ভণ কইসেঁ সহজ বোলবা জায়

হাবিব আর রহমান
সহজ বাউল সোহারাব হোসেন পুনশ্চ কলকাতা, ২০১৭

গত শতাব্দী থেকে এ-পর্যন্ত বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে দুই বাংলার গবেষক-লেখকরা বেশকিছু বই লিখেছেন। তা সত্ত্বেও শিক্ষিত নাগরিক সমাজে এই বিশেষ সম্প্রদায় সম্পর্কে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা এখনো যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে। সাম্প্রতিককালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত অকালপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও গবেষক-লেখক সোহারাব হোসেন (১৯৬৬ – ২ মার্চ ২০১৮)-রচিত সহজ বাউল (পুনশ্চ, ২০১৭) বইটি পড়তে গিয়ে এ-কথা আমাদের মনে হয়েছে। মিতপরিসর বইটিকে লেখক নিজে বলেছেন ‘হ্যান্ডবুক’।
বাউল শব্দটির উৎপত্তি এবং বাউল কারা এ নিয়ে মতভিন্নতা কম নয়। শব্দটির উৎস যা-ই হোক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয় বাউলের স্বরূপগত পরিচয়। সোহারাব হোসেনের বইয়ে উদ্ধৃত দুদ্দু শাহের একটি গানের নিহিতার্থের দিকে নজর দিলে বাউলের স্বরূপ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণায় পৌঁছতে পারা সম্ভব বলে মনে হয়। গানটি এই :
যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল
বস্ত্ততে ঈশ্বর খুঁজে পায় তার উল।
পূর্ব পুনঃজন্ম না মানে
চক্ষু না দেয় অনুমানে
মানুষ ভজে বর্তমানে হয় রে কবুল।

মানুষে সকল মেলে
দেখে শুনে বাউল বলে
দীন দুদ্দু কি বলে লালন সাঁইজির কুল।

গানটিতে খোদ-এ-খোদাতত্ত্ব অর্থাৎ নিজের দেহের মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, তাঁকে বাইরে কোথাও কিছুতে খোঁজার প্রয়োজন নেই – এই মতের প্রকাশ ঘটেছে। এই মতের অনুসারীদের যদি বাউল বলা যায়, তাহলে ইসলাম ধর্ম থেকে উদ্ভূত সুফিতত্ত্বের অনুসারীদের বাউল বলতে বাধা থাকার কথা নয়। সে-হিসেবে হিন্দু তান্ত্রিক, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়াপন্থি, ফকির-দরবেশ সবাইকেই বাউল অভিধা দেওয়া যেতে পারে। কেননা এঁদের সকলেরই লক্ষ্য এক – নিজের দেহের মধ্যে পরমের সন্ধান। সেই পরম মহানন্দময়। আর যদি কেবল সংসারবিবাগি দেহসাধকদের বাউল বলা হয়, তাহলে বেশ কয়েকটি তর্ক এসে হাজির হয়। সোহারাবের সহজ বাউল পড়লে বোঝা যায় বাউল শব্দটিকে তিনিও বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করেছেন। সে-বৃত্তান্ত আলোচনাক্রমে বলবার চেষ্টা করা যাবে।
