অরুণ সেন : শ্রদ্ধার্ঘ্য

বাংলা প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের ঐতিহাসে অরুণ সেন একজন বিশিষ্ট গদ্যকার। গত ৪ জুলাই ২০২০ তাঁর প্রয়াণ ঘটে। কবি বিষ্ণু দে চর্চা এবং বিষ্ণু দে-র জীবনীগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে অরুণ সেনের লেখালেখির জগতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। উত্তর কলকাতার জয়পুরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনা করেছেন। আসলে তাঁর কাছে শিক্ষাদানের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবিদ্যাচর্চা তথা আন্তর্জাতিক সাহিত্যচর্চার একটি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে আজন্ম সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। পরিচয়, সাহিত্যপত্র, প্রতিক্ষণ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পরিচয় পত্রিকার দফতরে বন্ধুবর দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত প্রমুখ সাহিত্যিকের সঙ্গে আড্ডা ও সাহিত্যচর্চায় প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। প্রতিক্ষণ পত্রিকা দফতরেও তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। জয়পুরিয়া কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর দীর্ঘদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছিলেন। অধ্যাপনা করার সঙ্গে সঙ্গে কোনো গবেষকের তাঁর কাছে বইপত্র চাওয়া থেকে শুরু করে পরামর্শ পর্যন্ত তিনি দিতেন। এক্ষেত্রে তাঁর এই সহৃদয় সাহায্যকারী মনোভাব আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। বিষ্ণু দে-র সাহিত্যচর্চার একটি বিশিষ্ট তথা অ্যাকাডেমিক বিদ্যাচর্চার ধারা তিনি সম্পাদন করেছেন। বিষ্ণু দে সম্পর্কে তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – এই মৈত্রী এই মতান্তর, বিষ্ণু দে-র রচনাপঞ্জি, বিষ্ণু দে, এ ব্রতযাত্রায়, বিষ্ণু দে-র নন্দনবিশ্ব, বিষ্ণু দে-র কথা, যামিনী রায় বিষ্ণু দে : বিনিময় প্রভৃতি। অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন বিষ্ণু দে : কালে, কালোত্তরে। এছাড়া সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে ভারতীয় সাহিত্যকার জীবনী পুস্তকমালা সিরিজে তাঁর লেখা বিষ্ণু দে জীবনীগ্রন্থটি এখন পর্যন্ত বিষ্ণু দে-র প্রথম প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থ। একজন ঐতিহাসিক মন তাঁর অন্তরে সদাজাগ্রত থাকত, তাই বিষ্ণু দে-র জীবনী রচনা করতে গিয়ে তিনি সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সেই সত্য স্বীকার করে বলেছেন –
আমরা একজন কবির জন্ম ও বিকাশের কাহিনীটাই লিখতে চেষ্টা করব। এই কাহিনীটাই তাঁর জীবনী, যদিও এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে দেশকালের অবয়বকেও আমরা দেখতে চাই। আমরা চাই আয়নাটা যাতে দুই বিপরীত দিক থেকেই কাজ করে – জীবন ও সৃষ্টিতে প্রতিফলিত দেশকাল এবং দেশকালে প্রতিফলিত তাঁর জীবন ও সৃষ্টি। (পৃ ৪)
আবার যখন তিনি বিষ্ণু দে-র কবিতায় সুন্দর ও অসুন্দরের দ্বন্দ্ব অন্বেষণ করেন সেক্ষেত্রে সমালোচক অরুণ সেনের নান্দনিকবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এমনকি বিষ্ণু দে-র কবিতার অবয়ব নির্মাণশৈলীর বিষয়েও তাঁর অভিনিবেশ আমাদের বিস্মিত করে।
এর পাশাপাশি তাঁর লেখা বাংলাদেশের সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থগুলির পরিচয় পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে যাই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ-আয়োজিত ‘সতীনাথ ভাদুড়ী স্মারক বক্তৃতা (৩)’ দিয়েছিলেন তিনি। বক্তৃতার বিষয় হিসেবে তিনি নির্ধারণ করেছিলেন – ‘বাংলাদেশের উপন্যাসের আগে-পরে’ এবং অরুণ সেন এর ‘মুখবন্ধ’তে জানিয়েছেন –
সতীনাথকে স্মরণ করেই বাংলাদেশের উপন্যাসের বৈচিত্র্য ও তাতে নিম্নবর্গীয় জীবন সন্ধানের সাম্প্রতিক চেষ্টার কথা যদি ওঠে, তা আশা করি প্রাসঙ্গিক হবে।
