॥ ১৬ ॥

  জেরেমিস :  হাই মোলি! চা খাবে? ইয়াসমিন চা বানাবে বলছে।

ইয়াসমিন : হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার হাতের চা সবাই ভালোবাসে। তোমার কেমন চা মোলি?
মোলি : আমি তো লিকার খাই। নো সুগার।
জেরেমিস : বসো মোলি।
মোলি : অ্যাকর্ডিয়ানটা …
ইয়াসমিন : [মোলির কথার মাঝে] জেরেমিস, তোমার পাশ ফেরা মুখের ছবি দারুণ হবে।
জেরেমিস : ধন্যবাদ ইয়াসমিন। মোলি কী বলছ?
মোলি : অ্যাকর্ডিয়ানটা …
ইয়াসমিন : [কথার মাঝে] তোমার একটা ফটেসেশন করব জেরেমিস। আপত্তি নেই তো?
জেরেমিস : অবশ্যই আছে। ক্যামেরার সামনে আমার নিজেকে হাবাগোবা মনে হয়। মোলি, বলো।
মোলি : … এটা সঙ্গে …
ইয়াসমিন : তুমি যে রান্না করো জেরেমিস, এটা তোমার পুরুষোচিত প্রকৃতির সঙ্গে একদম মানায় না।
জেরেমিস : দুঃখিত, তোমার কথা বুঝলাম না ইয়াসমিন। মোলি, কী বলছ? এটা সঙ্গে এনেছি কিনা! না। এটা আজই ভাড়া করলাম। তিন মাসের জন্য।
মোলি : এরকম ভাড়া …
ইয়াসমিন : [কথার মাঝে] ছেলেরা হুকুম করবে, মেয়েরা ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াবে। আমি যেমন চা করছি তোমার জন্য।
জেরেমিস : আমিও তোমার জন্য চা করতে পারি।
ইয়াসমিন : আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব জেরেমিস।
জেরেমিস : ধুৎ! আমাদের দেশে সবাই সব কাজ করে।
ইয়াসমিন : আমাদের পুরুষেরা কেবল হুকুম করে। কেবল শাসন করে। তাদের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করলে বা প্রেম করলে কুচুৎ করে গলাটা কেটে নেয়। ইংলিশে এর একটা দারুণ নাম আছে। অনার কিলিং। পাকিস্তানে বাপ-দাদা-স্বামী সব্বাইকে আমরা খুব ভয়ভক্তি করি। তাদের সম্মান তো আমাদের ওপর নির্ভর করে, তাই। এই নাও তোমার চা জেরেমিস।
জেরেমিস : ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। আমি ইংলিশ বুঝি না। তার ওপর তুমি খুব দ্রুত কথা বলছ।
ইয়াসমিন : তুমি যে ভাষা বোঝো, আমি তা জানি জেরেমিস। জেরেমিস : তুমি সেøাভিন জানো? দারুণ তো! আর কোন কোন ভাষা জানো তুমি? তোমার সঙ্গে সেøাভিনে কথা বলব। এতক্ষণ যা যা বললে সেøাভিনে বলো তো।
ইয়াসমিন : মোলি, দুঃখিত, এখানে আর বাড়তি কাপ নেই। তুমি কি ঘর থেকে নিয়ে আসবে?
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল অমলিনী। ইয়াসমিন তাকে সহ্য করতে পারছে না। সে আজ শিকারি। সে অবশিষ্ট দুনিয়াকে তার প্রতিপক্ষ ভাবছে। অমলিনীর কোনো প্রতিযোগিতা নেই। সে আড্ডাঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। আর ইয়াকভ দূর থেকে ডাকতে লাগল তাকে। ‘দেখো, দেখো মোলি! এটা তোমার ভালো লাগবেই।’ তার হাতে একটি তারের বাদ্য। অনেকটা গিটারের মতো। কিন্তু গিটার নয়।
ইয়াকভ : খুব ক্লান্ত নাকি মোলি?
মোলি : না তো। কেন বলো?
