চলচ্চিত্রের ভাষা পাঠ

এক
এক অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেমে। একজন চলচ্চিত্রকার নিজের মনের রঙেই তাঁর চারপাশের পরিবেশ, এমনকি বিশ্বজগৎকেও রাঙিয়ে তুলতে পারেন। একজন কবি অথবা একজন চিত্রশিল্পীর মতোই শিল্পের ভুবনে তাঁর অবাধ স্বাধীনতা। শব্দ-বাক্য অথবা রং-তুলির বিন্যাসের মধ্য দিয়ে একজন কবি বা চিত্রশিল্পী তাঁর ভাবনাকে পাঠক বা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন। ঠিক একইভাবে আলোছায়া আর শব্দ ও সংগীতের মধ্য দিয়ে একজন কুশলী চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্রের পর্দায় দৃশ্যকাব্য তৈরি করেন। একজন চলচ্চিত্রকার একাধারে একজন কবি, একজন চিত্রশিল্পী, একজন সংগীতজ্ঞ এবং আরো অনেক কিছু। কারণ কবিতা বা ছবি একান্তই কবি অথবা শিল্পীর হৃদয় ও মননের প্রতিফল; কিন্তু চলচ্চিত্র একসঙ্গে প্রায় সব শিল্পমাধ্যমের সমন্বিত প্রকাশ। এজন্য তার ব্যাপ্তি অনেক বড়। তাই ‘Director’s Media’ নামে পরিচিত চলচ্চিত্রশিল্প অসংখ্য কলাকুশলীর মিলিত প্রয়াস হলেও সেটির কৃতিত্ব একান্তই নির্মাতার। কারণ একজন নির্মাতা যেভাবে তাঁর ভাবনাকে পর্দায় মেলে ধরতে চান, শেষ পর্যন্ত সেভাবেই একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে।
যদি বলি, কী নেই চলচ্চিত্রে? এর এককথায় উত্তর, চলচ্চিত্রে সবই আছে। সাহিত্য, চিত্রশিল্প, সংগীত, অভিনয়, চারু ও কারুশিল্প, সূচিশিল্প – সবই আছে এই বিশেষ শিল্পমাধ্যমে। অর্থাৎ শিল্পের নান্দনিকতার জন্য যেখানে যা প্রয়োজন, চলচ্চিত্র তাকেই আত্মস্থ করেছে। মাঝেমধ্যে বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ব্যাখ্যা দিয়ে তা বোঝা বা বোঝানো সম্ভব নয়। যেমন সংগীতের অপূর্ব সুর-মাধুর্য অবাক হয়েই শুনতে হয়। কোনোভাবে সেই সুরের সাংগীতিক ব্যাখ্যা করা গেলেও হৃদয়ঙ্গম করতে হয় হৃদয় দিয়েই। ধরা যাক, গানের বাণীতে যখন ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’ বলা হয়, সংগীত তখন প্রকৃত অর্থেই নিবেদনের অর্ঘ্য হয়ে ওঠে। একইভাবে অসাধারণ কোনো চিত্রকলার সামনে এসে দর্শক যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেন। অবাক বিস্ময়ে কেবল চেয়ে থাকেন। অসাধারণ কোনো কবিতা পাঠ করে গুণমুগ্ধ পাঠক কবিতার ভাবরাজ্যে হারিয়ে যান। এভাবেই যুগ যুগ ধরে যে-কোনো মহৎ শিল্পকর্ম মানুষকে মুগ্ধ করে। আবার অনুপ্রাণিতও করে।
কখনো শিল্পের সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিকে মুগ্ধ করে, আবার কখনো মুগ্ধ করে শ্রম্নতিকে। অর্থাৎ এমন কিছু দৃশ্য বা শব্দতরঙ্গে মুগ্ধ হতে হয়, যা সত্যিই অকল্পনীয়। তবে যে-কোনো শিল্পের সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য প্রাথমিক কিছু ধারণা থাকা অপরিহার্য। অবশ্য অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমের তুলনায় চলচ্চিত্রের রসাস্বাদন একটু ভিন্ন। চলচ্চিত্রের রস উপলব্ধির জন্য একটু বেশি প্রস্ত্ততির প্রয়োজন। অনন্যসাধারণ মেধাবী চলচ্চিত্রকার প্রয়াত আলমগীর কবির সবসময় তাঁর ছাত্রদের বলতেন, চলচ্চিত্র দেখার জন্য চোখ তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রকৃতিদত্ত চোখ থাকলেই কেউ চলচ্চিত্র দেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না। এজন্য অবশ্যই প্রস্ত্ততি প্রয়োজন। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের একটি
উদ্ধৃতি এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ :
চলচ্চিত্র হচ্ছে একটা অত্যন্ত জটিল মাধ্যম। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয়কলা সবকিছুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল মাধ্যম। তাই একটি ছায়াছবির অন্তর্নিহিত রস গ্রহণ করতে হলে সে মাধ্যমটি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে ভাষাটা বোঝা এবং জানা দরকার। চলচ্চিত্রের নিজস্ব কতগুলো ভঙ্গী আছে, সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় থাকা প্রয়োজন। নইলে চলচ্চিত্রের রস গ্রহণ সম্ভবপর নয়।
