মৃত্যুঞ্জয়ী আনিসুজ্জামান : তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও তাঁর লেখালেখিতে বাংলাদেশের শিল্পী ও শিল্প

‘মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে পারে না, কিন্তু কেউ কেউ মৃত্যুকে জয় করতে পারে।’ কথাগুলো লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান ২০০৬ সালে তাঁর এক প্রিয় শিল্পীবন্ধু নিতুন কুন্ডু সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর। নিতুন কুন্ডু ছিলেন আনিসুজ্জামানের সমবয়সী। মারা গিয়েছিলেন ৭০ বছর বয়সে। নিতুন কুন্ডুকে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষদের একজন আখ্যায়িত করেছেন। আনিসুজ্জামান মৃত্যুবরণ করেন তিরাশি বছর বয়সে। তিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন। মৃত্যুঞ্জয়ী যথার্থই। তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন। তাঁকে নানা সম্মানজনক বিশেষণে অভিষিক্ত করা হয়, তবে মূলত তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, বেশি সময় তাঁর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাতেই। মৃত্যুকালে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক।
আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে দেশের ও দেশের বাইরের অগণিত মানুষের মতো ব্যক্তিগতভাবে আমিও গভীরভাবে শোকাহত। বেশ কিছুদিন রাজধানীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নানা উপসর্গ নিয়ে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন, শেষ পর্যায়ে তাঁকে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তরিত করা হয়। দুঃখজনকভাবে ১৪ মে সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাঁর শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস শনাক্ত হয়। একই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুর দুদিন আগে কোভিড-১৯ চিকিৎসাধীন আমার স্ত্রীর (যিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্নেহধন্য প্রাক্তন ছাত্রী) ছোটভাই প্রখ্যাত রেডিওলজিস্ট মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) ডা. আবুল মোকারিম মো. মোহসিন উদ্দিন, পিএইচ.ডি, মাত্র ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পরপর দুজন কাছের মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষার শর্ত মানতে বাধ্য হয়ে তাঁদের মৃত্যুপরবর্তী আনুষ্ঠানিকতায় ‘অমানবিক দূরত্ব’ রক্ষা করতে হয়েছে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে দীর্ঘকাল দেখেছি, জেনেছি। তাঁর নানামুখী কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তাঁর অজস্র লেখা পাঠের সুযোগ পেয়েছি, তাঁর তুলনাহীন বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে কিছু কাজ করারও দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির ‘অমর একুশে বক্তৃতা’য় আমি ছিলাম বক্তা, তিনি সম্মানিত সভাপতি, এতে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন, তাতে আমার বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন, একই সঙ্গে দুয়েকটি তথ্যগত ভুল সংশোধন করে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। বক্তৃতা অনুষ্ঠানের পর আমরা একাডেমির মহাপরিচালকের সভাকক্ষে দীর্ঘ সময় চায়ের আসর উপভোগ করেছি। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে সম্প্রতি দেশে একটি ভিন্ন চরিত্রের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখনো ছাত্র ভর্তি বা পাঠদান কার্যক্রম শুরু হতে পারেনি, সবকিছু প্রস্তুত ছিল এমন পরিস্থিতিতে করোনার কারণে শুরুটা বিলম্বিত হচ্ছিল। রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি চেয়ারম্যান, আমি অন্যতম সদস্য। রাজধানীর উত্তরায় স্থাপিত হয়েছে এর অস্থায়ী ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর নিজস্ব স্বপ্ন ছিল, যেমন ছিল এবং এখনো আছে তাঁর স্নেহধন্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও আমার মতো ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যদের। বর্তমানে এর উপাচার্য পদে আসীন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক বাংলা সাহিত্যের কৃতী গবেষক ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রাক্তন ছাত্র ও পরে সহকর্মী ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। বিশ্ববিদ্যালয়টি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতির প্রতি যথার্থ সম্মান দেখানো হবে।
