আমাদের রানি

আমার নাম বারবারা মরাল। আমি কানাডার অধিবাসী। আমার স্বামীর নাম ডক্টর রবিন মরাল। আমাদের বিবাহিত জীবন খুব সুখের ছিল। আমরা ইচ্ছে করে আমাদের বিয়ের আট বছর বাদে সংসারে প্রথম সন্তানটি এনেছিলাম। সন্তানটি ছেলে ছিল। তাই শখ করে তার নাম দিয়েছিলাম, জন। জন মরাল। ষাটের দশকে পৃথিবী যখন লোকসংখ্যার বিস্ফোরণে চিন্তিত, তখন আমরা দুজনে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের একটি সন্তানের বেশি দরকার নেই। আমরা আমাদের কাজকর্ম এবং সংসার সুচারুভাবে করতে পারব। একটি সন্তানকেই আদরে এবং যতেœ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
কিন্তু কিছু বছর বাদে আমাদের জন যখন বড় হয়ে উঠল, আমাদের সংসারটা কেমন যেন একাকী হয়ে পড়ল। ছোট বাচ্চার হইচই নেই, চেঁচামেচি নেই, তাকে নিয়ে ব্যস্ততা নেই, আমাদের জন বড় হয়ে উঠছে, সেও এখন একটা খেলার সাথি চায়, আমি এবং আমার স্বামী রবিন একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।
জীবন যে এরকম হতে পারে এটা তো আগে ভাবিনি।
এমন সময় ১৯৭১ সালে মাসিক পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ পড়লাম, প্রবন্ধটির নাম ছিল, ‘একজন শিশুর সব চেয়ে বড় উপহার হল তার পরিবার।’
প্রবন্ধটি আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। সেখানে লেখা ছিল একটি কানাডীয় পরিবারে কীভাবে অনাথ শিশুরা, বিশেষ করে ভিয়েতনামী শিশুরা প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়ে উঠছে। এবং এটাও জানলাম ভিয়েতনামের অনাথ আশ্রমে এরকম হাজার হাজার শিশু তাদের দত্তক বাবা-মায়ের আশায় দিন গুনছে।
এই প্রবন্ধটি যেন আমাদের জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে চোখ খুলে দিলো। আমি এবং আমার স্বামী বেশ কয়েকটি দিন এবং রাত কী করব ভাবতে ভাবতে সময় কাটিয়ে দিলাম।
আমার স্বামী শেষমেশ ভিয়েতনাম থেকে দত্তক নেবেন বলে মনস্থির করে চিঠি লেখার উদ্যোগ নেবার আগেই বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বংসী ম্যাসাকারের খবর পৃথিবীজুড়ে হইচই শুরু করে দিলো। আমরা খবর পেলাম যে, দেশটি স্বাধীনতাকামী মানুষদের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে প্রায় তিন লক্ষ বাঙালি নারী পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে নির্যাতিতা এবং অনেকেই অবৈধ গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিয়েছে এবং তখনো দিচ্ছে।
খবরটা শুনে আমাদের মন ভীষণভাবে রক্তাক্ত হলো। আমার স্বামী বললেন, বারবারা, চলো আমরা একটি বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিই।
আমি রাজি হলাম। আমার স্বামী রবিন দরখাস্ত করলেন। আমরা ছেলে বা মেয়ে কোনো শিশুরই নাম উল্লেখ করলাম না। কারণ মনে হলো, এতে আমাদের মানব জন্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা দেবে। আমরা শুধু একটি শিশুই চাইলাম। যদিও মনের গোপনে আশা করছিলাম একটি মেয়ে। কারণ আমার একটি ছেলে আছে। এবার একটি মেয়ে হলে বেশ হয়।
কিন্তু সেটা মনে মনে। সঙ্গোপনে।
এবং ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের মাধ্যমে দরখাস্ত করে দেবার পর আমরা নানারকম দুশ্চিন্তায় ভুগতে লাগলাম। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল এই যে, আমরা কি বাচ্চাটির উপযুক্ত মা-বাবা হতে পারব? বিশেষ করে বাচ্চাটি যখন অন্য দেশের, অন্য সমাজের, অন্য ধরনের জলবায়ুর? সে-দেশের পারিবারিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক কোনো প্রকারের পরিস্থিতির সঙ্গেই তো আমরা পরিচিত নই, তাদের খাদ্যাভ্যাসও আমরা জানিনে।
এসব নানারকম জটিলতার ভেতর দিয়েই ঢাকা থেকে এক ভদ্রলোক সংস্থার মাধ্যমে জানালেন যে, তারা মরাল দম্পতির জন্যে একটি ফুটফুটে শিশুকন্যা দত্তক পেয়েছেন। চিঠিতে এটিও লেখা ছিল যে, আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান এরকম একটি শিশুকন্যা লাভ করে। শিশুটির মাথায় একরাশ কালো চুল। চেহারাটি অনুপম সৌন্দর্যে বিকশিত।
নাম তার রানি।
এই চিঠি পাওয়ার পর আমি আর আমার স্বামী আনন্দে সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারলাম না।
সবচেয়ে ভালো লাগল এই ভেবে যে, রবিনের নামের প্রথম অক্ষর আর আমাদের মেয়েটির নামের প্রথম অক্ষরে মিল দেখে।
কী হয়, কী হয় চিন্তায় আমাদের দিন-রাত কাটতে লাগল। রবিন ইতোমধ্যেই মেয়েটির নাম রাখতে শুরু করে দিলো। নাম তার এর আগেই রাখা হয়েছিল, রানি, সেটা তার জন্মনিবন্ধনের সময়। কিন্তু তাকে কী নামে ডাকবে এ নিয়ে রবিন হয়ে উঠল অস্থির। ইতোমধ্যে যে-আয়ারা বাংলাদেশে মেয়েটির জন্মের পর এই তিন মাস ধরে দেখাশোনা করেছে তাদের জন্যে কিছু টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিলাম। এবং বেশকিছু বছর ধরেই পাঠালাম।
তো যাই হোক, রানি বাংলাদেশ থেকে আসতে বেশ দেরি করতে লাগল। এদিকে আমাদের তো দেরি সহ্য হয় না। আবার আমাদের মেয়েটির শুনেছিলাম ওজন বেশ কম, মাত্র নাকি এক কেজি। তাতে করে আমরা আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এমনিতেও আমরা শুনেছিলাম অপুষ্ট যুদ্ধশিশুদের মৃত্যুর হার বেশি।
এই দীর্ঘযাত্রার ঝক্কি সে সামলাতে পারবে কিনা, এই নিয়েও আমাদের মনে দেখা দিলো সংশয়। কারণ রানি তার মায়ের বুকের কোনো দুধ পান করতে পারেনি। জন্মের পরপরই তার জন্মদাত্রী মা তাকে অনাথ আশ্রমে রেখে দিয়ে চলে যান। সে আশ্রমের তোলা দুধ খেয়ে বেঁচে আছে।
এখন কী হয়, কী হয়।
আমি আর রবিন মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপতে লাগলাম।
অবশেষে বাংলাদেশ থেকে রানি এসে পৌঁছাল আমাদের কাছে। সে-দিনটি আমাদের জীবনে বিশেষ একটি দিন। সেটি ছিল ২০ জুলাই, ১৯৭২।
কিন্তু তার আগের কদিন ধরেই আমাদের চোখে ঘুম নেই।
উত্তেজনা এবং আবেগে আমরা কী যে করব ভেবে পেলাম না।
তার ভেতরেই রানিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে রবিন হইচই করে ঘর সাজাতে লাগল।
নতুন জামা-কাপড় কিনে ঘর ভরে ফেলল। পুতুল কিনল একগাদা।
পারলে সে যেন তখুনি রানিকে তুলে আনে বাংলাদেশ থেকে।
কিন্তু‘ না।
সেটা সম্ভব নয়। কারণ রানি তখনো এসে পৌঁছেনি বাংলাদেশ থেকে।
কিন্তু মেয়ের জন্যে আমাদের তো চোখে আর ঘুম নেই।

অবশেষে রানি এসে কানাডায় পৌঁছল ২০ জুলাই ১৯৭২-এ।
আমি একাই রানিকে আনার জন্যে টরন্টো গেলাম। রবিনের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হলো না। রবিন থাকল আমাদের ছেলেটিকে নিয়ে বাড়িতে। ছেলে জনের সঙ্গে রবিন আলোচনা করতে লাগল মেয়ে বাড়িতে এসে প্রবেশ করলে কীভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে!