সোহারাব হোসেনের গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, বিশেষ করে মহারণ ও আরশি মানুষ উপন্যাসদুটির সঙ্গে, তাঁরা জানেন বাউল-ফকিরের লোকায়তিক জীবন-দর্শন ও সাধনা তাঁর একটি প্রিয় বিষয়। এর একটা বড় কারণ হয়তো তাঁর জন্মগত ভৌগোলিক পটভূমি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চবিবশ পরগণার বশিরহাটের সাংবাড়িয়া নামে যে-গ্রামে তাঁর জন্ম, সেখানে এবং আশপাশের গ্রামে ফকিরদের বসবাস ছিল। নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে হয়তো এখনো আছে। এঁদের সঙ্গে সোহারাবের পরিচয় আবাল্য। তাঁদের বাড়ির কাছেই বাস করতেন পির মহম্মদ আলি ফকির। তাঁর ছেলে নূর মহম্মদ ফকির ছিলেন লেখকের ‘ঠাকুরদা-স্থানীয়’। তিনি লেখকের দুই জ্যাঠতুতো দাদা-দিদিকে দত্তক নিয়ে লালনপালন করেছিলেন। প্রতিবছর বোশেখ মাসে নূর মহম্মদের বাড়িতে দুদিনব্যাপী মহম্মদ আলি ফকিরের ‘উরুশ’ (ওরস) উপলক্ষে বিরাট ফকির সম্মেলন বসত। সাধন-ভজন-জেকের-গানে মাতোয়ারা হয়ে উঠত পুরো গ্রাম। বোঝার বয়স না হলেও সোহারাবের বালকমনে ফকিরিগান আবেশ সৃষ্টি করত। সেই আবেশ কীভাবে ধীরে ধীরে অবচৈতনিক প্রক্রিয়ায় তাঁর সত্তা দখল করে নেয় তা লেখকের নিজের বয়ানে শোনাই ভালো :
শৈশব-কিশোরের সেই আবেশ তারুণ্যে যৌবনে
গাঢ়-ভালোবাসায় পর্যবসিত হয়। পরে-পরে সে-বাউলবোধ আমার জীবন-বিশ্বাস আর জীবন-দর্শনের নির্ণায়ক মাত্রা হয়ে দাঁড়ায়। বাউলের সৎ-স্বচ্ছ-শুভ্র-সুন্দর-সু-সুকুমার-নির্ভার-পবিত্র প্রবৃত্তিজয়ী পুণ্যতোয়া জীবনধারাকে আমার জীবনের দৈনন্দিনতার সঙ্গে অন্বিত করে ফেলি তখনই। ফলে একটা নির্ভার-নিরাসক্ত-আনন্দময় জীবনযাপনের পথে হাঁটতে শুরু করি। আজও সে প্রক্রিয়া সমানে বহমান – আজও জীবনযাপনের ঐ বিশ্বাসে আমি অটুট।
এই আত্মকথনের সময় সোহারাব হোসেনের বয়স পঞ্চাশ। জীবনের হাটে কেনা-বেচা-লেনা-দেনা একেবারে কম হয়নি। তীক্ষনধী আর সংবেদনশীলতার কারণে অভিজ্ঞতা যেমন বেড়েছে, তেমনি গভীর হয়েছে বোধি। চৈতন্যের অন্তস্তলে অনুধাবন করেছেন লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষে পূর্ণ যে-টেনশন বা আততিভরা জীবন আমরা যাপন করি, তা যদি একটা সভ্যতা হয় তবে বাউলের জীবনযাপন ও তার তত্ত্বদর্শন পালটা আরেকটি সভ্যতা। এই সভ্যতায় প্রথম সভ্যতার দুঃখ ও অশামিত্মর মূলীভূত কারণগুলো অবদমিত থাকে, বলা ভালো তাদের মেরে ফেলা হয়। বাউল একেই বলেন জ্যান্তে-মরা।
অথচ, সোহারাব লক্ষ করেছেন, বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে সমাজে সাধারণভাবে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা তাঁর বিবেচনায় বিভ্রম সৃষ্টিকারী। একদল মনে করেন গেরুয়াধারী তালিতাপ্পি মারা চোগাচাপকান-পরা বাবরিচুলো গৃহবিবাগি একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো মানুষেরাই বাউল। আরেক দল বাউল বলতে বোঝেন মদ-ভাং-গাঁজাসেবী, যৌন কদাচারে লিপ্ত,
গান-বাজনায় মত্ত আখড়াবাসীদের। তৃতীয় অন্য একটি শ্রেণির কথাও তিনি বলেছেন। তাঁরা বাউল-গবেষক হিসেবে পরিচিত। এঁদের কারো কারো কাছে বাউল-সঙ্গ ও গবেষণা স্ট্যাটাস-সিম্বলের নামান্তর। তাঁরা বাউলপ্রসঙ্গ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তার দর্শনকে গ্রহণ করেন না। বরং উলটো কাজ করেন।
