বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র

২৩ জুন বাঙালির ইতিহাসের একটি অনন্য দিন, পরম দুঃখের, পরম সুখের দিন। পরম দুঃখের দিন এ-কারণে যে, ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাব (জায়গিরদার) সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন। বাংলার ইংরেজ উপনিবেশে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশজুড়ে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়। একসময়ের বিশ্বের সমৃদ্ধতম দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটিতে পরিণত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করে।

পরম সুখের দিন কারণ ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম বা অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হৃত-গৌরবই কেবলমাত্র ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হয়নি, বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও সূচনালগ্নের উন্মেষ ঘটে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ্ব ইতিহাসে স্বাধীনতার যে-শ্রেষ্ঠ ভাষণটি ১০ লাখ জনতার সামনে দিয়েছিলেন, সেই ভাষণের প্রারম্ভেই তিনি বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের কথা বলেছিলেন।

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলের ২৩ বছরের নির্মম শোষণের কথা তীব্র ভাষায় জনতাকে জানিয়েছিলেন। সপ্তদশ শতকে যেসব ইউরোপীয় পরিব্রাজক বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাঁরা বাংলার ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বার্নিয়ার, ট্যাভার্নিয়ার প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক। বার্নিয়ার ফ্রান্সের তৎকালীন অত্যন্ত পরাক্রমশালী সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের প্রধানমন্ত্রী কোলবার্টকে জানিয়েছিলেন, তিনি দু-দুবার বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বিশ্বের যেসব দেশ পরিভ্রমণ করেছেন তিনি, তার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী। বার্নিয়ার এসেছিলেন শাহজাহানের রাজত্বকালে। আমরা জানি, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০-এর মধ্যে বাংলায় যে-লুণ্ঠন হয়েছিল, যা ‘Bengal Plunder’ নামে পরিচিত তা ছিল ব্রুক এডামসের হিসাবমতে, প্রায় ৫০০ কোটি পাউন্ড। এই লুণ্ঠন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের লুণ্ঠিত অর্থ বা ক্যাপিটাল ও ব্রিটিশ শ্রমিকশ্রেণির রক্ত জল করা শ্রমের বিনিময়েই অষ্টাদশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। এরপর আরো প্রায় ১৯০ বছর বাংলাদেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে শোষিত হয়েছিল। বাংলাদেশের বিশ্ববিশ্রুত মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বা বি-শিল্পকরণের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর দরিদ্র অর্থনীতিতে রূপান্তর করা হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল মুখ্যত বাংলার উন্মেষ-উন্মুখ মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের উৎসে ছিল হিন্দু ও মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসম বিকাশ। ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল মুসলিম উচ্চবিত্ত শ্রেণি বিশেষত আশরাফ শ্রেণি থেকে। এই আশরাফ শ্রেণি মনে করত তারা বহিরাগত, বস্তুত তাদের একটি অংশ বহিরাগতই ছিল। প্রথমে তাদের মুখের ভাষা ছিল তুর্কি বা ফার্সি, পরে উর্দু বা হিন্দুস্তানি। মুর্শিদ কুলী খাঁ, সরফরাজ খাঁ, আলীবর্দী, সিরাজউদ্দৌলা, মীরজাফর কারো মুখের ভাষাই বাংলা ছিল না। কিন্তু বাংলা ছিল বাংলার সাধারণ মুসলমানের মুখের ভাষা, সাধারণ হিন্দু-বৌদ্ধদেরও মুখের ভাষা। ইংরেজরা যেহেতু এই আশরাফ শ্রেণি থেকে ক্ষমতা নিয়েছিল সেহেতু এই আশরাফ শ্রেণি ইংরেজ শাসনের প্রথম শতাব্দী এই শাসনকে সর্বতোভাবে বর্জন করে, ইংরেজি ভাষাকেও তারা বর্জন করেছিল। ইংরেজ শাসনকে তারা ‘বিধর্মী শাসন’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল।

মুর্শিদ কুলী খাঁর শাসনামল থেকেই বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা অনুসারে (ড. এ কে নাজমুল করিম, ড. এ আর মল্লিক) একটি হিন্দু রাজকর্মচারী শ্রেণি বা আমলা শ্রেণির বিকাশ হয়েছিল। এরা ছিল নানাভাবে প্রশাসন ও রাজস্ব আহরণে যুক্ত। এই কারণে ফার্সি শিক্ষার্থী হিন্দুর সংখ্যা ছিল মুসলিম শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। কারণ ফার্সি ছিল প্রশাসনিক ভাষা (১৮২৭ পর্যন্ত)। প্রশাসনে যুক্ত এই শ্রেণিটি যখন ইংরেজি প্রশাসনের ভাষা হলো তখন এই ভাষাটি শিখতে তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। ইংরেজি-শিক্ষিত এই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি স্বাভাবিকভাবেই বাংলার অর্থনীতিতে প্রাধান্য অর্জন করে। ১৭৯৩ সালে ইংরেজরা যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন’ প্রচলন করে তাও বাংলায় একটি নতুন জমিদার শ্রেণির জন্ম দেয়, যেখানে হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা ছিল বেশি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অসম বিকাশের ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির নেতৃত্বে ছিল ইউপি বা উত্তর প্রদেশের মুসলিম জমিদার বা আশরাফ শ্রেণি, বাংলার মুসলিম জমিদার শ্রেণি, বোম্বাই ও গুজরাটের বিত্তশালী বা ধনী-মুসলিম ব্যবসায়ী শ্রেণি। এই জমিদার ও ব্যবসায়ী শ্রেণির বৃহৎ অংশেরই মুখের ভাষা ছিল উর্দু। তাই ঢাকার পরিবর্তে করাচিই হয় পাকিস্তানের রাজধানী, রাষ্ট্রভাষা করা হয় উর্দুকে।

পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই তখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠা উন্মেষ-উন্মুখ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনুভব করল তারা এক ঔপনিবেশিক শাসনের পরিবর্তে অন্য এক ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলজালে আবদ্ধ হয়েছে। এর প্রথম উপলব্ধি ঘটে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দীন ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর বিরুদ্ধে তখনই প্রতিবাদ করেছিলেন ড. শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহের হোসেন, ড. এনামুল হক, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক। ভাষার প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে-সময় যেসব ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা বলা চলে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন, একটি ভাগে ছিলেন জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, খাজা নাজিমুদ্দীনের অনুসারীরা; অন্য ভাগে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারীরা। পাকিস্তান সৃষ্টির ঠিক অব্যবহিত আগে সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু (নেতাজি সুভাষ বসুর বড়ভাই), আবুল হাশিম ও ডা. কিরণ শংকর রায় চেষ্টা করেছিলেন বৃহৎ বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির, যে-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের সমর্থন লাভ করতে।

১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গভর্নর হলেন। বিশাল অহংবোধে (তিনি চাননি তাঁর ওপরে আর কেউ থাকুন) চালিত হয়ে তিনি হলেন গভর্নর জেনারেল, লিয়াকত আলী হলেন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ববঙ্গের (তখনো নাম পূর্ব পাকিস্তান হয়নি) প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমউদ্দীন। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে আসতেই পারলেন না। তিনি পাকিস্তানে আসেন ১৯৪৯ সালে। কিন্তু তাঁর ও আবুল হাশিমের অনুসারীরা একটি নতুন ছাত্র সংগঠন তৈরি করার উদ্যোগ নেন ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসেই। ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে ছাত্র কর্মিসভা ডাকা হয়। সভাপতিত্ব করেন সে-সময়ের ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান প্রসিদ্ধ সমাজবিজ্ঞানী ড. এ কে নাজমুল করিম। সেই দিন প্রতিষ্ঠা করা হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। রাজশাহীর নইমুদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীতে আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কর্মীরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। এখানেই এই মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস স্থাপন করা হয়। নইমুদ্দিন আহমেদ আহ্বায়ক হলেও এই ছাত্রলীগের প্রাণপুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভেতর আমি সব জেলাতেই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমুদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সবকিছুই আমাকে করতে হতো।’

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে বিরোধী কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সেই সময় গণপরিষদের কোনো বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রস্তাব সমর্থন করে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন না করলেও তিনি করাচি থেকে ফিরে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। এর কিছুদিন পর ২ মার্চ ফজলুল হক হলে এক সভার আহ্বান করা হয়। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ, তমদ্দুন মজলিস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ ও বিভিন্ন কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এই সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে পূর্ব বাংলায় হরতাল আহ্বান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীর বর্ণনামতে, “১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষার দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোরের দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্র সভা করে, ঐ তারিখের তিনদিন পূর্বে ঢাকা ফিরে এলাম। … রাতে কাজ ভাগ হলো, কে কোথায় থাকবে এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব।”

১১ মার্চের হরতালে শত শত ছাত্রছাত্রী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করলে তাঁদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এই হরতালে বহু ছাত্র আহত হয়েছিলেন, কয়েকজন ছাত্রীও আহত হন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তাঁদের (বঙ্গবন্ধুসহ) প্রায় ৭০-৭৫ জনকে এরেস্ট করে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় সন্ধ্যার সময়।’ ১৯৪৮-এর ১১ মার্চের হরতালই ছিল ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বড় স্ফুরণ। এই সময় প্রাদেশিক আইনসভার বাজেট অধিবেশন চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুই পক্ষ, সরকারি পক্ষ ও সংগ্রাম পরিষদ পক্ষ, যৌথভাবে একটি খসড়া চুক্তি সম্পাদন করে। এই খসড়া চুক্তিটির অনুমোদন ছাত্রনেতাদের থেকে নেওয়ার জন্য জেলে যান কামরুদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম। অনুমোদন নেওয়া হয় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও কয়েকজন ছাত্রনেতার কাছ থেকে। ছাত্রনেতারা অনুমোদন দিলে এই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর দেন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ও সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমেদ।

