অধিকৃত প্যালেস্টাইনের লেখক রাইমা নাজার মেরিম্যান

অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ

প্যালেস্টাইনি লেখায় ইতিহাস, রাজনীতি ও সাহিত্য এমনভাবে পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে যে, তাদের আলাদা করা যায় না। এমনিতে, সাধারণভাবে, আরবি উপন্যাস নিপীড়ক শাসকদের আইন ভাঙার ইতিহাস বহন করে, যাদের পতন সম্প্রতি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। সেন্সরশিপ এড়াতে লেখকরা প্রায়শই রূপক এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, নাগিব মাহফুজের কয়েকটি উপন্যাস। মানুষের জীবনের ওপর সরকারের প্রবল প্রভাবকে শনাক্ত করার এ- প্রবণতাকে কখনো কখনো একটা বাধা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা আরব লেখকদের অধিকতর কল্পনা এবং সাহিত্যিক ধরনের লেখার মধ্যে আটকে রাখে; কিন্তু প্যালেস্টাইনি লেখকরা মনে করেন তাঁদের সামনে কোনো বিকল্প নেই এবং তারা এ-সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছেন।
বাস্ত্তচ্যুতি, নির্বাসন এবং পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নতা, তবে টিকে থাকাও, শেষ পর্যন্ত, প্যালেস্টাইনি গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। ১৯৪৮ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল ছয় লাখেরও বেশি প্যালেস্টাইনি শরণার্থীকে তাদের স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অধিকার দিতে অস্বীকার করেছে। বর্তমানে প্যালেস্টাইনি শরণার্থীর সংখ্যা আনুমানিক ৬০ লাখ। এর মধ্যে ১৪ লাখের বাস ৫৮টি স্বীকৃত শরণার্থী শিবিরে। এগুলো অবস্থিত জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে। চারশোরও বেশি প্যালেস্টাইনি গ্রামকে শারীরিকভাবেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে, আর যেসব প্যালেস্টাইনি কোনো রকমে থেকে যেতে পেরেছে, এখন যাকে বলা হচ্ছে ইসরায়েল, সেখানে। তারা (বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ) টিকে আছে বৈষম্য ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে।
পশ্চিম তীর (১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল দখল করে রেখেছে এবং এখন সেটা কংক্রিট দেয়াল দ্বারা বিভক্ত, ১৯৬৭ সালের গ্রিনলাইনের তুলনায় শতকরা ৮৫ ভাগ পশ্চিম তীরের মধ্যে পড়েছে) চারজন প্যালেস্টাইনি লেখককে নিয়ে গর্ব করতে পারে – যাঁরা প্যালেস্টাইনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবিচারের সাক্ষ্য সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন – তাঁরা এটা করছেন বিতর্ক, বিমূর্তন ও আদর্শবাদের মধ্যে নিমজ্জিত না হয়ে।
মাহমুদ শুকাইর অসংখ্য ছোটগল্প, সৃজনশীল গদ্য, টিভি নাটক, লোকসাহিত্য ও শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা। অন্য হাজারো প্যালেস্টাইনির মতো শুকাইরকেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দু-দুবার জেলে পাঠিয়েছে। ১৯৭৫ সালে বিতাড়নের শিকার হয়ে তাঁকে লেবাননে চলে যেতে হয়েছে। তারপর আম্মান, বৈরুত ও প্রাগে নির্বাসিত জীবনযাপন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন ১৯৯৩ সালে। তিনি শিক্ষকতা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন এবং একজোড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
শুকাইরের জন্ম ১৯৪১ সালে জেরুজালেমের পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত জাবাল আল-মুক্কাববারে। আল-আকসা মসজিদ দেখা যায় সেখান থেকে। এ-এলাকাটি এখন ইসরায়েলি দেয়ালের অভ্যন্তরে পড়েছে। ইসরায়েল এটাকে পূর্ব জেরুজালেমের সঙ্গে সংযুক্ত বৃহত্তর পৌরসভার অংশ হিসেবে গণ্য করে। দেয়ালটা শুকাইরের পাড়া পশ্চিম আল-সাওয়ারাহকে পূর্ব আল-সাওয়ারাহের অবশিষ্ট প্যালেস্টাইনি স্বজনদের থেকে পৃথক করে রেখেছে। এদের দাফন-কাফনের অনুষ্ঠানের জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। কারণ শহরের গোরস্তানটি পশ্চিম আল-সাওয়ারাহতে অবস্থিত। পরিস্থিতিকে এমনকি আরো উপহাসমূলক করে তোলার জন্যে শোকার্তদের সংখ্যাও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
