সংক্রমণ

আমিও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছি সন্দেহে নমুনা সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক বাসায় আসার পর পুরো অ্যাপার্টমেন্ট-ভবনটা লকডাউন করা হলো। ভবনের কোনো ফ্ল্যাটের জনপ্রাণী আর বাইরে যেতে পারবে না। বহিরাগত কেউ, এমনকি নিয়মিত কাজের বুয়া ও গাড়িচালকরাও ভেতরে ঢুকতে পারবে না, উঠতে পারবে না লিফটেও। কঠোর লকডাউন দশা বোঝাতে পুলিশের গাড়ি ভবনের সামনেও এসেছিল। পুলিশের নির্দেশেই দারোয়ান গেটের সামনের রাস্তায় আড়াআড়ি একটি বাঁশ ঝুলিয়ে দিয়েছে। বিপদের মাত্রা বোঝাতে বাঁশের মাথায় লাল গামছার ন্যাকড়াও বাঁধা হয়েছে।
করোনাভাইরাস আতঙ্কে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের প্রভাবে দেশেও অচলাবস্থা শুরু হলে ফ্ল্যাটবন্দি আগেই হয়েছিলাম। এবার ঘরেও সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তিন রুমের ফ্ল্যাটে আমরা দুজন মাত্র লোক। দুজনের আইসোলেশনে থাকায় কোনো অসুবিধা নেই। সমস্যা বাধল সঙ্গরোধক এই বিচ্ছেদ নিয়েই। চার দশকের পুরনো দাম্পত্য, সবকিছুতেই দুজনে শক্ত গাঁটছড়া বাঁধা। ভবনের পড়শি ও পরিচিতজনরা আড়ালে টিপ্পনী কাটে, রঙিলা বুড়া-বুড়ির বড় সুখের কপাল গো! ছেলেমেয়েরা দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। শেষ বয়সে সংসারে সন্তান ও নাতি-নাতনির উৎপাত নেই। কপোত-কপোতি নিজেদের ফ্ল্যাটে জোড় বেঁধে হানিমুন করছে।
দীর্ঘ দাম্পত্যের সুখে-দুঃখে এতদিন যাই করে থাকি, অপরিহার্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বরাবর এক ঘরে এবং এক বিছানায় ছিলাম আমরা। ঝগড়াঝাটি হলে পাশ ফিরে বড়জোর পরস্পরকে পিঠ দেখিয়েছি, তাতে প্রশস্ত খাটে আড়াই ফিটের বেশি ব্যবধান রচিত হয়নি। এখন এক বিছানায় ঘুমানো দূরে থাক, কেউ কারো ঘরে ঢুকতে পারব না। মুখোমুখি বসে গল্পগুজব কি খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ। এক বাসায় থেকেও দুজনকে সবকিছুতেই আলাদা থাকতে হবে। মরণকালে যাতে পরস্পরের কাছাকাছি থাকতে পারি, সেজন্য বাবা-মায়ের এক ঘরে থাকাটাই উৎসাহিত করেছিল সন্তানেরা। কিন্তু এখন বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন রাখতে তৎপর সবাই। অবশ্য ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে পরস্পরকে দেখেশুনে রাখতে পারব এবং সেটা পারতেও হবে, কারণ বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।
আলাদা হওয়ার পর অ্যাটাচ বাথ-ব্যালকনিসহ মাস্টারবেড রুমটি আমার একক দখলে। ফ্ল্যাটের বাদবাকি সবকিছুই স্ত্রী রেহানার নিয়ন্ত্রণে, তারপরও সে মাস্টারবেড বেদখল হওয়ার দুঃখ যেন ভুলতে পারে না। যখন-তখন দরজায় এসে, আট-দশ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে চেঁচায়, কই গো!
‘শুনেছো আসল খবর? এই বিল্ডিং তোমার জন্য লকডাউন হয়নি আসলে। পাঁচতলার ওসমান সাহেবের করোনা আগে ধরেছে। হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছে। এ-খবরটা পর্যন্ত আমরা জানি না। দারোয়ান বলল, ওসমান সাহেবের মেয়েও অসুস্থ। এখন বুঝতে পারছো তোমার শরীরে করোনাভাইরাস কোথা থেকে আর কীভাবে এসেছে?’