এই চুক্তি অনুসারে ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য আটক ছাত্রনেতা জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯ মার্চ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকা পৌঁছান। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ২১ মার্চ তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনা সভায় তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু; যারা এর বিরোধিতা করছে, তারা পাকিস্তানের শত্রুদের এজেন্ট এবং কমিউনিস্ট। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই সভায়ও তিনি ঘোষণা করেন, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। তখন কয়েকজন ছাত্র এর প্রতিবাদ করে ‘নো নো’ধ্বনি তোলে।

পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগই বাঙালির বিভিন্ন অধিকার নিয়ে প্রথম দাবি উত্থাপন করেছিল। এই দাবিসমূহ ছিল বঞ্চিত মানুষকে অধিকার দেওয়া। সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ কয়েকটি মৌলিক দাবি নিয়ে ধর্মঘট শুরু করলে সেই ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্মতা জানায় মুসলিম ছাত্রলীগ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন ছাত্রদের বহিষ্কারের হুমকি দেয় সেই হুমকিতে ভীত হয়ে নইমুদ্দিন আহমদ থেকে শুরু করে অনেকেই বন্ড দিয়ে এই ধর্মঘট থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনো অবস্থাতেই নিম্নশ্রেণির কর্মচারীদের অধিকারের দাবি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি, বরং আরো দৃঢ়ভাবে তাদের পাশে অবস্থান নেন। এর ফল হয়েছিল এই যে, তিনি কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতই হননি; গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।

তিন

১৯৪৯ সালের ১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে জেলে বন্দি থাকার কারণে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগের যে-অভিযাত্রা শুরু হয়, সেখানে উপস্থিত

থাকতে না পারলেও তাঁর প্রভাব বিরাটভাবেই ছিল এই সম্মেলনে, এই দলের সৃজনে। এই সভায় প্রায় ৩০০ কর্মী উপস্থিত ছিলেন। ভাসানী এবং ফজলুল হকও ছিলেন, যদিও ফজলুল হক কিছুক্ষণ পরেই সভাস্থল ছেড়ে চলে যান। এই সভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। জেলে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যুগ্ম সম্পাদক পদ প্রদানের মুখ্য কারণ ছিল, তাঁকেই গণ্য করা হতো সবচেয়ে বড় সংগঠক হিসেবে। যথার্থ অর্থেই তিনিই যে বাঙালির অধিকার-সংগ্রাম-আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সংগঠক ছিলেন, তা সবার কাছে সহজেই বোধগম্য হয়েছে তিনি বাংলাদেশ মুসলিম ছাত্রলীগ আন্দোলনকে জেলায় জেলায় মহকুমায় মহকুমায় যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা থেকে।

‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এই শব্দগুচ্ছে ‘মুসলিম’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হোক এটা তখন অনেকেই চাননি। বঙ্গবন্ধুও চাননি, এটা পরিষ্কার তাঁর এই মন্তব্যে : ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু মেনিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) তাঁর জেলে বসে এই ভাবনা অমূলক ছিল না।

সেই সময়ে প্রকৃত অর্থে পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশে সেক্যুলার রাজনীতি বা মতবাদের কোনো অবকাশই ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে প্রায় দুই কোটি লোক ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশে দেশান্তরিত হয়েছিল। প্রায় আট লাখ লোক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়। সাধারণ জনগণ তখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছিল কেবল ধর্মের কারণে। কিন্তু এই রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশের মধ্যেই, যেখানে মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ও প্রশাসন, তার মধ্যেই কয়েকজন ব্যক্তি সমবেত হচ্ছেন একটি রাজনৈতিক দলে, পাকিস্তানের মানুষের কল্যাণ ও জীবনের সবক্ষেত্রে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা – এই মুখ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে। ১৯৪৯-৫২ এই তিন বছরে আওয়ামী লীগকে অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনও মুখ্যত পরিচালিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছাত্রসমাজ কর্তৃক। (১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম থেকে মুসলিম শব্দটি যখন অপসৃত হয়; তখন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু)।

