পিটার হান্ডকের নোবেল বিতর্কিত পছন

খুব খারাপ যাচ্ছিল সুইডিশ অ্যাকাডেমির সময়। সারা দানিউস এসে স্থায়ী সচিব হিসেবে যোগ দিয়েই ল-ভ- করে ফেললেন সাহিত্য পুরস্কারের মানচিত্র। মূলত তাঁরই আগ্রহে ২০১৫-র সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার চলে যায় একজন সাংবাদিকের কাছে। পরের বছর একজন গায়ক ও গীতিকার পুরস্কৃত হয়ে এতটাই বিব্রত হলেন যে, ক-সপ্তাহ নোবেল কমিটির কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে সম্মত হলেন না। যখন অ্যাকাডেমির ইমেজ পুনরুদ্ধারের সময়, তখন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির যৌন কেলেঙ্কারি ভীষণ বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করল। সাতজন সদস্য পদত্যাগ করলেন, ২০১৮-তে সারা দানিউসকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো (এ-বছরের ১২ অক্টোবর সারার মৃত্যু হয়)। ১২ সদস্যের কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় ২০১৮-তে পুরস্কার স্থগিত রেখে ২০১৯-এ দু-বছরের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
২০১৯-এর পুরস্কার দেওয়া হলো অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার পিটার হান্ডকেকে। সৃষ্টি হলো ভিন্নধারার এক বিতর্ক – নোবেল কমিটি মানবতার পক্ষে, না বিপক্ষে? ৭৭ বছর বয়স্ক পিটার হান্ডকে বলকান যুদ্ধে সেস্নাবোদান মিলোসেভিচের পক্ষে দাঁড়ানোর অপরাধে ঘোষিত হাইনেরিখ হাইনে পুরস্কার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন ২০০৬ সালে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর নিজের ভূমিকার জবাবদিহি করতে করতে বাধ্য হয়ে মুখ বন্ধ করেছেন – এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবেন না।
লেখক হিসেবে তিনি কি অনুপযুক্ত? এ-প্রশ্নে সমালোচকদের কেউ হ্যাঁ বলছেন না। লেখক হিসেবে তিনি উপযুক্ত; কারো কারো মতে, গুন্টার গ্রাসের পর জার্মান থাকতে পারে। – এর জবাবে তিনি বললেন, দুজন বিচারক মিলোসেভিচকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দিতে রাজি ছিলেন না, অবশ্য কোরিয়ান বিচারক তাঁদের বিরোধিতা করেছেন।
মস্নাদিক এবং কারাদজিককে হেগ বিচারালয়ে সমর্পণ নিয়েও তাঁর এক ধরনের আপত্তি – তিনি বলছেন, ‘অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তো তাঁদের অপরাধী হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।’
কিন্তু স্রেব্রেনিকা গণহত্যার বিষয়টি তো স্পষ্ট। – এর জবাবে পিটার হান্ডকে বললেন, স্রেব্রেনিকার কাছাকাছি ৩০-৪০টি গ্রাম থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার পর মুসলমান গেরিলারা প্রায় ৫০ জন মানুষকে হত্যা করে, যাদের এক-তৃতীয়াংশ বেসামরিক নাগরিক। দ্রিনা নদীর অপরদিক থেকে আসা সার্বিয়ান মিলিশিয়ারা প্রতিশোধ নিয়ে হত্যাকা- চালায়, তা ছিল ভয়াবহ এবং ভয়ংকর নিন্দনীয়।
১৯৯৫-এর জুলাইয়ে সার্বিয়ান মিলিশিয়াদের হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা আট হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে ছয় হাজার আটশো চৌত্রিশ জনের পরিচিতি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
পিটার হান্ডকে এই হত্যাকা-কে বড় অপরাধ মনে করেন বলেই তাঁকে প্রদান করার জন্য ঘোষিত হাইনেরিখ হাইনে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা হয়।
পিটার হান্ডকে মিলোসেভিচের শেষকৃত্যে হাজির হয়ে তাঁর প্রশস্তি করেছেন।

