পাললিক চেতনার অদম্য কারিগর

নদীবিধৌত সমতট ভূমির মানুষ হিসেবে সবুজ প্রকৃতি ও বিসত্মৃত পরিসরের নৈসর্গিক উপাদান ইত্যাদি সঙ্গী করেই এতদাঞ্চলের মানুষের বিকাশ ও সমৃদ্ধি। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি আমাদের স্বভাবজাত প্রেমের ভিত্তিও সেই একই উৎসধারা-উৎসারিত। এটি খুবই সাধারণ প্রবণতা বাংলাদেশের মানুষের যে, ষড়ঋতুর বিচিত্র রূপরসগন্ধ ও রং থেকে শুরু করে ঝড়বাদলসহ তাবৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি সবকিছুকেই তাদের জীবনের সঙ্গী হিসেবেই তারা গ্রহণ করে – ফি-বছর যখন বৈশাখ আসে, তখন কালবোশেখির তা-ব যে-কোনো সময় হানা দিতে পারে তা যতই কিনা আশঙ্কার বিষয় হোক, তাকে ভাগ্য বলে মেনে নেওয়ার চেয়েও বরণ করারও একটা মানসিক প্রস্ত্ততি যেন থাকে, কারণ সেজন্য আগেভাগেই কিছু-না-কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবসময়ই গ্রহণ করি আমরা। এ তো গেল সর্বসাধারণের বিষয়ে বলবার কথা, আর সে-মানুষটি যখন হন চারুশিল্পী, তখন তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টা হয় এরকম যে, মঙ্গলজনক ঘটনাই হোক আর করুণ মর্মবিদারক অঘটনই হোক, সবরকমের পরিস্থিতিই তার প্রেরণার উৎস হয়ে যেতে পারে। আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রতিবাদী সৃজনকর্ম তাঁর বিখ্যাত ‘দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা’র জলজ্যান্ত প্রমাণ। আর সেই শিল্পীব্যক্তিত্ব যদি হন কালিদাস কর্মকার, তাহলে তো কথাই নেই – দেশপ্রেমিক মানুষ তিনি, জন্মভূমির মাটি আর মানুষের প্রতি তাঁর গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ ভালোবাসা, যা অবিরাম এবং যাকে অনায়াসে তুলনা করা চলে অন্তহীন যাত্রার সঙ্গে।
যিশুখ্রিষ্টকে হত্যা করা হয়েছিল দ-কাষ্ঠ বা ক্রুশকাষ্ঠে, আর ক্রুশে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করেই তাঁর প্রাণবধ করা হয়েছিল। এ যে কত মর্মন্তুদ ঘটনা, তা প্রমাণের জন্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কোনো অবকাশ নেই। মানবেতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সেই ক্রুশবিদ্ধ মহামানবের মৃত্যুকাহিনি নিয়ে অর্থাৎ তাঁর জীবনের শেষ দৃশ্যটিকে বিষয়-উপজীব্য করে এযাবৎকালের মধ্যে বিভিন্ন যুগের বহু খ্যাতনামা শিল্পস্রষ্টা বিচিত্র মাধ্যম-প্রকরণ, রচনাশৈলী ও প্রকাশ-আঙ্গিকে শিল্পকর্ম সৃজন করেছেন, এমনকি বর্তমান সময়কালের আধুনিক ও আধুনিকোত্তর শিল্পযুগেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ১৯৭৬ সালে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রথম একক প্রদর্শনীতে পোস্টারে ব্যবহৃত প্রতিকৃতিসহ ছবিটি দর্শনমাত্র মনে পড়ে গিয়েছিল সেই পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করে যিশুখ্রিষ্টের প্রাণবধের কাহিনি। ছবিটিতে লক্ষণীয় এক শ্মশ্রম্নধারী মুখমণ্ডল, সেই মুখাবয়বের দুচোখ ঢাকা কপাল জুড়ে চ্যাপ্টা বেল্টের মতো করে সেঁটে তার ওপর অজস্র পেরেক (তারকাঁটা) দিয়ে আটা। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, যাঁরা মানুষটিকে চেনেন তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন সেটি আসলে আত্মপ্রতিকৃতি, আর তা শিল্পী কালিদাসের নিজের। কিন্তু যাঁরা তাঁকে কখনো দেখেননি, তাঁর ছবিও চেনেন না – তাঁদের কাছে সেই ক্রুশকাষ্ঠে ঐতিহাসিক মৃত্যুদৃশ্যটিই মনে হবে। তবে অবশ্যই কালিদাস কর্মকার-সৃষ্ট এই পোস্টারটিরও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তরকালে বিজয়ের মাত্র প্রায় চার বছর অতিবাহিত হতে না হতেই ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার স্থপতি দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল
দেশি-বিদেশি পরাজিত শত্রম্নদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে তাদের প্রতিনিধি কিছু স্বাধীনতাবিরোধী অমানুষ। সমর্থিত তথ্যানুযায়ী আমাদের জানামতে শিল্পী কালিদাস সেই দুঃসহ মর্মামিত্মক ঘটনায় প্রচ- মর্মপীড়া অনুভব করেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমাদের অস্তিত্ব-সত্তার মূল-শিকড় পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছে – আর তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিবাদ জাতীয় কিছু করা যাচ্ছে না, রক্তক্ষয়ী মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতাসংগ্রামী বাঙালি যে আবার সুসংগঠিত হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তারও কোনোরকম অনুকূলতা তখন ছিল না; কথা বলা যাবে না, এমনকি চোখ খুলে কিছু দেখাও যাবে না – সে ছিল এক ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্বিনীত সময়কাল। এই তাঁর সুস্পষ্ট চেতনাবোধ উৎসারিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শিল্পী প্রাথমিক কল্পনায় তথা খসড়া স্কেচে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতেই পেরেক বিদ্ধ করে বিষয়টি সুস্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন, পরে দমে গিয়েছিলেন নানা বাস্তব আশঙ্কায় – তাই আর সাহস করেননি। শেষে অবলম্বন করেছিলেন আত্মপ্রতিকৃতি। পুরো বিষয়টি নিয়ে যদি আরেকবার গোড়া থেকে গুছিয়ে নিয়ে চিন্তা করা যায়, তাহলে দাঁড়াবে এরকম : দ-কাষ্ঠে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করা অর্থাৎ ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিষ্টের হত্যাদৃশ্য পেরিয়ে পেরেকবিদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু-প্রতিকৃতির পরিকল্পনা, এবং শেষ ধাপে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছাপিয়ে সেখানে আত্মপ্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা : আমার জ্ঞানবোধ আমাকে এই মর্মে শতভাগ সুনিশ্চিত করে যে, কালিমালিপ্ত পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু আততায়ীর গুলিতে নিহত
হওয়ার সময় যতটা যন্ত্রণাকাতর কষ্টভোগ করেছিলেন, সেই তীব্র অনুভব-উপলব্ধি নিজের সত্তায় ধারণ করে তারই প্রতিফলনে ওই প্রতিবাদী শিল্প সৃষ্টি করেছিলেন কালিদাস। অতএব ব্যাপারটি ‘জলবৎ তরলং’ কিছু নয়, বরং গভীরভাবে ভাববার বিষয়।
সৃজনশিল্পে এ-জাতীয় প্রত্যয়ী ধ্যান-ধারণার প্রতীকী রূপায়ণ আর দ্বিতীয়টির সন্ধান নেই। আর এখানেই তা শেষ নয়, বিচিত্র মাধ্যম-প্রকরণে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকাশ-আঙ্গিকের আরো অসংখ্য শিল্পকর্মে হাজারো পেরেক ঠুকে সিরিজকর্ম সম্পন্ন করেছিলেন কালিদাস।
