আখতারুজ্জামান ইলয়িাস বেঁচে থাকবনে একটি উপন্যাস দিয়েই

খুব স্বল্প সময়ের জন্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জীবিত ছিলেন মাত্র চুয়ান্ন বছর; ১৯৪৩ থেকে ১৯৯৭ সাল অবধি। লেখালেখির জীবনে রচনা করেছেন মাত্র দুটি উপন্যাস, আটাশটি গল্প, কয়েকটি প্রবন্ধ। উপন্যাসদুটি হলো চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা। দুটিই কালোত্তীর্ণ। তবে আলোচিত হবে এখানে চিলেকোঠার সেপাই। বাংলাদেশের আরেকজন অগ্রজ কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। তিনি বেঁচেছিলেন আরো কম সময়, মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর। ১৯২২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছিল তাঁর জীবনপরিধি। কালজয়ী তাঁর রচনাও। লিখেছেন অসাধারণ তিন উপন্যাস – লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বেঁচেছিলেন তারও চাইতে কম সময়, মাত্র ৩৭ বছর। এর মধ্যেই রচনা করতে পেরেছিলেন তাঁর যুগশ্রেষ্ঠ উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম। স্বল্প আয়ু আর স্বল্প রচনা নিয়ে অমর হয়ে আছেন এমন লেখকের সংখ্যা অনেক। মূল বিষয় এখানে গুণগত মান, সংখ্যা নয়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাসমগ্র-১-এর ভূমিকায় খালিকুজ্জামান ইলিয়াস এ-বিষয়ে যে-মন্তব্য করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, ‘একজন লেখকের বলার কথা তো খুব বেশি নয়। একই কথা অবশ্য নানাভাবে, নানা ঢঙে বলা যায়, নানা ভঙ্গিতে কথার ওপর কথা চড়িয়ে গড়ে তোলা যায় কথার ফানুস; কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। এই শূন্যগর্ভ ফানুস গড়তে গিয়ে লেখক প্রকরণের দিকেই মনোযোগী হন বেশি। তখন প্রসঙ্গের সঙ্গে প্রকরণের ঘটে বিচ্ছেদ, এবং প্রায় অবধারিতভাবেই প্রসঙ্গ হয় অবহেলিত। তাই বলা চলে, প্রতিটি লেখাকেই জীবনের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ শিল্পকর্মে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হলে এবং নেহায়েত বণিকবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত না হতে চাইলে একজন লেখকের প্রকাশিত রচনার সংখ্যা খুব বেশি না হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতি চান এমন অনেক শিল্পসাধকের জন্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সীমিত, কিন্তু জ্ঞানগর্ভ রচনাকর্ম একটি বার্তা। তাঁদের অনেককেই সংখ্যা বাড়াতে খুব তৎপর দেখি, বিশেষ করে ‘একুশে’ সামনে এলে নতুন প্রকাশনা নিয়ে তাঁরা রীতিমতো ঘুম হারাম করে ফেলেন। মানের ঘাটতির জন্য এসব প্রকাশনা কেবল সংখ্যাই বাড়ায়, প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতি আনে না। এ প্রসঙ্গে প্রকাশকদের কথা না বললে মতামত অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। অতি তৎপরতা তাঁদের মধ্যেও দেখা যায়, ‘একুশে’র মেলায় বই তোলার জন্য তাঁরাও গলদঘর্ম থাকেন। সেখানেই ঘটে বিপত্তি। ভুলে ভরা থাকে অধিকাংশ পুস্তক। তাড়াহুড়ার ছাপ প্রতি পর্যায়ে। প্রুফ দেখার পেশাদারিত্ব একেবারেই উঠে গেছে মনে হয় আমাদের প্রকাশনাজগৎ থেকে। একুশের বইমেলা বই প্রকাশের বেলায় গুরুত্ব পাক বইপ্রেমী সকলেই তা চান, কিন্তু সেটি যদি হয় যেনতেন প্রকারে কেবল সংখ্যা বাড়ানোর জন্য, নিশ্চয়ই তা আপত্তিকর। আসলে বই প্রকাশিত হওয়া উচিত বছর জুড়ে, ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। তাতে প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা বাড়বে।
সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে কালের দর্পণ, ইতিহাসের উপাদানের আধার। কথাসাহিত্যের বেলায় এটি বেশি করে সত্য। অনেক ক্ষেত্রে কথাসাহিত্য যা পারে, ইতিহাস তা পারে না। কথাসাহিত্যিক যতটা আবেগ মিশিয়ে বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে সমর্থ হন, ইতিহাসকার ততটা নন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই এর জ্বলজ্বলে প্রমাণ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র; তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং পরিপার্শ্ব পাঠকের সামনে এমনভাবে উপস্থাপিত, যেটি কেবল ঔপন্যাসিকের পক্ষে সম্ভবপর, ইতিহাসকারের পক্ষে নয়। তবে মনে রাখতে হবে, কথাসাহিত্য ইতিহাসের সম্পূরক নয়। কথাসাহিত্যে সংগতকারণেই থাকে রঙের প্রলেপ, কল্পনাশক্তির মিশেল। ভাবাদর্শ কথাসাহিত্যিককে এদিক-ওদিক টানে, হেলায় – পাঠক তা মেনে নেন। কিন্তু ইতিহাসের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। হেলানো ইতিহাস পাপের শামিল, আখেরে তা টেকেও না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই বুঝতে হলে সহপাঠ হিসেবে কিছুটা ইতিহাসের পাঠ লাগবে, অথবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসকে ঠিকঠাকমতো বুঝতে হলে চিলেকোঠার সেপাই পাঠ খুব কার্যকর হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রথম ধাপের বিজয়ের স্মারক এই অভ্যুত্থান। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে তাঁকেসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের সরকার পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে দায়ের করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। আসামিরা ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একই বছরের জুন থেকে শুরু হয় এই মামলার কার্যক্রম। সাজানো এ-মামলার বিরুদ্ধে মাঠে নামে আপামর জনসাধারণ, অংশগ্রহণ দিনকে দিন কেবল বাড়তেই থাকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ একতাবদ্ধ হতে শুরু করে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ বরাবরই প্রাগ্রসর। আটষট্টি সালের ডিসেম্বর মাসেই একতাবদ্ধ হয়ে তারা গঠন করেছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। নতুন বছর, অর্থাৎ ঊনসত্তরের জানুয়ারিতে তারা ঘোষণা করে ১১ দফা, যাতে ছয় দফার সারবস্তুকে ধারণ করা হয়েছিল। এরপর ছাত্র-জনতার মিলিত আন্দোলনে আইয়ুবের মসনদ কেঁপে ওঠে। আন্দোলনের তীব্রতায় ভীতসন্ত্রস্ত আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দেন, এবং নিজে ২৫ মার্চ তারিখে সেনানায়ক ইয়াহিয়া খানের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারির মাধ্যমে শাসনকার্যের সূচনা করেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই অর্জনের পেছনে আছে অনেক ত্যাগের ঘটনা। মোকাবিলা করতে হয়েছে কার্ফ্যুসহ নানা কালাকানুন। যত্রতত্র নিক্ষিপ্ত হয়েছে টিয়ারগ্যাস-গুলি, যার শিকার হয়েছে ছাত্র-জনতা। যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল গোটা দেশে। ঊনসত্তরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি সময়কালে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদ, মতিউর, রুস্তম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে। জানা-অজানা আরো অনেক মানুষ প্রাণ হারান, আহত ও পঙ্গু হন।
ঊনসত্তর নিয়ে বইয়ের ফ্ল্যাপের বক্তব্য, ‘১৯৬৯ সালের পূর্ব বাঙলা। কী এক জীবনস্পর্ধী মন্ত্রের মুখে বিস্ফারিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনো কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনো ঘুম-ভেঙে-দেওয়া আঁধির ঝাপটায়। মিটিং, মিছিল, গুলিবর্ষণ আর কার্ফ্যু-ভাঙা আর গণআদালত – সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে – ‘মুক্তি’। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তির সেই দুর্নিবার আকাক্সক্ষার একেবারে মর্মমূলে প্রবেশ করে স্বরূপ তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে বিস্ময়কর কুশলতায়। রাজনীতির নানামুখী স্রোত তাঁর বিবরণ থেকে বাদ পড়েনি। উপন্যাসের চরিত্রদের কথোপকথনে ধরা পড়ে কে কোন ধারার লোক। মূলধারাকে চিনে নিতেও অসুবিধা হয় না। তবে আনকোরা পাঠকের জন্যে কিছুটা সহপাঠ আবশ্যক হবে, যার ইঙ্গিত আগে দেওয়া হয়েছে।
ঊনসত্তরের ঘটনাবলি তুলে ধরতে গিয়ে আখতারুজ্জমান ইলিয়াস তাঁর উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাইয়ে সে-সময়ে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসমূহের ভূমিকা ও ভাবাদর্শ বিভিন্ন চরিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। রাজনীতির মাঠে তখন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও তাদের ছাত্রসংগঠন এনএসএফ মূলত পুলিশের ছত্রছায়ায় সক্রিয় ছিল। জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারঘেঁষা কিছু দল ও সংগঠনের পায়ের তলায় মাটি বলতে গেলে ছিলই না। অপরপক্ষে প্রবল প্রতাপ ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের। শেখ মুজিব অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন। সরকারবিরোধী সংগ্রামে বাম সংগঠনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল; তবে তাদের মতাদর্শগত বিরোধ ছিল ব্যাপক।
বামপন্থিদের এই বিরোধ ১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সূচিত। সেই সংঘর্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষ নেওয়ায় ভাঙন দেখা দেয় বাম শিবিরে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সংক্ষেপে ন্যাপ, বিভক্ত হয় দুই ভাগে। মওলানা ভাসানী একভাগের নেতৃত্ব দেন পিকিংপন্থি পরিচয়ে, অপরাংশের প্রধান হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মস্কোপন্থি হিসেবে। ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ নামে সমাজতন্ত্র-অন্বিষ্ট ছাত্র সংগঠনও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে; একভাগ পিকিংপন্থি, অপরভাগ মস্কোপন্থি। একইভাবে বিভক্ত হয় কমিউনিস্ট পার্টি; একদল পিকিং অনুসারী, অপর দল মস্কোর। পিকিংপন্থিদের মধ্যে ছিল আবার নানা মত ও নানা পথের মানুষ; তত্ত্ববিভ্রাট ছিল নেতাদের ভেতর প্রবল। তাঁদের কারো কারো আশীর্বাদপুষ্ট ছিল চরমপন্থিরা, যারা জোতদার নির্মূলকে মুক্তির নিয়ামক ভাবত। ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে গণআদালত বসাত সেই জোতদার-ভূস্বামীদের বিচারের উদ্দেশ্যে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বর্ণনায় উঠে এসেছে তার সবই। উপন্যাসের একেকটি চরিত্র একেকটি ধারার প্রতিনিধি। অভ্যুত্থানের প্রভাব গ্রাম-শহর সর্বত্র দৃশ্যমান ছিল। ইলিয়াসের কাহিনিও গড়িয়েছে শহর ছাড়িয়ে গ্রামে, এমনকি গ্রামের দুর্গম চরাঞ্চল পর্যন্ত তাঁর কথামালা বিস্তৃত। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাস ওসমান গনি ওরফে রঞ্জুর। রহমতউল্লার সর্বত্র দৃশ্যমান ছিল; ইলিয়াসের কাহিনিও গড়িয়েছে শহর ছাড়িয়ে গ্রামে, এমনকি দুর্গম জরাজীর্ণ বাড়ির চিলেকোঠায় তার একাকী জীবনযাপন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর পিতা ভারত থেকে পাকিস্তানে এসে বসবাস শুরু করলেও কিছুদিন পর বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের জন্যে যে-শাসনতন্ত্র জারি করেন, তাতে মৌলিক গণতন্ত্র নামক এক অদ্ভুত বিধানের সংযোজন ঘটানো হয়। এতে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ৮০ হাজার মানুষকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটার করা হয়েছিল। এরা প্রকৃতপক্ষে আইয়ুবের সুবিধাভোগী। তাদের বলা হতো বিডি মেম্বার। রহমতউল্লা সেই বিডি মেম্বারদেরই একজন, আইয়ুবের সমর্থক, আন্দোলনবিরোধী। পেশায় রিকশা গ্যারেজ ব্যবসায়ী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে মহাজন বলে পরিচিত এই রহমতউল্লা। পাশের গ্যারেজের মালিক আলাউদ্দিন, রহমতউল্লার ভাগ্নে। আলাউদ্দিন ঊনসত্তরের আন্দোলনে সম্পৃক্ত, নেতা মানেন শেখ মুজিবকে। আলাউদ্দিনের গ্যারেজের কর্মচারী হাড্ডি খিজির আলাউদ্দিনের অনুসারী। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্যে সে জান কোরবানে প্রস্তুত। খিজিরের আন্দোলন-সম্পৃক্ততা নজিরবিহীন, মিছিল-স্লোগান, সভা-সমাবেশে তার উপস্থিতি শতভাগ। মুক্তির প্রশ্নে সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ। প্রতিবাদমুখর সে মহাজন রহমতউল্লার বিরুদ্ধেও – যে কিনা অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ভোগ্যা বানিয়েছে তার মা ও স্ত্রী উভয়কে। নিজের উপলব্ধি ও জিজ্ঞাস্য চাপা রেখে ওসমান দেখে যায় সব। তবে সর্বপ্রথম দেখে তালেবের লাশ নিয়ে কাড়াকাড়ির দৃশ্য। আন্দোলন জুড়ে ছিল লাশের মিছিল, পুলিশ সেনাবাহিনীর হাতে অকাতরে জীবন দিচ্ছিল ছাত্র-যুবা-তরুণরা। এদেরই একজন তালেব, ওসমান যে-ভবনের চিলেকোঠায় থাকে সেই ভবনেরই বাসিন্দা ছিল সে। মা-বাবা, ভাইবোনদের নিয়ে একসঙ্গে থাকত। পুলিশের গুলিতে অকারণে মারা যায় ছেলেটি। লাশ নিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ হতে পারে – এই ভয়ে রহমতউল্লার সহায়তায় দ্রুত দাফনের কাজ সারতে চায় পুলিশ। সারেও।
আনোয়ার, আলতাফ, সিকানদার, ইফতিখার, ফরিদ – এরা ওসমানের বন্ধু। আনোয়ারের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য এই যে, অন্যরা আন্দোলনের
গতিপ্রকৃতি, নেতৃত্ব, দাবিনামা ইত্যাদি বিষয়ে একমত। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সকলে একাট্টা, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে ক্ষমতায় যাওয়াকে তারা বাঞ্ছিত মনে করেন। অন্যদিকে আনোয়ার বহুধাবিভক্ত বামপন্থি রাজনীতির প্রতিনিধি। আনোয়ারের খোঁজে ওসমান একদিন তার বাসায় গেলে আনোয়ারের বড়ভাই মন্তব্য করেন, ‘ওদের পার্টি তো প্রায়ই ভাঙছে। এখন ও যে কোন গ্রুপ বিলঙ করে, সেই গ্রুপের বেস কোথায়, – নোয়াখালী না পাবনা না যশোর না চিটাগাং – এসব অঙ্ক মেলাতে পারলে ওর হোয়্যার অ্যাবাউট জানতে পারবে।’
