জোয়ারের জলে নতুন দৃশ্য

ক্ষেতচাষি সোহরাবের গানের নেশা বেশি। গান গাইতে গাইতে ক্ষেতের কাজ করে। কাজ না থাকলে রাবনাবাদ নদীর ধারে গিয়ে বসে গান গায়। বঙ্গোপসাগরের মোহনার সঙ্গে মিশেছে রাবনাবাদ নদী। নদীর ধারে গেলে দেখা যায় সাগরের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে যায় নদীর স্রোত। দৃশ্যটি ভীষণ আনন্দের। ধানক্ষেতের কাজ কম থাকলে ও প্রতিদিন নদীর ধারে আসে। মনের সুখে গলা ছেড়ে গান গায়। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে থাকে। কখনো চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে। গাছের ডালে পাখি দেখে কিংবা পলাশ-শিমুল ফুল দেখতে চাইলে সেসব গাছের নিচে যায়। শুয়ে পড়ে।
গ্রামের কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, কী রে, তুই এভাবে শুয়ে থাকিস কেন?

– শুয়ে শুয়ে ফুল দেখতে অন্যরকম লাগে।

– শয়তান একটা। তোর কানের ভেতর পিঁপড়া ঢুকলে মগজটা কেটে শেষ করবে।

– আমার মগজ কাটলে কাটবে, তাতে তোর কী? ধাম করে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত ধরে বলে, দেব লাত্থি দিয়ে নদীতে ফেলে।

– আমি একা পড়ব না, তোকে নিয়ে নদীতে পড়ব শয়তান।
ওর পেটে একটা ঘুসি মেরে বলে, শয়তান বলিস কেন? আমি তোর কী করেছি।
ও পেট চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলে সোহরাব ওকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। গ্রামে ফিরে আসে। বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। চৌকিতে শুয়ে চোখ বুজলে চোখ ভরে যায় পানিতে। ও দুহাতে পানি মোছে না। যতক্ষণ পানি গড়ায় ততক্ষণ গড়াতে দেয়।
চোখের সামনে মায়ের মুখ, বাবার মুখ ভেসে ওঠে। মা মারা গেছে ওর তিন বছর বয়সে। বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর বয়সে। চাচা-মামার বাড়িতে নানা হাত ঘুরে বড় হয়েছে ও। ছোটবেলা থেকেই ঘরের টান ছিল না। আদর-যত্নে মানুষ হওয়া ছেলে ও নয়। অযত্নে বড় হওয়া শিশুটি প্রকৃতির কাছে গিয়ে ছায়া খুঁজেছে। ধানক্ষেতসহ নানা ক্ষেতের আলের ওপরে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকত। দুচোখ মেলে ফড়িং, প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলত, তোরা আমার বন্ধু। তোদের আমি ধরে মেরে ফেলব না। আমার গায়ের যেখানে খুশি যেখানে এসে বসবি। নদীর ধারে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। বনে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গান গাইত। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছিল চাচা। কিন্তু স্কুলে ঠিকমতো যাতায়াত করেনি। বইখাতা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যেত কোথাও।
ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। মনে করে এমন আনন্দ আর কোথাও পাওয়া যায় না।
কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে, তুই এত ঘুরে বেড়াস কেন রে?

– দেখতে ভালো লাগে। যখন তাকাই তখন মনে হয় একটা নতুন কিছু দেখছি।

– একটা গাছ বা বাঁশঝাড় রোজ রোজ দেখলে এগুলো আবার নতুন হয় কী করে?

– এটাই তো দেখার মজা। আমি নানা রকমে দেখতে জানি। রোজই এক একটা গাছ আমার কাছে নতুন হয়ে যায়। গাছের নিচে বসলে মনে হয় বাবার আদর পাচ্ছি। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে।

– তুই তো দেখছি আজব ছেলে।

– বেশি বাড়াবাড়ি করিস না সাজু। আমি ছোট থেকে এভাবে বড় হয়েছি। এভাবে বড় হয়ে আমি বাবা-মায়ের আদর পাই। বাবার জমিতে চাষ করে ভাত খাই। ফসল কম হলে দিনমজুরি করি। গোটা গ্রাম আমার বাবা-মা।

– এইজন্য লোকে তোকে পাগল বলে।

– বলুক। আমার কিছু যায়-আসে না।

– পাগল শুনে সহ্য করতে পারিস?