অন্য যে-কোনো শিল্পের তুলনায় চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে একটি জটিল মাধ্যম। তাই চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের অবশ্যই এই মাধ্যমটি সম্পর্কে বিশেষ প্রস্ত্ততি এবং ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই প্রস্ত্ততি চলচ্চিত্রের দর্শকদের বেলায়ও প্রযোজ্য। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন :
ছবি করবার সময়েই আমি ধরে নিই যে দর্শকের সমস্যা থাকবেই। অর্থাৎ সব দর্শকের আমার ছবি ভালো লাগবে না। অনেকেই বাতিল করবেন, বাকিরা গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই বাতিল করতে বা গ্রহণ করতে, শিল্পসম্মত কায়দায় বাতিল করতে বা শিল্পসম্মত কায়দায় গ্রহণ করতে, আমার বিশেষ নির্বাচিত (ডিস্ক্রিমিনেটিং) দর্শক দরকার হবে। এবং এই দর্শক ক্রমেই বাড়বে। তার প্রমাণ এখনই পাওয়া যায়।

দুই
চলচ্চিত্রের ভাষা মূলত ছবি, ধ্বনি বা শব্দের সমন্বিত রূপ। এজন্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিত্রনাট্যের ভাষা এমন হতে হবে, যা দেখা কিংবা উপলব্ধি করা সম্ভব। সাহিত্যের সঙ্গে চিত্রনাট্যের এখানেই মৌলিক পার্থক্য। সাহিত্য যখন পাঠককে ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, চিত্রনাট্য তখন সরাসরি দৃশ্যটি চোখের সামনে মেলে ধরে। এভাবেই সাহিত্য থেকে বিশ্বখ্যাত অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেভিড ডবিস্নউ গ্রিফিথ (D. W. Griffith) নির্মাণ করেছিলেন তাঁর কালজয়ী ছবি The Birth of a Nation (১৯১৪)। অবশ্য তখন ছবিটির নাম ছিল The Clansman। লেখক Dixon-এর অনুরোধে পরে ছবির নাম পালটানো হয়। পৌনে তিন ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের এই ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে এক হাজার ৩৭৫টি শটে। অর্থাৎ এক হাজার ৩৭৫টি চিত্রের সমন্বয়ে পুরো ছবিটি নির্মিত হয়েছে। এ যেন অজস্র ফুল দিয়ে একটি সম্পূর্ণ মালা গাঁথা। চলচ্চিত্রে প্রতিটি শট যেন একটি করে ফুল, কিন্তু ফুলগুলো ভিন্ন। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তাই বিভিন্ন ফুলের সমাহারে যথার্থভাবে মালাটি গেঁথে তোলাই এখানে আসল। চলচ্চিত্রে এটিই চিত্রনাট্য। চলচ্চিত্রকার গ্রিফিথের এই ছবির চিত্রনাট্যের একটি অংশকে এভাবে দেখানো যেতে পারে :

শট-১ Full Shot লিংকনের দলবল। এক-এক করে তারা থিয়েটারের সর্বোচ্চ সিঁড়িতে ওঠেন এবং ঘুরে প্রেসিডেন্টের জন্য বিশেষ কক্ষক্ষ প্রবেশ করেন। লিংকনের দেহরক্ষীকে দেখা যায় সর্বাগ্রে এবং সর্বশেষে প্রেসিডেন্ট লিংকন স্বয়ং।
শট-২ থিয়েটারের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া প্রেসিডেন্ট কক্ষ। প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা কক্ষক্ষ প্রবেশ করেন।
শট-৩ Full Shot প্রেসিডেন্ট লিংকন কক্ষের বাইরে নিজের টুপি খুলে পরিচালকের হাতে দিলেন।
শট-৪ প্রেসিডেন্ট কক্ষ। কক্ষক্ষ লিংকন প্রবেশ করেন।
শট-৫ Mid Shot বেঞ্জামিন এবং এলসি অডিটরিয়ামে বসে আছেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টের কক্ষের দিকে তাকান এবং উচ্ছ্বসিত হাততালি দিতে দিতে উঠে দাঁড়ান।
শট-৬ অডিটরিয়ামের দিক থেকে। প্রেসিডেন্ট কক্ষ ফ্রেমের ডানদিকে। দর্শকরা Back to Camera-এ দাঁড়ানো অবস্থায় হাততালি দিয়ে লিংকনকে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন।
শট-৭ প্রেসিডেন্ট কক্ষ। লিংকন এবং মিসেস লিংকন সামনের দিকে নুয়ে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করেন।
শট-৮ শট ৬-এর অনুরূপ।
শট-৯ প্রেসিডেন্ট কক্ষ। অভিবাদন গ্রহণশেষে লিংকন আসন গ্রহণ করেন।

নিজের দেশের দিকে চোখ ফেরাই। আবু ইসহাকের কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার মসিহউদ্দিন শাকের এবং শেখ নিয়ামত আলী নির্মাণ করেছেন সূর্যদীঘল বাড়ী (১৯৭৯)। সরকারি অনুদানে নির্মিত সাদা-কালো এই ছবির দৈর্ঘ্য বারো হাজার ৩৮৭ ফুট। নানাভাবে নন্দিত এ-ছবির প্রথম দৃশ্যের চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে এভাবে :

