শেখ মুজিব : রাজনীতিক ও ব্যক্তিমানুষ

যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্কের কথা জেনেই করেন। এই ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বও গড়ে ওঠে এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই। সুতরাং একদিন রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে থাকতে হবে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনদের সঙ্গে দ্বন্দ্বময় থাকতে হবে – এমন একটা প্রণোদনা থাকার কথা যে-কিশোরটি রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হবে তার অন্তরে। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার বাসনা থেকেই কারো মনে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে থাকার ইচ্ছার উন্মেষ ঘটতে পারে। এই ইচ্ছাটাই একজন মানুষের রাজনীতিকের সত্তা।

একজন রাজনীতিক সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে ওপরে উত্থাপিত কথাগুলো উল্লেখ করার অবকাশ সাধারণ অর্থে না থাকলেও বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মনে করে নেওয়া জরুরি। কারণ ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় ব্যক্তিবিশেষের বা স্বল্পসংখ্যকের লাভালাভের প্রাসঙ্গিকতাকে এখনকার তরুণ রাজনীতিকদের জীবনাচরণে যতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায়, তাতে এই অতি প্রাথমিক কথাটিও স্মরণ করে নেওয়া জরুরি বলে মনে হয়। শেখ মুজিব সম্পর্কে আলোচনাসূত্রে তাই এ-প্রসঙ্গটি আগে উত্থাপন প্রয়োজনীয় বলে অনুভূত।

শেখ মুজিবের জীবন গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে যে-কেউ হয়তো অনুভব করবেন যে, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে মানবদরদি বা মানবিক না হলে তাঁর মতো যথার্থ রাজনীতিক হওয়া যায় না। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বা কারাগারের রোজনামচাসহ অন্য যে-কটি রচনা তিনি লিখেছেন, তাতে তিনি কতটা মানবিক সত্তায় পূর্ণ একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন তা বোঝা যায়। বোঝা যায় মানুষের দুঃখে তাঁর অন্তর কতটা পীড়িত হয়ে উঠত! অনুভব করা যায় রাজনীতি করলে একসঙ্গে অনেক মানুষের উপকার হবে বলেই তিনি রাজনীতি করতেন।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লিখিত পাকিস্তান হওয়ার পরে তাঁর জীবনের একটা ঘটনা থেকে আমরা তাঁর এই মনোভাব বুঝতে পারি।

ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার সাধারণ কৃষকের একটা সংকট তাঁকে কী রকম ব্যথিত করেছিল সে-কথা তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন। সাধারণ মানুষের মনোভঙ্গি তিনি কতটা বুঝতেন, বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকে সে-সম্পর্কে তিনি কতটা জানতেন তার পরিচয় পাওয়া যায় ওই বইয়ে তাঁর ওই উল্লেখ থেকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি জানাচ্ছেন, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলায় পাকিস্তান সরকার তাদের আমল শুরু হওয়ার প্রথমদিকে কর্ডন প্রথা চালু করে। এর ফলে এক অঞ্চলের কৃষকের ধান অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় দুর্ভোগ! প্রথাটি সম্পর্কে তিনি জানাচ্ছেন, বহু বছর ধরে ধান কাটার মওসুমে ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক খুলনা ও বরিশালে যেত গৃহস্থ কৃষকদের ধান কেটে দিতে। যারা ধান কেটে দিত তাদের বলা হতো ‘দাওয়াল’। ওই সময় বিশাল এলাকা জুড়ে ধান প্রায় একই সময় পেকে উঠত। একত্রে এতগুলো ধান কাটার জন্য মানুষ পাওয়া যেত না সেই অঞ্চলে। তাই দাওয়ালরা গিয়ে সেই ধান কেটে দিত। ধান কাটার বিনিময়ে তারা ধান নিয়ে আসত নিজেদের এলাকায়। দাওয়ালদের অনেকেরই নিজের নৌকা ছিল না। তারা অন্যের নৌকা ধার করে নিয়ে আসত। বিনিময়ে তাদেরও কিছু ধান দিতে হতো। দুই মাসের মতো সময় ধরে তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ধান কাটতে যেত। ওই সময় মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত দাওয়ালরা। পরে ধান কেটে উপার্জন করা ধান দিয়ে শোধ করত নিজেদের ঋণ। ওই অঞ্চলের কৃষকরা কেটে আনা এই ধানের ওপরই প্রধানত নির্ভরশীল ছিল।

কর্ডন প্রথা চালু হওয়ার পর ধান কাটার মওসুম এসে গেলে দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে গেল, তখন প্রথমে তাদের কেউ বাধা দিলো না। কারণ অনেক মানুষ না পেলে একসঙ্গে এত ধান তারা কাটবে কী করে! কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কাটা ধান নিয়ে দাওয়ালদের ফিরে আসার সময়। কর্ডন প্রথার কারণে এক জেলার ধান অন্য জেলায় নেওয়ার আইনগত অধিকার হারায় দাওয়ালরা। তাদের ধান রেখে দিয়ে খালি নৌকা নিয়ে ফিরে যেতে বলা হয়। দাওয়ালরা পড়ে দুর্দশায়। শেখ মুজিব দাওয়ালদের দুর্দশার কথা শুনে ব্যথিত হলেন। তাদের বেদনা তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই সরকারি আইনের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়লেন।