ওপরের শেষ বাক্যদুটি বর্তমান আলোচকের অভিমত। তিনি এমন একাধিক গবেষককে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। লালনের গানের ভাষায় ‘দরগাতলায় শিরনি খাওয়ার লোভ’ তাদের মধ্যে প্রবলভাবেই দেখা গেছে। সোহারাবের বিবেচনায় এরা এবং প্রথমোক্ত দুটি দল বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে
সমাজ-মনেও বিভ্রামিত্মর জন্ম দেন। এই ভুল ধারণা সৃষ্টির পেছনে ভেকধারী কিছু কথিত বাউলেরও হয়তো ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বাউলের উদ্দেশ্য হচ্ছে লালন ফকির যেমনটি বলেছেন – ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।’ অভিজ্ঞতায় এই সত্যলাভ করেছেন বলেই সোহারাব নিজের জীবনের সঙ্গে তাকে অন্বিত করে নিয়েছিলেন। কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, তাঁর শিল্পীজীবনেও এর প্রভাব এতটা আমূল ছিল যে, প্রথম উপন্যাস মহারণে (২০০৩) কেন্দ্রীয় থিম হিসেবে বাউলতত্ত্ব ও সত্যকেই গ্রহণ করেছিলেন। এই উপন্যাসে বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মার্কসতত্ত্বকে মেলাবার এক অভিনব ও সাহসী চেষ্টা দেখা যায়। এ যেন দুই ভিন্ন প্রকৃতির বস্ত্তবাদের মিলন-প্রয়াস। কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা এখানেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। মহারণ রচনা শুরুর দেড় যুগেরও বেশি পর ২০১৬ সালে লেখেন, তাঁর নিজের কথায়, ‘বাউলতত্ত্ব ও বাউল-ব্যাকরণের সামগ্রিক রূপ-মহারূপসর্বস্ব উপন্যাস ‘আরশি মানুষ’।’ এছাড়া অনেকগুলো ছোটগল্পের বিষয়ের মধ্যেও বাউল-দর্শন জায়গা জুড়েছে।
আরশি মানুষ রচনার আগের বছর সোহারাব লিখেন সহজ বাউল, যদিও সেটি গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয় পরে। ‘মুখ-কথা’ নামে ভূমিকায় বইটি লেখার পশ্চাৎপট হিসেবে জানিয়েছেন,
বন্ধু-পরিজন-ছাত্রসমাজ কিংবা পরিচিত শিক্ষক-অধ্যাপক-অনুসন্ধিৎসু গবেষক-মহলে বাউল নিয়ে বরাবরই প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ করেছি। বিভিন্ন স্থানে বাউল-সংক্রান্ত কিছু ক্লাস ও সেমিনার করার পর প্রাসঙ্গিক মহলকে বাউল-তত্ত্বসত্য ও বাউল গান সম্পর্কিত খুব স্পষ্ট আলোচনা-সমন্বিত বই খুঁজতে দেখেছি। কথা বলে বুঝেছি তাদের চাহিদা মূলত বাউল-সম্পর্কিত একটি হ্যান্ডবুকের। কৌতূহলী সমাজের এই অন্বেষণের প্রতিক্রিয়ায়, বাউল কী-কেন-কীরূপ তার একটা হ্যান্ডবুক হিসেবে, ‘সহজ বাউল’ গ্রন্থটিকে প্রস্ত্তত করতে চেয়েছি।
বইটি লেখার কারণ যা-ই হোক, আমাদের বিবেচনায় মহারণ, আরশি মানুষ ও সহজ বাউল পরস্পর পরিপূরক তিনটি বই। প্রথম দুটি বাউল দর্শনের শিল্পধর্মী রসরূপ আর তৃতীয়টি তথ্য ও ব্যাখ্যাধর্মী তত্ত্বরূপ।

দুই