জেরুজালেমের পরিচয়পত্রধারী প্যালেস্টাইনি হিসেবে শুকাইরকে অবশ্যই প্রতিদিনই ইসরায়েলি দেয়ালের মোকাবেলা করতে হয়, যেটা তার সমাজকে সোজা দুভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। এই যে অসংগতি এবং অযৌক্তিতার সম্মুখীন তাকে প্রতিদিন হতে হয়, তা-ই সম্ভবত তাঁকে তাঁর প্রথম দিককার রচনায় প্রতিফলিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর সাম্প্রতিক লেখালেখির বিপরীতার্থকতা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ এবং অবাস্তবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। শুকাইরের সাম্প্রতিক দুটো ছোটগল্প সংকলন – সুরাত শাকিরা (২০০৩, শাকিরাজ পিকচার) এবং ইবনাত খালাতি কন্ডোলিজা (২০০৪, মাই কাজিন কন্ডোলিজা)। এ গল্পগুলো রচিত হয়েছে অবাস্তব ও বিদ্রূপাত্মক পরিস্থিতিকে ঘিরে। কতক গল্পের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে পশ্চিমা জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের নামে, কতকগুলো চরিত্রের স্বপ্নকে পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বহির্বিশ্বের দূরবর্তী অস্তিত্বের সঙ্গে এবং চরিত্রগুলোর বসবাস যে শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতার মধ্যে, তাকে নাটকীয় করে তোলার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, শুকাইরের ‘রোনালদোজ সিট’ গল্পে প্রধান চরিত্র কাদিম আলী একজন ক্যাব ড্রাইভার, ‘ব্রাজিলের ফুটবল তারকা রোনালদোর প্রতি অতিউন্মাদনার কারণে সে তার সমস্যাগুলোকে আমল দিচ্ছে না।’ ‘রোনালদোজ সিট’ এবং ‘শাকিরাজ পিকচার’ গল্পদুটি গ্রন্থিত হয়েছে মরদেছাইজ মুসটাশ অ্যান্ড হিজ ওয়াইফস ক্যাটস (২০০৭; মরদেছাইয়ের গোঁফ এবং তার স্ত্রীর বিড়াল), এখনো পর্যন্ত শুকাইরের একমাত্র ইংরেজিতে অনূদিত, গল্পসংকলনে। নামগল্পের প্রধান চরিত্র ইসরায়েলি ইহুদি মরদেছাই। সে ‘একজন সাধারণ লোক’, তেলআবিবে তার প্রতিবেশীদের মতো। তার প্রতিবেশীরা তাকে পছন্দ করে ‘কারণ সে তাদের বিরক্ত করে না’ : ‘তেলআবিবে তার মতো হাজার হাজার লোক আছে।’ তবে মরদেছাই তার বিশিষ্ট অবস্থানে অনড়, সে বিশ্বাস করে যে, ‘তার মতো লোক খুব কমই আছে।’
তার গোঁফ এবং তার স্ত্রীর বিড়ালগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন হাস্যকর ঘটনার সূত্রে মরদেছাই আবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়। সে নিয়োজিত হয় রামাল্লার দক্ষিণে এক চেকপয়েন্টে, যেখানে সে তার জীবনে প্রথম প্যালেস্টাইনিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। সে লক্ষ্য করে যে, ‘ওরা নীরব এবং ভয়ার্ত, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চেকপয়েন্টের সামনে, সেটা পার হওয়ার অনুমতির প্রতীক্ষায়।… নিরস্ত্র ও অরক্ষিত লোকজন, যারা স্রেফ তার হাতের একটা ইঙ্গিতের অপেক্ষা করছে।’ প্যালেস্টাইনিদের প্রতি তার সহানুভূতিকে চাপা দেওয়ার জন্য সে তার কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তরুণদের ওপর, ‘এরাই হলো বিপদের উৎস, সমস্যার মূল। এরাই সেসব সন্ত্রাসী, যারা ইসরায়েলিদের হৃৎপিন্ডে মৃত্যু বপন করার উদ্দেশ্যে কোমরের বেল্টে বিস্ফোরক জড়িয়ে রাখে, অথবা পোশাকের নিচে লুকিয়ে রাখে বন্দুক।’ পাঠককে ছেড়ে দেওয়া হয় মরদেছাইয়ের ভাবনা এবং কল্পনার ওপর, যে কিনা একজন সাধারণ মানুষ, তার আগ্রহের বিষয় কেবল ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং একজন ‘আদর্শ’ নাগরিক হওয়া। সে দাঁড়িয়ে থাকল পাকা দেয়ালের পেছনে, মাথায় নতুন পাওয়া ইস্পাতের হেলমেট। তার মুখমন্ডল, গোঁফ এবং কাঁধ ও হাতের উপরিভাগ ছাড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে আর কিছু দেখা যায় না।’ তার কিছু চিন্তা বর্ণবাদী, কিছু নির্মম, কিছু মানসিক বিভ্রান্তি, কিছু অনুভূতিহীন, কিছু স্রেফ বোকামি, কিছু খামখেয়ালি, কিছু মনে হয় যেন সহানুভূতির আবেগ দমন করার প্রয়াস। যতই সে তার ভাবনাকে মুক্তভাবে ঘোরার জন্যে ছেড়ে দেয়, ততই সে অসচেতনভাবে তার গোঁফে তা দিতে থাকে, যতক্ষণ না চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ প্যালেস্টাইনিরা ঠাট্টা শুরু করে (যখনই সে চেকপয়েন্টে হাজির হয়, তখনই তারা ভুটভাট আওয়াজ করতে শুরু করে)। এতে সে তার গোঁফ কামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়।