আমি বুঝিনি, বুঝতেও চাই না। রেহানা দরজায় দাঁড়িয়ে বোঝাতে থাকে। করোনা ঠেকাতে সরকার দেশ অচল করে দেওয়ার পরও মসজিদগুলো খোলা ছিল। এখনো সীমিত নামাজির জন্য খোলাই আছে। আমি সর্বশেষ শুক্রবার জামাতে গিয়েছিলাম ওসমান সাহেবের সঙ্গে। নামাজও পড়েছি এক কাতারে। তাছাড়া আমার শরীরে করোনা-উপসর্গ ফুটে বেরোনোর কদিন আগেও বাজারে গিয়েছিলাম। তখন লিফটে ওসমান সাহেবের সঙ্গে একসঙ্গে নেমেছি, কথাও বলেছি।
দারোয়ানের কাছে এসব তথ্য জানার পর রেহানা অভিযোগ করে, ‘তুমি খামোকা আমার কাজের মেয়েটাকে সন্দেহ করে তাড়ালে। ওর অভিশাপ লাগল কি না আল্লাহই জানে। এখন এই বয়সে সংসার সামলানো ও রোগীসেবা একা আমি কদিন করতে পারব? আমারো জ্বর-কাশি শুরু হলেই হয়।’
আমার মতো এবং আমাকর্তৃক রেহানাও সংক্রামিত হলে পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আমার কাছে জবাব না পেয়ে সে কিচেনে চলে যায়। নিজের চিন্তাভাবনা আনন্দ-বেদনা স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করা তার পুরনো অভ্যাস। শেয়ার না করলে রাগক্ষোভ ও গালমন্দ আমাকে সইতে হয়। চুপ করে থাকলে আমাকে শুনিয়েই গজরগজর করবে। ছেলের দেওয়া গিফট স্মার্টফোনে ছেলে, প্রবাসী মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সারাদিনে কত টাকার যে কথা বলে তার হিসাব থাকে না। আর বিনাপয়সায় বিস্তর কথা শোনাবার উপযুক্ত পাত্র যেহেতু আমি ছাড়া সংসারে আর দ্বিতীয়জন নেই, আইসোলেশনের পরও দরজায় দাঁড়িয়ে যখন-তখন ‘কই গো’ ‘হ্যাঁ গো’ করবেই।
কিন্তু রেহানার কথা নয়, আমি আসলে কাজের মেয়ে রুহির কথাই ভাবছি। রুহিকে তাড়িয়ে দিয়েছি বলে তার অভিশাপেই এই দশা হলো কিনা – রেহানার এ-শংকাটি আমার মনেও খোঁচা দিয়েছে। করোনাসংক্রমণ রোধে সরকার জনসমাগম বন্ধ ঘোষণা করেছিল মার্চ মাসেই। ৮ই মার্চ কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর, ১৭ই মার্চ বহুলপ্রত্যাশিত জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়াসহ সকল রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। বন্ধ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও দোকানপাট। এই অবস্থায় ড্রাইভার ও বাসার ছুটা কাজের লোকজনকেও ছুটি দিতে শুরু করেছিল নগরীর সচ্ছল বাসিন্দারা। ড্রাইভারকে ছুটি দিলেও আমরা কাজের মেয়ে রুহিকে ছাড়ানোর কথা ভাবিনি, সেও আমাদের কাজ ছাড়তে চায়নি। কারণ ছুটা হলেও মেয়েটা নিজগুণে আমাদের বাসার নির্ভরযোগ্য ও নিয়মিত লোক হয়ে গিয়েছিল।
ছুটা কাজের মেয়েরা সাধারণত একাধিক বাসায় কাজ করে। ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি কাজপ্রতি মজুরি চায়। রুহিও এরকম কাজ দু-তিন বাসায় করত। কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাটের সব কাজই করত সে। কিচেনে রেহানাকে সাহায্য করত, এমনকি প্রয়োজনে রান্নাবান্নার কাজও। মেয়েটার রান্নার হাতও ভালো। বেতন বেশি পেত, সময়ও দিত বেশি এবং আমরা তার পছন্দের মনিব ছিলাম অবশ্যই। করোনা-আতঙ্কে অন্য বাসার কাজ ছেড়ে দিলেও আমাদের দেওয়া মাস্ক পরে কাজে আসত। কাজ শুরুর আগে বেসিনে সাবান দিয়ে হাতও উত্তমরূপে ধুতো। নিজের বাসায় যাতে একইরকম সতর্ক থাকে, সেরকম নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল তাকে।
কিন্তু সেদিন বাসায় এসেই অদ্ভুত এক আবদার শোনায় মেয়েটা। এ-মহল্লারই বস্তি সমতুল এক বাড়িতে তিন হাজার টাকা ভাড়ার এক ঘরে স্বামী-সন্তান নিয়ে আছে সে। তাদের বস্তিতেও মনে হয় একজনের করোনা ধরেছে, জ্বরে বিছানা নিয়ে দিনে-রাতে কাশি দিচ্ছে লোকটা। বাড়িটাতে পাঁচটা ঘরের বাসিন্দাদের জন্য একটা বাথরুম, রান্নাঘরও একটাই। কারো করোনা ধরলে বাচ্চা নিয়ে কোথায় পালাবে রুহি? স্বামী নারায়ণগঞ্জে এক কারখানায় কাজ করত। নারায়ণগঞ্জ লকডাউন হওয়ায় বাড়িতে এসে বেকার শুয়ে-বসে থাকছে। গার্মেন্টসে চাকরি করা এক ননদ, তারও কাম বন্ধ। এই অবস্থায় রুহি তার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে স্থায়ী কাজের মানুষ হিসেবে আমাদের ফ্ল্যাটে থাকতে চায়। স্বামী তার বোনকে নিয়ে ওই বাসায় থাক, কিংবা গ্রামে কি জাহান্নামে চলে যাক, কিছুই যায়-আসবে না তার। আমাদের খালি বাসা দেখে নয়, মানুষ হিসেবেও খালা-খালুকে পছন্দ বলে চিন্তাটা মাথায় এসেছে তার। আলাদা ঘর কি খাট-বিছানা লাগবে না রুহির, ছেলেকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে কি কিচেনের মেঝেতেও ঘুমাতে পারবে সে। করোনার আজাব থেকে দেশ মুক্ত না হলে বাসা থেকে বেরোবেও না। বাঁধা মানুষের মতো বাসার সব কাজই করবে। তার বাচ্চাটাও আমাদের নাতির বয়সী, বেশ শান্তশিষ্ট, টিভির সামনে বসিয়ে দিলে নড়চড় করে না।