– শুনেও শুনি না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই।

– তোর গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগেরে সোহরাব। অনেকেরই ভালো লাগে। সবাই তোর গানের প্রশংসা করে।

– গান গাইতে গাইতে আমি বাবা-মাকে মনে করি।

– কীভাবে মনে করিস?

– মায়ের হাসিমুখ দেখতে পাই। যেদিকে তাকাই সেখানেই মায়ের ছবি। পাশাপাশি বাবাও থাকে। কখনো বাবাকে দেখি ধানক্ষেতে। দুই বিঘা জমি রেখে গেছেন বাবা। আমি বড় হওয়া পর্যন্ত চাচারা আমার জমি চাষ করেছে। এখন আমি করি। অন্য কাউকে চাষ করতে দিই না।

– এসব আমি জানি।

– তাহলে ভাগ এখান থেকে। আমি একা থাকব।

– কী করবি?

– ওই বেড়িবাঁধের ওপর হাঁটব। একদিকে নদী দেখব আর একদিকে সবুজ মাঠঘাট।

– মানুষ দেখবি না?

– না। মানুষ দেখতে ভালো লাগে না।

– বিয়ে করবি না?

– না। এত কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? এরপর কথা বললে ঘুসি মেরে তোর মাথা ফাটিয়ে দেব।

– ওরে, বাবারে। গেলাম।
সোহরাব কিছুক্ষণ দ্রুতপায়ে ওর চলে যাওয়া দেখে। সাজু একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। একসময় রাস্তা ছেড়ে ধানক্ষেতে নেমে যায়। সোহরাব আর দাঁড়ায় না। বেড়িবাঁধের ওপরে ওঠে। বেড়িবাঁধ ওর একটি প্রিয় জায়গা। নদীর ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে হাঁটা যায় এটা যেমন একটা দিক, আবার মাঠের দিকে তাকালে দিগন্তপ্রসারিত ভূমি ওর চিন্তার জগৎ তোলপাড় করে দেয়। যেতে যেতে হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। বেড়িবাঁধের একটি বড় জায়গায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কলকলিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। ভেসে যাচ্ছে ক্ষেত-মাঠ। পানি আরো বাড়লে ঘরবাড়িতেও ঢুকবে। ও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সাগরের মোহনায় জুড়ে থাকা রাবনাবাদ নদীতে এখন প্রবল স্রোত। জোয়ারের জল তেড়ে আসছে। ঢুকে যাচ্ছে গ্রামে।
ও বাঁধ থেকে নেমে দ্রুত ছুটতে থাকে। ঘরে ঘরে গিয়ে বাঁধ ভাঙার খবর দেয়। এক বয়সী মানুষ বলে, পাগলা ছেলেটার বুদ্ধি হয়েছে। আমরাও দেখেছি বাঁধ ভেঙেছে; কিন্তু আমরা তো ঘরে ঘরে যাইনি।

– এখন আমাদের কী হবে?
– ভাঙা বাঁধ সারাতে হবে।
– কবে সারানো হবে?
– কে জানে? সরকার কী করে সেজন্য আমাদের বসে থাকতে হবে।
– ছেলেমেয়েগুলোকে ঠিকমতো রাখতে হবে। ওরা যেন পানিতে ডুবে না যায়।
– এটা তুই খেয়াল রাখবি সোহরাব। ছোটরা তো পানির মধ্যে ঝাঁপায়ে পড়তে পারে।
– আচ্ছা চাচা, আমি ওদের দেখব। জোয়ারের সময় হলে সারাদিন ঘুরব।
– বাহ্বা, তুই আমাদের সোনার ছেলে।
– আমার ধানক্ষেত পানির তলে চলে গেছে। আমার তো আর কাজ নাই। এখন যাই ঘুরে বেড়াই।