দেশের মাটি ও মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়-নিংড়ানো প্রেম, প্রিয় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে অন্তরে লালিত গভীর ভালোবাসার আকুতি সৃজনশিল্পী কালিদাস কর্মকারের সারাজীবনের কর্মকা– নানাভাবে ছায়া ফেলেছে। তাঁর এই দেশপ্রেমিক ভাবনার কথা বিভিন্ন সময় নিজেই প্রকাশ করে বলেছেন যে, তাঁর চিত্রকর্ম আমাদের গৌরবম–ত স্বাধীনতাসংগ্রাম, সামাজিক ধ্যান-ধারণা, অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রভৃতির তাৎপর্যবাহী প্রতীকী রূপায়ণ; সেসব ভিত্তি করেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর একক প্রদর্শনীর শিরোনাম হিসেবে ‘ALLUVIAL’ বা ‘পাললিক’ শব্দটি। বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ, মাটি যেমন নরম সেরকমই শক্ত – বাঙালির মন সেই নরম কাদামাটিতে গড়া কোমল প্রকৃতির হলেও তা পুড়ে কঠিন আকার ধারণ করতে পারে। সে-কারণেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রভূত শক্তির প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিল বাঙালি জাতি, এ-সত্যে প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর। তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মূলত জন্মভূমির মাটি ও সংস্কৃতি থেকে। তাই সবসময় বলতেন, একজন শিল্পীর নিজস্ব সমাজ-পরিবেশ এবং স্বদেশভূমির মাটি ও তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকেই প্রেরণা গ্রহণ করা উচিত।
ঢাকায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে কালিদাস দুই বছরের প্রিলিমিনারি কোর্স গ্রহণের পর তৎকালীন অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের রিকমেন্ডেশন পত্র নিয়ে কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানকার সরকারি আর্ট কলেজে এবং সেখানেই চিত্রকলা বিভাগে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পুরো শিক্ষাকোর্সে অধ্যয়ন করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সুকুমার কলায় ডিগ্রি নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়ারশতে সত্তরের দশকে; তারই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে প্যারিসে গিয়ে বিখ্যাত ‘আঁতিলিয়া ১৭’-তে, এবং সর্বশেষে টোকিও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মিউজিকে। প্যারিসে তিনি ‘সুপিরিয়র স্কলারশিপ ইন ফাইন আর্ট’ অর্জন করেছিলেন এবং বিচিত্রবর্ণা এচিংয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই কালিদাস কর্মকার শিল্পজ্ঞান ও দক্ষতায় নিজেকে পরিপূর্ণরূপে দীক্ষিত করে সৃজনশীল শিল্পচর্চায় আত্মনিবেদন করেছিলেন। তাঁর চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধি ঘটেছিল মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ ও মানুষের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চড়াই-উতরাইয়ের বিচিত্র বাস্তবতা। তিনি নানারকম কাগজ ও কাপড়ের চিত্রপট এবং আরো নানাকিছু ব্যবহার করেছেন সাপোর্ট হিসেবে, সম্পন্ন করেছেন একরঙা ও বহুরঙা কালার এচিং, জলরং, তেলরং ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের পাশাপাশি মেটাল কোলাজ, মিনিয়েচার, মিশ্রমাধ্যম, ইনস্টলেশন আর্ট এবং পারফরম্যান্স আর্টসহ আরো নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতে নিজের শিল্পীসত্তাকে ধারাবাহিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ব্যবহার