বাসায় বাঁধা একটি কাজের মেয়ে থাকলে বুড়াবুড়ির সংসারে সুখ বাড়বে অবশ্যই। বাঁধা কাজের মেয়ে নেই বলে ছেলে তার বউবাচ্চা নিয়ে বাসায় বেড়াতে এসে থাকতে চায় না, কারণ তার মায়ের ওপর কাজের বাড়তি চাপ পড়ে। এরকম পরিস্থিতিতে রুহি অবশ্য আগে বাড়তি সময়েও আমাদের বাড়তি কাজ করে দিতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে এই প্রস্তাব দিলে নিজের ঘরসংসার ফেলে সে কিছুতেই শুধু আমাদের সেবায় বাঁধা পড়তে চাইত না। এখন করোনার ভয়ে আশ্রয় চাইছে। রেহানা সংসারে ভারমুক্ত হওয়ার খুশিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু খাল কেটে কুমির আনার মতো বিপদের ভয়ে আমি কঠোর বাধা দিয়েছি। পুরো মাসের বেতন বুঝিয়ে দিয়ে ওইদিনই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি মেয়েটাকে। রেহানা গজগজ করেছিল। আমার সিদ্ধান্তকে ছেলেমেয়েরাও ফোনে জোরসমর্থন দেওয়ায় মেনে নিয়েছিল। অন্যদিকে সংকটকালে কাজের মেয়ের শূন্যতা পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আমিও। এই বয়সেও হাতে গ্লাভস পরে বাসন ধোয়া ও ঘর মোছার মতো কাজও করেছি। আপন কর্মবীরত্ব জাহির করতে রেহানাকে দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। লকডাউনে কাজের মেয়েবিহীন সংসারে স্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে তরুণ স্বামীদের উৎসাহিত করার জন্য লিখেছিলাম, করোনাকালে ঘরকন্নার কাজে কিচেনে স্ত্রীকে এভাবে সাহায্য করলে ক্ষতি কি? ছেলের বয়সী একজন মন্তব্য করেছিল, আংকেল আপনাকে গুরু মানছি। আরেকজন বলেছে, আমি শুধু বাসন ধুই না, আনাজ এমনকি মাছও কুটে দিই। আর একজন সরস মন্তব্য করেছে, সাহায্য করতে গিয়ে হাতের ঝাড়– যেন ভুলে ওনার পিঠে না পড়ে। সাতটি মন্তব্য ছাড়াও পোস্টটায় লাইক পেয়েছিলাম ৫৯ জনের। কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করলেও দিনেরাতে সকল কাজে স্ত্রীর পাশাপাশি থাকার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ।
কাজের মেয়েটাকে বিদায় দেওয়ার ঠিক ১৩ দিন পর আমার শরীর খারাপ তথা প্রথম গা-গরম ভাবটা টের পাই। রুহির কথা মনে হয়েছিল স্বভাবতই। খুকখুক কাশির পর সাহানাকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, হারামজাদি কাজের মেয়েটাই করোনা দিয়ে গেল নাকি? রেহানা তার কাজের মেয়ের প্রতি পক্ষপাত নিয়ে জবাব দিয়েছে, তুমি কি তার গায়ে হাত দিয়েছিলে? রুহির করোনা থাকলে আমাকেই আগে ধরত। আমি তো কিচেনে সবসময় তার কাছাকাছি ছিলাম।
যৌবনকালে এরকম সংক্রামক মহামারি যুগ দেখা দিলে রেহানা আমার ঠাট্টাকে সত্যি ভেবে স্বামীকে সন্দেহ করত অবশ্যই। কিন্তু আজ আমার সংক্রমণের অন্য উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে সে। নির্দোষ কাজের মেয়েটার প্রতি দরদও তাই উথলে উঠছে। সত্যি বলতে কী, মেয়েটার কথা ভেবে আমারও খারাপ লাগে। খেটে খাওয়া গরিব মানুষ, লকডাউনে সবাই রুজিরোজগারহীন। কীভাবে চলছে তাদের কে জানে। টিভির খবরে প্রতিদিন করোনা-আপডেট দেখি বলে জানি, নগরীর এই এলাকাতেও শতাধিক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে রুহি কিংবা তার স্বামী-সন্তানও আছে কি না জানি না। তিন বছরের বাচ্চাও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে আমার নিজের নাতির কথা মনে পড়েছিল। বউমাকে ফোন করে আরো সতর্ক থাকার কথা বলেছি।
দরজায় আবার রেহানার উপস্থিতি টের পাই।
‘এই ঘুমালে? গলাব্যথা বা শ্বাসকষ্টের মতো টের পাচ্ছো কিছু?’
