সঞ্চয়পত্রের হিসাব

নির্দিষ্ট দিনটিতে সঞ্চয়পত্রের কুপনদুটি তার বহুদিনকার পুরনো ফোল্ডার ব্যাগে কয়েকবার দেখেশুনে গুছিয়ে তবেই তাদের হাজারীবাগের বাসা থেকে পথে নামে কবীর। অন্য মাসে কুপন থাকে একটি। আর প্রতি তৃতীয় মাসে একবার তা হয় দুটি। আজ তার দুটি কুপন ভাঙানোর দিন। এই দিনে তার পকেট অন্য মাসের তুলনায় কিছুটা ভারি হয়ে যায়। সেই মাসে সে দেখেশুনে বেশি বাজার-সদাই করতে পারে। আর নিজের মাসের হাতখরচও মন্দ থাকে না। বিকেলের দিকে নিয়মিত নয়, তার খেয়ালখুশিমতো কোনো কোনোদিন বেরোলে হাজারীবাগ পেরিয়ে জিগাতলায় যাওয়ার মাঝপথে ‘মায়ের দোয়া’ রেস্তোরাঁর পথে বিছানো মোড়ায় বসে সে খানিকটা সময় কাটায়। এখানকার কলিজার শিঙাড়া ও ঘন টিনের দুধের চা তার মন্দ লাগে না। সেখানে বসে সাতমসজিদ রোডের সচল গাড়ি-রিকশা-ভ্যান ও পথচলা মানুষের ব্যতিব্যস্ত অঢেল ভিড় দেখে কবীর।
সে জানে এবং তার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, এই বড় পথ ধরে সে কোনদিকে যায়। কোনদিকে তার সেই কাক্সিক্ষত ব্যাংক। সাতমসজিদ রোডের বাঁয়ে মোড় নিয়ে সামান্য পা চালিয়ে অনায়াসে সে-ব্যাংকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় কবীর। এর মেইন গেটের সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই ভেতর থেকে পোশাকি দারোয়ান মোটা কাচের দরজা টেনে ধরে। কবীর অনায়াসে তখন তার পরিচিত
ব্যাংককক্ষে ঢুকে যায়। রুমের পশ্চিম পাড় থেকে স্বচ্ছ কাচের দুটো পার্টিশন দেওয়া কিউবিকল ছেড়ে সে তৃতীয়টির কমবয়সী এক জুনিয়র অফিসারের সামনে পৌঁছে যায়। সেখানে দুটো চেয়ার পাতা। কোনোদিন তা সকাল সকালই দখল হয়ে যায়। আজ তা খালি পেয়ে একটিতে গিয়ে বসে সে। বসে তাড়াহুড়ো না করে মেয়ে জুনিয়র অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অপেক্ষায় থাকে। আজ তার সেই অতিকাক্সিক্ষত দিন।
কবীর লক্ষ করে, আজকাল রাজধানী শহরের প্রায় ব্যাংকগুলোতে অহরহ বড়সড় অঙ্কের লেনদেন হয়। যখন-তখন। তা ছয় অঙ্কের নিচে তো নয়। চেকবাহক নিজে হলে তাদের বসে অপেক্ষা করার সময় নেই। বরং ব্যাংক সাজিয়ে বসা সুসজ্জিতা লেডি অফিসারদের কাছে তাদের চেক ক্যাশ করে রাখার হালকা নির্দেশনা দিয়ে চলে যায় সহজ ভঙ্গিমায়।
‘কাজটা করে রাখবেন … সময় করে এসে তা নিয়ে যাব।’
এদিকে ব্যাংক অফিসার ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রায় উঠে দাঁড়ায়।
‘তা কেমন করে হয় … অন্তত এক কাপ-কফি … ?’
‘এখন হাতে সময় নেই … পরে হবে।’
কেউ কেউ তখন বসেও। তাদের ওজর-আবদার রাখতে হয়।
‘ঝটপট বেয়ারাকে বলুন … চিনি কম।’
বসেও তাদের নিস্তার নেই যেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শেয়ার মার্কেট, আমানত-জামানত …, কোন লিজিংয়ের অবস্থা কেমন যাচ্ছে ইত্যাদি নিয়ে তারা অনর্গল কথা বলে যায়। কোনো ব্যাংক লোন, সুদের হারের ওঠানামা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা কথা বলে তখন। মহিলা ব্যাংক কর্মকর্তা তার হাতের রুটিন কাজ চালিয়ে যায় ও তাদের কথাও শুনতে থাকে। এটা যেন তাদের এক পেশাগত রপ্ত করা অভ্যাস।
কখনো পাশের চেয়ারে বসে বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কবীরের ধারণা হয়, এই লোকগুলো কেতাদুরস্ত ধনী বনেদি ব্যবসায়ী। শহরের পাকাপোক্ত বাসিন্দা। তারা সারা শহর জুড়ে ছুটছে। অভিজাত অফিস-আদালত এলাকায় সুরম্য বিল্ডিংগুলোর যত্রতত্র তাদের যাতায়াত। যাওয়া-আসা। তাদের চোখের সামনে সর্বত্র যেন উড়ছে টাকা। টাকা আর টাকা। আর তা সংগ্রহ করার কৌশলী নেশাও বুঝি তাদের নখদর্পণে।
মহিলা ব্যাংক অফিসার কবীরকে চিনতে পারে।
‘ও আপনি …। আজ আপনাকে একটু বসতে হবে। হাতে কয়েকটা জরুরি কাজ সেরে …।’
কবীর বিনয়ী হয়।
‘আমার তাড়া নেই। আপনি কাজ শেষ করুন …।’
এতক্ষণে কবীরের পাশের চেয়ারে একজন নতুন ক্লায়েন্ট এসে বসে। তার চোখে মোটা ফ্রেমের ভারী চশমা, পরনে হালকা রঙের প্যান্টের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া রংচঙা হাফ হাতার বুশশার্ট। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথার চুল হালকা-পাতলা।
তাকে দেখে ব্যাংক অফিসার উৎফুল্ল­ হয়ে হাসে।
‘আপনার কমার্শিয়াল ব্যাংকে চেক বুক হয়ে গেছে।’
‘আর একটু উপকার করতে হবে। আমার এই চেকটা একটু অ্যানকেশ করে দিতে হবে। এই লম্বা লাইন ধরে …।’
‘আপনাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। চেকটা দিন।’
চেক হাতে ব্যাংক অফিসার উঠে যায়।
‘আপনি বসুন।’
ব্যাংক অফিসার ফিরে আসে।
‘একটু অপেক্ষা করতে হবে। ক্যাশ কাউন্টারে ভিড় লেগে গেছে।’
ব্যাংক অফিসার ড্রয়ার টেনে সামনে বসা ভদ্রলোককে মোটা চেকবই এগিয়ে দিয়ে জানান, ‘লেজার বইয়ে একটা সই দিয়ে দিন।’
ব্যাংক অফিসার টেবিলে থাকা কাগজপত্রে সই ও কয়েকটা সিলছাপ্পর মেরে আবার উঠে যায়। খানিক পরে হাতে হাজার টাকার দুই বান্ডেল নোট নিয়ে ফিরে আসে। ভদ্রলোক অনেকটা না দেখার মতো ভান করে টাকাগুলো প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘থ্যাংকস।’ বলে চেয়ার ছেড়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় পা টেনে চলে যান।
এবার অফিসার কিছুটা কৈফিয়তের সুরে আবার তাকে বলে, ‘আপনার শুধু সঞ্চয়পত্রের কুপন জমা দেওয়ার হলে এক্ষুনি হয়ে যেত। কিন্তু আপনি তো আবার কুপন ভাঙিয়ে হাতে ক্যাশ নিয়ে যাবেন … তাই না?’
