়েছে কারুর কাছে অভিযোগ করার জন্য। এরকম কাজকর্ম করা ছিল দৈনিক ব্যাপার, এবং পুরুষরাও এরকম করত, দেখত যে-কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গরা তাদের কে কতখানি গুরুত্ব দেয় বা অপমান করে। কাজেই আমার কখনো এটা মনে হয়নি যে তার কৃষ্ণাঙ্গদের অস্তিত্বের এ-ধরনের নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা থেকে নিজেকে সরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়া দরকার। এবং মূল ঘটনা হচ্ছে, সে একজন নারী তাই বলে তাকে কখনো বাধাগ্রস্ত করা হয়নি। বাচ্চারা সিনেমায় গেলে – কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চারা – তার মেয়ে বাচ্চারা, একই ভাবে তার ছেলেরাও সিনেমায় গেলে তাদের সঙ্গে অন্য শ্বেতাঙ্গরা কী ব্যবহার করে তা দেখার জন্য তিনি খুবই উৎসুক ছিলেন। কাজেই আমি এমনসব মানুষের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম যারা এই সব নিয়মকানুন কাজকর্ম খুব গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালনা করত এবং নিজেরা এসব কাজ করত। পরবর্তীকালে এগুলোকে বলা হতে লাগল যে, এগুলো ‘নারীবাদী’ আচরণ। শুরুর দিকে এরকম ব্যাখ্যার কারণে আমি প্রচুর ঝামেলার মধ্যে পড়েছি। এবং আমি এ-বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি, এবং সত্যিকার অর্থে, আমি সুলা বইটিও লিখেছি সে-কারণেই, নতুন ধারণার ওপর তাত্ত্বিক ভিত্তিতে, যেটাতে ছিল : নারীরা অবশ্যই একে অন্যের বন্ধু। এবং যে কমিউনিটিতে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানে এমন অবস্থা যে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পরিপ্রেক্ষিতে, একজন নারী একজন পুরুষের চাইতে একজন নারীর বন্ধুত্ব ও সঙ্গ বেশি পছন্দ করে। তারা এই চেতনায় সত্যি সত্যিই একে অন্যের ‘বোন’।’
শুধু আমার নয়, অসংখ্য পাঠকের প্রিয় টনি মরিসন শিক্ষকতা ছেড়ে ‘র‌্যানডম হাউস’ প্রকাশনার সম্পাদক হয়েছিলেন, নিউইয়র্কের সিরাকুজে জীবনকে থিতু করতে চেয়েছিলেন, পরে অবশ্য নিউইয়র্ক সিটিতে নির্মাণ করেছিলেন প্রত্যয়ী পথ। চাকরি ছেড়ে লেখায় মন দিয়েছিলেন। কালো মেয়েটিকে নিয়ে লেখা ছোটগল্পটিকে উপন্যাসে পরিণত করলেন। লেখালেখিকে নিলেন ‘এক্সাইটিং’ ও ‘চ্যালেঞ্জিং’ হিসেবে। গল্পটি ব্ল‍ুয়েস্ট আই (১৯৭০) নামে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করালেন। এরপরের উপন্যাসগুলো হলো : সুলা (১৯৭৩), সংস অব সলোমন (১৯৭৭), বেবি টার (১৯৮১) ও বিলাভড (১৯৮৭)। বিলাভড উপন্যাসটি পরের বছর পুলিৎজার পুরস্কার পায়। আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের এক হৃদয়বিদারক কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এ-উপন্যাসে। ১৮৫১ সালের একটি ঘটনা। ক্রীতদাসী মার্গারেট গার্নার তার কেন্টাকির মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে আসেন ওহাইওতে। ধরা পড়ার আগে তিনি তার সমত্মানদের হত্যা করতে চান, দাসত্বের জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে। একটি সমত্মানকে হত্যাও করেন। মার্গারেট এজন্য অনুতপ্ত নন, কারণ তিনি চান তার মতো দাসত্বের জীবন যেন সমত্মানদের স্পর্শ না করে। পরবর্তী উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – জাজ (১৯৯২) ও প্যারাডাইস (১৯৯৭)। টনি মরিসন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে। তিনিই নোবেল বিজয়ী একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী। তাঁর লেখায় বর্ণবাদী সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা, আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের জীবন এবং বৈরী সমাজে তাদের শক্তি ও সংগ্রাম, পৌরাণিক উপাদান, সুগভীর পর্যবেক্ষণ, সমবেদনা এবং ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক এসেছে অত্যন্ত কাব্যময় গীতলতায়। নানা বিষয়ে লেখা তাঁর গল্প, কবিতা ও আলোচনায় মূর্ত হয়েছে আফ্রো-আমেরিকান সংস্কৃতি, বর্ণবাদ, যৌনতা ও শ্রেণিবৈষম্যের কথা। ছোটবেলায় শোনা দক্ষিণাঞ্চলীয় আমেরিকানদের লোকগাথা সংগীতের অনুরণনের অনুভব নিয়েই তিনি পাঠ করেন তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, ফ্লবেয়ার থেকে শুরু করে জেন অস্টেন পর্যন্ত।
এই পথচলায় অনন্য ছিলেন তিনি। তাঁর মতো কেউ নেই, তাঁর সমকক্ষও নেই কেউ। সাহিত্যমানে নির্মলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজের সমাবর্তনে তাঁর দেওয়া ভাষণটি চিরঅমলিন হয়ে থাকবে। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ তোমরা সাফল্যের সঙ্গে এক মহৎ, সম্মানজনক ও তাৎপর্যময় ডিগ্রি অর্জন করলে, তাই শুরুতেই তোমাদের ধন্যবাদ। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পৃথিবীর অনেক অবদান, অগণিত অর্জন শেষাবধি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি শুধুমাত্র ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে না যাওয়ার কারণে। তোমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন। তোমাদের আর পরীক্ষার চাপ নেই। তোমাদের সামনে এখন অবারিত জীবনের নতুন যাত্রাপথ। শিক্ষাজীবনের যত ঋণ, যত দায় – সেসব শোধরানোর সময় এখন। যাত্রা শুরুর পর আগের গৎবাঁধা সব রোডম্যাপ ছুড়ে ফেলতে হবে। নতুনভাবে পথচলার পরিকল্পনা নিতে হবে তোমাদের নিজেকেই। পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গিটা হতে হবে অভিনব, চিরসতেজ, নান্দনিক। অবাঞ্ছিত বিষয় বর্জন করে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করো। পথচলার সময় অবশ্যই মনে রাখবে, তুমি কোথা থেকে এসেছ। যে-জায়গায় আমাদের জন্ম, সেখানকার ধুলোবালি আর স্বপ্ন আমাদের লালন করতে হবে। পুরো পথেই নিজেকে প্রশ্ন করবে, ‘আমি কেন এই পথে?’ এর একটা উত্তর আমি তোমাদের বলতে পারি। সেটা হলো, জিততে। তুমি জিততেই এ-পথে নেমেছ। এ-জেতাটা হচ্ছে নিজের সম্ভাবনাময় শক্তির জয়। এ-জেতাটা হলো শ্রেষ্ঠ হিসাবরক্ষক, প্রকৌশলী, শিক্ষক কিংবা তুমি যা হতে চাও, তা হওয়ার। যে-সম্ভাবনা তোমার মধ্যে আছে, সেটার জন্য নিজেকে বিশ্বাস করো। অন্য কারো সাফল্য দেখে নিজের সফলতাকে বিচার করবে না। অন্য কারো সফলতার গল্প পড়ার দরকার নেই, তুমি নিজেই নিজের গল্প হও। কোন বিষয়ে তোমার আগ্রহ বেশি – এটা তুমি জেনে যাবে একদিন। আবার কেউ কেউ আছে, যারা নিজের আগ্রহের জায়গাটা কখনো জানতে পারে না। এরই মধ্যে তুমি যদি তোমার লক্ষ্য স্থির করে থাকো, অথবা