আমি জবাব দিই না। সরকারি লোক মাত্র আজকে আমার নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। পজিটিভ কি নেগেটিভ – জানতে দু-তিনদিন লাগবে। তার আগেই রেহানা আমার কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে নিশ্চিত নয় শুধু, বৈধব্য বরণেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন।
‘কথা বলছো না যে! ঘুমিয়েছো? অনেকক্ষণ কাশছো না, জ্বরটা বেড়েছে নাকি? আমি ফল কেটে আনি, আবার আদা-চাও খাও এক মগ।’
আমি বিছানায় চোখ বুজে চুপচাপ থাকি। করোনায় মৃতের মিছিলে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিনই হাজার হাজার লোক যোগ দিচ্ছে, সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার আগে আজ একটু মরার ভান করে স্ত্রীর বৈধব্যশোক কিংবা স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করে গেলে ক্ষতি কি? নীরব থেকে তার উদ্বেগ বাড়াই। অভিমানও হয় কিছুটা। মাত্র তিন-চারদিন ধরে অল্পস্বল্প সর্দিজ্বর। গোসলের সময় ঠান্ডাগরমের তারতম্য হলে এরকম হয় আমার। খুকখুক কাশি কারণে-অকারণেও জীবনে অসংখ্যবার কেশেছি। কিন্তু জ্বরকাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট যে কোভিড-১৯ রোগীর লক্ষণ, মিডিয়ার রাতদিন প্রচারণায় জানতে বাকি নেই দুনিয়ার মানুষের। রোগীর করোনা-উপসর্গ থাকলে ডাক্তাররা পর্যন্ত ভয়ে পালায়। করোনার ভয়ে অন্য রোগের রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া বন্ধ করেছে অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল। কাজেই আমার খুকখুক কাশির সঙ্গে নিজেই ঠাট্টা করে করোনা ও কাজের মেয়ের সম্পর্ক উল্লেখ করায় ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপেছিল রেহানার। ছেলেমেয়েকে জানাতে না করেছিলাম, কিন্তু রেহানা তৎক্ষণাৎ আড়ালে গিয়ে ছেলেকে এবং প্রবাসী মেয়েকেও ফোন করেছে।
করোনার আতঙ্ক আমাদের দুজনকে সারাক্ষণ তাড়া করছিল আসলে ইংল্যান্ড প্রাবাসী মেয়ের কারণে। বিয়ের পর ডাক্তার জামাই ও দুই সন্তান নিয়ে বিদেশে মেয়ের এত ব্যস্ততা যে, আসি আসি করেও পাঁচ বছর ধরে দেশে আসার সময় পায়নি। বিদেশে জন্ম নাতনি দুটিকে ভিডিওতে দেখে ইন্টারনেটে চ্যাট করে আর কতটুকু মন ভরে? কোলে নিয়ে আদর দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি দুজনেই। বাবা-মায়ের শখ পূরণের জন্য মেয়ে-জামাই এ-বছর এপ্রিলে দেশে আসবে বলে ছয় মাস আগেই টিকেট বুকিং দিয়েছিল। মেয়ে ও নাতনিদের গৃহপ্রবেশ ঘটবে বলে রেহানাও ফ্ল্যাট সাজাতে শুরু করেছিল। কাজের মেয়ে রুহিকেও পর্যন্ত প্রস্তুত করেছিল ওই সময়ে আরো বেশি সার্ভিস দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে জানত করোনাভাইরাসের বিশ্বায়নে ওলটপালট হয়ে যাবে সবকিছু? লকডাউনে ইউরোপ-আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বই থমকে গেছে। মহামারি আতঙ্কে কাঁপছে বিশ্ববাসী। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত। জামাইয়ের ঘনিষ্ঠ ডাক্তার বন্ধুর করোনায় মৃত্যুর পর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই হাসপাতালে ডিউটি করছে। বাসায় দুই সন্তান নিয়ে মেয়ে একা আইসোলেশনে। যাদের দেখার জন্য দিন গুনছিলাম আমরা, এখন তাদের চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশংকায় বুক ধুক্‌পুক্‌ করে দিনেরাতে।
ইংল্যান্ডের করোনা-আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীকে হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়ার খবর যেদিন টিভিতে দেখাল, ঠিক সেদিনই আমার জ্বর-কাশি শুরু হয়। খবর পেয়েই লন্ডন থেকে মেয়ে ফোন করেছে। নিজের ভয় পাওয়া আড়াল করতে উপদেশ দিয়েছে, ‘একদম ভয় পাবে না বাবা। ভয় পেলেই তোমার ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাবে। কোভিড-১৯ রোগী নাইনটিফাইভ পার্সেন্ট সুস্থ হচ্ছে। পরীক্ষার পর পজিটিভ হলে শ্বাসকষ্ট ওঠার আগেই হাসপাতালে ভর্তি হবে। কারণ অক্সিজেন দিতে হবে, সেটাই এ-রোগের চিকিৎসা। ইংল্যান্ডের পিএমকেও অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।’
যতই বলি, আমার অবস্থা তোমাদের পিএমের মতো খারাপ না, এমনি ঠিক হয়ে যাব, মেয়ে আমার কথায় বিন্দুমাত্র ভরসা না পেয়ে তার ভাইকে ফোন করেছে। ডাক্তার স্বামীকে দিয়ে আমাকে নয় শুধু, ঢাকায় তার এক ডাক্তার বন্ধুকেও ফোন করিয়েছে আমাকে সাহায্য করার জন্য।