‘জি।’ কবীর সলজ্জ হাসে।
‘তাহলে একটু বসুন …।’
কবীর হাতে টাকা পেয়ে পাতা পাতা ধরে গুনে তবে তা প্যান্টের ডান পকেটে সযতেœ গুছিয়ে রেখে ব্যাংক ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে বাইরে সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। এতক্ষণ ব্যাংকের এসিতে বসে বাইরে এসে তার উত্তাপটা মন্দ লাগেনি। ক্যালেন্ডারের হিসাবে ফাল্গুন মাস এসে গেলেও শীতের আমেজ রয়ে গেছে। কবীর সূর্যের ওমের আরামটা শরীরে ধরে রেখে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকে। ধীর পদক্ষেপে। তার এখনকার গন্তব্যস্থান বাজার। মোহাম্মদপুর বাজার, সেখান থেকে আজ ভালো-মন্দ, গতানুগতিকতা ছাড়িয়ে কিছু বাজার-সওদা করে ঘরে ফিরবে। ছেলের বউ ঝরনাও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকবে। তারপর রান্না হবে। কবীর খেতে বসবে আনন্দের সঙ্গে।

দুই
কবীর জন্মেছিল ঢাকার অদূরে ইকুরিয়া থানার চরসিন্দুর গ্রামে। এক বড় কৃষক পরিবারে। তার বাবা হাজি তালুক মিয়া নিজে কৃষিকাজে হাত না লাগালেও তার অভিজ্ঞতা ও কামলা-জোগাল তদারকিতে তিনি ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী। ফসলের পর ফসল ধরে এগিয়ে বাদল-বৃষ্টি-খরা এড়িয়ে তা সময় ধরে ঘরে তুলে আনাতে তার জুড়ি ছিল না। আশপাশের দু-চার গ্রামের নানা মাপের চাষি-কৃষকরা তার কাছে আসত পরামর্শ নিতে। এছাড়া তিনি ছিলেন ইকুরিয়া হাটবাজারের প্রধান একজন মৌসুমি পাট কারবারিও। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে তার পাটের গুদামঘর ছিল বাজারের সবার পরিচিত। তার সফলতা ও সচ্ছলতা ছিল অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়।
হাজি তালুকের সংসারে তাদের বড় মেয়ের জন্মের চার বছর পর কবীর জন্মেছিল। পরিবারে তার আদরযত্নের কমতি ছিল না। হাজি তালুকের
গাই-গরুর পালের দুধ খেয়েই সে বড় হয়েছিল। আর এর সঙ্গে কবীরের উপরি পাওনা ছিল বড় বোন আছিয়ার সান্নিধ্য ও অন্তরঙ্গ ভালোবাসা।
কবীরের বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল চরসিন্দুর উচ্চ মাদ্রাসায়। কিন্তু তিনি কবীরকে ঘিরে উচ্চাভিলাষী হতে থাকলে তাকে ইকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। সেই স্কুলে অবশ্য তাকে নদীর খাল ধরে নৌকায় যেতে হতো।
কবীরের স্কুল-শিক্ষার শেষের দিকের পরপর দুবার তার বাবা পাট ব্যবসায় মার খান। এর কারণ, বছরে কয়েকবার পাটকল শ্রমিক ধর্মঘট। এ-সময়ে আর্থিকভাবে খানিকটা অসচ্ছল হয়ে পড়লেও তিনি ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে যান, ‘বাবা তুমি স্কুলের পড়া যখন ভালোভাবে পাশ দিছ … এইবার তুমি ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ/এমএ পড়তে যাও। চিন্তার কিছু নাই। আমি যতদিন আছি …। চেষ্টা করো যাতে তোমাকে আর গইগেরামে ফিরা আইতে না অয়। গ্রামের মানুষ দিন দিন বড় ভেজাইল্লা অইয়া যাইতেছে। কারে মাইরা কে খাইবো।’
তার সঙ্গের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ-সালাপ করে কবীর বুঝতে পারে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার হবে না। গ্রেড কম। তাই সে ঢাকা কলেজে বিকম অনার্সে ভর্তি হয়। সে এখনকার প্রচলিত নিয়ম ধরে নিয়ে কমার্স পড়লে চাকরির সম্ভাবনা বেশি। ঢাকায় তার আপনজন তেমন না থাকায় বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে কলেজ হোস্টেলে সে ওঠে। কলেজ হোস্টেল জীবন কবীরের মন্দ কাটেনি। সারাদেশের কত জায়গার ছেলেপেলে না এখানে এসে উঠেছে। অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়।
বেলা তিনটা-চারটার মধ্যে কলেজের ক্লাস শেষ। এরপর কেউ কমনরুমে, না হয় খেলার মাঠে যায়। কবীর ফুটবল খেলার দলে যোগ দেয়। এরপর সান্ধ্য-আড্ডা। সঙ্গে আলীর দোকানের শিঙাড়া-চা। ভালোই সময় কেটেছে তার।
যেসব শিক্ষক তাদের পড়াতেন তারাও মানগত বিবেচনায় ভালো ছিলেন। সে-সময়ের দু-চারজন শিক্ষক, বিশেষ করে বাংলা-ইংরেজি-অংকের শিক্ষকদের ঢাকায় সুখ্যাতি ছিল।
কো-এডুকেশন ক্লাসে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না তখন। তারা সারি বেঁধে সামনের লম্বা দুই-তিন বেঞ্চ ধরে বসত। এদের মধ্যে বোরখা পরা থেকে নিয়ে আধুনিক ধাঁচের মেয়েরাও ছিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার আধুনিক কায়দার। টিফিন ব্রেকে তারা ছেলেদের সঙ্গে টেবিল টেনিস, ক্যারম, লুডু খেলত।
