কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব ২৫

২৫-এ পা। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবের। সেই সূত্রে এ-উৎসবকে সেরা করে তোলার ভাবনা তো ছিলই। ৭৬টি দেশের ১৭৬টি ছবি। রৌপ্যজয়ন্তীতে পরিকল্পনামতোই রঙিন হয়ে উঠল উৎসব। ৮ জানুয়ারি ২০১৯-এ নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে চাঁদের হাট। বলিউড-টলিউডের তারকামেলা। কেন্দ্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদেশি চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্বরাও উপস্থিত। উদ্বোধনী ছবি সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন। রেস্টোরড ভার্সন। ‘গু গা বা বা’ তো ৫০ পেরোল। ২৫টা বছর কম কথা নয়। তার আগেও আরেক চলচ্চিত্র ছিল। ভারত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব। মূলত দিল্লিতে, কিন্তু কিছু বছর অন্তর অন্তর আসত কলকাতাতেই। ১৯৫২-তে প্রথম। কিন্তু চলচ্চিত্রজগতের নানা নামিদামি ব্যক্তিত্বের লেখনীতে রয়েছে সেই আভাস। কীভাবে এক চলচ্চিত্র-উৎসবের প্রভাবে পালটে গিয়েছিল বাংলা সিনেমার ক্লিশে জগৎ। ১৯৫২ সালের সেই উৎসবের প্রভাবেই বাংলা সিনেমা সাবালক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। তার ২৫-এ পা। ফলে এবার যৌবনের স্পর্ধা নিয়েই সে উপস্থিত। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের উদ্বোধনমঞ্চেও ছিল স্মৃতি। আন্ডি ম্যাকডোনাল্ড। অতীতে তাঁর একটি ছবি তো কাঁপিয়েছিল কলকাতা শহর। সেক্স, লাইজ, অ্যান্ড ভিডিওটেপ। তখন এখানে তেমনভাবে চালু হয়নি ইন্টারনেট বা ভিডিও সংস্কৃতি। ফলে নাম-মাহাত্ম্যে নন্দনে মারকাটারি ভিড়। কিন্তু যে-কারণে ভিড় তার কিছুই খুঁজে পান না দর্শকেরা। ছবিটি ছিল এক ক্ল্যাসিক। অ্যাসেট নায়িকা ম্যাকডোনাল্ডের অসামান্য অভিনয়। সেই আন্ডি এবার উদ্বোধনী মঞ্চে। তিনি আবার একদিন ‘মাস্টার ক্লাস’ নিলেন। আরেক স্মৃতি Ñ কলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসবেই তো একদা দেখানো হয়েছিল গুন্টার গ্রাসের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র টিন ড্রাম। সে-ছবির পরিচালক ছিলেন ভলকার স্কলনডর্ফ। তিনিও তো এবার ‘কিফ-২৫’-এর মঞ্চে। সঙ্গে নিয়েছেন তাঁর আরো বেশকিছু ছবি। অসুস্থতার জন্যে অমিতাভ শেষ মুহূর্তে আসতে পারেননি। কিন্তু তাতে কি উদ্বোধনের খুব একটা তাল কেটেছে? এবার শাহরুখ খানের পাশে ছিলেন মহারাজা সৌরভ গাঙ্গুলি এবং বাংলার মেয়ে রাখি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও ছিল স্মৃতিময়তা। তাঁর দাবি যথার্থ। এবারের চলচ্চিত্র-উৎসব সব অর্থেই সেরা।

সেই স্মৃতি এই সময়
স্বাধীনতার পর ফিল্ম ডিভিশনের উদ্যোগে ভারতে দেশবিদেশের চলচ্চিত্রের মেলা বসে ১৯৫২ সালে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে অত্যন্ত বাছাই করা ছবি এসেছিল সে-উৎসবে। বোম্বাইয়ে (বর্তমানে মুম্বাই) উৎসব হয়ে যাওয়ার পর ভারতের প্রধান প্রধান শহরে এই উৎসবকে ঘোরানো হয়। কলকাতাতেও হয়েছিল। সেই প্রথম কলকাতায় সিনেমা উৎসব। কলকাতার অন্য ধারার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল ’৫২-র এই চলচ্চিত্রমেলা। সিনেমা হল ছাড়াও ইডেন গার্ডেনস এবং ওয়েলিংটনের এক পার্কে বিশাল দর্শকের সামনে দেশ-বিদেশের সিনেমা দেখানো হয়। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এই উৎসব প্রসঙ্গে ১৯৮২ সালে এক স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘১৯৫২ সালে কলকাতায় যে আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব হয়েছিল, তার তুলনায় পরের সবকটি ফিল্মোৎসবকেই বেশ মøান মনে হয়। সত্যি বলতে কী, এতগুলি ভাল ছবি একসঙ্গে পৃথিবীর কোনও দেশের কোনও উৎসবেই দেখানো হয়েছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।’ শুধু সত্যজিৎ নন, পরবর্তীকালের আরো দুই বিখ্যাত চলচ্চিত্র-পরিচালক মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের ওপরও বিশেষ করে প্রভাব ফেলেছিল এই ফিল্মোৎসব। বাংলা ছবির জগতে তৈরি হয়েছিল এক সমান্তরাল শৈল্পিক ধারা। আর এই ধারার পাইওনিয়র ছিলেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক এবং মৃণালই। এই উৎসবের দৌলতেই বাংলা ছবির পরিচালক, কলাকুশলী এবং দর্শকরা পরিচিত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের এক নতুনতর ভাষার সঙ্গে। এই উৎসবেই দেখানো হয় ইতালি সিনেমার নববাস্তবতার পথিকৃৎ ভিক্টোরিয়া ডি সিকার মিরাকল ইন মিলান, আকিরা কুরোশাওয়ার রশোমন, রসোলিনির ওপেন সিটি রোম, তাতির জুর দ্য ফেত। সত্যজিতের পথের পাঁচালী নির্মাণের অন্যতম অনুপ্রেরণা ডি সিকার বাইসাইকেল থিফস, যা তিনি দেখেছিলেন বিদেশ ভ্রমণকালে। তবে ’৫২-র চলচ্চিত্রোৎসবে আবার ডি সিকার অন্য ছবি দেখে ছবি তথা পথের পাঁচালী নির্মাণে আরো বেশি করে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাছাড়া ’৫২-র চলচ্চিত্রোৎসবে সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ দেখে সত্যজিৎ বুঝতে পারেন, ভালো ছবি দেখার ব্যাপারে এখানকার সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। কিন্তু ভালো ছবির চাহিদা থাকলেও ভালো ছবির তেমন যোগান নেই এই বাংলায়। ভালো ছবির যোগান তৈরি করতে হবে। সত্যজিৎ পাকাপাকিভাবে চলচ্চিত্র-পরিচালক হবেন বলে ঠিক করে ফেললেন। সত্যজিৎ লিখছেন, ‘চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হবার পর আমার মনে আর কোনও সংশয় থাকে না যে আমি ছবিই তুলব। ‘পথের পাঁচালী’ হবে আমার প্রথম ছবি। ছবি যদি ভাল না হয় তো মাথা নিচু করে ফিরে যাব কিমারের কাছে। আর যদি উতরে যায় তো একটার পর একটা ছবি করে যাব।’ বাংলার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে আমূল প্রভাব ফেলল এই চলচ্চিত্রোৎসব। শুধু সত্যজিৎ নন, ঋত্বিক ঘটকের মুখেও একই কথা Ñ ‘এই উৎসবের আগে-পরে দুটোর মধ্যে যেন এক বিরাট পার্থক্য বর্তমান … আজকের বলিষ্ঠ জীবনের ধারা চলে এসেছে ইটালিতে, চেকোসেø­াভিয়া, রাশিয়ায় … কলকাতার এই উৎসব শিক্ষার এক উৎস হিসেবে দেখা দিল।’ সত্যজিতের পাশাপাশি ঋত্বিকও নেমে পড়লেন ছবি নির্মাণে। ১৯৫৩ সালে তৈরি হলো ঋত্বিকের নাগরিক। যদিও ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। চলচ্চিত্র-আগ্রহীদের বাংলায় শুটিং হওয়া জঁ রেনোয়ার দি রিভার ছবিটিও দেখানো হলো কলকাতায় প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবে। এখান থেকেও এক ধরনের অভিজ্ঞতা পেলেন কলকাতার চলচ্চিত্রকারেরা। ঋত্বিক বা মৃণালও বলেন, সেই উৎসব থেকে তাঁরা শিখেছেন অনেক।
