বাংলার নেতৃত্ব ও বঙ্গবন্ধু

বাংলার অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলার, বিভক্ত বাংলার অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বা বাংলাদেশের কথা বলছি। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশ শতকে যেভাবে গড়ে উঠেছিল তা এই প্রবন্ধে বিবেচ্য। ১৯৩৫ সালে ভারতশাসন আইন অনুসারে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন প্রদেশকে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনপদ্ধতি ওই আইন অনুসারেই প্রচলিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তিনটি দল প্রাধান্য পেয়েছিল – কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস; কিন্তু কোনো দলই সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। যদিও তুলনামূলকভাবে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি অন্য দুটি দলের চেয়ে বেশি সদস্যপদ পেয়েছিল, কিন্তু সরকার গঠনের জন্য অন্য দলের সঙ্গে কোয়ালিশনের প্রয়োজন ছিল। হক সাহেব কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনে আগ্রহী ছিলেন; কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অনীহার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগকে ফজলুল হকের প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকারে যোগদানের নির্দেশ দেন। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক প্রজা ও মুসলিম লীগ দলের কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং হক সাহেবের নেতৃত্বে এই দুই দল বস্তুতপক্ষে একক দলে পরিণত হয়।

অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক সরকারের আমলে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যার ফলে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল, যেমন ঋণ সালিশি বোর্ড, প্রজাস্বত্ব আইন এবং প্রাথমিক শিক্ষা বিল। ওইসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ কে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। তিনি অবিভক্ত ভারতের মুসলমান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এই কারণেই ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’উত্থাপনের জন্য ফজলুল হককেই বেছে নেন।

লাহোর প্রস্তাবের মূল দাবি ছিল উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ শাসন প্রক্রিয়ায় ভারতের পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মির নিয়ে অপর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। এ কে ফজলুল হক যখন লাহোরে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় প্রবেশ করেন, তখন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে কাউন্সিলের সদস্যরা দাঁড়িয়ে ‘শের-এ-বঙ্গাল জিন্দাবাদ’ধ্বনিতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। শেরেবাংলা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। স্মরণীয় যে, সে-সময় বাংলা ছাড়া অপর কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতাসীন ছিল না। ১৯৪১ সালের দিকে চলমান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতের ভাইসরয় যে ‘ওয়ার কাউন্সিল’গঠন করেন, তার অন্যতম সদস্যরূপে যোগদানের জন্য তিনি শেরেবাংলাকে আমন্ত্রণ জানান। শেরেবাংলা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর অনুমতি ছাড়া ওয়ার কাউন্সিলে যোগদান করায় জিন্নাহ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন। ফলে বাধ্য হয়ে শেরেবাংলা হিন্দু মহাসভা নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে মিলিত হয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন, যা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা নামে পরিচিত ছিল; কিন্তু মুসলিম লীগের বিরোধিতার জন্য এই সরকার বেশিদিন টিকতে পারেনি। ফলে এই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয় এবং খাজা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই মন্ত্রিসভার আমলেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলায় ষাট লাখ লোক অনাহারে প্রাণ দিয়েছিল।

অবিভক্ত বাংলার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৫-৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রায় সব আসনে পাকিস্তান আন্দোলনকে ইস্যু করে জয়লাভ করেছিল। অন্যদিকে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আবদুল গাফ্ফার খানের নেতৃত্বে কংগ্রেস-প্রভাবিত ‘রেড শার্ট’বা লাল কোর্তা দল ক্ষমতা দখল করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বিভিন্ন প্রাদেশিক পরিষদে ও ভারতের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত মুসলিম লীগদলীয় পরিষদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে তিনি ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগ কাউন্সিলে গৃহীত প্রস্তাবের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও গ্রহণ করান, যার মূলকথা ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান নামে দুটির পরিবর্তে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জিন্নাহ সাহেবের নির্দেশে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

লক্ষণীয় যে, লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করার পর শেরেবাংলার ভাগ্যে যে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি ঘটেছিল, পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলা পরিষদ দলের নেতা নির্বাচন করা হয়েছিল খাজা নাজিমউদ্দীনকে, যিনি ’৪৫-৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে দুটি কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তার একটি থেকে উপনির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দীনকে নির্বাচিত করিয়েছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকায় এসে অ্যাডভোকেট জেনারেলের চাকরি নিয়েছিলেন। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলায় এসে বহিষ্কৃত হয়ে করাচি গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রথম সাধারণ নির্বাচনে একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত স্মৃতিবহ একুশ দফার ভিত্তিতে ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কিন্তু শেরেবাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার দু-মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তবে পরবর্তীকালে শেরেবাংলা কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী এবং আরো পরে পূর্ব বাংলা গভর্নরের চাকরি করেছিলেন। অপরদিকে অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর করাচিতে গিয়ে প্রথমে আইনব্যবসা এবং পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলির মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্মরণীয় যে, মোহাম্মদ আলি অবিভক্ত বাংলায় সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান পাশ করিয়েছিলেন। তবে সেই সংবিধানে পাকিস্তানের দুটি অংশে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় পরিষদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানসংখ্যক সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এভাবেই পূর্ব বাংলার নাম বদলে হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান আর পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লোপ পায়। প্রতিবাদে পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ওই সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘বে-অব-বেঙ্গল’ছাড়া আর কোথাও বাংলা নাম রইলো না। স্মরণীয় যে, ওই সংবিধান অনুসারে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমে জেনারেল ইসকান্দর মির্জা, পরে জেনারেল আইয়ুব খান এবং শেষে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বিভাজনের কাজটি সুসম্পন্ন করেন।