ইয়াকভ : তোমাকে সবসময় উজ্জ্বল দেখায় মোলি। কিন্তু এখন যেন তুমি বিষাদে কালো হয়ে গিয়েছ। এমন কেন মোলি? আনন্দে থাকো! চলো চলো। তোমাকে এই বাজনাটা শোনাব। আমার সবচেয়ে প্রিয়। জেরেমিস পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান ভাড়া করেছে। সেও বাজাবে। চলো। আমিও একটা গিটার ভাড়া নিলাম।
মোলি : তুমি আড্ডাঘরে যাও, আমি আসছি। চা খাবে? তাহলে তোমার কাপ আনব।
ইয়াকভ : তুমি বানাচ্ছ?
মোলি : ইয়াসমিন বানিয়েছে। বলল এ-ঘরে কাপের অভাব। আমি তোমার কাপ আনছি।
দুটি কাপসহ আড্ডাঘরে ফিরে অমলিনী দেখল পটে চা ভিজিয়ে চলে গিয়েছে ইয়াসমিন। সে চা ঢালতে লাগল। ইয়াকভও চায়ে
দুধ-চিনি খায় না। জেরেমিস বলল, ‘শি লাইড।’
ইয়াকভ : কে?
জেরেমিস : ইয়াসমিন। বলল সেøাভেনিয়ান জানে, বাট শি লাইড।
মোলি : তোমার রান্না কেমন হলো?
জেরেমিন : দারুণ! এখন কদিন নিশ্চিন্ত। তুমি না থাকলে আমি বড়ই বিপদে পড়তাম। তুমি নৈশভোজ সেরেছ?
মোলি : এখনই! সাড়ে দশটার আগে নয়।
জেরেমিস : সাড়ে দশটা! আমি তো ছটায় শেষ খাবার খাই। হেভি ব্রেকফাস্ট। হেভি লাঞ্চ। লাইট ডিনার।

মোলি : আমাদের দেশে এসব কেউ মানে না। তাই সব্বার মস্ত পেট, বিশাল অম্বল, গ্যাস Ñ কিন্তু সবাই দারুণ পেটুক!
জেরেমিস : হা হা হা!
ইয়াকভ : হো হো হো!
জেরেমিস : কিন্তু তুমি তো মোটা নও। মোটা হলো ইয়াসমিন, রোজানা, হারিক। মোটা মেয়ে আমার একদম ভালো লাগে না।
মোলি : আহা! ইয়াসমিনের সব প্রয়াস কি বিফল হলো?
জেরেমিস : তুমি খুব দুষ্টু মেয়ে মোলি!
ইয়াকভ : মোলি খুব ভালো। নমস্কার মোলি।
মোলি : নমস্কার! নমস্কার! এটা কী যন্ত্র ইয়াকভ।
ইয়াকভ : এটার নাম তম্বুরা। আমাদের ম্যাসিডোনিয়ার অত্যন্ত ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন যন্ত্র। আমার বাঁশি তোমার ভালো লাগেনি, তম্বুরা কেমন লাগে জানিয়ো।
মোলি : একটু অভ্যাস করলেই তুমি খুব ভালো বাঁশি বাজাবে ইয়াকভ। তুমি কি জানো, ইন্ডিয়ায় একটা যন্ত্র আছে, তার নাম তানপুরা। আগে তাকে তম্বুরাই বলা হতো। এখনো কর্ণাটকে তম্বুরা বলে। এতে মাত্র চারটে তার। কোনো সুর বাজানো যায় না। কিন্তু একটা সুরচক্র তৈরি করে দেয় যেটা গায়ক বা বাদককে সাহায্য করে।
ইয়াকভ : আমি জানি। তোমাদের তানপুরা আর আমাদের তম্বুরার উৎস এক। তনবুর হলো পারসি শব্দ। তনবুর মানে এই গোল ও লম্বা
আকৃতির যন্ত্র।
মোলি : বাজাও।
টুকরো টুকরো সুর বাজাতে লাগল ইয়াকভ। অল্প অল্প জড়তা আছে হাতে। কিন্তু ভারি মধুর শব্দ। সে আর জেরেমিস মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। ইয়াকভ যেন কোনো সুরেই স্থিত হতে পারছে না। যেন সঠিক সুরটি খুঁজে বেড়াচ্ছে, যা এই মুহূর্তের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী। কিন্তু তার অনভ্যস্ত সুরের মধুরতা ২১৫নং ঘরের আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। করিডোরে বেড়াতে লাগল এই দানিয়েলের আত্মার