দিন গড়ায়। বাঁধ সারানোর কাজে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। প্রতিদিন জোয়ারের জল ঢুকে ভেসে যায় চাড়িপাড়া গ্রাম। বাঁধের বেশ বড় অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে গেছে। পানির তোড়ে রোজই ভাঙতে থাকে। ক্ষেতের ভেতর যে পানি ঢুকেছে সে-পানি আর সরে না। পানিতে থইথই করে। নদীর ধারের অনেক জমি ভেঙে নদীতে পড়ে যাচ্ছে। ছোট হয়ে যাচ্ছে গ্রাম। যেটুকু বাঁধ এখনো ভাঙেনি, সেখানে এসে বসে থাকে সোহরাব। যেখানে অল্প পানি জমে সেসব জায়গা দিয়ে হেঁটে বা সাঁতার কেটে ছেলেমেয়েরা আসে। বাঁধের ওপর খেলে। দৌড়ায়।
রাজু এসে বলে, মামা আমাদের গ্রামটা পানির গ্রাম হয়ে গেছে। এখন থেকে আমরা কি শুধু পানি খেয়ে বেঁচে থাকব?শুধু পানি খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?

না গেলে মরে যাব। কী আর করব? আমাদের কি সরকার বাঁচাবে না মামা?

সরকার তো এই ভাঙা বাঁধ জোড়া লাগায় না।

কবে বাঁধ জোড়া লাগাবে মামা?

আমি তো জানি না রে।

তুমি জানবে না কেন? তুমি যাও না কেন সরকারি অফিসে?

ধুর, আমার এসব ভালো লাগে না। যারা এসব কাজ করে তারা করবে। চল, তোদের নিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে আসি। তোদের তো খেলাধুলা বন্ধ।

কোথায় যাব মামা?

কোথাও যাব না। যেতে হলে তো পানিতে নামতে হবে। কোথাও পানি বেশি থাকলে আমরা ডুবে যাব।

তুমি ডুববে না মামা। আমরা ছোটরা ডুবে যাব।

আমি থাকতে তোরা কেউ ডুববি না। আমি তোদের মাথার ওপর তুলে নেব।

চারজনকে কীভাবে নেবে?

পারব, চল।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর আসার পর ওরা দেখতে পায় গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বাচ্চাসহ ছয়জন লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনজন বাচ্চার গলাসমান পানি। ওদের মাথার ওপর বালতি।

আমরাও তো ওই ছেলেদের মতো মামা। আমরা পানিতে নামলে গলাসমান হবে। গর্ত থাকলে ডুবেও যেতে পারি।

এসব কথা বলবি না। চুপ কর। দেখতে পাচ্ছিস নদী আমাদের মাটি খেয়ে ফেলছে। চেয়ারম্যানের বাড়িটা ইটের দালান। চারদিক কী সুন্দর গাছপালা দিয়ে ঘেরা।

ওই দেখো দুজন খালা মাথায় কাঁথা-বালিশ নিয়ে নেমেছে।

একজন লোক বুড়ো দাদিকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।

ওরা কোথায় যাবে মামা?

বোঝা যাচ্ছে ঘরে পানি উঠে গেছে। থাকতে পারবে না। যাবে গ্রামের অন্যদিকে।

ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব সুন্দর লাগছে।

কেন রে রাজু? এটা তো একটা কষ্টের ছবি।

কষ্টের হলেও এমন ছবি তো আমরা সবসময় দেখতে পাই না। কী সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি। চারপাশ সবুজ হয়ে আছে। সামনে থকথকে পানি। আর কয়েকজন মানুষ বাড়ি থেকে পানির মধ্যে নেমেছে। পানি মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একজন একটি ছোট্ট মেয়েকে ঘাড়ে বসিয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছে। ও বোধহয় ভয় পাচ্ছে। আমি তাকিয়ে থাকব। ছবিটা দেখব।

তাহলে আয় আমরা এই গাছের নিচে বসি। ছবিটা আমিও দেখব। ওদের মতো আমাদেরও পানিতে এভাবে হাঁটতে হতে পারে।

আমাদের গ্রামটা কি একদিন নদী হয়ে যাবে মামা?

যেভাবে ভেঙে যাচ্ছে মাটি তাতে মনে হয় হতেও পারে। যদি এই বাঁধটা তাড়াতাড়ি সারানো না হয়, তাহলে আমাদের গ্রামটা নদী হয়ে যাবে।

ও আল্লাহরে, আমাদের গ্রামটা নদী হয়ে যাবে। ও আল্লাহ আমাদের গ্রাম বাঁচাও।

থামরে, তোরা চুপ কর। ছবি দেখে আনন্দ পাচ্ছিস?

হ্যাঁ, পাচ্ছি। মানুষ পানিকে জয় করছে। এই ছবি আমরা অনেকদিন মনে রাখব। তোমার জন্য আমি এই ছবিটা দেখতে পেলাম মামা। তোমাকে জলপাই আর কামরাঙা খাওয়াব।

ইস, খুব মজার ফলের কথা বললি। আমি জলপাই আর কামরাঙা খেতে খুব ভালোবাসি। ওই দেখ তোদের ছবি গাছের আড়ালে চলে গেছে। চল আমরা বাড়ি যাই। মায়েরা খুঁজবে তোদের।

চলো, চলো, বাড়ি চলো।

তোরা সবাই আমার হাত ধর। কেউ একা যাবি না। আমার হাত ছেড়ে কেউ দৌড়াবি না।

কেন?

দেখছিস না একদিকে নদী, আর একদিকে জোয়ারের জল। পড়ে গেলে আর উঠতে পারবি না।

আমরা সবাই সাঁতার জানি।

তোরা যে সাঁতার শিখেছিস সেটা অল্প পানির সাঁতার। জোয়ারের জলে স্রোত বেশি সাঁতার কেটে কুলানো যায় না। বড়দেরই কষ্ট হয়। ছোটরা তো পারবেই না।

আচ্ছা, ঠিক বলেছ। আমরা তোমার হাত ধর আস্তে আস্তে হাঁটব। যেখানে অল্প পানি আছে সেখানে নেমে হেঁটে চলে যাব।
তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।

আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে; চল দৌড়াই। সোহরাব ওদেরকে নানাভাবে ওকে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির ঝাঁপ বাড়ে। ওরা বাঁধের পাশের বড় বটগাছটার নিচে দাঁড়ায়। এমনভাবে গাছের পাশে দাঁড়ায় যেন বৃষ্টির ছাঁট গায়ে বেশি না লাগে। ঝুলে থাকা দুটো ডাল টেনে চারপাশ ঘিরে রাখে। এর ফলে বৃষ্টির ঝাপটায় ওরা কম ভেজে। ছেলেরা সোহরাবকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

তোদের কি কষ্ট হচ্ছে?

না, এটা আমাদের কাছে খেলা মনে হচ্ছে। এমন খেলা মামা ছাড়া হয় না।

বল, হুররে, মামা মামা।
সোহরাব নিজেও আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে মনে হয় নিজের ভাইবোন থাকলে এমন আনন্দে ছোটবেলা থেকে বড় হতে পারত। সেটা হয়নি। ভাত খেতে পেরেছে, কিন্তু বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে আদরের জায়গাটা পূরণ করেনি কেউ। আচমকা কষ্টে বুকটা ভার হয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। রাজু খিলখিলিয়ে হেসে বলে, তোমার চোখ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে মামা। তুমি আমাদের আকাশ। তোমাকে আমরা আকাশ মামা ডাকব।
সোহরাব দুহাতে পানি মোছে। ওদের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। বুক ভার হয়ে গেলে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। বটগাছের পাতার ফাঁকে বসে থাকা আজ ওর কাছে নতুন দৃশ্য। এসব দৃশ্য ওর বেঁচে থাকার সুদিন। এইসব দৃশ্য দেখে ভরে যায় মন। বিষণ্নতা কাঁদায় না। একসময় খেয়াল করে বৃষ্টি কমে গেছে।

চল আমরা বাসায় যাই। বৃষ্টি থেমে গেছে।

চলো, চলো। মামার বাড়ি নেই। মামার বাড়ি থাকলে আমরা মামার বাড়িতে যেতাম।

মামার বাড়ি কখনো হবে না। আমি যেখানে থাকি সেখানে কেউ যেতে পারবে না।

আচ্ছা, যাব না, যাব না। শুধু ক্ষেতে-জঙ্গলে তোমার সঙ্গে ঘুরব। ঘুরে ঘুরে গ্রাম, নদী, সাগর, দেখব। দেখতে দেখতে বড় হবো।

যা, বাড়ি যা।

তুমি কোথায় যাবে?

– ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের অফিসে। দেখি বাঁধ সারানোর কতদূর কাজ হলো। আমরা আর কতদিন এই পানির মধ্যে থাকব।
ভাঙা বাঁধের অপরদিকে এসে ছেলেদের রাস্তায় নামিয়ে দেয় সোহরাব। এদিকে এখনো জোয়ারের জল ঢোকেনি। হালকা পানি এসে গড়িয়ে নেমে যায়। ওরা দৌড়াতে থাকে বাড়ির দিকে।
– শুধু পানি খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?
– না গেলে মরে যাব। কী আর করব? আমাদের কি সরকার বাঁচাবে না মামা?
– সরকার তো এই ভাঙা বাঁধ জোড়া লাগায় না।
– কবে বাঁধ জোড়া লাগাবে মামা?
– আমি তো জানি না রে।
– তুমি জানবে না কেন? তুমি যাও না কেন সরকারি অফিসে?
– ধুর, আমার এসব ভালো লাগে না। যারা এসব কাজ করে তারা করবে। চল, তোদের নিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে আসি। তোদের তো খেলাধুলা বন্ধ।
– কোথায় যাব মামা?
– কোথাও যাব না। যেতে হলে তো পানিতে নামতে হবে। কোথাও পানি বেশি থাকলে আমরা ডুবে যাব।
– তুমি ডুববে না মামা। আমরা ছোটরা ডুবে যাব।
– আমি থাকতে তোরা কেউ ডুববি না। আমি তোদের মাথার ওপর তুলে নেব।
– চারজনকে কীভাবে নেবে?
– পারব, চল।
– হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর আসার পর ওরা দেখতে পায় গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বাচ্চাসহ ছয়জন লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনজন বাচ্চার গলাসমান পানি। ওদের মাথার ওপর বালতি।
– আমরাও তো ওই ছেলেদের মতো মামা। আমরা পানিতে নামলে গলাসমান হবে। গর্ত থাকলে ডুবেও যেতে পারি।
– এসব কথা বলবি না। চুপ কর। দেখতে পাচ্ছিস নদী আমাদের মাটি খেয়ে ফেলছে। চেয়ারম্যানের বাড়িটা ইটের দালান। চারদিক কী সুন্দর গাছপালা দিয়ে ঘেরা।
– ওই দেখো দুজন খালা মাথায় কাঁথা-বালিশ নিয়ে নেমেছে।
– একজন লোক বুড়ো দাদিকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।
– ওরা কোথায় যাবে মামা?
– বোঝা যাচ্ছে ঘরে পানি উঠে গেছে। থাকতে পারবে না। যাবে গ্রামের অন্যদিকে।
– ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব সুন্দর লাগছে।
– কেন রে রাজু? এটা তো একটা কষ্টের ছবি।
– কষ্টের হলেও এমন ছবি তো আমরা সবসময় দেখতে পাই না। কী সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি। চারপাশ সবুজ হয়ে আছে। সামনে থকথকে পানি। আর কয়েকজন মানুষ বাড়ি থেকে পানির মধ্যে নেমেছে। পানি মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একজন একটি ছোট্ট মেয়েকে ঘাড়ে বসিয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছে। ও বোধহয় ভয় পাচ্ছে। আমি তাকিয়ে থাকব। ছবিটা দেখব।
– তাহলে আয় আমরা এই গাছের নিচে বসি। ছবিটা আমিও দেখব। ওদের মতো আমাদেরও পানিতে এভাবে হাঁটতে হতে পারে।
– আমাদের গ্রামটা কি একদিন নদী হয়ে যাবে মামা?
– যেভাবে ভেঙে যাচ্ছে মাটি তাতে মনে হয় হতেও পারে। যদি এই বাঁধটা তাড়াতাড়ি সারানো না হয়, তাহলে আমাদের গ্রামটা নদী হয়ে যাবে।
– ও আল্লাহরে, আমাদের গ্রামটা নদী হয়ে যাবে। ও আল্লাহ আমাদের গ্রাম বাঁচাও।
– থামরে, তোরা চুপ কর। ছবি দেখে আনন্দ পাচ্ছিস?
– হ্যাঁ, পাচ্ছি। মানুষ পানিকে জয় করছে। এই ছবি আমরা অনেকদিন মনে রাখব। তোমার জন্য আমি এই ছবিটা দেখতে পেলাম মামা। তোমাকে জলপাই আর কামরাঙা খাওয়াব।
