বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব : একটি অনালোচিত অধ্যায়

বাংলাদেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তির নিরবচ্ছিন্ন ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৫৯ সাল থেকে, যদিও প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। তবে এর পরবর্তী দু-বছর কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এ-সময়ে কোনো ছবি নির্মাণের কাজ চলেনি।
প্রকৃতপক্ষে ছবি নির্মাণের কাজ চলেছিল বলেই ১৯৫৯ সালে চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিগুলো ছিল – এ জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা, ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহীউদ্দীনের মাটির পাহাড় ও এহতেশামের এদেশ তোমার আমার।
সে-বছর মুক্তিপ্রাপ্ত চারটি ছবির মধ্যে জাগো হুয়া সাভেরা অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিল। এ-সাফল্য বাণিজ্যিক বিবেচনায় নয়, বরং তা ছিল নির্মাতাদের মননশীলতা প্রকাশের ক্ষেত্রে সাফল্য। নানা কারণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবির অশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি ছিল সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রথম উপন্যাসনির্ভর চলচ্চিত্র। ‘সত্যিকার অর্থে’ কথাটা বলার কারণ হলো, এর কাহিনি একটি বিখ্যাত উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছিল, বলা চলে সেই উপন্যাসেরই একটি চলচ্চিত্রায়ণ। এর আগে আর কোনো উপন্যাস নিয়ে কেউ ছবি বানাননি। উপন্যাসটির রচয়িতা ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উপন্যাসের নাম ছিল পদ্মা নদীর মাঝি। বাংলাদেশের মানুষের জীবন লেপ্টে ছিল এই ছবির পরতে পরতে। কিন্তু ছবিটির কোথাও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা পদ্মা নদীর মাঝির কোনো স্বীকৃতি ছিল না। বরং এর কাহিনিকার হিসেবে পাকিস্তানের প্রগতিশীল ধারার উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের নামের উল্লেখ রয়েছে। তাই প্রকাশ্য উপন্যাসনির্ভর ছবি হিসেবে এর কোনো স্বীকৃতি নেই।
এখানে গুরুত্বের সঙ্গে জাগো হুয়া সাভেরার উল্লেখ করার কারণ হলো – এই ছবিটি বাংলাদেশের মানুষকে চলচ্চিত্র উৎসব
কথাটার সঙ্গে যতটা পরিচিত করেছিল, ততটা পরিচিত আর কোনো ছবি করেনি। এটি ছিল বাংলাদেশের সেই প্রথম ছায়াছবি, যা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছিল। এসব উৎসব ও পুরস্কার এবং তা নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, এদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রী – সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য খুব মর্যাদাপূর্ণ ছিল। জাগো হুয়া সাভেরার আগে শুধু বাংলাদেশের নয়, তখনকার পুরো পাকিস্তানেরই আর কোনো চলচ্চিত্র এত বেশি পুরস্কার পায়নি। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসের পত্রিকায়ও এই ছবির নিত্যনতুন সম্মাননাপ্রাপ্তির সংবাদ ছাপা হতে দেখা যায়। চিত্রালী থেকে এমন একটি সংবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
উদ্ধৃত সংবাদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জাগো হুয়া সাভেরাই পাকিস্তানের একমাত্র চলচ্চিত্র, যা প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল এবং বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল আর একই সঙ্গে পুরস্কার এনেছিল। উৎসবগুলোর খুব খ্যাতি ছিল, তবে সেসব উৎসবের একটাও বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা পাকিস্তানেই তখনো কোনো চলচ্চিত্র-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়নি।
বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র-উৎসব আয়োজিত হয়েছিল এর অনেক পরে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক
চলচ্চিত্র-উৎসবটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবেরই একটা অংশ। তিনটি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে-উৎসব। প্রথম পর্যায়ে লাহোরে, দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকায় ও তৃতীয় পর্যায়ে করাচিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকার বলাকা সিনেমাহলে প্রদর্শিত হয়েছিল উৎসবের ছবিগুলো।
চিত্রালীর সংবাদটি ছিল১ –