১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যু ও ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি ধীরে ধীরে সামরিক ও বেসামরিক আমলানির্ভর হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের রাজনীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক। মুসলিম লীগ সবসময় ধর্মকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভার যে-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ। অবশ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি যোগ দিয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলে। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুলভাবে জয়ী হলো। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুক্তফ্রন্টের দাবি ছিল, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক যে-বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছিল, যেভাবে পূর্ব বাংলার ওপর অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রাখা হচ্ছিল, তা থেকে মুক্তি। পাকিস্তানি শাসকবর্গ অর্থাৎ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কোনোভাবে চায়নি পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত থাকুক, পূর্ব বাংলা কোনো ধরনের স্বায়ত্তশাসন পাক। এই কারণে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার তিন মাসও স্থায়িত্ব পায়নি। ‘৯২-ক’ ধারা প্রয়োগ করে এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন প্রচণ্ডভাবে ভাঙাগড়া চলছিল। এই ভাঙাগড়ার রাজনীতি চলে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পরে গভর্নর জেনারেল হন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর খাজা নাজিমউদ্দীন হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। গোলাম মোহাম্মদ হন গভর্নর জেনারেল। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দীনকে সরিয়ে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে, যিনি আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী করেন। আরো পরে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর জায়গায় প্রধানমন্ত্রী হন আরেক আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তান গণপরিষদ দীর্ঘ নয় বছর সময় নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করতে। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ এই সংবিধান চালু করে ২৩ মার্চকে পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থ হয়ে ছুটিতে চলে যাওয়ায় তাঁর জায়গায় গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন ইস্কান্দার মির্জা।

পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হওয়ার পরে ১৯৫৯ সালের প্রথমার্ধে পাকিস্তানে সংবিধানভিত্তিক নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার অর্থাৎ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শঙ্কিত ছিল পাকিস্তানে সংবিধানভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের কর্তৃত্ব বহুলাংশে শিথিল হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ঔপনিবেশিক-অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রেখে তারা যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে তুলছে, তা দুরূহ হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার এ-ও আশঙ্কা ছিল, সংবিধানের প্রয়োগ শুরু হলে সংবিধানভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য খর্ব হবে। এই কারণে তিনি ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। অবশ্য কুড়ি দিন পরে ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট হলেন। সংবিধান বাতিল করা হলো। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বিলুপ্ত হলো। দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি হলো। রাজনীতিবিদরা প্রায় সকলেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে সামরিক শাসন জারি করার অব্যবহিত পরেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের সব নেতার মধ্যে পাকিস্তানের শাসকবর্গ তাঁকেই সবচেয়ে বেশি ভয় করত। কারণ তিনিই ছিলেন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ, সভাপতি বারবার বিভিন্ন জন হওয়া সত্ত্বেও। মনে রাখা দরকার ’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেছিলেন।

সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে আরো নগ্নভাবে শোষণ করার সুযোগ পায়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানকে নিয়ে এক ইউনিট বা পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ ও পূর্ব পাকিস্তানকে আরেক ইউনিট বা প্রদেশ গণ্য করে দুই ইউনিট বা দুই প্রদেশবিশিষ্ট পাকিস্তান ফেডারেল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। সংবিধানে দুই ইউনিটকে সাম্য প্রদান করা হয়। সব প্রদেশ মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিট করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আপত্তি ছিল। তবু তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে। পঞ্চাশের দশকের শেষেই বাঙালি অনুভব করেছিল, পূর্ব পাকিস্তান কী নির্মমভাবে শোষিত হচ্ছে; অর্থনীতির প্রায় সবক্ষেত্রেই শোষিত। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী ছিল পশ্চিম পাকিস্তান (প্রথমে করাচি, পরে রাওয়ালপিন্ডি এবং আরো পরে ইসলামাবাদ), সেহেতু কেন্দ্রের সব ব্যয় সেখানেই হতো এবং এই ব্যয় ছিল বিশাল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের বিরাট অংশ, প্রায় অর্ধেকই নির্ধারিত থাকত সামরিক খাতে বা প্রতিরক্ষা খাতে। প্রতিরক্ষা ব্যয় ১৯৬৭-৬৮ সালে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ, এই ব্যয় কোনো আর্থিক বছরই ৫০ শতাংশের নিচে নামেনি। ১৯৬৮-৬৯ সালে তা ছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ২৪৫ কোটি টাকা। এখনকার হিসাবে এটি ছোট মনে হলেও এই ব্যয় ছিল বিরাট। একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে এই ব্যয় কী বিশাল ছিল! সে-সময় প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ১০০ টাকার সামান্য বেশি, বর্তমানে তা প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি ১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি থেকে কম থাকলেও ’৬৭-৬৮-এ তা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যায়, মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। ১৯৪৯-৫০-এ পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি ছিল ১২৩৭.৪ কোটি টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১২০৯.১ কোটি টাকা; ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ও পশ্চিম পাকিস্তানে তা হয় যথাক্রমে ২২৭১.৩ ও ৩১৫৬.৩ কোটি টাকা। ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৫৪-৫৫ অর্থাৎ পাকিস্তানের উন্নয়ন ব্যয়ের প্রথম পাঁচ বছরে মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয় ৮০ শতাংশ। ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৯-৭০ এই পাঁচ বছরে উন্নয়ন ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছুটা বাড়লেও তা ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৬৪ শতাংশ। জন্মের পর থেকে পাকিস্তানের আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট ও পাটজাত সামগ্রী। সে-সময় পূর্ব পাকিস্তানে বিশাল বিশাল পাটকল স্থাপন করা হয়েছিল, যেমন আদমজী, বাওয়ানী, আমিন ও আরো বহু পাটকল। আদমজী পাটকলকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল নগরীই গড়ে উঠেছিল। পাট বিক্রির অর্থ দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানে বড় আকারের শিল্পায়ন সম্পন্ন হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পরিণত করা হয় সেসব শিল্পসামগ্রী বিক্রির বাজারে। ফলে প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য ঘাটতি থাকত বিরাট। এই বাণিজ্য ঘাটতি মেটানো হতো পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যে বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হতো তা দিয়ে। বিশ্বের সঙ্গে প্রায় প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্য ঘাটতি হতো বড় অঙ্কের। এই বাণিজ্য ঘাটতির উৎসে ছিল বিশ্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়নের জন্য ক্যাপিটাল গুডস বা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রসামগ্রী বা কাঁচামাল আমদানি।

