বেকার দিনের দায়

কেদারুর এক হাতে গরুর দড়ি, অন্য হাতে গরু খেদানোর চিকন লাঠি, ঠোঁটে জ্বলন্ত বিড়ি এবং ঘাড়ে বছরচারেকের নাতি, যার হাত দুটি পেঁচিয়ে রেখেছে কেদারুর কাঁচা-পাকা চুলের মাথাটা। পাকা রাসত্মায় তিন প্রাণীর অভিন্ন লক্ষ্য ছুটে চলা দেখে পড়শি এক গেরস্ত জানতে চায়, ‘দুইটাকে নিয়া যাইস কই কেদারু?’
ঠোঁটের বিড়ি প্যান্টিধরা হাতে নিয়ে কেদারু জবাব দেয়, ‘ঢাকা যামো ভাই। নাতি কাঁদন জুড়ছে, বাপ-মায়ের কাছে যাইবে। গ্রামে তো এলা কামলার কাম নাই। সেইজন্য বিল্টু নানিকে বুদ্ধি দেয়, ঢাকা গিয়া হামরা দুইজনেই গারমেন্টের চাকরি নেমো। ঠিক না, বিল্টু?’
বিল্টু নানার মাথায় চাটি দিয়ে বলে, ‘হয়, হনহনায় চল।’
খালি গায়ে কেদারুর নাতি, গরুসহ ঢাকাযাত্রা দেখে পড়শি সহাস্য মন্তব্য করে, ‘যা, তোর গরুটাকেও গরমেন্টের একটা চাকরি নিয়া দিস। মোটাতাজা করি বেচলে মেলা টাকা পাবি।’
লোকের কথা শুনে বিল্টু যেন আকাশ থেকে নানার মাথায় ভেঙে পড়ে, ‘ও নানা, গরু কি বাসে উঠতে পারবে?’
কেদারু ধরা পড়ার খুশিতেও ভাবে, নাতির বড় চোখা বুদ্ধি। সে নিজে ঢাকা যায়নি সত্য, কিন্তু বিল্টু বাবা-মায়ের সঙ্গে অন্তত তিনবার যাতায়াত করেছে। কাজেই ঢাকা যাওয়ার বায়না পূরণ করতে নানা তাকে কাঁধে নিয়ে রওনা দিলে হয়তো বিশ্বাস জেগেছিল, নানার খালি গা দেখেও বিশ্বাসটা নষ্ট হয়নি; কিন্তু গরুটাকে দেখে সন্দেহ জাগছে। সন্দেহ দূর করতে বলে কেদারু, ‘দামড়াটার ঠ্যাং বাঁধিয়া বাসের ছাদে তুলি দেমো। গরু দেখিয়া তোর বাপ-মাও খুশি হইবে।’
বিল্টু আশ্বস্ত হয়ে বলে, ‘বাসের ছাদে চড়িয়া হামরাও গরুর দড়ি ধরি বসি থাকমো নানা। না হইলে শালা লাফ দেবে।’
বয়স কম, বাইরে বেরোলেই তাই বাছুরটা ছুটে চলতে চায়। রাসত্মা ছেড়ে পাশের ডগমগে সবুজ ধানক্ষেতে ছুটতে চাইলে দড়ি টেনে ধরে কেদারু, মুখের শাসন যথেষ্ট না হলে বিড়ি ঠোঁটে নিয়ে হাতের প্যান্টি তোলে।
বিল্টু বলে, ‘ও নানা, বিড়িটা মোকে দিয়া ডাঙাও ওটাকে।’
‘দূর পাগলা, বিড়ি খাওয়ার বয়স হইছে তোর! তার চাইতে ফোনটা হাতে নে তুই।’
ঢাকা থেকে মেয়ের জরুরি ফোন পাওয়ার আশায় সেটা কাছছাড়া করেনি, বাইরে বেরোনোর সময় কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গুঁজে নিয়েছে কেদারু। বিল্টুর হাতে দিলে টেপাটেপি করে নষ্ট করতে পারে। তারপরও ফোন দেওয়ার প্রসত্মাব করে আসলে তার ঢাকা যাওয়ার বায়না ভোলাতে। কিন্তু বিল্টু তার বায়নায় অটল থাকতেই বলে, ‘মোবাইলে মায়ের সাথে আর কথা না কইম মুই। বাসে চড়িয়া আগে ঢাকা চলো।’