জাগো হুয়া সাভেরার নতুন সম্মান লাভ
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক এ. জে. কারদারের একমাত্র সম্পূর্ণ কাহিনিচিত্র জাগো হুয়া সাভেরা – যেটি তিনি বছর ছয়েক আগে তৈরি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে – ১৯৫৯ সালে মস্কোতে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল – এ খবর কারো অজানা নয়। … ফ্রান্সে প্রতিবছর মহিলা বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ‘ফেমিনিন ডার সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল’-এ গ্রান্ড প্রিন্স পুরস্কারের জন্য সম্প্রতি রানারআপ হয়েছে এ. জে. কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা। ওই উৎসবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি লাভ করেন আলবার্ট ল্যামোরিসে, তাঁর ফিফি লা ফ্লুম ছবির জন্য। উল্লেখ্য, ফ্রান্সে ব্যবসাভিত্তিক প্রদর্শনের জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত পাকিস্তানি ছবি এটিই প্রথম।
জাগো হুয়া সাভেরাই একমাত্র পাকিস্তানি ছবি, যা এ যাবত বিশ্বের প্রধান প্রধান চিত্র উৎসবগুলো থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছে।
মস্কো ছাড়াও বোস্টন আন্তর্জাতিক উৎসব থেকে ১৯৬১ সালে স্বর্ণপদক পেয়েছে ছবিটি। এছাড়া ডেনিশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (১৯৫৯), ফ্ল্যাহার্টি ফিল্ম সেমিনার (১৯৫৯) এবং মিলান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৬২-৬৩) ছবিটি স্পেশাল মেন্শান লাভ করেছে।
১৯৬৫ সালের ১৮ মার্চ এই অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল। উদ্বোধন করেছিলেন বিচারপতি বি. এ সিদ্দিকী। ১৯৬৫ সালের ২৩ মার্চ সংখ্যা বেগমে ১৯ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত এই উৎসব চলার সংবাদ পাওয়া যায়। এগারোটি দেশের ছায়াছবি এগারো দিনে প্রদর্শিত হওয়ার সংবাদও এতে ছাপা হয়েছিল। সেইসঙ্গে দেশগুলো, ছবির নাম এবং প্রতি দেশের একটি করে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের বিষয় এতে উল্লেখ করা হয়। ছবিগুলোর যে-তালিকা বেগম ছেপেছিল তা ছিল এরকম –
১. গণচীন : নিউ ইয়ার্স স্যাক্রিফাইস
২. ইরান : সোয়ালোজ রিটার্ন টু দেয়ার নেস্ট
৩. সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) : হ্যামলেট
৪. তুরস্ক : বিটার লাইফ
৫. পোল্যান্ড : কানাল
৬. জাপান : প্রেসিপিস
৭. চেকোশেস্নাভাকিয়া : জাভরাত
৮. ফ্রান্স : হিরোশিমা মুন আমুর
৯. সিংহল : রেকাভা
১০. ভারত : মহানগর
১১. ব্রাজিল : গড অ্যান্ড ডেভিল ইন দ্য ল্যান্ড অব সান