মতো। দানিয়েল, দানিয়েল। অমলিনীর সুখে যার সুখ, অমলিনীর দুঃখে দুঃখ। দানিয়েল, দানিয়েল। আমার হৃদয় সুরে সুরে মিশে রাইটারদের দুয়ারে দুয়ারে সংগীতের বার্তা পৌঁছে দিতে লাগল। এসো। শোনো। ম্যাসিডোনিয়ার স্বপ্নিল কবি ইয়াকভ মিষ্টি মধুর বাজনা এনেছে তার দূরের দেশ থেকে, শুধু এখানকার মুহূর্তগুলো সুরে সুরে ভরিয়ে দেবে বলে। সেøাভেনিয়ার জেরেমিস পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান ভাড়াই করে ফেলল! আমার মৃগনয়নী অ্যামেলিয়া ভারতের অমলিনী সুরের মায়ায় কোন আনন্দলোকে পৌঁছে গিয়েছে দেখো এসে! … আমার নীরব বারতা রাইটারদের অনুভবতন্ত্রীতে ধরা পড়ল ঠিক! ক্লান্তি ও জড়তা ঠেলে একে একে আসতে লাগল তারা। শবনম, রোজানা, হারিক, জর্জ, রুবা, রুথ, কাম্বা, মানঘিল, সের্গেই, আমাদায়ুং, লিলি, হাসিন, ক্যাথি, মেইমি, আদনাশে।
অবশেষে একটি সুরে স্থিত হয়েছে ইয়াকভ। তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছে। সুর, লয়, ছন্দ সবই এখন তার করায়ত্ত। জেরেমিস ও অমলিনী মগ্ন হয়ে শুনছে। রাইটাররা ছায়ার মতো নিঃশব্দ। যে-সুরখানি বাজাচ্ছে ইয়াকভ, অমলিনীর কাছে তা পরজ রাগ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হচ্ছে তার অতিপ্রিয় এক রবীন্দ্রগান।
প্রায় কুড়ি মিনিট বাজিয়ে ইয়াকভ থামল। সুরসম্মোহিত শ্রোতারা হাততালি দিতে ভুলে গেল। অমলিনী প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের পরজের সুর। পরজ রাগ।’
ইয়াকভ : রাগ? গাও, প্লিজ!
মোলি : বাংলা গান যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান।
ইয়াকভ : তাগোর। গ্রেত তাগোর। হি ইজ মাই ফেভারিত।
অমলিনী গাইতে লাগল :
ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে।
নিদ্রামগন যবে বিশ্বজগৎ,
হৃদয়ে আসিয়ে নীরবে ডাকো হে ॥
তোমারি অমৃতে ॥
জ্বালো তব দীপ এ অন্তরতিমিরে
বার বার ডাকো মম অচেত চিতে ॥
ধীরলয়ে, সুরঋদ্ধ কণ্ঠে, শুদ্ধ উচ্চারণে, রবীন্দ্রগানে জড়ানো পরজ রাগের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে লাগল সে। তার চোখ বন্ধ ছিল, তাই দেখতে পাচ্ছিল না, সুরের মায়া, কণ্ঠের দরদি উদ্ভাস রাইটারদের আবেগ উসকে তুলছে। তারা অভিভূত। মেইমি, রোজানা, হাসিন ও ক্যাথির চোখে জল।
বাংলা জানে না, ভারতীয় দর্শন জানে না, উপনিষদ বোঝে না, ইয়াকভের মতো তাগোর সম্পর্কে ধারণাও হয়তো অনেকের নেই। তবু কী শক্তি ওই সুরের, ওই গানের, ওই হৃদয়মথিত আবেদনের! সে গান শেষ করে চোখ মেলল, দেখল শবনম তার গান রেকর্ড করছে। মেইমি হেসে চোখ মুছল। রাইটারদের হাততালির মধ্যেই গান ধরে ফেলল রোজানা। আরবি সংগীত। সুরেলা আজানের মতো স্তরের পর স্তর ছড়িয়ে তার গান ভেসে গেল আকাশে আকাশে। এক করুণ আত্মনিবেদনের সুরতরঙ্গে বুঁদ হয়ে গেল রাইটারদের দল। অমলিনী দেখল, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান কোলে তুলে নিচ্ছে জেরেমিস।
