ষাটের কবি হায়াৎ সাইফ একটি উপক্রমণিকা

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কবি হিসেবে যাঁদের কপালে তিলক কাটা হয়েছে, হায়াৎ সাইফ তাঁদেরই একজন। এঁদের অনেকে কবি হিসেবে যৌবনেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, অনেকেই কবিতার অঙ্গন পরিত্যাগ করেছেন। রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেলাল চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, রবিউল হুসাইন, আসাদ চৌধুরী পূর্বাপর কবিজনোচিত জীবনযাপন করেছেন। সিকদার আমিনুল হকও। সত্তরের দশকেই তাঁদের কবিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, কবিযশ অর্জিত হয়েছে। তাঁদের অনুজ মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, আবিদ আজাদ প্রমুখও দ্রুত প্রতিষ্ঠার মুখদর্শন করেছেন। পরবর্তীকালে সৈয়দ শামসুল হকও কবি হিসেবে পরিব্যাপ্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। তাঁদের কাব্যাবলির কতটুকু খাদ কতটুকু সোনা, সময়ের নির্মম কষ্টিপাথরে তা পরখ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো প্রতিভাদীপ্ত কবি কবিতার জগৎ সর্বৈব পরিত্যাগ করেছেন।
তবে এ-কথা কবুল করে নিতে হবে যে, হায়াৎ সাইফ ষাটের দশকের প্রধান একজন কবি হিসেবে পরিচিতিলাভ করেননি। ২০১৮-তে সদাশয় সরকার তাঁকে ‘একুশে পুরস্কার’ প্রদান করলেও সর্বজনবিদিত তথ্য এই যে, তাঁর কবিখ্যাতি ছিল সীমিত। জীবনের শেষবেলায় ‘একুশে পুরস্কার’ না জুটলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হায়াৎ সাইফের কবিতা নিয়ে বেশি কিছু লেখার থাকত কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলে তাঁর প্রতি অবিচার হবে না।
বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে বিখ্যাত হওয়ার জন্য বহুলপ্রজ হতে হয়। পত্রপত্রিকার সংখ্যা প্রচুর, এগুলোতে নিয়মিত প্রকাশ করতে হয়। তার সঙ্গে নাটকীয় জীবন থাকলে ভালো, দীর্ঘ শ্মশ্রু ও ফাজলামো উপকারী প্রমাণিত। রাজনীতিকদের সঙ্গে কাতারবন্দি হয়ে উদগ্র দেশাত্মবোধক, বন্দনামূলক কবিতা লিখলেও অতিরিক্ত সুবিধা হয়। অন্যদিকে হায়াৎ সাইফের মধ্যে এসব বাজারচলতি গুণাবলির অভাব ছিল প্রকট। এসব কারণে তিনি নামি কবিদের সারিতে স্থানলাভ করেননি। বাংলা একাডেমির মহাজনরা কদ্যপি তাঁর কবিতা বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি।
এজন্য তাঁকেই সবিশেষ দায়ী করতে হবে। তিনি প্রচুর লেখেননি; অধিকন্তু যা প্রকাশ করেছেন তার প্রচারে একবিন্দু মনোযোগ দেননি। এদিক দিয়ে অগ্রজ আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর তুলনীয়। কিন্তু অগ্রজের যতটুকু পরিচিতি তাও অনুজের নেই। উভয়েই অস্থিমজ্জায় কবি Ñ নিছক ‘কবিতা লেখক’ নন। তারপরও চলনে-বলনে কবি বলা যাবে না। উচ্চপদস্থ চৌকস আমলার সর্বগুণে দুজনেই গুণান্বিত ছিলেন। কিন্তু না তাঁরা কবিদের আড্ডায় হাজির থাকতেন, না কবিতা পকেটে পুরে সাহিত্য সম্পাদকের দপ্তরে হানা দিতেন। মোদ্দা কথা, কবিযশঃপ্রার্থী বলতে যা বোঝায়, তাঁদের কেউ সেরূপ ছিলেন না। তাঁরা ব্যস্ত দাপ্তরিক জীবনের শেষে ঘরে ফিরে কখনো কবিত্বকে হাতকড়া দিয়ে কাগজে নামিয়েছেন মাত্র; কখনো প্রকাশ করেছেন, কখনো করেননি। অথচ বিংশ শতকের বাংলা কবিতার ইতিহাসে দীর্ঘ কবিতার যদি মূল্য দিতে হয় তবে আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ অথবা ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ সর্বাগ্রে স্মরণ করতেই হবে।
হায়াৎ সাইফের জমা-খরচের খাতায় ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ বা ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ নেই; নেই বহুবিশ্রুত ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা’। সৌভাগ্যের বণ্টনে তিনি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর সমভাগ্যবান নন। অথচ তাঁর সার্বিক কাব্যে অজস্র স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা রয়েছে যা না পঠিত হয়েছে, না হয়েছে আলোচিত। তথাপি সুপুরুষ হায়াৎ সাইফ যখনই সুকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেছেন, তখনই ধ্বনি-ব্যঞ্জনায় একটি আসর জমে উঠতে বিলম্ব হয়নি। তিনি একের পর এক কবিতা পাঠ করছেন, শ্রোতা ক্রমে মুগ্ধতর হচ্ছে। তাঁর কবিতা কেবল বোঝার নয়, শোনারও বটে। এর মধ্যে স্বকীয় একটি ধ্বনিতরঙ্গের সুর রয়েছে যা সঠিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী সংগীতের মতোই শ্রুতিমধুর হয়ে বিভাসিত হয়। তাঁর কবিতা শব্দের এক স্বতঃস্ফূর্ত অভিযাত্রা, যা অক্লেশে পাঠককে হৃদয়ানুভূতির একান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কবিতা পাঠের আসরে হায়াৎ সাইফের শ্রোতারা সহসাই আবিষ্ট হয়ে পড়তেন।