‘বাসস্ট্যান্ড তো মেলা দূর, তার আগে মিলিটারির দোকানে যায়য়া চা-বিস্কুট খাইলে কেমন হয় বিল্টু? চল, তোকে এলায় একটা চিপসও কিনি দিম।’
চিপসের প্রসত্মাবে কখনোই আপত্তি নেই বিল্টুর। খুশি হয়ে জবাব দেয়, ‘ঠিক আছে। লাল ঠোঙার চিপস কিনবু কিন্তু।’
গন্তব্য পালটাতে রাজি হয়েছে যখন, চিপস পেলে ঢাকা যাওয়ার বায়নাও ভোলানো যাবে। চা-পান খেয়ে গরুটাসহ বিলের ধারে যাবে। ঘাস-পানা খেয়ে গরুরও পেট ভরবে। আর পাথারে নাতির সঙ্গে খোশগল্প ও খেলাধুলা করেই বেকার দিনটা আজ কাটাবে কেদারু। কিন্তু রজব মিলিটারির দোকানে যাওয়ার কথা ভাবলে হাঁটার গতি কমে আসে, হাস্য-পরিহাসের মেজাজটাও চুপসে যায়। তওবা করেছিল কেদারু, বাকির টাকা শোধ না হলে মিলিটারির দোকানে যাবে না আর। বাকির খাতায় কেদারুর নামে তিন হাজার সাতশো চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে, আদায়ের জন্য মিলিটারি পারলে তাকে গুলি করে, এমনই পাগলা কুত্তা-মেজাজ হয়েছে তার। মিলিটারির কথা মনে হলে কেদারুর মেজাজও তাই বিগড়ে যায়।
চাকরি করে মিলিটারি বন্দুক নিয়ে কোথায় কী যুদ্ধ করেছে কেউ জানে না। কিন্তু রিটেয়ার করে পেনশনের টাকায় বাড়ির সামনে মুদিদোকান দিয়েছে। গ্রামবাসীর টাকা খসাতে মিলিটারি হয়েছে মহাজন, আর সাইনবোর্ড ছাড়াই দোকানের নাম হয়েছে মিলিটারির দোকান। হরেক মালে দোকান ভরেছে, চা বেচে, তার ওপর ডিশটিভিও ফিট করেছে। গ্রামবাসীর কাছে মিলিটারির দোকান এখন অবসর বিনোদনেরও বড় জায়গা। কিন্তু গত এক সপ্তাহ টিভি দেখতেও মিলিটারির দোকানে উঁকি দেয়নি কেদারু।
এই সময়টায় গাঁয়ের চাষি-মজুরদের মাঝে বেকার শুধু কেদারু নয়, ধান রোয়ার কাজ শেষ হওয়ার পর যথারীতি বেকার হয়েছে গাঁয়ের সব কামলাই। এদের কয়েকজন দোকানে বসে চা-পানের সঙ্গে গুলতানি মারছে। পরিচিত ভিড়ে শরিক হওয়ার জন্য আজ দোকানের সামনে এসেও নাতিকে ঘাড় থেকে নামায় না কেদারু। মিলিটারি দোকানে দাঁড়ানো দুজন কাস্টমার বিদায়ে ব্যস্ত, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বেঞ্চিতে বসা একজনকে বলে সে, ‘ও সলেমন দেখ তো, দামড়াটা হাটে তুললে কত দাম হইবে রে?’