– ইস, খুব মজার ফলের কথা বললি। আমি জলপাই আর কামরাঙা খেতে খুব ভালোবাসি। ওই দেখ তোদের ছবি গাছের আড়ালে চলে গেছে। চল আমরা বাড়ি যাই। মায়েরা খুঁজবে তোদের।
– চলো, চলো, বাড়ি চলো।
– তোরা সবাই আমার হাত ধর। কেউ একা যাবি না। আমার হাত ছেড়ে কেউ দৌড়াবি না।
কেন?
– দেখছিস না একদিকে নদী, আর একদিকে জোয়ারের জল। পড়ে গেলে আর উঠতে পারবি না।
– আমরা সবাই সাঁতার জানি।
– তোরা যে সাঁতার শিখেছিস সেটা অল্প পানির সাঁতার। জোয়ারের জলে স্রোত বেশি সাঁতার কেটে কুলানো যায় না। বড়দেরই কষ্ট হয়। ছোটরা তো পারবেই না।
– আচ্ছা, ঠিক বলেছ। আমরা তোমার হাত ধর আস্তে আস্তে হাঁটব। যেখানে অল্প পানি আছে সেখানে নেমে হেঁটে চলে যাব।
– তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।
– আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে; চল দৌড়াই। সোহরাব ওদেরকে নানাভাবে ওকে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির ঝাঁপ বাড়ে। ওরা বাঁধের পাশের বড় বটগাছটার নিচে দাঁড়ায়। এমনভাবে গাছের পাশে দাঁড়ায় যেন বৃষ্টির ছাঁট গায়ে বেশি না লাগে। ঝুলে থাকা দুটো ডাল টেনে চারপাশ ঘিরে রাখে। এর ফলে বৃষ্টির ঝাপটায় ওরা কম ভেজে। ছেলেরা সোহরাবকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
– তোদের কি কষ্ট হচ্ছে?
– না, এটা আমাদের কাছে খেলা মনে হচ্ছে। এমন খেলা মামা ছাড়া হয় না।
– বল, হুররে, মামা মামা।
– সোহরাব নিজেও আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে মনে হয় নিজের ভাইবোন থাকলে এমন আনন্দে ছোটবেলা থেকে বড় হতে পারত। সেটা হয়নি। ভাত খেতে পেরেছে, কিন্তু বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে আদরের জায়গাটা পূরণ করেনি কেউ। আচমকা কষ্টে বুকটা ভার হয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। রাজু খিলখিলিয়ে হেসে বলে, তোমার চোখ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে মামা। তুমি আমাদের আকাশ। তোমাকে আমরা আকাশ মামা ডাকব।
– সোহরাব দুহাতে পানি মোছে। ওদের সঙ্গে কথা বাড়ায় না। বুক ভার হয়ে গেলে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। বটগাছের পাতার ফাঁকে বসে থাকা আজ ওর কাছে নতুন দৃশ্য। এসব দৃশ্য ওর বেঁচে থাকার সুদিন। এইসব দৃশ্য দেখে ভরে যায় মন। বিষণ্নতা কাঁদায় না। একসময় খেয়াল করে বৃষ্টি কমে গেছে।
– চল আমরা বাসায় যাই। বৃষ্টি থেমে গেছে।
– চলো, চলো। মামার বাড়ি নেই। মামার বাড়ি থাকলে আমরা মামার বাড়িতে যেতাম।
– মামার বাড়ি কখনো হবে না। আমি যেখানে থাকি সেখানে কেউ যেতে পারবে না।
– আচ্ছা, যাব না, যাব না। শুধু ক্ষেতে-জঙ্গলে তোমার সঙ্গে ঘুরব। ঘুরে ঘুরে গ্রাম, নদী, সাগর, দেখব। দেখতে দেখতে বড় হবো।
– যা, বাড়ি যা।
– তুমি কোথায় যাবে?
– ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের অফিসে। দেখি বাঁধ সারানোর কতদূর কাজ হলো। আমরা আর কতদিন এই পানির মধ্যে থাকব।
– ভাঙা বাঁধের অপরদিকে এসে ছেলেদের রাস্তায় নামিয়ে দেয় সোহরাব। এদিকে এখনো জোয়ারের জল ঢোকেনি। হালকা পানি এসে গড়িয়ে নেমে যায়। ওরা দৌড়াতে থাকে বাড়ির দিকে।
– সোহরাব ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যায়। চেয়ারম্যান একাই ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে বলে, কী খবর সোহরাব? ভালো আছিস? আছি চাচা। আমাদের এই বাঁধ কবে সারানো হবে। আমার ক্ষেতটাও তো পানির তলে। চাষাবাদ বন্ধ।