দুই
ইতিহাস যতই অতীত হতে থাকে, ততই নিরপেক্ষতা ও নির্মমতার পরিচয় দিয়ে থাকে। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া সে কাউকে স্থান দিতে চায় না। কবি সাজ্জাদ আরেফিনের আদেশক্রমে পশ্চিম বাংলার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে সম্প্রতি তত্ত্বতালাশ করে এরকম প্রতীতীই জন্মেছে : তাঁর সম্পর্কে বই-পুস্তকে আলোচনা নেই বললেই চলে। কৌতূহলী পাঠক আধুনিক বাংলা কবিতা জাতীয় অনেক বই খুলে দেখতে পারেন; এতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনা দূরে থাক, নাম পর্যন্ত দেখবেন না।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩) জীবদ্দশায় প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় বিরাজমান ছিলেন। আজ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত’ এবং ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা’ ইত্যাদি কয়েকটি পঙ্ক্তিনিচয় মাত্র। জীবনানন্দ যা-ই বলে থাকুন না কেন, অডেন-কথিত এক-দুটি ‘স্মরণীয় বাণী’ না-লিখতে পারলে কবিজীবন বৃথা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আর হায়াৎ সাইফের মতো কবি যিনি অপরিচয়ের দূরত্বে থেকে জীবনযাপন করেছেন তাঁর কবিযশ এক অসম্ভব প্রকল্প।
এই সূত্রে আহমদ ছফার কথা উল্লেখ করতেই হয়। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান চিন্তক ও লেখক আহমদ ছফাকে বিস্মরণের সমাধি থেকে উদ্ধার করে যথাপ্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শত্রুও স্বীকার করবেন, তাঁর চেষ্টা বিফলে যায়নি। গত কুড়ি বছরে আহমদ ছফা সম্পর্কে পাঠকের মনে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আশঙ্কা হয়, আহমদ ছফাকে গণনীয় ‘কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আরো সময় লাগবে। এই উদ্যোগ মহতী; আমরাও এতে সানন্দে শরিক রয়েছি। আহমদ ছফার কবিতার প্রকৃত মূল্যমান একদিন নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে Ñ এই আশা আমাদের বুকেও কিঞ্চিৎ রয়েছে। আমরা অন্যত্র বলেছি : বাংলা ভাষায় দীর্ঘ কবিতার ইতিহাস লিখতে গেলে আহমদ ছফার ‘লেনিনের সমাধি’, ‘বস্তি উজাড়’ প্রভৃতির কথা আলোচনা না-করে উপায় নাই। আহমদ ছফা কবি Ñ এই পরিচয় প্রচারিত না-থাকলে তাঁর অমূল্য কবিতাবলি অপঠিত থেকে যাবে। পাঠক বঞ্চিত হবেন।
কবুল করে রাখি : আহমদ ছফার ব্যাপারে সলিমুল্লাহ খানের যে ধনুর্ভঙ্গপণ তা আমাদের নেই, তদুপরি কবজির জোরও অশক্ত। অতএব আমরা কেবল কবি হায়াৎ সাইফের কবিসত্তার একটি অবিস্তীর্ণ মানচিত্র অঙ্কনের প্রচেষ্টা নেব। এটা এক ফোঁটা শিশিরের বেশি Ñ এরূপ না-হক দাবি আমরা করছি না।
এই নিবন্ধের একটি উদ্দেশ্য তো এই যে পাঠক তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত হতে আগ্রহ বোধ করবেন। দ্বিতীয়ত, তিরিশের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতার কতটুকু তিনি ধারণ করেছেন এবং একই সঙ্গে তিরিশ থেকে কতদূর পৃথক হয়েছেন তার তত্ত্বতালাশ করা। তৃতীয়ত, বলা হয়ে থাকে হায়াৎ সাইফ ষাটের কবি Ñ এই মন্তব্যটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব যাচাই করে দেখা।

তিন
হায়াৎ সাইফের যে-কবিকৃতি তা স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হলেও পূর্বজ কবিদের নির্মিত ভিত্তিভূমির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। তাঁর রচনাশৈলীর মৌলিক প্রবণতা সর্বাংশে উপস্থিত এরকম একটি কবিতাংশ দিয়ে আলোচনা অগ্রসর হতে পারে :
অকস্মাৎ খুলে গ্যালো জাগ্রত আলোকিত দিন
চতুষ্পার্শ্ব সমুজ্জ্বল হলুদে পিঙ্গলে বর্ণের
প্রস্রবণ যেন ছোটে দিগি¦দিক Ñ উত্থিত লাঙল যেন ধাবমান বৃষ এক
স্ফুরিত নাসায় আর গলকম্বলে বুঝি বা আন্দোলিত অন্তরীণ গোপন তাবিজ।
বহুকাল শিখায়েছো রাত্রি এলে গতদিন পাপক্ষয়,
স্নায়ুতে তন্ত্রীতে বুঝি বা স্পন্দিত গান
আরেকটু কাছে এসে থামে তার পরিচিত আয়ুর বলয়,
যদিও বিলয়বোধ নিকষ আঁধারে তার ঠিকানা মজ্জিত
ক্রন্দিত কোলাহল থেকে দূরে,