‘পনেরো হাজার হইতে পারে, তা এখন বেচবি কেন? মোটাতাজা করিয়া কোরবানি ঈদে না বেচবি কইলি।’
‘না বেচলে নাতিকে চকলেট-চিপস-বিস্কুট খাওয়াই কী দিয়া? মিলিটারির দোকানের বাকি শোধ করতে হইবে।’
‘কেন কেদারুভাই, নাতিকে নানার ঘাড়ত দিছে যারা ঢাকা হইতে তারা কি টাকা পাঠায় না?’
গত মাসে মেয়ের পাঠানো টাকা পেয়েও কেদারু দোকানের পাওনাটা শোধ করেনি, মিথ্যে বলেছিল, সেই মিথ্যেটাকে আঁকড়ে ধরে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জামাই হামার আন্দোলন করিয়া গারমেন্টের চাকরি হারাইছে। মেয়ের গারমেন্টস কারখানাতেও বেতন বাড়ানোর আন্দোলন হইতেছে। ও মিলিটারি, টিভিতে গারমেন্টসের নতুন খবর কিছু কয় নাই?’
টিভি বন্ধ রেখে রজব মিলিটারি এখন নগদ পয়সার খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত, কেদারু কিংবা তার হাতের পনেরো হাজার টাকার সম্পদের দিকে ভ্রম্নক্ষেপ করে না। কেদারু গরুটাকে রাসত্মার পাশে এক গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে নাতিকেও ঘাড় থেকে নামায়। উপস্থিত লোকজনকে সাক্ষী রেখে মিলিটারি মহাজনকে শুনিয়ে বলে, ‘বেটি যদি এই সপ্তাহে টাকা বিকাশ না করে, সামনের হাটে এই গরু বেচে দোকানের বাকি-বকেয়া শোধ করি দেবো ইনশালস্নাহ।’
বিল্টু দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিপসের প্যাকেট দেখায়, ‘এটা না, ওটা, না না ওই নালটা নে হে।’
ছোটদের মন ভোলাতে মিলিটারি নানারকম প্যাকেট দোকানে ঝুলিয়ে রেখেছে, বয়ামের মধ্যেও আছে রকমারি বিস্কুট-চকলেট। মিলিটারি অবাঞ্ছিত ক্রেতার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় না। কেদারু মহাজনকে শোনাতেই নাতিকে বলে, ‘ওই চিপসের বদলে পাওরুটি দিয়া চা খাই আগে, তোর চিপসের দাম দিতে এই হাটেই গরু তুলিম, দাও মিলিটারি একটা চা দাও।’
চায়ের আদেশ দিয়ে আকালু দোকানে ঝোলানো দশ টাকার পাউরুটি ছিঁড়তে গেলে খেঁকিয়ে ওঠে মিলিটারি, ‘খবরদার! আলস্নাহ কি শরম-হায়া জিনিসটা তোর মধ্যে একদম দেয় নাই বাহে?’
রজব মিলিটারি দোকানে উপস্থিত খদ্দেরদের বিচারকের মর্যাদা দিয়ে নালিশ জানায়, ‘সেদিন আলস্নার কিড়া কাটিয়া দুইদিনের মধ্যে টাকা শোধের কথা কয়া গেলি। নগদ টাকা নিয়া বাজার গিয়া সদাইপাতি কিনি আনিস, আর চায়ের নেশায় মিলিটারির দোকানে আসছিস ফের বাকি খাইতে? আমি কি নোঙরখানা খুলছি তোর জন্যে?’
‘কাম পাইলে দিনে পাঁচশো টাকাও রুজি করি, কাম জুটলে তোমার বাকি তিন-চার হাজার টাকা শুধতে কয়দিন লাগবে?’
‘তোর কামের আশায় বসি থাকব আমি? গরু বেচে হউক, আর মেয়ে-জামাইকে বেচে দিয়াই হউক, এই হাটের মধ্যে টাকা না পাইলে কঠিন ব্যবস্থা নেব আমি। যা, তোর বাকির খাতা চিরতরে বন্ধ হইছে।’
নাতির চিপস কিনতে কেদারু গরু বেচার কথাটা বলেছিল ঠাট্টা করে, কিন্তু মিলিটারি পারলে এখনই যেন তার গরু কেড়ে নেবে। ওদিকে চিপস না পেয়ে বিল্টু নানার হাত টানতে শুরু করেছে, বাড়িতে যেমন ঢাকা যাওয়ার জন্য বায়না জুড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল, চিপসের জন্যও সেই অস্ত্র প্রয়োগ করবে নির্ঘাৎ। মিলিটারির সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে নাতির কান্নার বাঁধ ভাঙতে চায় না কেদারু, আদুরে গলায় বলে, ‘বিল্টু সোনা, তোর মিলিটারি চাচা যে বাকি চিপস দেয় না! এক দৌড়ে বাড়ি যা, তোর নানির কাছ থেকে চিপসের দশ টাকা আদায় করিয়া আন।’
বিল্টু নানির কাছে যাওয়ার জন্য বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। মিলিটারির জন্য গরু বিসর্জন দেওয়ার মতো উদারতা দেখিয়ে কেদারুর চায়ের সঙ্গে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটাও প্রবল হয়েছিল। বিল্টুকে একটা চিপসের প্যাকেট দিয়ে নিজে পানবিড়ি মুখে নিয়ে গরুসহ বিলের ধারে গেলে নানা-নাতির দিনটা আজ ভালোই কাটত। কিন্তু মিলিটারি মহাজনের ব্যবহারে মেজাজটা এমন খিচড়ে ওঠে যে, এক লাফে দোকানে উঠে লোকটার কোমরে একটা গোলকিক দিয়ে দোকানটা ল-ভ- করে দিতে পারলে উচিত কাজ হয়।
বিল্টু কেঁদেকেটে নানির কাছে দশ টাকা আদায় করবে ঠিকই, তারপর টাকা নিয়ে দোকানেও একা ফিরে এসে চিপস কিনতে পারবে। নানাকে দোকানে না দেখলে ঢাকায় মায়ের কাছে যাওয়ার বায়নাও ভুলে যাবে। কেদারু তাই গাছে বাঁধা গরুর দড়ি হাতে নিয়ে মিলিটারির উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, ‘দোকান চালুর পর হইতে মোর কামলার দাম, মেয়েজামাইয়ের গারমেন্টের রোজগার দিয়া কত টাকা তবিলে ভরছেন, সে হিসাব আছে? এলায় গরুর উপর চোখ পড়ছে? গরু দিয়া তোমার লাভের তবিল ভরে দিম, আইসেন গরু নিতে।’
‘কানাকে চ্যাট দেখানোর মতো ফের গরু দেখাইস? পাওনা শোধ করিয়া বড় কথা বলিস।’
উপস্থিত ক্রেতা-খদ্দেররা কেদারুর পক্ষে, নাকি মিলিটারির সমর্থনে হাস্যরসের জোগান দেয়, বোঝার চেষ্টা করে না আর। হাতের লাঠি মিলিটারির উদ্দেশে গরুর পিঠে পড়লে, গরুর সঙ্গে নিজেও ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে সিদ্ধান্ত নেয় সে, মেয়ে টাকা পাঠালেও মিলিটারির পাওনা শোধ করবে না সে, পাওনা আদায়ের জন্য মিলিটারি যদি সত্যর গরুই দড়ি ধরে টানাটানি করে, তা হলে অতি অবশ্যই কেদারুর পা মাটির বদলে মিলিটারির কোমরেই ধপাধপ পড়বে।
মেঠো রাসত্মায় নেমে, রাসত্মার দুবলা ঘাসে গরু মুখ নামালে কেদারু তাকে বিলের ধারে ছোটানোর জন্য হাতের প্যান্টি তোলে না। মিলিটারি তাকে চা-রুটি খাওয়ার তৃপ্তি দেয়নি, কিন্তু অবলা জীবের খাওয়ার সুখ নষ্ট করতে চায় না কেদারু। দড়ি ধরে রাসত্মার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
দোকানে যাওয়ার জন্য সম্ভবত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে জয়নাল, কাছাকাছি হয়ে জানতে চায়, ‘ও কেদারুভাই, সবাই প্রায় কামের ধান্ধায় গ্রাম ছাড়িল, তুই গেলু না এবার?’
