মৃত্যু থেকে ঝলমলে বসন্তদিনের দিকে যাত্রা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী চিলির লেখিকা ইসাবেল আয়েন্দে (Isabel Allende) চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘California is my home and Chile is the land of my nostalgia. My heart isn’t divided, it has merely grows longer’। দুই জায়গার কোনোটিকেই অস্বীকার করে নয়, বরং তাদের উপস্থিতির কথা স্বীকার করেই আয়েন্দে তাঁর অস্তিত্বের অভিনিবেশ এবং লেখক-সত্তাকে টিকিয়ে রেখেই বলতে পেরেছিলেন, ‘I can live and write anywhere. Every book contributes to the completion of that ‘country inside my head’ .’ আমরা যারা নিজেদের দেশেই বসবাস করি, এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তখনই হই, যখন মূল ভাষা বা অনুবাদের মধ্যে দিয়ে একটি দেশ বা অঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাই। এই জড়িয়ে যাবার উপলক্ষটি আমাদের নানাভাবে তৈরি করে দিয়েছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

দুই
পড়াশোনা ও কর্মসূত্রে কলকাতায় এবং দেশের বাইরে নানা জায়গায় কাটিয়েছেন ঠিকই, তবে মানবেন্দ্রের শৈশব আর বালক বয়সটা কেটেছে কলকাতা থেকে দূরে, তখনকার মফস্বল শহর সিলেটে। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার ছেলেবেলাটা কেটেছিলো ছোট্ট একটা মফস্বল শহরে, বাংলার বাইরে। ‘বাংলার বাইরে’ কথাটা লিখেই একটু খটকা লাগলো। কারণ সেই ছোট্ট শহরটায় প্রায় সবাই বাঙালি।’ সেই শহরেই সার্কিট হাউসের বাংলোর পেছনে একটা ‘গোপন আশ্রয়ে’ গাছের ছায়ায় শুয়ে-শুয়ে বই পড়ার স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারেননি মানবেন্দ্র। ভুলতে পারেননি কুশিয়ারা নদীকে। আর সেইসঙ্গে ‘এক রহস্যময় কুহেলি ঢাকা বাড়ি’র বাসিন্দাদের। যে-বাড়িতে তিনি যেতেন বইয়ের খোঁজে, বইয়েরই টানে। তারপর জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির বিশেষ একটি মানুষের সঙ্গে, যাকে দেখে প্রথমেই যে-কারো মনে হতে পারে যেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের সেই ‘অমল’। তবে কোনো ছেলে নয়; চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সের এক রুগ্‌ণ কিশোরী।

তিন
মানবেন্দ্রের বিবরণ অনুযায়ী, ‘সারাদিন শুয়ে থাকে বিছানায়, ফ্যাকাশে ফরশা মুখ, এতই ফ্যাকাশে যে তাকে যে ফরশা দেখায় সে হয়তো তার ঐ রক্তশূন্যতার জন্যেই; সারাক্ষণ তার বিছানায় কাটে, তার পাশের টেবিলে থাকে কত রকম ওষুধের শিশি, জলের সোরাই আর গেলাস, আর থাকে বই – দেয়াল জোড়া আলমারি সব, তাতে দেদার বই। হয় সে শুয়ে-শুয়ে বই পড়ে, নয় চোখ বুজে শুয়ে থাকে – কিংবা শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে স্কাইলাইটের দিকে।’ তার আব্বা-আম্মা মেয়েটিকে ডাকতেন ‘বুবুল সোনা’ বলে। কিন্তু তারও একটা পোশাকি ভালো নাম ছিল, যে-নামটি আর নিশ্চিতভাবে মনে করতেন পারেন না মানবেন্দ্র : ‘কী নাম ছিলো সেটা? জাহানারা? শাহানা? নাসিমা? আয়েষা? এরই কোনো-একটা।’ এটাকেই হয়তো লোকে বলে সময়ের হাতে স্মৃতির কাছে পরাজয়। হয়তো সেই পোশাকি নামটা তেমন কাজে লাগেনি বলেই এই বিস্মরণ। মানবেন্দ্র আরো জানিয়েছেন, ‘কী তার অসুখ কেউ আমাদের বলেনি, কিন্তু এটা জানতুম যে ডাক্তাররা বলে দিয়েছে বেশিদিন বাঁচবে না।’ একটা সময় তারা সেই শহর ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। আর কখনোই দেখা হয়নি তাদের।

চার