তর্জনি সঙ্কেতে কোনোদিন ঘটেনি তো মূল্যবান নীতির প্রলয়;
অমেয় বিলাস তার রাখা নেই গোপন সিন্দুকে
রাখা নেই প্রখ্যাত কোনো এক জাদুর প্রদীপ; Ñ
হায়াৎ সাইফের উপরিউদ্ধৃত কাব্যাংশে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অকপট উত্তরাধিকার প্রকট। শব্দচয়ন কি পঙ্ক্তিবিন্যাস Ñ উভয়ই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নির্ভেজাল মুদ্রায় অঙ্কিত। ত্রিশের দশকের কবিরা বাংলা কবিতায় আধুনিকতার জনক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সকলেই একই রকমে কবিতা রচনা করেননি। জীবনানন্দ দাশ আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে কাব্যবোধ ও বাগ্ভঙ্গির ব্যাপক পার্থক্য ছিল। বস্তুত ‘ব্যাপক পার্থক্য ছিল’ বললে যথার্থ হয় না, বরং এরূপ সমীচীন হবে যে, তাঁদের মধ্যে ব্যবধান ছিল মেরুপ্রতিম Ñ তাঁরা দুজনে দুই ভিন্নগ্রহের নাগরিক।
সে যাই হোক, যাঁরা হায়াৎ সাইফের সমসাময়িক, তাঁদের সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। হায়াৎ সাইফের যাঁরা সমূহ অগ্রজ Ñ শামসুর রাহমান কি আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর কি হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী কি ফজল শাহাবুদ্দিন Ñ তখনো কবিতার নতুন কোনো বিশিষ্ট আদল দৃঢ়ভিত্তিতে গেঁথে তুলতে পারেননি। তাই প্রত্যক্ষ হয়, এমনকি পরাবাস্তবতাপ্রেমী আবদুল মান্নান সৈয়দও কখনো কখনো সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাববলয়ের অন্তর্ভুক্ত থেকেই কাব্যরচনা করেছেন। এই প্রস্তাবের সমর্থনে পাঠক সৈয়দ সাহেবের ‘বেগানা সেরেনাদ’ কবিতাটি এক চিমটি চেখে দেখতে পারেন :
তোমার একটি চোখ ফেলে গেছো আমার কৈশোরে, হে
বৈদেহী, নাস্তিক নেমির মধ্যে জন্মমৃত্যু একাধারে তুমি; ধর্মাধর্ম
লুফে নিয়ে অঙ্গুলিরুচিতে খেলা করো, কিবা দীর্ঘ নোখের
ত্রিকোণে এমুড়োওমুড়ো চিরে ফ্যালো হৃৎপি- আমার,
তুমি র’বে আমার শারদ বিদ্যা, অলৌকিক শ্রাবণরজনী
তোমার বৈকুণ্ঠ থেকে অকুণ্ঠ ক্ষরণ; চন্দ্রাবলী, আমার
সমগ্র দর্প তোমার সম্মুখে আনত আভূমি; যদি আশুতোষে
যাই, আমি র’বো তোমার অধিকতর সঞ্চিত।
(‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
মান্নান সৈয়দের উপর্যুক্ত পদ্যে শব্দচয়নে কেবল নয়, শব্দবিন্যাসেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নির্ভুল প্রভাব প্রকটিত। হায়াৎ সাইফকে ‘সুধীন দত্তীয় ঘরানার কবি’ বললে তিনি মুচকি-মুচকি হাসতেন। অন্যপক্ষে, মান্নান সৈয়দের নিকট থেকে এরকম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বীকারোক্তি কখনো পাওয়া যায়নি। উপরন্তু তিনি নিজেকে উত্তর-তিরিশের প্রতিভূ বলেই দাবি করতেন। জীবনানন্দ-প্রেমিক মান্নান সৈয়দ কেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের হাতে নাড়া বাঁধার কোশেশ করেছিলেন তা একটি দুর্জ্ঞেয় রহস্য।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনপনেয় ছায়াপাত থাকলেও বড় কথা এই যে, হায়াৎ সাইফের একটিও কবিতা নেই যা সুধীন দত্তের অসমর্থ অনুকৃতি বলে প্রতীয়মান হতে পারে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা ‘শাশ্বতী’। ‘শাশ্বতী’র মতো একটি কবিতাও হায়াৎ সাইফ রচনা করেননি; বড় কথা, এরকম একটি কবিতার জন্য তিনি উৎকণ্ঠিতও হননি কিংবা এরকম প্রচেষ্টায় তিলমাত্র কালক্ষয় করেননি। সম্প্রতি ঢাকার ‘অনন্যা’ প্রকাশনা সংস্থা হায়াৎ সাইফের কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাঠক লক্ষ করবেন, সুধীন দত্তীয় প্রভাব একসময় অবসিত হয়েছে এবং হায়াৎ সাইফ একপর্যায়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে লিখতে শুরু করেছেন। সুধীন দত্তীয় মুদ্রাদোষ কাটিয়ে উঠতে তাঁকে আদৌ ক্লেশ পেতে হয়নি তার কারণ কাব্যবোধে তিনি সুধীন দত্তের কাছে ঋণী ছিলেন না। তিনি কেবল শৈলীতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

চার