চলচ্চিত্র-উৎসব প্রসঙ্গে ফজল শাহাবুদ্দিন জানান২ –
দেশের প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে সবার মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। উদ্যাপন কমিটির সেক্রেটারি ছিলাম আমি। সভাপতি সম্ভবত পাকিস্তানের একজন ছিলেন। জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন এসএম পারভেজ। উৎসব উপলক্ষে একটা কাজ হয়েছিল। বলাকায় ছবিগুলো প্রদর্শনীর স্থান নির্ধারণ হলেও সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমরা তখন ঢাকার ডিসি এম কে আনোয়ারকে৩ বললাম বলাকার সামনের ফাঁকা জায়গাটা পার্কিংয়ের জন্য দিয়ে দিতে। সেই থেকে ওই সরকারি জায়গাটা হল কর্তৃপক্ষ পেল এবং পরবর্তী সময়ে তা স্থায়ীভাবে বলাকা সিনেমা হলের মালিকানায় এসে যায়।
চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভুট্টো৪ ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি এফডিসিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই একই অনুষ্ঠানে খুব চমৎকার একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন আহমেদ জামান চৌধুরী।৫
চলচ্চিত্র-উৎসব আয়োজন-সংক্রান্ত সংবাদ বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা বলতে তখন প্রধানত চিত্রালীকেই বোঝানো হতো। এই চিত্রালীতে উৎসববিষয়ক অনেক সংবাদ সেসময় ছাপা হয়েছিল, যা এখন ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। এমন কিছু সংবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। চলচ্চিত্র উৎসবের বৎসরাধিককাল আগে চিত্রালী লিখেছিল৬ –

ঢাকায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন এই উৎসবের আয়োজন করেছেন বলে প্রকাশ।
উৎসবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছবি প্রদর্শিত হবে। উৎসবে যোগদানকারী দেশসমূহ হচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, মিসর ও ভারত। অন্যান্য দু’একটি দেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে চিত্রালীতে প্রকাশিত সংবাদে ঢাকায় সে-বছর মার্চে দশ দিনব্যাপী উৎসব আয়োজনের সংবাদ এবং উৎসবের স্থান হিসেবে লাহোর, ঢাকা ও করাচির নাম জানা যায়। তবে তারিখটি ঠিক ছিল না। সংবাদটি ছিল এরকম৭ –
পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব : ৫ই মার্চ থেকে ঢাকাতে শুরু হচ্ছে
(স্টাফ রিপোর্টার)
আগামী ৫ই মার্চ থেকে পাকিস্তানের বহু প্রতীক্ষিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ঢাকাতে উদ্বোধিত হচ্ছে। পাকিস্তান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সর্বশেষে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ-তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আগামী ফেব্রম্নয়ারির ১৫ তারিখ লাহোরে শুরু হচ্ছে। বিশ্বের দশটি দেশের দশটি স্মরণীয় চিত্রকীর্তি উৎসবে প্রদর্শিত হবে। লাহোরের পর ঢাকাতে দশ দিনের জন্য উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকার অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর করাচি হবে উৎসবের তৃতীয় কেন্দ্র। আগামী ২১শে মার্চ থেকে দশ দিনের জন্য করাচিতে চিত্রোৎসব স্থায়ী হবে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব শুরুর পর এর বিস্তারিত তথ্যাদিসহ বেগম ২৩ মার্চ, ১৯৬৫ সংখ্যায় যে-সংবাদ প্রতিবেদন ছেপেছিল তা এখানে হুবহু উদ্ধৃত হলো৮ –