পাকিস্তানের অর্থনীতিকে যে বাইশ পরিবার নিয়ন্ত্রণ করত তাঁদের একজন ব্যতিরেকে সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। তাঁরা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান, উভয় প্রদেশের বিভিন্ন শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মালিক। এই মালিকানা তাঁরা অর্জন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি মুখ্যত পাটচাষিদের শোষণ করেই। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে এই শোষণ ছিল কী নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ষাটের দশকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৪.৭৫ টাকা, খোলাবাজারে যা বিক্রি হতো আট টাকায়। অর্থাৎ বিদেশে পাট বা পাটজাত পণ্য বিক্রি করে যে-ডলার আয় হতো তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পাটচাষি ডলারের হিসাবে পেত ৪.৭৫ টাকা। কিন্তু যাঁরা অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এই বিক্রয়কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা এর প্রকৃত মূল্য বাজার থেকে পেতেন ৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলারে তাঁদের লাভ হতো ৩.২৫ টাকা, যা ছিল পাটচাষিরই ন্যায্য পাওনা। নির্মম এই শোষণের মাধ্যমে এক দশকের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান কৃষি, শিল্প ও সেবা – এই তিন খাতেই বিরাট অগ্রগতি অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান অনায়াসেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারত যদি এই ধরনের শোষণের শিকার না হতো; যদি তার উদ্বৃত্তের যথাযথ বিনিয়োগ হতো তারই শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে। ’৭১-উত্তর পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মাহবুবুল হক স্বীকার করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি অর্থনীতিকে অনায়াসেই উন্নত করা যেত এমনকি সমৃদ্ধ করা যেত যদি এই খাতটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো। ১৯৫০-এর দশকের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি এমনভাবে পিছিয়ে পড়ে যে এখানে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই খাদ্যাভাবের বিরুদ্ধে ১৯৫৫, ১৯৫৬ সালে ভুখা মিছিলও হয়েছিল। বাংলার সর্বহারা ও বঞ্চিত মানুষের অধিকারের বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করার জন্য ১৯৬০-এর দশকে আওয়ামী লীগের অসংখ্য কর্মী বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাভোগ করেছেন। এঁদের সবার অগ্রভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের প্রায় ১২ বছরই কারান্তরালে কাটিয়েছেন।

তিন

আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১ মার্চ নিজেই একটি সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে প্রদান করেন; সংবিধান দেওয়ার পরে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের কার্যকলাপ শুরু করার অনুমতি পায়। ’৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্ণধার হয়েছিলেন। ’৬২-র ৬ জুন বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগকে আবার উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। সামরিক শাসনের আঘাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনেকেই নিজেদের রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এঁদের আবার আওয়ামী লীগে সংঘবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধুকে নিরলসভাবে কাজ করতে হয়েছে। ১৯৬৪ সালের ২ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা আহ্বান করেন, এই কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার হোটেল ইডেনে। এই সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয় বঙ্গবন্ধুর ওপর। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে মাওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের পক্ষ নিয়ে ১৯৬৩ সালে চীন সফর থেকে ফিরে এসে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে’ আইয়ুব খানকেই সমর্থন করতে হবে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে ভাসানীর প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। প্রায় সব বড় নেতা ও দল যখন এভাবে সামরিক শাসকের সামনে ভগ্নহাঁটু, তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই ধীরে ধীরে প্রকৃত প্রধান বিরোধীদলের রূপ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করলেন, সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতাই বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন, যেমন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ।