ব্যক্তিগত স্তরে যে-স্মৃতি, তাতেও তো রয়েছে নানা মণিমানিক্য। ১৯৯৫ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব শুরু হওয়ার ঠিক আগের বছর, ১৯৯৪ সালের চলচ্চিত্র-উৎসবে কলকাতায় এলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মাইকেলেঞ্জেলো আন্তনিয়নি। এর আগে অবশ্য তিনি ভারতে এসেছেন Ñ ১৯৭৭ সালে। কলকাতায় এই প্রথম। কলকাতার চলচ্চিত্র-আগ্রহীদের কাছে ভীষণ কাছের পরিচালক। তাঁর বিখ্যাত তিন ছবি ব্লো আপ, জারবিস্কি পয়েন্ট এবং প্যাসেঞ্জার বাণিজ্যিকভাবেই মুক্তি পেয়েছে। আরো কিছু ছবি যেমন লা নত্তে, লা আভেঞ্চুরা ইত্যাদিসহ আরো বেশকিছু ছবি বাংলার দর্শক দেখে নিয়েছে ফিল্ম সোসাইটি সার্কিটে। এই বিশ্ববরেণ্য পরিচালক কলকাতায় আসার আগেই কলকাতার মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে ঘিরে এক অন্য ক্রেজ। কলকাতায় নেমে তিনি তাজ হোটেলে উঠলেন। এই হোটেলে খুব স্বাভাবিক কারণেই সাংবাদিকদের ভিড়। এই প্রতিবেদকও তখন কলকাতার এক প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। সব সাংবাদিকের একটাই চেষ্টা, কী করে আন্তনিয়নির একান্ত সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়; কিন্তু আন্তনিয়নির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতাটা খুব সুখের হলো না। শুনেছিলাম আন্তনিয়নি বেশ অসুস্থ। কিন্তু তাঁর অসুস্থতা যে এতদূর সেটা জানতে পারিনি। তিনি এখন মূলত হুইলচেয়ারেই বন্দি। কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন। কিন্তু যেটা তাঁর রয়ে গেছে তা হলো চলচ্চিত্রমেধা। সে-সময় আন্তনিয়নির সঙ্গে ছিলেন তাঁর তৎকালীন বান্ধবী, পরবর্তীকালের স্ত্রী, এনরিকা। কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে এনরিকাকে বিয়ে করেন তিনি। সাইন লাঙ্গুয়েজে তখন কথা বলতেন আন্তনিয়নি। সেই ভাষা একমাত্র বুঝতেন এনরিকাই। আন্তনিয়নির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ব্যাখ্যা করতেন তিনি, আবার আন্তনিয়নির উত্তর সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা করে দিতেন। আগেই বলেছি, চলচ্চিত্রই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান আন্তনিয়নির। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়, যেখানে চলচ্চিত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই এমন এক জায়গায় যদি নির্বাসন দেওয়া যায় তাহলে তিনি কী করবেন? আন্তনিয়নির উত্তর, ‘সেখানে গিয়ে চলচ্চিত্রই বানাব।’ সঙ্গিনীর সহায়তায় চলচ্চিত্র-উৎসব চলাকালে সারা নন্দনচত্বর ঘুরে বেড়াতেন তিনি। সেবার ছিল আন্তনিয়নির সাতখানা ছবির এক প্যাকেজ। তার মধ্যে ছিল অসুস্থ হওয়ার আগে ১৯৮২ সালে তৈরি ছবি আইডেন্টিফিকেশন অব আ উয়োম্যান। এটিই তখন অবধি তাঁর শেষ ছবি। কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে তিনি নতুন ছবিতে হাত দেন Ñ বিয়ন্ড দ্য ক্লাউড। আরেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-পরিচালক উইম উন্ডেডার তাঁকে এই চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন।

কালাপাহাড় এবং গুনে আবিষ্কার