ঢাকায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
গত ১৮ই মার্চ ঢাকার বলাকা চিত্রগৃহে প্রথম পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। বিচারপতি জনাব বি.এ সিদ্দিকী আনুষ্ঠানিকভাবে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
১৯ মার্চ থেকে ২৯শে মার্চ পর্যন্ত এগারো দিনব্যাপী এ উৎসব উপলক্ষে এগারোটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের চলচ্চিত্রসমূহ প্রদর্শিত হবে। পাকিস্তান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রথম পর্যায়ে এ চিত্রউৎসব গত ২৬ শে ফেব্রম্নয়ারি থেকে এগারো দিনব্যাপী লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের উৎসব অনুষ্ঠিত হবে করাচীতে।
এ উৎসবে প্রদর্শনের জন্যে একটি করে প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে প্রতিটি রাষ্ট্র একটি করে কাহিনীচিত্র পাঠিয়েছেন। ছবিগুলো হচেছ – গণচীনের ‘নিউ ইয়ার্স স্যাক্রিফাইস’, ইরানের ‘সোয়ালোজ রিটার্ন টু দেয়ার নেস্ট’, সোভিয়েট রাশিয়ার ‘হ্যামলেট’, তুরস্কের ‘বিটার লাইফ’, পোল্যান্ডের ‘কানাল’, জাপানের ‘প্রেসিপিস’, চেকোশেস্নাভাকিয়ার ‘জাভরাত’, ফ্রান্সের ‘হিরোশিমা মুন আমুর’, সিংহলের ‘রেকাভা’, ভারতের ‘মহানগর’ এবং ব্রাজিলের ‘গড অ্যান্ড ডেভিল ইন দ্য ল্যান্ড অব সান’। সিংহলের ছবিটি ছাড়া লাহোর উৎসবে এ-ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। লাহোর উৎসবে সিংহল যে-ছবি পাঠিয়েছিল তার নাম ‘স্টার অব ভিনাস’।
ঢাকার এ উৎসবে যোগদানের জন্যে তিনজন সদস্যবিশিষ্ট একটি চীনা প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। এ দলে রয়েছেন দলের নেতা মি. লি মু (পিকিং ফিল্ম স্টুডিওর ভাইস প্রেসিডেন্ট), জনপ্রিয় অভিনেতা মি. চ্যাং লিয়া এবং তাদের দোভাষী হিসেবে মি. চৌ তনার লিও।
পাকিস্তান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জেনারেল সেক্রেটারি মি. ফারেদুন, গভর্নিং বডির স্থায়ী সদস্য বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি জনাব ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রমুখও উৎসব উপলক্ষে ঢাকায় আগমন করেছেন।
উপরোক্ত প্রতিবেদনটি যথেষ্ট গোছানো ও তথ্যে সমৃদ্ধ। বেগমের একই সংখ্যায় ‘পাকিস্তানে প্রথম চলচ্চিত্র মেলা’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় যা এখানে উদ্ধৃত হলো৯ –

পাকিস্তানে প্রথম চলচ্চিত্র মেলা
প্রযোজক-পরিচালক জনাব সালাহউদ্দীন জানিয়েছেন যে, আগামী মে মাসের ১৪ তারিখ থেকে ঢাকায় এক সপ্তাহকালব্যাপী পাকিস্তান চলচ্চিত্র মেলা ও সাংস্কৃতিক সেমিনারের আয়োজন করা হবে।
এই মেলায় পাকিস্তানে ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যে সকল ছবি মুক্তি পেয়েছে তার মধ্য থেকে ছয়টি করে মোট ১২টি ছবি প্রদর্শিত হবে। সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, কলাকুশলীদের পুরস্কৃত করা হবে।
মেলায় শিল্প ও সাংস্কৃতিক সেনিমারও অনুষ্ঠিত হবে। সেমিনারে চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর নানা প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা করা হবে।
এ মেলা উপলক্ষে সুধী মহলে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া জেগেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বহু শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক এবং বিদেশি বহু শিল্পীও মেলায় যোগদান করবেন বলে জানা গেছে।
প্রকাশ, পাকিস্তানে এটিই প্রথম চলচ্চিত্র মেলা।
পূর্ব পাকিস্তান প্রযোজক সমিতি এবং চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের যৌথ প্রচেষ্টায় এ মেলা অনুষ্ঠিত হবে।

প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব উপলক্ষে চিত্রালী একটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। সংখ্যাটি বেরিয়েছিল ১৯৬৫ সালের ১৯ মার্চ তারিখে। এই সংখ্যার একটি বিশেষ নামও ছিল – ‘প্রথম পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা।’ সেই সংখ্যায় চিত্রালী লিখেছিল১০ –

