অভিবাসীদের জীবন নিয়ে

ভূঁইয়া ইকবাল
বেলা অবেলার গল্প হামিদ রেজা খান ইত্যাদি ঢাকা, ২০১৯ ২৫০ টাকা

বেলা অবেলার গল্প হামিদ রেজা খানের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস। এ-উপন্যাসে লেখক একটি জীবনঘনিষ্ঠ গল্প বলতে চেয়েছেন। মুনশিয়ানার সঙ্গে বেশ জমিয়ে কাহিনিটি বলতে পেরেছেন। লেখকের জীবনচেতনা শিল্পিত রূপ পেয়েছে এই কাহিনিতে। সুদীর্ঘ অর্ধশতক কাল প্রকাশ্যে সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন
না-থেকেও পরিণত বয়সের এই বইয়ে এমন একটি আন্তরিক সুর আছে যা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।
লেখকের অভিবাসী জীবনে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বদেশ ও স্বজাতি বহুমুখী রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ওই কালপর্বের নানা ঘটনা ও তাদের প্রতিক্রিয়া লেখককে কীভাবে স্পর্শ করেছে, আলোড়িত করেছে, তার কিছু আভাস আছে এ-উপন্যাসে।
ঔপন্যাসিক তাঁর কাহিনি বিন্যাস করতে গিয়ে অল্প কয়েকটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তবে নায়ক-চরিত্র রবি ছাড়া অন্য চরিত্রগুলোর প্রতি লেখক কম মনোযোগী। রবির জীবন ও ভাবনাকে কেন্দ্র করেই

উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত। নায়ক একজন অভিবাসী ডাক্তার। তার স্ত্রী সুলতা ক্যান্সারে দু-বছর ভুগে মারা যায়। তাদের দুটি কন্যা – ত্বরী ও জরী। দুজনেই লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে আমেরিকায়ই স্থায়ীভাবে অভিবাসীর জীবন বরণ করতে চায় সে। জায়গা-জমির ব্যবস্থা করতে দেশে এসেছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাত্রাকালে হঠাৎ বহুদিন পরে দেখা হয় সুলতা ও রবির সহপাঠিনী মনিরার সঙ্গে। সন্তানহীনা মনিরার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে বহু বছর আগে। তার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত রবি আবার সংসার পাতে। ভাবে, দেশের মানুষের কাছে তার দায় আছে। তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এই হলো মোটা দাগে উপন্যাসের কাহিনি।
বেলা অবেলার গল্প উপন্যাসে প্রত্যাশিত প্রায় সব উপাদানই আছে : সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত কাহিনি আছে, প্রধান চরিত্রের দেশের ও মানুষের প্রতি দায়বোধ ও অঙ্গীকারের কথা আছে। পাঠকরা খেয়াল করবেন, রবি কলেজে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিল। লেখকের বাস্তবতাবোধের সঙ্গে কল্পনাশক্তির সমন্বয় ঘটেছে। ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সরলতার একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে। এই দক্ষতা ও পারঙ্গমতা হঠাৎ লিখতে বসে আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য। মনে হয়, দীর্ঘ চার দশকের প্রবাসজীবনে লেখক আরো লিখেছেন, তবে সেগুলো লোকলোচনের সামনে আসেনি। প্রচারবিমুখতা কিংবা উপযুক্ত পরিবেশের অভাব তার কারণ হতে পারে।
তিনি কৈশোরে কবিতা লিখতেন। তাঁর গদ্যে কাব্যিক সুষমা আছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরণ ভেঙে গদ্যে ব্যবহার করেছেন।
মানুষের প্রতি লেখকের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এ-উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়। ইরফানের পাঠশালা তাকে উদ্বুদ্ধ করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে। মানুষ হিসেবে অন্যের প্রতি দায়বোধ রবির চারিত্রিক গুণ। জগৎ ও জীবনের প্রতি লেখকের যে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তাতে তাকে আর দশজন সাধারণ অভিবাসী থেকে আলাদা করেছে।
বড় মেয়ে ত্বরীর ইহুদিকে বিয়ে রবি মেনে নিতে পারেনি। অপত্য স্নেহ ও স্বধর্মনিষ্ঠার দ্বন্দ্বে প্রথমে ধর্ম জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত পিতৃহৃদয় জয়ী হয়। ছোট মেয়ে জরীর শিয়া মুসলমানকে বিয়ের ব্যাপারটি রবি মেনে নেয় এই ভেবে;
আল্লাহ আর তার নবীকে মানলেই সে মুসলমান। ডিফারেন্সগুলো আমাদের বানানো। ভুল ভ্রামিত্ম থাকলে আল্লাহ বিচার করবেন।
রবির দ্বিতীয় বিয়ে ও দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জেনে তার দুই মেয়ের কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার মুহূর্তে তার দুই চোখ অশ্রম্নসিক্ত দেখে পাঠকের চোখও শুকনো থাকে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে একবার বলেছিলেন, সব লেখকেরই প্রথম উপন্যাস হয়ে থাকে আত্মজৈবনিক। এই উপন্যাসেও হয়তো লেখকের ব্যক্তিজীবনের কিছু ছায়াপাত ঘটে থাকতে পারে। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেখকের কল্পনাশক্তি।
কাহিনির সুশৃঙ্খল বিন্যাসে, ভাষার কাব্যময়তা ও প্রাঞ্জলতায়, অল্প কয়েকটি রেখাচিত্রে চরিত্র ফুটিয়ে তোলায়, জীবনাভিজ্ঞতার বাস্তবোচিত শিল্পরূপায়ণে, মার্কিন প্রবাসী বাঙালি সমাজচিত্রণে, সর্বোপরি একটি সুখপাঠ্য কাহিনি নির্মাণে লেখকের দক্ষতা প্রশংসনীয়।
লেখক হয়তো উচ্চাকাঙক্ষী নন। আরো বৃহত্তর পরিসরে জীবন ও জগতের জটিলতর বিষয় অবলম্বনে তাঁর ভবিষ্যৎ শিল্প-অন্বেষা তাঁকে আমাদের কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী আসন দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা।