বেঁচে থাক ১৯৭১

আমি তখন জলপাইগুড়ি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফাইনাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। সেটা ১৯৫২ সাল। সেবার এপ্রিল মাসে গরমের সময় অন্নদাশঙ্কর এলেন দার্জিলিংয়ে। জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মাত্র তিন-চার ঘণ্টার পথ। আমরা গেলাম দু-তিনজন বন্ধু। যে-অন্নদাশঙ্করকে দেখেছিলাম শান্তিনিকেতনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে, তিনি দার্জিলিংয়ে স্যুটবুটের সাহেব। নানা কথা প্রসঙ্গে, বোধহয় বাংলা সাহিত্য ও ভাষা প্রসঙ্গে, উঠল একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। ওই সময় আমরা পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। খবরের কাগজ পড়ার বা রেডিও শোনার ফুরসত ছিল না। হয়তো তাই ঢাকায় কী হয়েছে, জানতাম না। একুশের কথা উঠতেই জ্বলে উঠলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখে নিয়ো, ইতিহাসে এর সুদূরপ্রসারী ফল ফলবে।’

এরপর ১৯৫৩-র একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছরপূর্তিতে অন্নদাশঙ্করের আয়োজনে সাহিত্যমেলা হয়। এক হিসেবে সেটাই প্রথম মাতৃভাষা দিবস। সাহিত্যমেলায় অন্নদাশঙ্করের ব্যবস্থাপনায় তিনজন প্রবীণ সাহিত্যিক, দুজন নবীন সাহিত্যিক আসেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকে আসেন – নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত, কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। সাহিত্যমেলার বিবরণ লিখতে স্টুডেন্ট ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আসেন শঙ্খ ঘোষ, এসে আমার অতিথি হন, আমার হোস্টেলেই। আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে প্রথমে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হই, হোস্টেলে ঠাঁই না পেয়ে শান্তিনিকেতনে গিয়ে হোস্টেলে জায়গা পাই। আমার কথা থাক। আসল কথায় আসি।

সেই যে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি, সেটাই সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হলো ১৯৭১-এর মার্চ মাসে।

১৯৫২-তে ভারতের প্রথম নির্বাচন। তারপর থেকে বছর বছর ভারতে নির্বাচন হতে থাকে। কিন্তু একই বছরে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা হলেও একই সঙ্গে নির্বাচন হয় না। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে নির্বাচনই হয় না। অথচ জনসাধারণ নির্বাচন চাইছিল। অবশেষে ইয়াহিয়া খানের সুবুদ্ধি হলো। তিনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন। তখন দুটি দল নিয়ে পাকিস্তানের জনসাধারণ – পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টি আর পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ। ইয়াহিয়া খান পাঞ্জাবি খান আর আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি। একদিকে খান আর অন্যদিকে শেখ। পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো সিন্ধি। পাঞ্জাবিদের সঙ্গে তাদের খুব মিল, তবে দুজনেই উর্দুভাষী। একই ভাষাভাষী। উর্দুভাষীরা একদিকে এবং বাংলাভাষীরা একদিকে।

ইয়াহিয়া খান আশা করেছিলেন যে নির্বাচন হলে উর্দুভাষীরাই জিতবে, কিন্তু জিতল বাংলাভাষীরা। দুম করে পাশার দান পালটে গেল। উর্দুভাষীদের অপ্রত্যাশিত পরাজয়। ক্ষমতা তখনো উর্দুভাষীদের কুক্ষিতে। তারা সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল নির্বাচনে জিতে। নির্বাচনের ফল তারা মানতে চাইল না। আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, এটা জনসাধারণের রায়। কিছুদিন চেষ্টার পর দেখলেন যে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার মানে স্বাধীন হতে হবে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