চার

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায় লাহোর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। পাকিস্তানের এই বিপর্যয়ের জন্য আইয়ুব খানকেই দায়ী করা হয়েছিল।যুদ্ধবিরতি নিয়ে তাসখন্দে যে-চুক্তি হয় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে, আইয়ুব খান-বিরোধী ব্যক্তিরা, যাঁদের মধ্যে মন্ত্রিত্ব হারানো ভুট্টোও ছিলেন, সেই চুক্তিকে ভারতের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ হিসেবেই জনগণের কাছে তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ১৯৬৫-র এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত ছিল; পূর্ব পাকিস্তানে সামান্য কয়েকটি রেজিমেন্ট ছিল, এমনকি পুরো এক ডিভিশন সৈন্যও ছিল না। ভারত ইচ্ছে করলেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে এটিও একটি ক্ষোভের কারণ হয়েছিল।পাকিস্তানের বিরোধীদলগুলো লাহোরে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। এই বৈঠকেই তিনি বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা উপস্থাপন করেন। ৬ দফা গোলটেবিলে উপস্থিত দলসমূহকে হতবিহ্বল করে ফেলে, কারণ এটা ছিল তাদের আলোচ্য এজেন্ডার বাইরে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের রাজনীতির এক যুগসন্ধিক্ষণে যথার্থ সময়ে এই ৬ দফা উপস্থাপন করেছিলেন। ৬ দফা ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা। এই ৬ দফায় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য কেবল রাখা হয়েছিল পররাষ্ট্রনীতি, স্বরাষ্ট্র, দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। প্রতিরক্ষাও সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের ছিল না। প্রদেশের সুরক্ষার জন্য আলাদা মিলিশিয়া গঠনের প্রস্তাবও ছিল ৬ দফায়। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত সম্পদ যেন পশ্চিম পাকিস্তান আর নিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য দুটি আলাদা মুদ্রা অথবা দুটি আলাদা ব্যাংক হিসাবের দাবিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও প্রদেশকে স্বাধীন অধিকার দেওয়া হয়। বস্তুত এই ৬ দফার মধ্যে দুটি রাষ্ট্রের অবয়ব পরিস্ফুট হয়েছিল, সেজন্য এই ৬ দফা পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরে পূর্ব বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ প্রমুখ নেতা তাঁকে সমর্থন জানাননি। বঙ্গবন্ধু তাঁদের সমর্থন না পেলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সারাদেশে ৬ দফা প্রচার শুরু করেন। সর্বপ্রথম তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বিশাল জনতার সামনে ৬ দফা উপস্থাপন করেন। তাঁর পাশে ছিলেন এম এ আজিজ ও জহুর আহমেদ চৌধুরী। আরো ছিল তরুণ ছাত্রনেতা মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। আইয়ুব খান এই ৬ দফার বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু যদি ‘যুক্তির ভাষা’ না বোঝেন, অর্থাৎ ৬ দফা প্রত্যাহার না করেন তাহলে তাঁকে ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধুকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় ও পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে চিরতরে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যে ৬ দফা দিয়েছিলেন, তা সারাদেশকে এক নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনায়, মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও উদ্দীপ্ত করে। ১৯৬৭ সালের ৭ জুন ৬ দফার দাবিতে দেশজুড়ে হরতাল পালন করা হয়েছিল, হরতাল পালন করার সময় অনেকেই শহিদ হন। শহিদদের রক্তপাত যেমন ভাষা-আন্দোলনকে এক গভীর আদর্শবোধে উজ্জীবিত করেছিল, তেমনি ৭ই জুনের আন্দোলনও বাঙালিকে আদর্শের জন্য অপরিসীম আত্মত্যাগের প্রেরণা দেয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে কথিত আসামিদের নিপীড়নের যে চিত্র পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে এবং সেই মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর অপচেষ্টা উন্মোচিত হলে বাংলাদেশের জনগণকে তা প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ’৬৯-এর প্রারম্ভে এক প্রচণ্ড বাঁধভাঙা গণআন্দোলনের সূচনা করে বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে।