মেয়ে প্রবাসী হলেও আমাদের একমাত্র ছেলে দেশে মাত্র মাইল পাঁচেকের ব্যবধানে, স্ত্রীর অফিস ও সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর সুবিধা নিতে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তা বলে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব তার বোনের চেয়ে কম নয়, বরং বেশি। ফোনে নিয়মিত খোঁজ নেওয়া ছাড়াও প্রায় প্রতি সপ্তাহে নাতিকে তার দাদা-দাদির সান্নিধ্যলাভের সুযোগ করে দিয়ে ধন্য করে আমাদের। দেশে কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে বউ-বাচ্চা দূরে থাক, নিজেও আসেনি। কিন্তু আমার করোনা উপসর্গের কথা শুনে বোনের নিষেধ সত্ত্বেও বাসায় ছুটে এসেছে সে। অবশ্য মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছিল। ডাক্তারের পরামর্শমতো আমার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধপথ্য ছাড়াও করোনা সংক্রমণ থেকে মাকে রক্ষা করতে সবরকম ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে সে। ফ্রিজ ভরা মাছ-মাংস খাদ্যসামগ্রী ও মাসের বাজার করে দিয়ে গেছে, যাতে গৃহবন্দি থেকেও গোটা মাস স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারি আমরা। বাবা-মায়ের আইসোলেশন পোক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি পুত্র, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচিত এক কর্মকর্তাকে ধরে আমার করোনা টেস্টের ত্বরিত ব্যবস্থাও করে ফেলেছে।
কেন জানি না, করোনা টেস্টের সরকারি লোকটাকে বাসায় দেখার পর থেকেই আমার মৃত্যুভীতিটা গলায় উঠি উঠব করছে। নমুনা সংগ্রাহকের আপাদমস্তক পিপিই ও তার আচরণের কারণেও সম্ভবত, তার চেহারার মধ্যে জান-কবজকারী আজরাইলের ছায়া দেখেছিলাম যেন। একটা কাঠি দিয়ে সে আমার নাক ও গলার লালরস এবং রক্তের নমুনাও নিয়েছে। নিরাপদ পাত্রে স্যাম্পল নিয়ে চলে যাওয়ার আগে রেহানারও টেস্টের প্রয়োজনীয়তার কথা তাকে স্মরণ করে দিয়েছি। কিন্তু যেহেতু রেহানার এখন পর্যন্ত একটাও উপসর্গ নেই, সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এবং সুস্থ লোককে পরীক্ষার নিয়ম নেই বলে তার নমুনা আজ নেয়নি। তবে পরীক্ষায় আমারটা পজিটিভ হলে আমার টেস্ট আরো একাধিকবার হবে, তখন আমার স্ত্রীর এবং এই ভবনের আরো অনেকের টেস্ট হবে অবশ্যই। ততদিন পর্যন্ত আইসোলেশেনের কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে আমাদের।
টেস্টের ফলাফল পজিটিভ হলে আমাকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থাও প্রায় পাকা করে রেখেছে ছেলে। আর নেগেটিভ হলেও অসুস্থ পিতাকে কোনো বেসরকারি ক্লিনিকে রেখে মাকে নিজের প্রযত্নে রাখার ইচ্ছে তার। আর রিপোর্ট পাওয়ার আগেই যদি আমার অসুখ সহসা গুরুতর রূপ নেয়, খবর পেলে ছেলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে আসবে অবশ্যই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, করোনারোগী সন্দেহ করলে কোনো হাসপাতালই ভর্তি নেবে না আমাকে। ডাক্তার নেই, আইসিইউ নেই ইত্যকার অজুহাত দেখাবে। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় অসুস্থ পিতাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও বিনা চিকিৎসায় মরতে দিয়েছে অসহায় এক পুত্র, তারচেয়েও বড় ট্র্যাজেডি একমাত্র সন্তান হয়েও পিতার দাফন-কাফন-জানাজায় শরিক হতে পারেনি। উলটো নিজেও করোনারোগী সন্দেহে কোয়ারেন্টাইনে আছে এখন। কোয়ারেন্টাইনে থেকে নিজের মর্মান্তিক শোকগাথা ফেসবুকে লিখেছে সে। পোস্টটি পড়ে এতিম ছেলেটির জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। জানি না, আমাকে নিয়েও অচিরে আমার ছেলের পাতালে-হাসপাতালে কী দুঃসহ অভিজ্ঞতার শিকার হতে হবে এবার।
আজ নিজেও যখন পজিটিভ ও নেগেটিভের দ্বন্দ্বে দুলছি, মাঝে মাঝে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়াটিতেও খুব মনোযোগী হয়ে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা পরখ করে বুঝতে চাইছি আপন পরমায়ুর দৈর্ঘ্য। সত্যই যদি শ্বাসকষ্ট চরমে উঠতে থাকে, দরজা বন্ধ করে চুপচাপ মরে যাওয়াই ভালো। অবশ্য এরকম স্বেচ্ছামৃত্যুর আগে ফেসবুকে অন্তত জীবনের শেষকথা কিছু লিখে যাওয়া উচিত, যার জন্য মৃত্যুর পরও স্বজন-বন্ধুদের কাছে অন্তত গভীর দীর্ঘশ্বাস উপহার পাব একটা। কিন্তু কী লিখব মৃত্যুপথযাত্রীর ডায়েরিতে?