পিটার হান্ডকের সঙ্গে কথোপকথন
পিটার হান্ডকে তখনো নিজেকে বিতর্কে জড়াননি। তখন তরুণ ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। গুন্টার গ্রাস, হাইনেরিখ বোল, সিগফ্রিদ লেনৎজ প্রমুখের উপন্যাসকে তিনি তখন উড়িয়ে দিচ্ছেন ‘উপন্যাস হয়ে ওঠেনি’ – এই বলে। লেখকদের বলছেন, উপন্যাস কিন্তু প্রবন্ধ নয়, এখানে নসিহত করার সুযোগ নেই।
সাক্ষাৎকারটি বার্লিনে নেওয়া, ১৩ জুলাই ১৯৭৯। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুন শুলেটার আর জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডিট্রিখ বুশার। এর আংশিক ভাষান্তরিত হলো।
প্রশ্ন : ফ্যান্টাসিস অ্যান্ড প্রিজুডিস নামে আপনার ইংরেজিতে সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসটির সাবটাইটেলে যা লিখেছেন তার মানে দাঁড়ায়, ১৯৭৫-এর নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭৭-এর মার্চ পর্যন্ত এক বছর পাঁচ মাস আপনি প্রতিদিন লিখেছেন। এটা কি সত্যি?
পিটার হান্ডকে : হ্যাঁ। তবে কখনো কখনো দু-তিনদিনের লেখা একত্রে মিলে গেছে। অধিকাংশ তারিখই যথার্থ। জার্নালের বৈশিষ্ট্যই প্রতিদিনের বিষয়টি সেদিনই লেখা, বছরের অন্য কোনো দিনের জন্য ফেলে না রাখা।
প্রশ্ন : সেই মাসগুলোতে আপনার জীবনে ঘটা ঘটনাগুলো কি জার্নাল লেখার জন্য আপনাকে বিশেষ প্রণোদনা জুগিয়েছে?
হান্ডকে : হ্যাঁ, এ-ঘটনাগুলোই।
প্রশ্ন : তারপরও ভূমিকাতে লিখেছেন এই জার্নালের যে
সাহিত্য-সম্ভাবনা আছে তা আপনি আগে বুঝতে পারেননি। আপনি কি মনে করেন সেখানে এই বইটি একটি ফিকশন, যেটিকে সত্যি ঘটনার জার্নাল বানিয়ে আপনি বিভ্রামিত্মকর উপস্থাপনা করছেন।
হান্ডকে : জার্নাল ও ফিকশনের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে বলে আমি মনে করি না। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার যে নোট রাখা হয় তারই একটি বস্ত্তনিষ্ঠ বর্ণনা জার্নাল। ‘জার্নাল’ বলার আরো একটি কারণ হচ্ছে, এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দ আমি পাইনি। আমি বিশ্বাস করি, এটাকে বরং উপন্যাসই বেশি মনে হওয়ার কথা। আমার জন্য এটা উপন্যাস কিংবা প্রতিদিনের ঘটনার মহাকাব্য। তবে এটা আসলে কী, বলা যাবে ফলাফল দেখার পর।
প্রশ্ন : আপনার ‘রোমান্টিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে সাহিত্যের নতুন সংজ্ঞা দেওয়ার কথা লিখেছেন – কাহিনিবিহীন সাহিত্য শব্দের চাতুরীহীন, ছন্দহীন, শৈলীবিহীন সাহিত্য। আপনি বলেছেন, রিয়েলিস্টিক – বাস্তববাদী কেবল এ-ধরনের সাহিত্যকে বলা যাবে। আপনার লেখা দ্য ওয়েট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কি রিয়েলিস্টিক?
হান্ডকে : না।
প্রশ্ন : আপনার অন্য কোনো লেখাকে রিয়েলিস্টিক মনে করেন?
হান্ডকে : আমি লেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে রিয়েলিস্টিক বা রোমান্টিক পরিচিহ্নিত করা এড়াতে চেষ্টা করি। … একটি বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যে কেউ লিখতে পারেন না। লেখাটি একগুচ্ছ বিধিবিধান নয়। সে-সময় এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে গিয়ে প্রবন্ধটি লিখেছি। আসলে রিয়েলিস্টিক যে কী আমি সত্যিই জানি না।
প্রশ্ন : মার্কিন সমালোচক লায়োনেল ট্রিলিং এবং অন্যরাও মন্তব্য করেছেন যে সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে উপন্যাস নিঃশেষিত হয়ে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। উপন্যাসের দিন শেষ। আপনি কি তা-ই মনে করেন?
হান্ডকে : এ-কথা আমি প্রায়ই শুনে থাকি। আমি বিশ্বাস করি সব প্রজন্ম এবং সব সময়ের জন্য কেবল রিপোর্টের বাইরের বর্ণনা পড়ার দরকার আছে – যা বর্ণনাতীত, যা সাংবাদিকের আওতার বাইরে; মানুষ খবরের কাগজে যা পড়ছে, টেলিভিশনে যা দেখছে তার বাইরের একটি সৃষ্টি যাতে পুনরাবৃত্তি নেই, সম্ভবত সেটাই উপন্যাস – আসলে উপন্যাস কী আমি বলতে পারব না – তবে সেই বিবরণী সমাজের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারে। আমি ‘উপন্যাস’ বলছি না – পুরনো সাধারণ একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা যেখানে আমি ছিলাম, কিংবা তিনি গিয়েছিলেন, কিংবা একজন নারী সেখানে গিয়েছেন – আমি ভাবি এটাই চিরকালীন ভাষা এবং স্বাধীনতম ভাষা। …
প্রশ্ন : রোলা বাখত্ (১৯১৫-৮০, ফরাসি দার্শনিক ও প্রবন্ধকার) আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
হান্ডকে : পনেরো বছর আগে কাঠামোর জন্য তাঁর লেখা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাকে কাঠামো দেখতে সাহায্য করেছে – এটা আনন্দদায়ক, সব প্রপঞ্চের মধ্যে কাঠামোহীনতা আছে; সব ‘আমি’ নিজের জন্য, সবাই হতবুদ্ধি অবস্থায় – এক সময় আমি তাঁর লেখা থেকে বিধানটা দেখেছি, কাঠামোগত বিধান, আধিপত্য পরম্পরার কাঠামো নয়। অনেক আগের বিষয় ভুলেও গেছি, তবু
কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন : আপনি কি নিজেকে প্রাথমিকভাবে অস্ট্রিয়ান লেখক মনে করেন?
হান্ডকে : আমি নিজেকে জার্মান ভাষার লেখক মনে করি। আমি অস্ট্রিয়ান – এটাই আমার উত্তর। অন্য কেউ যদি আমাকে অস্ট্রিয়ান লেখক বলেন সেটাও সত্যি।
প্রশ্ন : কিন্তু কেউ কি আপনাকে বিশেষ কোনো অস্ট্রিয়ান লেখকের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন?
হান্ডকে : সচেতনভাবে যারা ভাষা নিয়ে, বাক্য নিয়ে কাজ করেন অন্য যিনি এ-ধরনের কাজ করেন তার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাক্যকে যারা গুরুত্বপূর্ণভাবে নিয়েছেন আমি আশা করি আমাকে তাদের সঙ্গে তুলনা করা হবে।
প্রশ্ন : ১৯৬৭ সালে আপনি লিখেছেন ক্লিষ্ট, ফ্লবেয়র দস্তয়েভস্কি, কাফকা, ফকনার এবং রব-গ্রিয়ে আপনার সচেতনতার বিশ্বটি বদলে দিয়েছেন। এই তালিকায় কি আর কোনো নাম যোগ করবেন?
হান্ডকে : অনেক বেশি লেখক, কিন্তু খুব কম মহান লেখকের নাম ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী লেখক তিনিই। এই লেখাটিতে পিটার হান্ডকেবিষয়ক বিতর্ক, তাঁর সাক্ষাৎকারের অংশ এবং তাঁর কবিতার অনুবাদ সংযুক্ত হয়েছে।