বাউলের সাধনা সহজিয়া প্রেমের সাধনা। কাকে বলে ‘সহজিয়া’? মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক বৃত্তিকে অর্থাৎ কামপ্রবৃত্তিকে স্বীকার করে নিয়ে তাকেই সাধনপন্থা রূপে গ্রহণ করাই সহজিয়া-তত্ত্ব। স্বাভাবিকভাবেই তাই এই সাধনায় সঙ্গী-সঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়। সহজিয়া সাধকের মতে, কাম ছাড়া প্রেম নেই। কিন্তু একশ্রেণির সাধক আছেন যাঁরা সঙ্গী-সঙ্গিনী ছাড়াই প্রেম-সাধনা করেন। বোঝাই যাচ্ছে এই সাধনায় স্ত্রী-পুরুষে রমণ নেই। সোহারাব হোসেন মনোহর দাসের একটা গান উদ্ধৃত করেছেন যার চতুর্থ স্তবকে বলা হয়েছে –
কেবল স্ত্রী-পুরুষে রমণ করা নয়
আত্মায় আত্মায় রমণ হলে রসিক তাকে কয়
তারা শুধু আত্মাকে ভেদ করিয়ে সদাই
লক্ষ্য পানে দেয় হানা।

সঙ্গী-সঙ্গিনীবিরহিত আত্মায়-আত্মায় যে-রমণের কথা এই গানে বলা হয়েছে, কারা সেই পন্থি – সে-ব্যাপারে সোহারাব কিছু বলেননি। বললে ভালো হতো। এবং সেইসঙ্গে সুফি-সাধনার
কথাও তিনি বলতে পারতেন। কেননা, সুফির প্রেমসাধনা রতিনির্ভর প্রেমসাধনা নয়। বাউলতত্ত্বের সঙ্গে সুফিতত্ত্বের কয়েকটি জায়গায় গভীর মিল রয়েছে। সুফিতত্ত্বও গুরু বা পির-মুর্শিদনির্ভর, এখানেও রয়েছে দম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ, সুফিরও লক্ষ্য নিজের মধ্যেই পরমকে পাওয়া অর্থাৎ বাউলের সেই খোদ-এ-খোদাতত্ত্ব। এ-দিকটা ভেবেই এ-লেখার গোড়ায় আমরা বলেছি যে, সুফিদেরও বাউল ভাবতে অসুবিধা নেই।
আসলে বাউলতত্ত্ব ও সাধনায় নানা তত্ত্বদর্শন ও করণক্রিয়ার মিশ্রণ ঘটেছে। ভূমিকায় সোহারাব ইতিহাসসম্মতভাবে এ-সম্পর্কে সুন্দর করে বলেছেন,
… বাউল-ধর্ম একক-মৌলিক ও নতুন কোনো মতপথ নয়। বাউল একটি মিশ্র-পন্থা। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত দেহ-সাধনা-কেন্দ্রিক অনেক মতপথের স্রোত এসে বাউল নামের বড়ো গাঙে এক-প্রবাহে চলছে। লোক-বাংলায় প্রচলিত ও অনুশীলিত ভাবের মাতনে পাগল হওয়া মানুষজন, বায়ু তথা শ্বাসের সাধনে অভ্যস্ত মানবগোষ্ঠী, সুফিবাদে বিশ্বাসী আউলিয়া সম্প্রদায়, খোদা-প্রেমে মাতোয়ারা বাতাল-সাধক সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সহজিয়া বজ্রকুল গোষ্ঠী, বৈষ্ণব-সহজিয়া-কর্তাভজা-কিশোরীভজন গোষ্ঠী, নাথ-যোগী-সম্প্রদায়, মুসলমান ফকির কিংবা হিন্দুতান্ত্রিক-সমাজের আচার-ক্রিয়া-মতাদর্শ-বিশ্বাসের সমন্বয়ে-মন্থনে-রসায়নে সৃজিত পাল্টা জীবনযাপনের খাতে একদা বাংলায় বাউল-মতপথের উদ্ভব হয়েছিল।
এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার ধারণা করা যায়, বাউল বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর নাম নয়, একটি বিশেষ তত্ত্ব বা দর্শনের নাম। সেজন্য শুরুতে আমরা বলেছি যে, সোহারাব হোসেন তত্ত্বগত দিক থেকে বাউল শব্দটিকে বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করেছেন। এদের যেহেতু নানা গোষ্ঠী আছে সেজন্য তাদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের দীক্ষাদান, সাধনপদ্ধতি ও আচারক্রিয়া প্রচলিত রয়েছে। ধারণ করা অর্থে ধর্ম শব্দটি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে বলা যাবে, বাউল একটি ধর্মও বটে।