বেশিরভাগ সময় কবীর দর্শকের ভূমিকায় থাকত। সবার খেলাধুলা দেখত। এর মধ্যে দু-চারজন আবার প্রফেশনাল টেনিস, ফুটবল প্লে­য়ারও ছিল। তারা সব খেলায়ই ভালো ছিল। এর মধ্যে দু-চারজন মেয়েও ছিল। তারা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় যেত এবং কাপ-মেডেল নিয়ে ফিরত। তাদের মধ্যে মালিহা খানম ও কুসুমী দাস জোড় তো আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবর ব্যাডমিন্টনে মেডেল নিয়ে আসত। তারা কমনরুমও হই-হুল্লে­াড় করে মাতিয়ে রাখত। কবীরের বেশ মনে আছে, একদিন তিনজন মেয়ে ক্যারম বোর্ডে জাঁকিয়ে বসে বাজি ধরল, ‘আজ এই ক্যারম কমপিটিশনে যে হারবে তারা বলাকা হলে সিনেমা দেখাবে।’ যেই কথা … সেই কাজ। কিন্তু ওরা যে তিনজন। চতুর্থজন খুঁজে না পেয়ে অগত্যা তাদের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা কবীরকে তারা জোরজবরদস্তি করে ক্যারম খেলায় নামায়। কবীর মাঝে মাঝে রাতের বেলায় ক্যারম খেলত। সামান্য অভ্যাস আছে মনে করে দাঁড়িয়ে যায়। খেলা শুরু হলে দেখা গেল, কবীরের পার্টনার মালিহা খানম যথেষ্ট ভালো খেলে। সুতরাং জয় হলো মালিহা-কবীর পার্টনারশিপের।
বৃহস্পতিবার কলেজের ক্লাস হতো আধা দিন। মালিহা হইচই করে তাদের ক্যারম বিজয় ঘোষণার প্রোগ্রাম করে ফেলে। শুধু তারাই নয়, সঙ্গে ক্লাসের অনেকেই চাঁদা তুলে সেদিন বলাকায় ম্যাটিনি শো দেখতে গিয়েছিল। আর হাফ-টাইমে মালিহা সবাইকে আইসক্রিম খাইয়েছিল। সে বড়লোকের মেয়ে। গাড়িতে আসা-যাওয়া করত। ক্যারম জেতার পর থেকে মালিহা কবীরকে দেখলেই ‘পার্টনার’ বলে সম্বোধন করত। কবীর তাতে লজ্জায় পড়ে যেত। এই নিয়ে ছাত্রছাত্রী মহলে একটা চাপা গুঞ্জরণও ছড়িয়ে ছিল।
এসব সেই ছাত্রজীবনের কথা। কতদিন আগের তা আজ কবীরের ভালো মনেও নেই।

তিন
গ্রামীণ সাদামাটা আখতারী তার জীবনে এসেছিল অল্প বয়সে। তার চাকরি পাওয়ার প্রথম বছরের শেষের দিকে। বাবা-মার তাগিদেই বিয়েতে তাকে রাজি হতে হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, ‘বাবা … দুইডা না, চারডা না, তুই আমাদের বংশের একমাত্র বাতি। আমরা আর কয়দিন …?’
আশ্চর্যজনক হলেও তার বিয়ের পরের বছরই তাদের পালা গাই-গরুর গুঁতো খেয়ে পড়ে গিয়ে বাবা যে অসুস্থ হলেন আর উঠে দাঁড়ালেন না। তিনি চলেই গেলেন। স্থানীয় কোনো চিকিৎসায় তাকে ধরেনি। কবীর বাবাকে ঢাকায় এনে উন্নত চিকিৎসার কথা বলেছিল। তাতে তিনি রাজি হননি। বাবার মৃত্যুতে মা একা হয়েও তাদের ভিটা ছাড়েননি। বাবার স্মৃতি, শহরে থাকা ছেলেবউয়ের গালগল্প করে গাঁয়ের গাছগাছালির মধ্যে খোলা বাতাস ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে তার জীবন কেটে যেতে থাকে। ছেলে, ছেলেবউ ঝরনার আবদার ধরে শহরে এসে বসবাসের কথা সে ভাবেননি কোনোদিন।
আখতারী-কবীরের বিয়ের তিন বছরের মাথায় ছেলে আশিকের জন্ম। খানিক দেরিতেই বলতে হয়। তাতেও ছেলেকে ঘিরে তাদের আনন্দের সীমা ছিল না। এ উপলক্ষে যথেষ্ট ওজর-আবদার করে মাকে কবীর ঢাকা এনেছিল। তার আবদারের জোরালো দিকটা ছিল, ‘মা আখতারী কি জানে নতুন শিশুর সেবা, তার তথ্যতালাফি। সঠিক যত্ন কেমন করে করতে হয়? আখতারী কমবয়সী মেয়ে … তুমি একটু দেখিয়ে-শুনিয়ে না দিলে …।’
তাৎক্ষণিকভাবে কবীরের মা সেই আবদারে খুশি হয়েই সাড়া দিয়েছিলেন।
ঢাকার অদূরে চরসিন্দুর গ্রামের বাড়ি থেকে কবীর নিজেই মাকে ঢাকা এনেছিল। সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার চাকরি হিসেবে আজিমপুর কলোনিতে যে-বাসা পেয়েছিল, তাতে মাকে এনে উঠিয়েছিল। কবীরের ইচ্ছা ছিল, মাকে তার কাছেই রাখবে। একা একা গইগেরামে থাকা ঠিক নয়। তার বয়স বাড়ছে। দু-চারটা স্থায়ী রোগশোকও ভর করেছে তার দেহে।
বউয়েরও প্রস্তাবটা মন্দ লাগেনি। তার মতে, একজন ময়মুরুব্বি ঘরে থাকলে সবার জন্য মঙ্গলজনক। ছোট্ট শিশুর দেখভালের জন্য তো অবশ্যই।
কিন্তু মা মাসখানেক ঢাকায় থাকার পর হাঁপিয়ে উঠে একদিন কবীরকে বলেন, ‘বাবা কবীর ঢাহায় আমার গা-গতর ঠিক লাগতাছে না। আমি বরং বাড়ির গ্রামে …।’
কবীর মার অবস্থা বুঝে ঢাকায় ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলে তাকে ঠেকানোর যে-চেষ্টা করল তাতে সুবিধা হয়নি। বেশি দেরিও করতে পারেনি। কাছের শুক্র-শনির বন্ধ ধরে মাকে সে দিয়ে আসে তাদের চরসিন্দুরে।
এদিকে আশিক যতই বড় হতে থাকে কবীরের চাকরিজীবনের মেয়াদও ক্রমে ক্রমে শেষ হয়ে আসতে থাকে। একদিন কবীর অবসরজীবনের নোটিশ পায়।
পেনশনে যাওয়াটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তারপরও প্রথা অনুযায়ী তাকে তা মেনে নিতে হয়। আশিক তখন কলেজের শেষ বর্ষে।
পেনশনের চেকটা হাতে নেওয়ার সময় ভারিক্কি গোছের অ্যাকাউন্ট্যান্ট কবীরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন,
‘সময় নষ্ট না করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনে ফেলবেন। মাসের শেষে কিছু ক্যাশ না এলে চলবেন কেমনে? সংসারের খরচ আছে না?’