আত্মনিবেদনের তন্ময়তা ছাপিয়ে, ছিন্ন করে, কারুণ্যের ঘোর ভাঙিয়ে ঝমঝম করে উঠল জেরেমিসের পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান। দক্ষ, অভ্যস্ত হাতে অপূর্ব ঝংকার তুলল সে। ইয়াকভ ক্ল্যাসিক বাজিয়েছিল, অমলিনী ও রোজানাও ক্ল্যাসিক গেয়েছে। কিন্তু জেরেমিসের বাজনা আধুনিকতার যৌবনোচ্ছ্বাসে ভরপুর।
তার বাজনার সঙ্গে মানানসই করবার জন্য গিটার নিয়ে এলো ইয়াকভ। জর্জ একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে এলো। জিয়াং, অ্যালেক্স, ফিলিপ ও সের্গেই এসে জুটল। এক বোতল হুইস্কিতে কী হবে? অতএব আরো এক বোতল নিয়ে এলো অ্যালেক্স। অমলিনী হুইস্কি পছন্দ করে না। ঘরে সুরের যে-মায়া তৈরি হয়েছিল, তার ঘোর ভেঙে যাওয়ায় তার আর ভালোও লাগছিল না। সে উঠবে বলে ভাবছে, মেইমি এসে পাশে বসল। অমলিনীর গলা জড়িয়ে বলল, ‘আমি তোমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার যে বই থেকে ইয়াপ ওয়েবসাইটে লেখার নমুনা দিয়েছ, আমাজনে কিনে আমি পড়েছি। তুমি অত্যন্ত প্রতিভাময়ী।’
অমলিনী বলল, ‘সত্যি? খুব খুশি হলাম। তোমার লেখা আমি পড়ব মেইমি। জেনিফার বলছিল তুমি খুব ভালো লেখো।’
মেইমি : চলো, আমরা একটু হুইস্কি খাই। আজ আমার জন্মদিন।
অমলিনী : জন্মদিন? তোমার? আরে, আমাদের মধ্যে প্রথম একটা জন্মদিন এলো, উদ্যাপন করব না?
মেইমি : না না, কাউকে বোলো না। প্লিজ!
অমলিনী : তোমার ভালো লাগবে না, সবাই আনন্দ করলে?
মেইমি : লাগবে। কিন্তু নিজেই নিজের জন্মদিন … আই’ম নট এ চাইল্ড!
অমলিনী বলল অ্যালেক্সকে, অ্যালেক্স জর্জকে, জর্জ ক্যাথিকে, ক্যাথি বলল ইয়াকভকে, ইয়াকভ সের্গেইকে। সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন! শুভ জন্মদিন মেইমি। উই মাস্ট সেলিব্রেট।’
রুথ লাফিয়ে একটা চেয়ারে উঠে পড়ল। বলে উঠল, ‘কেউ চলে যেয়ো না। আমাদের ফেসবুক সংযোগ হয়নি এখনো। না হলে সকালেই জানতে পারতাম মেইমির জন্মদিন। আমরা এখন জন্মদিনের উৎসব করব।’
কেউ গেল বাকিদের ডেকে আনতে, কেউ গেল কেক, মদ ও খাবার আনতে। সবাই পাঁচ ডলার করে চাঁদা দিলো। খাদ্য ও মদের খরচসহ মেইমির জন্য উপহার কেনা হবে। শবনম বলল, ‘আরে ছাতার শহরে, সব দোকান এতক্ষণে বন্ধ। এসব পাবে নাকি!’
জেনিফার : কেন? আমরা ওয়ালমার্ট যাব। সারারাত খোলা থাকে। আর সব পাওয়া যায়।
কাম্বা : আমি জানি, এখান থেকে মাত্র দশ মিনিট ড্রাইভে একটা ওয়ালমার্ট আছে।
অ্যালেক্স : আমি উবর ডাকছি। জেনিফার তুমি যাবে? জর্জ, তুমি?
দারুণ লজ্জায় একেবারে নরম হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার মেইমি। অথচ তার লাজুক হাসিতে অসম্ভব ভালো লাগার ব্যঞ্জনা। সে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘সব প্রভু যিশুর কৃপা। এই দূরপ্রবাসে, পরিবার-পরিজন ছাড়া, আমি ভাবতেও পারিনি এত আনন্দ, এত শুভেচ্ছা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের মধ্যে এখনো ভালো করে চেনাজানাও হয়নি! আমি সত্যিই অভিভূত।’ (চলবে)