লোক-সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গুরু-পরম্পরায় দীর্ঘ কাল ধরে একে বহন করে চলেছে। নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও এদের লক্ষ্য এক হওয়ায় স্বরূপত এরা অভিন্ন। সেজন্য এরা যে-পন্থানুসারী, তাকে সহজেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যময় পন্থা বলা যেতে পারে। সেই পন্থার সারকথা হলো ‘কামজয়ী-প্রবৃত্তিজয়ী নির্ভার-নিরাসক্ত-মহাসুখ
মহাতৃপ্তি-মহানন্দময় জীবনের অধিকারী হওয়া।’ বাউলের সেই
অন্বিষ্টকে যথাসম্ভব সহজ-সরলভাবে মূর্ত করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এ-গ্রন্থে।

তিন
ভারতে, বিশেষ করে বাংলা ও সন্নিহিত অঞ্চলে তন্ত্রসাধনার উদ্ভব বহু প্রাচীনকালে। ধারণা করা যায়, বৌদ্ধ বজ্রযানপন্থিদের সহজিয়া সাধনায় এর প্রভাব পড়েছিল। প্রভাব মানে হুবহু প্রভাব নয়, রূপান্তরিত প্রভাব। সহজ বাউলের ‘বাউলের দেহতত্ত্ব – দেহসাধন’ নামাঙ্কিত প্রথম অধ্যায়ে তিন তারের সাধনার বিবরণ দিতে গিয়ে প্রসঙ্গটি এসেছে। লেখক আমাদের জানিয়েছেন, শাক্তমতের তিন তার ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না বৌদ্ধ সহজিয়ামতে ডানগা, বামগা ও মধ্যগা নাড়ি। মধ্যগাকে অবধূতিকা নামেও চিহ্নিত করা হয়। বৌদ্ধ সাধক ডানগা নাড়িকে ডান নাক থেকে নাভি পর্যন্ত ও বাঁগা নাড়িকে বাঁ নাক থেকে নাভি পর্যন্ত কল্পনা করেন। আর মধ্যগা হচ্ছে সুষুম্না বা মেরুদ-। এই মতে ডানগায় সৃষ্টি আর বাঁগায় সংহার। সংহার বা পতনকে নাভিতে বেঁধে বোধিচিত্তকে জাগিয়ে সুষুম্না বরাবর ওপরে তুলে মাথায় নিতে পারলে তবেই সিদ্ধি। নর-নারীর দৈহিক মিলনের ফলে যে-পরমানন্দ, যে-এককেন্দ্রিক উপলব্ধিময় ধ্যান – তাকেই বজ্রযানীরা বলেন বোধিচিত্ত।
বেশকিছু চর্যায় সাধনার এই প্রক্রিয়াকে চমৎকারভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন শবরপাদের ‘উঞ্চা উঞ্চা পাবত’ পদটির কথা বলা যেতে পারে। এই পদে আছে ‘তিআ-ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলি’ – তিন ধাতুর খাট পাতা হলো, শবর মহাসুখে শয্যা বিছাল। কোথায় থাকে সেই মহাসুখ চক্র বা বোধিচিত্ত? তা থাকে দেহরূপ পবর্তের উচ্চ শিখরে অর্থাৎ মসিত্মষ্কে – ‘উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।’ বৌদ্ধ-সহজিয়া সাধকদের সাধনতত্ত্বের চমৎকার কাব্যরূপ ঘটেছে, এমন দু-চারটি চর্যাপদ বেছে নিয়ে সোহারাব যদি এঁদের দেহসাধনার রহস্যকথা আরো কিছু বলতেন তবে তাঁর সহজ বাউল আরো সমৃদ্ধি লাভ করত বলে মনে হয়।