যদি এমন হয় তুমি তোমার লক্ষ্যকে সন্ধান করছ, তবে মনে রেখো, কৌতূহলই একদিন তোমার জীবনে সফলতা এনে দেবে। অন্যদিকে স্বপ্ন সত্যি করতে হলে তোমার ভেতরে যে ‘তুমি’ আছে, তার কথা শুনতে হবে। ইচ্ছে যদি বিসত্মৃত হয়, বিশাল হয়, তোমার স্বপ্ন সত্যি হবেই। সততা, নৈতিকতা ও আগ্রহ নিয়ে কাজ করে যাও। যদি তোমার স্বপ্নের সঙ্গে আপস না করো, তুমি সফল হবে, হবেই। পথ বেছে নিতে তুমি যেমন স্বাধীন, সফল হওয়াটাও তোমার জন্য উন্মুক্ত। দরকার শুধু কঠোর পরিশ্রম এবং একটি স্বপ্ন। আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করলে, তাদের অনেকেই জানো না, তোমরা পৃথিবীটাই বদলে দিতে যাচ্ছ। আমি জানি, সত্যিই তোমরা পৃথিবীটা বদলে দেবে। কীভাবে বদলাবে, সে-সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাদেরই। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আদর্শের জন্য সংগ্রাম করি। জীবনে সংগ্রাম করাটাই তো চিরসত্য। দরিদ্র দেশের ছোট্ট কোনো গাঁয়ে নাকি উন্নত দেশের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে একটি শিশু জন্ম নিল, সেটি মুখ্য বিষয় নয়। সব মানুষের আতমমর্যাদা ও মৌলিক সাম্যে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আরো বিশ্বাস করি, সব মানুষ শামিত্ম চায়। আমরা অসাধারণ সুন্দর এক পৃথিবীর বাসিন্দা। যদিও তা বিভক্ত বিভিন্ন দলে, তবু আমরা একই মানব সম্প্রদায়ের অংশ। সমতার পৃথিবী গড়তে হলে এখন তোমাদের সহযোগিতা দরকার। তোমরা যে যেখানেই যাও, ভবিষ্যতে যে যা-ই করো না কেন, তোমরা সেই পৃথিবীতে যোগ দিতে যাচ্ছ, উত্তরোত্তর যার বিশ্বায়ন ঘটছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেখানে তোমরা সবাই এক হয়ে কাজ করবে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমার একটা অভ্যাস ছিল এমন, আমি হঠাৎ করে অধ্যাপকদের কক্ষে হানা দিতাম। তাঁদের প্রশ্ন করতাম – জীবনের অর্থ কী? অধ্যাপকরা ঘাবড়ে যেতেন, ভাবতেন আমার ‘নিওরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার’ হয়েছে। সবাই যে এমনটা ভাবতেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘সুখ’। আবার কেউবা বলতেন, ‘জ্ঞান’। আমার কাছে জীবনের অর্থ হলো, আমার কাছের মানুষকে সুখী করার জন্য কাজ করা। তোমাদের কাছেও জীবনের আলাদা আলাদা অর্থ থাকতে পারে। আর যদি না থাকে, তাহলে এ পথে চেষ্টা করে দেখতে পারো। অন্যের জন্য কিছু করার মধ্য দিয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নাও। তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে।’
অসাধারণ তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি লেখা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি বই। ইন্টারভিউ নামে একটি ম্যাগাজিনে ১ মে, ২০১২ সালে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ক্রিস্টোফার বোলেন। ফটোগ্রাফিতে ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক ড্যামন উইন্টার। সেখানে প্রশ্ন করা হয়, আপনি তো ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহত্যাবিষয়ক বিষয়বস্ত্ত নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের থিসিস করেছিলেন, তাই না?
