আনিসুজ্জামান, প্রিয় শিক্ষক

বৈশ্বিক দুর্দিনের এক করোনাকালে মহাকালের সহজ হিসাবের খাতায় লেখা হলো তাঁর নাম। তিনি নিজে ছিলেন এক সহজ মানুষ, সহজ মনীষী এবং ছিলেন সহজলভ্য, সকলের জন্য। অশীতি-অতিক্রান্ত কর্মক্লান্ত দেহটি যখন আর নিজের ভার সইতে পারে না, অথচ তাকে থাকতে হয় সজাগ, সতর্ক ও সক্রিয়, তখন করুণাময়ের অপার করুণা হয়তোবা এভাবেই নেমে আসে। তাঁর জীবনব্যাপী দানের ঋণ নীরবে নতমস্তকে স্মরণ করার এবং তাঁকে শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাবার সুযোগ পেল না – এ দুঃখ বাঙালিকে বহন করতে হবে অনেকদিন। রবি-প্রয়াণের পরে নজরুল লিখেছিলেন, ‘ঘুমাইতে দাও ক্লান্ত রবিরে। …’ আমাদের কবি-শিরোমণি শামসুর রাহমান এবং সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর জীবন-স্তোত্র রচনার পরিতৃপ্তি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন তাঁর আগেই। বিনয়নম্র, সদাপ্রসন্ন তাঁর শোকগাথা তাই লিখতে হলো বাংলার প্রকৃতিকে। টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর বিদায়ী দৃশ্যের ভার আমরা বহন করবো আজীবন; ইতিহাসে এ-দৃশ্যটি লেখা হলো আমাদের চোখের জলে।

আনিসুজ্জামান। এ-নামটির আগে-পরে গুণীজনদের হাত দিয়েই বিশেষণ এসেছে প্রচুর। তাঁর জীবদ্দশাতেই বলা হলো, ‘… জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, সৃজনশীলতা, উদার মানবিকতা এবং সত্য ও সুন্দরের নিরন্তর সাধনায় নিজেকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, এখন তিনিই তাঁর তুলনা। এজন্য তাঁর নামের আগে-পরে (আর) কোনো বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে না।’ (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান সম্মাননা গ্রন্থ) আজ তাঁর মহাপ্রয়াণের পরে আমরা দেখছি আমাদের হাহাকারের অন্ধকার শূন্যতা জুড়ে জেগে আছে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মতো অভ্রভেদী এক কীর্তিস্তম্ভ নাম, আনিসুজ্জামান।

তাঁর চলে  যাবার পরে তাণ্ডবনৃত্যে আমাদের এপার-ওপার লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল আম্পান। আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে। প্রহরজুড়ে তখন দূরদর্শনে চোখ পেতে বসে থাকা। না, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে নয়, বসে আছি স্যারের জন্মগ্রাম দেখবো বলে। স্যারকে কাছে থেকে দেখার (শ্রেণিকক্ষের বাইরে) সৌভাগ্য যাদের হয়নি বা তাঁর নামের সঙ্গে অবিনয়ী ‘আমি’ শব্দটি জুড়ে কিছু বলার বা লেখার স্পর্ধায় তো নয়ই, ভালোবেসেও যারা তা পারে না তাদের প্রতিনিধি হয়ে বসে থেকেছি তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মধন্য, পিতামহের নামধন্য সেই গ্রামের পথঘাট, বাড়িঘর, গাছপালা ও মানুষজন দেখবো বলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অগণ্য, অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর তিনি ছিলেন প্রিয় শিক্ষক। স্যার ছিলেন পরশপাথর। যাদের ছুঁয়েছেন তারা জানে। মরিয়া হয়ে যারা তাঁকে ছুঁয়েছে তারাও জানে। আমরা যারা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে ডানে-বাঁয়ে প্রসন্নতার দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে সম্ভাষিত হবার আগেই নিরুচ্চারে সকলের অভিবাদনের উত্তর দিতে দিতে স্যারের আসা-যাওয়া দেখেছি তাদের ওইটুকু স্মৃতিও কম মহার্ঘ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার বেশ কয়েক বছর পরে সন্তানদের স্কুলের বার্ষিক বিচিত্রানুষ্ঠানে স্যারকে প্রধান অতিথির আসনে দেখে চমকে উঠি। পাহাড়তলীর এক কোণে পাহাড়চূড়ায় ছোট্ট মিশনারি স্কুল। সেখানে সৌম্যদর্শন ফাদারদের সঙ্গে স্যারকে দেখে ভেবেছি হয়তো এঁদের আমন্ত্রণেই এসেছেন। পরে জেনেছি স্যারের উপস্থিতি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার প্রয়োজন ছিল এবং তাঁর উদ্দেশ্য বিফল হয়নি। অনুষ্ঠানশেষে স্যারকে মধ্যমণি করে মঞ্চে যখন ছবি তোলার তোড়জোড় হচ্ছে, তখন দর্শকসারির এক কোণে বসে স্যারের মুখে নিজের নাম শুনে আমি বিহ্বল। স্মরণশক্তির চূড়ান্ত প্রাখর্যেও এটি সম্ভব? এই ছিলেন আনিসুজ্জামান। একটি প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক বিচিত্রানুষ্ঠানে হাসিমুখে তিনিই কাটিয়ে দিতে পারেন পুরো একটি সন্ধ্যা। আসলে কাউকেই যে তিনি ফেরাতে পারতেন না বহুদিন পরে তাঁর আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে ভূঁইয়া ইকবালের একটি লেখায় তার ইঙ্গিত পেলাম। অধ্যাপক ইকবাল ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে গবেষণা ও সাহিত্যকর্ম ছাড়াও বিবেকবান বুদ্ধিজীবী হিসেবে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করার আন্দোলন, গণআদালত এবং ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যদানের মতো কাজের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও সামাজিক সংকটে এবং সংগ্রামে তাঁর নিরলস নেতৃত্বের কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে বলেন, ‘… তবে আমরা অনেক সময় তাঁকে নানা অকিঞ্চিৎকর কাজে ব্যস্ত রাখি।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এই বয়সে তাঁকে মানপত্র পাঠের মতো ‘মহৎ’ কাজে না লাগালেই কি নয়?’ স্যারের জন্য এমন আক্ষেপের আর প্রয়োজন নেই।

অধ্যাপক, গবেষণা ও লেখালেখির পাশাপাশি স্বদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা তাঁর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘ভাষা-আন্দোলন কী এবং কেন’ – এমন একটি চিন্তার দায় তাঁকে মাথায় নিতে হয়েছিল অনতিতারুণ্যে, কলেজে পাঠকালীন ছাত্রাবস্থায়। একই শিরোনামের পুস্তিকা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তাঁর চিন্তাশীল লেখনী পরিক্রমার সূচনা। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল বলে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি তাঁর মননশীল লেখনীর প্রসাদ পেয়ে গেছে নিরন্তর। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে সরকার ও বেপথু বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্রবিরোধিতার মুখে তাঁকে আমরা পেলাম আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে এবং এদেশে রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থটিও তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রথম এবং প্রধান আবেগ ঠিকই কিন্তু আনিসুজ্জামান নিছক আবেগতাড়িত হয়ে কখনো কোনো কাজ করেননি। আবেগকাতর মানুষ যে তিনি নন নিজ মুখে সে-কথা বলেও গেছেন। গভীর শ্রদ্ধা ও নিবিড় আবেগ প্রচ্ছন্ন রেখে এমনকি রবীন্দ্রনাথ বিষয়েও কতটা নির্মোহ বিশ্লেষণ সম্ভব তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধে সংকলিত রবীন্দ্রবিষয়ক দুটি প্রবন্ধ তার প্রমাণ।

 ১৯৬৯-এ রাজপথে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শিক্ষকসমাজের নেতৃত্বে থাকা আনিসুজ্জামানের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের পথ মুক্তিযুদ্ধে যথার্থ ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ জীবন বাজি রেখে অনিশ্চিত পথে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এঁদের কারো অবদান কাজের ধরন, পরিমাপ বা পরিসংখ্যান দিয়ে হয় না। আনিসুজ্জামান ২৫শে মার্চের পরে (১৯৭১) দেশত্যাগ করেন। ভারতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের মধ্যে দিয়ে শেষ হতে পারত; কিন্তু হয়নি। যুদ্ধশেষে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র সংকলন ও সম্পাদনার কাজ তাঁকে ছাড়া হয় না। তাঁর জন্য অবিসংবাদিতভাবে অপেক্ষিত থাকে সংবিধানের ইংরেজি খসড়ার বাংলা ভাষ্য তৈরি করার কাজ। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সভায় জাতীয় সংগীত, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, মৌলিক অধিকারের শর্তসাপেক্ষতা, এমনকি বাংলা ভাষা নিয়েও তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তাঁর ভূমিকা, তাঁর অবস্থান, সর্বোপরি তাঁর অবদান সম্পর্কে সকলেই অবগত রয়েছেন। তিনি নিজেও লিখেছেন, ‘… এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসের অর্ধেকই ঢাকায় থেকেছি সংবিধানের বাংলা ভাষ্য প্রণয়নের কাজে। অনেক খেটেছিলাম। কখনো গভীর রাতে ঘরে না ফিরে কামালের বসার ঘরে রাত কাটিয়ে সকালে আবার একসঙ্গে ফিরেছি গণপরিষদে। …’ জীবনব্যাপী সম্পূর্ণতার সাধকের শেষ হয়েও শেষ না হওয়া এ-কাজটি ২০০৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আইন-শব্দকোষ গ্রন্থের সংকলন ও সম্পাদনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তবে আমৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য কাজ তাঁকে করতে হয়েছে এবং করেছেন বলেই আজ তাঁর জীবন অবলম্বন করে জাতির ইতিহাসে পৌঁছানো সম্ভব।