আমরা এতক্ষণ অবিভক্ত বাংলার এবং পাকিস্তানের প্রথম যুগের দুজন স্বনামধন্য নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবনের কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। এই উভয় নেতাই বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথমার্ধে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, যাঁদের শেষ শয়ান ঢাকার রমনায়।

বাংলার সবচেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্রের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রথমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্য লাভ করেন। তবে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করলে তাঁর সঙ্গে শেখ সাহেবের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতি ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান যখন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে আইএ ও বিএ পড়ছিলেন, তখন থেকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে ওঠে, যা সোহরাওয়ার্দীর জীবনে শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল, যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচিতে থেকে রাজনীতি করে গেছেন।

শেখ মুজিবুর রহমান দেশবিভাগের পর ঢাকায় আসেন এবং মোগলটুলীতে অবস্থিত মুসলিম লীগ কর্মী শিবির স্থাপন করে পূর্ব বাংলার রাজনীতি শুরু করেন। ’৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলন, কারাবরণ ও ছাত্রলীগ গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় তাঁর নতুন রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্ন কর্মচারী ধর্মঘট আন্দোলনে যোগ দিলে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হলে কারাগারে থেকেই তিনি সে-প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময়ও তিনি বন্দি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত অবস্থায় ’৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আনা হলে ভাষা-আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফলে তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। এ-সময় আদমজী পাটকলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা বাধিয়ে দিলে তিনি সেখানে ছুটে যান এবং হানাহানি বন্ধ করান। এরপর আমরা তাঁকে দেখি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরূপে। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণ তাঁর একটি বড় কাজ। ’৫৬ সালে পাকিস্তানে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর ঢাকায় গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রথা প্রচলিত হয়। তার পেছনে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয় ভূমিকা। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব শেখ সাহেবকেই পালন করতে হচ্ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান সামরিক চক্রের চক্ষুশূল ছিলেন। ফলে তাঁকে প্রথমে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি এবং পরে দেশত্যাগ করে বিদেশে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। বৈরুতে এক হোটেলে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের অবসান ঘটে। যেদিন তাঁর ঢাকায় আসার কথা ছিল, সেদিন তাঁর লাশ ঢাকায় এসেছিল। এই প্রেক্ষাপটে আইয়ুব-মোনেম চক্রের সবচেয়ে বড় দুশমন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ডান-বাম অনেক নেতাই প্রকাশ্যে বা গোপনে সামরিক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, ব্যতিক্রম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৪ সালে যখন কতিপয় অবাঙালি মোহাজেরকে দিয়ে পূর্ব বাংলায় এক ভয়াবহ বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়, তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’আন্দোলন শুরু হয়। এই দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলা থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়ন। কিন্তু শেখ সাহেবের নেতৃত্বে ওই দাঙ্গা রুখে দেওয়া হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে গেলে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় ছিল, কারণ পাকিস্তান সামরিক শক্তির শতকরা নব্বইভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে মোতায়েন ছিল। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের উভয় অংশে স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশনে পরিণত করা। শেখ সাহেবের ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে এক গণআন্দোলন শুরু হয়, যার প্রতিশোধ নেবার জন্য পাকিস্তান সামরিক চক্র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করেছিল। পূর্ব থেকে কারাবন্দি শেখ সাহেবকে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি করে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারকার্য শুরু হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক উত্তাল গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ছয় ও এগারো দফার ভিত্তিতে এই আন্দোলন থেকেই ধ্বনি ওঠে – ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এই আন্দোলন ’৬৯-এ এসে চরম আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনে ছাত্রনেতা আসাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাসহ অগণিত মানুষ প্রাণ দেন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে এবং ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ সাহেবসহ সব আসামিকে মুক্তি দিতে। এর পরেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান গণপরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন ঢাকায়। কিন্তু ১লা মার্চ ১৯৭১ তিনি অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। বিক্ষোভে পূর্ব বাংলা ফেটে পড়ে, শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩রা মার্চ পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলা ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’গানটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা করে। ৭ই মার্চ ১৯৭১, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, যা ছিল পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান। পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে, ধ্বনি ওঠে – ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান বাংলাদেশে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করলে গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে ২৬শে মার্চের সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন, যা চট্টগ্রাম বেতার থেকে ২৬শে মার্চ প্রচারিত হয়। শুরু হয়ে যায় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্যেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।**