শট-১
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ Insert of a Card-এ তুলে ধরা হলো।
শট-২
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেস্নন উড়ছে এবং বোমাবর্ষণ করছে। নিচে ট্যাঙ্কবাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে।
শট-৩
গোডাউনে সত্মূপীকৃত বসত্মা। ব্যবসায়ীরা খাদ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য খাদ্যশস্য অন্যায়ভাবে মজুদ করে রেখেছে।
শট-৪
স্টিল : জয়নুল আবেদিনের পেইন্টিং।
ক. পঞ্চাশের মন্বন্তরের বিখ্যাত স্কেচসহ আরো দুটি স্কেচ।
খ. স্থির আলোকচিত্র : অনশনক্লিষ্ট মা ও তার শিশু এবং আরো কয়েকটি দুর্ভিক্ষের স্থিরচিত্র।
শট-৫
একটি উড়ন্ত শকুন।
শট-৬
টাইটেল দৃশ্য।
শট-৭
জয়গুন ফুটপাতের এক দেয়ালে ঘুঁটে তৈরির জন্য গোবর দিচ্ছে। সে কী যেন ভাবছে। বসিত্মর মন্বন্তরক্লিষ্ট নর-নারীর সঙ্গে জয়গুনরা বাস করছে। হঠাৎ তার মনে ঢেঁকির শব্দ ভেসে আসে। অর্থাৎ গ্রাম তাকে ডাকছে। কারণ পৌষ-মাঘ মাসের ধানের মৌসুম তাকে হাতছানি দেয়।
চলচ্চিত্র এমনই একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে রয়েছে দৃষ্টি আর শ্রম্নতির নিবিড় মেলবন্ধন। চলচ্চিত্রের সেই আদি যুগে, ফরাসি দেশে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় (Louis Lumiere এবং Auguste Lumiere) থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির খোলা দরজা পেরিয়েও চলচ্চিত্রশিল্প মানুষকে মুগ্ধ করে চলেছে। এখনো কোনো কালজয়ী চলচ্চিত্রের কথা মনে করে দর্শক সেই চলচ্চিত্রের বিশেষ কোনো দৃশ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। এই যে মুগ্ধতা এবং নিজেকে হারিয়ে ফেলা – তা একমাত্র সৃজনশীল শিল্পের জন্যই সম্ভব। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগে চলমান দৃশ্য দেখে মানুষ যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি খুশিও হয়েছে। একটি অভাবনীয় কা- মানুষ তখন নিজের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় ঘটতে দেখেছে। এই দেখার মধ্যে কৌতূহলের পাশাপাশি অপার বিস্ময়ও ছিল। এরপর চলচ্চিত্রে আসে সবাক যুগ। পর্দায় চলমান মানুষের ছবিগুলো এবার সত্যি সত্যিই যেন কথা বলে উঠল। এবং এর আরো পরে আসে রঙিন চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্র এসে মানুষের চৈতন্যের প্রায় সবটাই যেন দখল করে নেয়। কারণ চলচ্চিত্র এমনই সর্বগ্রাসী একটি মাধ্যম, যেখানে শিল্পকলার প্রতিটি শাখা উপস্থিত। অবশ্য নাটক, চিত্রকলা, সংগীত ইত্যাদির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রশিল্প সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। যেন শিল্পের সব রসাধার থেকে রস আহরণ করে এক পরিপূর্ণ মাধ্যম।
সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক অতিনিবিড়। কারণ বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মহৎ সাহিত্যকর্ম চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় চিত্রায়িত হয়েছে। ইতালির বিশিষ্ট লেখক লুইগি বার্তোলিনি (Luigi Bartolini) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রোম শহরে এক দরিদ্র পিতা ও তার পুত্রের চুরি হয়ে যাওয়া সাইকেল অনুসন্ধানের একটি মর্মস্পর্শী গল্প রচনা করেছিলেন। পরে সে-দেশের অন্যতম চলচ্চিত্রকার ভিত্তোরিও দে সিকা (Vittorio De Sica) গল্পটি অবলম্বনে নির্মাণ করেন কালজয়ী চলচ্চিত্র The Bicycle Thief (১৯৪৮)। যদিও ছবিটি ইতালির একজন সাহিত্যিকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত, কিন্তু সেই চলচ্চিত্রের কৃতিত্ব অবশ্যই নির্মাতা ভিত্তোরিও দে সিকার। এটাও ঠিক যে, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের প্রায়োগিক ভাষা তৈরি হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে অন্যতম কৃতী নির্মাতা শেখ নিয়ামত আলীর একটি অভিমত বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে
পারে :
প্রতি দশকে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রে জন্ম নিচ্ছে এমন সব প্রয়োগ ভাষা, যেগুলো বাস্তবিকই এ শিল্পকে দিন দিন জীবন্ত ও সৃজনশীল করে চলছে। কিন্তু এটাও সত্য, আজ যেটা উৎকৃষ্ট প্রয়োগ ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা গুরুত্ব পাচ্ছে – হয়তো, আগামী দশকে সে ভাষার প্রয়োগে ততটুকু উৎকর্ষ খুঁজে না পাবার জন্য তা কম গুরুত্ব সহকারে ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি চিরস্মরণীয় নাম। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালী অবলম্বনে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৭) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) নামে ত্রয়ী বা ‘ট্রিলজি’ চলচ্চিত্র। এককথায় এই ছবিগুলো অসাধারণ। বাংলা সাহিত্যের ভা-ারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম নিঃসন্দেহে অমূল্য সম্পদ। তাঁর সাহিত্য অবলম্বনে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলোও বাংলা চলচ্চিত্র ভা-ারের অসাধারণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে চিরকাল। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলা যায় যে, প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের প্রকাশভঙ্গি আলাদা। সাহিত্যে পথের পাঁচালীতে যেভাবে গল্প বর্ণনা করা হয়েছে, চলচ্চিত্রে সেভাবে বলা হয়নি। সেভাবে বলা যায়ও না। কারণ সাহিত্যের ভাষা চলচ্চিত্রের ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দুটি মাধ্যমও ভিন্ন। দুটি মাধ্যমের প্রায়োগিক নমুনা হিসেবে একটি অংশ তুলে ধরা যেতে পারে। উপন্যাসে দৃশ্যটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে :
দেশের স্টেশনে নামিয়া বৈকালের দিকে সে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে আসিয়া পৌঁছিল। পথে বড় একটা কাহারও সহিত দেখা হইল না, দেখা হইলেও সে হনহন করিয়া উদ্বিগ্নচিত্তে কাহারও দিকে বিশেষ লক্ষ্য না করিয়া বাড়ির দিকে চলিল। দরজায় ঢুকিতে ঢুকিতে আপনমনে বলিল – উঃ দ্যাখো কা-খানা, বাঁশঝাড়টা ঝুঁকে পড়েছে একেবারে পাঁচিলের উপর। ভুবনকাকা কাটাবেনও না – মুস্কিল হয়েছে আচ্ছা। – পরে সে বাড়ির উঠানে ঢুকিয়া অভ্যাসমত আগ্রহের সুরে ডাকিল, ওমা দুগ্গা – ও অপু –
তাহার গলার স্বর শুনিয়া সর্বজয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। হরিহর হাসিয়া বলিল – বাড়ির সব ভাল? এরা সব কোথায় গেল? বাড়ি নেই বুঝি?…
উপন্যাসের এ-অংশটুকু বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যে সাজিয়েছিলেন এভাবে :
১.
মেঘলা দিন। হরিহরের ভিটার পেছনের বাঁশবন।
Long Top Shot : দূর থেকে দেখা যায় হরিহর আসছে।
হরিহর : অপু!
২.
মেঘলা দিন। ইন্দিরের দাওয়া।
Close up : হরিহরের গলার স্বর শুনে সর্বজয়ার reaction – গালটা হাত থেকে সামান্য সরে গিয়ে শাঁখাটা আলগা হয়ে একটুখানি নিচের দিকে নেমে এলো।
৩.
মেঘলা দিন। হরিহরের ভিটার দক্ষিণের পাঁচিলের পাশে।
Med Shot : হরিহর এসে থমকে দাঁড়ায়। একটা আমডাল ভেঙে পাঁচিলের ওপর পড়ে তার খানিকটা অংশ ভেঙে দিয়েছে। হরিহর : (স্বগত) ইস, আর ক’টা দিন সবুর সইল না?
হরিহর ডালটা ডিঙিয়ে এগিয়ে আসে – camera সঙ্গে সঙ্গে pan করে।
হরিহর এগিয়ে এসে বাড়ির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তার ভগ্ন কোঠার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর উঠোনের দরজার দিকে ছবির গ–র বাইরে চলে যায়। camera আর pan করে না – ভাঙা পাঁচিলের পেছনে ভাঙা গোয়ালে গরুটা জাবর কাটছে।
তার পেছনে হরিহরের দাওয়া। [নেপথ্যে হরিহরের দরজা খুলে ঢোকার শব্দ]।
কিছুক্ষণ পর হরিহরকে long-এ দেখা গেল তার দাওয়ার সামনে পৌঁছেছে।
সে উদ্বিগ্নভাবে এদিক-ওদিক চায়।
হরিহর : (উদ্বিগ্ন কণ্ঠে) দুর্গা।
সর্বজয়া হরিহরের পাশ দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দাওয়ায় ওঠে।
হরিহর : ওঃ – তুমি আছ?