সঞ্চয়পত্র কেনার ব্যাপারটা তারও জানা ছিল। সীমিত আয়ের মানুষের এর বিকল্প সহায় আর তেমন নেই।
কবীর পেনশনের টাকা কিছুটা হাতে রেখে তাই করেছিল। আর এর কিছু টাকা তিনি ব্যাংকে সামান্য সুদে রেখে দিয়েছিলেন। তাও আখতারীর দুরারোগ্য এক ব্যাধির চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে তা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভাগ্য ভালো, ততদিনে আশিক সরকারি মৎস্য বিভাগে চাকরি পেয়ে যায়। তা পাওয়াও তেমন সহজ ছিল না। তার ছোট কাকার সাহায্য-সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু আখতারীকে যে বাঁচানো গেল না, সেই কষ্টও তাকে সইতে হলো। চাকরি ছেড়ে কবীর তখন আরো একাকী হয়ে পড়ে। বাপ-বেটার সংসার যখন প্রায় অচল হয়ে পড়ার উপক্রম, তখন আশিকের ছোট চাচাই তার বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। পরিশেষে তাদের ঘরে ঝরনা আসে এবং সংসারের হাল ধরে।

চার
প্রতি মাসের একটি দিনক্ষণের অপেক্ষায় থাকে কবীর। এই দিনটি যে সবসময় এক নিয়মে হয় … তাও নয়। ত্রিশ-একত্রিশ দিনের মাসে তা বদলে যায় অনেক সময়। তাছাড়া সেই দিন শুক্র-শনিতেও পড়ে যায়। তখন ব্যাংক বন্ধ। সেই উপলক্ষটি তখন গিয়ে পড়ে রোববারে। সপ্তাহের প্রথম দিনে।
দিনক্ষণ যাই হোক না কেন, সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে কবীর খানিকটা উত্তেজনা-অস্থিরতায় ভোগে। সকালে সময়মতো ঘুম ভেঙে কালক্ষেপণ না করে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে না উঠে সেদিন ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। কেননা, তাকে তো যেতে হবে ব্যাংকে। পারিবারিক, নয়তো ত্রৈমাসিক সঞ্চয়পত্রের টাকা ওঠানোর দিন-তারিখ যে আজ। কাজেই সময় নষ্ট করা যাবে না। ঘড়ি ধরে শেভ-গোসল ইত্যাদি সেরে নাশতা খেয়ে তাকে বের হতে হবে। একমাত্র ছেলে আশিকের বউ ঝরনাকে সে আগের রাতেই বলে রাখে, ‘বউমা কাল আমার ব্যাংকে যাওয়ার দিন। চা-নাশতার পর্বটা ঝটপট সেরে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে।’
ঝরনাও তা মনে রাখে। সে সকাল সকাল উঠে যায়। শ্বশুরের এই আগামবার্তার প্রতি সেও সজাগ। সে জানে, এই বিশিষ্ট দিনটিতে তিনি বাড়ি ফেরেন খানিক দেরি করে। আর যখন ফেরেন, তখন তার হাতে থাকে কয়েকটা ছোটবড় ব্যাগ-পোঁটলা। সেগুলোতে প্রথাগত নিয়মের মতোই থাকে ঋতুর কোনো না কোনো ফলফলান্তি, বাজারে নতুন আসা তরতাজা তরিতরকারি বা বিশেষ কোনো শাক-লতা-পাতা। সর্বোপরি ঝরনাকে যা বেশি আকর্ষণ করে তা হলো, বিল-ঝিল-নদীনালার আসল ছোট-বড় মাছ, যা আজকাল হাটবাজারে তেমন ওঠে না বললেই চলে। বাজারে ওঠে শুধু কষ্টেসৃষ্টে হাঁ করে জীবিত থাকা ছোটবড় চাষের মাছ। এখন রুই-কাতল থেকে নিয়ে পাবদা-টেংরা, এমনকি ছোট পুঁটি মাছেরও দেদার চাষ হয়। এবং তা বিকোয়ও তুলনামূলকভাবে কম দামে। স্বাভাবিক জলাধারের শিং-মাগুর-কই বলতে গেলে তো আজকাল পাওয়াই যায় না। সেদিন কবীর সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফেরে। আর তখন তার অবসরের জীবনধারার কিছুটা সার্থকতাও খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হয় কবীর।
‘বউমা আজকাল কৃত্রিম চাষের মাছ ও ফার্মের মুরগি খেতে খেতে মুখের স্বাদই নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের। তবে সামান্য হলেও বিলঝিল, নদীনালার ছোট মাছের মধ্যে মলা-ঢেলা, টেংরা আরো কিছু মাছ পাওয়া যায় শুধু। আর বড় মাছের মধ্যে নদীর বোয়াল, চিতল যদিও-বা ওঠে তা আমাদের মতো ছাপোষা মানুষজনের পক্ষে হাত দেওয়া সম্ভব নয়।’
একটু থেমে আবার বলে যান তিনি, ‘শোল-গজার বা বাইন ছোটখাটো হলে কেনা যায় দু-একটা।’
সেটাই সে করে এই বিশেষ দিনটিতে। যেদিন তার হাতে আসে সঞ্চয়পত্রের কিছু বেশতি পয়সা বা গতানুগতিক ধারার বাইরের কিছু আয়, সেদিন কবীর গদগদ হয়েই বলেন, ‘নাও-গো বউমা নাও … ধরো কশাইয়া মাছটা রান্দ। জিরাগুঁড়া ছিটাইয়া দিও ওপরে …।’
কবীরের মতো ঝরনাও বড় হয়েছে গ্রামেগঞ্জে। তারও গ্রামগঞ্জের হাটবাজার থেকে কেনা, ছোট ছোট নাইয়া জেলেদের ধরা ছোট-বড় মাছের স্বাদ-গন্ধের সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। ঝরনার বাবা দূর-দূরান্তের হাটবাজারে যেতেন। কখনো কখনো প্রায় মাঝরাত করে ঘরে ফিরতেন। তার মা ও ছোট ভাইবোনেরা বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে থাকত। তাদের বাবা বাজার হাতে ফিরে এলে তার আনা মাছ-বাজার দেখে আনন্দিত হয়ে বসে থেকে সেসব মাছ রান্না হলে তবে খেয়ে তারা ঘুমাতে যেত। সেই সময়কার মার হাতের রান্না করা মাছের স্বাদ-ঘ্রাণ আজো যেন ঝরনার মুখে লেগে আছে। তাই বাড়িতে বাজারের আয়োজন হলে শ্বশুরের মতো সেও উৎফুল্ল­ হয়। ঝরনাও শ্বশুরের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে। আর এসে গেলে সে ঝটপট তার হাত থেকে ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে আগ্রহসহকারে সব দেখে ও তা রান্নাবান্নার আয়োজন করতে শুরু করে দেয়। ঝরনা জানে, আজ শ্বশুর যা যা এনেছে এর কিছুটা রান্না হলে তবে তিনি খাবেন।
