আনিসুজ্জামান স্যার ও নারী-প্রগতির গবেষণা-চর্চা

আনিস স্যার বলতেই অনন্য ও একক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সকলের মনের দর্পণে হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে ভাস্বর হয়ে ওঠেন। ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’ – এই রবীন্দ্র-আহ্বানে আনিস স্যার আমাদের উজ্জীবিত করে এসেছেন।
মানুষের কথা, মানুষের জীবন, মানুষের সাধনা – এসবই স্যারের জীবনব্যাপী শিক্ষা-সাহিত্য-জীবন চর্চার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ‘জড়িয়ে আছে’। ‘জড়িয়ে ছিল’ – এরকম অতীতবাচক শব্দ তাঁর জীবনের কর্মসাধনায় প্রযোজ্য হতে পারে না। তাঁর সকল সাধনা ও কাজ অতীতকে বর্তমানের দোরগোড়ায় নিয়ে আসার এবং ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দেওয়ার ইতিবাচক প্রচেষ্টায় ও উদ্দীপনায় পূর্ণ। তাঁর জীবনচর্চায় আমি দৃষ্টি দেব নারীর প্রগতি বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত বিষয়ে।
সমাজ-সংসারে, কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিতে সর্বোপরি সংস্কৃতিতে নারী ও পুরুষের সমতা-সমমর্যাদা-সমঅবস্থান বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা সেই শৈশব থেকে আজীবন লালন ও পালন করেছেন তিনি। বিস্তৃত ও বহুল গবেষণায়-লেখায় ও ভাষণে তিনি নারীর অসম অবস্থান যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি নারীর সংগ্রামের ইতিহাসও রচনা করেছেন। পিএইচ.ডি গবেষণায় তিনি ১৯৬০-এর দশকে মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বিশ্লেষণ করে এ-বিষয়ে তাঁর স্থির মতামত দিয়েছেন যে, ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থার কারণে আদর্শবাদের অভাবে নারী-সৌন্দর্যে স্তুতি সত্ত্বেও নারীর প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা ঘটেছে। ১৭৫৭-১৯১৮ সময়কালে বাঙালি মুসলমান লেখকদের ‘সমাজ ও সম্প্রদায় সম্পর্কে অনুভূতি’ বিশ্লেষণ করে লিখেছেন :
এক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মুসলমান লেখকদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। আমাদের সমাজে আধুনিক শিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতা, বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যোগ স্থাপন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের প্রচেষ্টা সমাজের অগ্রগতির সহায়ক হয়েছিল।’ (মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখা, ঢাকা ১৯৬৪, পৃ ২৩)
১৮১৭ সালে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষালাভের তথ্য, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যের দ্বিতীয় পর্বে (১৮৮২-১৯৩৬) জানিয়েছেন, ‘মেয়েদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ এবং তাদেরকে শিক্ষা ও স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এ-কালের সাহিত্যেই প্রকাশ পেয়েছিল। আধুনিক কালের প্রথম লেখিকার আবির্ভাব এ যুগের স্মরণীয় ঘটনা।’ (ওই, পৃ ২৫৭)।
আমাদের জন্য, পাঠকের জন্য স্যারের যত লেখা গ্রন্থিত ও প্রকাশিত হয়েছে সেসব বইয়ে আছে দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি-ব্যক্তি-ব্যক্তিত্ব-কাজ ও সাধনা বিষয়ে ইতিহাসের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে নিজস্ব গবেষণালব্ধ নতুন পথের অনুসন্ধান। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিবাচক বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে উপহার দিয়েছেন কথায়, লেখায় ও কাজে।