সর্বজয়া : এসো …
হরিহর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে।

এই যে ভিন্ন দুটি মাধ্যম – সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র, প্রকাশভঙ্গি আলাদা হলেও দুটি মাধ্যম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রকাশরীতিতে কখনো একটি মাধ্যম অপরটিকে অতিক্রম করলেও করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো একটি বিশেষ মাধ্যমকে ছোট করে দেখা বা ভাবার উপায় নেই। এ-কথা ঠিক, চলচ্চিত্রে সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক সুযোগ রয়েছে, যা অন্য কোনো শিল্পের বেলায় সীমিত। এখানে একজন সৃজনশীল নির্মাতা ইচ্ছা করলেই তাঁর বহুমাত্রিক ভাবনার ডানা অনায়াসেই চলচ্চিত্রের পর্দায় মেলে ধরতে পারেন।
অর্থাৎ নির্মাতার ভাবনা এবং কল্পনায় সৃষ্টির অপূর্ব সুযোগ রয়েছে চলচ্চিত্রে। দেশে-বিদেশে এভাবে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। কখনো সাহিত্যের তুলনায় চলচ্চিত্রটিকে মস্নান মনে হয়েছে আবার কখনোবা চলচ্চিত্রের আলোয় নিষ্প্রভ মনে হয়েছে সাহিত্যকর্ম। তবে এটি বিচার্য বিষয় নয়। এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তারপরও দুটি ভিন্ন মাধ্যম স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্যে অনবদ্য।

তিন
চলচ্চিত্রে ধ্বনি বা শব্দের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে রাখা উচিত যে, ধ্বনি বা শব্দ চলচ্চিত্রে ইমেজ থেকে আলাদা কোনো বিষয় নয়; বরং ইমেজের পরিপূরক। ক্যানভাসে আঁকা পেইন্টিংয়ের কোনো ধ্বনি নেই। তারপরও একটি চিত্রকর্ম অনেক ধ্বনির সমাহার। একটি স্থিরচিত্র শব্দ করে কিছু না প্রকাশ করলেও অনেক কথাই বুঝিয়ে দেয়। তেমনি চলচ্চিত্রের প্রতিটি শট চিত্রকর্মের মতোই। এখানে অবশ্য ধ্বনি বা শব্দ ব্যবহারের সুযোগ আছে। কিন্তু তারপরও চলচ্চিত্রের একেকটি ছবি যেন একেকটি বাক্য। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে দর্শক এভাবেই চলচ্চিত্র উপভোগ করেছেন। তবে সবাক চলচ্চিত্রের যুগে দর্শককে চোখ-কান দুটোই খোলা রাখতে হয়। কারণ শুধু শব্দ বা ধ্বনি শুনে চলচ্চিত্রের বিষয় উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এখানে ইমেজটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় শব্দহীন ইমেজও চলচ্চিত্রে অনেক বড় ধ্বনি বা শব্দ ব্যঞ্জনা তৈরি করে, যা ধ্বনি বা শব্দ প্রয়োগে সম্ভব নয়।
এবার বাংলা চলচ্চিত্র এবং বাংলা সংগীতের কথাই না হয় ভাবা যাক। বাংলা সিনেমা যেমন বাঙালির স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, তেমনি বাঙালির বাদ্যযন্ত্রেও আছে নিজস্বতা। পাশ্চাত্যের অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্রের ভিড়ে আজো টিকে আছে বাংলার ঢোল, বাঁশি, খঞ্জনি, একতারা, দোতারা ইত্যাদি। অবশ্য বিদেশি যন্ত্র ব্যবহারেও বাঙালি সুরশিল্পীরা অনাগ্রহী নন। বাংলার সুপ্রাচীন যাত্রাশিল্পে
ঢোল-বাঁশির পাশাপাশি বেহালা, ক্ল্যারিনেট, কর্নেট ইত্যাদি অনেকদিন আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বরেণ্য চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় এ-প্রসঙ্গে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
সঙ্গীতের ব্যঞ্জনা আছে, কিন্তু পরিষ্কার কোন ভাষা নেই। এখানে সাযুজ্যের একটা প্রশ্ন আসে। সব কথায় সুর বসে না। গান সেখানেই সার্থক যেখানে সুর হল ভাষার ব্যঞ্জক। … পথের পাঁচালি ছিল গ্রাম্য পরিবেশের কাহিনী। কিন্তু তা বলে তা লোকসাহিত্য নয়। তার ভাষায়, তার মেজাজে রীতিমত sophistication আছে। তার চরিত্রবর্ণনে আধুনিক মনসত্মাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ আছে। ছবিতেও অনুরূপ sophistication আনবার চেষ্টা করা হয়েছিল। সুতরাং এর আবহসঙ্গীতে কেবল গ্রাম্য যন্ত্রে গ্রাম্য সুর বাজানোর কোন সার্থকতা আছে বলে আমরা মনে করিনি। বাঁশি, গুপিযন্ত্র, ঢোল ইত্যাদির সঙ্গে সেতার, সরোদ, পাখোয়াজ মেশাতে তাই রবিশঙ্কর দ্বিধা করেননি। …
চলচ্চিত্রে সংগীত একটি আবশ্যিক মাধ্যম, এজন্য চলচ্চিত্রের কথা বলতে গিয়ে বারবার সংগীতের কথা এসে যায়। তবে সংগীত কেবলই সুরসমৃদ্ধ বাণীনির্ভর কোনো গান নয়। যে-কোনো বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও সংগীতের অংশ। তাই বাণীনির্ভর গান ছাড়াও চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে; কিন্তু সবাক চলচ্চিত্র-যুগে সংগীতবিহীন চলচ্চিত্রের কথা ভাবা অসম্ভব। যদি বলি, সংগীত কেন অপরিহার্য, এক কথায় এর কোনো উত্তর হতে পারে যে, সংগীত পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতি ও পরিবেশের সবকিছুই ছন্দোবদ্ধ। প্রকৃতির সর্বত্র একটা নির্দিষ্ট রীতি বা ধারার অনুসরণ রয়েছে। এখানে বিশৃঙ্খলার স্থান নেই। তাই বিশৃঙ্খলায় বিপর্যস্ত মানুষকে বারবার প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে বলা হয়। প্রকৃতি শামিত্ম ও স্বসিত্মর আধার। যেখানে শৃঙ্খলা, সেখানেই শামিত্ম। যেহেতু প্রকৃতির সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরাজমান, তাই একমাত্র প্রকৃতিতেই শামিত্ম। শুচিস্নিগ্ধ প্রকৃতিই বিশ্বচরাচরকে শামিত্মর পাঠে উজ্জীবিত করতে পারে। ফার্সি প্রবাদে বলা হয়, ‘তলোয়ার দিয়ে রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু সংগীত দিয়ে শত্র‍ুকে বন্ধু করা যায়।’ পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রবোদ্ধারাও চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রয়োজনের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন :
Music in film can never be ignored discounted. Even when the audience is not consciously aware of it, and even when the music is so low as to seem almost inaudible. Not only is music among the most effective of film making tools, it is among the most flexible, at least when used to create and direct emotions and psychic states of being. Its appeal is non-rational so far as the film audience is concerned…

চার
ফটোগ্রাফি বা চিত্রায়ণ চলচ্চিত্রের মুখ্য ভাষা। অসংখ্য ছবির মেলবন্ধনেই চলচ্চিত্রের ভাষা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নামটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত তাঁর অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১)। ‘গণহত্যা বন্ধ করো’ এই শিরোনাম তুলে ধরে যে-ফটোগ্রাফি বা চিত্রায়ণে ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে, তা এককথায় অসাধারণ। এক দেশের মানুষের মুখের ভাষা অন্য দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য না হলেও ছবির অসাধারণ ভাষায় সর্বগ্রাহী দৃশ্যপট নির্মাণ করা হয়েছে এ-ছবিতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত এ-ছবি এখন পর্যন্ত দেশের প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে এক অনন্য মাইলফলক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে আশ্রয় করে জহির রায়হান আরো কয়েকটি ছবি নির্মাণ করেছেন : বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার (১৯৭১), অ্যা স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১), লিবারেশন ফাইটার্স (১৯৭১) এবং ইন্নোসেন্ট মিলিয়ন্স (১৯৭১)। অবশ্য স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে তাঁর নির্মিত কাহিনিচিত্র জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চলচ্চিত্রায়ণ যে ছবির আসল ভাষা, সে-কথার সার্থক প্রমাণ মেলে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া (১৯৭১) ছবিতে। যদিও ছবিটি প্রতীকধর্মী; কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-ছবির ফটোগ্রাফি এবং ফ্রেমিং অনেক কথা বলে দেয়, যা সংলাপে বলার প্রয়োজন হয়নি। ছোট্ট একটি উদাহরণ হিসেবে ছবিতে সমবেত কণ্ঠে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানের দৃশ্যটির কথা বলা যেতে পারে। অভিনয়ে প্রতিটি চরিত্রের শানিত অভিব্যক্তির পাশাপাশি শটগুলোর ফ্রেম কম্পোজিশন দেখলেই বোঝা যায়, কী অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ইমেজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে অসংখ্য লাঙল। এরই ফাঁকে ফাঁকে খুব ক্লোজ শট ধরা হয়েছে চরিত্রগুলোর। গানটি সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হলেও চরিত্রগুলোর ক্লোজ শটে তাদের প্রতিবাদী ইমেজ তুলে ধরে যে-বার্তাটি নির্মাতা দিতে চেয়েছেন, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। একই ছবিতে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি চিত্রায়িত করা হয়েছে। দুটি গান সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি আঙ্গিকের। চিত্রায়ণও করা হয়েছে সেভাবে। শটগুলো এমনভাবে কম্পোজ করা হয়েছে, যেখানে অভিনেতা অথবা অভিনেত্রীকে ক্লোজ ভিউতে রেখে গ্রামবাংলার পরিবেশকে দেখানো হয়েছে বড় পরিসরে। চমৎকার শট ডিভিশন গানের আবেদনকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই অসাধারণ মেধাবী নির্মাতা সাহিত্যচর্চা এবং পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কতো দিন, কয়েকটি মৃত্যু, তৃষ্ণা। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজনাও করেছেন বেশকিছু সাড়া জাগানো ছবি জ্বলতে সুরুজ কি নিচে (১৯৭১), জুলেখা (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), সুয়োরানী দুয়োরানী (১৯৬৮), দুই ভাই (১৯৬৮), শেষ পর্যন্ত (১৯৬৯), মনের মত বউ (১৯৬৯)। অনেক আশা নিয়ে শুরু করেছিলেন নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র লেট দেয়ার বি লাইট (১৯৭০) নির্মাণের কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নানা প্রতিকূলতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে সে-ছবি আর
কোনো দিনই আলোর মুখ দেখেনি।
ছবির ভাষা যে ছবি, সেজন্য অতিরিক্ত শব্দ বা সংলাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না, এ-কথার প্রমাণ অনেক ছবিতেই মেলে। স্মরণ করা যেতে পারে কালজয়ী নির্মাতা ঋত্বিককুমার ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) ছবির কথা। অদ্বৈত মলস্নবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসকে কেন্দ্র করে ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত বাংলাদেশের তিতাস নদীপাড়ের অবহেলিত জেলেদের
সুখ-দুঃখ নিয়েই এ-ছবি। অদ্বৈত মলস্নবর্মণ তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে নিজেই বলেছেন :
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। … তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের তো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।
চলচ্চিত্রকার ঋত্বিককুমার ঘটক যে খুবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপন্যাসটির চিত্রায়ণ করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সাদা-কালো এ-ছবির ফটোগ্রাফিই যেন ছবির ভাষা। অনেক না-বলা-কথা কেবল চিত্রায়ণের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে। অদ্বৈত মলস্নবর্মণের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট চলচ্চিত্রকার এভাবে বর্ণনা করেছেন :
তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খ-জীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো – সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল। … অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুনর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।

১৫৯ মিনিটের এই ছবিতে খুব কমই সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষাকে অবিকৃত রেখে সংলাপ প্রয়োগ ছাড়াও পুরো ছবিতে যে-ধরনের দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয়েছে, তা কেবল ঋত্বিককুমার ঘটকের পক্ষেই সম্ভব।

পাঁচ
আমরা চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে সাধারণ সৌন্দর্যের কথা বলেছি। নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা অনেক বড় পরিসরের। চলচ্চিত্রবোদ্ধারাই সে-আলোচনার প্রকৃত সমঝদার। কিন্তু আমরা সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের বহিরাবরণ বা সৌন্দর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি মাত্র। যে-কোনো শিল্পমাধ্যমেরই বহিরাবরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সুন্দর প্রচ্ছদপট, মনোরম বাঁধাই আর ঝকঝকে মুদ্রণের একটি বই স্বাভাবিকভাবেই একজন পাঠককে আকৃষ্ট করে। তেমনি একটি সুন্দর পরিপাটি চিত্রের ক্যানভাস দর্শককে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে থাকে। সংগীতের বেলাতেও একই কথা। চমৎকার সুরমূর্ছনা শুরুতেই শ্রোতাকে মুগ্ধ করে।
চলচ্চিত্রের সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, একজন নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিই শেষকথা। নির্মাতার চেষ্টাই একটি চলচ্চিত্রকে সুন্দর করতে পারে। এখানে অবশ্যই চলচ্চিত্রকারের মেধা, মননশীলতা এবং রুচিবোধ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি তাঁর কথা আর ছন্দকে পাঠকের জন্য শ্রম্নতিনন্দন ও পাঠযোগ্য করে তোলেন। একজন শিল্পী রেখা ও রঙের বিন্যাসে ক্যানভাসে দৃষ্টিননদন করে তোলেন তাঁর শিল্পকর্ম। কিন্তু একজন চলচ্চিত্রকারের দায়িত্ব দর্শকের দৃষ্টি ও শ্রম্নতিকে একত্রে আকৃষ্ট করা। চলচ্চিত্র-গবেষক সাজেদুল আউয়াল বিষয়টি এভাবে বিশেস্নষণ করেছেন :
চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে শাস্ত্রাবদ্ধ হয়নি। তবে অন্যান্য শিল্পাঙ্গিকের নান্দনিকতার ধরনটি অন্বেষণের ক্ষেত্রে যেসব প্রশ্ন ও বিবেচনার মুখোমুখি হতে হয় সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব অন্বেষকদেরও হতে হয়। নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি দর্শনশাস্ত্রের শিল্পসম্বন্ধীয় চিন্তাভাবনার আওতাধীন। … ভালো সিনেমা অহেতুক বকবক করে না। অপ্রয়োজনীয় শব্দ আর কথোপকথন অতিষ্ঠ করে তোলে না। বরং ইমেজগুলো উপহার দেয় নানা ইঙ্গিত এবং সংকেত। … ভালো সিনেমা এই ইঙ্গিতের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তার বিষয় উপস্থাপন করে। একজন কবি বা সাহিত্যিক বিভিন্ন শব্দ একসঙ্গে সংস্থাপন করে যে সুন্দর বাক্যটি রচনা করেন সেটি অনেক কিছু বলে দিয়েও কিছু বাকি রাখে সেটিই ইঙ্গিত।
নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতা বিশেস্নষণ করতে গিয়ে চলচ্চিত্র-গবেষক সাজেদুল আউয়াল যথার্থই বলেছেন, ছবিতে অপ্রয়োজনীয় শব্দের চেয়ে ইমেজ অনেক বেশি কার্যকর। এসব ইমেজ চলচ্চিত্রের সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান। সাজেদুল আউয়ালের মতোই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় মন্তব্য করেছেন :