তাঁর নিজস্ব স্মৃতির গোপন এলাকার বাইরে সেই কিশোরী মেয়েটি কোথাও আর নেই। না মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায়, না গল্প-উপন্যাসে, না অনুবাদে। কিন্তু সেই কিশোরীর আন্তরিক তাগিদেই ‘লেখা’ শুরু করেছিলেন তিনি – এটা ভুলতে পারেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কবিতায় কোনো কিশোরী ছিলো না কখনও, কোনো ছোট্ট মেয়ে ছিলো না, যাকে দেখতে ছিলো শিউলি ফুলের মতো, রোদ্দুরের আঁচে যে-ফুল শুকিয়ে যাচ্ছিলো।’
তাঁর লেখালেখির গোটা জীবন জুড়েই সেই কিশোরীর গোপন অথচ অমোঘ উপস্থিতির কথা মানবেন্দ্র আমাদের অকপটে জানিয়ে দেন। এইভাবে স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে যেন বলেন, ‘তার জন্যেই লিখেছিলুম। দেশ-বিদেশের লেখা, যে-সব দেশে সে কোনোদিন যেতেও পারবে না – বইয়ের মধ্যে দিয়ে ছাড়া – তারও তর্জমা ওরই জন্যে তো। আর তো ছিলো কলেজের পড়ার খরচ চালাবার জন্যে প্রকাশকের ফরমাশে অনুবাদের কাজ – কোনো বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট কাউকে পড়াবার চাইতে তো ভালো ছিলো। আর সে-লেখা ছাপা হলে সেইসঙ্গে তারও পড়া হয়ে যাবে হয়তো। লেখার পেছনে এই ভাবটাও ছিলো। যদি সে কোথাও থাকে, তবে হয়তো পড়বে, এই ভেবেই লিখেছিলুম।’

পাঁচ
মানবেন্দ্রসহ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা যাঁকে সারাজীবনই অন্তর্চেতনা দিয়ে, আপ্লবে শিক্ষক হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, সেই বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৮ সালে লিখছেন, ‘প্রথমেই বলতে চাই যে সাহিত্য মানেই বিশ্বসাহিত্য। ‘বাংলা সাহিত্য’, ‘ইংরেজি সাহিত্য’, ‘ভারতীয় সাহিত্য’, ‘য়োরোপীয় সাহিত্য’ – এই সব নামকরণের সার্থকতা নেই এমন কথা কেউ বলবে না; কোনো-কোনো ক্ষেত্রে এরা অপরিহার্য; কিন্তু একান্তভাবে এদেরই অবলম্বন করলে সাহিত্যকে আমরা খণ্ডিত করে দেখবো; তা যে, ঈশ্বরের মতোই, বহুবিচিত্রের মধ্যে এক, সে-কথা আমাদের ধারণার বাইরে থেকে যাবে।’ এইজন্যই সাহিত্যগত-প্রাণ বুদ্ধদেব এটিকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর ভাবনাটা বরং এরকম যে, ‘মানুষে-মানুষে ভাষাগত ও জাতিগত বৈষম্য আছে, আছে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিশিষ্টতা; কিন্তু এইসব বিভেদ সত্ত্বেও, এমনকি বিভেদের মধ্য দিয়েই, মানুষ যে মৌলিকভাবে এক, তাও আমরা স্বীকার না-করে পারি না। তেমনি, সাহিত্য।’ আর এরই সূত্র ধরে বুদ্ধদেব বসু এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান যে, ‘বাঙালি, ইহুদি, জর্মান – এই তথ্যগুলির অন্তরালে ও পরপারে ‘মানুষ’ নামক একটি ধারণাও আমরা নিত্য উপলব্ধি করছি, তেমনি বিশেষ-বিশেষ ভাষা, দেশ, জাতিকে অতিক্রম করে ‘সাহিত্য’ নামে একটি সর্বজনীন ও চিরন্তন সত্তাও আমাদের মনে সুস্পষ্ট। ‘বিশ্বসাহিত্য’ এরই আধুনিক নাম।’ এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব গে্যঁটের বিশ্ববীক্ষা ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের পুনরাবিষ্কারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে ভোলেননি।

ছয়
বিশ্বসাহিত্যের এই প্রসঙ্গ ধরেই অনিবার্যভাবে চলে আসে অনুবাদের কথা। যদিও সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথী অনুবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিমত গোপন রাখেননি। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই দলে গিয়ে ভেড়েন। শুধুই কি রবীন্দ্রনাথ? ফ্রস্টের (Robert Frost) মতো কবিকেও বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘Poetry is what gets lost in translation’। এঁদের সবার বিপক্ষেই ছিল বুদ্ধদেব বসুর কঠোর অবস্থান। প্রাচ্যের কালিদাস থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের বোদলেয়ার, ফ্রিডরিশ হোল্ডার্লিন, রাইনের মারিয়া রিলকে; চিনা কবি থেকে রুশ কবি বরিস পাস্তেরনাক; সুইডিশ ডাগ হামারশেল্ড – বলা যেতে পারে এক ভুবনব্যাপী ‘অনুবাদ’ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব একা।