সুতরাং ছেলে জনকে নিয়ে সে বাড়িতে থাকল। আর আমি সাসক্যাটুন থেকে প্লেনে চড়ে টরন্টো চলে গেলাম একা রানিকে এয়ারপোর্ট থেকে অভ্যর্থনা করে বাড়ি নিয়ে আসার জন্যে।
সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের রানির সঙ্গে আরো চৌদ্দটি যুদ্ধশিশু ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি এবং নিউইয়র্ক হয়ে টরন্টো এসে পৌঁছেছে। আর অধিকাংশের মা-বাবাই ছুটে এসেছে তাদের দত্তক নেওয়া ছেলেমেয়েদের অভ্যর্থনা করার জন্যে।
আমি চেষ্টা করলাম যেন আমাদের রানির খবর কেউ জানার আগেই বাড়ি গিয়ে পৌঁছানোর। কারণ আমরা চাইনি এ নিয়ে কোনো প্রকারের হইচই হোক এবং লোক জানাজানি হোক।
মেয়েটিকে বাংলাদেশ থেকে আগত নার্স যখন সবকিছু কাগজপত্র তদারকি করে আমার কোলে তুলে দিলো, আমার শরীরের ভেতর দিয়ে যেন আনন্দের তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে গেল। এত সুন্দর শিশু যেন আমি জীবনে চোখে দেখিনি এমনি মনে হলো আমার। আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। আমি রবিনের কথা চিন্তা করলাম। না জানি, ওর ভেতরে কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে রানিকে কোলে নেবার পর।
আমি তাকিয়ে দেখলাম রানির মুখ। মাত্র তিন মাস বয়সের রানির অপুষ্ট দেহের ভেতর দিয়েও যেন সৌন্দর্য ছিটকে পড়ছে, এমনি মনে হয়েছিল আমার তখন। আমি রানির কপালে আমার স্নেহচুম্বন এঁকে বুকের ভেতরে তাকে জড়িয়ে নিয়ে সেই গভীর রাতে আবার প্লেনে উঠলাম বাড়ি ফিরে আসার জন্যে। এত রাতে বাড়ি না ফিরলেও হতো। কিন্তু আমার ভয় ছিল যে টরন্টোর সাংবাদিকরা আমাদের রানিকে নিয়ে খবর রটাতে পারে। আমরা চাইনি এরকম কিছু হোক।

দুই
বাড়ি ফিরে এলাম অনেক রাতে। তখন আমাদের ছেলে জন ঘুমিয়ে পড়েছে। রবিন জেগে ছিল। সে দরজা খুলেই আগে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর আমার কোলের মধ্যে আমাদের রানি।
আমি আস্তে করে রবিনের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে রানিকে আমার স্বামীর কোলে তুলে দিলাম। সে এত সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কন্যাকে জড়িয়ে ধরল যে, দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। তারপর দেখি রবিন মুগ্ধ হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর তার কপালে আলতো করে চুমো এঁকে আমার দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি হেসে বলল, আমাদের রাজকন্যার মতো মেয়ে হয়েছে, তাই না বারবারা?
তার পরদিন সকালে উঠে কাগজ খুলেই রবিন আঁতকে উঠে বলল, বারবারা, আমাদের রানির খবর তো দেখছি কাগজে উঠে গেছে। সেদিন স্থানীয় এবং জাতীয় দৈনিকে যে-কজন যুদ্ধশিশু কানাডায় এসেছিল, নয়াদিল্লি ও নিউইয়র্ক হয়ে সকলেরই নাম খবরের কাগজে উঠেছিল।
আমরা সেটা জানতাম না।
খবর বেরোবার পরপর আমাদের বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেল।
আমরা তখন বাধ্য হয়ে আমাদের কন্যাকে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে গেলাম। এবং তাকে আশীর্বাদ করতে বললাম। কারণ আমি আর রবিন জানতাম এ নিয়ে কোনো তিক্ত অবস্থা হলে পরবর্তী সময়ে আমাদের মেয়ের ওপর তার ধাক্কাটা পড়বে।
কিন্তু মেয়ের শরীরের অবস্থা দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। একে তো সাড়ে তিন মাসের বাচ্চা হিসেবে তার ওজন কম, তার ওপর সে কিছু মুখে তুলতে চাইতো না। মুখে কোনো খাবার বা দুধ দিলেই দুই ঠোঁট আটকে সে বসে থাকত। এরকম দিনের পর দিন। সে গর্ভজাত অবস্থায় তার প্রকৃতিদত্ত মাকে যে কতটা হিংস্র পরিবেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, কতখানি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সেটি যেন আমরা রানির ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতাম।
এতে করে আমরা নিজেরাই অসহায় বোধ করতাম।
বুঝতে পারতাম না কী করলে আমাদের মেয়েটিকে শরীর ও মনের দিক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারব।
আমরা মন খারাপ করে কতদিন বসে থেকেছি আমাদের কন্যা রানি ঠিকমতো খায় না বলে। রবিন কতদিন তার কাজ থেকে বাড়ি ফিরেই আমাকে যে প্রথম প্রশ্নটি করত, সেটা ছিল, বারবারা, রানি কি আজ কিছু খেয়েছে?