২০০৮ সালে ১৮ ও ১৯ মার্চ তিনি এই বক্তৃতা প্রদান করেন। পরে সেটি সতীনাথ ভাদুড়ী স্মারক বক্তৃতা গ্রন্থমালা ৩ হিসেবে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ১১ এপ্রিল ২০০৮ ডায়মন্ড-হারবার ফকিরচাঁদ কলেজে ‘বাংলাদেশের কবিতার চারদিক’, বারাসত পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-এর ১৩ মার্চ ‘বাংলাদেশের নাটক’ শিরোনামে বিশেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে তিনি এসব বক্তৃতা ও ‘শামসুর রাহমানের একটি কবিতা’-নামাঙ্কিত প্রবন্ধসহ একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। অরুণ সেন গ্রন্থটির নামাঙ্কন করেন সাহিত্যের বাংলাদেশ। আসলে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই প্রসঙ্গে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো – দুই বাঙালি এক বাঙালি, বাংলা বই বাংলাদেশের বই (দুই খণ্ড), সেলিম আল দীন : নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র, দেশে বাংলাদেশে বাঙালির আত্মসত্তা নির্মাণ (যুগ্ম সম্পাদক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়), বাঙালি ও বাংলাদেশ (যুগ্ম-সম্পাদক আবুল হাসনাত) প্রভৃতি। বাংলাদেশের নির্বাচিত উপন্যাসসংকলন দুটি খণ্ডে সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। দ্বিখণ্ডিত বঙ্গদেশের ব্যথা অন্তরে রেখেছিলেন এবং সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের কাছে পূর্ববঙ্গের প্রতি এক অভ্যস্ত অনুৎসাহ তাঁর কাছে বাংলাভাষী বাঙালি হিসেবে লজ্জা ও দুঃখবোধের কারণ ছিল, সেই থেকেই বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাভাষী বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড় অন্বেষণে তিনি সাহিত্য, সংগীত, ইতিহাসচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত দুই বাঙালি, এক বাঙালি গ্রন্থের ভূমিকায় সেই ব্যথাজড়িত ক্ষোভ নিয়ে এই সত্য স্বীকার করে বলেছেন –
সব মিলিয়ে এই বাংলাদেশ, তার মানুষ ও তার সংস্কৃতির সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে করতেই ওখানে যাওয়া, এই বোধ এবং তা নিয়েই লেখালেখি। এপারের বাঙালি হিসেবে ওপারের বাঙালির রূপকে চিনতে চাওয়া, আর তারই মধ্যে অপার বাংলার স্বরূপকে বুঝে নেওয়া।
বাঙালি ও বাংলাদেশ বাংলাদেশের প্রবন্ধ সংকলন এবং দেশে বাংলাদেশে বাঙালির আত্মসত্তা নির্মাণ প্রবন্ধ সংকলন দুটি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
পিতামহ পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন, দেশভাগের স্মৃতি ও পূর্ববঙ্গের প্রতি অন্তরে অকৃত্রিম ভালোবাসা তখনো অটুট ছিল অধ্যাপক সেনের। তাই তিনি কলকাতায় মানুষ হয়েও মনেপ্রাণে একটি অখণ্ড বঙ্গদেশকে লালন করেছিলেন আমৃত্যু। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ কলকাতার বাঙাল : উভচর স্মৃতি (২০১৯) লিখেছিলেন –
কলকাতায় থাকলেও পূর্ববঙ্গের অনেক অভ্যাস ও স্বভাব তাদের রক্তে। আজীবন পশ্চিমবঙ্গবাসী হয়েও আমিও তো তাই। এখানে বাল্য, কৈশোর, যৌবনের দিনগুলি পার হয়ে পৌঁছেছি বার্ধক্যে। – দুই বাংলারই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে সম্বল করে।
শিল্পসাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর কৃতিত্ব অবশ্য উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত অন্য গ্রন্থগুলি হলো – কবিতার দায় কবিতার মুক্তি, বই পড়া বইপাড়া, কবিতা : এই সময়ের পাঠ, বাচন ও স্বনির্বাচন, কোনারক যৌবনমন্দির, যোগেন চৌধুরীর ছবি
প্রভৃতি। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন কবিতার কলকাতা, সমুদ্রের কবিতা, কবি অরুণ মিত্র (যুগ্ম-সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ), বিষ্ণু দে : সাতরঙার সিমফনি, বিভূতিভূষণ : আধুনিক জিজ্ঞাসা প্রভৃতি। পরিচয়, প্রতিক্ষণ, অন্তঃসার, বারোমাস প্রভৃতি পত্রিকায় সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর। একসময়ে প্রতিক্ষণ পত্রিকায় নতুন কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটানোর জন্য নিয়মিত গদ্য লিখতেন। তরুণ সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। গ্রন্থ-সমালোচক হিসেবেও তাঁকে কলম ধরতে হয়েছিল। বন্ধুমহলে আড্ডারসিক মানুষ ছিলেন তিনি। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংগীত বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহ ছিল। বঙ্গবিদ্যাচর্চা, কবি বিষ্ণু দে চর্চা, বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার বিবিধ ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ রসপিপাসু মনন আমাদের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণীয় হয়ে থাকবে। আমার মতো অর্বাচীন ও অযোগ্য ব্যক্তির পক্ষে তাঁর লেখালেখি নিয়ে কিছু বলা ধৃষ্ঠতামাত্র। অধ্যাপক অরুণ সেনের অকালপ্রয়াণে অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাই।