একটু যদি খোলা আকাশ

পা ফেলতে থাকি। উদ্ভ্রান্ত পথিকের ইচ্ছেমাফিক দৃষ্টি কিংবা দৃষ্টির বিভ্রম নিয়ে থানার ঘাটে গাভীর দুধ চায়ে চুকচুক করতে থাকি। একটা প্রশ্ন মন থেকে কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না। কাল রাতে আমি কি স্বপ্ন দেখেছিলাম? স্বপ্ন, নাকি স্বপ্নবিভ্রম? জেগে জেগে নির্ঘুমে অবিকল বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
একজন কিশোরীর রাঙা লাজুক মুখের ওপর থোকা থোকা রক্তজবা পড়েছিল কি? রক্তজবাগুলো পালটে একটি টকটকে লাল ঘুড্ডি ওর মুখে হাওয়ার দাপটে চেপে বসেছিল। ও খিলখিল করে হেসে যাচ্ছিল।
বলি ওই, তাকা, তাকা না –
আড়াল থেকে মৃদু কণ্ঠে টেনে টেনে বলে, না-আ-আ।
কেন?
ডর করে।
কাকে?
তোমারে।
আমি হো হো করে হেসে ফেলতেই ও কেঁপে ওঠে, কিন্তু সরে যায় না। চিকন দুটি হাত উঠিয়ে লাল ঘুড্ডির দুপাশে চেপে বলে, দেহি নাই, দেহি নাই।
হায়রে অবোধ কিশোরী, কোত্থেকে এলি তুই, তবুও স্বপ্নে, স্বপ্নে, নাকি সহজাত-বিভ্রমে? বুঝতে পারি না।
স্ত্রীকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলেছিলাম, এই শোনো –
কী হলো?
আমি কি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম?
ওপাশ ফিরতে ফিরতে বলে, বেশ ভালোই তো নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিলে।
শেষ রাত। মাথার জ্যামটা গাঢ় হয় সেখান থেকেই। উদ্ভ্রান্ত জীবনের সূত্রটা কেমন ধাঁধার মতো সামনে মেলে যায়।
রাত ১০টার থানার ঘাট। মানুষের পারাপার কমে এলেও স্থানীয়দের গুঞ্জন এখনো অনেক। দুধ চায়ে চুকচুক করতেই মোবাইল ফোনে স্ত্রীর কল এলো।
তুমি কোথায়? খাবে না?
চা খাচ্ছি।
এখন চা কেন?
হ্যাঁ তুমিও চলে এসো, এক সঙ্গে বসে চা খাই।
তাই নাকি।
হ্যাঁ, জায়গাটার মধ্যে স্বচ্ছ একটা পারাপার মনকে কেমন ভাবিয়ে তোলে।
ঠিক আছে আসছি।
সত্যি আসছ?
হুঁ।
লাইন কেটে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম। মাথার ওপর অর্ধেক চাঁদ। নদীর পাড় ঘেঁষে চওড়া রাস্তা। আগে যখন রাস্তাটি ছিল না, উঁচু-নিচু ঢালুতে বেশির ভাগ সময় ছায়া পড়ে থাকত। ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে কোনো যৌনকর্মী সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শুকনো ঠোঁট কুঁজো করে তাকাত। বয়স অল্প ছিল বলেই হা করে তাকিয়ে থাকতাম। সময়ের ঘূর্ণিস্রোতে এখন সমসাময়িক বলে কিছু নেই। হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। বাটন টিপলেই দুনিয়াটা পাখা মেলে।
তুমি এখানে, আমি চায়ের দোকানগুলো দেখে এলাম।
সরি ডিয়ার, চলো নিচে নামি।
কী বলছ!
হ্যাঁ চলো।
এই দাঁড়াও দাঁড়াও, রাত কটা হলো?
আমি তবু পা টিপে টিপে সামনে যাই। এই পারাপারের রাস্তাতেই কিশোরী মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিল। স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নবোধের বাহুল্য নিয়ে আমার এখন মাথাব্যথা নেই। আমি খুঁজি অর্থবহ বাস্তব। হয়তো ঘোরের ভেতর আচমকা ওর দেখা পাব। তখনই খপ করে ধরে বলব, আমাকেও রক্তজবা দিবি?
স্ত্রী বিচলিত, কোথায় তুমি?
আসছি।
পাগল হলে?
আসছি।
আমি কি স্বপ্নাক্রান্ত বাস্তব ব্যাধিতে সত্যি সত্যি আক্রান্ত? দুপাশে অন্তঃসারশূন্য চরাচর। স্ত্রীকে দেখাচ্ছে পাড়ে দাঁড়ানো প্রাচীন পুরাকীর্তির স্তম্ভ অথচ চঞ্চলায় মোহাবিষ্ট সার্থক গৃহিণীর মতো। ওর নির্বাক অস্তিত্বের মৃদু সঞ্চালন ঘিরে বুঝি-বা ঘুরপাক খাচ্ছে রহস্যময় ঝড়।
ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
এই তো এদিকে লালবালির উঁচু স্ফীত অংশেই মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল। কী অদ্ভুত নিরবচ্ছিন্ন পারাপারেও ওর সলাজ মুখটি রক্তজবায় ছেয়ে যাচ্ছিল। রক্তজবা, নাকি রক্তস্নাত-পাপড়ি? বোধে আসে না।
বালিময় স্ফীতি আমাকে মুগ্ধতা দিলো। ধপ্ করে বসে পড়ি। এখন আর স্ত্রীকে দেখলাম না। মোবাইল করেও কিছু জানল না। বেচারী মহা ক্ষেপেছে মনে হয়। আমি তখনো অদূরে বসে পারাপার দেখছি। মনে হয়, এই পারাপার ঘিরেই স্বচ্ছ কিংবা অস্বচ্ছের চিরায়ত প্রাকৃতিক লীলা, যাকে ঘিরেই আবর্তিত স্বপ্নাক্রান্ত ঘোর, নয়তো ঘোরের ভেতর অনুচ্চারিত বেঁচে থাকার আস্বাদ। স্ত্রীকে মোবাইলে কল করতেই স্বাভাবিকভাবে বলে, কোথায় আছো?
এই তো কাছাকাছি।
আসবে?
আসছি।
দাঁড়ালাম। একটু হাওয়া জাগল। নিজেকে মনোব্যাধিতে আক্রান্ত যুক্তিহীন আগন্তুকের মতো লাগছে। যদিও স্বপ্নের কিশোরী কেমন যেন পূর্ণতা দিয়েছে। কিছু একটা অন্বেষণের সুদূর বিলাসী ভালোবাসা, যা বোঝা যায়, আবার যায় না। পাড়ে উঠে স্ত্রীকে দেখলাম না। তবে সেই গাড্ডুকে দেখা গেল। যাকে শহরের আনাচে-কানাচে প্রায়ই দেখা যায়। শুকনো হাত-পা আর কুঁজো পিঠের ওপর মোটা একটি মাথা। এমনভাবে নির্দিষ্ট ছন্দে একরৈখিক ধ্যানে হেঁটে চলে, যেন মানুষ আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ওর চরম তাচ্ছিল্য। আগে ওর মায়ের সঙ্গে ভিক্ষা করতে দেখা যেত। এখন একাই এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করে। ঘাটের অদূরে মেহগিনি গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে বসে আছে।
কিরে গাড্ডু।
মাথা তুলে তাকাল। মনে হলো, মাথাটা তুলতেই ওর দেহের শিরায় শিরায় টনটনে ভার অনুভূত হলো। কটকটে লাল চোখে গা-ছাড়া ভাবে একটু তাকাল মাত্র, এরপর স্থবির। এ যেন মহাজাগতিক সাধনায় নিমগ্ন, কিংবা নিমগ্নতার অর্থবহ ব্যাখ্যা ওর নিজেরও জানা নেই। স্ত্রী মোবাইলে কল করল,
কি গো নায়ক, ক-কাপ চা খেলে।
তুমি চলে গেছ।
না।
দেখলাম না তো।
এবার এসে দেখো।
স্ত্রীর এমন সহজাত দুষ্টুমি নতুন কিছু নয়। আমার সকল খামখেয়ালির অনুকূলে ওর সহমর্মিতা আছে বলেই নিজেকে মনোব্যাধিগ্রস্ত মনে হলেও নিশ্বাসটা পড়ে সতেজ। ঘাটে দ্রুত চলে আসতেই ওকে দেখা গেল। চা-দোকানের সামনে টুলের একপাশে বসে আছে। কিছুই ভালো লাগে না, এইসব পারাপার, নিজের কর্মের নিকেশ কিংবা স্ত্রীর আন্তরিকতা, সব কেমন যেন জোড়াতালি দেওয়া কদর্য বাস্তবতা। মাথা ঝিমঝিম করছে। স্ত্রীকে কেমন অপরাধবোধ নিয়ে বলি,
একা একা বসে আছো –
কেন ভালোই তো লাগছিল। চা খাও।
তুমি খাবে না?