এর বছর দুয়েক আগে ১৯৮২-তে চলচ্চিত্র উৎসবে ছিল আরেক সিনেমা। কলকাতা চলচ্চিত্র-উৎসবে এলো ফরাসি সিনেমার কালাপাহাড় ফরাসি সিনেমার নবতরঙ্গের প্রাণপুরুষ জঁ লুক গোদারের একঝাঁক ছবি। ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় গোদারজ্বর। আগের দিন মাঝরাত থেকে গোদারের ছবির টিকিট জোগাড়ের জন্যে সোসাইটি সিনেমায় বিশাল লাইন। কিন্তু উৎসব শুরু হওয়ার পর কলকাতা আবিষ্কার করল অন্য এক পরিচালককে। ইলমাজ গুনে। তুরস্কের এই পরিচালকের বেশকিছু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল কলকাতা। সেই উৎসবের আরেক আকর্ষণ ছিল চিত্র-সমালোচক জে. হোবারম্যন। তুরস্কের এই খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ইলমাজ গুনে সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ঝড়সবঃযরহম ষরশব ঈষরহঃ ঊধংঃড়িড়ফ, ঔধসবং উবধহ, ধহফ ঈযব এঁবাধৎধ পড়সনরহবফ.’ তুরস্কের রুপালি পর্দার জনপ্রিয় এ-তারকা সত্তরের দশকে একজন রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানবিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন। মার্কসীয় রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ, সুপারস্টার ইমেজ, ব্যক্তিগত জীবনে হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি আবার সার্থক সংগ্রামী চলচ্চিত্র-নির্মাতা Ñ ইলমাজ গুনে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব। এই উৎসবে আরেকজন মুগ্ধ করেছিলেন Ñ ইয়াঞ্চো। হাঙ্গেরির এই পরিচালক ভারতে প্রায় অচেনাই ছিলেন। এই উৎসবের দৌলতে তাঁকে চিনলেন ভারতের চলচ্চিত্র-দর্শক।
কেন্দ্রীয় সরকার-আয়োজিত ভারতের প্রধান প্রধান চলচ্চিত্র উৎসব যখন বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রতি ক্রমশ আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিকল্পনা করল এমন এক চলচ্চিত্র কমপ্লেক্সের, যেখানে এক ছাদের তলায় থাকবে অনেক সিনেমা হল, সেমিনার কক্ষ, চলচ্চিত্র লাইব্রেরি। নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র হয়ে উঠল এমন এক সরকারি প্রেক্ষাগৃহ ও চলচ্চিত্র উৎকর্ষ কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র-শিল্পের বিকাশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চলচ্চিত্র-সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক নন্দন প্রতিষ্ঠিত হয়। নন্দনের সুদৃশ্য স্থাপত্যবিশিষ্ট ভবনটির দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়। নন্দনের প্রতীকচিহ্নটিও তিনি অঙ্কন করেন। কলকাতার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি কেন্দ্র নন্দন বর্তমানে শুধুমাত্র কলকাতা শহরই নয়, বরং সমগ্র পূর্বভারতের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র। ‘নন্দন’ নকশা ও নির্মাণ-পরিকল্পক ছিলেন বিখ্যাত স্থপতি অমিতাভ দাশগুপ্ত।
১৯৮২-র পর ’৯০। নানা শহর ঘুরে দীর্ঘ আট বছর পর কলকাতায় আবার চলচ্চিত্র-উৎসব এলো। নজরুলমঞ্চে উদ্বোধন করলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। উদ্বোধনের দিনই দেখা গেল গ্রিসের পরিচালক থিও আঞ্জেলোপুলিশের ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট। দুই ভাইবোনের গল্প। এ যেন গ্রিসের আরেক পথের পাঁচালী। এই উৎসবেই তো দেখলাম শোহেই ইমামুরার ব্ল্যাক রেন। মুগ্ধতার শুরু। একের পর এক। আশির চলচ্চিত্র-উৎসবে যেমন বাংলার দর্শকরা আবিষ্কার করেন ইলমাজ গুনেকে, নব্বইয়ের চলচ্চিত্র-উৎসবে তেমনি তাভিয়ানি ব্রাদার্স Ñ পাওলো এবং ভিট্টোরিও তাভিয়ানিকে। ’৮২-র উৎসবে অবশ্যই সেরা ছবি মেফিস্টো। তেমনই ’৯০-এ ত্রিস্তফ কিওসলস্কির আ শট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ এবং আ শটফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং।
