নজরুল-চর্চার দিগ্বলয়

অভিজিৎ দাশগুপ্ত

নজরুল চর্চা : একালের ভাবনায়
সম্পাদনা : নিরুপম আচার্য
পরম্পরা
কলকাতা
৩০০ রুপি

তাঁকে আবিষ্কার করার চেষ্টা এদেশে সেভাবে হয়নি। কিন্তু ধারা যে শুকিয়ে যায়নি, তার প্রমাণ নজরুল চর্চা : একালের ভাবনায় বইটি। সম্পাদনা করেছেন নিরুপম আচার্য। ২৪০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে এক দিবসীয় রাজ্যস্তরের আলোচনা সভার সারাৎসার। সাতাশটি প্রবন্ধের ভেতর দিয়ে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ কাজী নজরুলকে দেখার চেষ্টা হয়েছে।
আসাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সমরেশ মণ্ডলের ‘সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বন্ধন : নজরুলের মানবতা ও ঐক্যবন্ধনের সাম্যবাদ’ প্রবন্ধটি বর্তমান সময় অনুযায়ী পাঠপ্রতিক্রিয়া দাবি করে। আলোচনার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন – “সাম্প্রদায়িকতা’ এবং ‘ঐক্যবন্ধনের সাম্যবাদ’ শব্দ দুটি আলাদা কিন্তু এই শব্দ দুটি অতীত থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে, বর্তমান পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে অসহিষ্ণুতার প্রভাব লক্ষ করা যায়।” তাঁর এই স্পষ্ট বক্তব্য আমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে। হিন্দু- মুসলমানের সম্প্রীতির জন্য এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো এত বলিষ্ঠ লেখা আর কেউ লেখেননি। জাকির হোসেন মণ্ডলের এই মত সর্বাংশে সত্য। এ-প্রসঙ্গেই আসে দ্বিতীয় ভাবনাটি। ‘নজরুলের কবিতা : রাজনীতি ও মানবতার যুগলবন্দি’তে স্বরূপ হালদার ভারতীয় রাজনীতি ও নজরুলের প্রতিবাদী লেখনীসত্তা বিশ্লেষণ করেছেন মার্কসীয় উপলব্ধিতে।
নজরুল এই অনুভবের আকাশকে ধরতে চেয়েছেন স্বাতী বসু রাউত তাঁর ‘শ্রমজীবী সমাজের উত্থান ও কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনাচিন্তা’ রচনায়। এক জায়গায় তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘নজরুল মন থেকেই শ্রমজীবীদের ভালোবাসতেন। … নজরুল বিশ্বাস করতেন শ্রমজীবীদের প্রকৃত মঙ্গল মিটিং-মিছিল-ফেস্টুন-ব্যানার-লোক দেখানো বক্তৃতায় হবে না।’ প্রাবন্ধিকের এ-ভাবনা যথার্থ।
আচ্ছা, নজরুলই কি বাঙালির স্বপ্নের নায়ক শঙ্কর (‘চাঁদের পাহাড়’)। ইংরেজ সরকারের ভালো চাকরিতে জীবনের মোক্ষ বলে যখন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ভাবতে শুরু করেছে, তখন নজরুল গণ্ডির মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পেও সে-ভাবনা তুলে ধরেছেন লেখক বিহঙ্গ দূত। ‘আধুনিকতার দ্বন্দ্ব : বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ লেখাটিতে কবির অর্ধেক জীবন বই-পত্রপত্রিকার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। এর সঙ্গেই সমন্বয়ী জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় ‘রাক্ষুসি’, ‘স্বামীহারা’ ইত্যাদি গল্পে। দেবিকা মণ্ডল তাঁর ‘ছোটগল্পের বিন্দুবিশ্ব : নজরুল ও বাস্তবতা’ প্রবন্ধে সেদিকটারই সুলুকসন্ধান করেছেন। তাঁর মতে, নজরুলের ছোটগল্পগুলি ‘সর্বদোষ-ত্রুটিমুক্ত হয়ত নয় … কিন্তু ছোটগল্পগুলির অসাধারণ বাস্তববোধ আমাদের রসবোধকে উসকে দেয়।’ সেইসঙ্গে নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে কস্তুরী করের আলোচনাটিরও উল্লেখ প্রয়োজন। ‘প্রথম মহাযুদ্ধের পর আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত মাতৃভূমি এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট।’ তাঁর সঠিক মূল্যায়ন – ‘অনেকে উপন্যাসকে মহাকাব্যের আধুনিক যুগ বলে মনে করেন। এ কথা কতটা ঠিক তা অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষ। তবে এই উপন্যাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ধ্যান ধারণাকে বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে জন্মানো ধূমকেতু কবি নজরুল যেন চ্যালেঞ্জ করলেন, সাহিত্যে আনলেন ‘neo-realism’-এর ছোঁয়া।’
বলা হয়, নজরুলের প্রকৃত জীবনবোধ ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটিতে সমাজের সঙ্গে সঙ্গে কবির সংসারজীবনের সংকটের ছবিও ধরা আছে। হিন্দু ব্রাহ্ম কন্যাকে (প্রমীলা দেবী) বিবাহের ফলে তাঁকে কী ধরনের সংকটের মোকাবিলা করতে হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন ড. সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় (‘কবি নজরুলের জীবনের প্রতিবিম্ব : ‘আমার কৈফিয়ৎ’)।
নজরুলের ভেতর অফুরন্ত প্রাণশক্তি। সেই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে তিনি রচনা করেছেন শাক্ত সংগীত, উপন্যাস, গান ইত্যাদি। শাক্ত নজরুলের মাতৃসংগীত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অভিজিৎ পাল। এ যেন কোনো ধর্ম থেকে নয়, মাতৃহারা বালকের আর্তি মাকে পাওয়ার জন্য। ‘নজরুলের গানে তন্ত্রের দেবী মহাকালী হয়ে উঠেছেন ভারতমাতারই সমার্থক এক সত্তা।’ তাঁর এই প্রতিভার দ্যুতি (সংগীতে) কত ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। রাজু মণ্ডলের যথার্থ বিশ্লেষণ – ‘গজল দিয়ে শুরু করেন তিনি। এরপর একে একে রচনা করেন – কাওয়ালি, নাত, ভজন, কোরাস, কাব্যগীতি, নানাবিধ লৌকিক সুরভক্তির গান, দেশাত্মবোধক, বিদেশি সুরভক্তির গান, কুচকাওয়াজের গান, নারী-জাগরণের গান, হিন্দুস্তানি খেয়াল, ইসলামী সংগীত ও নবীর গান, লুপ্ত রাগরাগিণীর পুনরুজ্জীবনমূলক গান ও শিশুসংগীত। তাঁর মতো এতো প্রকারের গান রচনা করেন শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের শুর্বাট ও আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ (‘গানের নজরুল : বিচিত্র প্রতিভার দ্যুতি’)
নজরুলকে বাস্তববাদী হিসেবে দাগিয়ে দিলেও তাঁর সাহিত্যে বাংলার ফুল, পাখি, প্রকৃতি, শস্য-শ্যামল ভূমি আর ঋতু পরিক্রমার অপরূপ চিত্র আমরা পাচ্ছি। সুমনা সাহু এ-সম্বন্ধে তাঁর প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘কবির জন্ম রাঢ় বাংলার লালমাটি আর কাঁকড়ের দেশে। তবু ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা প্রভৃতি জায়গায় বাংলার শ্যামল- শোভন প্রকৃতিকে তিনি অবলোকন করেছেন কবির দৃষ্টিতে।’ (‘নজরুল সাহিত্যে প্রকৃতি’)। ভূতের ভয় নজরুলের একটি রূপক সাংকেতিক নাটক। স্বর্গ থেকে ভূতদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে দেবাদিপতি দেবলোকে সভা ডেকেছেন। তার বক্তব্য সোজা : ‘… ঐ মন্ত্র উচ্চারণ কর/ সকলে। মাভৈঃ। মাভৈঃ। ভয় নাই। শুধু এই/ বাণীর আশ্বাসে এই মন্ত্রের জোরেই আমরা অভিশপ্ত/ আত্মা ভূতে দলকে আবার সাগর-পারে তাড়িয়ে/ আসবো (প্রথম দৃশ্য) (‘ভূতের ভয়’ : কাজী নজরুল ইসলামের নাটকে দেশপ্রেম’, শেখ কামাল উদ্দিন)। স্বাধীনতার জন্য নজরুলের আত্মবলিদানের ইচ্ছাকেও লেখক উল্লেখ করেছেন গুরুত্ব দিয়ে। নজরুলের কবিতার চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন মৌমিত পাত্র। বিভিন্ন কবিতার পঙ্‌ক্তি ধরে ধরে তিনি দেখিয়েছেন নজরুলের শব্দ-বুনন কীভাবে গভীর ব্যঞ্জনাসহ চিত্রকে উপস্থিত করছে।