চতুর্দিকে মিটিং-মিছিল আর পুলিশি তৎপরতার ভেতর ওসমান ও তার বন্ধুদের আমজাদিয়া হোটেলের এক আড্ডার কথাবার্তা খেয়াল করলে মতামতের ভিন্নতা ধরা পড়ে। আনোয়ার – ‘এর আগে পিপল যেসব মুভমেন্টে একটিভলি পার্টিসিপেট করেছে, সেগুলো হয়েছে এক একটি এলাকা জুড়ে। ধরো তেভাগা, ধরো হাজং কিংবা সাঁওতালদের বিদ্রোহ – এগুলো বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, তাই না? কিন্তু এরকম সমস্ত প্রভিন্স জুড়ে।’ আনোয়ার বলতে থাকে, ‘এই ব্যাপক আন্দোলন কি কেবল অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ আর পার্লামেন্টারি ফর্ম আর অটোনমির জন্যে? আর কিছু না?’ প্রত্যুত্তরে আলতাফ, ‘ভোটের রাইট চাই আগে। ক্ষমতায় আসতে না পারলে বাঙালি কিচ্ছু করতে পারবে না।’ আলতাফ এরপর বৈষম্যের ফিরিস্তি দেয়। আনোয়ারের প্যাচাপ্যাচি এতেও বন্ধ না হলে সিকানদার উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘ঐগুলি ছাড়েন। বাখোয়াজি বহুত শুনছি। স্বাধীনতার কথা বলেন। স্বাধীনতা! মাওরাগো হাত থাইকা বাঁচার উপায় ঐ একটাই।’ আনোয়ার থামে না, বলে ‘ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেল পদ পাওয়া – এসব ভদ্রলোকের প্রব্লে­ম। এই ইস্যুতে ভোটের রাইট পাওয়ার জন্যে মানুষের এতো বড়ো আপসার্জ হতে পারে?’ – ‘পারে। মানুষ গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ করতে পারে।’ – ‘ভোটের রাইট পাওয়ার জন্যে মানুষ প্রাণ দেবে?’ – ‘দেবে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্যে মানুষ যুগে যুগে প্রাণ দিয়ে এসেছে।’ – ‘ভোট দিলেই কি সব মানুুষের জন্য গণতন্ত্র আসে?’ – ‘আসে। ভোট দেওয়ার অধিকার গণতন্ত্রের একটা বড়ো শর্ত। তোমরা ভোট নিয়ে তোমাদের প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করতে পারবে।’ আলতাফকে সমর্থন দিয়ে ফরিদ আনোয়ারের উদ্দেশে বলে, ‘ইলেক্টেড হতে না পারলে আপনি বুঝবেন কি করে যে, আপনার পক্ষে মানুষ আছে? আপনি কার হয়ে কথা বলবেন?’
এরপর আনোয়ার মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের কথা তুলে মন্তব্য করে যে, এ-নেতৃত্ব দ্বারা সাধারণ মানুষের উপকার হবে না। প্রতিবাদ করে ফরিদ, আলতাফ। আলতাফ যুক্তি দেখায় যে, সব দেশেই এমনটি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সামনে আনে লেনিন,
চৌ-এন-লাইয়ের নেতৃত্বকে, যারা এসেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই। আলতাফ মত ব্যক্ত করে ‘আপসার্জ তো আকাশ থেকে পড়েনি! এর জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এই প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ করেছে কোন অর্গানিজেশন, বলো? দিনের পর দিন মিটিং করে, জেল খেটে -।’