তারপর তো আমাদের রানি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। ধীরে ধীরে খেতেও শিখল। যদিও খাওয়ার প্রতি তার কোনোদিনও বেশি ঝোঁক ছিল না, কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে যেদিন জানত আমি পায়েলা রান্না করেছি তো শুনে খুব খুশি হতো।
রানি লেখাপড়ায় বেশ বুদ্ধির পরিচয় দিত। আর আমরা তার জন্মগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলাম বলে মাঝে মাঝেই আমরা তাকে আমাদের এলাকার অর্থাৎ স্যাসক্যাটুনে যে দু-চার ঘর বাঙালি বসবাস করত, তাদের কাছে নিয়ে যেতাম।
ছেলেবেলা থেকেই দেখতাম রানি খুব মিশুক ছিল। অনর্গল কথা বলতে আর হাসতে ভালোবাসত। মানুষের সঙ্গে খুব অনায়াসে মিশতে পারত। বন্ধুত্ব করে ফেলত অনায়াসে। এতে করে আমাদের মনে একটু চিন্তাও হতো। হাজার হোক, আমাদের মেয়েটি ছোট।
তারপর দেখতাম রানি নাচ করতে পারত খুব সাবলীলভাবে। ভারতীয় কিছু ব্যাপারে রানির ঝোঁক দেখে আমরা অবাক হতাম। কারণ রানি তো ছেলেবেলায় কোনো ভারতীয়ের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়নি। একটু বড় হলে আমরাই খুঁজে খুঁজে ভারতীয়দের বের করেছি। রানিকে তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে নিয়ে গেছি। আমাদের ওখানে মিসেস লাল বলে একজন মহিলা ছিলেন, তিনি শিশুদের ভারতীয় নাচ শেখাতেন।
আমরা রানিকে তার স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। আর সেখানে গিয়ে আমাদের রানি অতি অল্পদিনে নানাবিধ শিল্পকলায় এবং ভারতীয় ধ্রুপদি নৃত্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করল।
তার আর্টকুশলতা দেখে আমরা তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সে আমাদের ওখানকার নানাবিধ ভারতীয় অনুষ্ঠানে নাচের নিমন্ত্রণ পেত। এবং খুশি মনে রানি সেসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যেত। যাবার আগে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করত বড় সাবলীলভাবে। আমার যা গহনা ছিল বা তার বান্ধবীদের মায়ের যেসব গহনা ছিল সব সে জোগাড় করত নাচের আগে নিজেকে গহনা দিয়ে সজ্জিত করবে বলে। একদিন আমার রানি একটা ফাংশনের আগে আমার কাছে এসে মুখ ভার করে দাঁড়াল।
আমি তার মুখে বিষণœ ভাব দেখে বললাম, কী হয়েছে, মামণি।
রানি বলল, মা, তোমার অনেক গহনা নেই কেন? আমি এখন ফাংশনে কী পরে যাব?
আমি তার কথা শুনে একটু ভেবে বললাম, আমি তো বেশি গহনা-টহনা পরিনে, মামণি।
কেন পরো না? ওই তো লিসার মায়ের কত গহনা। ফিয়োনার মায়েরও কত গহনাগাটি। ফিয়োনা বাইরে যাবার সময় ওর মায়ের গহনা পরে বাইরে যায়। দেখতে কত সুন্দর লাগে।
আমি মেয়ের বায়না শুনে বলি, আচ্ছা, তা হলে ঠিক আছে। আমি এবার তোমাকেও কিছু কিছু গহনা কিনে দেবো।
ওকে এ-কথা বলার সময় হঠাৎ আমার উপলব্ধি হলো একদিন, আসলে আমার মেয়ের জিনসের ভেতরেই আছে ভারতীয় রক্ত। আর ভারতীয় রমণীরা শুনেছি গহনা পরতে খুব ভালোবাসে।
একবার এক ইন্ডিয়ান মহিলার কাছে ওদের দেশের বিখ্যাত কবি টেগোরের কথা শুনেছিলাম। তিনি নাকি একবার একটা গল্প লিখেছিলেন, ভারতীয় মেয়েদের গহনাপ্রীতি নিয়ে। সেই ভারতীয় মহিলা ছিলেন বাঙালি। স্বামীর ব্যবসা হঠাৎ করে মার খেলে স্বামী যখন ব্যবসাকে সামাল দেবার জন্যে নিজের স্ত্রীর কাছে গহনাগুলো ধার হিসেবে চাইলেন, তখন সেই মহিলা তার প্রিয় গহনাগুলো হারাবার ভয়ে গৃহের আশ্রিত একজন লোকের সঙ্গে রাতের আঁধারে স্বামীর অলক্ষে ত্যাগ করলেন স্বামীর সংসার। লোকটি তাকে বাপের আশ্রয়ে নিরাপদে পৌঁছে দেবে এই আশ্বাসে। তারপর যা হয়। লোকটি মাঝ নদীতে মহিলাকে ফেলে দিয়ে গহনার বাকসো নিয়ে চম্পট দিলো।
এই গল্পটি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। তবে হতবাক হইনি। কারণ আমি জানি, মেয়েদের জীবনে দামি গহনার একটি বিশেষ স্থান আছে। বিপদে-আপদে তারা রমণীদের আর্থিকভাবে সাহায্য করে। বিশেষ করে তখনকার দিনে এখনকার মতো কোনো ব্যাংক সিস্টেম তো ছিল না।
একদিন সত্যি সত্যি আমি রানিকে দোকানে নিয়ে গিয়ে কিছু গহনা কিনে দিলাম। গহনা পেয়ে আমার রানি তো ভীষণ খুশি হলো। আমি এরপর আমাদের লোকালিটির বাঙালি পরিবারের রমণীদের পোশাকি সাজসজ্জা দেখে আমার রানিকেও ঝকঝকে সব পোশাক কিনে দিতাম। বাঙালি সমাজের সঙ্গে আমরা রানির মাধ্যমে নিয়মিতভাবে মিশতাম। তাদের তৈরি খাবার খেতাম। শেষে এমন হলো যে, আমি আর রবিন ভারতীয় খাবার এবং ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ধীরে ধীরে অনুরক্ত হয়ে গেলাম।

তিন
আমাদের রানি এত সপ্রতিভ একটি মেয়ে ছিল যে, সে যে-কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারত, সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারত। তাছাড়া আমরা যে সমস্ত পরিবার বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিয়েছিল, সকলের সঙ্গে, তারা কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের হলেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। রানিও তাদের সঙ্গে মিশত, কথা বলত। এ পর্যন্ত আমি এবং রবিন রানিকে নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়িনি। রানিকে দেখে তখন যে-কোনো মানুষ তাকে একজন হাসিখুশি, চঞ্চল টিনএজার বলে ধারণা করত। আমরাও রানিকে নিয়ে বড়ই সুখী ছিলাম। আমাদের ছেলেটিও রানিকে বড় ভালোবাসত। দুজনে কতদিন গল্প করে, খেলা করে কাটিয়েছে। টেলিভিশনে কোনো ভালো প্রোগ্রাম হলে দুই ভাইবোন একসঙ্গে মিলে দেখেছে, হাসাহাসি করেছে। বিফবার্গার আর চিপস আর কোকাকোলা নিয়ে দুজনে ছুটির দিনে বাগানে বসে সময় কাটিয়েছে।
১৯৮৬ সালে রানিকে আমরা আমাদের স্থানীয় স্কুল বিশপ জেমস ম্যাহোনি হাইস্কুলে ভর্তি করে দিলাম। তখন ওর বয়স চোদ্দো বছর। সেখানে আমাদের রানি ছিল ভীষণ উৎসাহী একজন ছাত্রী। সেখানে সে চারুকলা বিষয়ে অধ্যয়ন করে। সেখানে অতি সহজে সে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলতে শেখে। রানির যে কত ধরনের বন্ধু ছিল, যাদের সঙ্গে রানি ঘোরাফেরা করত।
ভারতীয়, চীন, আফ্রিকা, ইয়োরোপ এরকম অনেক দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিল রানির বন্ধুত্ব।
এরকম বহুজাতীয় ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেশার ফলে রানির বিশ্বজ্ঞানের প্রসারও খুব দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে।
সে-সময় রানি সাসক্যাটুন ইয়ুথ অর্কেস্ট্রায় সুন্দর বেহালা বাজানো শেখে। তার হাতে বেহালার ছড় যেন বিশেষ একটা ভাষা পায়। রানি বেহালা বাজানোয় বেশ নাম করে।
তারপর সে শখ করে বাঁশি বাজানো শেখে। অচিরেই সে বাঁশি বাজানোয় এমন দক্ষ হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন ফাংশনে রানির ডাক পড়ে। শুধু তাই নয়, খুব ছেলেবেলা থেকেই রানি গান লিখতে শুরু করে। তার গানের ছন্দ এরকম যে, অচিরেই সে তার স্কুলে ছন্দের মাস্টার হিসেবে নাম করে ফেলে।
মোটকথা, আমাদের রানি শিল্প-সাহিত্যের যে-কোনো শাখায় হাত দিলেই যেন সে সুনাম বয়ে আনত বাড়িতে। আর এসব নিয়ে আমি আর রবিন কত যে সুখ পেতাম, কত যে আনন্দ হতো আমাদের তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। সত্যি বলতে আমাদের নিজেকে তখন গর্বিত একজন প্যারেন্ট হিসেবে যেন মনে হতো।
রবিন মাঝে মাঝে আমাকে ঠাট্টা করে বলত, দেখ, তোমাকে শিগগির লোকেরা রানির মা বলে ডাকতে শুরু করবে! বারবারা বা মিসেস মরাল বলে আর কেউ ডাকবে না!