আজীবন শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নিজস্ব শিক্ষা-ভাবনা ছিল। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে হাত দিয়েছিলেন, সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজেও। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঘটনাক্রমে তিনটি কাজের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন : উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য হিসেবে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যুক্ত হয়েছিলেন এর বাংলাভাষ্য রচনায় মূল ভূমিকা পালনে এবং শিক্ষানীতি প্রণয়নে অনেক বেশি প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখেছেন ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে। ড. আনিসুজ্জামান তাঁর সুদীর্ঘকালের শিক্ষকতা জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার যে-সুযোগ পেয়েছিলেন সেটির শুরুতেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে, অশেষ দুঃখ আমাদের। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শিক্ষা-দর্শন নিয়ে তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে (২০১৭ সালে) অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত আনিসুজ্জামান সম্মাননা গ্রন্থে আমি একটি স্বল্পপরিসর প্রবন্ধে কিছু কথা লিখেছি (নজরুল ইসলাম, ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামান’, পৃ ১৬৩-১৬৭)। তাঁর শিক্ষা-দর্শনে সর্বজনীন শিক্ষা, একমুখী শিক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, কারিগরি শিক্ষা, নারীশিক্ষায় গুরুত্বারোপ ও গুণগত মানবিশিষ্ট উচ্চশিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতি তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বহুবিধ পরিচয়ের মধ্যে ছিল, তিনি ভাষা-আন্দোলনের একজন তরুণ সৈনিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সার্বক্ষণিক বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা ও কর্মী, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রত্যয়ী পুরোধা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে ও সাক্ষ্য প্রদানে অসম সাহসী মানুষ, বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়নে ভাবাবেগহীনভাবে বস্তুনিষ্ঠ (‘ইতিহাস থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। সগৌরবে নিজের আসনে আসীন তিনি, আসীন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। জয় হোক তাঁর।’) (আনিসুজ্জামান, ‘জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ’, কালি ও কলম, মাঘ ১৪২৬, পৃ ২৩-২৫)।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বড় পরিচয় তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর বিদগ্ধ রচনাবলির জন্য তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। তাঁর তরুণ বয়সের পিএইচ.ডি (১৯৬২) অভিসন্দর্ভনির্ভর যে-প্রকাশনা মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৪, লেখক সংঘ প্রকাশনী, ঢাকা), সেটিই তাঁকে বাংলা ভাষার গবেষণা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে দিয়েছিল। প্রায় চার দশক পর প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের প্রথমটি কাল নিরবধি (২০০০, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা), পরে আমার একাত্তর (১৯৯৭, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা) ও সর্বশেষ বিপুলা পৃথিবী (২০১৫, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা)। সম্মিলিতভাবে প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠার এই মহাগ্রন্থ শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পরিপার্শ্ব নিয়েই নয়, তাঁর সমকালের বাংলা ও বাঙালির এক অসাধারণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্মোচন। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের জন্য এ-গ্রন্থের পাঠ বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
আনিসুজ্জামান মূলত লিখেছেন ভাষা, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে। তাঁর যেসব লেখা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি তা হলো বাংলাদেশের শিল্পী ও তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁর লেখালেখি। অথচ আমার বিবেচনায় এ-বিষয়ে তিনি খুবই প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন। শিল্পীদের নিয়ে তাঁর প্রবন্ধের একটি আলাদা সংকলন সহজেই হতে পারত।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও যোগাযোগের পাশাপাশি লেখালেখির একটি দিকে কিছুটা মিল রয়েছে। তা হলো, বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী ও তাঁদের চিত্রকর্ম নিয়ে। এদেশের প্রথম, দ্বিতীয় ও তার পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের অনেকের সঙ্গে আমাদের দুজনেরই জানাশোনা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল।
আনিসুজ্জামান প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র, তবে বয়সে মাত্র দু-বছরের। আমরা দুজনেই পুরনো ঢাকার একই স্কুল (নবাবপুর সরকারি বিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছি, তিনি ১৯৫১ সালে, আমি ১৯৫৬ সালে। আমি ১৯৫১ সাল থেকে ওই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের দুজনের বসবাসও ছিল একই মহল্লায়, ঠাটারীবাজার (কাপ্তানবাজার) তথা বিসিসি রোড এলাকায়। একই স্কুলের এবং একই মহল্লার মানুষ হলেও ছেলেবেলায় আমি তাঁকে শুধু দূর থেকে চিনতাম। দীর্ঘ বিরতির পর আশির দশকে আমরা কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, কিছু কিছু কাজের সূত্রে এবং ক্যাম্পাসে একই আবাসিক এলাকার দীর্ঘকাল (প্রায় দেড় দশক) প্রতিবেশী হয়ে।