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এখানে রাজনীতি-বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সেদিনের বাস্তবতা ছিল এরকমই। হোটেলে চায়ের টেবিলে, বৈঠকি আড্ডায় অবধারিত ছিল রাজনীতি। ভোটের অধিকার, নির্বাচন, ক্ষমতা ও মুক্তির পক্ষে ছিল গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ যেমনটি দেখা গেল ওসমান ও তার বন্ধুদের হোটেল আমজাদিয়ার আড্ডায়। লেখক রাজনীতিকে উপজীব্য করেছেন ঠিক, তবে উপন্যাসের আবেদন নষ্ট করে নয়। মূলধারার বাইরে বামপন্থি রাজনীতি যেমন আলোচনায় এসেছে, তেমনি এসেছে আইয়ুবের বিডি মেম্বারদের কথা। আইয়ুব খানের একান্ত বাধ্য মোনায়েম খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার জন্যে তিনি গঠন করেছিলেন ‘এনএসএফ’ নামক গুন্ডাবাহিনী, এদের উৎপীড়নের কথা বিধৃত করতেও ভোলেননি। ঈদের দিন রাতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি ফেরার পথে আক্রান্ত হয় এক দম্পতি, স্বামীকে ঘণ্টাখানেকের জন্যে অপেক্ষা করতে বলে স্ত্রীকে নিয়ে যায় এনএসএফের তিন গুন্ডা ফুর্তি করতে। ট্যাক্সি-ড্রাইভার খিজির আলী বা হাড্ডি খিজির থানায়, কিংবা হলে ছাত্রদের খবর দিতে বললে সেকশন অফিসার স্বামী নিজের ক্যারিয়ার ঠিক রাখার স্বার্থে রাজি হয় না। কী নিষ্ঠুর আপসরফা আমলাতন্ত্রের এক সদস্যের! ইলিয়াসের চোখ এড়ায় না তাও।
পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার মহাজন রহমতউল্লার মতো বিডি মেম্বারের দেখা মেলে গ্রামেও আনোয়ারের আত্মীয়দের মাঝে। প্রচুর সহায়সম্পদের মালিক খয়বার গাজী একজন বিডি মেম্বারও। থানা পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের হাতে রেখে সে অপকর্ম করে বেড়ায় নানা রকম। গরুচুরির সরদারও সে। দুর্গম ডাকাতমারা চরে খোঁয়াড়ের নাম করে গরুচুরির আস্তানা গড়ে তোলে খয়বার গাজী আরেক দুর্বৃত্ত হোসেন আলী সরকারের সহায়তায়। প্রয়োজনমতো খুনখারাবি করায় অবলীলায়। খয়বার গাজীর ভাতিজা আফসার গাজী অপকর্মের আরেক হোতা। অবৈধ বিভিন্ন পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে সেও।
ঊনসত্তরের আন্দোলনের সময় সহায়ক পরিবেশ তৈরি হলে আলীবক্সের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলে গ্রামের নিঃস্ব, রিক্ত মানুষ। এ ব্যাপারে সহায়-সম্বলহীন চেংটু খুব অগ্রণী ও সাহসী ভূমিকা পালন করে। আলিবক্স অসীম সাহসী বামপন্থি কর্মী, শ্রেণিশত্রু খতমের দর্শনে বিশ্বাসী। শহুরে বড় নেতাদের পার্টি ভাঙাগড়ায় বিরক্ত। গ্রামের বাড়িতে আনোয়ারের সঙ্গে দেখা হলে মন্তব্য করে, ‘আপনারা ঢাকাত বস্যা বড়ো বড়ো কথা কন আর পার্টি ভাঙেন। মতিনভাই আমাগোরে এলাকায় আসলো, দল থ্যাকা ভালো ভালো কয়েকটা কর্মী আলাদা হয়া গেলো। এরকম করলে কাম হয়? জনগণতান্ত্রিক কন আর স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক কন, উপনিবেশ কন আর আধা উপনিবেশ কন, গাঁয়ের মধ্যেকার শয়তানগুলাক শ্যাষ করবার না পারলে কোনো কাম হবো না।’ আনোয়ারের উত্তর – ‘সে তো বটেই। কিন্তু এইসব শয়তানের মুরুব্বিরা তো থাকে ঢাকা ইসলামাবাদ।’ আলিবক্সের কথা, ‘গাঁয়ের মানুষ তো অগোরে চেনে না। আর এই শয়তানগুলা শ্যাষ হলে মুরুব্বিরা খাড়াবো কোন জমির উপরে? আমরা পুবের চরের এলাকাত সব একসাথে শয়তান খতমের কামে নামছি।’ আলিবক্সের নেতৃত্বে তার কর্মীরা ডাকাতমারা চরে হোসেন আলির আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়, তাকে হত্যা করে। গণআদালত বসায় গ্রামে। খয়বার গাজীকে তোলা হয় কাঠগড়ায়। মৃত্যুদণ্ডের রায় হয় তার। খয়বার গাজী আনোয়ারের আরেক আত্মীয় জালাল মাস্টারের মাধ্যমে পরের দিন জুমা পর্যন্ত প্রাণদ- স্থগিত চায়, বরাবরের মতো পরের দিনের জুমার নামাজটা সে পড়তে চায়। তার আর্জি মঞ্জুর হয়, আর এই সুযোগে পালিয়ে যায় খয়বার গাজী। সময় গড়াতে থাকলে মতলববাজরা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী, জবরদখলকারী ও দুশ্চরিত্র আফসার গাজী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মেশে ও দেদার খরচ করে হয়ে যায় তাদের নেতা। স্থানীয় ছাত্ররা তার পিছু-পিছু ঘোরে।