চিত্রপরিচালকের হাতে তথ্য পরিবেশনের যত রকম উপায় আছে তার মধ্যে দুর্বলতম হচ্ছে কথা। দৃশ্য বা ধ্বনির সাহায্যে কাজ না হলেই চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালক কথার আশ্রয় গ্রহণ করেন। অন্তত সার্থক চলচ্চিত্রের এই নিয়ম। চীনাদের সেই উক্তি – ‘এক ছবি হাজার কথার শামিল’ – চলচ্চিত্রকারকে তাই মনে রাখতে হয়। শক্তিমান পরিচালকের প্রধান গুণ হল বাক্যের সাহায্য না নিয়েও দৃশ্যকে বাঙ্ময় করে তোলা। এ কাজে ক্যামেরা অভিনয় দৃশ্যগত ডিটেল সম্পাদনা ইত্যাদি সবকিছুই প্রয়োজনে আসতে পারে।
চলচ্চিত্রে ফটোগ্রাফি বা সিনেমাটোগ্রাফি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রের সৌন্দর্য অনেকাংশে নির্ভর করে তার চিত্রায়ণে। সত্যজিৎ রায়ের সাদা-কালো পথের পাঁচালী (১৯৫৫) ছবিতে কাশবনের মধ্য দিয়ে দুই কিশোর-কিশোরী অপু ও দুর্গার ট্রেন দেখার জন্য ছুটে যাওয়ার দৃশ্যটির কথা ভাবা যেতে পারে। সাদা কাশবন আর ট্রেনের কয়লার ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়ায় মিলেমিশে অপরূপ এক দৃশ্যপট। এভাবেই সুন্দর দৃশ্য সংযোজনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের সৌন্দর্য বিবেচিত হতে পারে। চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্যের শট এবং ফ্রেমগুলো সুন্দর হলেই সেই দৃশ্যটি সুন্দর হয়। তবে এ-কথাও ঠিক, কেবল ভালো চিত্রায়ণ হলেই একটি চলচ্চিত্র সৌন্দর্যম–ত ছবি হয় না, সেখানে কোন বিষয়টি কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটিই আসল। এখানে দৃশ্যকল্প নির্মাণশৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির চলচ্চিত্র সম্পর্কে প্রায়ই বলতেন, ‘Film is nothing but a make belief game।’ অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্যতার যত বেশি কাছাকাছি যাওয়া যাবে, ততই সেটি সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। তাই অভিনয় যে চলচ্চিত্রের সৌন্দর্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সে-কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে দৃশ্যগত ডিটেল, সম্পাদনা ইত্যাদি। চলচ্চিত্রপ্রিয় দর্শকদের নিশ্চয়ই মনে আছে পথের পাঁচালীর সেই ঝড়-জলের পর অপু-দুর্গাদের বাড়ির ভাঙাচোরা রান্নাঘরটির কথা। দৃশ্যগত ডিটেল নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানে একটি মরা ব্যাঙের উপস্থিতি যে কত জরুরি হতে পারে, সেটা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। এখানেও ওই বিশ্বাসযোগ্যতার কথা ঘুরেফিরে আসে। আবার সম্পাদনার টেবিলে ভিন্ন ভিন্ন শট জোড়া দিয়ে যখন দৃশ্য নির্মাণ করা হয়, তখনো ‘make belief game’-এর কথাটাই মাথায় থাকে।
চলচ্চিত্রের সৌন্দর্য-বিচারে এর প্রতিটি উপাদানই সমান গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্র দেখা ও শোনার একটি যুগল মাধ্যম। দেখার জন্য ইমেজের সৌন্দর্যের পাশাপাশি শোনার জন্য শব্দ ও সুরমূর্ছনার সৌন্দর্যও বেশি জরুরি। চলচ্চিত্রের ধ্বনি বা শব্দটি দর্শক-শ্রোতা কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটিও ভাবার বিষয়। শব্দের মধ্যে সংলাপ, স্বাভাবিক স্বর ও সুর-ব্যঞ্জনা কোনোটির গুরুত্বই কম নয়। শ্রম্নতি যখন শ্রোতা ও দর্শকের কর্ণকুহরে বিরক্তি উপাদান না করে বরং আনন্দ জাগায়, শ্রোতা তখনই হয়তো আপন মনে গেয়ে ওঠেন : ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী,/ আমি অবাক্ হয়ে শুনি কেবল শুনি’ …
অবশ্যই চলচ্চিত্র অবাক হয়ে দেখা এবং শোনার এক আশ্চর্য মাধ্যম। অবাক এই অর্থে যে, দর্শক তার কল্পনাকে চলচ্চিত্রের পর্দার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবনার সুযোগ খুঁজে পান। কারণ চলচ্চিত্র তো শুধু দেখার বিষয় নয়, উপভোগ এবং সেই সঙ্গে ভাবনাচিন্তারও বিষয় বটে।

তথ্যসূত্র
১. চলচ্চিত্রের ভাষা, বাদল রহমান, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫।
২. ক্যামেরা যখন রাইফেল, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ ফিল্ম বুলেটিনের বিশেষ সংকলন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৮০।
৩. সূর্যদীঘল বাড়ী চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রপত্র, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ ফিল্ম বুলেটিন, সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৮১।
৪. বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, সেপ্টেম্বর ১৯৮২।
৫. প্রেক্ষাপট বিশ্ব চলচ্চিত্র, সম্পাদক : মাহবুব জামিল, অনুষ্টুপ চলচ্চিত্র সংসদ দ্বিতীয় পর্যায়, ডিসেম্বর ১৯৭৬।
৬. শিল্প ও শিল্পী, ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, বৈশাখ ১৪২৩।
৭. আমি এবং চলচ্চিত্র, মৃণাল সেন, গ্রন্থপ্রকাশ, কলকাতা-১২, দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ, শ্রাবণ ১৩৮৪।
৮. The Work of the Film, Director by A. J. Reynertson, Focal Press London, 3rd Edition 1978.