‘অনুবাদে মূলের অনেক কিছু হারিয়ে যায়’ কিংবা ‘অনুবাদে সাহিত্যের কিছুই পাওয়া যায় না’ – এসব কথার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবেই জানান দিয়ে বুদ্ধদেব বসু অন্য আরেকটি প্রবন্ধে (১৯৫৫) বলেছিলেন, ‘অনুবাদে কিছু পাওয়া যায় না’ – এই উক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অভিজ্ঞতারও সাক্ষ্য আছে : আমরা অনেকেই ও-বস্তুর মধ্যে সারা জীবনের সম্পদ খুঁজে পেয়েছি, যেমন শেক্সপিয়র ও কিটস পেয়েছিলেন তাঁদের মাতৃভাষায় রূপান্তরিত গ্রীক বা লাতিন কাব্যে।’

সাত
অনুবাদ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ভিনদেশি ভাষা-শিক্ষার কথা চলে আসে। বুদ্ধদেব বসুও সেটি স্বীকার করেছিলেন। তবে পাশাপাশি তিনি এটাও বলেছেন, ‘ইটালিয়ানে দান্তে পড়াটাই আদর্শ তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু এই আদর্শের প্রতি অন্ধ আসক্তিবশত আমরা যদি বারে-বারেই নতুন ভাষা শিখতে যাই, তাহলে – যদি না কেউ মেধা ও অধ্যবসায়ের গৌরীশৃঙ্গ থাকেন – সেই চেষ্টার পরিণতি ঘটবে বিশ্বসাহিত্যের প্রত্যাখ্যানে।’ নিজের এই বক্তব্যকে আরো একটু প্রসারিত করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বলছেন, ‘আমরা যারা রুশ, স্প্যানিশ, লাতিন, গ্রীক, চৈনিক প্রভৃতি ভাষা জানি না, তারাও সে-সব ভাষার কাব্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি দুটি-তিনটি অনুবাদ মিলিয়ে পড়লে, জানতে পাই কবির মন, কী তিনি বলতে চেয়েছেন, হয়তো তাঁর ভঙ্গিরও খানিকটা।’ সেইসঙ্গে বুদ্ধদেব এটিও স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, অনুবাদে ‘মূলের অনেক রমণীয়তা নিশ্চয়ই বাদ পড়ে, কিন্তু – যদি সে-কবি শুধু শব্দের বেসাতি না-করে কিছু বলেও থাকেন – মোটের উপর এমন দামি জিনিশ পাওয়াই যাবে, যা হয়তো আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যে নেই, আর যার সঙ্গে পরিচয়ের ফলে সেই সাহিত্যের ঋদ্ধির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।’ আর সেই সম্ভাবনার সূত্রেই সাহিত্যের তুলনামূলক একটি ভাষ্য-নির্মাণে আমরা ধীরে-ধীরে হলেও অভিজ্ঞ হয়ে উঠি। সাহিত্যের পাঠপরিক্রমায় আমাদের উপলব্ধির গভীরতা বাড়ে। বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের ঐকতান সত্যিকার অর্থেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। যার পরিণতিতে রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটিই নতুনভাবে তাৎপর্যময়তা পায় যে, ‘বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিশ্বমানবকে দেখিবার লক্ষ্য আমরা স্থির করিব, প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রতাকে গ্রহণ করিব এবং সেই সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশচেষ্টার সম্বন্ধ দেখিব।’
রবীন্দ্রনাথ-কথিত এই সমগ্রতার সন্ধানে আমৃত্যু নিজেকে মগ্ন রেখেছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

আট