কালক্রমে শাক্ত বা বৌদ্ধ-সহজিয়াদের অনুষঙ্গে তিন তারের সাধনরূপ বাউল সাধনাতেও যুক্ত হয়েছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও মাত্রায়। যেমন ত্রিবেণীঘাট (নারী-যৌনাঙ্গ)। ত্রিবেণীঘাটের ত্রিবেণী ধারা সরস্বতী (ডানগা), যমুনা (বামগা) ও গঙ্গাধারা (মধ্যগা) হিসেবে কল্পিত। সোহারাব জানাচ্ছেন, ‘… এই ত্রিধারা নারীর
রজঃ-নিঃসরণের তিন দিনের ধারা বৈ-ভিন্ন-কিছু নয়। তিন-তার এখানে বাউলের চন্দ্র সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত।’
আবার বাউলের যে খোদ-এ-খোদাতত্ত্ব বা মানুষতত্ত্ব, সেখানে তিন-তার তারই পরিপূরক মাত্রায় ব্যবহৃত। এখানে তিন-তার ত্রিবেণী ধারার বিবর্তিত রূপ হিসেবে আল্লাহ-আদম-রসুল বা
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হিসেবে কল্পিত।
সাধনার অন্যান্য ধারাও – চন্দ্র সাধনা, বিন্দু সাধনা, লতা সাধনা, দর্পণ সাধনা ইত্যাদি ধারা সম্পর্কে প্রথম অধ্যায়ে বেশ বিসত্মারিতভাবে প্রাসঙ্গিক গানসহযোগে আলোচনা করা হয়েছে। বোঝা যায় লেখক প্রচুর বাউলগানের মর্মার্থ অনুধাবন করে সেগুলোর কিছু কিছু প্রয়োজন অনুযায়ী সাধনার বিভিন্ন ধারার সঙ্গে অন্বিত করেছেন। যেমন বিন্দু সাধনা। এই সাধনায় বিশেষ বৈষ্ণব দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব আছে। এই ধারার বাউল বিশ্বাস করেন, সোহারাব লিখেছেন,
… নারীদেহে থাকে রাধাবিন্দু এবং পুরুষদেহে কৃষ্ণবিন্দু।
দুটি বিন্দুই আধা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, বাউলদের একাংশ মনে করে কৃষ্ণবিন্দু থেকে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি। অর্থাৎ পূর্ণ কৃষ্ণবিন্দু থেকে খ–ত হয়ে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি হওয়ায় তা খ–ত। অর্থাৎ অর্ধ। … বিন্দু সাধনায় এই দুই অর্ধবিন্দু নির্দিষ্ট যোগ ও নিয়ম মেনে মিলিত হলে পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই রাধাবিন্দু-কৃষ্ণবিন্দুর মিলনে সাধক/ সাধিকা সূক্ষ্মতম মহানন্দের অনুভবে নির্ভার হয় যা বাউল-সাধনার লক্ষ্য।
রাধাবিন্দু আসলে স্ত্রী-রজঃ, আর কৃষ্ণবিন্দু পুরুষের বীর্য। বিচিত্র সাধনায় এ-দুটিকে মিলিয়ে যার সন্ধান পাওয়া যায় বাউলের ভাষায় সেই হচ্ছে মনের মানুষ, মনু রায়, অচিন পাখি, আলেক সাঁই ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। একে পেলে মহাসুখ, মহানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু দুই অর্ধবিন্দুকে পূর্ণতায় পরিণত করা কঠিনসাধ্য, আর্জান শাহ তাঁর একটি গানে যাকে কালার সঙ্গে বোবার মিলন বলেছেন, সোহারাব যেটি ৫৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।