না।
আমিও খাব না।
সে কী! তাহলে বাসায় চলো।
এখন যাব না।
কেন?
একজন কিশোরীকে খুঁজছি। কাল স্বপ্নাক্রান্ত ঘোরে ঠিক ওইখানে মানে এখানে দাঁড়িয়ে মেয়েটি –
হুঁম, অত ব্যাখ্যার দরকার নেই, তুমি খুঁজে এসো।
ও চলে যাচ্ছে। পথ আটকিয়ে নাটুকেপনার কোনো মানে হয় না। আমার ইচ্ছেশক্তির কাছে নিজেই কেমন রুদ্ধ হয়ে পথ ভাঙছি। উদ্দেশ্যহীন চলছি, ঘরহীন ঘোরের দোলায় যা কিছু দেখছি, দেখার আপেক্ষিক বিচারে নিজেকে মনে হচ্ছে কূলকিনারাহীন উজবুক। ও বাড়ির ময়নাকে দেখলাম বাসায় ফিরছে।
বলি, শোন শোন –
কী?
এদিকে ছোট্ট একটা মেয়ে দেখেছিস, কেমন ময়লা হলুদ রঙের জামা?
না তো।
ওহ্!
আপনের কী দরকার।
তাই তো, কোন দরকারে আমি পথের নিশানা ভ্রমবিকারে তলিয়ে কেবলই পথ ভেঙে এদিক-ওদিক খুঁজছি। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, এর সম্মোহনী টানে অকস্মাৎ পূর্বাপর ভুলে কিসের মন্ত্রমায়ায় আমার ইচ্ছাশক্তি ভেঙে কেবলই কিশোরী-কিশোরী করছে। যতদূর মনে পড়ে, বিয়ের প্রথম রাতে স্ত্রীকে স্পর্শ করে কেমন চমকে উঠেছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই স্পর্শের গভীরতা বুঝতে হলে ঘর নয়, বাইরে যাওয়া দরকার। সব শব্দ পড়ে গেলে, স্থির মধ্যরাতে ও আমার বাহুলগ্ন হয়ে বলেছিল, দুর্বোধ্য!
কতটা?
বুঝি না।
বোঝার চেষ্টা করো।
ও মুচকি হাসছিল। পরদিন ওকে নিয়ে আসি সেই পারাপারে। যেখানে মুক্তছন্দে মানুষেরা চলাচল করলেও একটা অসামর্থ্য বোঝা যায়। যা হয়তো আমার মতোই দুর্বোধ্য, নয়তো দুর্বোধ্যতার ভেতর নিজের মনোজাগতিক স্পর্শ খুঁজে পাওয়া। স্ত্রী বলেছিল, আমার কাছে মনে হয় কি জান?
কি?
তোমার কাছে জীবনটা একটা প্রহসন, কেবল একটা ঘোরে বেঁচে আছ।
কি জানি –
এরপর থেকে আজ অবধি ও আমাকে সেভাবেই দেখে আসছে। ঠিক চড়া দুপুরে ঘনায়মান মেঘেদের ছায়ার মতো, গম্ভীর আবার সতত।
পরদিন রাতে সেই স্বপ্নটিই দেখলাম। একটু ব্যতিক্রম। মেয়েটি কতগুলি টকটকে লাল রক্তজবা চটকাচ্ছে। মুখে প্রচুর ধূলিকণা, গালের একপাশে কেমন যেন অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তির কালশিটে দাগ। বলি, কেমন আছিস? তাকালেও কিছু বলে না।
কিরে কেমন আছিস?