রেহানা আমার জন্য ফল ও আদা-চা করে এনেছে আবার। তখন মিছেমিছি মরার ভান করে শুয়ে থেকে জবাব দিইনি, এবার সে-কারণেই বোধহয় দরজার কাছে এসেই উচ্চস্বরে ঘোষণা করে, ‘তুমি উঠে চা-টা খেতে না পারলে এবার আমি কিন্তু খোকনকে ফোন করব, আসুক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে।’
আমি বিছানায় উঠে বসি, স্বাভাবিক মানুষের মতো হাসারও চেষ্টা করি। অভয় দিতে ঠাট্টা করি, ‘আমাকে মারার জন্য জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? এই বয়সে বিধবা হলে আর কোথাও বিয়ে হবে তোমার? রিপোর্টে করোনা পজিটিভ হলেও মরছি না সহজে।’
রেহানা ট্রে-ভরা খাদ্যসামগ্রী দরজায় রেখে দিলে, আমি ট্রে তুলে টেবিলে কিংবা বিছানায় বসে একা খাই। নিজের এঁটো বাসনপত্র বাথরুমে নিজেই পরিষ্কার করে রাখি। সঙ্গরোধক দূরত্ব বজায় রাখতে ছেলেমেয়েরাই এসব সতর্কপ্রণালি শিখিয়ে দিয়েছে মাকে।
রেহানা আশ্বস্ত হয়ে বলে, ‘জ্বরটা তাহলে আর বাড়েনি? আজ ফোনে বেবি বলল, জ্বর-কাশি না হলেও নাকি করোনা পজিটিভ হয়। ও আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে বেশি। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে সবসময় কী দোয়া করছি জানো? তোমার আগেই যেন আমার মরণ হয়। তুমি করোনায় গেলে বিদেশে মেয়ের কাছে গিয়েও থাকতে পারব না, ছেলেবউয়ের সংসারেও শান্তিতে থাকতে পারব না।’
রেহানা বরাবরের মতো করোনাকালেও আমার আগে মরণ কামনা করে বটে, কিন্তু করোনার থাবা থেকে শত হাত দূরে থাকতেই তৎপর। অন্য সময় হলে আমার কপালে হাত দিয়ে কতবার জ্বর মাপত, জলপট্টি দিয়ে দিত মাথায়। কিন্তু এমনই সতর্ক হয়েছে, আমার ব্যবহৃত থার্মোমিটারটি পর্যন্ত স্পর্শ করে না সে। আমি ঘরে কাশি দিলেও সে ছুটে পালায়। কোন ডাক্তার নাকি টিভিতে বলেছে, করোনা রোগীর এক কাশিতে পাঁচ লক্ষ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
আমি রেহানার দেওয়া পেয়ারা-আপেল খাই। সাহস জোগাতে বলি, ‘আমার ডায়াবেটিস-প্রেসার তোমার চেয়েও বেশি, তবু ভয় পাচ্ছি না। আর তোমার শরীরে এখনো কোনো খারাপ লক্ষণ নেই, এত ভয় পাও কেন গো! মরবে না তুমি।’
‘মরতে তো হবেই, কিন্তু করোনায় মরলে মেয়ে আর নাতনি দুটির মুখ দেখে যেতে পারব না। এত কাছে থাকলেও মরণকালে ছেলে ও নাতির মুখ দেখা হবে না আর। বেঁচে থাকলেও ওদেরও সারাজীবন এ-কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে। তারচেয়েও বড় দুঃখ, মরার পরে ঠিকঠাক দাফন-কাফন ছাড়াই কবরে যেতে হবে। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুর সময় গার্ড অব অনার পাওয়ার কথা, জানাজায় কত লোক আসত, ছেলেমেয়েরা ধুমধাম করে কুলখানি করত, কিন্তু এসব কিছুই হবে না। চোরের মতো চুপি চুপি মরার কথা ভেবেছিলে কখনো? আল্লাহ যে সারা দুনিয়ায় মানুষের জন্য কেন এমন গজব চাপাল! তুমি চা-টা খেয়ে টিভি কি ফেসবুক দেখ, আমি রাতে তোমার জন্য চিকেন স্যুপ করবো।’
রেহানা আমার আসন্ন মৃত্যু এবং মৃত্যুপরবর্তী প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়েও দুঃখ করছে! কিন্তু মৃত্যুপরবর্তী বঞ্চনা নয়, সুখ-দুঃখের পুরনো সঙ্গী এই মানুষটাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটাই আমার দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরোয়। মনে পড়ে, চাকরিতে রিটায়ার করার দিন অনেক ফুলের তোড়া ও গিফট নিয়ে যেদিন বাসায় আসি, রেহানা সেদিনও আমার ঘরের একাকিত্ব নিয়ে উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘এতদিন ঘরের বাইরে অফিস, বন্ধুবান্ধব, পলিটিক্স, আড্ডা-মিটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। কিন্তু এখন দিনেরাতে ঘরে একা থেকে বউয়ের মুখ দেখতে ভালো লাগবে?’