নারী-আন্দোলনের সূত্র ধরে এই প্রসঙ্গে আমার অব্যাহত অনুসন্ধান, প্রাপ্তি এবং কর্মসাধনার বিষয় হচ্ছে নারীর অবস্থান ও নারী-পুরুষের সমমর্যাদা। দেশের-পরিবারের সমাজ-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক অবস্থান হচ্ছে প্রেক্ষাপট। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের পথে নারী-পুরুষের সহযাত্রার বিষয়ে রাজনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি-গবেষণা ও সাংগঠনিকভাবে নারী-আন্দোলনের জাতীয়, আন্তর্জাতিক, ঐক্যবদ্ধ আদর্শে বিষয় হচ্ছে আমার গবেষণার মূল্য লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য স্থির হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সোভিয়েত মতাদর্শ-অনুসরণে দেশের মহীয়সী রোকেয়া থেকে সুফিয়া কামালের জীবন-সাধনা অনুসরণের মধ্য দিয়ে। নারী-আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা আমাকে ১৯৬৪ সালে অনুপ্রাণিত করল স্যারের গবেষণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়া শুরু করেছি ১৯৬২ সালে। আনিস স্যারের তারুণ্যপূর্ণ শিক্ষকতা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সেই ষাটের দশকে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা বিষয়ে ইতিবাচক-চিন্তাধারা তৈরিতে খুবই প্রেরণাদায়ক ছিল। ব্যক্তিজীবনে স্যারের আদর্শিক প্রভাব ছিল অন্যতম প্রেরণা।
ঢাকার ওয়ারী পাড়ার বাসিন্দা ছিলাম। পড়েছি নারী শিক্ষা মন্দির স্কুলে। তার আগে পড়েছি ময়মনসিংহে। বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলে। ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলানাগ-প্রতিষ্ঠিত ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ আমার জীবনের সকল শিক্ষা, প্রেরণা, গবেষণা, নারী-আন্দোলনের পথযাত্রার ভিত্তিমূল বললে অত্যুক্তি হবে না। ইডেন কলেজে শিক্ষকরূপে (বকশীবাজার, ১৯৬০-৬১) পেয়েছিলাম অগ্নিশপথে সোচ্চার রোকেয়া রহমান কবির ও রবীন্দ্রসংগীত-চর্চায়, রবীন্দ্র-আন্দোলনে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে কৃতী অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুনকে। স্মৃতিজাগানিয়া সেই শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলিতে ওয়ারী পাড়ায় সকল কর্মকাণ্ডের; মুকুল ফৌজ, ভাষা-আন্দোলন, রবীন্দ্রচর্চা, রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনের কর্মকাণ্ড, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সবকিছু ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিট, র‌্যাংকিন স্ট্রিট, যুগীনগর, হেয়ার স্ট্রিট ও বলধা গার্ডেনকে ঘিরে প্রথিতযশা ডা. মন্ময়নাথ নন্দী, শিল্পী কামরুল হাসান, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহেদুর রহিম, সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, ফয়েজ আহমেদ, রোজবুবু, শ্রদ্ধেয় মানিক ঘোষ এবং আমাদের স্যার আনিসুজ্জামান সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-বাংলাভাষা আন্দোলনের কর্মী থেকে নেতৃত্ব পর্যায়ের ভূমিকায় কর্মব্যস্ত ছিলেন।
অনেকের সঙ্গে আমি আগ্রহভরে জড়িত হয়েছিলাম। ইন্দিরা নন্দী, মন্দিরা নন্দী, বাবা মন্মথনাথ নন্দী এবং মা শান্তি নন্দী (নারী শিক্ষা মন্দিরের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন) নিজেদের র‌্যাংকিন স্ট্রিটের বাসায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন। সেই সূত্রে বর্তমানে প্রয়াত আমার পঞ্চম ভাই আবদুল হালিমের বন্ধু হিসেবে ঘনিষ্ঠ আনিস স্যারের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রভাব পারিবারিকভাবে আমার ওপরও পড়েছিল।
অল্পবিস্তর, পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রভাবে আনিস স্যারের এবং আরো বহু প্রগতিশীল-রাজনীতি-সচেতন, সংস্কৃতিবান নারী ও পুরুষ ব্যক্তিত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রমেই সাংগঠনিক ও আন্দোলনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়লাম।