তবে ছেলে আশিকের বাবা ও স্ত্রীর মতো এ-জাতীয় আকর্ষণ নেই। নতুন মাছ বা তরিতরকারি, ফলফলান্তির আস্বাদন উপভোগ করার ব্যাপারে সে মোটামুটি নিস্পৃহ। খেতে বসে সামনে যা পায় তাই সে খেয়ে নেয়। মাছে মাছে স্বাদের তারতম্য হয় … এসব তার খুব একটা জানা নেই। তার স্ত্রী এ-ব্যাপারে তাকে আগ্রহী করে তুলতে গিয়ে সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
তখন নিরুৎসাহ হয়ে থেমে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় থাকে না।
তবে সেই বিশেষ দিনে শ্বশুরকে সদ্য কিনে আনা মাছ-সবজি রান্না করে খেতে দিয়ে সেই স্বাদের ভিন্নতার আলাপটা খুব জমে তাদের।
কবীর খেতে খেতে তরতাজা মাছের স্বাদ-আস্বাদনে উল্লসিত হয়ে আহ্-উহ্ করে। ঝরনার তখন খুব আনন্দ হয়। তখন তার ছোটবেলার গ্রামজীবনের কত কথা না মনে পড়ে যেতে থাকে। একে একে।
একসময় তার চোখের সামনে আখতারীর ছায়া এসে হাজির হয়। সঙ্গে তার আরো কিছু স্মৃতিকথা এগিয়ে আসতে থাকে।
কবীরের চাকরির সুবাদে ছেলে আশিক বড় হয়েছে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। তার দেশের বাড়িতে কালেভদ্রে যেতে হলেও তা বেশিদিনের জন্য নয়। গ্রীষ্মের ছুটিছাটায় বড়জোর সে দেড়-দুই মাস থেকেছে গ্রামে। তাই গ্রামগঞ্জের সুখ-বেসুখ-আরামের খবরাখবরের সঙ্গে পরিচয় তার খুব একটা হয় নাই।

পাঁচ
কবীর বাজারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আর তখনই কে একজন মহিলা তার হাত টেনে ধরে।
‘কে … কবীর বলে মনে হচ্ছে যে?’
কবীর কাঁচুমাচু হয়ে থমকে দাঁড়ায়। সে মহিলার দিকে তাকায়।
‘আমি তো ঠিক …।’
‘না চেনারই কথা। অনেকদিন আগের কথা। তুমি এত সনের দিকে ঢাকা কলেজে পড়তে না? বিশ-ত্রিশ বছর তো হবেই …?’
কবীর আচমকা হোঁচট খায় যেন, ‘হ্যাঁ পড়তাম তো! কিন্তু আপনি?’
‘আমি মালিহা।’
কবীরের আবছা আবছা অনেক কথা মনে পড়তে থাকে। ‘হ্যাঁ আপনি মালিহা … মনে পড়ছে।’
‘আপনি নয় … বলো তুমি … আমরা কত-না আনন্দ করতাম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে … ক্যারম-টেবিল টেনিস খেলতাম। সিনেমা দেখতাম।’
কবীর মালিহার কাছে এগোয়, ‘তাই তো! কতদিন আগেকার কথা …।’
মালিহা হাত বাড়িয়ে কবীরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। সঙ্গে তার প্রাণখোলা হাসির মহড়ায় তাকেও হাসতে হয়।
‘একবার যখন পেয়েছি কবীর … তোমাকে … আর ছাড়ছে কে?’
‘কী করছ এখন?’
‘টিঅ্যান্ডটিতেই?’
‘না অবসরপ্রাপ্ত। কতদিন হয়ে গেল …!’
‘তা হলে তো আরো ভালো … কাজের ব্যস্ততার তাড়া নেই। নির্বিঘœ সময় কাটানো যাবে। চলো বসি কোথাও … আমাদের অতীতের কথা … বর্তমানের কথা … সব শুনব আর বলব … কেমন?’
কবীর মৃদু হেসে মাথা নাড়ে।
মালিহা কবীরের হাত না ছেড়েই হাঁটে। এগিয়ে যায়।
‘আমরা কি হেঁটে হেঁটে কথা বলব? চলো বসি কোথাও।’
স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কবীরেরও সায় দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ‘চলো বসি।’
মালিহা ভাবালু হয়ে কপাল কুঁচকায়, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে, এর আশপাশেই কোথাও ডে অ্যান্ড নাইট বার-বি-কিউ নামে একটা ভালো কাবাব হাউজ রয়েছে … কতদিন হয় বটিকাবাব খাই না। পৃথিবী জুড়ে চষে বেড়াই, কত ধরনের খাবার না খাই … কিন্তু ওই যে বটিকাবাব তা পাই না কোথাও।’
কবীর জানে তা সে এখানে পাবে না। তবে এ-ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমন খাবারের দোকানের নাম শুনেছে বলেও মনে হয় না তার।
মালিহা কবীরের হাত ধরে আগেপিছে হেঁটে এ-পথের পাশে পেয়ে যায় তার ‘বার-বি-কিউ’ হাউজ।
‘এই যে পেয়ে গেছি! আমি বলছিলাম না … আমার আন্দাজ ভুল হতে পারে না। ঢাকায় এলেই এখানে একবার আসা চাই আমার। আর পেটপূর্তি যত কাবাব আছে সব … শিককাবাব, বটিকাবাব, চিকেন রোস্ট … খাটাখাট … সঙ্গে রুমালি রুটি। এখানকার খাটাখাট আর রুমালি রুটি যা জমে … স্বাদটা একেবারে জিহ্বায় লেগে থাকে।’
‘কী বললে, খাটাখাট!’
‘হ্যাঁ গরুর দিল-গুর্দা আরো কী কী দিয়ে জানি খোলা বড় তাওয়ায় খুন্তি-ছুরি দিয়ে খাটাখাট শব্দে কাটে ও ভাজে। আর মাংসের সুবাস ছড়াতে থাকে। যা মজা! সাথে রুমালি রুটি …।’
কবীরকে হাত ধরে টেনে ‘বার-বি- কিউ’ হাউজে ঢুকে পড়ে মালিহা।
একজন বয়স্ক বয় ছুটে আসে, ‘আসেন ম্যাম … আজকাল তো আপনাকে দেখিই না।’
‘এই তো এলাম। কাল আবার চলে যাবো।’
‘কোথায় যাবে?’ বসতে বসতে কবীর আগ্রহী হয়।
‘কেন মাল্টায়।’
‘সেটা আবার কোথায়?’
‘ভূমধ্যসাগরের এক দ্বীপ।’
‘সেখানে কী?’
‘আমার হাজব্যান্ড থাকে। এটা অবশ্য আমার দ্বিতীয় জামাই। ও ওখানে ব্যবসা করে।’
‘দ্বিতীয় হাজব্যান্ড মানে?’
‘মোমেন্ট … অর্ডারটা দিয়ে নিই।’
একটানে মালিহা নানা ধরনের কাবাব-ফ্রাই-রুমালি রুটি … কত কিনা অর্ডার করল।
বেয়ারা চলে যাচ্ছিল, মালিহা বেয়ারাকে আবার ডাকে।
‘শোনো, সব এক প্লে­ট করে।’
‘জি ম্যাম … আমি জানি।’
‘জানো তো, ঠিকই আনলে দেখা যাবে দু-প্লে­ট। তোমাদের চালাকি … যত বেশি আনতে পারো … ততই পয়সা। পয়সা গাছে ধরে?’
‘প্রথম হাজব্যান্ড ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিল। তার পোস্টিং কাবুলে।
কাবুলের মরুভূমিতে মানুষ থাকে। তুমি যাও। আমি যাবো না আর যাইওনি। চলে গেলাম হাওয়াই। সেটা সুন্দর দ্বীপমালার দেশ। থেকে গেলাম। পেয়ে গেলাম এক মেক্সিকান ছেলেকে। সে মেয়েদের ভালোবাসতে জানে। পেশাগত পরিচয়ে সে কৃষিবিদ।’
খাবার এসে যায়। কবীরের সেদিকে খেয়াল নেই। সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মালিহার কথা শুনছিল। এমন কথা সে জীবনে শোনেনি। একবার তার মনে হচ্ছিল, সে আবোল-তাবোল বকছে। আবার মনে হলো, মালিহাকে সে যতদূর জানে, সবই তার পক্ষে সম্ভব। ছয়
মালিহা শিককাবাবের প্লে­টটা প্রথম টেনে নেয়। পরে বটিকাবাব। সঙ্গে রুমালি রুটি। কবীরের প্লে­টেও এসব তুলতে গেলে সে প্লে­ট এগিয়ে দেয়। তবে অনুযোগও করে।
‘এসব স্পাইসি হট পোড়া মাংস আমার খুব একটা অভ্যাস নেই। তবে বটিকাবাব দিতে পারো খানিক। সঙ্গে হাতের তৈরি সেই রুটি।’
‘কেন এসবে অভ্যাস করোনি। বউকে নিয়ে মাঝেসাজে খাও না?’
কবীর থমকে যায়।
‘সে তো নাই …।’
‘কেন বেঁচে নাই? এ কেমন কথা!’
‘কী আর বলব … কেমন করে জানি বুকের মরণব্যাধি গোপন করে টিকে ছিল কিছুদিন। যখন ব্যথা-কাতর হয়ে একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, তখন আমি জানতে পারি। দৌড়ে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার জানায়, টু লেট …। তেমন কিছু করার নেই।’
মালিহা খাবার থামিয়ে কোল্ড ড্রিংসের বোতল কাছে টেনে নেয়।
‘ব্রেস্ট ক্যান্সার, গোপন করে রেখেছিল … আশ্চর্য … বলো কী?’
কবীর চোখ নামায়।
‘অনেকটা তাই।’
‘তাহলে তুমি একা?’
‘ঠিক একা নই। ছেলে-বউয়ের সংসারে থাকি। বউমা খুব ভালো। বেশ তথ্যতালাফি করে আমার। আমি পেনশনার।’
‘থাক এসব কথা। খাবারে হাত দাও। দুপুর প্রায় হয়ে গেছে। আমি খুব ক্ষুধার্ত। সকালে আবার নাশতা করিনি। দেখো না মুটিয়ে যাচ্ছি।’
আখতারীর প্রসঙ্গ এসে গেলে কবীর খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। খাবারে হাত দেয় সময় নিয়ে।
বেয়ারা বারকয়েক এসে খবর নিয়ে যায়।
‘আরো কিছু দেবো ম্যাম? খাবার ঠিক আছে তো?’
বেয়ারাকে মালিহা ইশারায় যেতে বলে সে বলে যায়, ‘ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে মাঝখানে একটা স্টপেজ নিয়ে মাল্টা। দ্বীপমালার দেশ বড় সুন্দর। যেন ভূমধ্যসাগরে ভাসছে এক সোনার থালা।
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘মাল্টা। সেখানে আমার হাজব্যান্ড হাওয়াই থেকে ফল পাঠায়। এয়ার লিফট। এখন সে ওখানে।’
কবীর বোকা বোকা হয়ে প্রশ্ন করে –
‘তুমি এতো ঘোরো?
‘হ্যাঁ চলতি কা নাম গাড়ি।’
ততক্ষণে কবীরের জীবনে প্রথম শোনা প্লে­ট খাটাখাট এসে যায়। মালিহা উপুড় হয়ে এগিয়ে গন্ধ নেয়।
‘আহ কি এক্সোটিক স্মেল …’ বলে প্লে­টে থাকা অবস্থায় সে চামচ দিয়ে খানিকটা মুখে তুলে নেয়।
‘এই স্বাদ কোথাও পাওয়া যায় না। যদিও একটু ঝাল … কত দেশের কত খাবার খেলাম …। এমন হয় না।’
কবীর দেখে খাটাখাটের প্লে­টভর্তি ঘন ঝোলে ছোট ছোট গাঢ়-হালকা মাংসের টুকরো।
মালিহা চামচভর্তি প্লে­ট থেকে তা কবীরকে দিতে গেলে সে বাধা দেয়।
‘দেখো মালিহা, এসব অপরিচিত ঘন-ঝাল খাবার আমি খাই না। পেটে মানে না।’
‘তা হলে থাক … কিন্তু তুমি দেখছি আগের মতোই ভেজিটেবল রয়ে গেছো।’
কবীর হাসে। ‘অনেকটা তাই।’
একটার পর একটা প্লে­ট-আইটেম কমবেশি শেষ করে মালিহা কোল্ড ড্রিংকসের টিন টেনে নেয়। জিহ্বা তুলে হু-হা করে।
ঝালের মধ্যেও একটা মজা আছে। বিশেষ করে কাঁচা-লংকার ঘ্রাণ।
দু-তিনজন বেয়ারা এসে প্লে­ট-বাটি উঠিয়ে নিতে থাকে। এদের মধ্য থেকে একজন বিনয়ের সঙ্গে জানায়, ‘ম্যাডাম মিষ্টি কিছু দেবো।’
‘কী আছে?’