কবিতার ইতিহাস মূলত টেকনিকের ইতিহাস বললে ষাটের দশকের প্রকৃত পরিচয় অনবগুণ্ঠিত হবে না। ষাটের দশক পূর্ববঙ্গের কবিদের কাব্যচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। পূর্ববাংলায় বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এটি একটি ক্রান্তিকাল। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বাঙালির মনস্তত্ত্বে গভীর ও সর্বগ্রাসী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। ষাটের দশক সম্পর্কে হায়াৎ সাইফের পর্যবেক্ষণ স্মরণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘ষাটের দশকে ছিল নানাবিধ আন্দোলন এবং একটা ভবিষ্যতের স্বপ্নকে দীর্ঘ সময় ধ’রে লালন করবার অভিজ্ঞতা ও আশায় বুক বাঁধবার শক্তি। সদ্য উদ্ভূত মধ্যবিত্ত তখন শিক্ষা-দীক্ষায় এই ভূখ-ে জেগে উঠছে এবং তার আত্মশক্তির উদ্বোধনও ঘটেছে। স্বৈরাচারকেও তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সরাসরি অভিজ্ঞতায় দেখেছিলেন নব্য সাম্রাজ্যবাদের সমূহ উত্থান ও বিপুল আগ্রাসন। তাঁরা দেখেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র এবং তার বিরুদ্ধে তাঁরা সাংস্কৃতিকভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন একটা স্বোপার্জিত নান্দনিক উৎকাক্সক্ষা, আত্মশক্তি ও আদর্শ নিয়ে। সেই সময়ে বহির্বিশ্বের নানাবিধ সাহিত্যিক আন্দোলনও তাঁদেরকে বেশ প্রভাবিত করেছিল।’
হায়াৎ সাইফের অপ্রতিরোধ্য ব্যাখ্যা ষাটের দশকের মূল্যবান তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। ষাটের দশকের পূর্ববঙ্গে জন্ম নিয়েছিল একটি প্রগাঢ় দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ, যা কবিদের কাব্যচেতনায় গভীর শিকড় মেলেছিল। এটা সমর সেনের ঘোষণা ‘আমি রোম্যান্টিক নই, আমি মার্কসিস্ট’ থেকে পৃথক। ষাটের দশকের এরকম আত্মোপলব্ধি হায়াৎ সাইফের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে সুরমূর্ছনায় :
আদ্যন্ত ধরাশায়ী কাটাগাছ বিশুষ্ক মাটিতে কাঁদে
বৃষ্টি নেই গুঁড়ো ওড়ে করুণ কা- থেকে কঠিন করাতে
প্রভাতফেরীও ফেরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ক্লান্ত হয় সুর
খিন্ন খঞ্জনার মতো শোভাযাত্রা থামে
উচ্ছ্বাস উদ্দামতা প্রশমিত হ’য়ে আসে মুমূর্ষু বাতাসে
আর, বার বার ফিরে আসে অনন্য ফাল্গুন Ñ ঐ এক সুখ,
কেননা দৃষ্টি ফিরায়ে দ্যাখো Ñ পাতার ভিতরে ছিলো
আজ যৌবন ছুঁয়েছে তার বুক
নৃত্যের মতোন তাই রক্তে বাজে বিদগ্ধ বেহাগ
(‘গাছকাটা’)
অন্যত্র,
অথচ মøান সন্ধ্যায় সেই কোন পা-ুর পাড়াগাঁর কুঁড়েঘরে
ছেঁড়া থানপরা মৃন্ময়ী শীর্ণা জননী
বখাটে ছেলে আর নষ্ট হয়ে যাওয়া উঠতি বয়েসী
মেয়েটিকে এখনও কেন যেন ক্ষমা করে দিয়ে
ক্ষীণ হেসে ধীরপায়ে শূন্য হেঁসেলের দিকে হেঁটে চলে যায়।
নিসর্গপৃষ্ঠ হে বঙ্গভূমি, স্বদেশ আমার,
একটি দীর্ঘশ্বাসেও কি কখনো আলোড়িত হয়ে ওঠে
নির্লিপ্ত নির্লজ্জ তোমার জলবায়ু?
(‘জননীর নাম’)
ষাটের কাব্যবোধ আত্মজৈবনিকতা ও দেশাত্মবোধের অজাতপূর্ব মিশ্রণ। এই চেতনা ক্রমশ নিবিড় হয়েছে এবং কাব্যচেতনাকে অপসারণ করেছে। দেশাত্মবোধ অনেকের ক্ষেত্রেই প্রধানত কাব্য প্রেরণায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে হায়াৎ সাইফ দেশাত্মবোধকে সর্বগ্রাসী হতে দেননি।

পাঁচ
নিবন্ধের প্রারম্ভে আমরা লিখেছি যে হায়াৎ সাইফ স্বল্পপঠিত হলেও তাঁর সার্বিক কাব্যে অজস্র স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা রয়েছে, যা পঠিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা জানিয়েছি : সুকণ্ঠ কবি যখনই দৃঢ় অথচ স্বচ্ছ স্বরে স্বীয় রচনা পাঠ করেছেন, তখনই ধ্বনি-ব্যঞ্জনায় একটি আসর জমে উঠত। হায়াৎ সাইফের প্রতীতী এরকম যে, কবিতার অনুষঙ্গে শব্দের ধ্বনিরূপ একেবারে মৌলিকভাবে প্রয়োজনীয়। তিনি মনে করেন : নিঃশব্দ দ্রুত পঠনে কবিতা আসলে হারিয়ে যায়। পরীক্ষার খাতিরে যখন স্কুল-কলেজে কবিতা অধ্যয়ন করতে হয়, তখন কবিতার একরূপ অপমৃত্যু ঘটে। এই কারণে তিনি স্বকণ্ঠে স্বীয় কবিতা পাঠ করতে সদাপ্রস্তুত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন : কবিতা কেবল বোঝার নয়, শোনারও বটে। এই মন্তব্যের সমর্থনে একটি উপযুক্ত উদ্ধৃতি পাঠক দাবি করতেই পারেন :
… আমার সমগ্র জাগরণ ও নিদ্রা স্বপ্ন ও চেতনা স্থৈর্য ও চঞ্চলতা
যেন কেন্দ্রীভূত একটি চৈতন্যের ভেতরে আবর্তিত হতে থাকে
আন্দোলিত হতে থাকে নিঃশেষিত হতে থাকে
পাপের জন্যে নয় পূণ্যের জন্যে নয় জীবনের জন্যে নয় মৃত্যুর
জন্যে নয়
বিলাসের জন্যে নয় কৃচ্ছ্রতার জন্যে নয় প্রকৃতির জন্যে নয়
পুরুষের জন্যে নয়
কেবলমাত্র চলমানতার জন্যে
আমার ভেতরে নদী বাহিরেও নদীর উপমা।
(‘নদী ও মানুষ’)
