চলে গেলেন আমার স্যার, আমার শিক্ষক আনিস স্যার। এ-মহাপ্রস্থান সবার জীবনেই আসবে। এ-অমোঘ বিধান এড়াবার ক্ষমতা কারো নেই। এ-বেদনাদায়ক পরিণতি যুগ যুগ ধরে ঘটে আসছে এবং ঘটবেই। কিন্তু আমি নিজেকেই অনেক সময় প্রশ্ন করি, এতশত জেনেও এ-চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা এত কেন আহত করে আমাদের বুঝি না, এত কেন অস্থির করে – সে-মৃত্যু যে-বয়সেই হোক – পরিণত, কি অপরিণত? আনিস স্যার ছিলেন আমার কাছে এমনই একজন নমস্য ব্যক্তি যাঁকে হারিয়ে মনটা শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। আমি জানতাম, যে কোনো সময় তাঁর ডাক আসতে পারে। তারপরেও সেদিন বিকেল পাঁচটার সময় ত্রপার বাবা যখন বলল, ‘স্যার আর নেই।’ আমার স্যার নেই – মুহূর্তে নানান কথা মনে পড়ে গেল। কত সভা, কত অনুষ্ঠানে স্যার সভাপতি হয়ে গেছেন – আর আমার সৌভাগ্য সেখানে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে গেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি স্যারের সরাসরি ছাত্রী ছিলাম বাংলা বিভাগের। এত অমায়িক, এত ভদ্র, এত মিষ্টভাষী, এত ঠান্ডা-সুশীতল মানুষ ছিলেন স্যার যে কখনো আমাদের একটু গলা উঁচিয়ে কথা পর্যন্ত বলেননি। এত গুণী মানুষ, এত সম্মানিত ব্যক্তি হয়েও সবসময় বিনয়াবনত ও হাস্যময় ছিলেন। এই সেদিনও আমার একটা বই যা ইচ্ছা তাই-এর মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান ছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। আমার ভাগ্য সবসময় আমি স্যারের পাশেই বসতাম। বড় স্নেহভরে যখন তিনি আমাকে তাঁর পাশে বসাতেন তখন আমার স্বাভাবিকভাবেই আমার ভাই মুনীর ভাইকে মনে পড়ে যেত – যাকে নিষ্ঠুরভাবে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
আনিস স্যার চলে গেলেন আমাদের এ-দুঃসময়ে যখন মারণ ভাইরাস কোভিড-১৯-এ সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত, এ-ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়ে, মৃত্যুভয়ে আতংকিত। তবে বেবী আপা (স্যারের স্ত্রী), যাঁকে আমি স্যারের স্ত্রী হবার আগে থেকেই চিনতাম – মাটির মানুষ – খাঁটি মানুষ, কোনো কথা জোরে আদেশের ভঙ্গিতে বলতে পারতেন না বেবী আপা, স্যার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কী মিষ্টি করে বলছিলেন, ‘দেখো ফেরদৌসী, আমি ভালো মানুষ, – জোর গলায় তোমার স্যারকে কোনো কিছু বারণ করতেও পারি না। আমার বিধিনিষেধকে পাত্তাই দেন না। তিনি বয়সের কোনো ধার ধারেন না। সেই আগের মতো সব অনুষ্ঠানে যাবেন, সব নেমন্তন্ন গ্রহণ করবেন আর রাত করে বাড়ি ফিরবেন। বলো এই বয়সে এত অনিয়ম আর ধকল সইবে কেন?’
আমাকে আর ত্রপার বাবাকে বেবী আপা বলছিলেন, ‘এবার হাসপাতাল থেকে ফিরলে তোমরা একটু সাবধান করো তো তোমাদের স্যারকে। তোমাদের কথা শুনবেন।’ দুঃখ! এবার আর তিনি ইহজগতে ফিরলেন না। এসবই চিরসত্য। পরপারে চিরতরে চলে গেলেন। আমাদের অভিভাবকহীন করে দিয়ে চলে গেলেন। বড় ভরসার জায়গা ছিল মানুষটা। যেখানে গেছি তিনি যদি আমাকে দেখেছেন উচ্চৈঃস্বরে আমার নাম ধরে ডেকে তাঁর পাশে বসাতেন।
স্যারের রসবোধ ছিল অনেক। সেদিন আমার বই যা ইচ্ছা তাই-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে একঘরভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, ‘ফেরদৌসীর এই বইতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে যেখানে ফেরদৌসী বলেছে ‘আনিস স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটক পড়াতেন। কী ভালোই পড়াতেন!’ স্যারের এ-রসবোধে হলের সবাই আনন্দে হেসে উঠেছিল সেদিন। স্যার কত লক্ষ করেছেন। প্রশংসা করে কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘একালেও ফেরদৌসী সবসময়ই ত্রপার বাবাকে ত্রপার বাবাই বলে – কখনো স্বামীর নাম ধরে ডাকতে শুনিনি।’
বড় স্নেহ করতেন স্যার আমায়। আমি আর বকুল বাংলায় অনার্স পড়ার সময় তাঁর টিউটোরিয়াল ক্লাস করতাম। সবসময়ই আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম; স্যার আমাদের এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে নিরস্ত হয়ে চলে গেতেন। স্যার পরদিন আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমরা কোথায় ছিলে? ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমগুলোতে তোমাদের খুঁজে বেড়ালাম – তোমাদের পেলাম না তো।’ আমরা অবলীলায় মুখ শুকিয়ে বলতাম, ‘স্যার, আমরাও তো আপনাকে খুঁজেছি – না পেয়ে ভাবলাম আপনি বোধহয় আজ আসেননি।’ আমরা অবশ্য বুঝতাম স্যার আমাদের ছলচাতুরী ঠিকই বুঝতে পারতেন। নেহায়েত ভদ্রলোক বলে আমাদের ঘাঁটাতেন না।
সব বড় বড় ভরসার জায়গা অতি দ্রুত পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন; কিন্তু আমরা যারা রয়ে গেলাম, তাদের আর কতদিন অভিভাবকহীন হয়ে থাকতে হবে কে জানে। এ-বছর অনেক জ্ঞানী-গুণীজনকে হারিয়েছি – অভিশপ্ত করোনার মারণ আঘাতে আরো কতজনকে হারাতে হবে এক বিধাতাই জানেন।
স্যার যদিও পরিণত বয়সে অবধারিত মৃত্যুবরণ করেছেন তবুও যখন ভাবি বিশেষ বিশেষ স্থানে আনিস স্যারের হাস্যোজ্জ্বল বদনটা আর দেখতে পাব না, তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত সুন্দর সুন্দর বাণী শুনতে পাব না, সঠিক এবং স্পষ্ট উচ্চারণে ‘ফেরদৌসী’ ডাকবেন না – ব্যাপারটা যেন বিশ্বাস হতে চায় না – আপনা থেকেই কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে পড়ি। স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করা এবং স্যার যাঁদের রেখে গেছেন বিশেষ করে বহুবছরের সুযোগ্যা স্বামী-সোহাগিনী স্ত্রী বেবী আপা যেন স্যারের মধুর মধুর স্মৃতিচারণ করে, সুন্দরভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারেন – আমার এ-শুভকামনা রইল তাঁর জন্যে। বেবী আপাকে আমার বড় ভালো লাগে। আর জনান্তিকে এও বলে রাখি, আমার ধারণা বেবী আপাও আমাকে ভালো জানেন ও ভালোবাসেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.