ইতিহাসের অন্ধকারে আশ্রিত
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ পর ১৭ অক্টোবর পিটার হান্ডকে নিজেও ঘোষণা করেন, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আর কখনো কোনো কথাই বলবেন না। নববইয়ের দশকে বলকান যুদ্ধে তাঁর অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকরা তাঁর ওপর প্রশ্নবোমা নিক্ষক্ষপ করে তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন।
‘যারা আমাকে প্রশ্ন করছেন তাঁদের কেউ আমার কোনো লেখা পড়েছেন কিংবা আমি কী লিখি তা জানেন বলে আমার মনে হয়নি – আমি শুধু প্রশ্ন শুনি : আমার নোবেল পুরস্কারে পৃথিবীর কী প্রতিক্রিয়া আর তাতে আমার কী প্রতিক্রিয়া – শুধু প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া।’
‘আমি একজন লেখক। আমি একজন লেখক, আমার শেকড় প্রোথিত তলস্তয়ে; আমার শেকড় হোমারে! আমার শেকড় সার্ভেন্তেসে; আমাকে শামিত্মতে থাকতে দিন, আমাকে এসব প্রশ্ন করবেন না।’
বসনিয়ান-জার্মান লেখক সাসা স্ট্যানিসিক বলেছেন, পিটার হান্ডকে যে বলকান বাস্তবতার বর্ণনা দেন তা মিথ্যা কথায় পরিপূর্ণ। যে-বাস্তবতার কারণে তাঁকে সপরিবার জার্মানিতে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে-কথা হান্ডকের লেখায় নেই।
সাসা স্ট্যানিসিক তাঁর উপন্যাস অরিজিতের জন্য শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার বই হিসেবে জার্মান বুক অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় নোবেল কমিটি এবং পিটার হান্ডকের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার তো ভাগ্য ভালো যে জীবিত এসে পৌঁছেছি, এদিকে হান্ডকে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মদদ জুগিয়ে গেছেন। সেখানে কী ঘটেছে সেটা বলতেও যে-লেখক অস্বীকার করেন, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া অবশ্যই একটি লজ্জাকর কাজ।’ কুড়ি বছর আগে ১৯৯৯ সালেই সালমান রুশদি তাঁকে বলেছিলেন, ‘বছরের সেরা আন্তর্জাতিক আহাম্মক।’ তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তিকে যারা নিন্দা জানিয়েছেন তাঁদের ভাষ্য, পিটার হান্ডকে ইতিহাসের সঠিক দিকে না থেকে ইতিহাসের অন্ধকার দিকটাতে আশ্রয় নিয়েছেন।
সুইডিশ অ্যাকাডেমির বিচারকরা তাঁদের পছন্দের যৌক্তিকতা প্রচার করবেন এটিই স্বাভাবিক। তবে দুজন সদস্য ম্যাটস মাম এবং এরিখ রুনেসন বলেছেন, পিটার হান্ডকে ‘অবশ্যই প্ররোচনামূলক অন্যায্য ও অস্পষ্ট রাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন, তবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি স্পষ্টতই কোনো যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যা বা যুদ্ধাপরাধের
অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীকে পুরস্কৃত করতে চাইবে না।’ ১৯৯৬ সালে তাঁর লেখা জাস্টিস ফর সার্বিয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে স্রেব্রেনিকা গণহত্যায় হয়তো মুসলমানরাই নিজেদের হত্যা করেছে। ১৯৯৯-এর টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সার্বিয়ার পরিণতিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন নাৎসি হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করে বিতর্কের মুখে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছেন, এটা ছিল তাঁর ‘সিস্নপ অব টাঙ্গ’।
বিচারকম-লীর হেনরিক পেটারসন এবং রেবেকা কার্দে কমিটির পছন্দ যথার্থ এবং অনেকদিন ধরেই তিনি পুরস্কারের যোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তিনি জাতীয়তাবাদবিরোধী লেখক। সদস্য এন্ডার্স ও লসন বলেন, তাঁকে পছন্দ করা হয়েছে ‘সাহিত্যের পরিমাপে, রাজনীতির নয়’। এ-কথার রেশ ধরে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, ‘পুরস্কারটি সবসময়ই রাজনৈতিক, সবসময়ই একটি সমঝোতা।’

মিলোসেভিচ প্রশস্তি
যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতার বিরুদ্ধাচারের অভিযোগে সেস্নাবোদান মিলোসেভিচকে হেগে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ওঠানো হয়। পিটার হান্ডকে এই ট্রাইব্যুনালকে বললেন অবৈধ। কিন্তু কেন?
মার্টিন মেয়ার ও আন্দ্রিয়াস ব্রিটেইস্টেইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জবাব দিলেন, ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে কেবল মিলোসেভিচের প্রসঙ্গে অবৈধ বলেছেন। মিলোসেভিচের ব্যাপারে অনেক ভ্রামিত্ম ও পক্ষপাত সেখানে কাজ করছে, আমি চাইব বিচারটা সার্বিয়ায় হোক।’
পিটার হান্ডকে ট্রাইব্যুনালের কোরিয়ান ও জ্যামাইকান বিচারক নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। তাঁরা ফৌজদারি পদ্ধতির বিচারক না হতে পারেন; কিন্তু ন্যায়বিচার করার মতো অসাধারণ কা-জ্ঞান তাঁদের করা যায়। আমি ইতিহাসের একটু পেছনদিক থেকে শুরু করি এবং শুরু থেকে পুনঃপাঠ করতে থাকি। অনেক আগেই স্কুলে হোমার, পিন্ডার, হেরাক্লিটাস নিয়ে আমি মোহিত থাকতাম। আমি বারবার পড়েছি এবং হয়তো আরো অনেকের মতোই কম বয়সে। তারপর ধীরে ধীরে পড়েছি গ্যায়টে। আরো একজন আছেন, হেল্ডারলিন, তাঁকে আমি এখন পুরোপুরি বুঝি – এভাবে তাঁকে আগে বুঝিনি।