হায়াৎ সাইফের কাব্যে স্বকীয় একটি সুর রয়েছে, যা সঠিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ধ্রুপদী সংগীতের মতোই শ্রুতিমধুর হয়ে বিভাসিত হয়। এই বিষয়টি কিঞ্চিদধিক গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শিল্পের হায়ারার্কিতে সংগীতের অধিষ্ঠান কবিতার এক কাঠি ওপরে বলেই সাহিত্যের মহাজনেরা রায় দিয়ে এসেছেন। হায়াৎ সাইফের কবিতা-মন্দ্র সাংগীতিকতায় ঋদ্ধ : তাঁর কবিতার শরীরে, শব্দের বুননে, দুটি পদের অভ্যন্তরে, দুটি যতিচিহ্নের অবকাশে সংগীত সঞ্চিত রয়েছে। উচ্চকণ্ঠ পাঠের সময় এই সংগীত পর্যায়ক্রমে অবমুক্ত হয়ে পাঠকের অনুভূতির বীণায় তোলে অব্যর্থ সুর। তখন উচ্চারিত শব্দাবলি কবিতা হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় কবিতা একরূপ শ্রুতিশিল্পও বটে। এই প্রসঙ্গে কবি নিজেও পূর্ণরূপ সচেতন ছিলেন। তিনি লিখেছেন :
কবিতা কেমন ক’রে পাঠকের মনের মধ্যে কাজ করে তা’ বিভিন্ন সময়ে প-িতেরা নানাভাবে ভেবে দেখেছেন। কিন্তু একজন কবি কবিতা রচনা করেন কেন তার সঠিক উত্তর কোন কবি হয়তো একইভাবে দেবেন না। কবিতা কেমন ক’রে তৈরি হয়, তার কোন নির্ধারিত ফর্মুলা দেয়া যায় না। কারণটা হয়তো এই যে, কবিতার ভাষা সাহিত্যের অন্য সব আঙ্গিকের ভাষা থেকে একেবারে আলাদা এবং এই অনন্যতাই কবিতার বোদ্ধাকে প্রধানত আকৃষ্ট করে।
এই সূত্রে হায়াৎ সাইফ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তিনি বলছেন, কবিতা দীর্ঘদিন ছিল কেবল শ্রুতির বিষয়, কেবল শোনার নয় মনে রাখারও বিষয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন :
মানব সংস্কৃতিতে গত পাঁচ শতাব্দী জুড়ে মুদ্রণযন্ত্রের কারণে ভাষার যে-কোনো শৈলীর সৃষ্টি আমরা শুনতে নয় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এই অভ্যাস অল্পদিনের। এর আগের অন্তত তিন সহস্রাব্দ ধরে মানুষ কেবল শুনেছে। নদীর কুলকুল, পাতার মর্মর, শিশুকণ্ঠের কলকল Ñ এর সমস্ত কিছু থেকে পিপাসিত কান এবং চোখের মাধ্যমে মনের মধ্যে উঠে এসেছে শব্দ। যে-শব্দ এক সময় কেবল বস্তুকে নয়, তার অবয়বকে নয় Ñ শব্দের বিশিষ্ট এক ধ্বনি দ্যোতনার ভেতর দিয়ে বিশ্বজগৎকে ধরতে চেয়েছে। কবিতা দীর্ঘদিন তাই ছিল শ্রুতির বিষয়। আজকের দিনেও মুদ্রিত পাতায় কবিতা কেমন দেখায় তার চেয়ে কানে কেমন শোনায় তাই দিয়েই শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে তার অধিষ্ঠান ঘটে। এখন পর্যন্ত ধ্বনিমাধুর্যের কারণে, যদিও কেবলমাত্র সে-কারণেই নয়, আমরা সহজে কবিতা মনে রাখতে পারি।
হায়াৎ সাইফের কবিতা সম্পর্কে উপর্যুক্ত শ্রুতিময়তার শর্ত আপাদমস্তক প্রযোজ্য। তাঁর কবিতার মধ্যে শব্দের একটি ছন্দোময় প্রবহমানতা রয়েছে। এটা হেমন্তের নদীর মতোই লাজুক বটে। কেবল সন্ধ্যাতারা ফুটলে প্রকৃতি ও মানুষ যখন নৈঃশব্দ্য অবলম্বন করে, তখন যেমন নদীর মৃদুমন্দ ছলছল অভিমান শ্রুতিযোগ্য হয়ে ওঠে, হায়াৎ সাইফের কবিতা হৃদয়ঙ্গম করবার জন্যও তদ্রƒপ একটি অভিনিবেশের প্রয়োজন হয়।
উত্তর-তিরিশের অনুষঙ্গে হায়াৎ সাইফের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হলে সমালোচককে অনিবার্যভাবেই তাঁর কবিতার শ্রুতিময়তার কথা উল্লেখ করতে হবে। তাঁর প্রথমদিকের ‘স্বস্তি দেবে না’ শীর্ষক কবিতায় চিত্রকল্প ও শব্দের ধ্বনিময়তার এমন সংশ্লেষ প্রত্যক্ষ হয় যার পূর্বসূরি বলে অন্য কোনো কবিকে চিহ্নিত করা যায় না :
ঝিলের কাজল জলে সন্ধ্যাতারা জ্বলে, প্রস্রবণ ঝরে পড়ে অনেক
শব্দের,
প্লাবনে পুঞ্জিত হয় কচুরীর কোমল হৃদয় শামুকের সিক্ত মন
গেওয়ার নবীন চারা বাড়ে কেওড়ায় পুষ্পিত স্তবক,
নেচে চলে অচেনা নর্তকী কম্প্রমান শাপলার বঙ্কিম মৃণাল Ñ
ভেসে যায়, ভেসে যায়, ভেসে যায় প্রেম প্রীতি নীলগন্ধা নদী।
(‘স্বস্তি দেবে না’, সন্ত্রাসে সহবাস)
এটি কেবল তাঁর রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য নয়; বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতায় এটি হায়াৎ সাইফের একচেটিয়া অবদানও বটে।

ছয়