গণমাধ্যমের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ ছিল সরাসরি। রেডিও, চলচ্চিত্র, নাটক, রেকর্ড কোম্পানি ইত্যাদি বিনোদনের সবকটি মাধ্যমে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। দীপঙ্কর সরদারের তথ্যবহুল লেখাটি ‘গণমাধ্যম ও নজরুল : একটি পর্যালোচনা’ নামে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। এ অন্যতম প্রাপ্তি বলে মনে হয়। প্রদীপ্ত রায়ের ‘ঔপনিবেশিক অবিভক্ত বাংলার চলচ্চিত্রের অভিযাত্রায় নজরুল’ লেখাটিতে কবির চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে কাহিনিকার, অভিনেতা, সহ-পরিচালক নজরুলের উদারমনস্কতাকেও কুর্নিশ জানিয়েছেন লেখক। যেমন আরো একটি প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও একই অভিমত এ-লেখকের। অমৃত লাল বিশ্বাস তাঁর ‘কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় উপভাষার ব্যবহার’ প্রবন্ধে বেশ পরিশ্রম করে শব্দ চয়ন করেছেন। দু-বাংলার আঞ্চলিক শব্দ কীভাবে তাঁর কবিতায় স্থান করে নিয়েছে, সে-তথ্য উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন।
পনেরো ফর্মার এই বইটিতে সম্পাদক এবং সাহায্যকারী মিলিয়ে নয়জন। ফলে পাঠকের দিক থেকে আশার পরিমাণটা একটু বেশি হলে, তাকে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যায় না। তবে এমন একটি বইয়ের প্রবন্ধগুলো আরো গুরুত্বসহকারে বিচার করে সূচিবদ্ধ করা উচিত। একই বিষয় (কবিতা, গল্প, চলচ্চিত্র) বিভিন্ন লেখায় একাধিকবার উঠে আসায় পাঠক হিসেবে ক্লান্তি আসে। নজরুল মানেই একধরনের আবেগ – এই প্রচলিত ধারণাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর সাহিত্যের আরো গভীরে আলো ফেলা প্রয়োজন। বইটিতে বানান ভুল চোখে পড়ার মতো। যেমন – আবিচ্চত (প্রাক কথা), ধুমকেতু (পৃ ১১৭), আকাঙ্খা (১১৮, ১৩০), সৌভাতৃত্ব, অগ্নিবীনা (১১৮), ভুত (১৪৫), ভ্রুকুটি (১১৩), লক্ষী (১১৯), সত্ত্বা (১৫৪), ধুসর (১৯৭) ইত্যাদি। এমন একটি চর্চাগ্রন্থে এই জাতীয় ত্রুটি অনুচিত।
বইটির প্রচ্ছদ সুন্দর এবং যথাযথ, প্রথম দর্শনেই হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করে। বিপুলকুমার ঘোষ অবশ্য বলেছেন, ‘শরৎচন্দ্র বাংলা কাহিনিকে এবং নজরুল বাংলা কবিতাকে স্বল্প ও মধ্যশিক্ষিত অগণিত বাঙালি পাঠকের কাছে নিয়ে আসেন। তিনি বাঙালি মুসলমানকে বাংলা সাহিত্যের আপনজনে পরিণত করলেন। বাংলা সাহিত্যের হিন্দু প্রাধান্য যদি বিংশ শতকের নব্য শিক্ষিত মুসলমান তরুণদের স্বতন্ত্র ইসলামী বাংলা সাহিত্যের সন্ধানে উৎসাহী করে তোলে, তাকে স্বাভাবিক বলেই মানতে হবে। কিন্তু তার বাংলা সাহিত্যের যে-বিভাজন দেখা দিতে পারত, তাকে রাশ টেনে রুখে দিলেন নজরুল-ই।’ নজরুল ইসলামের লেখনীতে অতীত ও ভবিষ্যৎ উপেক্ষিত থাকলেও সমসাময়িক চিত্র ফুটে উঠেছে আর যে-সময়ের তিনি প্রতিনিধি, তার প্রতি সততা নিঃসন্দেহে উপযুক্ত মর্যাদা দাবি করে।