কিন্তু আমাদের এরকম সুখ, এরকম নিরুদ্বিগ্ন সাংসারিক সুখ যেন বিধাতার সহ্য হলো না!
একদিন হঠাৎ লক্ষ করলাম, আমাদের রানি যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আগের মতো সেরকম উচ্ছ্বাস বা চাঞ্চল্য নেই। হাসিখুশি রানি, আমাদের লক্ষ্মীমেয়ে রানি, কেমন যেন বিমর্ষ, একা একা, মনমরা। অথচ তারই বয়সী তার প্রিয় বন্ধুরা সকলেই হাসিখুশি, বহির্মুখী, চঞ্চল। রানিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে ঠিকমতো উত্তর দেয় না, কখনো বা কোনো উত্তরই দেয় না। চুপ করে থাকে। আনমনা থাকে। একাকী বসে বসে দীর্ঘশ^াস ফেলে।
আমি আর রবিন যেন মেয়ের এ-অবস্থা দেখে নিজেরাই পাগল হয়ে যাই। বিশেষ করে রবিন। সে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে রানিকে বলে, তোমার কী কষ্ট মামণি, আমাকে বলো। আমি যেভাবে হোক তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করব।
কিন্তু উত্তরে রানি কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মেয়ের কষ্ট দেখে আমাদের প্রাণ ভেঙে যায়। আমরা দিশেহারা হয়ে যাই।
একদিন দুপুরে আমরা বাড়িতে ছিলাম না, রবিন তার অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল, আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম একটা কাজে, আমাদের ছেলে জন স্কুলে গিয়েছিল, বাড়িতে শুধু রানি ছিল, ব্যাংকের কাজ সেরে কিছু বাজারঘাট করে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।
বাড়ি ফিরে আমি রানির ঘরে গিয়ে তাকে একটা জিনিস দেখাতে ঢোকার জন্যে তার ঘরের দরজায় টোকা দিলাম। কোনো উত্তর পেলাম না। তখন এমন একটা সময় যখন মানুষ ঘুমায় না। বিশেষ করে রানির ঘুম এমনিতেই খুব কম ছিল। রাত ছাড়া সে কখনো দিনে ঘুমাত না।
আমি তার দরজায় টোকা দিলে সে কোনো উত্তর দিলো না। তখন দরজা টান মেরে খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম রানি কেমন যেন ভীতিবিহ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গলায় জড়িয়ে রেখেছে আমারই কিনে দেওয়া একটি স্কার্ফ।
আমার মনে কেমন যেন সন্দেহ হলো।
আমি হাতের জিনিস ফেলে দ্রুততার সঙ্গে তার কাছে গিয়ে স্কার্ফটা টান মেরে খুলে ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটা এমনভাবে গিঁট বাঁধা যে আমার মনে কেমন যেন সন্দেহ হলো।
আমি আতঙ্কিত হয়ে রানির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী করছিলে রানি?
উত্তরে কিছু না বলে রানি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
এরপর আমি খুব ভীত হয়ে পড়লাম।
রবিনকে ফোন করে আমার সন্দেহের কথা জানালাম।
রবিন তার অফিসের কাজ ফেলে দ্রুত বাড়িতে ফিরে এলো।
তারপর রানির ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ কী সব কথা বলতে লাগল।
আর সারাটা সময় আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। ঈশ্বরকে মনে মনে বারবার ডেকে বলতে লাগলাম, হে ঈশ্বর, আমাদের মেয়েটিকে ভালো করে তোল। এই মেয়েটির কিছু হলে আমরা বাঁচব না ঈশ্বর!
অবশেষে আমি আর রবিন রানিকে একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে সমর্থ হলাম। আমার আর রবিনের ধারণা হলো, রানি নিশ্চয় তার অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। সে কে, কী তার আসল পরিচয়, কে তার আসল মা, কে তার জন্মদাতা, কোন পরিস্থিতিতে তার জন্ম, কীভাবে তাকে দত্তক নেওয়া হলো আমাদের পরিবারে, এসব কথা রানি নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছুক। কিন্তু হয়তো আমাদের সঙ্গে সে-চিন্তাটা ভাগ করে নিতে পারছে না।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, আমরা ছেলেবেলা থেকে আমাদের মেয়েকে তার জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়েছি। যেন সে বাইরের কারো কাছ থেকে অযথা কিছু শুনে বিভ্রান্ত না হয়। আমরা এটাও শুনেছি যে, অন্যান্য বাবা-মায়েরাও তাদের দত্তক সন্তানদের তাদের জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়েছে। এবং বড় হয়ে তারা নথিপত্র পড়ে আসল আরো অনেক কিছু জানতে পারবে, এ-খবরও দত্তক ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয়েছে।
সত্যি বলতে কোনো তথ্যই যতদূর সম্ভব তাদের কাছ থেকে গোপন করার চেষ্টা করা হয়নি।
এর আরো একটা কারণ এই ছিল যে, এসব যুদ্ধশিশু, যেহেতু তাদের জন্মদাত্রী মায়ের বা তাদের বাবা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই বা জানার কোনো প্রকার সম্ভাবনাও নেই, তাই তারা যেন ফ্যান্টাসির ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে।
সাধারণত স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া দত্তক শিশুরা বড় হলে অনেকেই পোষা বাবা-মায়ের প্রতি আক্রোশ পোষণ করে, অনেকে ভাবে বুঝি ছলচাতুরী করে তাদের আসল বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে তার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
একদিন আমার স্বামী রবিন বললেন, জানো বারবারা, আমি অনেক তথ্য ঘেঁটে বের করে পড়ে দেখলাম, আসলে দত্তক নেওয়া ছেলেমেয়েদের মনে সারাজীবনে একটিই ভয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আর সেটা হলো, পাছে কেউ তাদের ‘অবাঞ্ছিত’ বলে!