কবি হায়াৎ সাইফের পিতৃদত্ত পূর্ণ নাম আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম খান। এ-নাম সর্বজনবিদিত নয় মোটেও। কর্মক্ষেত্রে সাইফুল ইসলাম খান নামেই পরিচিত ছিলেন; সহকর্মীরা সংক্ষেপে এস আই খান বলে তাঁকে উল্লেখ করতেন। তাঁদের আদিনিবাস বর্তমান সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে, আর জন্মস্থান ঢাকা শহরের বেগম বাজারে। তাঁর শৈশবের একটি অংশ কলকাতায় অতিবাহিত হয়েছিল। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত তিনি পাবনা শহরে জিলা স্কুলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কেটেছে রাজশাহীতে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬১-তে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (আর্টস) পাশ করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করে যথাক্রমে বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাঁর কর্মজীবনের শুরু ১৯৬৬ সালে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ সংক্ষিপ্তকাল তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে যোগদান করলে তাঁর সরকারি চাকুরের জীবন শুরু হয়। প্রথম চাকরিতে পদবি ছিল কাস্টমস ও এক্সাইজ বিভাগের সহকারী কালেক্টর। ১৯৮৪-তে তিনি কালেক্টর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। কালক্রমে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। কিছুদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টব্দে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরলাভ করেন। এরপর মৃত্যু অবধি তিনি একাধিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
১৯৬১ সালে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, তখন সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই প্রথম তিনি লেখক-নাম ‘হায়াৎ সাইফ’ ব্যবহার করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বাক্ষর পত্রিকার সঙ্গে। ষাটের দশকে সমকাল (সম্পাদক : সিকান্দার আবু জাফর), পূর্বমেঘ (সম্পাদক : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম), কণ্ঠস্বর (সম্পাদক : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ), উত্তর অন্বেষা (সম্পাদক : মযহারুল ইসলাম), পরিক্রম (সম্পাদক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) এবং উত্তরণ (সম্পাদক : এনামুল হক) পত্রিকাসমূহে নিয়মিত কবিতা প্রকাশ করেছেন। ছন্দ, চিত্রকল্প ও দার্শনিক চিন্তা এই ত্রয়ীর স্বাভাবিক সমন্বয়ে তাঁর কবিতারাজি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এই সময় তিনি বেশকিছু সাহিত্য-নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যাতে তাঁর কাব্যভাবনার সুস্পষ্ট রূপরেখা অবধৃত হয়ে রয়েছে।
সরকারি চাকরির জীবন তাঁর কবিসত্তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে Ñ কার্যত এক অবিনাশী ঔদাসীন্যের শিকার হয় তাঁর কবিসত্তা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত কবিতার অঙ্গন থেকে তিনি দূরে সরে থাকেন। ১৯৮৩-তে যখন তিনি চট্টগ্রামে কন্ট্রোলার অব কাস্টমস ভ্যালুয়েশন হিসেবে পদস্থ, তখন এই উদাসীনতার কিঞ্চিৎ অবসান হয় যার ফলে ওই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য সন্ত্রাসে সহবাস। এটি যেন কবি হায়াৎ সাইফের পুনরুজ্জীবন। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। কবি-পরিচয় হারিয়ে হায়াৎ সাইফ ততদিনে নিছকই সরকারি কর্মচারীতে পর্যবসিত। পরিণতিতে প্রথম কাব্য সন্ত্রাসে সহবাস না হলো পঠিত, না হলো আলোচিত।
অব্যবহিত পরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সব ফেলে দিয়ে (১৯৮৫) সমরূপ দুর্ভাগ্যের শিকার হলো। অথচ এই কাব্যগ্রন্থ মানুষের শোক ও সংগ্রামের কথা, স্বেদ ও শোণিতের কথা, আশা ও আকাক্সক্ষার কথা স্পষ্ট উচ্চারণে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তীব্র শ্লেষাত্মক বাক্যবাণে ব্যক্ত হয়ে সমকালিক জনচেতনাকে বিশ্বস্ততার সহিত ধারণ করেছিল।
দ্বিতীয় সর্বনাশটি ঘটেছিল অব্যবহিত পরেই। তিনি ‘পদাবলী’ কবিতা গোষ্ঠীর সহিত যুক্ত হলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখের প্ররোচনায় এবং জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ‘পদাবলী’ ঢাকার বৃহত্তর কবিসমাজের কোপানলে পড়ল। হায়াৎ সাইফেরও কপাল পুড়ল। অথচ কোনো সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে যে রাষ্ট্রপতি পদমর্যাদার সামরিক শাসকের আনুকূল্য প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব এই সাদা সত্যটি কেউ গ্রাহ্য করল না। কবি সিকদার আমিনুল হকের মতোই নিপাট ভদ্রলোক হায়াৎ সাইফ অকারণে কবিকুলের বৈরিতার শিকার হলেন। সাহিত্যের রাজনীতির সর্বব্যাপী পঙ্কিলতা ও সমাজের ক্রমঘনায়মান অবক্ষয়ে হায়াৎ সাইফ পীড়িত বোধ করতে লাগলেন। জীবনের প্রতি প্রগাঢ় বিবমিষা তাঁকে গ্রাস করে ফেলল। একটি কবিতায় তাঁর তিক্ত মনোভাব নিম্নোক্তরূপে প্রতিফলিত হয়েছে :