আনিসুজ্জামান তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি জগন্নাথ কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র। কাছেই ছিল ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট, জয়নুল আবেদিন ছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। পরবর্তী সময়ের প্রখ্যাত শিল্পী আমিনুল ইসলাম ছিলেন আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ছাত্র, ১৯৪৮ সাল থেকে। প্রথমদিকে আনিসুজ্জামানরা আমিনুল ইসলামদের শান্তিনগর এলাকার দিকে বসবাস করতেন। সেখানেই দুজনের পরিচয় ও অসম বয়সের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব। তখন আমিনুল আনিসুজ্জামানের একটি প্রতিকৃতিও আঁকেন। আমিনুল ইসলামের সূত্র ধরে বিজন চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী ও পরে দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু প্রমুখ চারুকলার ছাত্রের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ও ওঠাবসা। এঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আবার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিক মতাদর্শের মিলের কারণে। আনিসুজ্জামান সে-সময়ে যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তায় শিল্পী (ও সাহিত্যিক) বন্ধুদের মতো বাম আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। পরবর্তী সময়ে যখন আনিসুজ্জামান শিল্পীদের ওপর প্রবন্ধ বা শিল্পকলা নিয়ে লেখেন, দেখা যায় সেসবে বামপন্থীরাই তাঁর আলোচ্য শিল্পী। এঁরা সবাই তাঁর কাছাকাছি বয়সের। সর্বকনিষ্ঠ নিতুন কুন্ডুও তাঁর চেয়ে বছরদুয়েকের বড়।
অবশ্য আর্ট ইনস্টিটিউটের এসব ছাত্রের শিক্ষকদের সঙ্গেও আনিসুজ্জামানের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কামরুল হাসান কলকাতা থেকেই তাঁর পরিচিত এবং মুকুল ফৌজে তাঁর গুরু। ঢাকায় কামরুল হাসান শুরু থেকেই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। আনিসুজ্জামান জয়নুল আবেদিনকেও তাঁর বাবার সূত্রে কলকাতা থেকেই চিনতেন, ঢাকায় প্রথম দিকে পারিবারিক বসতবাটি ক্রয়সংক্রান্ত এক অস্বস্তিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁদের পুনঃযোগাযোগ। পরে তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে নানা পর্যায়ে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছেন।

আনিসুজ্জামানের লেখালেখিতে শিল্পী ও শিল্প
আনিসুজ্জামানের শিল্পীদের সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধের মধ্যে অন্তত নয়টি তাঁর তিনটি প্রবন্ধ সংকলনের কোনো-না-কোনোটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক প্রবন্ধ সংকলন স্মরণ ও বরণে (২০১৮, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা) স্থান পেয়েছে ‘জয়নুল আবেদিন’, ‘কাইয়ুম চৌধুরী’ ও ‘রশিদ চৌধুরী’ শীর্ষক প্রবন্ধ তিনটি; আমার চোখে (১৯৯৯, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা) সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘কামরুল হাসান’, এই সংকলনে ‘মন্বন্তরের ছবি’ শীর্ষক প্রবন্ধে জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। তাঁর সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি সাধক (২০১৩, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা) সংকলনে স্থান পেয়েছে সর্বাধিক শিল্পী-আলোচনা, ‘কামরুল হাসান’ (এই প্রবন্ধটি আমার চোখে সংকলনেও অন্তর্ভুক্ত), ‘আমিনুল ইসলাম’, ‘বিজন চৌধুরী’, ‘মুর্তজা বশীর’, ‘দেবদাস চক্রবর্তী’ ও ‘নিতুন কুন্ডু’। প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের। দীর্ঘতম প্রবন্ধ ‘দেবদাস চক্রবর্তী’, প্রায় ৩১৫০ শব্দের, স্বল্পতমটি ‘নিতুন কুন্ডু’, ৯০০ শব্দের কিছু বেশি। ‘জয়নুল আবেদিন’ প্রবন্ধটিও ছোট, অনধিক ১২০০ শব্দের। প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময়ে লেখা, মধ্য আশি থেকে ২০১৮। প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘দেবদাস চক্রবর্তী’ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘আর্ট অব বাংলাদেশ’ সিরিজের অন্যতম মনোগ্রাফের বাংলা টেক্সট। এর ইংরেজি ভাষ্যও রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, এই সিরিজে জয়নুল আবেদিন ও আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে দুটো মনোগ্রাফের লেখক আমি ও সফিউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে লেখা মনোগ্রাফের লেখক মাহমুদ আল জামান (তথা আবুল হাসনাত)। মজার ব্যাপার, আনিসুজ্জামানের নির্বাচিত প্রবন্ধ বা শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ সংকলন দুটোতে তাঁর লেখা শিল্পী ও শিল্পবিষয়ের কোনো প্রবন্ধ সংগৃহীত হয়নি। আরো মজার বিষয় যে, আনিসুজ্জামানকে নিবেদন করে যে-দুটি চমৎকার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, ভূঁইয়া ইকবাল-সম্পাদিত সমাজ ও সংস্কৃতি (২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা) ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম-সম্পাদিত আনিসুজ্জামান সম্মাননাগ্রন্থ (২০১৭, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা) তাতে সংকলিত মোট প্রায় ৯০টি রচনার একটিও শিল্পী বা শিল্পবিষয়ক নয়।