লেখাপড়ার ক্রম ধাপগুলো ডিঙিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের অনার্স-এমএ শেষ করার সময়ে সাহিত্যপাঠ, রোকেয়া হলের ভিপি এবং ডাকসুর সংসদে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১ নম্বরের জন্য এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলেও ভেঙে পড়িনি। ছাত্র-রাজনীতি থেকে উত্তীর্ণ হলাম নারী-আন্দোলনের কাজে। কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রথমে ঢাকার এবং পরে দেশের বহু গৃহিণী, শিক্ষক, পেশাজীবী, সাহিত্যিক নারীদের সংগঠিত করার কাজ করেছি। ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের শেষে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, মূলত ভারতীয় ও সোভিয়েত মহাশূন্যচারী ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা-পরিচালিত আন্তর্জাতিক ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন’ (ডব্লিউআইডিএফ) নারী সংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত নারী-আন্দোলনের কাজে জাতীয় সংগঠকের গুরুদায়িত্ব পেয়ে আনন্দে কাজ করেছি। সেই সময়েও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চর্চায় যুক্ত ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের, পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে।
এসব কাজের মধ্যেও নারীবিষয়ক গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেছি এবং পেশাগত খণ্ডকালীন, কখনো সার্বক্ষণিক কাজ করেছি। সব কাজের মধ্যমণি ছিল নারীসমাজ। সাহিত্যচর্চাও ছিল মূল পেশাগত কাজ। ব্যক্তিগত-পেশাগত, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আন্দোলন-সংগঠনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতে হয়েছিল।
দেশের ও বিদেশের সংগঠক, নেতা-নেত্রী, গবেষক ও কর্মীদের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার কাজ করেছি মহাআনন্দে। নারী-পুরুষ সংগঠক-গবেষকদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দময় সম্পর্ক গড়ে তোলার স্রোতধারায় আনিস স্যারের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ, নিরপেক্ষ পথনির্দেশ আমার ব্যক্তিগত গবেষণা ও পেশাগত কাজে-চর্চায় এক ও অনন্য হয়ে আছে।
বাংলাদেশের নারী-আন্দোলনের চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের ও ২০২০-এর ৮ মার্চ পর্যন্ত যত ঘটনা এবং যত ইতিহাস আনিস স্যারের জানা ছিল সে-সব বিষয়ে আমাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন।
স্যারের অনুপ্রেরণায় সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আনিসুজ্জামান এবং প্রকাশক আবুল খায়েরের বরাবর একটি গবেষণা-প্রস্তাব দিয়েছিলাম ২০১৬ সালে। ‘বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনে নারীর ভূমিকা : ১৯৪৭-১৯৯০’ – শিরোনামে আমার গবেষণা প্রস্তাবটি আনিস স্যার অনুমোদন করার সময় আমি বলেছিলাম, স্যার আপনি আমার গবেষণা পরিচালক হবেন এটাই আমার একান্ত ইচ্ছা। স্যার সম্মতি দিলেন। অবশ্য বললেন, আরো দুজন বিশেষজ্ঞকে সহযোগী পরিচালকের দায়িত্বে যুক্ত করলে ভালো হয়। আমি প্রস্তাব দিলাম, ড. নাজমা চৌধুরী এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে যুক্ত করা যেতে পারে। স্যার সম্মতি দিলেন। গবেষণার ব্যয়ভার নিলেন আবুল খায়ের লিটু। সাংগঠনিক প্রক্রিয়াশেষে গবেষণার বিষয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কাজের একটি প্রস্তাব তৈরি করে সকলের সম্মতি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। সেই গবেষণার কাজটি স্যারের পরামর্শে, সহযোগিতায় এবং উৎসাহে এগিয়ে চলছিল।
বারবার স্যার বলেছিলেন, ‘বেশি সময় নিও না; বেশি বড় করো না।’ ১৯৯০ সালের সময়সীমা তিনি বাড়াতে বললেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত গণআন্দোলনে নারীর ভূমিকা বিষয়ে কাজের পরিসীমা বাড়ালাম ১৯৪৭-২০০০ পর্যন্ত।
১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমার ছাত্র-নারী রাজনীতিতে সাংগঠনিকভাবে সংযুক্তি ঘটেছিল। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (মণি সিংহ নেতা) সদস্য ছিলাম। নারী-আন্দোলনের ইতিহাস জানা ও পড়ার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন নারী নেত্রীদের রাজনৈতিক কাজ, কারাজীবন, সামাজিক নারী অধিকার আন্দোলনের বিষয়ে জানছিলাম। সেই সাথে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজের মধ্য দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ও নারী অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। দীর্ঘকাল ধরে এই বিষয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় আনিস স্যার, ড. নাজমা চৌধুরী ও ড. মুনতাসীর মামুনের অব্যাহত সহায়তায় কাজটি এগিয়েছে অনেক দূর।
ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগের অধ্যাপক পদে ২০০০-১১ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলাম। পরবর্তীকালে আজ পর্যন্ত ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি’র ‘সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগের চেয়ারপারসনের দায়িত্বে ও অধ্যাপনায় যুক্ত আছি। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিস স্যারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নারী শিক্ষা-সংস্কৃতি-আন্দোলন বিষয়ে বক্তব্য জানার সুযোগ হয়েছিল।
দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছে গবেষণার তথ্যাদি সংগ্রহে, সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণে এবং লেখা প্রস্তুতিতে। আনিস স্যারের কাছে কাজের বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছি। লেখা, কম্পোজ, সংশোধনী করে ছক অনুযায়ী অনেকদূর এগিয়েছি। আনিস স্যার সর্বশেষ ২০২০ সালের (চলতি বছরের) জানুয়ারি মাসে আমার লেখাগুলো যত্ন ও সময় নিয়ে দেখলেন। সেদিন প্রায় সারাদিন স্যারের বাসায় ছিলাম। প্রিয় বেবী ভাবির সাদর সস্নেহ পরিবেশনায় খাওয়া, গল্প – সবকিছুর স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে মনে। স্যার পরামর্শ দিয়েছিলেন :
সামগ্রিকভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে শুধু রাজনীতিভিত্তিক আন্দোলনের বিবরণ যেন না হয়ে ওঠে এই গবেষণা। নারীর ভূমিকা মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও সংযোজন করতে হবে।
স্যারের নির্দেশ-পরামর্শ অনুসারে কাজ অব্যাহত ছিল। কাজও অনেক এগিয়েছে। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশে আঘাত হানলো ৮ মার্চ, ২০২০। আমি-আমরা নানা দুশ্চিন্তায়, ভাইরাসের আতঙ্কে বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলো। শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে কাজের পরিকল্পনার জন্য অনলাইন, জুম, ই-মেইল, টেলিফোন সবকিছু শিখলাম, কাজ শুরু করলাম।
এই সময়কালে সিদ্দিকা (বেবী) ভাবির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি, জেনেছিলাম স্যারের শারীরিক অবস্থা – হার্টের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, চলাফেরার সমস্যা ইত্যাদি ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছিল। হাসপাতালে নেওয়া হলো স্যারকে। মে মাসের শুরু থেকে ১৪ মে সকাল পর্যন্ত ক্রমশ অসুস্থতা। হাসপাতালে চিকিৎসা চলার পরে ১৪ মে বিকেলশেষে ঘড়িতে যখন ৪টা ৫০ মিনিটে স্যারের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার খবর জানলাম। ঝড়ো বৃষ্টি ছিল। প্রকৃতি কাঁদছিল। স্ত্রী-সন্তানেরা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুজন অসহায় হয়ে পড়লেন। জানুয়ারির পরে তিন মাসের বেশি সময় তাঁকে সরাসরি দেখতে যেতে পারিনি। এই আফসোস, বেদনা তীব্র দহন জ্বালায় আমাকে দগ্ধ করে চলেছে।
আমার অসম্পূর্ণ গবেষণার কাজটি স্যারের অনুমোদন, পরামর্শ অনুসারে শেষ করা আমার শিরোধার্য হয়ে উঠেছে। আবুল খায়ের লিটুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, পরামর্শদাতা, পথনির্দেশক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের স্মৃতিতে পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।