রক্ত দেখতাছি।
এ তো ফুলের রক্ত।
মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে তাকায়। কেমন লাজুক হেসে বলে, আমি মানুষের রক্ত ভালোবাসি।
বলে কী! লক্ষ করি ওর স্বাভাবিকতার ভেতর প্রকট হচ্ছে একধরনের জেদ। ভূকম্পনের মতো থরথর করে ওর শরীর যেন একটা অস্বাভাবিক পাথরকে ডিঙাতে চাচ্ছে। ধপ্ করে পড়ে আক্রোশে দু-হাতে রক্তজবার অবশেষ ঝেড়ে ফেলে কটকটে চোখে বলে, যান, যান গা –
তোকে নিয়ে যাব।
হি হি হি!
ঘুম কেটে গেল। ভীষণ ভয় চাপে। স্ত্রী বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অর্ধেক গ্লাস পানি খেয়ে মাঝরাতের আচমকা ভয় আর রুদ্ধশ্বাসের ধূম্রজালে হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে ডাকতে গিয়েও গুটিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই নির্জন অশরীরীর তপ্ত নিশ্বাসের মতো গা শিউরে শিউরে ওঠে। সে গাড্ডু ছেলেটি, বাড়ির মুখোমুখি রাস্তার ওপাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মুখ তুলে উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর দিকে কয়েকবার তাকাল। এরপর স্থির, একটু-আধটু নড়াচড়া, কোটরাগত লাল চোখদুটি মধ্যরাতের নির্জন ছায়াতেও বোঝা যায়। মুখোমুখি সমান্তরাল অবস্থানের মাঝখান দিয়ে শাঁ-শাঁ শব্দে একটি ট্রাক চলে গেল।
মানুষ ও যন্ত্রযানের বিপরীতে মাঝরাতের নিশুতি এমনই ভাববিদ্ধ করে যে, ভাবনার আমূলবোধ চরচর করে ওঠে। বুঝি-বা রাতের রাস্তায় বৃষ্টির মতো গড়িয়ে পড়ছে অজস্র রক্তের ফোঁটা। কোরবানির গরুর শেষ নিশ্বাস বেরোবার সময় খক্ক্ খক্ক্ গোঁও-ও-ও শব্দের অবশেষ যেন মিশে আছে বহমান রক্তপ্রবাহে। সেই গাড্ডু, বুঝি-বা রক্তনির্যাসেরই প্রতিরূপ। শত শত চাবুকাঘাত খেয়ে মধ্যযুগের কোনো হাবসি ক্রীতদাসের মতো ভেদবুদ্ধিহীন। বিপরীতে কিশোরীর রক্তজবায় বাঁচার নির্মল আস্বাদ থাকলেও কেমন একটা সূক্ষ্ম মর্মবেদনার কষ্ট কল্পজগৎকে ঠেলে দেয় বহুদূর।
এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো।
স্ত্রীর ডাকে ঘোর কাটে। বলি, না-না, ওই ছেলেটাকে দেখছি।
সেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বলল, ঘরে চলো।
আরেকটু থাকি।
না।
গল্প শোনাবে?
ও মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ শোনাব।
নাম-না-জানা একটা পাখি কোত্থেকে যেন য়ুক্ য়ুক্ য়ুক্ শব্দ করে ডেকে যাচ্ছে। মানুষের কোলাহল নেই বলেই হয়তো ওর এত স্বস্তি।
ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। স্ত্রী ঘর গোছাচ্ছিল। আমাকে একনজর দেখে বলল, উঠেছো, দাঁড়াও তোমার চা এনে দিচ্ছি।
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি দাও।
এরপর কপট রাগে বলল, আজো কাজের বুয়াটা এলো না, এবার এলে একটা রফা করবো।
এরা খুব পাজি।
আর বলো না, অসহ্য। আর শোনো, বিকাশদা কিন্তু ভাড়ার টাকা দিয়ে গেছে।
তাই নাকি, তোমার কাছেই রেখে দাও।
ও রান্নাঘরে চলে গেল। নার্ভগুলো কেমন সিঁটিয়ে আছে। শরীরের কোথাও না কোথাও একটা ব্যথা লেগেই থাকে। অবসেসিভ কম্পালসিভ হলে চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়। তখনই শুরু হয় শরীরময় অস্বস্তি। স্ত্রী চা এনে বলল, ওঠো, বিছানাটা গুছিয়ে দিই।
চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, দায়িত্বশীল গৃহবধূ। সংসারের এলোপাতাড়ি সময়গুলো অপরিমেয় সৌহার্দ্যে ভাঁজ-ভাঁজ করে রাখে, আর আমি একটা অবেলার সময় ও অসহ্য মনোপীড়নে ওর ছায়াটাকে আশ্রয় করেই যেন বোঁচে আছি। এক কথায় সংসারধর্মে ওর রহস্যময়তার কাছে সবকিছুই কেমন খামখেয়ালিপনায় ভরা। যদিও এ নিয়ে ওকে কিছুই বলা হয় না। বাস্তবধর্মী জীবনের অনুকূলে, মতপার্থক্য না থাকলেও, চিন্তার বিপরীতমুখী অনিবার্য ভারটুকু আমারই থাক।
তুমি কি এখন বেরোবে? স্ত্রী বলল।
হ্যাঁ।
কোথায় যাবে?