আমার বর্তমান আলোচনায় আমি উপরোল্লিখিত নয়জন শিল্পীকে নিয়ে লেখা আনিসুজ্জামানের প্রকাশিত প্রবন্ধের মধ্যে সীমিত থাকব। এগুলোর বাইরে শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর লেখালেখির খোঁজ আমার কাছে আপাতত নেই। আনিসুজ্জামানের শিল্পকলা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোয় নির্বাচিত শিল্পী ও তাঁর শিল্পকর্ম দুই-ই গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু শিল্পীদের শিল্পকর্মের মূল্যায়নই নয়, দেশ ও জাতির জন্য তাঁদের যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবদান, লেখক সেদিকেও আলোকপাত করেছেন। এঁদের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন, ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, জাতীয় উন্নয়নের নানা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এ-কারণে তাঁরা সর্বোচ্চ জাতীয় পদক লাভ করেছেন, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক অথবা কেউ কেউ দুটোই। নয় শিল্পীর মধ্যে একমাত্র মুর্তজা বশীর (জন্ম, ১৯৩২) জীবিত আছেন ও শিল্পচর্চা করছেন।
জয়নুল আবেদিনকে (১৯৪১-৭৬) নিয়ে আনিসুজ্জামান যে-প্রবন্ধটি লিখেছেন সেটি কলেবরে ছোট ও মূলত স্মৃতিচারণমূলক। পূর্ব পাকিস্তানের বিরূপ পরিবেশে ১৯৪৮ সালেই একটি আধুনিক ধারার চারুকলা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ও স্বল্প সময়ে সেটিকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানো, জয়নুলের এ-ধরনের কৃতিত্বকে মূল্যায়ন করেছেন আনিসুজ্জামান, লিখেছেন ‘সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ’। শুধু আধুনিক শিল্পের বিকাশেই জয়নুল তৎপর ছিলেন না, ‘দেশের লোকজীবন ও লোকশিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল।’ আনিসুজ্জামান আরো লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি তাঁকে সৌন্দর্যের সন্ধান দিয়েছিল। তাঁর সমস্ত সত্তার গভীরে লোকজ নন্দনতত্ত্ব বাসা বেঁধেছিল। এটাই ছিল তাঁর অর্জন এবং উৎস ছিল তাঁর দানের।’ আনিসুজ্জামান জয়নুলের প্রধান শিল্পকর্ম ‘তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ’ চিত্রমালা নিয়ে নিজস্ব মন্তব্য করেননি, বরং তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধে (‘মন্বন্তরের ছবি’) সেই চিত্রমালাগুলো সম্পর্কে ভারতীয় ও প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্পবোদ্ধাদের প্রশংসা মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। জয়নুল আবেদিন প্রথম জীবনে কলকাতায় থাকতে বাম রাজনীতিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির কাগজে তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবি মুদ্রিত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান পর্বে বাম ঘরানার সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলা যাবে না। তবে তিনি উদার প্রগতিশীল, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চেয়ে পটুয়া কামরুল হাসানের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের ওঠাবসা বেশি ছিল। তিনিও যে একাধারে বড় শিল্পী এবং সফল শিল্প ও সংস্কৃতি উদ্যোক্তা ছিলেন, ‘কামরুল হাসান’ প্রবন্ধে তা স্পষ্ট হয়েছে। ডিজাইন সেন্টার তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আনিসুজ্জামান কামরুল হাসানকে (১৯২৮-৮৮) চিনতেন কলকাতায় ছোটবেলা থেকে। মুকুল ফৌজে তাঁর নেতৃত্বে ব্রতচারী নাচ আয়োজন ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। দেশভাগের পর ঢাকায় এসেও কামরুল হাসানের সান্নিধ্য লাভ করেন। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা প্রবাসী সরকারের সংস্কৃতি শাখার সদস্য হয়ে একসঙ্গে কাজ করা, বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যৌথভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা ইত্যাদিতে নানাভাবে কামরুল হাসান ও আনিসুজ্জামান যুক্ত ছিলেন।
কামরুল হাসান প্রকৃতই প্রতিবাদী শিল্পী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ইয়াহিয়ার মুখ (‘এই সব জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’), বাংলাদেশের আশির দশকের শেষপর্বে এরশাদবিরোধিতা (‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’) শিল্পকর্মের মাধ্যমে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে তুলে ধরেছেন। আনিসুজ্জামানের ‘কামরুল হাসান’ শীর্ষক প্রবন্ধে শিল্পীর রাজনৈতিক ভূমিকা স্পষ্ট করেছেন। তাঁর চিত্রকলার নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন আনিসুজ্জামান। লিখেছেন, ‘নানা মাধ্যমে কাজ করেছিলেন তিনি। তবে আমার মনে হয় প্রাধান্য পেয়েছিল জলরং। তাতে ছিল নির্বাচিত মৌল রঙের ব্যবহার, প্রায় সবকিছুকে স্টাইলাইজ করার ঝোঁক, আবার যত্নকৃত ড্রইং, বিষয়ে প্রকৃতি ও মানব-মানবীর অবাধ সহযোগ, বাংলার প্রকৃতির উদার দাক্ষিণ্য, বাঙালি পুরুষের শ্রমশীলতা, বাঙালি রমণীর উপচেপড়া লাবণ্য।
প্রকৃতির রঙে মানুষের অবয়বে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন লোকজ ঐতিহ্যের উপাদান। কামরুল হাসানের বিশিষ্টতাকে তা স্বতঃপ্রতিষ্ঠা করে তুলেছিল।’ এভাবে অল্প কথায় কামরুল হাসানের শিল্পশৈলীর পরিচয় তুলে ধরেন আনিসুজ্জামান। তিনি কামরুল হাসানের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নানা কথা আলোচনা করেন। তাঁর বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টেকেনি, আফসোস করেছেন আনিসুজ্জামান। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তেও দেশরক্ষার চিন্তাই ছিল কামরুল হাসানের হৃদয়ে।
জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান ছিলেন এদেশের প্রথম শিল্পগুরুদের সারিতে। আমিনুল ইসলাম (১৯৩১-২০১১) তাঁদের একেবারে শুরুর শিষ্য। তিনি ঢাকায় আনিসুজ্জামানের শিল্পীবন্ধু, বয়সে কয়েক বছরের বড়, কিন্তু তা বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। আমিনুলের হাত ধরেই বলতে গেলে আনিসুজ্জামানের শিল্পীমহলে প্রবেশ, শিল্পকলা-সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহী হওয়া।
আমিনুল ইসলাম ছিলেন মেধাবী ছাত্র, চারুকলার পাঁচ বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা (তখন এই মর্যাদা ছিল) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পান, দ্বিতীয় হন, প্রথম হয়েছিলেন তাঁর বন্ধু বিজন চৌধুরী। দুজনেই কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী, নিবেদিতকর্মী। আমিনুল প্রথম থেকেই মানবকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ১৯৫৩-৫৬ সালে বৃত্তিসহ ইতালিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। যখন ফিরেছেন তাঁর শিল্পশৈলীতে তৎকালীন ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পবৈশিষ্ট্যের প্রভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে। আধাবিমূর্ত আঙ্গিক এবং জ্যামিতিকতা প্রাধান্য পাচ্ছিল। আনিসুজ্জামান আমিনুলের সে-সময়কার ছবির প্রদর্শনী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তখন দেশীয় বাস্তবতা এবং দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্রবহীনতা দেখে বেশ হতাশ হয়েছিলাম।’ তবু আমিনুল ইসলামকেই এদেশে পাশ্চাত্য আধুনিক শিল্পচর্চায় অগ্রণী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমিনুল ইসলাম-পরবর্তী সময়ে বারবার তাঁর ছবির আঙ্গিক বদল করেছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। মোজাইকে দেয়ালচিত্র অংকনে এদেশে তিনি পথিকৃৎ। তাঁর ড্রইংয়ের প্রভূত প্রশংসা করেছেন আনিসুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে আঁকা তাঁর ছবিগুলো শুধু আকৃতিতেই বড় নয়, শৈল্পিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। আমিনুল ইসলাম শিক্ষক হিসেবে তরুণদের শ্রদ্ধেয় ছিলেন, অভিমত আনিসুজ্জামানের।
বিজন চৌধুরী (১৯৩১-২০১২), ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে আমিনুল ইসলামের সতীর্থ। তিনি কলকাতায় বছরতিনেক আর্ট পড়ার পর রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন এবং ঢাকায় এসে অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের সহযোগিতায় তৃতীয় বর্ষেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ১৯৫৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন; কিন্তু কলেজে চাকরি পাননি। কয়েক বছর অন্যত্র কাজ করে আবার কলকাতা ফিরে যান, শিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন, খ্যাতি ও মর্যাদাও পান। জীবনের শেষদিকে কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গ পেয়েছেন। তিনি বামধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন সবসময়। আচরণে-ব্যবহারে অত্যন্ত অমায়িক। ‘বড় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি একথা সবাই বলতেন। শিশুসুলভ সারল্য ছিল, মধুর হাসি ছিল মুখে’, লিখেছেন আনিসুজ্জামান। তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের মন্তব্য – ‘বিজনের বেশির ভাগ কাজ অবয়বধর্মী। কিন্তু তারই মধ্যে তিনি রঙিন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেন, বিমূর্ততার আভাস তুলে এনে দেন। বিজন চৌধুরী আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন চিত্রশিল্পে, অনুগত ছিলেন শিল্পসত্যের প্রতি, মানুষের প্রতি।’ বিজন চৌধুরী ও আনিসুজ্জামান খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন পঞ্চাশের দশকে এবং তাঁদের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শেষজীবনে। বিজন চৌধুরীর জন্ম ফরিদপুরে, ১৯৩১ সালে। এক পর্যায় থেকে ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু ভালোবাসা ছিল জন্মভূমির জন্য।
রশীদ চৌধুরী (১৯৩২-৮৬) সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন আনিসুজ্জামান। তাঁর জন্ম তৎকালীন ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে। আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র, আবদুর রাজ্জাক (জন্ম ফরিদপুরে), কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরদের সতীর্থ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আনিসুজ্জামান তাঁদের আড্ডার সঙ্গী। ষাটের শেষে ও সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী। খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