আমিও হেসে জবাব দিয়েছিলাম, ‘শুধু তোমার মুখ দেখব কেন, ফেসবুকে এখন আমার কত বন্ধু-বান্ধবী, এদের সঙ্গে আড্ডা দেব। তাছাড়া খাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা কখনো একা কিংবা বেকার থাকে না। দেশ ও মানুষের জন্য দায়িত্ব সবসময় তাদের থাকে।’
‘থাকো তুমি তোমার দায়িত্ব নিয়ে। দিনেরাতে ঘরে থেকে আমাকে জ্বালাবে না বললাম, বুড়ার তো আবার এই বয়সেও ভীমরতি ধরে।’
এই বয়সেও রেহানার স্বামীর জ্বালাতন সইবার আগ্রহ ও সহ্যধৈর্য দেখে অবাক হই। মেহেদি কলপ লাগিয়ে একটা চুলকেও ধূসর হতে দেয়নি এখনো, যুবতী বয়সের মতো রূপচর্চাও করে অনেকটা সময়। আড়ালে শাশুড়ির শখ-শৌখিনতা দেখে পুত্রবধূ টিটকিরি দেয় হয়তো, কিন্তু আমার ভালো লাগে, যৌবনবেলায় ভালোবাসাও উথলায় কখনো-বা। করোনাকালের এই আইসোলেশন এত ভালোবাসার বউয়ের সঙ্গেও চিরবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। গোপন আশংকায় বুক কাঁপে আমার।
সারাদিন সংসারে কাজে ও স্বামীর সেবা করে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে রেহানা, নিজের ঘরে একা হলে আর খোঁজ থাকে না। দিনে অনেক সময় একই বাসায় থেকেও পরস্পরকে ফোন করি, ফোনেও দরকারি কথাবার্তা হয় । কিন্তু রাতে ফোন করে আইসোলেশনে রেহানার নামাজ কিংবা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করে না। রাতে ঘুম হয় না আমার। আর এই সময়টা বড় একা লাগে, ভয়ও হয়। ছেলে সরকারি লোকজনকে ধরপাকড় করেও দুদিনেও আমার টেস্টের রেজাল্ট পায়নি। এদিকে জ্বরটা থার্মোমিটারে ধরা না গেলেও কখনো-বা মনের মিটারে তরতর করে বেড়ে যায়। তখন মনে হয়, এ-যাত্রা আর টিকব না। কাশির সঙ্গে টের পাই গলাটাও ব্যথা করছে। করোনা উপসর্গ নিয়ে দেশে প্রতিদিনই বিনা টেস্টে ও বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। ইউরোপ-আমেরিকা উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়েও করোনা মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, প্রতিদিনই হাজারে হাজারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও অপ্রতুল চিকিৎসা-সুবিধার দেশে যে শিগগিরই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকবে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয় মোটেও। আমার সৌভাগ্য যে, বাড়িতে বসেই টেস্টটা অন্তত হয়েছে। এরপর আক্রান্ত কিংবা করোনায় মৃত্যুর তালিকায় ঠাঁই পাই আর না পাই, শ্বাসকষ্ট উঠলে দেশের চিকিৎসাসেবার দৈন্যদশা হাড়েমজ্জায় অনুভব করেই শেষ নিশ্বাস ফেলাটাই হয়তো আমার নিয়তি।
বিছানায় শুয়েবসে ফোনটা হাতে চেপে ইন্টারনেটে করোনার বিশ্বপরিস্থিতি দেখি। ফেসবুকে প্রতিদিনই চেনা-অচেনা বন্ধুদের খবর খুঁজি। কিন্তু নিজের করোনা-উপসর্গের খবর ফেসবুকে দিয়ে বন্ধুদের ইলেকট্রনিক সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করিনি। অনেকেই ফেসবুকে নিজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তিগত খবরটিও জানায়। আবার অনেকেই কারো ব্যক্তিগত শোকদুঃখের খবর পড়েও শেয়ার কিংবা কমেন্টসের বদলে লাইক বাটন টেপে। আমি সত্তরঘেঁষা প্রবীণ এবং স্বীকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশ ও সামাজিক সমস্যার বিষয়ে নিজ মতামত রাখতে পছন্দ করি। সমর্থনও পাই অনেকের। সর্বশেষ পোস্টে কিচেনে কাজ করার ছবিটি পোস্ট করেছিলাম, সেটাও ছিল আসলে সংকটকালে সামাজিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই। করোনায় মৃত্যুর আগে, করোনাক্রান্ত ও আক্রান্ত হওয়ার আতংকে বিশ্বময় কোটি কোটি মানুষের উদ্দেশে কিছু লিখে রেখে যেতে চাই। জ্বর বাড়লে কিংবা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে লেখা হবে না, লিখলে এখনই লিখে যেতে হবে। কিন্তু কী লিখব?