পাবলিক ডিমান্ড। বছর দুয়েকের মধ্যে আবার কলকাতায় ফিল্ম উৎসব। এবারো কিওসলস্কির থ্রি কালার্স ব্লু মুগ্ধ করে দিলো। এই উৎসবেই তো আবার দেখলাম ফেদেরিকো ফেলিনির লা দোলচে ভিতা, কুরোশাওয়ার মাদাদেও কলকাতা প্রথম দেখল। এরকম আরো অনেক চলচ্চিত্রমুগ্ধতা।

মাঠে-ময়দানে সিনেমা
আর নয় দিল্লির দিকে চেয়ে থাকা। ‘নন্দন’ তৈরির দশ বছরের মাথাতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত এবার তাঁরা নিজেরাই করবেন ফিল্ম ফেস্টিভাল। ’৮৩ থেকেই প্রস্তুতিপর্ব। ’৮৫-তে প্রথম স্বাধীনভাবে রাজ্যে শুরু হলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব। বলা ভালো, ফেস্টিভাল অব দ্য ফেস্টিভাল। ভেনিস, কান, বার্লিন প্রভৃতি চলচ্চিত্র-উৎসব থেকে সেরা ছবি বাছাই করে এনে এক ফিল্ম ফেস্টিভাল। সত্যজিৎ রায় নন্দনকে কেন্দ্র করে এরকম এক চলচ্চিত্র-উৎসবের কথাই ভেবেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবের যেটি সবচেয়ে মূল্যবান কাজ Ñ অর্থাৎ দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের একটি সুযোগ করে দেওয়া Ñ সেটা মনে হয় নানান বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও অটুট থাকবে।’ সেই সূত্র ধরেই এই কলকাতা চলচ্চিত্র-উৎসবের আয়োজন। বিদেশের স্বদেশের নানা রাজ্যের ছবি ও চলচ্চিত্রকারদেরও যেন এক মিলনমেলা এই চলচ্চিত্র-উৎসব।
রাজ্যে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র-উৎসবের মেজাজ পালটালো। নতুন সরকার এই চলচ্চিত্র-উৎসবকে ছড়িয়ে দিলো সাধারণ মানুষের মধ্যে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আর নন্দনে সীমিতসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর মধ্যে নয়, বরং নিয়ে যাওয়া হলো নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে Ñ অগুনতি সাধারণ মানুষের মধ্যে। উৎসব ইন্টেলেকচুয়াল কালচার থেকে সরে হয়ে উঠল পপুলিস্ট কালচার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে এলেন মুম্বাই, চেন্নাইয়ের জনপ্রিয় তারকারা। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কমল হাসান, মিঠুন চক্রবর্তী প্রমুখ। এই জনপ্রিয় সংস্কৃতি আবহাওয়ার মধ্যেই পৃথিবীর সেরা ছবিগুলো দেখার সুযোগ পেল বাংলার দর্শকরা। যেমন একের পর এক গোদারের সাম্প্রতিক ছবিগুলো তো দেখার সুযোগ হলো এই উৎসবেই, পাশাপাশি এই উৎসব এখন প্রতিযোগিতামূলকও। কুক্ষিগত বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ল মাঠে-ময়দানে।
এবার চলচ্চিত্র-উৎসব ২৫। দেশ-বিদেশের সেরা ছবির মেলা। কান-ভেনিস চলচ্চিত্রোৎসব থেকে নিয়ে আসা সব ছবি। রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে এবার বরপ্রাপ্তি জার্মান পরিচালক আলেকজান্ডার ক্লুগ, ভলকার স্কোলনডর্ফ এবং সেø­াভাকিয়ান পরিচালক ডুসান হানকের নির্বাচিত বেশকিছু ছবি। এবার সুবর্ণজয়ন্তী হয়েছে এমন কিছু হলিউড ওল্ড ক্ল্যাসিকের রেস্টোর্ড ভার্সন ছিল এই উৎসবে। যেমন Ñ মিডনাইট কাউবয়, দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চ বা টোপাজ কিংবা ইজি রাইডার। এবার যেসব পরিচালকের ছবি উৎসবে ছিল তাঁদের মধ্যে রয়েছেন Ñ কোস্ট্রা গাভরাস, ফ্রাঁসোয়া ওজো, কেন লোচ, লভ ডিয়াজ, এলিয়া সুলেমান, আটম এগোয়ান, ব্রুনো দুমো প্রমুখ। স্টিনারি বিভাগে পেলাম নৌশাদ, অরবিন্দ মুখার্জি, মান্না দে, জহর রায় প্রমুখকে।