যদিও মায়ের জন্মভূমি সার্বিয়ার জন্য তিনি হঠকারী রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন, পুরনো সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনীতিতে তাঁর সামান্য আগ্রহও নেই। নিজ দেশ অস্ট্রিয়ায় কী ঘটছে সে-খবর তিনি রাখেন না, বরং জার্মানির কিছুটা খবর রাখেন। তিনি সে অর্থে কোনো দেশকেই স্বদেশ মনে করেন না। তিনি নিজেকে মনে করেন এপিকিউরিয়ান – আনন্দবিলাসী মানুষ।

শৈশব সংগীত
যখন শিশুটি শিশু ছিল
সে তার হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটত
সে চেয়েছে ছোট্ট স্রোতধারা নদী হয়ে যাক
নদী হোক খরস্রোত জলরাশি
আর এই ডোবা হয়ে যাক সমুদ্র।

যখন শিশুটি শিশু ছিল
সে জানত না যে সে শিশু
সবকিছু ছিল গভীর অনুভূতির
আর সব আত্মা এক হয়ে গিয়েছিল।

যখন শিশুটি শিশু ছিল
কোনো বিষয়ে তার কোনো মতামত ছিল না
তার কোনো অভ্যাস ছিল না
প্রায়ই সে পা আড়াআড়ি করে বসত
দৌড়ে ছুটে যেত ইচ্ছেমাফিক
কপালের ওপর দিয়ে নামত চুলের গোছা
ছবি তুললে দেখা যেত চেহারা নেই।

যখন শিশুটি শিশু ছিল
এসব প্রশ্ন করার তখনই ছিল সময় :
আমি আমি কেন? আমি তুমি না কেন?
আমি এখানে কেন? ওখানে না কেন?
সময় কখন শুরু হলো, পরিসরের শেষ কোথায়?
সূর্যের নিচে জীবন কেবলই কি স্বপ্ন?
আমি যা দেখি শুনি এবং শুঁকি
তা কি এ-পৃথিবীর আগের কোনো পৃথিবীর মায়া নয়?
শয়তান ও মানুষের যেসব ঘটনা জানি
শয়তান সত্যিই কি বিরাজমান?
এটা কেমন করে হবে, আমি – এই যে আমি
এখানে অস্তিত্বমান হবার আগে কোথাও বিরাজ করতাম না
এবং এমন কি হবে না, আমি – এই যে আমি
আর কখনো আমি হয়ে থাকবো না?