বুদ্ধদেব বসুর পরে বাংলা সাহিত্যে আর কাউকেই পাওয়া যায় না, যিনি মানবেন্দ্রের মতো নিজেকে নিবিষ্টভাবে অনুবাদকর্মে এইভাবে সমর্পিত করেছিলেন। তাঁর কবি-পরিচয়, অধ্যাপক-পরিচয় – সবকিছুই ছাপিয়ে গিয়েছিল এই অনুবাদক পরিচয়ের আড়ালে। লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে ক্যারিবীয় অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপ – গোটা দুনিয়ার একটি বড় অঞ্চল মানবেন্দ্রের হাত ঘুরে আমাদের কাছে অন্য আলোয় নতুনভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সাহিত্য যথার্থভাবেই তাঁর হাতে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা পায়। তাঁর অনুবাদকর্মের সামান্য একটি অংশ যদি পাঠকের সামান্য পেশ করা যায়, তাহলে বুঝতে পারাটা সহজ হয়ে ওঠে তাঁর রুচির বৈচিত্র্য আর সাহিত্যের প্রতি মগ্ন-ভালোবাসার নিদর্শনের একটি স্বরূপ।
প্রথমে কথাসাহিত্যের প্রসঙ্গই যদি তুলি, দেখব – তর্জমা করেছেন মেক্সিকোর কথাসাহিত্যিক হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র (মাঘ, ১৩৯৬)। যেখানে রুলফোর বিখ্যাত পেদ্রো পারামো উপন্যাসটিসহ আরো পনেরোটি গল্পের অনুবাদ জায়গা পেয়েছে। অনুবাদ করেছেন কিউবান কথাসাহিত্যিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের-এর রচনাসংগ্রহ (মাঘ, ১৩৯৭)। সেখানে রয়েছে দুটো উপন্যাস আর পাঁচটি গল্প। কলাম্বিয়ার বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে আমরা বাংলা ভাষায় প্রথম পেলাম মানবেন্দ্রেরই সৌজন্যে – কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না (বৈশাখ, ১৩৯৭), সরলা এরেন্দিরা আর তার নিদয়া ঠাকুরমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনী (শ্রাবণ, ১৩৯৭)।
লাতিন আমেরিকার এইসব কথাসাহিত্যের মধ্যে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে, সেটি ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’, যাকে মানবেন্দ্র বলেছেন ‘বাস্তবের কুহক’। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন, ‘বাস্তবের কুহক, তাহলে, লুকিয়ে থাকে বলবার ধরনটাতেই। যে-কথাটা খুব ভালো করে তাঁর লেখায় বলতে চেয়েছেন হুলিও কোর্তাসার, আর রোকামাদুরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন, যেমন ঋণ স্বীকার করেছেন আলেহো কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো বা কার্লোস ফুয়েন্তেসেরে কাছে। ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ একজন লেখকের সৃষ্টি নয় – সকলের সম্মিলিত চেষ্টার ফল।’
এবার কবিতার অনুবাদের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায়, তাহলে দেখব একজন কবিতাপ্রেমী অনুবাদকের অবিশ্বাস্য পরিশ্রম আর নিষ্ঠার অনন্য নিবেদন। পোল্যান্ডের কবি চেসোয়াভ মিউশ : শ্রেষ্ঠ কবিতা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২); চেক প্রজাতন্ত্রের কবি মিরোস্লাভ হোলুবের শ্রেষ্ঠ কবিতা (মে, ১৯৮৫); সার্বিয়ার ভাসকো পোপার শ্রেষ্ঠ কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬); এই স্বপ্ন! এই গন্তব্য!/ লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবিতা (মে, ১৯৮৭); বারবাডোসের কবি ব্রাফেটের কবিতাগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন স্তব্ধতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে : এডওয়ার্ড কামাউ ব্রাফেট-এর কবিতা (মার্চ, ১৯৯০); চিলির পাবলো নেরুদার গীতিনাট্য হোয়াকিন মুরিয়েতর মহিমা ও মৃত্যু (জানুয়ারি, ১৯৯১); চিলির নিকানোর পার্‌রার শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা (জুন, ১৯৯২); কিউবার কবিদের কবিতার সংকলন গুয়ানতানামেরা কবিতা কুবানা (বইমেলা, ২০০৩); অস্ট্রিয়ার পেটার হান্‌ট্‌কের অর্থহীনতা আর সুখ (বইমেলা, জানুয়ারি ২০১১)। এখানে লেখা বাহুল্য, মানবেন্দ্রের অনুবাদকর্মের একটি সামান্য অংশের তালিকা এটি।