এরই পরিণতি হয়তো আন্দোলনে গভীরসম্পৃক্ত চেংটুর মতো কর্মীর হত্যাকাণ্ড। হতদরিদ্র চেংটু খয়বার গাজীদের মতো পাপিষ্ঠদের বিচারের ব্যাপারে স্থির সংকল্পবদ্ধ ছিল। তার মন্তব্য, ‘শালা খয়বার গাজী মানুষের পয়দা না। কতো গরীব মানুষের উজিউজগার তাই বন্ধ কর‌্যা দিছে! গোরু হারালে চাষামানুষ কাম করবার পারে? আম্রা ওর বিচার করমু। ওর ভাইয়ের ব্যাটা আফসার গাজী, মিয়াবাড়ির অশিদুল, ফকিরবাড়ির ফরিদ, – সোগলির বিচার হবো। আফসার শালা আছে খালি মাগীমানষের পাছাত, চাষাভুষার ঘরত এয়ানা সুন্দর মাগীমানুষ দেখলে তাই খালি ফাল পাড়ে। আর শালা অশিদুল করে কি জানেন? – এক জমিত কাকো তাই দুই তিন বারের বেশি বর্গা করবার দিবো না! শালা এক জমি পাঁচজনের কাছে বর্গা দেয়, বর্গাদাররা কাইজা করে অশিদ মিয়া মজা মারে। তাই -।’ পরিস্থিতি অনুকূলে এলে খয়বার-আশরাফরা চেংটুকে বাঁচতে দেয়নি, তাকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে পার্শ্ববর্তী স্থানে। এর আগে খয়বার-হোসেন আলীদের হাতে মারা পড়ে পচার বাপ। চুরি হওয়া গরু ফিরিয়ে আনতে গিয়ে হোসেন আলির দাবিমতো সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় পথিমধ্যে তাকে মেরে ফেলা হয়। পরে আলিবক্সও চরমপন্থি কার্যকলাপের দরুন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হয়।
চেংটুর মতো খিজির আলীও আন্দোলন অন্তপ্রাণ, প্রতিবাদী ও সাহসী। বাঁচতে পারেনি সেও। আন্দোলনের অন্তিমলগ্নে কার্ফ্যু উপেক্ষা করে মিছিল বের করে খিজির ওরফে হাড্ডি খিজির। লেখকের ভাষায়, ‘রাস্তায় যখন নামে খিজিরের সঙ্গে ছিলো মোটে কয়েকজন, গওসল আজম স্যু ফ্যাক্টরির কর্মীরা। সেই কয়েকজনের শ্লোগানের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তোলে মহল্লার সবগুলো গলি উপগলি জুড়ে। এখন এ-গলি ও-গলি থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে। নবদ্বীপ বসাক লেনের টুটাফাটা কাঁথা, বেঢপ কোট ও রংজ্বলা জামা গায়ে বেরিয়ে আসে ১০/১২ জন মানুষের একটা দল। পাঁচভাই ঘাট লেনের শামসুদ্দিনের রুটির কারখানার লোকজন বেরিয়ে এসেছে তন্দুরের ওম ছেড়ে। হৃষীকেশ দাস রোডের গ্যারেজ থেকে আসছে রিকশাওয়ালার দল। ঠাকুরদাস লেনের ৫/৬ জনের ১টি নীরব মিছিল সরব হয়ে ওঠে কলুটোলার মানুষের মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। মানুষের সংখ্যা অনুমান করা মুশকিল। দরকারই বা কি? আকাশে চাঁদ নাই, নির্মেঘ আকাশে তারা আছে বটে, তবে তার আলো নামে কুয়াশা চুয়ে। এর সঙ্গে মেশে ল্যাম্পপোষ্টগুলোর হলুদ আলো। কালচে হলুদ আলোর নিচে মানুষের সারি ক্রমে দীর্ঘ হয়, খিজিরের গা একেকবার ছমছম করে ওঠে, সে নিশ্চিত যে মহল্লার বহুকালের পুরনো বাসিন্দারা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। … আর একটু এগিয়ে গেলে দেখা যায় শ্যামাচরণ চৌধুরী লেনের মানুষ। ঈশ্বরদাস লেনের মানুষ আসে বাণী ভবনের কলেজ ছাত্রদের সঙ্গে। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের পাশের মুচিপাড়ার এতো ছেলে এসেছে! গলি-উপগলি শাখা-গলি থেকে এই যে ছলকে ছলকে মানুষ, এর ফলে সামনে পেছনে মিছিল কেবল বেড়েই চলে। এতে খিজির পড়ে মিছিলের মাঝামাঝি। সামনে যাওয়া দরকার। উত্তর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। ঐদিকে যাওয়া চাই। কার্ফ্যু ভেঙ্গে শালার টুকরা টুকরা করে ফেলো কালো আকাশ। হঠাত ১ মুহূর্তের জন্য চোখে পড়ে জুম্মনকে। হাত উঁচু করে জুম্মন শ্লোগান দিচ্ছে, তার পাশে আরো কয়েকটা পিচ্চি। সবগুলোই বস্তি এলাকার ছ্যামরা। এর মধ্যেও জুম্মনের হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার দেখে খিজিরের হাসি পায়। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলার সময় নাই। হাওয়ায় শোনা যায় মালীবাগ, কমলাপুর, শাজাহানপুর থেকে, নাখালপাড়া, মনিপুরীপাড়া থেকে হাজার হাজার মানুষ কার্ফ্যু ভেঙ্গে ছুটে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ক্যান্টনমেন্টের চারদিকের দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলা হবে আজ রাতে, বিশাল সমাবেশের সমবেত আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে মিলিটারির গুদাম গুদাম হাতিয়ার। কিংবা হাতিয়ার সব চলে আসবে মানুষের হাতে। খিজিরের হাত তো আজ খালি, তার স্ক্রু-ড্রাইভার ও প্লায়ার সে দিয়ে এসেছে জুম্মনের হাতে, ২/৪টা হাতিয়ার নিতে খিজিরের আজ কোনো ঝামেলা হবে না। চুতমারানি মিলিটারিকে আজ ভাসিয়ে দেবে পেচ্ছাবের ফেনার মতো।’
খ- খ- মিছিল বিভিন্ন দিক থেকে এসে মূল মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। খিজির পেছনে পড়তে চায় না, ওভারটেক করে সামনে এগোয়। কিন্তু একেবারে সামনে পৌঁছবার আগেই শাঁখারীবাজারের দিক থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে একটি ট্রাক এসে থামে পুরনো স্টেট ব্যাংক বিল্ডিংয়ের গেটে, পরে আরেকটি। দুটিই মিলিটারির লরি। সেনা উপস্থিতি দেখে শতগুণ জোরে উচ্চারিত হতে থাকে মানি না-মানি না স্লোগান। ততোধিক জোর আওয়াজ নিয়ে বর্ষিত হতে থাকে সেনাদের গুলি। খিজিরসহ অনেকেই প্রাণ হারায় তৎক্ষণাৎ। স্থানীয় রিকশা গ্যারেজের মালিক ও বিডি মেম্বার রহমতউল্লা খিজিরের মা ও স্ত্রী উভয়কেই ভোগ্যা বানিয়েছিল। খিজির এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, পারেনি। তার নিজের মহাজন ও স্থানীয় আন্দোলনকারীদের নেতা আলাউদ্দিন আত্মীয়তার কারণে, ও তার মেয়ে সিতারাকে বিয়ে করার লোভে পক্ষ নিয়েছিল রহমতউল্লার। প্রতিশোধ না নিতে পারার বেদনা তার রয়েই গেল। তবে খিজিরের রক্ত বৃথা যায়নি, আন্দোলন সফল হয়েছিল।
চিলেকোঠার ওসমান সবকিছু দেখেশুনে উন্মাদপ্রায়। তার নিজের ঘরে তাকে পাহারা দিয়ে আবদ্ধ রাখে বন্ধু ও সুহৃদ আনোয়ার। ওসমান এই বন্দিজীবন ঘোচাতে চায়, শক্তি জোগায় খিজির। জীবিতদের চাইতে শহীদদের আহ্বান বোধ করি শক্তিশালী বেশি! সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে, কার্ফ্যুর দাপট অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসে পথে।
এভাবেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে অসামান্য দক্ষতায় তুলে আনেন তাঁর উপন্যাসে। শিল্পসুবাসিত চিলেকোঠার সেপাই কি তাঁকে বাঁচিয়ে না রেখে পারে?