তাছাড়া আমাদের রানির ভেতরেও এ ভয় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে কি না, দেখতে হবে। চলো আমরা মেয়েকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যাই।
কিন্তু আমাদের মেয়ে রানি কিছুতে মনোবিদকে সাহায্য করল না। তাকে বিভিন্ন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অনেক কিছু প্রশ্ন করা হলো, রানি তার একটারও জবাব দিলো না বা দিতে পারল না।
তার বিষণœ মনোভাব যেন তাকে ও আমাদের কুরে কুরে খেতে লাগল।
তখন নিরুপায় হয়ে আমরা ভাবলাম হয়তো মেয়েকে কিছুদিনের জন্যে বাংলাদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে এলে তার মন ভালো হবে। এমন অনেক কথা আছে, যা ছেলেমেয়েরা হাজার চেষ্টা করলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না। তা ছাড়া, হাজার হোক, আমরা তার দত্তক বাবা-মা। আমরা মনে যাতে কোনো কারণে কষ্ট না পাই, সে-বিষয়েও রানি খুব সচেতন। কারণ আমরা যেমন রানিকে ভালোবাসি, সেও ঠিক আমাদের ভালোবাসে। এ ভালোবাসার তো কোনো তল নেই।

চার
আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম যে, বাংলাদেশ ভ্রমণের নাম শুনে আমাদের মেয়ে রানি কীভাবে উল্লসিত হয়ে উঠল! লম্বা একটি বছরের বিমর্ষতার পর সে যেন আবার সেই আগের মতো হাসিখুশি হয়ে উঠল। কথা বলতে লাগল আনন্দের সঙ্গে। তাকে দেখে তখন আর আমাদের মনেই হলো না যে, এই রানি মাত্র কদিন আগেই কতখানি বিমর্ষ ছিল। এটা দেখে আমি আর রবিন নিজেদের ভেতরে আলোচনা করলাম যে, বড় হয়ে উঠবার পর হয়তো রানি তার উৎসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিল না। যেখানে তার জন্ম, সেই জন্মদেশ চোখে দেখলে তার সম্যক উপলব্ধি হবে কোথা থেকে তার উৎস। এবং সেই উৎস থেকে অবশেষে কোথায় তার গমন।
একদিন সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে রবিন রানিকে বলল, মামণি, একবার যাও না, বাংলাদেশ থেকে কয়েক দিনের জন্যে বেড়িয়ে এসো না।
বাবার কথা শুনে রানি তো অবাক। সে রুটিতে নত মুখে তখন মাখন লাগাচ্ছিল, হঠাৎ তার বাবার কথা শুনে কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, কী বলছ?
বলছি, যাও না, বাংলাদেশ থেকে একবার ঘুরে আসো না, ওখানকার মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে আসো, দেশটাও এই ফাঁকে দেখে আসো।
এ-কথায় রানি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে তার বাবাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে খুশি গলায় বলে উঠল, বাবা, তুমি এত ভালো কেন বলো তো? আমিও সেটা চিন্তা করছিলাম কিছুদিন ধরে। তুমি আমার মনের কথা কীভাবে বুঝলে, বাবা?
রানির কথা শুনে রবিন বলে উঠল, আরে, তুমি আমার মেয়ে আর আমি তোমার মনের কথা বুঝব না? কী বলিস পাগলি!
বাবা আর মেয়েতে সেদিন খুব হাসিখুশি একটা পরিবেশ হলো।
রানি এই সময় আমার দিকে তাকিয়ে রবিনকে বলল, কিন্তু মা আমাকে অত দূরে যেতে দেবে তো? সে তো আমি একা কখনো বাইরে বেরোলেই ছটফট করে ওঠে!
আমি হাসিমুখে বাবা আর মেয়ের আলোচনা শুনতে শুনতে বললাম, কেন দেবো না? অবশ্যই দেব। এখন তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ না? এখন তো তোমাকে আমাদের একা ছাড়তেই হবে।
তখন রবিন কী ভেবে বলে উঠল, তো কথাটা যখন উঠলই তখন আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ সফর করিনে কেন। আমাদেরও তো এই দেশটা একবার চোখে দেখা দরকার। দেখা দরকার, কোথা থেকে আমরা আমাদের এই পরির মতো সুন্দর সন্তানটিকে আমাদের কোলে পেলাম!
এরপর আমাদের সংসারে অবার যেন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো, অন্তত কিছুদিনের জন্যে।
আমরা যখন মেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবার জন্যে তোড়জোড় করছি, ঠিক তখুনি খবর পেলাম কানাডার অন্টেরিও প্রদেশের মিস্টার ডেন এবং মিসেস ডনা উলসি তাদের যুদ্ধশিশু আমিনাকে বাংলাদেশে পাঠাবার জন্যে একটা ট্রিপের ব্যবস্থা করছেন। সেই ট্রিপে আরো কিছু যুদ্ধশিশু এবং অনাথ বাচ্চাও যাবে।
ব্যাপারটা একেবারে কাকতালীয়ভাবে আমাদের কাছে ধরা দিলো।
শুনে আমরা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম।
আমরা তাদের সঙ্গেই যাব বলে মনস্থির করলাম।
কয়েক সপ্তাহব্যাপী তোড়জোড় করার পর অবশেষে আমরা বাংলাদেশে গেলাম।
সেটা ছিল ১৯৮৯ সাল।

বাংলাদেশে পৌঁছে আমরা তো হতবাক।
এত সুন্দর সবুজ একটা দেশে এত ভয়াবহ একটি যুদ্ধ ঘটে গেছে? আর সেই অল্প সময়ের যুদ্ধে এত হাজার হাজার যুদ্ধশিশু। আর এত লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি?
আর যে মানুষটির জন্যে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই ক্ষণজন্মা মানুষটিকে স্বাধীন দেশে তাঁর পরিবারসহ হনন করে ফেলা?
ভেবে আমাদের মন শুধু খারাপ নয়, একটু যেন হতভম্ব হয়ে গেল।
কিন্তু আমাদের মেয়ে রানির মনের অবস্থা তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যেন সে বাংলাদেশে এসে হাতে চাঁদ পেয়েছে, এমনি মনে হতে লাগল তাকে দেখে।
প্রবল এক উত্তেজনা এবং আনন্দে সে যেন অস্থির হয়ে উঠল।
যেদিন তাকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে যাওয়া হলো, এই আশ্রম থেকেই সাড়ে তিন মাস বয়সে তাকে কানাডায় আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল এবং সে সেই অনাথ আশ্রমের নাম – রেজিস্টার খাতায় নিজের নামটি যখন কালির অক্ষরে দেখতে পেল, মনে হলো যেন সে খুশিতে গান গেয়ে উঠবে!
মনে হলো যেন সে অবিশ্বাস্য কিছু চোখে তাকিয়ে দেখছে।
সে রেজিস্টার খাতায় তার নামটির ওপরে সযতেœ আঙুল বোলাতে লাগল।
তখন অনাথ আশ্রমের সেই আয়াটি যে রানিকে তার জন্মের পর থেকে সাড়ে তিন মাস দেখাশোনা করেছিল, এবং যাকে আমরা কানাডা থেকে নিয়মিত ভাতা পাঠাতাম, সে তখনো সেই আশ্রমে ছিল। রানিকে কাছে পেয়ে সেই আয়াটি তাকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরল।
আর রানির সঙ্গে সঙ্গে যেন মনে হলো, তার মা, জন্মদাত্রী মা বেঁচে আছে!
আশপাশেই আছে।
এবং সে কোথাও থেকে তাকে তাকিয়ে দেখছে!
কিন্তু কাছে এসে পরিচয় দিচ্ছে না, শুধু দুচোখ ভরে তাকে তাকিয়ে দেখছে!
এরকম একটি শারীরিক অনুভব রানিকে যেন হঠাৎ করে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সে অনাথ আশ্রমের শিশুদের একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরল। তাদের কোলে নিয়ে আদরে আদরে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। সে অনাথ আশ্রমের কর্মী মহিলাদেরও জড়িয়ে ধরতে লাগল। একের পর এক। যেন সে স্পর্শের মাধ্যমে বুঝতে চাইল এদেরই কেউ তার মা কি না!