স্বাধীন দেশে পেশাগত দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি স্বদেশে-বিদেশে গবেষক ও বক্তা আনিসুজ্জামানের কৃতিত্ব আমাদের গর্ব। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তবে দেশের দুর্দিনে, ইতিহাসের নানা সংকটকালে, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব ও যথোচিত ভূমিকার সাফল্য অধিক। বিশেষ করে গণ-আদালতে ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যদান তাঁর জন্য জাতির অভিভাবক হয়ে ওঠার পথ বেঁধে দেয়।

শুচিস্নিগ্ধ, রুচিস্নাত তাঁর দীর্ঘ জীবনে সাময়িক ঝড়-ঝাপটা আসেনি এমন নয়; কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েছেন, দোটানায় ভুগেছেন বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন – এমন শোনা যায়নি। বরং বেদনাদীর্ণ ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তেও কতটা অবিচলিত থেকেছেন সেসব কথা তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি। দৃঢ়প্রত্যয় ও স্থির সংকল্পে স্থিত ছিলেন বরাবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  পড়বেন, বাংলা বিভাগে ভর্তি হবেন এবং শিক্ষক হবেন এর কোনো বিকল্প ভাবনায় আন্দোলিত হননি কোনোদিন। পেশাগত জীবনের অনুষঙ্গে গবেষণা-ভাবনাও ছিল তাঁর মজ্জাগত। পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে লেখা প্রথম বইটি (মুসলিম-মানস বাংলা সাহিত্য) সম্পর্কে অর্ধশত বছর পরে যখন ওই সময়কার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর নতুন আলো পড়েছে, নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, নতুন বইও হয়েছে অনেক, তাঁর নিজেরও দৃষ্টিভঙ্গি খানিকটা বদলেছে, তখনো তিনি দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে বলেন, ‘আমি এখনো মনে করি যে ওই বইয়ে আমি যা বলেছি সে বিষয়ের মূল কথাগুলো আমি এখনো স্বীকার করি।’ নিজের সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘… অনেকে বলেন আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সবসময়ে কাজ করেছে।’ (সাক্ষাৎকার, অন্য আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) বস্তুত একই গবেষণাকর্ম কতটা চিন্তা, শ্রম, অধ্যয়ন-অধ্যবসায় দাবি করে এবং আনিসুজ্জামান কতখানি নিষ্ঠার সঙ্গে এ-কাজ করেছেন ড. ভূঁইয়া ইকবালকে লেখা তাঁর একটি পত্রে সে-প্রমাণ মেলে। 

১৯৭৭-এ লন্ডন থেকে তাঁর ‘ফ্যাক্টরি করেসপন্ডেন্স অ্যান্ড আদার বেঙ্গলি ডকুমেন্টস’ গবেষণা সম্পর্কে ওই চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, ‘… প্রায় ১১০০ চিঠির প্রতিটি চিঠির সারমর্ম লিখছি ইংরেজিতে। চল্লিশটা বা তার কিছু বেশি চিঠির পুরো অনুবাদ করতে হবে। Glossary থাকবে, Biographical notes on civilians mentioned in correspondence দিতে হবে। তারপর ভূমিকা। … Introduction লেখার জন্য দু-একটা বই পড়তে হচ্ছে যা এমন বিষয়ে, যার ক-খ পর্যন্ত জানি না। (Trade and commercial organization in Bengal ধরনের মহৎ সাহিত্য)।’ (‘জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য’, ভূঁইয়া ইকবাল, দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) আনিসুজ্জামানের এই গবেষণাকর্মটি বাংলার কৃষি ও শিল্প ধ্বংসের ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের এক করুণ অথচ উপভোগ্য ইতিহাস। সার্বক্ষণিক তন্নিষ্ঠতায় ডুবে থাকা এমন গবেষণাকালেও তিনি কীভাবে স্বদেশের সাহিত্যে গবেষণার অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভাবতেন ভূঁইয়া ইকবালকে লেখা চিঠিতে তারও সাক্ষ্য রয়েছে। বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল পুরনো বাংলা গদ্য। দুশো বছরের গদ্যের সম্ভব সব ধরনের নমুনা যাচাই করে কাজের পথ বেয়ে বাংলা গদ্যের ভাবের জগতে উত্তরণ এবং সব ধরনের আলস্য ও পিছুটান পেছনে ফেলে তার আধুনিক হয়ে-ওঠা বিষয়ক এ-গ্রন্থটিও বাংলা গদ্যের ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন। বস্তুত তাঁর গবেষণার আলো পড়েছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। নতুন পথরেখার নির্দেশনাও তিনি রেখে গেছেন।

বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ জ্ঞান শুধু নয়, তিনি রেখে গেছেন ভাষা-ব্যবহারের, ভাষা-প্রয়োগের অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রবন্ধাবলিতে তো বটেই, তাঁর স্মৃতিকথন ও আত্মলেখাগুলিতেও তাঁর গদ্য নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তাঁকে দেখার, শোনার বা তাঁর সান্নিধ্যধন্য হবার সুযোগ যাঁরা পাননি বা পাবেন না তাঁরা তাঁর লেখায় তাঁকে পাবেন। আনিসুজ্জামানের সদাপ্রসন্ন মেজাজের সার্বক্ষণিক প্রসন্নতা, রুচিবোধের লাবণ্য, সৌজন্যবোধের সাহজিকতা, পরিমিতি জ্ঞানের যাথার্থ্য এবং তাঁর মেধা-মননের শানিত রূপের প্রতিফলন তাঁর ভাষা। ভাষার সম্মোহক এক ক্ষুরধার সারল্যের তিনি অধীশ্বর।

মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের স্বরূপ দেখেছে বাঙালি জাতি। আনিসুজ্জামান এই ঐক্যকে আরাধ্য করেছেন তাঁর সকল কাজে।  ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা গ্রহণ করতে গেছেন দিল্লিতে। অশোকা হোটেলের ড্রয়িংরুমে বসে দেখছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের খেলা। সুযোগটি হেলায় হারাননি সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন, ‘এই উপমহাদেশে ক্রিকেট সত্যি-সত্যিই একটা ধর্ম হয়ে গেল। ক্রিকেট মানুষকে কানেক্ট করেছে, মানুষকে জুড়ছে। এর একটা সম্ভাব্য কারণ মনে হয়, ঘরে বসে নিজেদের খেলা উপভোগ করা, যাতে আমরা একাত্ম হতে পারি। ফুটবলও তো আমরা দেখছি। কিন্তু সেখানে একাত্মবোধ কাজ করে না। কারণ, ফুটবলবিশ্বে আমরা অকিঞ্চিৎকর। ক্রিকেটে দশটা দেশের মধ্যে আমরা একজন। ফুটবলে দেড়শো দেশের মধ্যেও আমরা নেই। ফুটবল তাই জাতিবোধে জুড়তে পারছে না, ক্রিকেট যা পারছে।’ আমরা লক্ষ করব কোথায়, কেন,  কীভাবে এবং কতভাবে তিনি আমাদের শিক্ষক। শুধু তাঁর ছাত্রদের নয়, আপামর জনগণের শিক্ষক। স্যারের দীর্ঘ জীবনের সব কাজ,  সকল সাধনা যে আদ্যোপান্ত নির্ভুল ছিল, তাঁর চিন্তার জগতে তিনি যে দ্বিমতের অবকাশ রাখেননি এমন নয়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে অকপটে লিখতে গিয়ে এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেও শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, ‘তাঁর নিজস্বতা একেবারেই তাঁর নিজস্ব এবং অনন্য। তদুপরি তিনি একই সঙ্গে নম্র ও দৃঢ় এবং সেখানেও অসাধারণ।’ (‘উদারনীতির অতি উজ্জ্বল প্রতিনিধি’, দৈনিক প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০১) এই সঙ্গে আমরা বলবো, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অগৌরবের অন্ধকার সময়ে বুদ্ধিজীবিতার দীপশিখাটি যাঁরা জ্বালিয়ে রেখেছেন, সযত্নে আগলে রেখেছেন এঁরা তাঁদের অগ্রগণ্য। আনিসুজ্জামান আমৃত্যু এ-কাজটি করে গেছেন। সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে বাঙালি জাতির জন্মদিন বলে অভিহিত করেছিলেন। আমরা বলি, বিশেষ কোনো দিনক্ষণ বা উপলক্ষ নয়, অনাগত বহু বহু যুগ ধরে আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা হয়ে থাকবেন তিনি – তাঁর জীবন, কর্ম ও সাধনা। আমাদের স্বাধীন স্বদেশের ও এ-জাতির বেঁচে থাকার প্রেরণা তাঁর জীবন, তাঁর কর্ম ও তাঁর সাধনা।