সহজ বাউল পড়ে আমাদের পক্ষে যা অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে তা হচ্ছে, বাউলদের মধ্যে যাঁরা সহজিয়াপন্থি তাঁদের সাধনা আসলে বস্ত্ত রক্ষার সাধনা। বস্ত্ত বলতে তাঁরা রজঃ ও বীর্যকে বোঝেন। এই দুই বস্ত্তর মিলনেই মনুষ্য সৃষ্টি। আর এই দুই বস্ত্ততে আরো যেসব উপাদান বা বস্ত্ত (ম্যাটার) আছে, দেহ একদিন তাতেই বিলীন হয়ে যাবে। দুদ্দু শাহের একটি গানে এ-কথাই বলা হয়েছে বলে ধারণা করি : ‘বস্ত্তকেই আত্মা বলা যায়/ আত্মা কোনো অলৌকিক কিছু নয়।/ বিভিন্ন বস্ত্তর সমন্বয়ে/ আত্মার বিকাশ হয়ে/ জীবন রূপ সে পেয়ে জীবনেতে রয়।/ অসীম শকতি তার/ যে তাহার করে সমাচার/ সাধিয়া ভবের কারবার বস্ত্ততে হয় লয়।’
বাউল সাধনা কামের মধ্য দিয়ে কামকে অতিক্রম করে প্রেমের ফুল ফোটানোর সাধনা। তার জন্য নির্ধারিত আচার-প্রক্রিয়া আছে। সোহারাব সেসবের কিছু কিছু যতটা সম্ভব সহজ করে বলার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু ওই পর্যন্ত। ওর চেয়ে বেশি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কেননা প্রক্রিয়াটি ব্যবহারিক। তাছাড়া তা গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে শিখতে হয় এবং সমস্ত কিছুরই প্রকাশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকে। সাধনায় সিদ্ধি লাভ হলে সাধকের দেহ-মন সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে নির্ভার-নিরাসক্ত-আনন্দময় হয়। বাউলের এর চেয়ে বেশি কিছু আর চাওয়ার নেই।
মনে হতে পারে বাউলের সাধনা আধ্যাত্মিক সাধনার ভিন্ন এক রূপ। তাঁরাও ঈশ্বরকে পেতে চান। কিন্তু এই মনে-হওয়া যে একেবারেই ঠিক নয় সে-সম্পর্কে সোহারাব স্পষ্টভাবে লিখেছেন,
… বাউল-ফকিরি ধর্ম যতটা পরিমাণে পার্থিব আর মানবিক তার কণামাত্রও আধ্যাত্মিক নয়। বাউল ফকিরের
ভগবান-খোদা নেই, স্বর্গ-বেহেশত-নরক-দোজখ নেই, নেই কোরান-পুরাণ-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক-গ্রন্থসাহেব। বাউলের শুধু আছে মানুষ, আছে জাতপাতহীন ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজ, আছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, শিখ-জৈনাদি
নানান ধর্ম-ভেদ-বিরোধী জীবনদর্শন, আছে মানবমহিমা, আছে এক আলেক সাঁই তথা মনের মানুষ তথা একবীজ থেকে
সব-মানুষের জন্মতত্ত্বে বিশ্বাস। … জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষই তার সাধ্য মোক্ষ, … মানুষই তার আদম-কৃষ্ণ-মহম্মদ, মানুষই তার গয়া-কাশী, মানুষই তার মক্কা-বেনারস। বাউলের কাছে মানুষের দেহে-রূপে অরূপে-মহারূপে সব একাকার – সেখানে কৃষ্ণ-হরি-চৈতন্যে আল্লা-আদম-মহম্মদে কোনো ফারাক নেই।