মাঝে মাঝে মনে হয় এই সব প্রাত্যহিক প্রকট দায়িত্বাবলী
এই সব অর্থহীন অনুপুঙ্খ বাধ্যবাধকতা,
এইসব তথাকথিত অসার সামাজিক প্রবণতা
সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে
কপর্দকহীন চলে যাব কোনো এক দিগন্তের দিকে;
যদিও সেখানে দিক-চক্রবাল সরে সরে যায়,
চারদিকে বয়ে যায় সময় আর বাতাসের স্রোত;
এইভাবে দ্রুতগামী চলে গেলে
তথাকথিত জগত সংসার পিছে ফেলে দিয়ে
এর চেয়ে অসম্ভব প্রত্যয়ী কোনো অস্তিত্বের
দিকে হয়তো বা যাব চলে।
(‘এখনো তো মনোরথ শেষ হয় নাই’)
বস্তুত পরবর্তীকালের কবিতায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার সঙ্গে সঙ্গে কবির দার্শনিক চিন্তার বিভিন্ন দিকও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অস্তিত্বের প্রশ্ন, আধুনিক জীবনের যন্ত্রণা এবং সামাজিক প্রতিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির যে-সংঘর্ষ তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন কবিতার অবয়বে প্রতিফলিত হয়েছে।
ঘোর বৈরিতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হায়াৎ সাইফ তাঁর কবিসত্তা টিকিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৮৭-এ তিনি প্রকাশ করেন তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রধানত মাটি ও মানুষ। প্রথম দুই কাব্যে কবি যে নিজস্বতার নকশা কেটেছিলেন, উচ্চারণে ও নির্মাণে তা এই গ্রন্থের কবিতাবলিতে স্পষ্টতর হয়েছে। এই গ্রন্থটির একটা প্রবর্তনা উৎসব হয়েছিল যাতে কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন : ‘হায়াৎ সাইফ প্রকৃত কবি; তাঁর কবিতার বিষয় স্বোপার্জিত; তাঁর উচ্চারণ ও নির্মাণ ঋণে জর্জরিত নহে।’ Ñ সৈয়দ শামসুল হকের এই সিদ্ধান্ত প্রণিধানযোগ্য। একজন প্রকৃত কবি প্রতিভাবান বটে, তাঁকে অন্যের কাব্যানুসরণ করে কালক্ষেপণ করতে হয় না। হতে হয় না মেকি কবিতার জনক।
হায়াৎ সাইফের শেষজীবনের বিভিন্ন কাব্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ২০০৮-এ প্রকাশিত প্রধানত স্মৃতি ও মানুষের পথ চলা, ২০১০-এ প্রকাশিত রসুন বোনার ইতিকথা এবং ২০১২-তে প্রকাশিত মনোরথ শেষ হয় নাই। ৪০টি কবিতার সংকলন রসুন বোনার ইতিকথা সম্পর্কে বিশেষ করে কিছু বলার আছে। এই কবিতাবলিতে কেবল কবির জীবনদর্শন পরিণত ও সংহত হয়েছে তা নয়, হায়াৎ সাইফের কাব্যভাষা আদ্যোপান্ত নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। ‘অন্তর্জলি’ কবিতায় আমরা পাঠ করি :
রমনার আশেপাশে ফিরি নিউমার্কেট থেকে কাঁটাবন হয়ে,
রেলের লাইন ধরে নীলক্ষেত পাশে ফেলে বরাবর বিদ্যাপীঠে
উঠি।
হলের ক্যান্টিনে একদল তরুণ তাপস ঝড় তোলে কাপে,
উস্কখুস্ক চুল রক্ত-চোখ, সিগারেটে সিগারেটে দিনক্ষণ মাপে,
রিলকে থেকে শুরু করে আরো দূরে চলে যায় হেঁটে হেঁটে,
কখনো বা কাম্যু কখনো বা বোদলেয়ার আসে,
কখনো বা র্যাঁবোই প্রধান ব’লে মনে হয়,
হ্যামলেট মাঝে মাঝে এসে সোলিলোকি ভাঁজে
কখনো বা ওফেলিয়ার মৃতমুখ আধো অন্ধকারে ভেসে ওঠে;
ঘুরে ঘুরে এলোমেলো কত কী যে আসে আর বারবার চলে যায়,
কৃশ মানুষেরা আসে শ্মশ্রুময় প-িতেরা আসে
সুধীন জীবনানন্দ খাবি খায়, প্রায়শই উঁকি দেয় মার্কস ও লেনিন,
কমরেডের দল হাততালি দিয়ে ওঠে কখনো সখনো,
কখনো সখনো খানসেনাদের দোসরেরা আসে ভিন্ন চেহারায়।
(‘অন্তর্জলি’, রসুন বোনার ইতিকথা)
এ-গ্রন্থের পাঠক লক্ষ করবেন, প্রথম থেকে শেষ কবিতার গ্রন্থনায় একটা প্রবাহিত বক্তব্যের পূর্বাপর অনুসরণ রয়েছে। মানুষের সভ্যতার ঊর্ধ্বতনের প্রেক্ষাপটে বাংলার পাললিক সভ্যতার নির্যাস উপস্থাপিত করেছেন কবি, কখনো ছন্দোবন্ধে শ্লেষ ও বিদ্রƒপে (‘আলোকের দুধরাজ’), কখনো দীর্ঘ কবিতায় নানা উপমা রূপকে (‘অন্তর্জলি’), কখনো-বা বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা-নির্বেদ অসাধারণ নান্দনিকতায় রূপায়িত করেছেন কিংবদন্তির অনুষঙ্গে (‘রসুন বোনার ইতিকথা’, ‘কিংবদন্তী নয়’, ‘কবরের কাছে’, ‘সহজ নয়’)। আবার কখনো মানুষের মনন ও মানসের অন্তরীণ চিত্তের গহিন থেকে তার অস্তিত্বের ট্র্যাজেডি উৎক্ষিপ্ত হয়েছে (‘কিছুই থাকে না কাছে’, ‘পথের বাঁকে’)। হায়াৎ সাইফের নতুন বক্তব্য ও ভাষাভঙ্গি অব্যাহত থেকেছে শেষাবধি। পরবর্তী গ্রন্থে তিনি লিখছেন :
সব কিছু আজ দেখি বাউরি বাতাসে কাঁপে,
ধাপে ধাপে কেঁপে যায় স্মৃতির দরোজা;