উত্তরে সদ্যপ্রয়াত টনি বলেছিলেন – ‘আমি উলফ ও ফকনারকে নিয়ে থিসিস লিখেছিলাম। আমি তখন ফকনারের অনেক লেখা পড়েছি। আপনার হয়তো একটা বিষয় জানা না-ও থাকতে পারে। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকান সাহিত্য একেবারেই নতুন ছিল। এটি ছিল একেবারেই বিচ্যুত ও আনকোরা। ইংরেজি সাহিত্য বলতে তা মূলত ইংরেজিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমেরিকান সাহিত্যকে বেশি কিছু করার জন্য এই উঁচুমাপের অধ্যাপকগণই ভরসা ছিলেন। তাঁদের সেসব কাজ এখন আমাকে নাড়া দিচ্ছে।’
কতটা আলোর পথের পথিক হলে সমাজ-জীবন এবং আলো আর আঁধারের সমীকরণ নিয়ে আসতে পারেন নিজের সকল লেখায়? প্রশ্ন করতে করতে যাদের সময় কাটে, তাদের জন্য টনি মরিসনের এ-কথাগুলো জানা প্রয়োজন; তিনি বলেছেন – ‘আমি জানি, সেখানে লেখকরা আছেন যাঁরা তাঁদের সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায়ই কোনো ধরনের রিভিউ না দেখেই, অথবা কোনো বাজে আলোচনা না দেখেই, অথবা তাঁরা নিজেদের ছাঁকনির মধ্যে বা শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের মধ্যে ফেলে, এটা তাঁদের জন্য দরকারি হিসেবে খুঁজে পাবেন, কারণ এগুলো কখনো কখনো তাঁদের জন্যই বিষাক্ত হয়ে উঠবে। আমি এ-ধরনের স্বতন্ত্রীকরণ অনুমোদন করি না। এ-দেশ
আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্য কীভাবে মনের মধ্যে গ্রহণ করছে, কীভাবে লিখছে, কীভাবে দেখছে, তা জানার জন্য আমি খুবই আগ্রহী। এটা একটি দীর্ঘ এবং কঠোর সংগ্রাম, এবং এখানে যথেষ্ট পরিমাণ কাজ করতে হবে। নারীদের কাজ কীভাবে রিভিউ হচ্ছে এবং অনুধাবন করা হচ্ছে, তা জানার জন্য আমি বিশেষভাবে আগ্রহী। এবং এটা জানার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে আমার নিজের বইয়ের রিভিউ পাঠ করা; এটা শুধুমাত্র এ-কারণে নয় যে, আমি কীভাবে লিখি তা জানা। আমি বোঝাতে চাইছি, আমি এই কাজ দিয়ে কিছুই পাই না। আমি অন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, যারা দেখাচ্ছে আমি কীভাবে এ সকল কাজ করছি, কীভাবে এ সকল কাজে সফলতা আনছি, সে-বিষয়ে তাদের কাজের আকার-প্রকার বা ধারণা বক্তব্যের সঙ্গে নিজের কাজ মিলিয়ে ফেলছি না। কাজেই আমাকে এসব আদৌ প্রভাবিত করছে না। কিন্তু আমি সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য খুবই উদগ্রীব। এবং বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক এবং মজাদার বিষয়ও আমি রিভিউতে দেখতে পাই।’
আপনার বিখ্যাত উপন্যাস প্যারাডাইসকে ‘নারীবাদী’ উপন্যাস বলা হচ্ছে, আপনি কি এটার সঙ্গে একমত? প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘একেবারেই না। আমি কখনো কোনো ধরনের ‘বাদী’ জাতীয় কিছু লিখিনি। আমি কখনো কোনো ‘বাদী’ উপন্যাস লিখিনি।’
সাহসী উচ্চারণের কথাশিল্পী টনি মরিসন লিখেছেন কম, কিন্তু জয় করেছেন বেশি। হয়তো এ-কারণেই টনি মরিসনের গল্প ‘সুইটনেস’ যখন দুলাল আল মনসুর কর্তৃক অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তখন মননশীল লেখাটিতে ডুবে যেতে যেতে খুঁজে পাই জীবনের কথা বলার অসাধারণ রাস্তা। ‘সুইটনেসে’র শুরুটা ছিল এমন – ‘দোষ আমার নয়। তাহলে আমাকে দোষ দিতে পারো না তোমরা। এতে আমার হাত ছিল না। কী করে এমনটি হলো আমি জানিও না। আমার দুপায়ের সংযোগস্থল থেকে অন্যরা ওকে টেনে বের করে। তার এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি বুঝতে পারি কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে। সত্যিই গোলমাল হয়ে গেছে। ওর গায়ের