কবিতার অনুবাদের বেলায় মানবেন্দ্র কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতেন। যেমন, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘কবিতার তরজমা একই সঙ্গে কবিতাও হবে, আবার বিশ্বস্তও হবে – তরজমাকারের এই স্বয়ংরচিত দ্বৈরথের শেষ কোথায়, তা অন্তত আমার জানা নেই।’ কিন্তু তিনি সেইসঙ্গে এও জানিয়েছিলেন, কবিতা ‘তরজমা করতে গিয়ে আমি যেমন যথাযথ থাকতে চেয়েছি তেমনি আবার বাংলায় যাতে … কবিতার তুমুল অভিঘাত পৌঁছোয়, সেদিকেও সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি।’ বুঝতে পারি অনুবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল একেবারেই সুস্পষ্ট এবং বেশ খানিকটা বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদভাবনার অনুবর্তী।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-কথাসাহিত্যিক-কবি-অনুবাদক কেতকী কুশারী ডাইসন জানিয়েছিলেন, ‘সাহিত্যানুবাদের আরেক উদ্দেশ্য হলো বিশুদ্ধভাবে সাহিত্যিক – সাহিত্যের রসকেই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সঞ্চারিত করা। … যে-ভাষাটা পাঠকরা জানেন না, বা অল্পই জানেন, সেই ভাষার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পাঠকদের সহিতত্ব ঘটাতে হবে। এই ধরনের কাজ সাহিত্যসৃষ্টির সঙ্গেই সমান্তরাল, তারই সঙ্গে তুলনীয় একটা ক্রিয়া।’ কাজেই অনুবাদকর্মকে মৌলিক সাহিত্য রচনার চেয়ে কম মূল্যজ্ঞান করবার আজ অন্তত কোনো উপায় নেই। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকৃতির আলোচনা প্রসঙ্গে কথাগুলো যেন মনে রাখি।

নয়
আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যেও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বড়রকমের অবদান রয়েছে। বিশেষ করে সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনার বিচারের ক্ষেত্রে। সুকুমার রায় থেকে শুরু করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; বুদ্ধদেব বসু থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাংলাদেশের শামসুর রাহমান পর্যন্ত সেই প্রবন্ধের বিস্তৃতি। পাশাপাশি বিদেশি সাহিত্যের, বিশেষভাবে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের পর্যালোচনা তো রয়েইছে।
কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত বা শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা তাঁর গদ্য যেন কবিতা-পাঠকের প্রাণ ছুঁয়ে যায়। প্রণবেন্দুকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘অলিন্দ থেকে জীবনে’ শীর্ষক প্রবন্ধ। আমরা জানি অধ্যাপনা, কবিতা লেখার পাশপাশি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত অলিন্দ নামে একটি সাহিত্যপত্রও সম্পাদনা করেছেন। আর যতই তিনি বলুন, ‘রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ফতোয়া সাহিত্য আমি অপছন্দ করি।’ সেইসঙ্গে এটিও জানাতে দ্বিধা করেননি যে, ‘সমাজবোধ বা জীবনবোধ যদি কবিতায় অনুভূত না হয় তাহলে তা ব্যর্থ।’ প্রণবেন্দুর কবিতায় তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধ নানাভাবে ঝলসে উঠেছে। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন –
এ মানুষের কাছে আরেক মানুষ বসে থাকে।
