আনিসভাই

১৯৬১ সাল। ঢাকায় তখন রবীন্দ্রবার্ষিকী পালনের জোর তোড়জোড়। দুটো কারণ। এক. শতবার্ষিকী। দুই. পাকিস্তানি সরকারের রবীন্দ্রচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং আমাদের জিদ ষোলো আনা ছাড়িয়ে। মানব না এ-বন্ধনে, মানব না এ-শৃঙ্খলে – তরুণসমাজ, মাঝবয়সী ও বয়সী সবাই একাট্টা। আমাদের দাবি প্রাণের। সংস্কৃতির। অধিকারের। পাকিস্তানের বয়স তখন তেরো-চৌদ্দো। আমাদের মূল সাংস্কৃতিক বন্ধনটি হাজার বছরের বাঙালি ও বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির। শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যে মধ্যবিত্তের লড়াই। যদিও মূলত জাতিসত্তার। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত আর এক জনগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন এবং যার চরিত্র পুরোপুরি সামন্তবাদী। তখনকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি আমার মনে হয়ছিল একটি উন্মাদাগারে সৃষ্ট। পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী একধরনের পরাজিত কৌম।
বাংলার রাজধানী এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা ত্যাগ করে কৃষিভূমিনির্ভর একটি রাজ্য তাও মূল ভূখণ্ডের রাজধানী থেকে এত দূরে যে, উন্নয়নের ছিটেফোঁটা ছাড়া কিছুই ভাগে মিলত না। পূর্ব বাংলার পাট বিক্রির টাকায় নির্মিত হয় পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ। এটি রাওয়ালপিন্ডি-সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর আমরা ১৬০৮-১০ সালে তৈরি সুবাহদার ইসলাম খাঁর ছোট্ট শহরে – গঞ্জ বলাই শ্রেয় – রাজধানী বসাই, শীর্ণস্রোতা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। এ-রাজধানী প্রাদেশিক, অর্থাৎ মফস্বল শহর।
এর মধ্যে পূর্ব বাংলায় জাতিকে নাড়া দেওয়ার মতো আন্দোলন ঘটে গেছে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্থাপনের লড়াই। এতে জয়ী হয়ে জনগণ উজ্জীবিত।
১৯৬১-র রবীন্দ্রশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে আমার আনিস স্যারের শরণাপন্ন হওয়া। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগের সম্মান শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাদের পাঠ তখন চলত পুরনো ভবনে, অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজের দক্ষিণ ফটকের অংশে। যেখানে আমতলা ছিল সব রাজনৈতিক আন্দোলনের বক্তৃতামঞ্চ। আর পাশে মধুর ক্যান্টিন ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের মতো। সব নেতাই মধুদার সাহচর্য পেয়েছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে যিনি শহিদ হন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিপণিটি আজো আছে, নবাববাড়ির নাটমঞ্চ-ভবনে। আর্টস বিল্ডিংয়ের পূর্ব-উত্তর কোণে। এখানেও একটি আমগাছ আছে – ডালপালা ছড়িয়ে।
তো রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর কথা। আমি তখন উঠতি সাহিত্যিক। আমার বাসনা রবীন্দ্র-সমাজচিন্তার ওপর নিবন্ধ তৈরি করা। এখন কোথায় পাব রবীন্দ্ররচনাবলি? মনে পড়ে আনিসভাইয়ের কথা। তিনি তখন পুরনো শহরে কাপ্তান-বাজারের পেছনে থাকেন। এটা নবাবপুর ও ওয়ারীর মাঝে – দোতলা ভাড়াবাড়ি। তিনি আমার চেয়ে বছর চার-পাঁচের জ্যেষ্ঠ। তাঁর বসার ঘরে কাচ দেওয়া আলমারিতে রচনাবলি রাখা। তিনি সেগুলো থেকে দুটি খণ্ড আমাকে বেছে দিলেন। আমি বসে পড়তে শুরু করি পছন্দের রচনাগুলো। এর মধ্যে ভাবি চা দিয়ে গেছেন। শ্যামলা সুদর্শনা ভাবি আমাদের বয়সী। আমি একসময় আনিসভাইকে বলি, ভাইয়া, রচনাবলি দুটো কি বাসায় নিতে পারি? সময় না নিয়ে তিনি বললেন, নিয়ে যাও। ফেরত দেওয়ার কথা উচ্চারণ করলেন না।
শওকত ওসমানের সন্তান হিসেবে তাঁর পরিচিত সবার কাছ থেকে সারাজীবন অঢেল স্নেহ পেয়েছি। আজো বাবা ও তাঁর বন্ধুদের মধুর ব্যবহারের কথা ভেবে চোখ ভিজে আসে। একে একে সবাই চলে গেছেন। যেমন এই তো কদিন আগে আনিসভাইও চলে গেলেন। বলা বাহুল্য সদ্যপ্রয়াত। কে জানে, কোভিড-১৯ তাঁকে প্রচ্ছন্ন হলেও স্পর্শ করেছিল কি না?
কাজ শেষ হলে খণ্ড-দুটি আনিসভাইকে ফেরত দিয়ে আসি। সেদিন তিনি রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তার ওপর আমাকে বেশকিছু তথ্য ও রচনার কথা বলেন। দেন তার পটভূমিও।
আমার কাছ থেকে বই-দুটি নিয়ে তিনি যথাস্থানে স্থাপন করেন। আমি একটা অন্যায় করে ফেলায় মনে মনে শঙ্কিত ছিলাম। আমি অনেক রচনার নিচে পেনসিলের দাগ দিয়ে ফেলেছি। ছাত্র যে ছাত্রের মতোই আচরণ। বইটি যে নিজের নয় এবং রচনাবলির খণ্ড এতে দাগ দেওয়া অশোভন! ভাগ্য ভালো বই-দুটি তখন তিনি খুলে দেখেননি। পরবর্তী জীবনেও এ-ব্যাপারে তিনি কখনো কথা না তোলায় বুঝি – আমার অপকর্মটি সম্ভবত তাঁর চোখে পড়েনি বা পড়লেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। জানি না কোনটা।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ সালে তিনি প্রচুর শ্রম দিয়েছেন। তিনি তখন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মল্লিক সাহেবের নেতৃত্বে তাঁরা আগরতলা হয়ে অনেক পথপরিক্রম করে কলকাতায় পৌঁছেছিলেন। আনিসভাই তখন যুবকই বলতে গেলে। যদিও তাঁর অবয়বটি ধ্রুপদি ভারতীয় পণ্ডিতসুলভ। পরবর্তীকালে তাঁকে পাজামা-পাঞ্জাবিতে আদর্শ বাঙালি হিসেবে সুন্দর মানাত।
তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ২৪ পরগনায়। বাংলা বলতেন চোস্ত। খুব সহজ ও সাবলীল ছিল তাঁর কথনভঙ্গি। আর শব্দচয়ন কখনো জার্গনভিত্তিক ছিল না।
বাবা শওকত ওসমান মারা গেলে তাঁর পুস্তকাবলি যা বাজারে ছিল না বাজারজাত করার জন্যে অগ্রগামী প্রকাশনা সংস্থা ‘সময়ে’র স্বত্বাধিকারী অনুজপ্রতিম ফরিদ আহমেদ এগিয়ে আসেন। কলকাতায় প্রকাশিত পুস্তকের পাবলিশিং হাউজের তথ্য নিতে আমাকে প্রায়ই আনিসভাইয়ের শরণাপন্ন হতে হতো। এছাড়া আমার আর দ্বিতীয় উৎস ছিল না।
আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য – এই ডিসিপ্লিনের ছাত্র নই, তাদের কাছে আনিসভাই ছিলেন এক বাতিঘর। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা তাঁর ওপর ছিল নির্ভরশীল।
আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্রে যাঁরা নক্ষত্র তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, এনামুল হক. ড. আহমদ শরীফ, মুনীর চৌধুরী, ড. আবদুল হাই, আবদুল কাদির প্রমুখ। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মে ড. আনিসুজ্জামান, ড. মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে বক্তৃতাদানের ক্ষেত্রে প্রয়াত মুনীর চৌধুরী, ড. মনিরুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন অনন্য। ড. মোস্তফা নূর-উল ইসলামও ব্যতিক্রমধর্মী বক্তা। শেষজীবনে আনিসভাইকে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সংস্কৃতিমণ্ডলে নেমে এসেছে একটা বড় ধরনের শূন্যতা।