বাউলের সাধনায় তাই শুধু আত্মতত্ত্ব তথা মানুষতত্ত্বের সন্ধানই পাই না আমরা, সমাজতত্ত্বেরও চমৎকার প্রকাশ ঘটতে দেখি। বাউলের কাছে মানুষই যেহেতু সর্বসার, সেহেতু তার কাছে জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, ঘৃণাবিদ্বেষ, এককথায় প্রবৃত্তিসম্ভূত কোনো রকম ভেদাভেদ ও অনাচার নেই। বাউলবিশ্ব তাই শামিত্মর বিশ্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবমহিমায় একটি উচ্চতর রূপের কথা ভাবতেন। তাকে তিনি বলেছেন, মানবসত্তা, মহামানব ইত্যাদি। ইতিহাস জুড়ে এই মহিমা বা সত্তার বিনষ্টি আমরা দেখে চলেছি। কীভাবে ঘটে এই বিনষ্টি? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এই বিনষ্টি ঘটে তখন, যখন আমরা নিজেকে,
… টাকায় দেখি, খ্যাতিতে দেখি, ভোগের আয়োজনে দেখি। এই নিয়েই তো মানুষের যত বিবাদ, যত কান্না। মানুষের মানবসত্তা সম্পর্কে এ ধরনের বিকৃত বোধই জাতিতে জাতিতে শত্র‍ুতা, শ্রেণীতে শ্রেণীতে সংঘাত, শোষণ অত্যাচার ইত্যাদি যাবতীয় জাগতিক সমস্যার মূলে।
ফলে যে-সত্তার লালনে মানব-সমাজে রবীন্দ্র-কথিত একটি ‘বৃহৎ ও গভীর ঐক্য’ গড়ে উঠতে পারত, তা সম্ভব হলো না ওইসব তামসিক প্রবৃত্তির বিরাট হাঁ-করা মুখে রসদ জোগাতে গিয়ে। বাউলের সাধনা ওইসব প্রবৃত্তিকে জয় করার সাধনা। প্রবৃত্তিজয়ী বাউল তাই ঐক্যবাদী তথা সাম্যবাদী। জাতপাত সম্পর্কে তাঁরা এমন প্রশ্ন তোলেন, এমন যুক্তি দেখান যার কোনো উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা জাতবিচারীদের নেই। কিন্তু কেবল জাতের কথা নয়, অন্য অনাচারের বিরুদ্ধেও তাঁরা কথা বলেন। যেমন লালন ফকিরের বিখ্যাত ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানের এই দুটি পঙ্ক্তি : ‘পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ কর না/ পারে যেতে পারবে না …।’ লালনের ‘পার’ আর রবীন্দ্রনাথের মানবসত্তায় পৌঁছানো একই তাৎপর্যবাহী বলে ভাবা যেতেই পারে।
বাউলের সাধনায় যে একটি গভীর সমাজতত্ত্ব অন্তশায়ী হয়ে আছে, সোহারাব হোসেনের তা অবিদিত নয়। বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের নামই তিনি দিয়েছেন ‘বাউলের ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজতত্ত্ব’। প্রথম অধ্যায়ের কথা আগেই বলেছি। মোট সাতটি অধ্যায়ের অন্য অধ্যায়গুলোতে আছে বাউলের মানুষতত্ত্ব, মনের মানুষতত্ত্ব,
খোদ-এ-খোদাতত্ত্ব ও তাঁদের গানের কাব্যমূল্য বিচার। তত্ত্বগুলোকে প্রাসঙ্গিক গানের সাহায্যে যথাসম্ভব সহজ করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এ-ও তো সত্য, ‘সহজিয়া’ হলেও এই গোপন ঘরের তালা খোলা আমাদের মতো আটপৌরে সংসারী মানুষের পক্ষে সহজ নয়। এদিকে লক্ষ্য রেখেই এ-লেখার শিরোনামে কাহ্নপাদের একটি পদ থেকে এই পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছি : ‘ভণ কইসেঁ সহজ বোলবা জায়।’ – বলো কেমন করে সহজ বলা যায়। তবে সোহারাব অনেকটা পেরেছিলেন। পেরেছিলেন, কেননা তিনি আর দশজনের মতো আটপৌরে ছিলেন না।
বইটিকে লেখক ‘হ্যান্ডবুক’ হিসেবে গণ্য করতে চাইলেও দুই বাংলায় যাঁরা বাউলদের নিয়ে অন্তরের তাগিদে ভালো কাজ করেছেন সেগুলোর মধ্যে সহজ বাউল মর্যাদাপূর্ণ আসন পাবে বলেই আমাদের ধারণা।