– আমাদের ইউনিয়নের এগারোটা গ্রাম পানিতে থইথই করছে। আমি নিজেই তো কেঁদে কূল পাই না। কত জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করি। কাজ তো আগায় না। একশ বস্তা চাউল চাইছিলাম। চাউল আসছে। যাদের ঘরবাড়ি ভাঙছে, তাদের দেব।

– আমারও তো ঘরবাড়ি গেছে। আমি তো বাড়ি বাড়ি জায়গা খুঁজি আর রাত কাটাই। ঘরবাড়ি নাই, ধানের ক্ষেত নাই, চাল দিয়ে আর কয়দিন বাঁচব?

– থামরে বাবা, এত কথা বলিস না। ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সবখানে দৌড়াদৌড়ি করছি, বাঁধভাঙার খবর সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সবাই জানে। সরকারের নজরে আছে। ইঞ্জিনিয়ার বলছে পঞ্চাশ কোটি টাকা লাগবে।

– থাক, আমি আর এইসব শুনব না। যাই।

– আয় মুড়ি খাই। খাবি?

– হ্যাঁ, খাব।
– চেয়ারম্যান ওকে এক ঠোঙা মুড়ি দেয়। ও মুড়ি নিয়ে বলে, হাঁটতে হাঁটতে খাব। যাই।
ও ঘর থেকে বেরিয়ে চারদিকে তাকায়। চারপাশের সবকিছু ওর কাছে নতুন দৃশ্য হয়ে ফুটে ওঠে। ও হাঁটতে শুরু করে ভাঙা বাঁধের দিকে। একমুঠো মুড়ি মুখে পুরলে টের পায় সরষের তেল, কাঁচামরিচ দিয়ে মাখানো মুড়ি। ও বুঝতে পারে, চেয়ারম্যান এগুলো মাখিয়ে রেখেছে বিভিন্নজনকে দেওয়ার জন্য। লোকটা তো ভালোই। এমন করে চেনা হয়নি তাকে। ছোট বাচ্চাগুলো থাকলে ওদেরকে দিলে আনন্দ পেত ওরা। তারপর ও রাস্তার ধারের ঘাসের ওপর বসে একা একা খেয়ে ফেলে। খিদে পেয়েছিল। মুড়ি খেয়ে ও স্বস্তি পায়। দূর থেকে দেখতে পায় দুটো ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। ওর কাছে এসে বলে, মামা আপনাকে দেখে এসেছি।

– এই পানির মধ্যে একা একা ঘুরবি না তোরা।

– একা কই আপনি আছেন না।

– কোথায় যাবি?

– জোয়ারের পানি দেখতে।

– ওই যে দেখ ভাঙা বাঁধের ভেতর দিয়ে পানি ঢুকছে। সাগরের মোহনা আর নদী এক হয়ে গেছে।

– মোহনা কোনটা মামা?