চোখে-চোখে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ঘুরে যায়।
বাংলা ভাষা, মুখে খেলা করে।
… … …
এক মানুষের কাছে আরেক মানুষ
পাথরখণ্ডের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে না।
একদিন সমস্ত পাথর ফেটে যাবে।
ঝরনা কি নদীর মতো, অফুরান জলপ্রবাহের মতো
সবাই এগিয়ে যাবে। জীবনের বাইরে থেকে
জীবনের কিছুটা ভেতরে।
পঞ্চাশের কাব্য-প্রবণতার কথা বলতে গিয়ে মানবেন্দ্র তৎকালীন কিছু কবির এক ঝোঁকের কথা বেশ কৌতুকের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘মধ্যপঞ্চাশে অনেক অদ্ভুত ব্যাপারও ঘটতো। … তখন কারু-কারু মধ্যে অদ্ভুত কতগুলো প্রবণতাও জন্মে গিয়েছিল।’ কেমন সেই প্রবণতা? মানবেন্দ্র জানিয়েছিলেন, কবিদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, ‘বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা ছাপাবার জন্যে একরকম কবিতা লিখতে হবে, আর ‘পরিচয়’ তখন বামপন্থীদের দখলে বলে সেখানে লেখা পাঠাতে হবে অন্যরকম কবিতা।’ সেইসঙ্গে অতীতের দিকে চোখ ফিরিয়ে তিনি বলেছেন, ‘একটু অদ্ভুত লাগবে ভাবতে, তবু এরকম একটা চাপা গুঞ্জনও চলতি ছিলো – কাগজ অনুযায়ী কবিতার ধরন পালটে ফেলতে হবে, বক্তব্য ও প্রকরণ সুদ্ধু।’ এরপরেই মানবেন্দ্র লিখেছেন, ‘এই পটভূমির মধ্যেই কিন্তু প্রণবেন্দু দাশগুপ্তকে ভেবে নিতে হবে আমাদের।’ কেন প্রণবেন্দুকে আলাদাভাবে ভাবতে হবে, তার কারণ জানাতে গিয়ে মানবেন্দ্র জানাচ্ছেন, ‘প্রণবেন্দু সবসময়ে নিজের মতোই লিখতেন, কাগজের চাহিদা অনুযায়ী বহুরূপী হয়ে যেতেন না।’ এও এক প্রবণতা বটে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের, যাঁকে মানবেন্দ্র শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে ভোলেননি। প্রণবেন্দুর আরেকটি বিশেষ দিকের প্রতি তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সেটি হচ্ছে – পঞ্চাশের দশকের ‘কবিদের মধ্যে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘কনটেমপরারি আর্টিস্টদের’ যে-ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো, তেমন হয়তো আর কারু সঙ্গে নয়। প্রণবেন্দু পরে যে বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী বিষয়ে টুকরো-টুকরো পরিচায়িকা লিখবেন সাময়িকপত্রে, তারও পেছনে হয়তো ছিলো ছবি সম্বন্ধে এই সময়েই গড়ে-ওঠা অনুরাগ – বা আকর্ষণ।’ এখানে আমরা অন্য-এক প্রণবেন্দুকে পাই। কিংবা হয়তো কবিতার প্রণবেন্দু আর ছবি নিয়ে টুকরো-লেখার প্রণবেন্দু – দুটো মিলেই তাঁর কাব্যসত্তা গড়ে উঠেছিল। চিত্রপ্রদর্শনী নিয়ে লেখা প্রণবেন্দুর সেই গদ্যগুলো কেউ একসঙ্গে সংকলিত করবেন, এমন আশা করাটা নিশ্চয়ই অসংগত হবে না।
প্রণবেন্দুর কবিতার আরো একটি বিশেষ প্রবণতা সম্পর্কে মানবেন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আমাদের প্রতারিত করেই, তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে – ‘শান্ত ও নিস্তরঙ্গ’। সেইসঙ্গে কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে মানব জানাচ্ছেন, ‘তাঁর [প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত] জানা, তাঁর দেখা, তাঁর শোনা চারপাশের জগৎ ঐ আপাত শান্ত উপরিতলের আড়ালে কোথাও একটা তোলপাড় ঘটায়, আলোড়ন চালায়।’ পাশাপাশি মানবেন্দ্র কবিতায় সমর্পিত পাঠকের মতোই স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ‘বাংলা কবিতার ধারাকে স্বীকার করেই – আত্মস্থ করে নিয়েই – প্রণবেন্দু পৌঁছেছিলেন শেষ পর্যন্ত তাঁর এই সিদ্ধান্তে – ‘শুধু বিচ্ছিন্নতা নয়’। … তাঁর কবিতা, শেষ পর্যন্ত, সংলগ্ন হয়েই থাকে আমাদের জীবনের সঙ্গে।’