করেছেন শঙ্খ বা শক্ত খোলসজাতীয় দ্রব্যাদি, পাথর, হ্যান্ডমেড পেপারে এমবোস, তেলরং ও গোয়াশ, চায়নিজ ইঙ্ক ও টেম্পেরা প্রভৃতি। ছাপাইছবিতে নির্বস্ত্তকতা আরোপ করেছেন বৈচিত্র্যপূর্ণ পুরু টেক্সচার সৃষ্টি করে। প্রচ- দ্রম্নতগতি আরোপিত মুন্শিয়ানায় সম্পন্ন ড্রইং বা অঙ্কনরেখা কালিদাস কর্মকারের শিল্পভুবনের এক উলেস্নখযোগ্য শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গি। তাঁর কম্পোজিশনও ব্যতিক্রমী, স্পেস এবং কাঠামো আঙ্গিকের নজরকাড়া শক্তিশালী উপস্থাপনা। কালিদাস কর্মকারের শিল্পকর্মে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগরির দিকটি খুব বেশি সোচ্চার। তাঁর এই কারিগরি দৃষ্টিভঙ্গির গোড়াপত্তন তাঁর ভেতরে ঘটেছিল ছোটবেলায় প্রত্যক্ষ করা ফরিদপুরে তাঁদের পারিবারিক স্বর্ণ-ব্যবসা এবং গাড়ির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। এ ছিল তাঁদের বংশপরম্পরার ঐতিহ্য। তিনি স্বীকার করেন যে, সেই কারিগরির দিকে ঝোঁকই তাঁকে প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করেছে শিল্পকর্ম সৃষ্টিজনিত কাজের দিকে।
তৃতীয় সহস্রাব্দের তৃতীয় দশকের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেও বাংলাদেশ শিল্পাঙ্গন এখনো চারুকলা ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে এমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, যাকে এতদাঞ্চলের সৃজনশিল্পীদের মৌলিক অবদান বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এজন্যই সত্য ও বাস্তব এ-তথ্যটি দ্বিধাহীন উত্থাপন করতে সাহসী হচ্ছি। তার কারণ আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, আমার যৌক্তিক এ-বক্তব্যের বিপরীতে এ-প্রমাণ কেউ আমার সামনে হাজির করতে পারবেন না যে, চিত্রকলা কিংবা ভাস্কর্য প্রভৃতিতে এমন কোনো অভিনব উপাদান আমরা যুক্ত করতে পেরেছি যা বিশ্ব-শিল্পকলায় নতুন সংযোজনা এনেছে। কথাটি শুধু যে শিল্পের প্রকাশভঙ্গি, শিল্পধারা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে আমি বলছি তা নয়, শিল্প-উপকরণের দিকটাও আমার হিসেবে আছে। আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে বাংলাদেশের চারুশিল্পীদের কৃতিত্ব ব্যক্তিশিল্পীবিশেষের ভূমিকা-অবদানের দিক থেকে বেশ আগেই চিহ্নিত হয়েছে। স্বনামখ্যাত শিল্পীদের সৃজিত শিল্পকর্ম বিভিন্ন জাদুঘর, গ্যালারি এবং বিদেশি শিল্পসমঝদার কিংবা সংগ্রাহকদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে গুরুত্বসহকারে জায়গা করে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রদর্শনী প্রতিযোগিতাতেও বিভিন্ন সময় পুরস্কৃত হয়েছেন আমাদের বিভিন্ন প্রজন্মের শিল্পস্রষ্টাগণ, সেসব ক্ষেত্রে
সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই; কিন্তু এমন কোনো শৈল্পিক অথবা শিল্পোপকরণ জাতীয় উপাদান আমরা উদ্ভাবন কিংবা সংযুক্ত করতে সমর্থ হইনি যা বাইরের জগতে গৃহীত বা অনুসৃত হয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে শুধু নিয়েই চলেছি বাইরে থেকে কিন্তু দিতে পারিনি কিছুই। কালিদাস সচেষ্ট ছিলেন সেই ঘাটতি পূরণের ক্ষেত্রে অদম্য সাহসী পদক্ষক্ষপে।