সেই সব মুহূর্তে আমাদের রানি যেন তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলল। আবার আমাদের কাছে এসে বারবার করে সে আমাকে আর রবিনকেও জড়িয়ে ধরতে লাগল। যেন সে আমাদের বোঝাতে চাইল, তোমরা আছ, মা-বাবা, তোমরাও আমার এই অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে আছ। আমি তোমাদেরই মেয়ে, আমাকে তোমরা ভুল বুঝো না!
না, আমরা তাকে ভুল বুঝিনি। আমরা আমাদের মেয়েকে ভুল বুঝিনি। আমরা অশ্রুর ভেতর দিয়ে আমাদের মেয়েকে ভালোবেসেছি। সে আমাদেরই মেয়ে। আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমাদের বুকের ধন।

পাঁচ
কয়েকটা দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে, সেখানকার মানুষের ও সরকারের অশেষ যতœ-আত্তি পেয়ে যুদ্ধশিশু সকলেই কানাডায় ফিরে এলো। সকলের ছেলেমেয়েই মোটামুটি তাদের দত্তকগ্রাহী পিতা-মাতার সঙ্গে দিব্যি স্বাভাবিক হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের সেই পুরনো রানিকে আমরা যেন আর ফিরে পেলাম না।
তাকে তখন দেখে মনে হতো যেন সে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হঠাৎ অর্জন করে ফেলেছে। তার বুদ্ধি ও চেতনা সেই অভিজ্ঞতার আলোকে যেন নতুনভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করেছে।
আমাদের সেই আগের হাসিখুশি চঞ্চল রানিকে, যে গহনা ভালোবাসত, লাল চুড়ি হাতে পরতে ভালোবাসত, নাচ করতে ভালোবাসত, স্টেজে ভারতীয় সমাজের ফাংশনে ধ্রুপদি নৃত্য করে দর্শকদের মন মাতিয়ে তুলতে পারত, সে রানি যেন আর নেই।
বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসে আমাদের সে রানি যেন হারিয়ে গেছে।
এই রানি বিষণœ। এই রানি বাড়ির ভেতরে গোপনে চুপচাপ বসে থাকে।
এই রানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাঝে মাঝেই।
কী তার দুঃখ, কী যে তার বেদনা, সেটা সে তার মা-বাবার কাছে প্রকাশ করে না।
আমার যেন মনে হলো, রানি তার জন্মদাত্রী মাকে চোখে দেখার জন্যে একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে। যতই বয়স বাড়তে লাগল আমাদের রানি যেন ততই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। আমরা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, ভালোবাসা ও আদর দিয়ে যতই বোঝাতে চাইতাম না কেন, রানি যেন অনেক দূর থেকে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত।
যেন রানি মনে মনে বলত, মা-বাবা, তোমাদের ধন্যবাদ!
কিন্তু আমরা তো রানির ধন্যবাদ চাইতাম না, ধন্যবাদের আশায় আমরা আমাদের রানিকে তো মানুষ করে তুলিনি, আমরা তো মা-বাবা, আমরা তো তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম, আমরা তো আমাদের মেয়েকে ফিরে চেয়েছিলাম। আর তো কিছু চাইনি।
আমাদের তো ভীষণ একটা ভুল হয়ে গেল মেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে!
এর চেয়ে যেন অনেক ভালো ছিল যদি বাংলাদেশ তার কল্পনাতেই থেকে যেত!
আমরা এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। পেশাজীবীদের সহায়তা নিয়ে রানিকে ভালো করে তুলতে সচেষ্ট হলাম। রানিকে কাছে পেয়ে একদিন আমি বললাম, রানি, আমার একটা কথা শুনবি, মা?
রানি আয়না থাকতেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইদানীং চুল আঁচড়াত না। সে আপন মনে ভাঙা একটা চিরুনি চুলে বোলাতে বোলাতে বলল, কী বলবে, বলো?
শুনে আমি বললাম, মা, চলো তোমাকে আমি একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে তুমি যা মনে আসে সব বলতে পারবে।
আমার কথা শুনে রানি যেন একটু উগ্র হয়ে বলল, কেন, আমি মনোবিদের কাছে যাব কেন? আমার কী হয়েছে?
শুনে আমি আমতা আমতা করে বললাম, না, মানে, তোমাকে আজকাল আমি আর তোমার বাবা একটু অন্যমনস্ক দেখি তো, তাই। ভাবলাম যদি মনোবিদের কাছে গিয়ে –
আমার কথা শেষ হলো না, রানি রুখে উঠে বলল, কখনো না। আমার কিছু হয়নি। তোমরা খামোকা একগাদা পয়সা খরচ করে মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে চাও। শোনো, আমাকে নিয়ে ভেবো না, আমি ঠিক আছি।
আমি তখন বললাম, রানি, তোমার বয়স যখন দশ বা এগারো, তখন থেকে আমি দেখি তুমি কবিতা লিখছ, ডজনকে ডজন কবিতা লিখেছ, আমাদের পড়ে শুনিয়েছ, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসার পর তোমাকে আমি আর লিখতে দেখিনে। তার ওপর আগে রাত জেগে টেলিভিশন দেখতে বলে আমি কত রাগ করতাম, আর আজকাল তুমি টেলিভিশন খুলে দেখো না, তুমি তো আগে এরকম ছিলে না, মা।
আমার কথা শুনে রানি রাগ করে বলল, আমি কবিতা যে আর লিখিনে, একথা তোমাকে কে বলল? লিখি যখন আমার ইচ্ছে হয়, তখন। তোমাকে সেকথা বলব কেন?
আমি দেখলাম, এখানে কিছু বলে লাভ নেই। আসুক রবিন। ওকে দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করব।
ঠিক তাই, আমার কথায় রাজি হলো না বটে, কিন্তু তার বাপের কথা শুনে সে ঠিকই রাজি হলো।
যে দিন সে সাইকোলজিস্টের কাছে যাবে, বিকেল চারটেয় অধিবেশন, রবিন তার অফিস থেকে আগে আগে বাড়ি ফিরে এসেছে, মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বলে, রানি যাবার আগে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি! কিন্তু মা, আমার যেন আজকাল মনে হয় আমার আরেকটা মাও আমার চারপাশে ঘুরছেন! মা, আমি এজন্যে মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই! আমি কী করব।
তারপর একটু থেমে বলল, জানো মা, আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, মনে হয়, তুমি যদি আমাকে এখানে না নিয়ে আসতে, তাহলে হয়তো আমি সেখানেই থেকে যেতাম, তখন হয়তো কখনো আমার জন্মদাত্রী মা আমাকে দেখে যেত। আমাকে হয়তো কোলেও নিত। কিন্তু মা, এসব আমার অবান্তর চিন্তা। তোমাকে ছাড়া আমি কোনোদিন সুখী হতাম না মা। মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রানি এরপর বাড়ি ছেড়ে ওর বাবার সঙ্গে বাইরে চলে গেল। আমি ইচ্ছে করেই গেলাম না।
আমার তখন মনে পড়ল রানি আমার সংসারে আমাদের মেয়ে হয়ে এসেছিল ২০ জুলাই, ১৯৭২। তার নাম ছিল রানি। আমরা তার নামটা ঠিক রেখে তার সঙ্গে যোগ করেছিলাম, রানি জয় মরাল। আমার ছেলে জনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। রানির নামের মাঝের জয় নামটা ছিল ইংরেজিতে আনন্দ। আবার বাংলায় এই জয়ের মানে ছিল বিজয়। আমরা তখন না বুঝেই জয় রেখেছিলাম, পরে এর দ্বৈত মানে শুনে আমি আর রবিন কত যে আনন্দিত হয়েছিলাম, তা বলার মতো আমার ক্ষমতা এখন নেই। এখন সেই রানি আমার আজ মনোবিদের কাছে গেল তার সমস্যার কথা বলতে। ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো আমার রানির মতো আর কোনো যুদ্ধশিশুর এরকম হয়েছে বলে তো আমরা জানি না। তবে কি রানি আমাদের একটি স্পেশাল সন্তান?
