বত্রিশ নম্বর

বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস খুঁজতে গেলে
যেতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরবগাঁথা দেখতে হলে
যেতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্য-ইতিহাস জানতে হলে
পাতা উল্টে দেখতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাংলাদেশ ও বাঙালির কলংকচিহ্ন দেখতেও
যেতে হবে সেই বত্রিশ নম্বর
বাংলাদেশ ও বাঙালির কলংকচিহ্ন দেখতেও
যেতে হবে সেই বত্রিশ নম্বর;

বত্রিশ বলতে আর একটি সড়ক মাত্র নয়, নয় খালি একটি প্রতীকী সংখ্যা
শুধুমাত্র একটি সংখ্যাবাচকেই সীমাবদ্ধ নয় এ-বাড়ি
যার মাঝে আম জাম শিউলি বকুলঘেরা
দ্বীপের মতন একটি ভবন যেন এক অনিন্দ্য ভুবন
সাধারণ মানুষের কাছে শেখ সাহেবের বাড়ি নামের উজ্জ্বল বাতিঘর
বরং স্বাধীনতা সৌধের যথাশব্দও বলা যেতে পারে;

এ বাড়িটির প্রতিটি ইটে গাঁথা রয়েছে
বাঙালি জাতির গৌরব গাঁথা, শৌর্যের কথা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও অর্জনের কথা
বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশের রক্তসিন্ধু অভ্যুদয়ের কথা।

বত্রিশ নম্বর ঘিরে দীর্ঘকায় ঋজু উন্নতশির মানুষটির
কম্বুকণ্ঠী নিনাদে প্রকম্পিত আসমুদ্রহিমাচল –
এরিনমোর তামাকের গন্ধে ম ম
বত্রিশ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটির আনাচ-কানাচ
প্রতিটি দেয়াল প্রকোষ্ঠ গাড়িবারান্দা করিডোর বেয়ে
স্বাধীনতাকামী সহযোদ্ধাদের কত না দৃপ্ত পদচারণা
কত না মন্ত্রণা জল্পনা কল্পনা, আরে এই যে তাজউদ্দীন,
এই তো মনসুর, এসো এদিকে, হেনা কই
এমনি কত না কথোপকথন, কত না ছোটখাটো সুখ-দুঃখ
আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন,
কান পাতলে আজো যেন শোনা যায় বত্রিশ নম্বরের সেই চেনা বাড়িটির অলিন্দে দাঁড়ানো
বীর বাঙালি কর্ণধারের ৭ই মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণ

  • প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক, স্বাধীনতার ঘোষণা;
    এ বাড়িটির প্রতিটি দরজা দেয়াল সিঁড়ি গাছপালা
    শুধু কালের নীরব সাক্ষীই নয়, দেখেছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ
    ‘নিদ্রা হতে প্রার্থনা উত্তম’এই ডাক ভাসছে তখন ভোরের আকাশ জুড়ে
    এই শব্দপুঞ্জের সমান্তরালে কী পৈশাচিক বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতাই না ঘটে গেল
    ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়, অথচ সেই অমোঘ শপথবাক্য তো আগেই বলে দিয়েছিলেন :
    ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো
    এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ’।

চারপাশের রোরুদ্যমান দেয়ালগুলির ঝাঁজরা পাঁজর বেয়ে
তখন ছুটে চলতে শুরু করেছে ক্ষত-চোঁয়া অবিরল রক্তের ফোয়ারা
জলজ্যান্ত গুলির বারুদগন্ধী বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চারধারে
পিতা-মাতা-ভ্রাতা-সন্তান এমনকি নববধূ ও নিষ্পাপ শিশুর
জমাট রক্তপিণ্ড যেন সবাইকে ডেকে বলতে চাইছে
মুক্ত মানুষেরা এসো দাঁড়াও ক্ষণিক দ্যাখো একবার
তোমরা সবাই তো এ দেশেরই সুসন্তান
একদিন যেমন সব পথ বত্রিশ নম্বরের দিকে
আজও তেমনি সব পথ বত্রিশ নম্বরের দিকে
উল্টোদিকে তখন দ্রুত ধাবমান রক্তধারা সিঁড়ি, করিডোর বেয়ে
সমগ্র দেশের দিকে
সমগ্র জাতির দিকে
সাগরের দিকে

  • কী হল, পোড়মুখ ঢাকছো কোন লজ্জায়
    ঐ তো ছিটকেপড়া চশমাজোড়া
    যার কাচে স্বপ্নের প্রলেপ
    যার ভেতর দিয়ে দেখেছিলেন মুক্তির স্বপ্ন, স্বাধীনতার স্বপ্ন
    শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন, খুঁজেছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা
    পাশে হতভম্ব প্রিয় ব্রায়ার পাইপ
    উল্টে আছে পায়ের চটি যুগল
    পরনের লুঙ্গি গেঞ্জি সবই রক্তস্নাত
    ঘরোয়া ভঙ্গিতে আলগোছে শুয়ে রয়েছেন যেন
    দু’চোখে অগাধ বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের বিস্ময়।
    একদিকে মানুষের ঢল অনর্গল
    তাদের চোখের টলমলে অশ্রুতে বিম্বিত
    বত্রিশ নম্বরই স্বাধীনতার পবিত্র সনদ আর অঙ্গীকারনামা।

পুনর্মুদ্রণ : দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু
সম্পাদক-আহমেদ সুবীর
শিশুসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৬