যত ছোটই হোক পাকিস্তান আন্দোলনের সে-সময়ের একজন নেতা ছিলেন তিনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, রাজনৈতিক তৎপরতায় তাঁরও প্রবল অংশগ্রহণ ও সমর্থন ছিল। কিন্তু সেই দলের প্রতিষ্ঠিত সরকার যখন এমন একটা পদক্ষেপ নিল যা বিপুলসংখ্যক মানুষের সংকটের উৎস হয়ে উঠেছে, তখন দলের সিদ্ধান্ত বলে তাঁর পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হয়নি। তখন তিনি তাঁর ভূমিকা রাখতে গেলেন। তিনি মাথা ঘামালেন সংকটের কারণ ও বাস্তবতা নিয়ে। অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গেই তাঁকে সম্পর্কিত হয়ে উঠতে হয়েছিল সে-সময়। দাওয়াল সমস্যা সমাধানে তাঁর তখনকার অংশগ্রহণ একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। এতটা প্রান্তিক সাধারণ মানুষের জন্য সমব্যথিতা ও আন্তরিক দরদ সে-সময়কার খুব কম রাজনীতিকের মধ্যেই পাওয়া গেছে। এটা তাঁর অন্তরের মানবিক বোধেরই প্ররোচনা!

কে কোন ধর্মের তা দিয়ে মুজিব মানুষকে বিচার করতেন না। মানুষকে দেখতেন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা-নীতির সংযোজন যে কোনো আকস্মিক ব্যাপার ছিল না, তার পরিচয় অসমাপ্ত আত্মজীবনীর আরো একটা অংশের লেখা থেকে পাওয়া যায়। তাঁর ওই আত্মজীবনীতে চন্দ্র ঘোষ নামে একজন সমাজকর্মীর কথা লিখেছেন মুজিব। তিনি লিখেছেন, মানুষটি ‘মহাত্মা গান্ধীর মত একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হত না। জুতা পরতেন না, খড়ম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারী কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্য সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তাঁর শাস্তি হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে সেই কর্মচারীকে বলেছিলেন, চন্দ্র ঘোষের মত মানুষকে গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে।’

সেই চন্দ্র ঘোষ জেলেই অসুস্থ হয়ে যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তখন চাইলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁর দেহে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত হয়। অপারেশন করতে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি বললেন, ‘আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’

শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর দেখা করার ব্যবস্থা হলো জেলগেটে। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে শেখ মুজিবকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই এরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনো দিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে পার্থক্য ভগবানও করেন নাই! আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।’

শেখ মুজিব প্রসঙ্গটি শেষ করেন এভাবে, ‘এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে, সুপারিনটেন্ডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’

কেউ কেউ বলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতিটি ভারতীয় সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিটি সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন।

কী উদ্দেশ্যে তিনি রাজনীতি করেন তা নিয়ে তাঁর ভাবনা কতটা স্বচ্ছ ছিল তার আরেকটা পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকেই। তিনি লিখছেন, ‘… খুলনার মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সিভিল সার্জন। তিনি জেল পরিদর্শন করতে এসে আমার কথা শুনে আমাকে অফিসে নিয়ে যেতে বললেন। আমি যেয়ে দেখি তিনি বসে আছেন। আমাকে বসতে বললেন তাঁর কাছে। আমি বসবার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কেন জেল খাটছেন?’ আমিও উত্তর দিলাম, ‘ক্ষমতা দখল করার জন্য।’ তিনি অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘ক্ষমতা দখল করে কী করবেন?’ বললাম, ‘যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না যেয়ে কি কিছু করা যায়?’ অর্থাৎ একজন রাজনীতিক কেন রাজনীতি করেন তা নিয়ে তাঁর ধারণা কতটা স্বচ্ছ ছিল তার দৃষ্টান্ত আমরা আত্মজীবনীর এই উল্লেখ থেকেও পাই। এই ধারণার মূলেও তাঁর মানবিক বোধই প্রধান। শেখ মুজিব যে মানবিকতাপূর্ণ অন্তরের অধিকারী মানুষ হিসেবে নিজে রাজনীতি করতেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতোই মৃত্যুর পর তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীকে মূল্যায়নের সময়। সোহরাওয়ার্দী-সম্পর্কিত আলোচনায় সোহরাওয়ার্দীর মানবিক গুণাবলিকে বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালের মার্চে দৈনিক ইত্তেফাকের সোহরাওয়ার্দী সংখ্যায় এবং ১৯৬৫ সালের সোহরাওয়ার্দী সংখ্যায় ‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ ও ‘শহীদ চরিত্রের অজানা দিক’ রচনায় এবং ‘স্মৃতির মিছিল : হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’ শীর্ষক তাঁর সাক্ষাৎকারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তাঁর মানবিক গুণাবলিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে রোগশয্যা থেকে বলেছিলেন, ‘বেঁচে আর কি করব, দেশের কাজে যদি না লাগলাম।’ সোহরাওয়ার্দীকে স্মরণ করতে গিয়ে তাঁর অন্তরে যে এই মানবিক দিক স্পর্শ করেছিল সে-পরিচয় উঠে এসেছে। রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিত্বে যদি মানবিকতার দিক প্রধান না হয়ে ওঠে তাহলে তাকে রাজনীতিবিদ বলা যায় না – এই মর্মকথাই শেখ মুজিবের রচনাবলিরও মূলে ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ রাজনীতি কেবল নিজেদের অর্থবিত্ত ও প্রভাব অর্জনের জন্য নয়, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মূলে থাকতে হবে মানবিক মানুষ হিসেবে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকার প্রণোদনা। নিজের জীবন ও অন্য রাজনীতিকের জীবন থেকে পাওয়া শেখ মুজিবের এই উপলব্ধিই হতে পারে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর লগ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।