গণআন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। ইয়াহিয়া খান নতুন মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সত্তরের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের অনেক দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। উগ্র বামপন্থি কয়েকটি দল ৬ দফাকে গ্রহণ করেনি। তারা বলেছিল, এই ৬ দফা সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট। তাদের বক্তব্য ছিল, ৬ দফা দেশীয় বুর্জোয়ার স্বার্থে তৈরি। এরা এতটাই অন্ধ ছিল যে, তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল ৬ দফার মধ্যেই বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিহিত। তাদের স্লোগান ছিল, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। ভাতের দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালেই ভুখা মিছিল করেছিল, এটা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। তখন থেকেই অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান আর খাদ্যে স্বয়ম্ভর ছিল না, প্রতিবছর ১০-২০ লাখ টন, কোনো কোনো বছর আরো বেশি খাদ্য আমদানি করতে হতো। তারা কার্ল মার্কসের এই বক্তব্যও বিস্মৃত হয়েছিল যে, এক্সটারনাল কোয়ার্শান (external coercion) বা বৈদেশিক শোষণ বা নিপীড়ন দূরীভূত করা হলো অভ্যন্তরীণ শ্রেণিসংগ্রাম সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত; অর্থাৎ প্রথমে অপসারণ করতে হবে ঔপনিবেশিক শোষণ। ১৯৭০-এর নির্বাচন অনেকগুলো দল বর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে কল্পনাতীত জনসমর্থন পেয়ে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদের সর্ববৃহৎ দলে পরিণত হয়। ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ভেবেছিল, পূর্ব পাকিস্তানে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তাদের এই হিসাবে বিরাট ভুল ছিল।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নবনির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ দল পিপিপির নেতা ভুট্টোর প্ররোচনায় ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ রেডিওর মাধ্যমে প্রদত্ত এক ভাষণে এই অধিবেশন স্থগিত করে দিলে বাংলাদেশ প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হরতাল ও অসহযোগ ঘোষণা করেন। বস্তুত সেই দিন অর্থাৎ ১ মার্চ থেকে বাংলাদেশের প্রকৃত শাসনভার তাঁর হাতেই চলে যায়। বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির জন্য অধীর হয়ে ওঠে। ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লক্ষাধিক জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব ইতিহাসে স্বাধীনতার যে-শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার শেষ বাক্যটি ছিল : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণটির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাই করেছিলেন, প্রত্যেক বাঙালিকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে ভাষণটি প্রদান করা হয়েছিল, যাতে এই ভাষণটিকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদের ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করা না যায়। এই ভাষণটি ছিল এক মহাকাব্যিক ভাষণ। কারণ এটি ছিল এক ‘মহাজাতি’ সৃজনের ভাষণ।

ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় এসেছিলেন (মার্চ ১৫ ও ২১-এ) বাঙালির স্বাধীনতার সনদ ৬ দফা দাবি থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে আনতে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ২৫ মার্চ রাত্রে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করলেন।

বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ভোররাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ২৬ মার্চ বিকেলে ইয়াহিয়া রেডিও মারফত বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে বললেন, ‘এবার শেখ মুজিব শাস্তি পাবে’, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে তাঁকে। আওয়ামী লীগ কেবল নিষিদ্ধই হলো না, দেশদ্রোহী দল হিসেবেও ঘোষিত হলো।

প্রায় নয় মাস যুদ্ধশেষে ৩০ লাখ প্রাণ, অসংখ্য মাতা-ভগ্নি-কন্যা ও জায়ার সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করে যে-দেশটি পেলেন, তা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নিঃস্ব। তিনি এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে প্রাণসঞ্চারের দায়িত্ব নিলেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি উদ্বাস্তু ও দেশের মধ্যে প্রায় দুই কোটি বাস্তুহারা মানুষকে পুনর্বাসিত করলেন। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যে ‘পোড়ামাটি’ নীতি অনুসরণ করেছিল, তার ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এক কোটি লোক অনাহারে মারা যাবে, এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল বিদেশের অনেক পত্র-পত্রিকা। বঙ্গবন্ধু একজন লোককেও অনাহারে মরতে দেননি। হাজার হাজার ভাঙা কালভার্ট ও সেতু পুনর্নির্মাণ করা হয় এক বছরের মধ্যে। বিধ্বস্ত ভৈরব সেতুকে পুনঃবিনির্মাণ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন রেলযোগাযোগ চালু করা হয়।

পাকিস্তান তার প্রথম সংবিধান রচনা করতে নয় বছর সময় নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই এক অসাধারণ সংবিধান রচনা করে বাঙালি জনগণকে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী করেছিলেন, যে-অধিকার বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে এর আগে কোনোদিন পায়নি। বঙ্গবন্ধু দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়ার প্রয়াসে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এই পরিকল্পনায় কৃষি ও শিক্ষাকে অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্নির্মাণ করে যখন সমৃদ্ধির আলোর রেখাটি দেখানো শুরু করেছিলেন, যখন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে, শিল্পে অগ্রগতি ৮ শতাংশের ওপরে, যা পরবর্তী আট বছরেও পাওয়া সম্ভব হয়নি, ঠিক সেই সময়ে, ১৯৭৫ সালে তিনি স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহী অপশক্তির হাতে সপরিবারে নিহত হলেন। এরপরের দুই দশকের ইতিহাস অন্ধকারের ইতিহাস, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালির পরাজিত হওয়ার ইতিহাস, সামরিক শাসনের জালে আবার নতুন করে বন্দি হওয়ার ইতিহাস, রাত্রিতে কারফিউর ইতিহাস। ১৬ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ আবার নতুনভাবে বাঙালির নবজাগরণের রথের সারথি হয়ে দেখা দিলো। যথার্থ গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চলল ১৯৯৬ পর্যন্ত। সংগ্রামের এই নতুন যাত্রায়, নব-অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের ওপর, তার নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর বারবার আঘাত এসেছে। ’৮৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় যোগ দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। ওই হত্যাযজ্ঞে ২৪ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। ২০০৪ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন না, বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ২১ আগস্ট আবার তাঁর ওপর ঘৃণ্য কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলা হলো। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যূহ রচনা করে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন। এই হত্যাকাণ্ডেও ২২ জন প্রাণ হারায়, প্রায় ৪০০ জন আহত হয়। আওয়ামী লীগের ৭০ বছরের ইতিহাসে কতবার যে তার ওপর আঘাত এসেছে তা বর্ণনাতীত।