রশীদ চৌধুরী ছিলেন নানামুখী প্রতিভা – চিত্রশিল্পী, ট্যাপেস্ট্রি শিল্পী, ভাস্কর, ছাপচিত্রী, শিল্প-সংগঠকও। ট্যাপেস্ট্রিতে এদেশে পথিকৃৎ। কবিও ছিলেন তিনি। রক্ষণশীল জমিদার (জমিহীন শেষদিকে) পিতার সন্তান, নিজে অত্যন্ত প্রগতিশীল, স্বভাবে চঞ্চল, বোহেমিয়ানই প্রায়। বিয়ে করেছিলেন প্রথমে ফরাসি রমণী, সেখানে দুই মেয়ের জনক, শেষ বয়সে তরুণী বাঙালি মেয়ে (ছাত্রী) বিয়ে করেছিলেন, অতৃপ্তি ছিল মনে, স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল আগাগোড়া, কিন্তু শিল্পকর্মে অসাধারণ। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের শিল্পকলার ক্ষেত্রে ট্যাপেস্ট্রির মতো একটা নতুনধারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। অঙ্কন পদ্ধতিতে অনেক সময় বিদেশিয়ানা সত্ত্বেও দেশের মানুষ ও প্রকৃতি তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। যেখানেই থাকুন না কেন, স্বদেশকে তিনি ভোলেননি। বাংলাদেশও তাঁকে ভুলবে না।’ একুশে পদক পেয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে শিল্পীদের মধ্যে সবার আগে, যে-বছর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পেয়েছিলেন (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পদক। তিনি উচ্চতর শিল্প শিক্ষা নিয়েছিলেন স্পেন ও ফ্রান্সে।
কাইয়ুম চৌধুরীর (১৯৩৪-২০১৪) সঙ্গে আনিসুজ্জামানের বন্ধুত্ব সুদীর্ঘ সময়ের। সেই পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে, ২০১৭ সালে কাইয়ুমের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। প্রায় একই রকম রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনার অধিকারী ছিলেন। শেষের দিকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শিল্পকলার নানামুখী তৎপরতার সঙ্গে দুজনেই জড়িত ছিলেন। জীবনাচরণেও ছিলেন সমমানসিকতার।
জয়নুল-প্রতিষ্ঠিত সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। সতীর্থ ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর প্রমুখ। আগাগোড়াই ভীষণভাবে জয়নুলভক্ত। অত্যন্ত প্রগতিশীল বাঙালি। নানা গুণে গুণান্বিত, চারুশিল্পী, প্রচ্ছদশিল্পী, কবি, কথাসাহিত্যিক, সংগীত সমঝদার। প্রখর জাতীয়তাবাদী, বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক। আনিসুজ্জামান তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কাইয়ুম রাজনীতি করেননি। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়পর সমাজের স্বপ্ন দেখতেন আজীবন এবং তার বাস্তবায়নের নানা প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। জীবনের শেষার্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।’
তিনি আরো লেখেন, ‘গুরুর কাছ থেকে তিনি শিল্পের যে পাঠ নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল লোকজীবন ও লোকশিল্পের প্রতি গুরুর ভালোবাসা। বাংলাদেশের লোকজীবন ও লোকশিল্প থেকে উপাদান গ্রহণ করেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী – বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নয়, তাঁকে স্টাইলাইজ বা রীতিবদ্ধ করে। … একজন আধুনিক চিত্রশিল্পীরূপে লোকশিল্পের পুনর্নির্মাণ তিনি করেননি, প্রেরণা নিয়েছেন সেখান থেকে, আভাসে-ইঙ্গিতে তার প্রাণবস্তুটি তিনি নিয়ে এসেছেন সামনে।’ এভাবে আরো দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্র চরিত্র নিয়ে আনিসুজ্জামান। আরো লিখেছেন, ‘কাইয়ুমের সব ছবিতেই যা চোখে পড়ে, তা কাইয়ুমের শক্তিশালী ড্রইং, জয়নুলের ড্রইংয়ের সামর্থ্যকে যা মনে করিয়ে দেয়।’
‘অজস্র ছবি এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী নানা মাধ্যমে; সাদা-কালো, জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক। সব মাধ্যমেই তাঁর নিজস্বতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ছবিতে শিল্পীর স্বাক্ষর না থাকলেও তা চেনা যায় কাইয়ুমের কাজ বলে। ছবির সর্বাঙ্গেই তাঁর হাতের অনপনেয় ছাপ।’ এভাবে আনিসুজ্জামান চিত্রিত করেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। বইয়ের প্রচ্ছদ অংকনে কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন এদেশে পথিকৃৎ। আধুনিক নিজস্ব বর্ণলিপি উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। ‘বাংলা বর্ণলিপির শৈল্পিক রূপায়ণে কাইয়ুমের জুড়ি পাওয়া ভার’, লিখেছেন আনিসুজ্জামান।
ব্যক্তি কাইয়ুমকে নিয়েও তাঁর মূল্যায়ন খুবই প্রণিধানযোগ্য। ‘কাইয়ুম ছিলেন অসাধারণ বন্ধুবৎসল মানুষ। অন্তরঙ্গদের কাছে অনায়াসে তিনি মনের অর্গল খুলে দিতেন। বন্ধুত্বের মূল্য তাঁর কাছে ছিল অপরিসীম।’
অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগে, একুশে পদক পেয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। রাষ্ট্র তাঁকে যথাযথ সম্মান করেছে।
মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী ও কাইয়ুম চৌধুরী সতীর্থ ছিলেন, আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র তাঁরা, আরো ছিলেন তাঁদের শ্রেণির সবসেরা ছাত্র আবদুর রাজ্জাক। এঁরা সবাই বিভিন্ন সালে ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন। কাইয়ুম ও বশীর ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ও। কী অসাধারণ ব্যাচ ছিল আর্ট ইনস্টিটিউটের এটি, ১৯৪৯-৫৪। এঁরা সবাই আনিসুজ্জামানের ছাত্রকালীন বন্ধু, শিল্প-আড্ডায়, ভাষা-আন্দোলনে, পরবর্তী আরো নানা আন্দোলন ও আয়োজনে।
মুর্তজা বশীর (জন্ম ১৯৩২) রশীদ ও কাইয়ুমের মতোই নানামুখী প্রতিভা। শিল্পকলার নানা মাধ্যমে সিদ্ধহস্ত যেমন সাহিত্যচর্চায়ও। বশীর আবার ব্যতিক্রমী গবেষকও, মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন, প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ভিন্নধর্মী আত্মজীবনী লিখেছেন। যেখানেই হাত দিয়েছেন, স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