‘এই পুডিং … রসমলাই …।’
‘নাহ্ … ডায়াবেটিসটা জাঁকিয়ে না বসলে খেতাম। আজ এখানেই ক্ষ্যান্ত।’
কিছুক্ষণ পরে, সাদা প্যান্ট-শার্ট-গোল হ্যাট পড়া একজন প্লে­টে সাজিয়ে বিল নিয়ে আসে। তা টেবিলে রাখে। মালিহা ভ্যানিটি ব্যাগের চেইন খোলে। তা দেখে, কবীর খানিকটা নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে স্বগতোক্তির মতো বলে ফেলে, ‘এ কি আমি দিচ্ছি … এতদিন পরে দেখা …।’
মালিহার হাত থামে।
‘তুমি দেবে … দাও। পরেরবার না হয় আমি …।’
তার কথায় তৎক্ষণাৎ একটা হোঁচট খেলেও তাকে পকেটে হাত দিতে হয়। ভাগ্যিস আজ সে খানিকক্ষণ আগে সঞ্চয়পত্রের টাকা উঠিয়েছে। বিল দিতে গিয়ে তার আজকের সঞ্চয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায়। ব্যাপারটা সয়ে উঠতে তার সময় লাগে। এক মাসের হিসাবের টাকা। আরো কিছুক্ষণ বসে মালিহা হাতে মুখ ঢেকে বারবার কয়েক ঢেঁকুর-হাই তুলে উঠে দাঁড়ায়।
‘চলো এবার যাওয়া যাক।’
তারা হোটেল থেকে বের হয়।
‘অনেকদিন পরে দেখা … ভালোই লাগলো। আবার দেখা হবে … আসি।’ মালিহা স্কুটার ডেকে চলে যায়।

সাত
কবীর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকটা হতভম্ব হয়ে। সে ঘড়ি দেখে। দুইটার বেশি বেজে গেছে। সে ধরে নেয়, এখন বাজারে গিয়ে লাভ নেই। সে উলটোমুখী হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে আর বিব্রতবোধ করে। কিন্তু … কিন্তু ঝরনা যে তার বাজারের অপেক্ষায় থাকবে?
ঝরনা যেন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। কবির কলিংবেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। আর ঝরনা কবীরের হাতের দিকে তাকায়।
‘কই বাজার?’
কবীর চলতে চলতে পলায়নপর হয়ে বলে যায়,
‘আর কইয়ো না, ব্যাংকে লাইন এত ভিড় … কোনোদিন এমনটা দেহি নাই। লাইনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া এত বেলা। কুপন ভাঙাইয়া ক্যাশ নিতে নিতে বেলা গেলো গা। ব্যাংক ছাইড়া বাইর অইয়া দেহি, সূর্য মাথার ওপর। বাজারে যাইতে পারি নাই।’
কবীর নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে গিয়ে সামান্য হোঁচট খায়। হোঁচট খাওয়ারই কথা। তার যে মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই। তবু বিপদে পড়ে তাকে বলতে হয়,
‘যা আছে আজ তা দিয়া চালাইয়া নাও বউমা। আমি আজ খাইতে পারবো না। পথের এক দোকানে এক কাপ চা খাইয়া পেটটা জানি কেমন করতাছে। তুমি আর অপেক্ষা কইরো না মা, … খাইয়া নাও। বেলা তো কম অইলো না।’
কবীর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয়। ফ্যান ছেড়ে গায়ের জামা-কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বিছানায় কাত হয়। সত্যি সত্যি সে এখন খানিকটা মানসিক ও শারীরিক অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। মালিহার সঙ্গে খেতে গিয়ে যথেষ্ট দেখে-বেছে খেয়েও তার পেটটা গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এ ধরনের তৈলাক্ত-পোড়া-ঘনতেলে ভাজা মাংস সে খায় নাই খুব একটা। সে উঠে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে খায়। কতক্ষণ সে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়েছে, সে বলতে পারবে না। এরই মধ্যে কোন ফাঁকে তার দুচোখ লেগে আসে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখে।
সে দেখে, কেল্লার খালপাড়ের দেশের বাড়ি চরসিন্দুরে গেছে। এটা তার বাপদাদার ভিটেবাড়ি। তা যেমন ছিল তেমনি আছে। খুব একটা বদলায় নাই। সে তার বাড়ির সামনের দক্ষিণমুখী বাংলাঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে। সামনে তার বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। ক্ষেত ছাড়িয়ে খাল। খাল পেরিয়ে দক্ষিণের বিল। এর চারিদিকে আম-কাঁঠাল গাছের বিস্তার। বাঁশঝাড়। বাঁদিকে এর ফুলে ভরা এক সারি লাল শিমুলগাছ। ওপরে নীল আকাশের সীমাহীন বিস্তার। শীত চলে গেলেও বসন্তকাল এখনো আসেনি।
কবীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাল্যের অতিপরিচিত সেসব দেখে। তার গায়েগতরে শিরশিরে হাওয়া মেখে আরো সুস্থির হয়ে বসে সে। কবীর আবেগাপ্লুত হয়ে একসময় টের পায়, তার সোহাগী স্ত্রী আখতারী তার পায়ের কাছে পানের বাটা নিয়ে বসে আছে। সময় নিয়ে সে এক খিলি পান বানায়। তাকে এগিয়ে দেয়। কবীর যথারীতি দেখে, তার মাথায় হালকা শাড়ির আবরণ, যা ছাড়া তাকে কোনোদিন দেখেনি সে। তার চিরাচরিত মিহি সুরে সে বলে যায়, ‘পানডা মুহে দাও, ভালো লাগব।’
সামনে অবারিত ক্ষেত-খামার, টুকটুকে লাল ফুলে ভরা শিমুলের সারি সামনে নিয়ে সে শোনে আখতারীর মুখে তাদের শিশু ছেলে আশিকের দুষ্টুমি, খলখলিয়ে হেসে ওঠার মিহি সুরের নানা কথা। কবীরের মনপ্রাণ ভরে উঠতে থাকে আখতারীর সুখ-আলাপনে। সংসরের আরো নানা কথায়। ভবিষ্যতের সামান্য সুখ-স্বপ্নে …।
শারীরিক অস্বস্তি মুচড়িয়ে উঠলে কবীরের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে তার মাথার ওপর দ্রুতবেগে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে চেয়ে থেকে সে বুঝতে পারে, এখন তার কেল্লার খালের চরসিন্দুরের গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে নেই। সে আটকা পড়ে আছে হাজারীবাগের ছেলের ছোট বাসার এক খুপরি ঘরে। আর তখন তার মালিহার সঙ্গে সারা দুপুর কাটানোর বিচিত্র সব কথা ও তার জন্য উদ্ভট-উটকো সব খাবার এবং সেখান থেকে কোনোক্রমে বেরিয়ে রেহাই পাওয়ার পরিস্থিতি তাকে আবার বিচলিত করতে থাকে। বিস্বাদ এ-পরিম-ল তাকে ঘিরে রাখে। তখন হঠাৎ করে দায়িত্ববোধের এক হিসাবের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাজার ছাড়া ঝরনা মেয়েটি কী করল, কী খেলো আজ কে জানে?