শেখ মুজিব যখন বুঝলেন যে ভুট্টো জনগণের রায় মানতে রাজি নন, তখনই আন্দাজ করলেন এটা পাঞ্জাবিরা, যোদ্ধার জাতি, নিষ্পত্তি করবে যুদ্ধ করে। তার প্রস্তুতিও দেখলেন পূর্ব পাকিস্তানে যেসব পাঞ্জাবি পরিবার আছে, সরকারি কাজের সুবাদে, তাদের মেয়েদের ও ছেলেমেয়েদের জাহাজে করে পাঠিয়ে দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। কেন? নিশ্চয়ই এবার যুদ্ধ শুরু করবে। চারদিকে একটা থমথমে ভাব! বোঝাই যাচ্ছে এবার আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করবে যে-কোনোদিন। মার্চ মাসে রমনার মাঠে এক সভায় বক্তৃতা দিলেন – ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

খানদের সঙ্গে যুদ্ধ শুনেই অনেকে, হিন্দু ও মুসলমান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালাতে লাগলেন। তখন ভারতে মৈত্রেয়ী দেবী এই সীমান্ত অঞ্চলে এই দেশছাড়াদের পশ্চিম বাংলার কোথায় কোথায় কার বাড়িতে রাখা যায় তার বিলি-ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমরা একজনকে রাখো।’ তাঁর লোক মারফত এই খবর পেয়ে আমি স্ত্রী মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলে সম্মতি জানালাম। কিন্তু একজনের বদলে এলেন প্রথমে দুজন, এলেন রংপুরের বাসিন্দা, একজন হিন্দু ও অন্যজন মুসলমান, তাদের নাম ভুলে গেছি, তবে মুসলমান ভদ্রলোক বেশ বিদ্বান, গবেষণা করছিলেন সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ নিয়ে। বললেন, সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের মূল নেতা ছিলেন মজনু শাহ। তিনি আসলে ছিলেন মোগল বংশোদ্ভূত জমিদার। মজনু মানে পাগল, শাহ মানে রাজা-বাদশাহ! মজনু শাহ মানে পাগল রাজা বা জমিদার। তিনি মোটেই ফকির নন। যেখানে ইংরেজরা মজনু শাহকে সম্মুখসমরে পরাস্ত করে হত্যা করে, সে-জায়গার নাম হয় মোগলকাটা বা মোগলমারা।

আমার স্ত্রী ইতিহাসে গোল্ডমেডেলিস্ট। তিনি সব লিখে নেন। কিন্তু সে-সময় আমাদের পাড়াতেও রাজনীতির দলাদলি থেকে মারামারি-খুনোখুনি চলছিল। পাকিস্তান থেকে আসা ভদ্রলোক বললেন, এরা এখানে না লড়ে বর্ডারে গিয়ে খানসেনাদের সঙ্গে লড়লে পারে।

ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রচুর মুসলমান বাঙালি পশ্চিম বাংলার নানা স্থানে, মূর্তি চা-বাগানে, কলাইকুণ্ডর ভারতীয় সেনা ছাউনিতে শিক্ষানবিশ হয়। বিশেষত গেরিলা যুদ্ধে।

ওদিকে পুবের সীমান্তে, ত্রিপুরায়, শরণার্থীদের সংখ্যা মূল ত্রিপুরাবাসীর সংখ্যা ছাপিয়ে যায়। অতিশয় জঘন্য দশায় শরণার্থীরা বাস করে। বহু শরণার্থী অনাহারে ও ব্যাধিতে মারা যায়। কিন্তু ত্রিপুরা সরকার, এমনকি প্রাক্তন মহারাজার পুত্রও, শরণার্থীদের সেবায় নিযুক্ত থাকেন। আবার বামপন্থি রাজনীতিবিদরাও। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসেন সুদূর দিল্লির নেতারা, এমনকি বহু বিদেশিও আসেন, বিদেশি সাংবাদিক, বিদেশিরা একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে ঢুকে গিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। খানসেনা আর শেখসেনার যুদ্ধ তৃতীয় মাস থেকেই বিশ্বের সংবাদ হয়ে ওঠে।