দেশে শিল্প-শিক্ষার পর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও ইতালির ফ্লোরেন্সে (১৯৫৬-৫৮) উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। শিল্পচর্চা করেছেন, দেশে ও (পশ্চিম) পাকিস্তানে, শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শুরু থেকে পাশ্চাত্য আধুনিক ধারার শিল্পী। দীর্ঘ শিল্পীজীবনে বহুবার শিল্পের আঙ্গিক বদল করেছেন। প্রতিবারই নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন, ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমও অনুশীলন করেছেন। ড্রইংয়ে তিনি অসাধারণ। তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য, কয়েক বছর ধরে একেকটা নতুন সিরিজ এঁকেছেন, যার মধ্যে বিখ্যাত ‘দেয়াল’ সিরিজ বা ‘এপিটাফ’ বা ‘শহীদস্মৃতি’।
বিমূর্ত, আধা-বিমূর্ত, অবয়বধর্মী, প্রতীকী নানা রীতির ছবি এঁকেছেন তিনি। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘আসলে আমাদের দেশের অনেক শিল্পীর মতো বশীরের মধ্যেও একটা দোলাচল আছে। নিজের ছবিতে কী তিনি ফুটিয়ে তুলবেন স্থানকালের বিশিষ্টতা, না তিনি মিশে যাবেন আন্তর্জাতিক চিত্রশিল্পের আধুনিক উদ্ভাবনের মধ্যে। বশীর এখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তবে সে সিদ্ধান্ত যে স্থায়ী হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। শিল্পী মাত্রেরই মনোজগতের রং ও রূপ বদলায়, বশীরের ক্ষেত্রে বেশি বদলায়।’
একদা বস্তুবাদী, কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী বশীর পরিণত বয়সে আন্তরিকভাবে অনুশীলন করেন ইসলাম ধর্মের প্রতীকী বাণীর লিখিত রূপ, ক্যালিগ্রাফি-প্রভাবিত প্রায় বিমূর্ত রূপকল্প নির্মাণ করেন। খুবই সফল হন। আনিসুজ্জামান তাঁর ‘মুর্তজা বশীর’ প্রবন্ধে শিল্পীর শিল্পকর্মের চেয়ে সাহিত্যকর্মের (বিশেষত মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত গ্রন্থ) দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তরুণ বয়সের বন্ধু দুজন পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। বশীরের চিত্রকলার এক প্রধান বিষয় নারী। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘১৯৬৭ থেকে মহিলাদের যেসব ছবি এঁকেছেন, তা কেবল বিক্রির জন্যে। রমণীদের ছবি এঁকে কখনো তৃপ্তি পাননি। তবুও মেয়েদের ছবি এঁকেছেন, তা অবচেতন মনের জৈবিক আকাঙ্ক্ষাজনিত। কিন্তু অতৃপ্তি? সে কি শিল্পী মাত্রই যে অতৃপ্তি বোধ করেন, যে অতৃপ্তিবোধ ক্রমাগত তাঁদের সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয়, সেই অতৃপ্তি, না অন্য কিছু?’
‘মুর্তজা বশীর’ প্রবন্ধে আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে বশীরের এক ধরনের ক্ষুব্ধ মনোভাব ছিল, শেষ জীবনে বশীর তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কিন্তু যখন তিনি (বশীর) পারলেন তাঁকে (শিল্পাচার্যকে) যথার্থ দৃষ্টিতে দেখতে, তখন নিজেকেই অনেক ছোট মনে হলো জয়নুলের পাশে। এই জয়নুলের স্নেহধন্য যে তিনি, এটাই হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ পাওয়া।’
দেবদাস চক্রবর্তী (১৯৩৩-২০০৮), জন্ম ফরিদপুর জেলায়, (বর্তমান শরীয়তপুরে), সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের লেখা প্রবন্ধটি আলোচিত নয়টি প্রবন্ধের মধ্যে দীর্ঘতম। মূলত প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘আর্ট অব বাংলাদেশ’সিরিজের জন্য (২০০৩ সাল)। বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্য ছিল প্রবন্ধের, সঙ্গে ছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিল্পকর্মের প্রতিলিপি।
প্রবন্ধটিতে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর ব্যক্তিজীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কথা আলোচিত হয়েছে, এবং অবশ্যই চিত্রকর্মের আঙ্গিকগত বিবর্তনের কথা। দেবদাসকে আনিসুজ্জামান খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, তরুণ বয়সে, তাঁরা যখন ছাত্র, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুজনই কলকাতায় প্রবাসী সরকারের সংস্কৃতি ও প্রচার কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। তখন দেবদাসের আঁকা একটি পোস্টার ‘বাংলার হিন্দু/ বাংলার খৃষ্টান/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী’ ছিল অত্যন্ত উদ্দীপনামূলক।
দেবদাস বিজন চৌধুরীর মতো প্রথমে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন, একই সময়ে একই কারণে তাঁদের কলেজ ছাড়তে হয়েছিল, দুজনেই (ফরিদপুরের মানুষ) এসে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন, বিজন তৃতীয় বর্ষে, জুনিয়র দেবদাস প্রথম বর্ষে। এসবই অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের অভিভাবকত্বে। দেবদাস ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে বের হন ১৯৫৬ সালে। প্রথমে আরমানিটোলা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন, পরে সরকারি দফতরে। আরো পরে ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তিনি ১৯৭৬ সালে পোল্যান্ড সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর চারুকলা শিক্ষার জন্য ওয়ারশ যান, কিন্তু স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে ১৯৭৯ সালে শিক্ষাক্রম অসমাপ্ত রেখে দেশে ফেরেন। তাঁর স্ত্রী সালেহা বেগম রাণী ছিলেন মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তাঁদের জীবন ছিল প্রেমময়। শেষ পর্যন্ত রাণীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। দেবদাস দেহান্তরী হন ২০০৮ সালে রোগে ভুগে, প্রাণচঞ্চল মানুষটি অনেকটাই বোধহীন ছিলেন শেষ সময়ে।