বাংলার বামপন্থী তান্ত্রিকের শবাসন,
লালনের গান, দক্ষিণের দামাল ঝড়, কখনো বা
নীলগন্ধা নদী, কখনো বা নীলকান্ত ধরণীর গলে
সমুদ্রের কুসুমিত ফেনা দোলে,
কেওড়া আর সুন্দরী জেগে থাকে,
হিম সৈকতে বহুদূর দূরগামী জাহাজের মাস্তুল দোলে,
একজন হেমকান্ত সৈকত দেখেছিল,
কুলকু-লিনী জেগেছিল কোনো এক দুর্বাসা তান্ত্রিকের;
অথচ আজ দুই কুড়ি পনেরোটা বছরের পর
সে মানুষটা নেই আর, শুধু ভেসে আসে তার ঋত্বিক কণ্ঠস্বর, …
(‘প্রাথমিক ভ্রƒণ’, মনোরথ শেষ হয় নাই)
সাত
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশনামীয় ভূখ-ের মানুষের জীবন দুশ্চিন্তাদীর্ণ হয়ে উঠেছে। এটার মূল পরিচয় সর্বস্তরে অনিশ্চয়তার ব্যাপ্তি। কাজের পরিবর্তে ঝামেলা ও মামলা সামলাতেই মানুষকে তার জীবনীশক্তি ও সময় অধিকতর ব্যবহার করতে হয়েছে। অনিশ্চয়তা ও ঝামেলার পরিব্যাপ্ত প্রাদুর্ভাব মানুষকে সদা অস্থির রেখেছে। এই অস্থিরতার মধ্যে দর্শন, কল্পনা ও মনীষীর যথার্থ সম্মিলন ঘটানো কঠিন। হায়াৎ সাইফ এই দুরূহতা অতিক্রম করে তার উপলব্ধি ও অনুভূতি সংহত শব্দে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীতেই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার গোড়াপত্তন ও বিকাশ। একুশ শতকের শুরুতে রাজনৈতিক দেশাত্মবোধের বিস্ফোরণ কবিতার জগৎকে সংকীর্ণ করে ফেলে। কবিদের অতিমাত্রিক আত্মজৈবনিকতা অগণিত ক্ষেত্রে কবিতার মারাত্মক ত্রুটি ঘটিয়েছে। ষাট ও সত্তরের দশকের অন্য কবিদের বিশিষ্ট আত্মজৈবনিকতা হায়াৎ সাইফের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। তবে এই সংক্রমণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে তীব্রতর হয়ে তাঁর কবিতাকে অনাকর্ষণীয় করে ফেলেনি।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে এলিয়ট, ইয়েটস, এজরা পাউন্ডের সঙ্গে হায়াৎ সাইফের মিথস্ক্রিয়া যৌবনেই শুরু হয়েছিল। সুতরাং উচ্চমানের আধুনিক কবিতার রূপ সম্পর্কে তাঁর সম্যক অবহিতি ছিল। তাঁর কবিতার কাঠামো, উপমা ও বাকপ্রতিমা এবং শব্দচয়নে গ্রাম্যতার লেশমাত্র নেই : তিনি নাগরিক কবি; সর্বাংশে নাগরিক। তিনি আধুনিক কবি; সর্বাংশে আধুনিক। কবিতার সাফল্যে শর্তাবলি সম্পর্কে তিনি অবহিত। শব্দের ব্যবহারে তিনি সচেতন, বাক্যগঠনে তিনি মনোযোগী; ছন্দের ব্যবহারে তিনি সযতœ। কাব্যগঠনে তিনি যৌক্তিক বিন্যাস ও আনুপূর্ব সঙ্গতিসাধনে পারঙ্গম।
হায়াৎ সাইফের বিপন্ন পৃথিবী আত্মসংকটের তীব্রতায় কম্প্রমান। আশা ও নিরাশা, প্রণয় ও ক্রোধ উভয়ই তার নিয়ামক। তাঁর সর্বশেষ মনোরথ শেষ হয় নাই কাব্যে কবির অনিবার্য মৃত্যুচিন্তার মধ্যেও জীবনের উদগ্রীবতা ও বর্র্ণিলতা সমুপস্থিত। বিভিন্ন জিজ্ঞাসায় রাজপথ আর জনপদে বাংলার মানুষের যাপিত জীবন প্রতিফলিত হয়েছে নিগূঢ় বিশ্বস্ততায়। আধুনিক বাংলা কবিতার মূলধারার মধ্যে থেকেও হায়াৎ সাইফ মেধা ও মননে কবিতার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গে একটি শিল্পোত্তীর্ণ স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর কবিতা একটি স্বকীয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের আধার।
হায়াৎ সাইফের কবিসত্তার উদ্ভিন্ন অস্তিত্বটুকু আদ্যোপান্ত নিভৃতেই বিরাজমান ছিল। ২০১৮-র ডিসেম্বরে তাঁর বয়স ৭৬ পূর্ণ হয়েছিল। সম্প্রতি কয়েক বছর যাবৎ তাঁর বৃক্কের সামর্থ্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। ইতোমধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে যুক্ত হয়েছিল হৃদযন্ত্রের বৈকল্য। ২৪ এপ্রিল ২০১৯ তিনি চেতনা হারালেন, ১৩ মে তারিখে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস নির্গত হলো ইউনাইটেড হাসপাতালে। তিনি মানব-অস্তিত্বের অন্তিম গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তিনি আর প্রত্যাবর্তন করবেন না, আর তিনি কবিতা লিখবেন না। কিন্তু তাঁর কবিতার অবিস্মরণীয় অনুরণন থেকে যাবে বাংলা কবিতার পরিম-লে :
আমার পেছনে থাকে আমারি বিমূঢ় ছায়া
স্মৃতি সঙ্গ অনুভব মন্দ্রিত জনপদে ঘোরে।
মানুষেরা চ’লে যায় যেমন গেছেন মাতা।
জনপদ থাকে। মাটি থেকে যায়।
স্মৃতি থাকে মাটির গভীরে।
শূন্যের দেউলে থাকে প্রতিমার কায়া।

আমার বুকেও থাকে পঞ্চাশের ছলচ্ছল
সত্তরের মানুষের ঢল তরুণের বজ্রমুষ্টি।
এখন কি সমস্তই স্মৃতির শিশির হ’য়ে ঝরবে টুপটাপ
শেষ অঘ্রাণের প্রত্যুষ-প্রদোষে নিভৃত কুয়াশায়?