তাঁর শুধু বিচ্ছিন্নতা নয় (জুলাই, ১৯৭৬) কাব্যের শেষ কবিতায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত লিখেছিলেন –
যখনই তোমরা যাও, যেভাবেই যাও, তার শব্দিত চলন
বুকের ভেতরে যেন বুকের ভেতরে এক তরঙ্গ শোনায়;
আমার মৃদুতা আছে – নীল জামাটির মতো তাকে ভালোবাসি,
তারও মেরুদণ্ড থাকে – তোমরা স্বীকার কর, আমি তোমাদের
দূর থেকে ছুঁয়ে আছি। এই হাত রচনা-প্রয়াসী।
প্রণবেন্দুকে নিয়ে মানবেন্দ্রের এই মূল্যায়ন তাৎক্ষণিকের নয়; বরং এর ভেতরে আছে গভীর অভিনিবেশের এক প্রবহণ, যা কিনা তাঁর সমালোচক-সত্তাকে মুগ্ধচিত্ত পাঠকের কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এতে শুধু কবি একাই নন, সমালোচকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।

দশ
কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর ‘প্রাণের মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন মানবেন্দ্র। তাঁর রাহমান-মুগ্ধতা যেন যুক্তি আর আবেগের বন্যায় উপচে পড়েছে। মানব লিখেছেন, ‘সেই-যে কবে আমি দেখেছিলাম শামসুর রাহমানকে, সম্ভবত তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র। কী একটা কাজে একদিন সকালবেলায় গেছি আমার শিক্ষক নরেশ গুহ-র বাসায়। আর সেখানেই তখন প্রথম চাক্ষুষ দেখেছিলাম শামসুর রাহমানকে।’ কিন্তু কবির সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় যে তারও অনেক আগে সেটিও মানব আমাদের জানিয়ে দেন। কীভাবে আলাপ আর কেমন করেই-বা পরিচয়? উত্তর হচ্ছে – কবিতার মাধ্যমে। কবিতা, চতুরঙ্গ, পূর্বাশা – কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শামসুর রাহমানের কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে, আর সেগুলো থেকে তাঁর কবিতা আস্বাদন করছেন তরুণ মানবেন্দ্র। তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল শামসুর রাহমানের ‘কবিতার গড়ন, ছন্দের খেলা, প্রাণের সুর।’ এইগুলোই তো একটি সার্থক কবিতার মধ্যে আমরা খুঁজে পেতে চাই। নরেশ গুহর মাধ্যমেই তিনি শামসুর রাহমানের প্রথম দুটি কবিতার বই হাতে পেয়েছিলেন।
মানবেন্দ্র বলেছিলেন, জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত মুগ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শামসুর রাহমানের কবিতা ছিল ‘একান্তই নিজস্ব একটি ঘরানার।’ শুধুই রাহমানের কবিতায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন, তা নয়। শামসুর রাহমানের গদ্যরচনারও তিনি ‘ভক্ত’ হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষভাবেই উল্লেখ করেছিলেন তাঁর স্মৃতির শহর বইটির কথা। এই বইটি সম্পর্কে মানবেন্দ্র বলেছিলেন, এটি ‘ছোটোদের উদ্দেশ করেই হয়তো রূপকথার গড়ন নিয়ে লেখা।’ কিন্তু এটাও জানাতে ভোলেননি যে, এই বই ‘শুধু ছোটোদের নয়, সকলেরই পড়বার।’ রাহমানের গদ্যের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন ‘গদ্যের সেই চাল’, যার মধ্যে ‘মাঝে মাঝে স্ফুরণ ঘটে কবিতার – না, কোনো কাব্যি-কাব্যি ন্যাকামিভাব নয়, বরং সত্যিকার কবিতারই চকিত উদ্ভাস।’ তিনি উল্লেখ করেন রাহমানের আরেকটি গদ্য-সংকলন – একান্ত ভাবনার কথা। যদিও মুদ্রণ প্রমাদে সেটি হয়ে গেছে একান্ত আপন। শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর বা একান্ত ভাবনার সঙ্গে যাদের পরিচয় রয়েছে, তারা আশা করি মানবেন্দ্রের কথার সারবত্তা উপলব্ধি করতে পারবেন। একান্ত ভাবনা থেকে একটি টুকরো উদ্ধৃতি করছি –
‘লেখা শুরু করতে গিয়ে প্রতিবারই মুশকিলে পড়তে হয়। কাগজ-কলম নিয়ে বসি, আঙুলের ফাঁকে সিগারেটকে পুড়তে দিই, চা খাই ঘন ঘন, কিন্তু লেখনী থেকে শব্দাবলি নিঃসৃত হয় না। আকাশের দিকে তাকাই, চোখদুটোকে বারবার দৌড় করাই ঘরের চার দেয়ালে দু-চারবার। লেখার কাগজ ছিঁড়ি কুটি কুটি করে। বাজে কাগজের ঝুড়ি দ্রুত ভরে ওঠে, অথচ কাগজ স্রেফ শাদা থেকে যায়। এমন পরিস্থিতিতে খুব নার্ভাস লাগে, মনে হয়, আর কখনো কিছু লিখতে পারবো না।’
এই হচ্ছে শামসুর রাহমানের কাব্যময় গদ্যভাষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যাতে মুগ্ধ না-হয়ে পারা যায় না।
শামসুর রাহমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে মানব আরো আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘কখনো যে একটানা তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ছে তা নয়। কিন্তু যতবার দেখা হয়েছে, আমি তাঁর স্মিত চারুবাকে মুগ্ধ হয়েছি।’ সেইসঙ্গে তিনি এটিও জানিয়ে দিতে ভোলেননি, ‘সেই মুগ্ধতারই সামান্য স্বীকৃতি হিসেবে আমি আমার তরজমা করা কবিতা কুবানার সংকলন ‘গুয়ানতানামেরা’ তাঁকে উৎসর্গ করেছিলাম ২০০৩ সালে। আর সে-বই পেয়ে তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন।’
এই যে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের পাশাপাশি রাহমানের সাহিত্যকৃতির পর্যালোচনা – সাহিত্য-সমালোচনার এই ধরনটিও আমাদের মুগ্ধ করে। লেখাটির সমাপ্তি টেনেছেন তিনি এইভাবে – ‘তাঁর সঙ্গে আর দেখাই হয়নি। হবেও না। কিন্তু তাই-বা বলি কী করে? তিনি তো তাঁর কবিতার মধ্যেই আছেন। আমাদের ঠিক প্রাণের মধ্যে।’ এইভাবেই পাঠক-সমালোচকের মনে একজন মৃত সাহিত্যিক মৃত্যুকে পরাজিত করে তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন।

এগারো
আমাদের সাহিত্যে যে-চিহ্ন রেখে গেলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তাকে মুছে ফেলা কঠিন হবে। মৃত্যু অবধারিত সত্য, সে শক্তিমান। কিন্তু সবসময় মানুষের বিরুদ্ধে সে জয়ী হতে পারে না। যাঁরা শুধুই সাহিত্যের নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও নিবিড় পাঠক, সেইসব বাংলাভাষী সাহিত্য-পাঠকদের কাছে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়োজন ফুরোবে না। কবি এজরা পাউন্ডের প্রসঙ্গ টেনে বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছিলেন, পাউন্ডের মতে, ‘অনুবাদও এক রকমের সমালোচনা।’ সাহিত্য-সমালোচনা তো বটেই। সমালোচনার সেই গণ্ডিকে ক্রমশই বিস্তৃত করে গেছেন মানবেন্দ্র।

বারো
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আমরা, আবার সেখানেই একটু ফিরে যাই। সেই যে কৈশোরের শাহানা কি আয়েষা কি নাসিমা কি জাহানারা – যার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল, আসলেই কি এইসব মানবীয় আবেগের কখনো বিচ্ছেদ ঘটে? মানবেন্দ্র তাঁর সেই স্মৃতিচারণমূলক লেখায় তো বলেইছিলেন, চিরদিনের মতো সেই কিশোরী বিদায় নিলেও ‘তারপর থেকে সব লেখাই তার জন্যে।’ আর ‘একটা ফাঁকা, হা-হা করে-ওঠা অথচ ঝলমলে বসন্ত দিনের জন্যে’ই তাঁর এইসব লেখালেখি। তাঁর একটা কবিতায় মানবেন্দ্র লিখেছিলেন, ‘জীবন যখন মাত্র একটাই, তাকে ধীরে-ধীরে/ নিজেই নতুন করে উদ্ভাবন করে নিতে হয়/ মৃত্যুরও ভেতরে।’ এখন থেকে নিজের সেই উদ্ভাবিত জগতেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন ঘর-বসতি গড়ে নেবার পালা শুরু। মৃত্যুত্তীর্ণ জীবনের এ এক নতুন আরম্ভ। যেখানে ঝলমলে বসন্তদিনের অপেক্ষায় কৈশোরের সেই শাহানা কি আয়েষা কি নাসিমা কি জাহানারা!