স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এসব কথা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ধান ভানতে শিবের গীত, কিন্তু প্রসঙ্গের বাইরে আমি কিছু বলছি না। শিল্পীর অবস্থান যেখানে, তার প্রেক্ষাপট যদি বর্ণনা না করি তাহলে কী করে সুস্পষ্ট করব তাঁর প্রকৃত আলোকিত রূপ-বৈশিষ্ট্যের দিকগুলো। আমাদের দেশে ওয়ার্কিং আর্টিস্টের সংখ্যা এখন আর সীমিত গ–তে নেই। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের চারুশিল্পী বলতেই এক কথায় বোঝা যেত এবং মনে আসত ঢাকার আর্ট কলেজের শিল্পী-পরিবারের কথা। এখন সময় পেরিয়েছে দীর্ঘ, মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে এখন লক্ষণীয়ভাবে চারুকলা কেন্দ্রের বিকেন্দ্রীকরণ সংঘটিত হয়ে গেছে। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে নানা স্তরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চারুকলা শিক্ষায়তনের সক্রিয় তৎপরতায় সাধারণ শিক্ষা থেকে নিয়ে উচ্চতর শিল্পশিক্ষা গ্রহণের বিস্তর সুযোগ এখন। ফলে একদিকে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার আদি কেন্দ্রটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গুণ-বৈশিষ্ট্যগত জেনারেশন গ্যাপের লক্ষণ দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে, তারই পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আপেক্ষক্ষক অর্থে সীমিত পরিসরে হলেও এবং সংখ্যায় কম হলেও তার মধ্য দিয়েই নতুন প্রজন্মের চারুশিল্পী তৈরি হচ্ছে। কর্মজ্ঞ চারুশিল্পী কালিদাসের শিল্প-কর্মকা–র সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটলে তা অবশ্যই তাঁদের প্রেরণার এক উৎস হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
শিল্পী কালিদাস কর্মকার শিল্পের প্রকাশভঙ্গি এবং ধারা-প্রকরণ অনুসরণ কিংবা শিল্পোপকরণ গ্রহণের দিক থেকে ছিলেন বিচিত্র পথগামী। বিমূর্ত এবং বিমূর্ত-প্রকাশবাদী ধারার শিল্প-রচনার প্রতিই পক্ষপাতি মনোযোগ ছিল অধিকতর। তিনি বলতেন : মানব-সম্বন্ধীয় বিষয়াদি প্রভৃতি সম্পর্কে যতটুকু না প্রকাশ করা সম্ভব প্রকৃতি ও বস্ত্তর অনুলিপি তথা প্রতিরূপ সৃষ্টির মাধ্যমে তার চেয়ে অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে বিমূর্ত শিল্পধারার মধ্যেই। পরাবাস্তববাদী শিল্পধারার প্রতিও দুর্বলতা ছিল কালিদাসের। তারই সঙ্গে বহুল পরিচিত প্রতিরূপ এবং প্রতীকী বিষয়াদির সম্মিলন ঘটাতেন তিনি, আর এভাবেই কখনো-সখনো তান্ত্রিক এবং পবিত্র সত্তাও জুড়ে বসে তাঁর চিত্রপট প্রভৃতিতে। সবদিক থেকেই ব্যতিক্রমী শিল্পসাধক ছিলেন কালিদাস কর্মকার। তাঁর শিল্পভুবন সর্বতোভাবে সামগ্রিক অর্থেই ব্যতিক্রমী এক সৃজনশীল সাম্রাজ্য। স্বদেশচেতনা ও আন্তর্জাতিক শিল্পচেতনার সমন্বয় ঘটিয়ে চেষ্টা করেছিলেন অভিনবত্ব আনতে, প্রচলিত ছাঁচে ঢালা শিল্পপ্রবণতাকে এড়িয়ে নতুন কিছু করতে। কিছুটা অগ্রসর তিনি যে হতে পেরেছিলেন তা স্বীকার করতেই হবে। তরুণ প্রজন্মের চারুশিল্পীদের এ-বিষয়ে অনুপ্রাণিত করার দিকটি নিয়েও তিনি বিসত্মৃত পরিসরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তবু বলব, কালিদাস কর্মকার অধরাই থেকে গেলেন। এই গুণী শিল্পস্রষ্টার কদর বা
স্বীকৃতি-সম্মান, তাঁর কর্মকা- বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে, এখনো হয়নি। ভবিষ্যতে তা যদি হয় কখনো, তাহলে তা আমাদের শিল্পাঙ্গনকে নতুন আলোর সন্ধান দেবে।