প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু
(স্টাফ রিপোর্টার)
ঢাকা, ১৮ই মার্চ বৃহস্পতিবার – আজ রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকার বলাকা চিত্রগৃহে প্রথম পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। বিচারপতি জনাব বি.এ সিদ্দিকী আনুষ্ঠানিকভাবে এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন।
পাকিস্তান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জেনারেল সেক্রেটারি মি. ফারেদুন, গভর্নিং বডির স্থায়ী সদস্য বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি জনাব ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রভৃতিও উৎসব উপলক্ষে ঢাকায় আগমন করেছেন।
পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি (পূর্বাঞ্চল শাখা) ও ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের উদ্যোগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে চলচ্চিত্র-উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় ১৯৬৫ সালের ১৩ আগস্টের চিত্রালীতে। সংবাদে উৎসবটি সাতদিন স্থায়ী হয়েছিল বলে জানা যায়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনয়েম খানের উৎসব উদ্বোধন এবং বিচারপতি এস. এম মোর্শেদের পুরস্কার বিতরণ সভায় সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। তবে গভর্নরের পক্ষে দেওয়ান আবদুল বাসেত এর উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২টি ছবি এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিল। এই উৎসবে সারা পাকিস্তানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিল কাঁচের দেয়াল ছবিটি। জহির রায়হান হয়েছিলেন পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সুমিতা দেবী হয়েছিলেন যুগ্মভাবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত সংবাদটি প্রথম রোমান্টিক জুটিবিষয়ক অধ্যায়ে সন্নিবেশিত রয়েছে। চলচ্চিত্র উৎসবের তথ্য দিয়ে আজিজ মিসির চিত্রালীতে তখন যে-নিবন্ধটি লিখেছিলেন তার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত হলো১১ –
আজ ৬ই আগস্ট। সাত দিনব্যাপী পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করা হবে আজই। পাকিস্তান চলচ্চিত্রে এ দিনটি নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। সাত দিনব্যাপী উৎসবের জন্য ফলশ্রম্নতি স্বরূপ হয়তো পাকিস্তান চলচ্চিত্র মানচিত্রের রূপ ও রেখায় বৈপস্নবিক পরিবর্তন আসবে। দেশের উভয় অংশে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলির (নির্বাচিত ১২টি ছবি) বিচার মূল্যায়ন, পুরস্কার প্রদান ও চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যাবলী আলোচনা করার উদ্দেশ্যেই এ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

এসব চলচ্চিত্র-উৎসবই পরবর্তীকালের অন্যসব চলচ্চিত্র-উৎসবের পথিকৃৎ। এ-সংক্রান্ত সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণার অভাবের কারণেই পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অনেক অনাকাঙিক্ষত বিভ্রামিত্মর সূচনা হয়েছে। আশা করা যায় যে, গবেষক-ইতিহাসবিদ ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা এ-আলোচনা থেকে উপকৃত হবেন।

তথ্যপঞ্জি ও টীকা

১. চিত্রালী, ১৩ আগস্ট ১৯৬৫, প্রথম পৃষ্ঠা।
২. সাক্ষাৎকার : ফজল শাহাবুদ্দিন, ৩ এপ্রিল ২০০৪।
৩. বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।
৪. সিন্ধুর লারকানার জমিদার পরিবারের সমত্মান জুলফিকার আলি ভুট্টো। তখন আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি ও গণহত্যার জন্য দায়ীদের অন্যতম। সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়াউল হক কর্তৃক কথিত খুনের মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
৫. চিত্রালীর সাবেক সম্পাদক, দেশের শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র সাংবাদিক। আজাচৌ নামে বহু নিবন্ধ, সমালোচনা লিখেছেন।
৬. পুরনো পাতা থেকে, চিত্রালী, ৩০ মার্চ ১৯৭৯।
৭. চিত্রালী, ৮ জানুয়ারি ১৯৬৫, প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ।
৮. ছায়াছবির কথা, পাকিস্তান দিবস সংখ্যা বেগম।
৯. প্রাগুক্ত।
১০. চিত্রালী, ১৯ মার্চ ১৯৬৫, প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ।
১১. পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব – আজিজ মিসির, চিত্রালী, ৬ আগস্ট ১৯৬৫।