যখন শিশুটি শিশু ছিল
তার গলায় শাক, মটরদানা কিংবা পায়েস আটকে গিয়ে
কিংবা সেদ্ধ ফুলকপিতে শ্বাসরুদ্ধ যেত
এখন সে এসবের সবকিছুই খায়, কারণ খেতে হয় এখন।
স্থিতিকালের প্রতি
স্থিতিকালের ওপর ভরসা করা যায় না;
এমনকি ধর্মানুরাগী
যারা নিত্যকার প্রার্থনায় যোগ দেন, তারাও নন
ধৈর্যশীল যারা প্রতীক্ষার গুরু, তারাও নন
এমনকি অনুগত যারা, তারাও নন
যারা সবসময় দৃঢ়ভাবে আপনারই থাকবে
যাদের সারাজীবন উপস্থিতির আশ্বাস দেওয়া যায়
আমি জানি, সম্ভবত
এটা সম্ভব হয় কেবল
আমি যখন কাজে থাকতে সমর্থ
এবং কাজের ব্যাপারে সতর্ক
মনোযোগী, তাড়াহুড়োর কিছু নেই
আঙুলের ডগায় তাৎক্ষণিক মনোযোগী জবাব
সেই কাজটা কী
যা দাবি করে আমার সারাক্ষণ লেগে থাকা?
বেঁচে থাকার ভালোবাসায়
সে তো নিজেকে প্রকাশ করবেই
কোনো না কোনো একটা কিছুর জন্য
আর সংলগ্নতার বিষয় অবহিত থাকায়
(যদি তা কল্পনাপ্রসূতও হয়)
এই কাজটি তেমন বড় নয়
বিশেষ কিছু নয়, অস্বাভাবিক, মহামানবিক নয়
যুদ্ধ নয়, চাঁদের পিঠে অবতরণও নয়
আবিষ্কার নয়, এক শতাব্দীর কাজ নয়
পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা নয়
মহাযুদ্ধে জাপানি কামিকাজে ফ্লাইটও নয়
আমি লক্ষ মানুষের সঙ্গে স্থিতিকাল ভাগাভাগি করি
আমার প্রতিবেশীর সঙ্গেও করি
যেখানে সাধারণ কাজ হিসেবে
মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায় ওয়ার্ল্ড সেন্টার
আমার নিজেরটার মতোই।
(আংশিক)

পিটার হান্ডকের বইপত্র (ইংরেজি-অনূদিত)
১৯৬৬ : দ্য হরনেটস (উপন্যাস)
১৯৬৬ : অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স অ্যান্ড আদার স্পোকেন পেস্নজ (নাটক)
১৯৬৭ : ক্যাসপার অ্যান্ড আদার পেস্নজ (নাটক)
১৯৭০ : দ্য গোলিস অ্যাংজাইটিস অ্যাট দ্য পেনাল্টি কিক (নাটক)
১৯৭২ : অ্যা সরো বিয়ন্ড ড্রিমস : আ লাইফ স্টোরি
(আত্মজীবনীমূলক গল্প)
১৯৭৫ : অ্যা মোমেন্ট অব প্রম্ন ফিলিং (উপন্যাস)
১৯৭৭ : দ্য লেফট হ্যান্ডেড ওমেন (নাটক)
১৯৭৯ : সেস্না হোমকামিং (গল্প)
১৯৮৬ : রিপিটেশন (উপন্যাস)
১৯৮৭ : উইংস অব ডিজায়ার (নাটক)
১৯৯২ : দ্য আওয়ার উই নিউ নাথিং অব ইচ আদার
১৯৯৪ : মাই ইয়ার ইন দ্য নো-ম্যানস বে (উপন্যাস)
১৯৯৬ : এ জার্নি টু দ্য রিভার্স : জাস্টিস ফর সার্বিয়া (প্রবন্ধ)
১৯৯৬ : ক্রসিং দ্য সিয়েরা দ্য গ্রেডস (উপন্যাস)
২০০৮ : দ্য মোরাভিয়ান নাইট
২০১০ : স্টর্ম লিফ (নাটক)