‘কেমনে যাই রে জয়নাল। বেটি-জামাই ঘাড়ত একটা দিয়া গেছে, তা বাদে এই দামড়া কিনি দিয়া গেইছে পোষার জন্য। পনেরো হাজার টাকার মাল হইতে না হইতেই এটার উপরে চোখ পড়ছে কত শকুনের! মুই গ্রামছাড়া হইলে তোর ভাবি একলা সামলাইতে পারবে?’
‘তোর আর চিন্তা কী কেদারুভাই! বেটিজামাই দুইজনে গারমেন্টের চাকরি করে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। এই দামড়াও তোর চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার মাল হইল প্রায়। এমনি কি আর মিলিটারি হাজার হাজার টাকা বাকি দেয়ার জন্য খাতা খুলি বসি আছে।’
‘হয়, মিলিটারির দোকান থাকি বাকিতে চা-রুটি খায়া আসনু রে! তুইও যা, মোর নাম করি তুই চা খা এক কাপ, মোর কথা কইলেই এলা বাকি দেবে, যা।’
ঠাট্টাকেও সত্যি ভেবে জয়নাল হাসে, চা অফারের জন্য হাসিতে কৃতজ্ঞতা-ধন্যবাদ ঝরায়, কিন্তু কেদারুর জ্বালাটা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না। মিলিটারির দোকান আর তার ফালতু খদ্দেরদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে কেদারু গরু নিয়ে বিলের দিকে হাঁটতে থাকে।
একা মিলিটারি নয়, গ্রামবাসী সকলেরই চোখ পড়েছে তার দামড়াটার ওপর। চাষাবাদের সঙ্গে লাঙল-বলদের সম্পর্ক গত হয়েছে। গরুগাড়িও অচল, ঘানি টানা কি ধান মাড়াইয়ের কামেও গরু লাগে না আর। গরুর ওপর তবু মহববত কমেনি কোনো গেরস্ত-চাষির। সাদা ভাতের ’পরে গাইয়ের দুধের মতো অমূল্য ধবধবে সাদা খাদ্য দুনিয়ায় আর কী আছে? তার ওপর কেদারুর দামড়া দেখেও হয়তো কষা মাংস খাওয়ার কথা ভেবে অভাবী মানুষগুলোর মুখে লোল গড়ায়। গরুটা নিয়ে প্রান্তরে এলেও যেমন অতীতের নানা সুখস্মৃতি মনে পড়ে কেদারুর।
এই প্রান্তরের অসংখ্য আইলঘেরা জমির মধ্যে কেদারুর নিজের এক টুকরা জমিও নেই। তবু একান্ত আপন মনে হয় ডগমগ ধানক্ষেতের এই সবুজ ভূঁইবাড়ি। কারণ লাঙলের মুঠো ধরে গরুর পিছে হাঁটতে হাঁটতে এই প্রান্তরেই নিজের কৃষিজীবন শুরু করেছিল কেদারু কৈশোরেই। এখনো প্রতিবছর কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে শরীরের ঘাম ঝরায় বলে প্রান্তরের ভূঁইবাড়িতে এত ফসল ফলে। হাজার বছর ধরে চাষাবাদের কাজে গরুই ছিল মানুষের বড় সহায়। কলের লাঙল এসে গরুকে বেকার করেছে মাত্র কিছুদিন আগে। প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কৃষিকামেও ডিজেলখেকো ও কারেন্টে চলা নানান যন্ত্রপাতি আসছে বলে গতরখাটা কামলাদের চাহিদাও কমে যাচ্ছে। গেল ধানকাটা-মারাই মৌসুমে চুক্তির কামে দিনে পাঁচশো টাকাও রুজি করেছে কেদারু। আগামী ধানকাটা-মাড়াইয়ের কামও নাকি ক্ষেতের মধ্যে মেশিন দিয়েই সারবে বড় গেরস্তরা। তার মানে বেকারত্ব বাড়বে কামলাদের। অন্যদের মতো ভ্যান চালানো কি কামের ধান্ধায় দূরান্তে যেতে পারবে না কেদারু। এটা আগাম বুঝেই কি মিলিটারি বকেয়া আদায়ের জন্যে কেদারুর প্রধান সম্পদ একমাত্র গরুটা দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে?
নিজস্ব জমিজমা নেই যেসব মজুর-চাষির, অন্তত একটা দুধেল গাই কিংবা এঁড়ে বাছুর পোষার স্বপ্ন দেখে তারাও। কারণ দুধ বেচলে রোজ নগদ টাকা আসে। বকনা বাছুর কিনে মোটাতাজা করে কোরবানি ঈদে বেচলে লাভ হয়। বেশি লাভের আশায় মুরগির ফার্ম যেমন, তেমনি গরুর ফার্মও হয়েছে গ্রামে। কেদারুর বউ বারো মাসই হাঁস-মুরগি পালে, ঘরে পোষা ছাগলও বংশবিসত্মার ঘটিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু বউয়ের ছাগল, হাঁস-মুরগি বেচেও এমন তহবিল হয় না যে, কেদারু গরু পোষার শখ মেটায়। মেয়ে বাছুর কিনতে দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। ফোনে বাছুরের রংচেহারার বয়ান শুনে হাসিমুখে স্বপ্ন দেখিয়েছে আরো, বকনাটা পুষে পঞ্চাশ হাজার টাকার মাল করতে পারে যদি, ততদিনে মেয়ে বাপকে আরো পঞ্চাশ হাজার দেবে, যাতে এক লাখ টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য দু-শতক মাটি কিনতে পারে কেদারু। জমি না কিনলেও এক দোন জমি বন্ধক নিতে পারলেও মেয়ের টাকা জমিতে বাঁধা থাকবে, আর বন্ধকী জমিতে চাষাবাদ করে আবাদি ধানের ভাত খেতে পারবে কেদারু।
বিলের ধারে একটি আইলে ঘাসের সন্ধান পেয়ে দামড়াটি গাপুসগুপুস খেতে শুরু করলে, কেদারুও তাকে খাওয়ার সুযোগ দিতে দড়ি ধরে আইলের ওপরই বসে পড়ে। গরুর খাওয়া দেখে নিজের বেকারত্ব সান্তবনা পায় অনেকটা। না জুটুক কাজ, গরুটাকেও নিয়মিত খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলতে পারে যদি, সেটাও কি কম বড় কাজ হবে? লুঙ্গির টেক থেকে বিড়ি-ম্যাচ বের করে কেদারু। বিড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে মন আবার মেয়ের কাছে ছুটে যায়। মেয়ে খারাপ খবর দিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়াতে চায় না বলেই হয়তো শেষবার বলেছিল, ভালো কোনো খবর হলেই ফোন করবে। আর ভালো খবর শোনার অপেক্ষায় ফোনটাকে সঙ্গে রেখে শরীরেরই অঙ্গ করে ফেলেছে কেদারু, বিষফোঁড়ার মতো যা এখন কোমরে ফুটে আছে। ভালো খবর এলেই খুশিতে জ্বলে উঠবে আর বাদ্য বাজাবে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে বিকাশে টাকা আসার খবর আসার সময় ফোনটা যেভাবে বাজে এবং জ্বলে, তার স্মৃতি স্মরণ করলেও মনটা চাঙ্গা হয়।
