আনিস স্যারকে যেমন দেখেছি

অসুস্থ হয়ে শেষবারের মতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভবত মাসখানেক আগে একদিন সকাল দশটা-সাড়ে দশটার দিকে আনিস স্যার ফোন করে আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে নিয়ে আমার লেখাটি তাঁর ভালো লেগেছে। তিনি সেদিনই সকালে ভোরের কাগজে লেখাটি পড়েছেন বলায় আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম যে, লেখাটি আমার নতুন কোনো লেখা নয়; সেটি আমার আগের লেখা এবং তাঁকে নিয়ে চন্দ্রাবতী একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত সম্মাননাগ্রন্থেও লেখাটি মুদ্রিত হয়েছে। আনিস স্যার জানালেন, তাঁর ঠিক মনে নেই সেটি আগে পড়েছেন কি না। স্যারের সঙ্গে এটিই ছিল আমার শেষ আলাপ – সংক্ষিপ্ত কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো।
আনিস স্যার মিতভাষী মানুষ ছিলেন। উঁচু গলায় কথা বলতে তাঁকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু কথা বলতেন যুক্তিনিষ্ঠতার সঙ্গে, সবকিছু ভেবেচিন্তে; এবং এমন ভাষায় যা হতো সহজ কিন্তু অকাট্য ও যথাযথ। তাঁর লেখার মধ্যেও কথা বলার এই অনন্য বৈশিষ্ট্য অনায়াসে চোখে পড়ে। প্রাঞ্জলতা তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্য ও প্রসাদগুণ, কিন্তু পড়ার সময় পাঠকের মনে হবে – বক্তব্য বিষয় এমন গুছিয়ে পরিবেশন করার কী অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর ছিল! অকারণ বাহুল্যকে বর্জন করার গুণ ও দৃঢ়তা তাঁর সব রচনার মধ্যেই দেদীপ্যমান।
বিভাগীয় ছাত্র হিসেবে অথবা শিক্ষকতার কর্মজীবনে সহকর্মী রূপে আনিস স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ আমি পাইনি। চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষ পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার আশ্রয় ছিল কার্জন হল। সে-সময় বাংলা বিভাগে একবার কবিতা বিষয়ে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। সে-বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম কলাভবনে বাংলা বিভাগে। এছাড়া আর গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না, যদিও তখনকার পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের উত্তর পাশে বিখ্যাত শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম কবিবন্ধুদের সঙ্গে। কবিতার জগতে তখন আমার যাতায়াত নেহাত কম ছিল না। সমকাল কবিতা সংখ্যায় কবিতা ছাপা হয়েছে তারও আগে। গল্প লেখাও চলছিল। কিন্তু আনিস স্যারের সঙ্গে তখন আমার দেখা-সাক্ষাৎ বা পরিচয় হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় ও কিছুটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর। সে-সময় সাহিত্যিক আবুল ফজলকে কেন্দ্র করে বেশ ভালোভাবেই চলছিল ‘চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদে’র সাহিত্যসভাগুলি। সাহিত্যসভার আসর বসত তাঁর জুবিলী রোডের বাড়ি ‘সাহিত্য নিকেতনে’র দোতলায়।
আনিস স্যার চট্টগ্রামে আসার পর তাঁর সঙ্গে ক্রমেই চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। এই সময়ে আমিও চট্টগ্রামে ছিলাম এবং আনিস স্যারের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎও ক্রমশ বেশি হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ভারতের আগরতলা শহরে আশ্রয় গ্রহণ ও থাকার সময়ে মনে হয় বারদুয়েক দেখা হয়েছিল আমার। স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী হিসেবে মে মাসের শেষ সপ্তাহে অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে আমিও কলকাতায় চলে যাই এবং বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থান করতে থাকি। আনিস স্যার ইতোমধ্যে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। সার্কুলার রোডের বাড়িটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যালয়, রেকর্ডিং সেন্টার এবং স্থায়ী কর্মী ও শিল্পীদের আবাসস্থল। কথিকা রেকর্ড করার জন্য আনিস স্যার মাঝে মাঝে এখানে আসতেন, কিন্তু সে-সময় তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ হতো না। কেবল পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তিনি কুশলাদি জানতে চাইতেন। আমারও বলার তেমন কিছু থাকত না।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলটির বাংলা রূপান্তর করার জন্য কয়েকজন অনুবাদককে মনোনীত করা হয়। এই অনুবাদক দলের মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত হই। বাংলা অনুবাদকর্মটির সম্পাদনা করেছিলেন আনিস স্যার। এই সময়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন – আহমেদ হুমায়ুন এবং আমার অনুবাদ ভালো হয়েছে।
এ ঘটনার পর, অনেকদিন বাদে, বাংলা একাডেমির বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশকালে আনিস স্যারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। আমার কাছে সেটি অপ্রত্যাশিত ছিল। তবুও নতুন একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় সে-কাজটি আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করি আমি। সপ্তাহে সম্ভবত তিনদিন তিনি বাংলা একাডেমিতে আসতেন এবং বর্ধমান হাউসের গাড়িবারান্দার ওপরের কক্ষটিতে বসতেন। সেখানে আমিও বসতাম এবং তাঁর নির্দেশনা মেনে কাজ করতাম। এই সময়ে আমি খুব কাছ থেকে গবেষণাধর্মী সম্পাদনার কাজে তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠা ও যোগ্যতার বিষয়টি লক্ষ করতে পেরেছিলাম। আনিস স্যার ছিলেন অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ। বেশিরভাগ দিনে তিনি আমার আগেই পৌঁছে যেতেন এবং কাজে মগ্ন হয়ে পড়তেন। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ শেষ হওয়ার পর আনিস স্যার পূর্বপ্রকাশিত প্রথম খণ্ড পরিমার্জন ও সংশোধনের কাজ শুরু করেন এবং তাতে আমাকেও সঙ্গী করে নেন। এই দীর্ঘ দেড় বছরের মতো সময় আমার জীবনের এক অমূল্য সঞ্চয় বলে আমি মনে করি। এ-সময়ে যেমন তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি, তেমনি তাঁর অন্তরঙ্গ সাহচর্যও পেয়েছি।
এরপর কালি ও কলম পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এখানেও খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখতে পেয়েছি। সর্বশেষ, মাসছয়েক আগে তাঁরই অনুরোধক্রমে আমি এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ প্রকল্পে অনুবাদ সম্পাদনার কিছু কাজ করি। এসব অ্যাকাডেমিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে আনিস স্যার আমাকে বিশেষভাবে বাধিত করেছেন এবং আমি নিজেও এতে বেশ উপকৃত হয়েছি। আমার ধারণা, আমার মতো আরো অনেককে তিনি নানাভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং সেসব কাজে অমূল্য সহযোগিতাও দান করেছেন।
মানুষ হিসেবে আনিস স্যারের চরিত্রের বিশেষ গুণ হলো – অন্য মানুষদের প্রতি উষ্ণ ভালোবাসার প্রকাশ। মানুষের ইতিবাচক গুণগুলির মূল্যায়নই তিনি করতেন বেশি; মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং তার আবরণ ছিল হৃদয়ের গভীর উষ্ণতা। এই উষ্ণতার সঞ্চার আমাদের হৃদয়ে পরিপূর্ণভাবে ঘটেছে কি না তা আমি জানি না; শুধু তার সুবাসটুকুই আমাদের জীবনের পরম সঞ্চয় হিসেবে থাকুক – এমন আশাই করতে পারি।