এরকম নানারকম কথায় আমি বাড়ির ভেতরে অস্থির হয়ে পায়চারি করে বেড়াতে লাগলাম।
অনেক পরে রানিকে নিয়ে রবিন ফেরত এলো বাড়িতে। তাকে দেখে মনে হলো সে খুব মনমরা হয়ে গেছে। রানিও বাড়ি ফিরে এসে হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করল। তারপর বলল, সে আর মনোবিদ বা থেরাপিস্টের কাছে যাবে না। তারা তাকে বুঝতে পারবে না।
এতসব কিছুর পরও আমাদের মনের ভেতরে ধিকি ধিকি করে আশার আলো জ্বলছিল। এতসব কিছুর পরও আমার রানি মানুষের প্রতি ছিল গভীরভাবে সহানুভূতিশীল। সে ছিল ভীষণ মমতাময়ী একজন মেয়ে। ১৯৯০ সালে আমাদের রানি বাইলিংগুয়াল ডিপ্লোমা নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়। এরপর আমরা তাকে অন্টেরিওর কুইন্স বিশ^বিদ্যালয়ে নার্সিং পড়তে পাঠালাম। সে নিজেই উৎসাহী হয়ে সেখানে পড়তে গেল।
প্রথম বছর সে খুব সহজেই পড়া শেষ করে দ্বিতীয় বছরে উঠল। ঠিক এ-সময় আমরা লক্ষ করলাম আমাদের মেয়ের মধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিক একটি আচরণ। যেন হঠাৎ করে সে বিশ বছর বয়স থেকে টিনএজ বয়সে নেমে এলো। টিনএজারদের মতো আচরণ করতে লাগল।
আমি আর রবিন ওর ব্যবহার দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
আমাদের মেয়ে তো এরকম ছিল না।
রানি তার জীবনের ডেইলি রুটিন থেকে যেন ধীরে ধীরে বিচ্যুত হয়ে যেতে লাগল। ক্লাসের পড়াশোনা নিয়মিত করতে পারত না। শেষে এমন হলো যে, সে ক্লাসে যাওয়াই ছেড়ে দিলো, অবশেষে তার লেখাপড়া করাই বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা, তার মা-বাবা, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকে সাসক্যাটুনের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।
অথচ এরকম তো হবার কথা ছিল না।
আমার মনে পড়ল, যখন আমরা তাকে কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিয়েছিলাম, তখন ছাত্রী অবস্থাতেই সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্যে কাজ করেছে। সে তাদের আশ্রয় নিবাসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছে। তাদের সেবা প্রদান করেছে। তাদের জন্যে সে কবিতা লিখেছে। তাদের নাচগান করে শুনিয়েছে। এজন্যে সে ইউনিভার্সিটি থেকে পুরস্কারও পেয়েছে। যে-কোনো মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের সে বিশেষ সেবা দেবার চেষ্টা করেছে। অথচ তার পরপরই নিজে যখন মানসিক বিষণœতায় আক্রান্ত তখন নিজেকে সে সান্ত¡না দিতে পারেনি। অথবা আমরাও কেউ তার ভরসা হতে পারিনি।
বরং তার বিষণœতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছল যে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। এবং সে নিয়মিতভাবে সেই হাসপাতাল থেকে পালাতে শুরু করল।
তারপর হাসপাতালে থাকতেই সে বলতে শুরু করলে যে, সে তার জন্মদাত্রী মাকে চোখে দেখতে পায়। সেই মা তার মাথার কাছে রাতের বেলা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। বস্তুত সে বাংলাদেশ সফর করার সময় অনাথ আশ্রমে যাওয়ার পর এবং রেজিস্টার খাতায় নিজের নাম দেখার পর তার মনে হতে থাকে যেন তার জন্মদাত্রী মা তাকে তাকিয়ে দেখছেন।
মাঝে মাঝেই তার ভেতরে প্রচ- রকমের ক্রোধ এবং হতাশার জন্ম হতো। মাঝে মাঝেই আচমকা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করত।
নিজের আবেগকে প্রশমিত করার উপায় হিসেবে আমি তাকে মাঝে মাঝেই বলতাম, মামণি, তুমি তো আগে কবিতা লিখতে, গান লিখতে, তা হলে তোমার সেই মাকে নিয়ে কবিতা বা গান লিখে আমাদের শোনাও না কেন। তা হলে হয়তো তোমার ভালো লাগবে।
আমি ইচ্ছে করে তাকে এসব কথা বলতাম, যাতে তার মন অন্যদিকে ধাবিত হয়। যেন সে আত্মবিধ্বংসী কোনো আচরণ না করে। রানিকে এসব কথা বলার সময় আমার নিজের মনের ভেতরে যেন রক্তক্ষরণ হতো। মেয়েকে এরকম অবস্থায় দেখে আমি আর রবিন মনে মনে যেন নিজেরাই পাগল হয়ে যেতাম।
হয়তো আমার কথা শুনেই রানি একটি কবিতা লিখেছিল সে-সময়, কবিতাটা ছিল এরকম :

মা, তুমি যখন আমাকে ফেলে চলে
গিয়েছিলে,
আমি ছিলাম একটি শিশু,
কেন ফেলে গিয়েছিলে আমি তা জানবো না
কোনোদিন
কিন্তু মা তুমি সারাটা সময় থাকবে আমার
মনের ভেতরে,
আমি তোমাকে ভালোবাসবোই মা,
যেমন আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি!