মন খুশি করার কোনো খবর দেওয়ার বদলে মোবাইলটা বেশ কিছুদিন ধরে কেবল খারাপ খবর দিয়ে গেছে। জামাইয়ের গার্মেন্টস কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়ে জামাই এখন স্ত্রীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। নতুন চাকরি পায়নি। ওদিকে মেয়ে আশুলিয়ায় যে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে, সেখানেও বেতন বাড়ানোর দাবিতে শুরু হয়েছে আন্দোলন। টিভিতে নিজের চোখে দেখেছে কেদারু, গার্মেন্টসকর্মীর আন্দোলন দেখে রাসত্মায় গাড়িঘোড়া দূরে থাক, পুলিশ পর্যন্ত ঢাল-তরোয়াল নিয়েও ভয়ে ভয়ে চলে। হাজার হাজার গার্মেন্টস লেবারের মধ্যে নিজের মেয়েকেও খুঁজেছে কেদারু। টানা কয়েকদিন টিভিতে আন্দোলন দেখার সুযোগ পেলে মেয়েকেও এক ঝলক দেখতে পেত হয়তোবা; কিন্তু বাকির খাতা বন্ধ করে মিলিটারি কেদারুর টিভি দেখাও বন্ধ করেছে। কেদারু অবশ্য বাজারে গিয়েও টিভি দেখে এবং মানুষের মুখে মুখেও গ্রামের শত শত গার্মেন্টস শ্রমিকের খবর জানতে পারে। কিন্তু খারাপ খবর জানার জন্য বাজারে যাওয়ার ইচ্ছে হয় না। ভালো খবর কিছু ঘটেনি বলেই হয়তো মেয়ে আর ফোন করেনি। এদিকে এইটুকু বিল্টু, তার রক্তেও হয়তো খবর বাজে, রক্তদাতা বাপ-মা ভালো নেই। সেই জন্যই হয়তো বিল্টু আজ মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না জুড়েছিল।
বিলের ধারে নির্জনে বসে সঙ্গীটির গোগ্রাসে খাওয়া দেখে আর নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে কেদারু। ভাবনার মধ্যে বিল্টুর ছায়া পড়তে না পড়তেই নারীকণ্ঠের চিৎকারে তার নাম শুনে চমকে ওঠে সে। বিল্টু ডাকের উৎস খুঁজতে গিয়ে
যে- নারীমূর্তিকে বিলের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, মুখ না দেখেও তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না কেদারুর। নাতিকে খুঁজতে বিলের দিকে এগিয়ে আসছে কেন বিল্টুর নানি? বিল্টু তার কাছে চিপসের টাকা আদায় করতে পারেনি?
কেদারুও চেঁচিয়ে স্ত্রীকে নিজের অবস্থান জানান দেয়, ‘চিলস্নায় ক্যানে বেটিছাওয়াটা? বিল্টু না টাকা নিতে তোর কাছে গেল?’
জবাব দিতে জোরপায়ে স্ত্রী এগিয়ে আসে বিলের ধারে। বিল্টু নানার সঙ্গে নেই দেখেও চারপাশে খোঁজে, ‘মোর কাছে দুই টাকা আদায় করিয়া না তোমার কাছে দৌড়ে গেল ফের। কয় যে নানাকে নিয়ে ঢাকা যাইম। দোকানে গিয়া দেখনু বিল্টু নাই। মমিনের সাথে খেলতেও যায় নাই। গেল কোনঠে চ্যাংড়াটা?’
‘দোকানেই গেছে মনে হয় চিপস কিনতে। কিন্তু হারামজাদা মিলিটারি দুই টাকায় কি চিপস দেবে?’
