মুক্তিযুদ্ধ নারী ও সময়

শেখ আবুল খায়ের আনছারী
রাজাকার কন্যা সাদত আল মাহমুদ চমনপ্রকাশ ঢাকা, ২০১৮ ৩৫০ টাকা

রাজাকারকন্যার মনেও থাকতে পারে দেশপ্রেম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে যারা দেশের বিরোধিতা করে পাকিসত্মানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তাদেরই চিহ্নিত করা হয় রাজাকার হিসেবে। অন্যপক্ষে দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সম্মুখ সমরে বা পরোক্ষক্ষ পাকিসত্মানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁরা দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা। আর মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরাও এক অর্থে মুক্তিযোদ্ধাই। মুক্তিযোদ্ধা খেতাব নাইবা জুটল কপালে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বা দেশের জন্য কিছু করতে পারাটা নিঃসন্দেহে গর্বের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাব্য, গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এসব আখ্যানে পুরুষ যোদ্ধাদের পাশাপাশি উঠে এসেছে এদেশের নারীসমাজের অবদান। দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য নিজের সম্ভ্রম-জীবন বিসর্জন দিতেও তাঁরা পিছপা হননি। যুদ্ধশেষে অনেকেই পেয়েছেন বীরাঙ্গনা খেতাব। কিন্তু এ খেতাব তাঁদের জীবনকে ক্ষেত্রবিশেষে করে তুলেছিল দুর্বিষহ। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হলেও ইতিহাসের সোনালি পাতায় তাঁরা থাকবেন অমর হয়ে। দেশমাতৃকার সেই চরম সময়ে এমন অনেক নারীর কথা জানা যায় যাঁরা হয়তো রাজাকার বা দেশদ্রোহী কোনো পুরুষের ঘরে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁর হৃদয় কেঁদে চলেছিল প্রতিক্ষণ। অনেকেই গোপনে সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তেমনই একটি চরিত্র রচনা করেছেন কথাসাহিত্যিক সাদত আল মাহমুদ তাঁর উপন্যাস রাজাকার কন্যায়। চরিত্রটির নাম তাহমিনা বেগম।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাহমিনা নিজের ও পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি। সে চিন্তা করেছে দেশের কথা, দেশের মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হবে – সে-কথা সবসময়ই তার হৃদয়ে অনুরণিত হতো। রাজাকারের মেয়ে হয়েও তাই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। নিজের ও পরিবারের সমূহ বিপদ জেনেও দেশের কথা চিন্তা করে বিপন্ন করেছিল ব্যক্তিজীবনকে।
এ-উপন্যাসের শুরু ভেলানগর গ্রামে। টেলিখালী থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে ভেলানগর গ্রাম। ভেলানগর হাইস্কুলে পাকিসত্মানি সেনারা ঘাঁটি স্থাপন করায় গ্রামের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ছাড়েন। এ সুযোগে গ্রামটিতে রাজাকারদের দাপট বেড়ে যায়। যাকে ইচ্ছে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া, হত্যা করা, নারীদের পাকিসত্মানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া, তাদের ওপর বর্বর সেনাদের নির্যাতন চলতে থাকে।
এদিকে উপন্যাসের আরেক কেন্দ্রীয় চরিত্র আকবর বিশজন মুক্তিযোদ্ধার কাফেলা নিয়ে হালুয়াঘাট থানার কাছে পাকিসত্মানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। যুদ্ধটা এমন এক দুর্গম এলাকায় চলছিল যেখানে দু-তিন কিলোমিটার এলাকা ফাঁকা, প্রায় মরুভূমির মতো। সঙ্গে খাবার হিসেবে কিছু চিড়া-মুড়ি এনেছিল আকবররা, যা প্রথম দিনই শেষ হয়ে যায়। দুদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা শুধু পানি খেয়ে পাকিসত্মানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে কতক্ষণইবা যুদ্ধ করা যায়! পাকিসত্মানি সেনাদের আক্রমণের মুখে ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা চার-পাঁচজন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খুঁজতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়। আকবরও দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে ভারি রাইফেল কাঁধে নিয়ে একসময় আকবররা এসে পৌঁছে ভেলানগর গ্রামে। চলার মতো শক্তি না
থাকায় এক বাড়ির উঠানে লুটিয়ে পড়ে তারা। কিন্তু তারা জানত না এটা কুখ্যাত রাজাকার নাজমুলের বাড়ি। ধূর্ত নাজমুল নিজের পরিচয় গোপন রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মেকি দরদ দেখায় আর মনে মনে বলে, ‘বাছারা বহুদিন ধরে তোমাদের খুঁজতাছি, আইজকা মনের সাধ মিটাব। ক্যাপ্টেনকে খবরটা পৌঁছাতে পারলে আমাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করবে।’ স্ত্রী আয়েশাকে ভালো খাবার রান্নার নির্দেশ দিয়ে নাজমুল মুক্তিযোদ্ধাদের জানায়, ‘বাবা তোমরা হইলা মুক্তিযোদ্ধা, তোমাদের সামান্যতম সেবা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।’ এদিকে নাজমুলের মেয়ে তাহমিনা বাবার দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে ছটফট করছিল। সে বুঝতে পারছিল আজ এই মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিত হত্যা করা হবে। এ-কথা জানানোর জন্য সে বহুবার চেষ্টা করে আকবরদের কাছে যেতে; কিন্তু বাবার বাধার কারণে যেতে পারে না। রাতে নাজমুল নিজ হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করে, বলে – ‘বাবারা তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আর যত দিন মন চায় আমার বাড়িতে থেকে যাও।’ টানা কয়েক দিন পেটে কোনো খাবার পড়েনি, তাই ভালো ভালো খাবার খেয়ে আকবররা নিরাপদ আশ্রয় মনে করে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ১২টার পর নাজমুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তাহমিনার বুঝতে বাকি থাকে না বাবা কোথায় যাচ্ছে। নাজমুল কিছুদূর যাওয়ার পরই তাহমিনা কাছারি ঘরের দিকে ছুটে যায়, যেখানে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল আকবর ও তার সাথিরা। তাহমিনা দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। কিন্তু কিছুতেই যেন ঘুম ভাঙে না মুক্তিযোদ্ধদের। অস্থির হয়ে ওঠে তাহমিনা – ‘হায়রে কপাল, ওরা কি তবে মরণঘুম ঘুমিয়েছেন।’ তাহমিনার ক্রমাগত করাঘাতে অবশেষে ঘুম ভাঙে আকবরের। দরজা খুলে দেখে এক যুবতী অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের পরিচয় দিয়ে তাহমিনা বলে, ‘আমার বাবা রাজাকার, আপনারা তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালান। আমার বাবা ক্যাম্পে খবর দিতে গেছে। পাকিসত্মানি আর্মিরা এসে আপনাদের মেরে ফেলবে।’ কালক্ষেপণ না করে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাঁচাতে রাজাকারের বাড়ি ত্যাগ করে। যাওয়ার সময় আকবর শুধু পরোপকারী মেয়েটির নাম জেনেছিল, – তাহমিনা।
যুদ্ধ শেষ হয়। পাকিসত্মানি সেনা কর্তৃক নির্যাতিত নারীদের অনেকেই তখনো নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ধর্ষিত নারীরা পথের পানে চেয়ে থাকে, বাবা-মা-স্বামী অথবা আত্মীয়স্বজন তাদের নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু বিধিবাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ আসে না এসব নারীকে নিতে। বাবা-মা বা স্বামী ধর্ষিত নারীকে বাড়িতে নিয়ে বদনামের ভাগীদার হতে চায় না। সে-কারণে পাকিসত্মানি সেনা দ্বারা ধর্ষিত নারীদের স্থায়ী আবাসস্থল হয়ে ওঠে এই পুনর্বাসন কেন্দ্র।
আকবর অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে তাহমিনার দেখা পায়। দীর্ঘ কয়েক মাস পর আকবরের সঙ্গে তাহমিনার আবার দেখা। সেই রাতে একঝলক দেখা মুখটি ভোলেনি আকবর। তাহমিনাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ওর শরীরের ওপর দিয়ে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আকবর তাহমিনাকে জিজ্ঞেস করে – ‘তাহমিনা তুমি কেমন আছো?’
তাহমিনা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকবরের মুখের দিয়ে তাকিয়ে অশ্রম্ন বিসর্জন দিতে থাকে।
‘তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? আমার জন্যই আজ তোমার এ অবস্থা। আমি আকবর। ওইদিন তোমার বুদ্ধির জোরেই আমরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। তোমার এই ঋণ আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব না।’
তাহমিনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আকবরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকবরও ওর বুকের মধ্যে তাহমিনাকে স্থান দিতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত হয়।
এ-ঘটনার পর রাজাকারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাহমিনা আকবরের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নেয়। আকবর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে তাহমিনাকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নেয়। জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুই আকবর স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়; কিন্তু বাদ সাধে তাহমিনার পেটের সন্তান। ভূমিষ্ঠ হয় এক মেয়েশিশু, নাম রাখা হয় বিলকিস। পাকিসত্মানিদের পাশবিকতার এই ফসল একসময় আকবর ও তাহমিনার সংসারের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
ঘটনা এগিয়ে চলে। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় বিলকিস। প্রেম হয় সহপাঠী আরিফের সঙ্গে। দুজনের প্রেমের স্বীকৃতি দিতে দুই পরিবারও এগিয়ে আসে। কিন্তু এরই মধ্যে গোল বাধে। আরিফের মা জেনে যান বিলকিসের জন্ম-ইতিহাস। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি রূঢ় ভাষায় তাহমিনাকে বলেন, ‘পাকিসত্মানি উচ্ছিষ্টের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব না। আপনি আপনার মেয়ের জন্য অন্য কোনো পাকিসত্মানি উচ্ছিষ্ট খুঁজে নিন।’
আবারো নতুন করে এক অন্ধকার ঘিরে ধরে তাহমিনাকে। নিজের জীবনের যে ক্ষত তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেই ক্ষত যে মেয়ের জীবনেও দাঁত বসাচ্ছে। দিশেহারা তাহমিনার কি তবে এর থেকে মুক্তি নেই? তবে কি রাজাকারকন্যা হয়ে দেশপ্রেম দেখানোটাই ছিল তার পাপ? এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে উপন্যাসে কাহিনিবিন্যাস করেছেন সাদত আল মাহমুদ।
মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়কালকে নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াসী সাদত। রাজাকার কন্যা উপন্যাসে একই সঙ্গে তিনি দেশ ও নারীর ব্যথাকে উৎকীর্ণ করেছেন পরম মমতায়। চেয়েছেন স্বাধীন এ-সমাজেও নারীর প্রতি চরম অবহেলা ও ঘৃণার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে, বিশেষ করে ’৭১-এ নির্যাতিত নারীদের প্রতি। অথচ এই নারীদের আত্মত্যাগ যে কত মহান ও মহিমাময় তা লিখে শেষ করা যাবে না। সাদত আল মাহমুদের রাজাকার কন্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই সব বীরাঙ্গনার কথা যাঁদের আমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, অপমান করে সরিয়ে রেখেছি সমাজের এককোণে, যেনবা তাঁরা এ-সমাজের উচ্ছিষ্ট। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো যে আমাদের একান্ত প্রয়োজন তা মনে করিয়ে দেয় রাজাকার কন্যা।