রং এতটাই কালো, আমি দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। মাঝরাতের মতো কালো। সুদানের মানুষের মতো কালো। আমার ত্বক মোটামুটি ফর্সা; মাথার চুলের রংও ভালো; আমরা এরকম রংকে বলি উজ্জ্বল হলুদ। লুলা অ্যানের বাবার রংও এরকমই। আমার পরিবারের লোকেরা যে যেখানে আছে তাদের কারো গায়ের রং ওর গায়ের রঙের ধারেকাছে নয়। ওর গায়ের রঙের সবচেয়ে কাছের তুলনা চলে আলকাতরার সঙ্গে। তবে ওর চুলের রং গায়ের সঙ্গে খাপ খায় না। হালকা কোঁকড়ানো হলেও বেশ সোজা। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাংটা প্রজাতির লোকদের চুলের মতো। তোমাদের মনে হতে পারে, আমাদের সুদূর কোনো পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য ওর মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে ওর আবির্ভাব হয়েছে কার কাছে? আমার নানিকে তোমরা দেখেছ নিশ্চয়ই। তাকে শ্বেতাঙ্গ বলেই তো মনে করা হতো; তার বিয়েও হয়েছিল শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে। তাঁর সমত্মানদের সম্পর্কে একটা কথাও তিনি বলেননি কাউকে। আমার মায়ের কিংবা খালাদের কাছ থেকে কোনো চিঠি পেলে না খুলে, না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। শেষে তারা আর কোনো খবর পেলেন না। তাঁকে তাঁর মতো থাকতে দিলেন। তখনকার দিনে প্রায় সব বর্ণসংকর এবং সংকরদের সংকর সমত্মানদের প্রায় সবাই এরকমই করতেন, বিশেষ করে তাদের চুল মনের মতো হয়ে থাকলে। কল্পনা করতে পারো, কতজন শ্বেতাঙ্গের শরীরের অভ্যন্তরে কৃষ্ণাঙ্গের রক্ত বয়ে চলেছে? অনুমান করে দ্যাখো। আমি শুনেছি এরকম শ্বেতাঙ্গের সংখ্যা শতকরা বিশজন। আমার নিজের মা লুলা মে নিজেকে শ্বেতাঙ্গের বংশধর বলে চালিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ থাকতেই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর জন্য অবশ্য তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। নিজেদের বিয়ের সময় বাবা আর মা গিয়েছিলেন আদালত ভবনে। সেখানে দুটো বাইবেল রাখা ছিল। একটার ওপরে হাত রেখে কৃষ্ণাঙ্গরা শপথ নিতেন। আরেকটা রাখা ছিল শ্বেতাঙ্গদের জন্য। তাদের কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য রাখা বাইবেলে হাত রাখতে দেওয়া হয়েছিল। বাইবেল বলে কথা! বাইবেল নিয়ে কি প্রতারণা করা যায়? এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতির বাড়িতে হাউসকিপার হিসেবে কাজ করতেন আমার মা। আমার মায়ের হাতের রান্নাই তারা প্রতিবেলা খেতেন। গোসলের সময় বাথটাবে বসে আমার মাকে পিঠ কচলে দিতে বলতেন তারা। তাঁকে আরো কত গোপন কাজকর্ম করতে বলতেন খোদা মালুম। কিন্তু কখনো তাদের বাইবেল ছুঁতে দিতেন না।’
একদিকে বর্ণবৈষম্য, অন্যদিকে ধর্ম নিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থান পরিষ্কার করেছেন টনি। যে-কারণে সারাবিশ্বে সব সাহিত্যামোদী তাঁকে করে রেখেছেন আদর্শ লেখক। কারণও আছে অনেক। সেই অনেক কারণের একটি হলো – লেখকসত্তা তাঁকে করেছে স্বপ্নলেখক। বাস্তবতা তুলে আনা নির্ভীক কথাশিল্পী। ‘সুইটনেসে’র শেষ অংশটাই তাঁর প্রমাণ – ‘এখন ওর পেটে বাচ্চা। চমৎকার অর্জন লুলা অ্যান। যদি মনে করে থাকো মাতৃত্ব মানে মধুর স্বরে কথা বলা, মাতৃত্ব মানে প্রাপ্ত কোনো মূল্যবান দ্রব্য, কিংবা ডায়াপার ইত্যাদি, তাহলে তোমার মানসিক ঝাঁকি খাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। বড় ধরনের ঝাঁকি। কল্পনা করে দ্যাখো তোমার বেনামি ছেলেবন্ধু, কিংবা স্বামীর কথা! আই লাভ ইউ মাই বেবি!