আনিসুজ্জামান তাঁর বন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা পর্যায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর প্রবন্ধে। তাঁর চিত্রকলা নিয়ে লিখেছেন, ‘আর দশজন শিল্পীর মতোই দেবদাস নিজের ছবির বিষয় আহরণ করেছেন তাঁর পরিবেষ্টনী থেকে, তবে তা নিজের মতো করে নিতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর চিত্রে রয়েছে প্রকৃতি ও মানুষ : বর্ষা ও শরৎ ঋতু, নদী-মাছ, পশুপাখি, গাছপালা; আছে নর-নারী – জীবনের বিভিন্ন অবস্থায় আছে শিল্পীর স্মৃতিধৃত জগৎ : পরিবর্তমান শহর, মুক্তিযুদ্ধ, রাণী। মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-যাতনা, রাজনীতি-দেশপ্রেম আছে। আছে স্থান-কালের চিরন্তন আবর্তনজনিত অনুভূতি ও জিজ্ঞাসা। চিত্রশিল্পের সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন। নিজের মতো করে। বস্তুধর্মী ছবি দিয়ে শুরু করে এসে পৌঁছেছেন বিমূর্ত প্রকাশবাদে। রেখা ও আকারের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার সত্ত্বেও তাঁর আদল ভেঙেছেন। রং তাঁর আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত উপায়, তবু সেই রঙের অতীতে যেতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার বিকাশের ইতিহাসে দেবদাস চক্রবর্তীর আসন হয়ে রইল স্থায়ী।’
আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন যথার্থ মনে করি। দেবদাস চক্রবর্তীর বিমূর্ত নগর চিত্রগুলো আমার প্রিয় কাজের অন্যতম। ‘দেবদাস চক্রবর্তী’ প্রবন্ধটি এদেশের চিত্রশিল্পীদের ওপর লেখা প্রবন্ধের আদর্শ মনে করা যেতে পারে।
নিতুন কুন্ডুকে (১৯৩৫-২০০৬) (মুক্তিযোদ্ধা) নিয়ে লেখা আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধটি আলোচিত ৯টি প্রবন্ধের মধ্যে হ্রস্বতম। মূলত শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর শিল্পকলাচর্চা ও শিল্প-কারখানার উৎপাদন নিয়ে অতিসংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা। অসাধারণ মেধাবী ও সৃষ্টিধর্মী নিতুন কুন্ডু এদেশের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রমী একজন। শুরুতে ছাত্রাবস্থায় সংগ্রামী জীবন, শেষ পর্বে দেশের অন্যতম সফল উদ্ভাবক শিল্পপতি, সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধে তা পরিস্ফুট। তিনি লিখেছেন, ‘স্কুলে পাঠ্যবইতে আমরা জীবনী পড়েছি সেসব সফল মানুষের যাঁরা ছোট থেকে বড়ো হয়েছিলেন নিজের অন্তর্নিহিত গুণে আর অবিরাম চেষ্টায়। লগ কেবিনে জন্ম যাঁর পৌঁছে গিয়েছিলেন হোয়াইট হাউজে। আমি বহু সময় বলেছি, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নিতুন কুন্ডুর জীবনী থাকা উচিত, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তা থেকে অনুপ্রেরণা পাবে।’ আর্ট ইনস্টিটিউটের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও নিতুন কুন্ডুকে অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন শিক্ষকতার চাকরি দেননি (সম্ভবত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অলিখিত নির্দেশে), বরং নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে ভালো বেতনে তৎকালীন ইউএসআইএসে ডিজাইন শিল্পীর পদ পাইয়ে দিয়েছিলেন। অন্তিমে এটা যে নিতুনের জন্য কতবড় আশীর্বাদ হয়েছিল, তা সবাই জেনেছেন। অবশ্য নিতুন কুন্ডুর প্রতিভার কারণেই তাঁর ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছিল। শিল্পী থেকে শিল্পোদ্যোক্তা, এমন এক শিল্প যেখানে শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব কাজে লেগেছে। নিতুন কুন্ডুর প্রতিষ্ঠিত অটবি এদেশের আসবাবশিল্পের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। নিতুন কুন্ডু শিল্পে ব্যস্ত থাকলেও তাঁর সুকুমার শিল্পকে ভুলে যাননি কখনো, কিন্তু অসাধারণ কোনো চিত্রকর্ম বা পেইন্টিং করতে পেরেছেন, আমার মনে হয়নি। বরং ভাস্কর্য কিংবা স্থাপনা শিল্পের কিছু কাজ দৃষ্টান্তমূলক নিদর্শন বলা যায়। যেমন ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলের কাছে নির্মিত ‘সার্ক ফোয়ারা’ কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত ‘সাবাস বাংলাদেশ’ ভাস্কর্য।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিতুন কুন্ডুকে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ বলেছেন, তিনি নিজেও যে তাই। আনিসুজ্জামান হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘হুমায়ূন নেই এ কথা সত্য। কিন্তু এ কথা আরো সত্য যে হুমায়ূন আছে, সে থাকবে’ (‘হুমায়ূন আহমেদ’, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি সাধক)। সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে তাঁরই কথা ধার করে বলতে চাই, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। বিপুলা পৃথিবীতে তিনি এক অনন্য বাঙালি। জয় হোক তাঁর।