ভাড়া তুলতে, রহিম চাচা আজ দোকানের ভাড়া দেবে বলেছে।
যাও।
সেই পথ, সেই রাস্তা। মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাড়ি। বিস্তর গ্যাঞ্জামের ভেতর দিয়েও মানুষেরা এঁকেবেঁকে ছুটছে। সবার আচরণ সচল হলেও কেমন একটা আত্মগত নির্জ্ঞান চেতনায় মজে আছে সবাই। যা বুঝতে পারে না, হয়তো বোঝা সম্ভবও হয়ে ওঠে না।
রহিম চাচাকে পাওয়া গেল না। ঘাটে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। ভাড়ায় ভাড়ায় জীবন, এরপর কর্মের আলস্য, মানুষ সংগ্রামী হলেই কি প্রত্যক্ষবোধে আসে অপার চাঞ্চল্য? কি জানি –
দুপুর গড়িয়ে গেল প্রায়। সবকিছু কেমন ছবির মতো ভাসছে। নদী এখন ছোট খালের মতো। স্বচ্ছ জলরাশি যেন বাতাসে উড়ছে। দুপাশে উঁচু-নিচু বালুকাময় উষ্ণতা, দৃশ্যের আড়ালে কত যে দৃশ্যান্তরের খেলা, এরই মধ্যে দু-দুবার স্ত্রীর কল এসেছে। ধরতে ইচ্ছে করেনি।
বড় মসজিদের সামনে থেকে একটা মহিলার আর্তচিৎকার ভেসে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি করে জড়ো হলো অনেক মানুষ। ট্রাকের ধাক্কায় মাথা ফেটে পড়ে আছে স্বপ্নের সেই কিশোরী। এখনো গাল-কপাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। কিশোরীর মা মাটি চাপড়ে বুক থাপড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। অকস্মাৎ চমকে উঠি, সেই গাড্ডু জড়ো হওয়া মানুষের একপাশে দাঁড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত ছেঁড়া লুঙ্গি উঠিয়ে গৎ গৎ নিশ্বাসে রক্তজবা চটকে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে মাথাটা কেমন চক্কর দিলো। মনে হচ্ছে, এই বস্তুজগতের একখণ্ড জায়গা কেমন অপস্রিয়মাণ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মানবিক উদারতায় কেমন একটা যোগসূত্রহীন ফাটল। পা ফেলতে গিয়ে মনে হলো মাতালের মতো ভারসাম্যহীন টলছি, চোখের সামনে ঘনীভূত অন্ধকারের যোগসূত্রটা বোঝা যায় না।
সেই কিশোরী মেয়েটি এগিয়ে আসছে। কিশোরী, নাকি স্ত্রী। সম্ভবত কিশোরী।
বলি, কিরে বেঁচে আছিস?
ও আমার হাত চেপে বলল, বাড়ি চলো।
তোদের বাড়ি যেন কোথায় –
কি শুরু করলে, দুবার মোবাইলে কল করলাম, ধরোনি।
মোবাইল, কি জানি –
ও আমার হাত টেনে বলল, আহা চলো না।
কোথায়?
বাড়ি।