এবং পন্টিকার্ভো
কলকাতা ভোলেনি সেই স্মৃতি। গিল্লো পন্টিকার্ভো স্বয়ং উপস্থিত। সঙ্গে তাঁর সেই কিংবদন্তিসম ছবি ব্যাটল অব আলজেরিয়া। সেবারের চলচ্চিত্র-উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সেই ছবি। প্রায় তিন ঘণ্টার ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল দর্শক। নন্দন চত্বরে তো স্বয়ং পন্টিকার্ভো। ফলে উৎসব চত্বরে এক আলাদা উত্তেজনা। সেই স্মৃতি ঘিরেই এবার আবার পন্টিকার্ভো-স্মরণ। অবশ্য অন্য একটা উপলক্ষ আছে। এবার গিল্লো পন্টিকার্ভোর জন্মশতবার্ষিকী। তাই সেন্টেনারি বিভাগে এবার তিনি। ১৯১৯ সালে ইতালিতে জন্ম তাঁর। বড়ভাই ব্রুনো পন্টিকার্ভো স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী। পন্টিকার্ভো নিজেও বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করেন। ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানীই হবেন; কিন্তু শেষ অবধি হন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা সূত্রেই রাজনীতির নানা মহলের সঙ্গে তাঁর ক্রমঃপরিচিতি। সাংবাদিকতা ছেড়ে চলচ্চিত্রে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালক। ডকুমেন্টারি দিয়ে শুরু। তারপর ফিচার। কিন্তু ফিচারের আঁচ রয়েই যায় তাঁর কাহিনিচিত্রে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ অবধি টানা এক ডজন তথ্যচিত্র। তারপরেই হাত দিলেন কাহিনিচিত্রে। এই ব্যাটল অব আলজেরিয়া। কিন্তু এই ছবির মধ্যেও রয়েছে কাহিনিচিত্রের নিখাদ প্রয়োগ। এই ছবির জন্যেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি। রাজনৈতিক পটভূমিতে তৈরি ছবিটি পাশাপাশি রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিকও। ব্যাটল অব আলজেরিয়া রাতারাতি আধুনিক রাজনৈতিক সিনেমা জগতে সাড়া জাগাল। রাজনৈতিক ছবি করার মতো অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিল। গিল্লো ছিলেন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের একজন প্রধান কমান্ডার। ব্যক্তিজীবনের রাজনৈতিক দর্শন, পাশাপাশি কাহিনিচিত্র ও তথ্যচিত্র Ñ এই দুরকম শৈলী ব্যবহার করে গিল্লো যে-উচ্চতায় ছবিকে নিয়ে গেছেন তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। সমষ্টির মুক্তির স্বপ্নকে তিনি ব্যক্তিপর্যায়ে নামিয়ে আনেন, আবার ব্যক্তির স্বাধীন হওয়ার প্রবল রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাকে মিলিয়ে দেন পুরো জাতির সঙ্গে। এই ছবির চিত্রনাট্যকারও ছিলেন কমিউনিস্টকর্মী, ফ্রাঙ্কো সোলেনাস। সোলেনাস নিজেও চলচ্চিত্র-পরিচালক। তিনি গিল্লোর বার্ন! ছবিরও চিত্রনাট্যকার। বার্ন ছবিটি এবার এই পন্টিকার্ভো ১০০-তে কলকাতা ২৫ চলচিত্র-উৎসবে দেখানো হয়।
এরপর বেশকিছু তথ্যচিত্রের মাঝে অন্তত তিনটি ফিচার ছবি করেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই একটি বার্ন। এটিও উপনিবেশবাদবিরোধী ছবি। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মারলোন ব্রান্ডো। এই ছবিটি এবার পন্টিকার্ভো স্মরণে দেখানো হয় চলচ্চিত্র-উৎসবে। গিল্লো পন্টিকার্ভোর মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে ইতালিতে, তখন তাঁর বয়স ৮৬। হার্টঅ্যাটাকে মারা যান তিনি। বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে ছবি করতেন পন্টিকার্ভো। প্রচুর ছবির অফার ফিরিয়ে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ছবির সঙ্গে প্রেমে না পড়া পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। বার্ন এবং ব্যাটল অব আলজেরিয়ার ছবি ছাড়া তাঁর বিখ্যাত ছবি হলো কাপো, দি ওয়াইল্ড ব্লু রোড এবং অপারেশন ওগ্রো। তিনি তথ্যচিত্রের যে-শাখা ‘সিনেমা ভেরি’র সার্থক প্রয়োগ করেন সিনেমায়। শুধু মত-ভাবনায় নয়, তিনি সব ক্ষেত্রে সব সময়েই সমসাময়িক। তিনি শুধু নির্দেশকই নন, শিল্প নির্দেশনার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর জগৎজোড়া নাম।

গৌতম ঘোষের নতুন ছবি
গৌতম ঘোষের নতুন ছবি এই কলকাতা দেখল এই উৎসবের দৌলতে। জার্নি বা পথচলার গল্প। আত্মকেন্দ্রিকতা বা এই স্বার্থপর দুনিয়ার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ। পরিচালক গৌতম ঘোষের নতুন ছবি রাহগীরের ওয়ান লাইনার হতে পারে এটাই। এখনকার দুনিয়ার প্রধান সমস্যা স্বার্থপরতা। আর তার বিরুদ্ধেই ছবি করতে চেয়েছেন গৌতম। তার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন এক বিস্তীর্ণ পটভূমি। আর সেখানে তিনি নিয়ে এসেছেন তাঁর ছবির তিন মুখ্য চরিত্রকে Ñ নাথনি, লাখপতি ও চপটলালকে। নাথনির আছে দুই সন্তান এবং এক পঙ্গু স্বামী। নাথনির রোজগারেই সংসার চলে। নাথনি রোজ শহরে যায় মজুর খাটতে। আর সেই উপার্জনই তার বেঁচে থাকার প্রধান উৎস। এই নাথনির সঙ্গেই পরিচয় হয় আরেক দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক লাখপতির। পথচলার পথেই লাখপতির সঙ্গে দেখা হয় নাথনির। বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মধ্যেই তাদের পথচলা। আর এর জন্যেই পরিচালক গৌতম ঘোষ ছবির পটভূমি বেছে নিয়েছেন ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচি ও নেতারহাট। সেখানকার অনবদ্য প্রকৃতি ছবির ভাবনার সঙ্গে দারুণভাবে মিশে যেতে থাকে।
লাখপতি আর নাথনির পথচলার পথে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চপটলালের। সে তার গাড়িতে নিয়ে চলেছে এক অসুস্থ রোগীকে। এই অসুস্থ রোগীকে অতিদ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। জীবন-মরণ সমস্যা; কিন্তু পথে প্রচ- বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিতে গাড়ির চাকা বসে যায়। গাড়ি উদ্ধারের জন্যে লোক দরকার। কেউই এগিয়ে আসে না। এক স্বার্থপর দুনিয়ার সার্বিক চেহারা তুলে ধরেন গৌতম। এক বিষয়-সম্পৃক্ত বৃষ্টির দৃশ্য ছবির সম্পদ হয়ে ওঠে। শেষ অবধি পথে দেখা হয়ে যাওয়া নাথনি আর লাখপতিকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যে অনুরোধ করে চপটলাল। এক অসুস্থ রোগীর জীবনভিক্ষা চায় সে। এদিকে এই সাহায্য করতে গেলে শহরে যেতে দেরি হয়ে যাবে তাদের। দেরি হলে কাজ পাবে না তারা। পুরো পরিবার অনশন। শেষ অবধি অবশ্য নাথনি আর লাখপতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মানবতার জয় ঘোষণা করেই ছবি শেষ হয়।
নাথনি, লাখপতি এবং চপটলালের ভূমিকায় অভিনয় করেন যথাক্রমে তিলোত্তমা সোম, আদিল হুসেন ও নীরজ কবি। সকলেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছেন। ছবিতে সমসাময়িক রাজনীতি এসেছে। এসেছে অরাজকতার সময়। সূক্ষ্মভাবে সব চিহ্নিত করেছেন পরিচালক। ঈষান ঘোষের ক্যামেরা এই ছবির আরেকটি অ্যাসেট।