স্ত্রীকে গরুর দড়ি ও মোবাইলটা দিয়ে কেদারু আবার মিলিটারির দোকানের দিকে ছুটতে থাকে।
মিলিটারি দোকানে টিভি চালু করেছে। যাদের দেখে গিয়েছিল কেদারু, তাদের মধ্যে সলেমন ও জয়নাল বসে আছে এখনো। কেদারু সরাসরি ব্যস্ত দোকানদারের কাছে জানতে চায়, ‘বিল্টু ফের দুই টাকা নিয়া তোমার কাছে চিপস নিতে আইসে নাই? দশ টাকার চিপস নাই দেন তো, নগদ দুই টাকায় একটা চকলেট দিলেন না ক্যানে?’
মিলিটারি আবার বাঁকা জবাব দেয়, ‘কাঁয় কখন কী নিতে দোকানে আসে, সেইটা খোঁজ রাখার দায়িত্ব কী মিলিটারির?’
সলেমন জবাব দেয়, ‘ভাবি কইল তোর নাতি বলে মায়ের কাছে যাওয়ার বায়না ধরছে। তারপাছে বা ভ্যানে চড়িয়া একাই ঢাকা রওনা দিলো?’
পাকা রাসত্মা ধরে হরদম টেম্পো-ভ্যান ছুটে চলে। কিন্তু মাত্র দুই টাকার লোভে ঢাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো ভ্যান বা টেম্পো বিল্টুকে তুলে নিয়ে উধাও হয়েছে, বিশ্বাস হতে চায় না। কেদারু মনাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘কী ছাগলের মতো কথা বলিস! এইটুকু মানুষ, নানাকে ছাড়া যে একদ- থাকতে পারে না, আর সে দুই টাকা নিয়া একলা ঢাকা যাইবে! গেল কই চ্যাংড়াটা? ওই বিল্টু-উ-উ!’
কেদারুর উত্তেজিত হাঁকডাকে নাতির হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যখন উপস্থিত সবার মাঝে গুরুত্ব পায়, বিল্টুর বয়সী একটি ছেলে তখন ঠান্ডা গলায় খবরটা দেয়, ‘বিল্টুকে তখন মিলিটারির দিঘির পাড়ে দেখনু। দিঘিতে নামি ডুবি গেইছে মনে হয়।’
মিলিটারি তার পগারটাকেও খুঁড়ে ছোটখাটো যে দিঘি বানিয়েছে, এখনো তাতে বুক পর্যন্ত পানি। গাঁয়ের চ্যাংড়ারা দিঘিতে নেমে লাফাঝাঁপা করে সাঁতার কাটে, কিন্তু বিল্টু সাঁতার জানে না বলে নানাকে ছাড়া কোনো পুকুরেই নামে না কখনো। তারপরও বিল্টুর পুকুরে ডোবার আশঙ্কাটিকে হেলা করে না কেউ। কারণ গত বছরই সরকারের দিঘিতে একটি বাচ্চার ডুবে মরার খবর গাঁয়ে সাড়াজাগানো ঘটনা হয়ে উঠেছিল।
কেদারুই প্রথম এক ছুটে মিলিটারির দিঘিতে যায়। দিঘির পাড়ে কি পানিতেও কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। মিলিটারি তখন বাকিতে চিপসটা দিলে বিল্টু এখনো নানার সঙ্গেই থাকত। মিলিটারির বিরুদ্ধে যে রাগক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, এক্ষণে তা তীব্রতর হয়ে পায়েও ভর করে যেন। মিলিটারিকে লাথি দেওয়ার আক্রোশ নিয়ে দিঘিতে লাফিয়ে পড়ে কেদারু। বিল্টু হারিয়ে গিয়ে বুকে যে হাহাকার, উত্তেজনা এবং ফিরে পাওয়ার আকুলতা, তা এবার দিঘির নিথর পানিতেও তুমুল আলোড়ন জাগায়।