পাঁচ

১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন আবার ক্ষমতায় এলো, তখন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার যে-প্রচেষ্টা শুরু করে, তার ফলে আজ বাংলাদেশ বিশ্বমানসে উন্নয়নের এক অসাধারণ মডেল।

আওয়ামী লীগের আমলেই ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-২০০১ সালে প্রায় দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর পরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে; এই দুই বছর কোনো খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়নি। এই খাদ্য স্বয়সম্ভরতা পরবর্তী পাঁচ বছরের জোট শাসনামলে স্থায়ী হয়নি। জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বিবেচনায় খাদ্য স্বয়ম্ভরতার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। কারণ সেই সময়েও চলমান আমেরিকার পি.এল.৪৮০ অনুদানে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাওয়া যেত, কেবলমাত্র পরিবহন খরচের বিনিময়ে। বাংলাদেশকে তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য আবার এক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে, যখন আওয়ামী লীগ দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে ২০০৯ সালে। গত এক দশকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে-অর্জন, তা এককথায় অনন্য, অসাধারণ। আজ বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন প্রায় চার কোটি টনের কাছাকাছি, যা ১৯৭১ সালে ছিল মাত্র এক কোটি টন। আজ চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। জাতিসংঘের হিসাবমতে, মাছ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ গত সাত-আট বছরে চতুর্থ স্থানে পৌঁছেছে। দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশ পৃথিবীর ছয়টি দেশের মধ্যে একটি। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই, তার স্থান ৩৪তম। গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রান্তে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৬ শতাংশে উন্নীত হয়। যেভাবে বাংলাদেশ এগোচ্ছে, তাতে এই দশক শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে পৌঁছুবে। এক দশকের কিছু আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার যা ছিল, তা থেকে অর্ধেকেরও বেশি নেমে এসে বর্তমানে তা ২১ শতাংশের সামান্য বেশি। মাথাপিছু আয় এক দশক আগে ছিল মাত্র ৬৫০ ডলার, তা বর্তমানে বেড়ে ১৯০০ ডলারের বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের এ-বছরের বাজেট অনুযায়ী ৭৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসবে বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবার। প্রতিবছর ক্যান্সার, হার্ট ও কিডনি রোগাক্রান্ত ৩০ হাজার দরিদ্র মানুষকে মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করা হবে।

আজকে বাংলাদেশে নারী শিক্ষা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে পাশ করা নারী

শিক্ষার্থীর হার ৫১ শতাংশের ওপরে, যদিও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষার্থী থেকে তা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। গণশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের যে-উদ্যোগ তা অনন্য, তুলনাহীন। প্রতিবছর চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ইংরেজি বছরের প্রথমেই বিনামূল্যে ৩৬ কোটি পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। বিশ্ব ইতিহাসে এর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামই ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। ৯০ শতাংশ গ্রামেই বিদ্যুৎ ছিল না। মাত্র এক দশক আগেও মাত্র ৪২ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল। বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবমতে তা বেড়ে ৯৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ২০৩১-এর আগেই উন্নতির মহাসোপানে পৌঁছাবে। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে বিশাল সব প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যেমন, পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ রেললাইন, ঢাকা মেট্রো রেল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি। এইসব ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প যখন সমাপ্ত হবে, পূর্ণতা পাবে, তখন বাংলাদেশ একটি প্রকৃত উন্নত রাষ্ট্রের অবয়ব লাভ করবে, যেমন, বর্তমানে চীন। এছাড়া ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি করা হচ্ছে শিল্পায়নকে বহুমুখী করে কোটির বেশি কর্ম সৃষ্টির জন্য। ২০১৯-এর ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সূচনা হয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও এই বছরে (২০১৯) ২৩ জুন তার অস্তিত্বের ৭০ বছর অতিক্রম করেছে; এই বছর তাই অসীম গৌরবের, বাংলাদেশের জন্য অসীম প্রাপ্তির। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে তার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক স্বাধীন; রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎসও সে। এই রাজনৈতিক অধিকার অর্থহীন হবে যদি অর্থনৈতিক মুক্তি সে না পায়। প্রতিটি বাঙালিকে অর্থনৈতিক অধিকারে ঋদ্ধ করার সংগ্রামে লিপ্ত তাঁর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। যদি কোনো প্রতিক্রিয়া তাঁর অগ্রযাত্রার পথকে তমসাবৃত না করে, তাঁর জয় অবশ্যম্ভাবী। আগামী দুই দশকের মধ্যেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা অর্জন করব।