আমার কথা শোনো। মা হলে কেমন লাগে এখন বুঝতে যাচ্ছ। জগৎ-সংসার কেমন, কেমন করে চলে এ-জগৎ, মা হওয়ার পরে জগৎটা কেমন করে বদলে যায় সব দেখতে পাবে।
সব সৌভাগ্য তোমার জন্য! ঈশ্বর তোমার সমত্মানের মঙ্গল করুন।’
তিনি স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন নিঃসন্দেহে। হয়তো এ-কারণেই সংসার-ধর্মকে আপন করে সমত্মানসন্ততি লালন-পালনের পাশাপাশি সাহিত্যময় করেছেন জীবনকে। তিনি অবশ্য তা নিজেই স্বীকার করেছেন ঠিক এভাবে – ‘ভীষণ ভীষণ সকালে, আমার বাচ্চারা জেগে ওঠার আগে। আমি রাতের বেলায় খুব ভালোভাবে কাজ করতে পারি না। আমি তখন কাজ করলে লেখালেখি খুব একটা এগিয়ে যায় না। কিন্তু আমি খুব সকালে জেগে উঠি, কাজেই আমি ওটা করতাম, এবং আমি সপ্তাহামেত্মর ছুটির দিনেও লিখতাম। গ্রীষ্মকালে বাচ্চারা আমার মা-বাবার কাছে ওহাইও শহরে যেত, যেখানে আমার বোন বাস করে – আমার পুরো পরিবার সেখানে বাস করে – কাজেই পুরো গ্রীষ্মকালই আমি লেখালেখির কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতাম। এবং এভাবেই আমি ওগুলো শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি। এটা এখন আমার জন্য কতকটা ভীতিকর বলেই মনে হয়; কিন্তু যখন আমি একজন সাধারণ গৃহবধূর জীবনযাপন করার কথা মনে করি অথবা অন্য কোনো কিছু করার কথা ভাবি, তখনো এই গৃহবধূর জীবনযাপন বা অন্যরকম বিলাসী জীবনযাপনও সেই একই রকম ভীতিকর বলে মনে হয় নিজের কাছে। তারা যা পারে তার সবকিছুই করতে পারে। তারা এটা সংঘবদ্ধ করে নেয়। এবং তারা জানে সময়কে কী করে ব্যবহার করতে হয়। কীভাবে প্রতিবার থালাবাসন ধুতে হবে তা কিন্তু আপনাকে প্রতিবার করার সময় শিখতে হবে না। আপনি এরই মধ্যে জানেন কীভাবে ওটা করতে হয়। যখন আপনি ওই থালাবাসন ধুচ্ছেন, আপনি তখনো কিন্তু চিমত্মা করতে পারছেন। আপনি জানেন, এই থালাবাসন ধোয়াটা আপনার পুরো মনকে আচ্ছন্ন করছে না। অথবা আপনার লেখার বিষয়ে চিমত্মাটা একটা আলাদা চিমত্মারেখার মধ্যেই আছে। আমি লেখালেখির বিষয়ে প্রচুর পরিমাণ সমস্যা অথবা কোনো চরিত্র সম্বন্ধে চিমত্মা প্যাকড ট্রেনের মধ্যে বসে সমাধান করেছি, যেখানে আপনি আর কোনো কিছু করতে পারবেন না। ঠিক আছে, আপনি হয়তো সেখানে বসে বড়জোর পেপার পড়তে পারেন। এবং এরপর আমি হয়তো চিমত্মা করতাম সে-সম্বন্ধে, আচ্ছা, সে কি এটা করেছে? এবং এরপর হয়তো কখনো কখনো আমি সত্যিই ভালো কিছু পেয়ে যেতাম। আমি অফিসে নামার সঙ্গে সঙ্গেই মানে অফিসে ঢুকেই যা চিমত্মা করেছিলাম তার সংক্ষিপ্ত সারমর্ম লিখে নিতাম এ-কারণে যে, আমি পরে আবার তা ভুলে না যাই। এটা খুবই শক্তিশালী একটা অন্তর্জাগতিক জীবন যেটা আমি এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন করেছি, এবং আমার নিজের জন্য এটা ছিল, কারণ কী বলব, সবসময়ই আমার মনের মধ্যে মন্থন হচ্ছিল …’
টনি মরিসন চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর লেখা রয়ে গেছে। রয়ে গেছে অবারিত সম্ভাবনার উপন্যাসগুলো, যা আমাদের হাজার বছরের কথাশিল্পে প্রজাপতি পাখা মেলে উড়ে যাবে বর্ণবৈষম্য-ধর্মব্যবসা আর সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে …