শহীদ কাদরীর কবিতায় বাড়ি ফেরার তাড়না

তোমার ঐ হাতের শিরায় এখনো বইছে এক
অন্তর্লীন শিল্পের আগুন!
(‘স্মৃতি-বিস্মৃতি’, শহীদ কাদরী)

অনেকেই বলেছেন শহীদ কাদরী বিরলপ্রজ কবি। নাগরিক কবি অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করার প্রয়াসও পেয়েছেন অনেকে। নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রসরমাণ এক আধুনিক মানুষ ও কবি। বাংলা কবিতা তাঁর কাছে পেয়েছে অনেক কিছুই। অনেকেই তাঁর রচনার স্বল্পতার কথা বারংবার সামনে এনেছেন। সংখ্যাধিক্যের বাহুল্যে কাব্যমান বা কাব্যের অন্তর্নিহিত নির্যাস বিচার করা চলে না। একেবারেই স্বল্পসংখ্যক কবিতা লিখে নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলেছেন এমন দৃষ্টান্তও আমাদের সামনে রয়েছে। ১৯৯২ সালে কবি শহীদ কাদরীর তিনটি কবিতার বই উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ও কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই নিয়ে একত্রে শহীদ কাদরীর কবিতা নামে একটি কবিতা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির শুরুতে ‘প্রকাশকের নিবেদন’ শিরোনামে ভূমিকায় বিজ্ঞজন প্রকাশক মফিদুল হক লিখেছেন, ‘বাংলা কবিতার অতি সাম্প্রতিক সৃষ্টি-প্রাচুর্যের ভিড়ে তাঁকে কেউ খুঁজে পাবেন না। অথচ সাতচল্লিশ-উত্তর কবিতাধারায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সঞ্চারিত করে কবিতার রূপবদলের যাঁরা ছিলেন কারিগর, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে, ঝলমলে বিশ্ব-নাগরিকতা বোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে তিনি যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাবন করে পরমুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন দূর দিগন্তের নিভৃত নির্জনতার কোলে।’
যাঁরা শহীদ কাদরীকে খুব ভালো করে পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন, পণ্ডিতজন মফিদুল হকের লেখা প্রতিটি শব্দ কত স্পষ্ট করে কবি শহীদ কাদরীকে চিনিয়ে দেয়! তিনি বিশ্বনাগরিকতা বোধসম্পন্ন আধুনিক কবি ছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি শুধু নাগরিক কবি ছিলেন না। বাংলার নিসর্গ তাঁর কবিতায় শব্দ ও বাণীর ঐশ্বর্যে, বর্ণনার নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে অন্য মাত্রা পেয়েছে। হীরের কারখানার মাপজোখে, চাহিদামতো কেটে, নিক্তিতে ওজন করিয়ে অলংকারে হীরে বসানোর মতো করে শব্দ বসিয়ে গেছেন কবিতায়। স্বাদেশিকতা ও মানবিকতা প্রবল ধ্বনি তোলে তাঁর কবিতায়।
তিনি বেশি লেখেননি। অনেকেই বলেছেন, তাঁর স্বদেশ থেকে দূরে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা এবং কিডনির অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়া কম লেখার কারণ। নিজের জবানিতে তাঁর জীবনের গল্প শোনা এবং তাঁর কবিতা বারবার পড়ে আমার অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম। শুরু থেকেই কম লিখেছেন। ভেবে-চিন্তে, যত্ন করে লিখেছেন। শুরু থেকেই জেনে-বুঝেই তিনি কম লিখেছেন। তাঁর গ্রন্থের প্রকাশকালের দিকে তাকালে আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথম সংকলন উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে, পঁচিশ বছর বয়সে। আট বছর সময় নিয়ে দ্বিতীয় গ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমার প্রকাশকাল ১৯৭৪। চার বছর পর ১৯৭৮ সালে প্রকাশ পায় তাঁর
তৃতীয় গ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এরপর দেশত্যাগ। জার্মানি ও ইংল্যান্ডে প্রবাসজীবন পার করে তিনি আবার স্বদেশে ফিরে যান। কিন্তু দেশে থিতু হননি, হতে পারেননি। এরপর তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। বস্টন ও নিউইয়র্ক মিলে লম্বা তাঁর প্রবাসজীবন। দেশে ফেরার ব্যাকুলতা থাকলেও ফেরেননি। ফিরতে পারেননি। অসুস্থতা তাকে বেঁধে রেখেছিল, ফিরতে দেয়নি। ফিরেছেন একেবারেই কফিনে নিজেকে মুড়িয়ে। অসুস্থাবস্থায় ২০০৯ সালে বন্ধু লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের আন্তরিক পীড়াপীড়ি ও আগ্রহে প্রকাশ পায় আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও।
যতদূর জানা যায় (তাঁর কাছ থেকেই শোনা, তিনি লিখে যত্ন করে রাখতেন না। সংরক্ষণে আগ্রহী ছিলেন না, হারিয়ে ফেলতেন। কবিবন্ধুরাই নিজ নিজ উদ্যোগে নিজের কাছে রাখতেন অথবা সংগ্রহ করে দিতেন, বা নিজেরাই পত্রিকায় পাঠাতেন) তিনি পড়ায় যত আগ্রহী ছিলেন, লেখার বেলায় ততটা একেবারেই ছিলেন না। প্রচুর পড়েছেন, বিশ্বসাহিত্য তাঁর মগজে ঠাসা ছিল। বড়ভাই শাহেদ কাদরীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তাঁর পাঠ্য ও সংগৃহীত বই তো ছিলই, তিনি নিজেও কিনতেন, সংগ্রহ করতেন এবং পড়তেন। পড়াশোনার আগ্রহ ও নেশার কারণেই যে তাঁর লেখালেখি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা তিনি কম লিখেছেন এমনটি নয়। তাঁর কবিতাগুলো বারংবার পড়ে এবং নিজের জীবনস্বভাব ও অভ্যাস সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে যা জেনেছি তাতে আমার মনে হয়েছে, তিনি জীবনের বিষয়গত ভাবনার দিকে, বাস্তব জীবনবোধ সম্পর্কে অনেকটাই উদাসীন ছিলেন। তার বড় প্রমাণ তিনি পেশাগত জীবনে দিকবদল করেছেন বারবার, কিন্তু কোনো পেশাতেই থিতু হতে পারেননি। তিনি অস্থিরতায় ভুগেছেন। তাঁর কবিমনের ভেতরে আরো এক বাউন্ডুলে উদাসীন মন বাস করেছে আজীবন। উন্মূল এক মন-মানসিকতা তাঁকে অস্থির করে রেখেছে। তাঁর যে-স্বদেশভাবনা, তার পুরোটাতেই জুড়ে আছে বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা দেখি, তিনি শৈশবের কলকাতা, পার্ক সার্কাস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্রিটিশ সৈন্য, বস্ন্যাকআউট, গোলা-কামান এসবকেও ভুলে যেতে পারেননি, যেমন পারেননি বাবার স্মৃতি, সুইস চকলেট টফির কথাও। কোনো মুহূর্তেই বোধ করি ভুলে থাকেননি বিউটি বোর্ডিং, রেকস, পুরনো ঢাকার অলিগলি, কৈশোরের, টগবগে যৌবনের বন্ধুদের স্মৃতি। আজীবন তিনি খুঁজে বেরিয়েছেন শামিত্মর নিবাস। কবিতা থেকে কবিতায় দেখি তাঁর বাড়ি ফেরার তাড়না। এ-বাড়ি খোঁজার অর্থ মানসিক আশ্রয় খোঁজা। শামিত্মর অন্বেষা। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা গ্রন্থে ‘বস্ন্যাক আউটের পূর্ণিমায়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন –
আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিলো নিদারুণ নির্বিকার
সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধক সে হলো সহায়,
বস্ন্যাক আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে
বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি :
আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হ’য়ে
নিজেদের ঘরে।
যদিও তিনি এ-চিত্র এঁকেছিলেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধশেষে নিজেদের ঘরে ফেরার। কিন্তু আমাদের খেয়াল করতে হবে এই চিত্রের ভেতরের চিত্র। লক্ষ করতে হবে এর ভাষাভঙ্গি ও শব্দ-প্রয়োগের দিকে।
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত উত্তরাধিকার গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘অগ্রজের উত্তর’ কবিতায় আমরা পিতৃপ্রতিম বড় ভাইয়ের উদ্বেগ লক্ষ করি। কী অপরিসীম মমত্ব নিয়ে, বাৎসল্যভরা হৃদয়ের আকুতি শুনতে পাই কবিতাটির পঙ্ক্তিগুলোতে!
না, শহীদ সে-তো নেই; গোধূলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না।
… … …
কিন্তু মধ্য-রাত্রির সশব্দ কড়া তার রুক্ষ হাতের নড়ায়
(যেন দুঃসংবাদ – নিতান্ত জরুরী) আমাকে অর্ধেক স্বপ্ন থেকে
দুঃস্বপ্নে জাগিয়ে দিয়ে, তারপর যেন মর্মাহতের মতন
এমন চিৎকার ক’রে ‘‘ভাই, ভাই, ভাই’’ ব’লে ডাকে;
মনে পড়ে সেবার দার্জিলিঙের সে কি পিছল রাসত্মার কথা,
একটি অচেনা লোক ওরকম ডেকে-ডেকে-ডেকে খসে পড়ে
গিয়েছিল হাজার-হাজার ফিট নিচে!
সভয়ে দরোজা খুলি – এভাবে দেখা পাই তার – মাঝরাতে;

উপমাটি লক্ষ করি, মধ্যরাতে বাসায় ফিরে ভাইকে অর্ধেক স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে জাগিয়ে দিয়ে ভাই ভাই বলে এমন চিৎকার শুরু করে যে, সেই চিৎকার বড়ভাইকে মনে করিয়ে দেয় দার্জিলিংয়ের পিছল রাসত্মায় একটি অচেনা লোকের হাজার ফুট নিচে পড়ে যাওয়ার সময় তার আর্তচিৎকারের কথা। (এরকম উপমার প্রয়োগ কবিতায় শহীদ কাদরীই করতে পারেন) চিন্তা করা যায়, শরীরে কাঁটা দেয়!
এই যে উদাসী কবি ছোটভাইয়ের জন্য বড়ভাইয়ের উৎকণ্ঠা, শহীদ কাদরী এটা জেনেবুঝেই করতেন। হয়তো তাঁর জন্য ভাইয়ের এই মমতা তিনি সানন্দে উপভোগ করতেন। আসলে তিনি নির্ভরতা খুঁজতেন। তাঁর বাউন্ডুলে মন তাঁকে ঘরছাড়া রাখতো, কিন্তু তিনি ঘরে ফিরতেই উন্মুখ ছিলেন।
নিজের অন্তর্গত নিঃসঙ্গতার কথা বলেছেন ‘উত্তরাধিকার’ কবিতায় :

  • এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা
    এবং আমাকে নিষ্কপর্দক, নিষ্ক্রিয়, নঞর্থক
    ক’রে রাখে; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা !
    আর আমি শুধু আঁধার নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে রক্তাক্ত জবার মতো
    বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীন চোখে
    প’ড়ে আছি মাঝ রাতে কম্পমান কম্পাসের মতো
    অনিদ্রায়।
    তিনি তুখোড় আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। সাহিত্য-আড্ডা তো বটেই, যে-কোনো আড্ডারই তিনি হয়ে উঠতেন মধ্যমণি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছিলেন বড় বেশি একা, বড় নিঃসঙ্গ। ‘এই শীতে’ কবিতায় তাঁকে উচ্চারণ করতে শুনি –
    আমি শুধু
    একাকী সবার জরার মুখোমুখি।

এবং আরো একজনের চোখে দেখি
লক্ষ সূর্যের আসা-যাওয়া এবং সেও একা
আমারই আত্মার মত
প্রাঙ্গণের তরুণ কুকুর।
তিনি মানসিক আশ্রয় খুঁজেছেন। ঘরের আবদ্ধ আবিষ্ট সুখের প্রত্যাশা করতেন তিনি।
ভালোবাসা চেয়েছেন আজীবন। ঘরের নিরাপত্তার বেষ্টনীতে নিজেকে বাঁধতে চেয়েছেন। তাই তিনি বারবার ভালোবেসেছেন। ভালোবেসে ঘর বেঁধেছেন। প্রথম প্রেম, প্রথম ঘর টেকেনি। নাজমুন নেসা পিয়ারী ও শহীদ কাদরীর মাঝখানে বন্ধন আদনান কাদরী। তা সত্ত্বেও দুজনে সমঝোতায় ঘর ভেঙে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এসে একসময় ডেরা বাঁধেন আমেরিকান ডিনার সঙ্গে। ডিনার অকালমৃত্যুতে তার শেষ হয়। তাঁর অসুস্থ অসহায় জীবনের অনেকখানি সহায় হয়ে উঠেছিলেন নীরা। নীরার সাহচর্যে আবার তাঁর সাহিত্যবলয়ের জীবনবৃত্ত গড়ে ওঠে। কিন্তু নীরার চোখের জল স্থায়ী ছবি আঁকে শহীদ নামের ভালোবাসার চিরবিদায়ে।
আজন্ম ভ্রাম্যমাণ জ্ঞানের পথিক, বাউন্ডুলে শহীদ ঘরকেই আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। নিজের দেশেই থাকতে চেয়েছিলেন। স্বদেশ, নিসর্গ, প্রাণের বন্ধুরা আর পড়াশোনা ও কবিতাকেই সঙ্গী করে থাকতে চেয়েছেন। তাই তো দেখি তিনি কবিবন্ধু রফিক আজাদকে উৎসর্গ করে লিখছেন ‘নিসর্গের নুন’ কবিতা :
ন্যুইয়র্কে নির্বাসনে যদিও অমিয় চক্রবর্তী তবুও তো’ পেয়েছেন
কবিতার উজ্জ্বল অমল ডালাপালা
আর ক্ষিপ্ত মিসিসিপির গাজনে যমুনার উচ্ছল ভজন,
ভল্গা-গঙ্গার ধারে ধারে
হে নিসর্গ, হে প্রকৃতি, হে সুচিত্রা মিত্র
হে লঙ-প্লেয়িং রেকর্ডের গান
হে বিব্রত বুড়ো-আংলা, তুমি গীত-বিতান আমার!

ইচ্ছে ছিলো কেবল তোমার নুন খেয়ে আজীবন
গুণ গেয়ে যাবো
অথচ কদ্দিন পরে বারান্দা পেরিয়ে
দাঁড়িয়েছি ঝোপে
ধারালো বটির মতো কোপ মেরে
কেন যে, কেন যে
দ্বিখ–ত করছে না
এখনও সুতীক্ষন বাঁকা
ঐ বঙ্গদেশীয় চাঁদ
শহীদ কাদরী ঘরের বাইরের জীবনকে দেখেছিলেন একজন
প্রকৃত ভবঘুরের চোখে। তাঁর চোখে মনে ঘরের বাইরের জীবন (হতে পারে সে মানুষ, নিসর্গ, রাসত্মা, প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা, বাতাস-বৃষ্টি, টেলিগ্রাফের তার, শালিক, কাঁঠালপাতা, মটরশুঁটির ক্ষেত)। সেজন্যেই ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে কত তুচ্ছ, আর কত সূক্ষ্ম বিষয়!
রাজত্ব, রাজত্ব শুধু আজ রাতে, রাজপথে-পথে
বাউ-ুলে আর লক্ষ্মীছাড়াদের, উন্মূল, উদ্বাস্ত্ত
বালকের, আজীবন ভিক্ষুকের, চোর আর অর্ধ-উন্মাদের
বৃষ্টিতে রাজত্ব আজ। রাজস্ব আদায় করে যারা,
চিরকাল গুণে নিয়ে যায়, তারা সব অসহায়
পালিয়েছে ভয়ে।
বন্দনা ধরেছে, – গান গাইছে সহর্ষে
উৎফুলস্ন আঁধার প্রেক্ষাগৃহ আর দেয়ালের মাতাল পস্ন্যাকার্ড,
বাঁকাচোরা টেলিফোন – পোল, দোল খাচ্ছে ওই উঁচু
শিখরে আসীন, উড়ে-আসা বুড়োসুড়ো পুরোন সাইনবোর্ড
তাল দিচ্ছে শহরের বেশুমার খড়খড়ি
কেননা সিপাই, সান্ত্রী আর রাজস্ব আদায়কারী ছিল যারা,
পালিয়েছে ভয়ে।
আজীবন বন্ধু-সঙ্গলিপ্সু বন্ধুদের খুঁজে বেরিয়েছেন মনে মনে। ‘বন্ধুদের চোখ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন –
ইদানীং আমার বন্ধুদের চোখ, আমার বন্ধুদের চোখ ইদানীং
চোখে-চোখে রাখে শুধু চোখে চোখে ঈগলচক্ষু বন্ধুরা আমার
আর আমি ঠাঠা রৌদ্রে ঠাটারীবাজার মাত করে চঞ্চল চোখের
কালো চকচকে চোখে ঝুলছি বাসি-মাংস ইদানীং
চোখে চোখে ঠাঠা রৌদ্রে ঠাটারীবাজারে কাৎ হ’য়ে
বাসি মাংস ইদানীং প’ড়ে আছি বন্ধুদের ঈগলচক্ষু চোখের
ভেতরে চোখে –
দীর্ঘদিন পরে তাঁর নিউইয়র্কবাসের প্রবাসজীবনে ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ কবিতা-সংকলন (নীরাকে উৎসর্গকৃত) আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাওতে এসে দেখি তাঁর স্বদেশ থেকে দূরে
থাকার যন্ত্রণা বেড়ে গেছে অনেকখানি। তাঁর মনোভূমে বাস করছে ঘরে ফেরার তাড়না। একবুক কষ্ট নিয়ে তিনি কালো কাককে জিজ্ঞেস করছেন, কোত্থেকে সে এই বর্ণবাদী দেশে এলো যেখানে অশ্বেতাঙ্গদের কোনো মূল্য নেই।
চড়ুইপাখিকে বাংলা শেখাচ্ছেন, ইলিশের কথা, গীতবিতানের কথা বলছেন। গ্রন্থটির কবিতায় কবিতায় স্বদেশ ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা, ঘরে ফেরার টান! ‘তাই এই দীর্ঘ পরবাস’ কবিতায় তিনি এমনকি পরবাস মেনে দেশ ছেড়ে যাবার কৈফিয়ত তুলে ধরেছেন। ‘প্রবাসের পঙ্ক্তিমালা’, ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর’ কবিতাগুলোর পঙ্ক্তিগুলো কান্না আর লুকানো আর্তনাদ।
‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কবিতাটির শেষের কটি চরণ :
আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেঁচে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।
‘সব নদী ঘরে ফেরে’ কবিতায় কবি শহীদ কাদরীর ঘরে ফেরার আর্তনাদ আছড়ে পড়ে।
বৃষ্টিশেষের সন্ধ্যাবেলায় এই যে আমি একা একাই
গাছতলাতে দাঁড়িয়ে আছি।
তোমার মতন আমি কি ভাই বলতে পারি –
‘যাচ্ছি বাড়ি’।
… … …
তোমার আমার প্রিয় কবি কোথায় যেন বলেছিলেন –
সব পাখিরা ঘরে ফেরে,
সব নদী।
আমরা কেন দ-ায়মান
গাছতলাতে নিরবধি।
কীর্তিনাশার কালোস্রোতে
নৌকো ভাসে সারি সারি
এবার আমি বলতে পারি
যাচ্ছি বাড়ি।
যাচ্ছি বাড়ি।
কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতায় তিনি ফিরে আসার অঙ্গীকার করেছিলেন। নদীর ওপারে সর্ষে ও মটরশুঁটির ক্ষেতে, তরমুজ ক্ষেতের ওপারে ফিরতে চেয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন, ‘দাঁড়াও আমি আসছি।’
জীবনভর তিনি বাড়ি ফিরতে চেয়েছেন। শামিত্মর পরশ পেতে চেয়েছেন। আশ্রয় খুঁজে ফিরেছেন। পরম নির্ভরতার সন্ধান করে ফিরেছেন। মনে মনে হাতড়ে বেরিয়েছেন তাঁকে। কে তিনি? কার বিয়োগব্যথা তাঁকে অমন করে ঘরের বাহিরে রেখেছিল?
তাঁর প্রকাশিত চতুর্থ গ্রন্থের (আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও) শেষ কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় আমরা তার ইঙ্গিত পাই –
আমার মতন ভ্রাম্যমাণ এক বিহবল মানুষ
ঘরের দিকেই
ফিরতে চাইবে
হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে সুস্থ
সহজ এবং স্বাভাবিক।
আমার নিজস্ব ঘরে প্রতিষ্ঠিত হব বলেই
আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েছিলাম একদা
আমার আজন্ম-চেনা গৃহচ্ছায়া থেকে –
আমার প্রথম কৈশোরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরে।
… … …
আমি ভ্রাম্যমাণ
কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঘরের দিকেই – পদব্রজে,
হামাগুড়ি দিয়ে, গিরগিটি বা সাপের মতো
বুকে হেঁটে হেঁটে
কিমাশ্চর্য!
যতোবার আমি ঘরের নিকটবর্তী হই
কুয়াশা আক্রান্ত সেই বারান্দায় রয়েছে দাঁড়ানো আজো
একটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি – একদা কৈশোরে
যে আমাকে জানিয়েছিলো বিদায়, সেই ছায়ামূর্তি
আজো, এখনো, আমাকে লক্ষ্য করে উড়িয়ে চলেছে একটি বিদায়ী রুমাল।