এ কবিতাটি পড়ে আমার তখন শুধু মনে মনে আফসোস হতো এ-কথা ভেবে যে, কেন আমরা রানিকে বাংলাদেশে নিয়ে গেলাম। কেন এতবড় ভুল কাজটি করলাম। যদি আমার রানি বাংলাদেশে কোনোদিন না যেত তাহলে তো আমাদের মেয়েকে এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।
কিন্তু যে-ঘটনা একবার ঘটে গেছে সেটা তো আর ফেরাতে পারব না।
রানি নিয়মিত গির্জায় যেত। সেখানে গিয়ে তার কিছু পছন্দের গান সে গাইত। যেমন, হিয়ার আই অ্যাম লর্ড, বা প্রেশার্স লর্ড, টেক মাই হ্যান্ড।
১৯৯২ সাল নাগাদ রানির লেখাপড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সাসক্যাটুনের বাড়িতে চিরদিনের জন্যে ফিরে এলো সে।
বাড়িতে ফিরে এসে রানি আমাদের সঙ্গে নিয়মিত গির্জায় যেত। সেখানে গিয়ে সে প্রভুর উদ্দেশে গাইত, হিয়ার আই অ্যাম লর্ড।
আবার গাইত, প্রেশার্স, টেক মাই হ্যান্ড।
বাড়ি ফিরে এসে রানি যেন আরো নিজেকে গুটিয়ে ফেলল। বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিলো। আমি আর রবিন অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। রানির কাছাকাছি সবসময় থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম। রবিন যেন তার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া ভুলে যেতে লাগল।
ডাক্তাররা বললেন, রানির নাকি বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে একটি মানসিক রোগ হয়েছে। যে রোগে মানুষ একবার উচ্ছলতার চরমে ওঠে আবার বিষণœতার পাথারে হারিয়ে যায়। এবং এই রোগ নাকি দফাওয়ারি। একবার ম্যানিয়া, আবার ডিপ্রেশন। এবং দুটো অবস্থা যখনই হবে চরম আকার ধারণ করবে। আর এই রোগে আত্মহত্যার প্রবণতাও মাঝে মাঝে ভীষণভাবে প্রকাশ পাবে। তখন একে প্রতিরোধ না করা হলে রোগী বাঁচে না। ডাক্তাররা আরো বললেন, খুব সম্ভব, রানির জন্মদাত্রী মায়েরও এরকম অসুখ থাকতে পারে। কারণ অসুখটা হয় সাধারণত বংশগত।
আবার কোনো কোনো স্পেশালিস্ট বললেন, ঠিক বাইপোলার ডিসঅর্ডার ব্যাখ্যা দিয়ে পুরো অসুখটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। অনেক সিম্পটম ছিল তার যেগুলো সেই অসুখের ধারাবাহিকতায় ঠিক পড়ে না। একজন থেরাপিস্ট আমাদের বলেছিলেন, রানি যেহেতু তার জন্মদাত্রী মা দ্বারা জন্মের পরপরই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, সেহেতু তার মনের ভেতরে একটা ভয় সবসময় কাজ করত এই যে, তার দত্তক পিতা-মাতাও তাকে কোনোদিন প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
যার ফলে আমরা রানিকে বারবার করে বোঝানোর পরও কোথায় যেন একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছিল। আমরা নিজেরাও যেন অন্ধকারের ভেতরে পতিত হয়েছিলাম। আমরা জানতাম রানি এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না, কিন্তু কোনো এক অমোঘ আকর্ষণ বারবার তাকে আমাদের কাছ থেকে যেন ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছিল।

ছয়
সেদিনটি ছিল একটি অদ্ভুত দিন। ছিল জুন মাস। সাধারণত এ-সময় বৃষ্টি হবার কথা নয়। কিন্তু সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার শরীরটা কেন জানি সকাল থেকে খারাপ লাগছিল। কারণ রানি ছিল হাসপাতালে ভর্তি। সে বিষণœতায় ভুগছিল। বিগত দু-সপ্তাহ ধরে ছিল সে হাসপাতালে। গত উইকএন্ডে আমাদের কাছে এসেছিল।
শনি-রোববার থেকে আবার হাসপাতালে ফিরে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে রোগীরা মাঝে মাঝে এভাবে তাদের ফ্যামিলির সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে আসে। আবার সোমবারে তারা হাসপাতালে ফিরে যায়। আমরা সকলে মিলে সেই রোববারে গির্জায় প্রার্থনা করতে গিয়েছিলাম।
সেদিন আমি রানির জন্যে চিকেন পাই রান্না করেছিলাম। কারণ রানি আমার হাতের চিকেন পাই খেতে খুব পছন্দ করত।
রোববারে বিকেলে যখন আমি আর রবিন তাকে হাসপাতালে রেখে আসতে গেলাম, সে হঠাৎ আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মুখ রেখে বলল, আমাকে মাফ করে দিও মা, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি!
তার এ রকম ব্যবহার দেখে রবিন তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলল, পাগলি মেয়ে, এসব কথা কখনো মা-বাবাকে বলতে হয়? সন্তান মানেই তো কষ্ট। আর এই কষ্ট যারা না পায়, তাদের তো জীবনই ব্যর্থ। আগামী শনিবার সকালে আমি আবার তোমাকে নিতে আসব, ঠিক আছে মামণি?
আর এ-কথার উত্তরে রানি তার বাবাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা, তুমি ভালো থেকো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, বাবা।
রানি এ-ধরনের আবেগী কথা মাঝে মাঝেই আমাদের বলত, কারণ সে ছিল আবেগী একটি মেয়ে। আমরা তাই তার এ-ধরনের কথায় কিছু ভাবিনি। কিন্তু সেদিনের কথাগুলো যে রানির শেষ কথা হবে, তা আমরা বুঝতে পারিনি। দুঃখের ব্যাপার, আমাদের ছেলে জন তখন অন্য একটা স্টেটে লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেছিল। তখন সে সদ্যবিবাহিত। হয়তো জন আমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের সে সতর্ক করত। দুর্ভাগ্য যে, আমাদের ছেলে জন আমাদের সঙ্গে ছিল না।
আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। তখনো ভাবতে পারিনি যে সেটাই হবে রানির সঙ্গে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ।
আমাদের আদরের ধন রানি আত্মহত্যা করল, ৭ জুন, ১৯৯৯। বেলা তখন ঠিক বারোটা তিরিশ মিনিট।

হ্যাঁ, অনেক মানুষ এসেছিলেন রানির শেষকৃত্যে। সকলেই অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। রবিন তার কন্যাশোক সামলে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কারণ তাকেই মানুষজন সামাল দিতে হয়েছিল। রানির শেষকৃত্যে অনেক মানুষ এসেছিলেন। প্রত্যেকের স্মৃতিতে রানি যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল সেদিন।
রানির ভাই জন এবং তার স্ত্রী কিম মরালও এসেছিল।

একসময় সবকিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে এলো।
মেয়ে হারিয়ে দীর্ঘদিন রবিন তার লাইব্রেরি ঘরে চুপচাপ বসে থাকল। তার হয়তো তখন মনে হতো কীভাবে রানি ছেলেবেলায় তার বাবার লাইব্রেরির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত, বাবা বেরোলেই তার কাছে কোনো বায়না ধরবে বলে।
আর আমি, আমি বারবারা মরাল এখনো আমার মেয়ে হারানোর শোক উদ্যাপন করে চলেছি।
রানি বাংলাদেশে গিয়ে অনাথ আশ্রম দেখে কানাডায় ফিরে এসে যে-কবিতাটা লিখেছিল, তার মাঝপথে ছিল এই পঙ্ক্তিটি:
মা, তোমাকে হারিয়ে আমি বিষণœ
ছিলাম,
কত যে কেঁদেছি তোমাকে ফিরে পেতে
ব্যথাতুর রাত্রিতে রাত্রিতে মনে হতো
এই ব্যথা কখনো হবে না শেষ।
এই কবিতাটা রানি তার গর্ভবতী মায়ের জন্যে লিখেছিল আমি জানি, যে গর্ভবতী মা তার জন্মের পরমুহূর্তেই তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল চিরজীবনের জন্য।
আর আমি, তার দত্তক মা, আমার সন্তান রানিকে হারিয়ে ঠিক তার লেখা কবিতার মতোই চিরটা জীবন ডুকরে চলেছি। এই শোকের শেষ কি কোনোদিন হবে?

শেষ
ফেব্রুয়ারি, ৯, ২০২০
গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার মুস্তফা চৌধুরী কর্তৃক একাত্তরের যুদ্ধশিশু গ্রন্থটির সাহায্যে।