আমার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা মনে পড়ে। ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ইন্ডিয়ায় গিয়ে যুবশিবিরে থাকার সময় রক্ত আমাশয় আর চোখের ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলাম। একা আমি নই, ইন্ডিয়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী অগণিত শরণার্থীর মধ্যে ছড়িয়েছিল এই জয়বাংলা ভাইরাস। আক্রান্ত মুক্তিকামী স্বদেশবাসীর সঙ্গে একাত্ম ছিলাম বলেই ভয় পাইনি, দেহের নিজস্ব প্রতিরোধশক্তিতে কয়েকদিনের মধ্যেই এমনি এমনি সুস্থ হয়েছিলাম। আজ একুশ শতকে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেওয়ার সময়ে করোনা-আতঙ্ক নিয়ে নিজ ঘরে একা হয়েছি বটে, বিচ্ছিন্ন তো হইনি। একাত্তরে একাত্ম ছিলাম শুধু মুক্তিকামী বাঙালি জাতির সঙ্গে, আর আজ দেশ ও জাতির গণ্ডি পেরিয়ে একাত্ম হয়েছি গোটা বিশ্বের মানবজাতির সঙ্গে। লকডাউন আর আইসোলেশনের ফাঁদে বাঁধা কোটি কোটি মানুষ আতঙ্কমুক্ত পৃথিবীতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মুক্তিকামী মানবজাতির ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার শক্তিতে করোনাভাইরাস অবশ্যই পরাজিত হবে, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে মানবজীবন। করোনার আগ্রাসী ক্ষুধায় আত্মসমর্পিত হওয়ার আগে মানুষের প্রতি এই আস্থা ও বিশ্বাসের কথাটা অন্তত ফেসবুকে লিখে যেতে পারি আমি।
মধ্যরাতে ফেসবুক খোলার জন্য যখন ঘরে আলো জ্বালাবার কথা ভাবছি, হঠাৎ ঘরে আলো লাফায়। চমকে চোখ মেলি, ভূত দেখার মতো আরো বেশি চমকে দেখি, রেহানা আমার ঘরে এসে সুইচবোর্ডের সুইচ টিপেছে।
‘তুমি এখানে! ঘরে ঢুকেছো কেন?’
রেহানা নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার বদলে ছুটে আমার বিছানায় আসে, আমি আঁতকে ওঠার আগেই কপালে হাত রেখে পরীক্ষা করে, ‘জ্বরটা কমেছে তোমার?’
চকিতে ভাবি, মধ্যরাতে আমার রিপোর্ট এসেছে হয়তো, ছেলের কাছে ফোনে জেনেছে, সরকারি টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ, অর্থাৎ আমার এসব উপসর্গ করোনা নয় আসলে। জানতে চাই, ‘আমার রিপোর্ট পেয়েছো?’
‘না। তবে সন্ধ্যাবেলায় একটা খারাপ খবর পেয়েছি, ইচ্ছে করেই জানাইনি তোমাকে।’
‘কী, খারাপ খবর?’
‘আমাদের কাজের মেয়ে রুহির স্বামীটা করোনায় মরেছে। বাচ্চাসহ তাকেও করোনায় ধরেছে। ওদের বাড়িটাও লকডাউন হয়েছে। অনেকেই পালিয়ে গেছে বাসা ছেড়ে। রুহি দারোয়ানের দেশের মেয়ে, ওর কাছেই শুনলাম খবরটা। তখন থেকে ভুলতে পারছি না মেয়েটার কথা।’
রুহির আবদার অগ্রাহ্য করে তাকে কাজছাড়া করতে খারাপ লেগেছিল, তার করোনাক্রান্ত হওয়ার খবর শুনেও গভীর সহমর্মিতা জাগে। রেহানাকে সান্ত্বনা দিই, ‘আমাদের কী করার আছে বলো। দুনিয়াজুড়ে এই মহামারি ঠেকাতে সোশ্যাল ডিসট্যান্স আইসোলেশন দিয়ে মানুষকে স্বার্থপর করে তুলেছে। কিন্তু তুমি কোয়ারেন্টাইন ভেঙে এ-ঘরে আসলে কেন?’
‘আমি তোমার আগে মরব। ছেলেমেয়েরা শুধু ফোনে সাহস দেয়, তোমার কাছে ঘেঁষতে না করে, কিন্তু এত স্বার্থপর হয়ে একা বাঁচতে পারব না আমি। রুহির খবরটা শোনার পর থেকে বুক ধড়ফড় করছে, এখন দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তোমার পাশে শুয়ে মরার জন্য ছুটে এলাম।’
আমি আতঙ্ক-বিহ্বল দৃষ্টিতে রেহানাকে দেখি। মরার আগে ফেসবুকে মানবজাতির জন্য কিছু আস্থা-ভালোবাসার বাণী লিখে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, তার আগে স্ত্রীর চেনা মুখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার আবেগ উথলে ওঠে। সংক্রমিত হওয়ার ভয় তুচ্ছ করে কিংবা সংক্রমিত হয়েছে বলেই হয়তো-বা, সে বিছানায় আমার পাশে, কপালে হাতও রেখেছে আমার। আমিও এবার রেহানাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘তোমাকে মরতে দেবো না আমি, তুমি বিছানায় শুয়ে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলার চেষ্টা করো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।’