– এখানে বসে দেখা যাবে না। আরো কাছে যেতে হবে।

– চলেন মামা আর একটু কাছে যাই।

– অত কাছে না যাওয়াই ভালো। জোয়ারে স্রোত বেশি হলে বাঁধ আরো ভাঙবে।

– আমরা মোহনা দেখবো মামা।

– বাঁধ আগে ঠিক করা হোক তখন তোদের মোহনা দেখাব। নৌকায় করে যাব।

– না আমরা ভাঙা বাঁধ আর মোহনা একসঙ্গে দেখব।

– বেশি দুষ্টামি হচ্ছে রে –
ওরা চুপ করে থেকে গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করে। দুজনে সোহরাবের দুহাত ধরে মৃদু টান দেয়। বাঁধের দিকে এগিয়ে যায়। মৃদুস্বরে বলে, এটা আমাদের খেলা। নদী আর সাগরের সঙ্গে খেলা। আর নিজেদের মাঠে জোয়ারের জলের সঙ্গে খেলা।
সোহরাব মৃদু হেসে ওদের মাথায় চাপড়ে দেয়। ওরা জোর করে ওর হাত চেপে ধরে। দেখতে পায় গলগলিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। ভাঙা বাঁধের ধারে দাঁড়ালে পানির ছিটকা এসে গায়ে লাগে। ওরা লাফাতে লাফাতে বলে, খেলা খেলা মজার খেলা। মামার বাড়ির মজার খেলা। পানি আমাদের বন্ধু।

– মামা, তোমার হাত ধরে ভাঙা বাঁধের এপার থেকে ওপারে আমরা লাফ দেব।

– খবরদার না, তোরা লাফ দিতে পারবি না।

– পারব, পারব।
– ওরা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলে তিনজনে ভাঙা বাঁধের মাঝখানে পড়ে যায়। সোহরাবের সাঁতার কাটার সুযোগ থাকে না। দুজনে জাপটে ধরে থাকে ওকে। তিনজনে প্রবল স্রোতে ভেসে যায় মোহনার দিকে। নদী আর সাগর এক হয়ে গেছে। সাঁতার কাটার সুযোগ নেই। সোহরাব ওদের মাথা জড়িয়ে ধরে বলে, তোরা ঠিক আছিস?
কোনো সাড়া নেই। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে ওকে। বাঁধের ওপরে কেউ নেই। নিঃশব্দ এলাকা। পানির প্রবল স্রোতে সাগর মোহনায় ডুবে যেতে থাকে তিনজনে। একসময় শিথিল হয়ে যায় শিশুদের হাত। ওদের ধরে রাখার চেষ্টা করে সোহরাব। কিন্তু পারে না। ওরা পানির তোড়ে অন্যদিকে ভেসে যায়।

– আমি তো একসঙ্গেই মরতে চেয়েছিলাম। তোরা আমাকে ছেড়ে গেলি কেন? আমার দুহাত চেপে ধরে আমার শরীর আঁকড়ে ছিলি। আমি তোদের ছেড়ে দিয়ে একলা বাঁচতে চাইনি। ওহ্, আল্লাহ রে!
নিজেকে আর সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। মোহনা ছাড়িয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে এখন ও। মাথা তলিয়ে আছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওর ভাবনা গলগলিয়ে ওঠে, বাবা-মা তোমাদের কাছে আসছি। আমাকে রেখে তোমরা আর কোথাও যাবে না। তোমাদের বুকের মধ্যে রেখে আজ আমি মৃত্যুসাগরে ডুবে যাচ্ছি।
নিত্যনতুন দৃশ্য দেখার ইচ্ছা ছিল আমার। আজকেও নতুন নতুন দৃশ্য বুকে নিয়ে তোমাদের কাছে আসছি।
বাঁধের ওপর লোক জমে গেছে। চিৎকার করছে অনেকে।

– সোহরাব তুই কোথায়? সোহরাব আমরা তোকে খুঁজছি।
– কারো কথা শোনার অবস্থা নেই ওর। ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে সাগরের গভীরে।
– এই নতুন দৃশ্য ওর আর দেখা হয় না। ও বুঝে যায় মৃত্যুও নতুন দৃশ্য তৈরি করে।