এদিকে খানসেনারা বিপর্যস্ত হতে থাকে আকাশ ঢেলে নামা বর্ষায় আর মাটিতে শেখসেনাদের গেরিলা যুদ্ধে। বর্ষায় ট্যাঙ্কগুলোও একে একে অচল হয়।

এর মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা বায়ুপথে উড়ে এলেন ঢাকায়। সেটা ১৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি আগেই ইয়াহিয়া খানের বার্তা পেয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির জন্য। অবশেষে জে এস অরোরার কাছে নিয়াজির আত্মসমর্পণ।

এ-ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান একটা মস্ত ভুল করেছিলেন – পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান শাসন করা যায় না। এটা বুঝেই, লন্ডন থেকে ভারতবর্ষ শাসন করা যায় না বুঝেই, ইংরেজরা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। সব দেশেই বিশ্বাসঘাতক থাকে। ভারতবর্ষেও ইংরেজের সহযোগী ছিল, পূর্ব পাকিস্তানেও ছিল – বাঙালি হলেও খানবাহিনীর অনুগত, এদের বলা হতো রাজাকার। এরা একেকজন খানদের থেকেও নৃশংস, অত্যাচারী ও খুনি-ধর্ষক।

যা-হোক, মুক্তিযুদ্ধ পর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অক্লান্তভাবে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ঘুরে একটা বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বাংলাভাষীদের পক্ষে। তাঁর নিজেরও কিশোরীজীবন কেটেছে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথকে সর্বদা উল্লেখ করতেন ‘গুরুদেব’ বলে। বাংলাভাষীদের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল। সেই বাংলাভাষার গৌরব নিয়েই যত কাণ্ড।

পূর্ব পাকিস্তান রাহুমুক্ত হলেও মুজিবুর রহমান কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। একটা সময় একটা কারাগারে ছিলেন যেখানে গ্রীষ্ম ছিল সবচেয়ে প্রখর। সেই দাবদাহে তাঁকে বন্ধ রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পরাজিত হয়ে ইয়াহিয়া খান মুজিবকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু জুলফিকার ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে এখন নিয়াজি ও তার বাহিনী আছে, রাজাকাররাও আছে, ইন্ডিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিবাহিনী তাদের মেরে ফেলবে। মুজিবের প্রাণ আর খানসেনাদের প্রাণ – এই দুই প্রাণ অদল-বদল হলো। মুজিবকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিয়াজিদের প্রাণ বাঁচানো হলো। সরাসরি মুজিবকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হলো না, তুলে দেওয়া হলো ইংরেজদের হাতে লন্ডনে। সেখান থেকে ইন্দিরা গান্ধী নিয়ে এলেন কলকাতায়। কলকাতা থেকে প্লেনে ঢাকায়। মুজিব নিশ্চিত ছিলেন তাঁর জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে। নিজের সুরক্ষা সম্বন্ধে। নিজের সুরক্ষা সম্বন্ধে কোনো সংশয় ছিল না তাঁর। ইন্দিরার হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত করেননি। ফল যা হওয়ার তাই হলো। ছদ্মবেশী প্রিয়জনদের গুলিতে ধানমণ্ডির নিজগৃহে নিহত হলেন। পরে ইন্দিরা গান্ধীও নিজের বাড়িতে নিজের রক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। অতিরিক্ত বিশ্বাসের পরিণাম।

ইন্দিরার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা বাংলাদেশের মানুষের মনে হয়নি বহুকাল, মনে পড়ল শেখ হাসিনার। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সোনিয়া গান্ধীকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিশেষ সংবর্ধনা জানান। এরপর ২০১২ ও ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা ভারতের ও বিদেশের যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য বা সমর্থন করেন তাঁদেরকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সংবর্ধনা ও নানা উপঢৌকন প্রদান করেন।

জয় বাংলা। বাংলাদেশের সঙ্গে আজো ভারতের সুসম্পর্ক। পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তান, যাকে আজ পাকিস্তান বললেই বোঝা যায়, তার সঙ্গে ভারতের খুটখাট লড়াই লেগেই আছে।