তখন সে দুর্বল হয়ে পড়া মানসিক পরিম-ল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। মনে মনে স্থির করে, কাল সকালে তার প্রথম কাজ হবে বাজারে যাওয়া। ভালোমন্দ কিছু কিনে ঘরে ফেরা। কবীর মেয়েটির মুখে দেখতে চায় সুখের বিনম্র হাসির রেখা।
কবীর বিছানায় উঠে বসে। মাথার ওপর তার ফ্যান ঘুরছে। ঘণ্টা দেড়-দুয়েক সময় মালিহার আলোড়িত প্রতাপী দর্পণের অঙ্গন ছাড়িয়ে কাবাব ঘর থেকে বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে নিজেকে অসহায় মনে হলেও নিজেকে নিজের গ-ির সীমানায় ফিরে পায় কবীর। হয়তো-বা সেই অসহায়ত্বের সুযোগে স্বপ্নে হলেও আখতারী ফিরে এসেছিল তার কাছে।

আট
পরদিন সকালে আগেভাগেই ঘুম ভেঙে যায় কবীরের। আর তখন যা প্রথম স্মরণ করিয়ে দেয়, বউমা গতকাল তার অপেক্ষায় ছিল দীর্ঘ সময়। অপেক্ষা করেছিল, তার হাত থেকে ঝরনা বাজারের ব্যাগ নেবে আনন্দে তৎপর হয়ে। সে আজকের কর্মসূচি স্থির করে, সে সকাল সকালই চলে যাবে বাজারে। ভালোমন্দ সব মিলিয়ে সে অনেক কিছু নিয়ে আসবে। সে দেখতে চায় ঝরনার আনন্দ উজ্জ্বল হাসি। আর তখনই টেলিফোন বেজে ওঠে।
‘আমি মালিহা বলছি … আমি আমার আজকের ফ্লাইট ক্যানসেল করেছি। তুমি তৈরি থেকো, আমি আসছি। তোমার ঠিকানা তো আছেই আমার কাছে। খুঁজতে অসুবিধা হলে ফোন দেবো।’
কবীর আঁতকে ওঠে। সর্বনাশ এ কি কথা! গতকালের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। তৎক্ষণাৎ খানিক ঋজু-দৃঢ় হয়ে সে মিথ্যার আশ্রয় নিতে সময় নষ্ট করেনি।
‘মালিহা আমি অসুস্থ। আমার পক্ষে …।’
‘আমি আসছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা করো।’
‘না … আমি হাসপাতালে … সিভিয়ার ডায়রিয়া …।
‘আমি হাসপাতালেই আসছি।’
‘হাসপাতালে তুমি আসতে পারবে না। অনেক দূরের গলিপথ। গাড়ি চলে না।’
‘বরং ভালো হয়ে … আমি তোমার সাথে …।’
‘সেটাই ভালো!’
‘আহ্হা প্রোগ্রামটা প- করে দিলে। ভেবেছিলাম, সেই পুরনো শহরে … বংশালে এক প্রসিদ্ধ তেহারি হাউজ আছে … সেখানে খাব।’
‘কী করব? আমি যে নিরুপায়। আমার শরীর বেশ খারাপ।’
‘আচ্ছা কাল না হয় আবার ফোন …।’
‘তাই করো।’
উপায়ান্ত না দেখে মিথ্যা বলতে খুব একটা ভালো না লাগলেও তার যে আর কোনো উপায় ছিল না। বরং এতে গতকালের অভিজ্ঞতার আলোকে সে খানিকটা নির্ভার হয়েছে এতে সন্দেহ নেই।

বেলা বাড়লে কবীর একেবারে তৈরি হয়ে বের হয়। দ্রুত নাশতা-পানি খেয়ে ঝরনার কাছ থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে সে মোহাম্মদপুর বাজারের দিকে রওনা দেয়। বাজার থেকে ফিরে আসতে বেশি সময় নেয়নি কবীর।
বাজারের ব্যাগটা ঝরনার হাতে তুলে দিয়ে সে স্বস্তিবোধ করে।
‘দেখো তো মা … কেমন হলো আজকের কেনাকাটা?’
ঝরনা মিষ্টি সলজ্জ হাসে।
‘আপনি আবার খারাপ বাজার করেন নাকি?’
ব্যাগ হাতে হেঁটে ফিরতে ফিরতে কবীর ভেবে রেখেছিল, মালিহার ফোন নম্বরটা ব্ল­ক করে দেবে, যাতে আর সে তার সন্ধান করতে না পারে। কিন্তু এটা করার কায়দা যে তার জানা নেই।
কবীর ঝরনার শরণাপন্ন হয়। তার পুরনো আমলের ছোট নকিয়া মোবাইল সেটটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
‘দেখো তো মা … এই নম্বরটা একটু ব্ল­ক করে দাও তো।’
ঝরনা হাসে।
‘এ আর তেমন কঠিন কিছু নয়।’
অল্প সময়ে ঝরনা টেলিফোন সেটটা টেপাটেপি করে মালিহার সংযোগী নম্বরটা ব্ল­ক করে দেয়।
‘এই নিন। হয়ে গেছে। ওই কল আর আসবে না।’
‘যাক …।’
নিশ্চিত হয়ে তার ঘরে আসে কবীর। সে আশ্বস্ত হয়ে বিছানায় বসে। ফ্যান ছেড়ে দেয়। মাথার ওপরে শোঁ … শোঁ … করে ফ্যান ঘুরতে থাকে পুরোদমে।