যদিও শুকাইর শুরুতে তার ইসরায়েলি চরিত্র সম্বন্ধে বিস্তৃত মানবিক বর্ণনা দেন তাঁর আরব পাঠকদের তার মানবিকতা দেখানো ও উপলব্ধি করানোর জন্য, তবু গল্পটা মূলত বিদ্রূপাত্মক। মরদেছাই শেষ পর্যন্ত উপহাসের যোগ্য চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আরব এবং ইসরায়েলিদের মধ্যকার সংযোগের মধ্য দিয়ে এই গল্পে যা বোঝাতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে বিজেতা ও বিজিতের।
‘শাকিরার ছবি’ গল্পে ব্রাজিলের পপগায়িকা শাকিরাকে আমদানি করা হয় গল্পকারের জ্ঞাতিভাই তালহা শাকিরাতকে উপস্থাপন করার জন্য। তালহার প্রয়োজন ইসরায়েলি অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের একটি অনুমতিপত্র, ‘যার দরোজায় জেরুজালেমের লোকেরা বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি সয়ে আসছে।’ তেলআবিব এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে যেতে হলে জেরুজালেমবাসী প্যালেস্টানিদের এই অনুমতিপত্র প্রয়োজন হয়। তালহা অনুমতিপত্রের জন্য নীরবে বিভিন্ন অমর্যাদাকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, কারণ ‘সে চায় তার সম্পর্কে প্রতিবেশীদের এ-ধারণা অব্যাহত থাকুক যে, সে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।’ যখন ইসরায়েলি প্রহরী তালহার নাম ডাকে এবং সরলভাবে জিজ্ঞেস করে, সে শাকিরার (গায়িকা আরব-বংশোদ্ভূত) পরিচিত কিনা, তখন তালহা পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে এই কল্পিত সংযোগসূত্র কাজে লাগাতে দ্বিধা করে না।
দখলদারিত্বের অধীনে বাস করার যে দৈনন্দিনতা, কষ্ট এবং অপমান, তা ছাড়াও শুকাইর আলোকপাত করেন সেসব সমস্যার ওপর, যা তার চরিত্রদের মোকাবেলা করতে হয়, সেগুলো ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দুর্বলতা ও ত্রুটির ফল। এগুলোকে মূর্ত করতে গিয়ে তিনি অতিরঞ্জন এবং প্রহসনের আশ্রয় নেন কৌতুক ও বিদ্রূপ করার জন্য, এমনকি সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও। ‘রোনালদোজ সিট’ গল্পের কাদিম আলী নিজেকে বোঝায় যে রোনালদো, তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে, তারা তার অতিথি হিসেবে দুই বা এক মাস থাকবে। ক্যাব-ড্রাইভারের বিভ্রম এতটাই বাস্তব হয়ে ওঠে যে, সে তার খদ্দেরদের ট্যাক্সির সামনের সিটে বসতে দেয় না, যা কিনা রোনালদোর জন্যে সংরক্ষিত। কাদিমের আচরণকে তার সমাজের লোকেরা পাগলামি বলে বাতিল করে দিলেও ক্রমেই একটা গুজব ‘ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে’ যে, অবৈধ নারী-ব্যবসার সঙ্গে সিট-ব্যবসার একটা সংযোগ আছে। যখন ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সে-এলাকার তিনটা নতুন বাড়ি উড়িয়ে দিলো (জেরুজালেমের প্যালেস্টাইনিরা নতুন বাড়ি নির্মাণ, অবয়ব পরিবর্তন বা সংস্কার করতে চাইলে অনুমতি নিতে হয়। যা পাওয়া খুব কঠিন বা অসম্ভব। সেজন্যে প্যালেস্টাইনিরা কখনো কখনো অনুমতি ছাড়াই এটা করে), তখন অন্য গুজব ছড়াল, কাদিম আলী সম্পর্কে সন্দেহ (ইসরায়েলিদের দালালি) ‘দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো’, তার ফল হলো মারাত্মক। তবু কাদিম দমল না। সে তার সামনের সিটটা রোনালদোর জন্য সংরক্ষিত রাখল।
আমিরি তার প্রথম বইয়ে সেসব থিমকেই স্পর্শ করেছেন, যেগুলো নিয়ে শুকাইর এবং অন্যান্য প্যালেস্টাইনি লেখকও কাজ করেছেন; কিন্তু যেহেতু তিনি সৃজনশীল নন-ফিকশন লিখছেন, সেহেতু পাঠকের ওপর, বিশেষত পাশ্চাত্যে, তাঁর রচনার শক্তিশালী প্রভাব পড়েছে।
সুয়াদ আমিরি, পশ্চিম তীর থেকে উঠে আসা প্যালেস্টাইনি, ইংরেজিতে লেখেন, এবং আলোকপাত করেন ওইসব বিষয়ের ওপরও, ‘যা প্যালেস্টাইনের প্যালেস্টাইনিদের অবস্থার হাস্যকর, নির্মম, সাধারণ, এবং অভিভূতকর বর্ণনা’, যেমনটি লেখা আছে তাঁর প্রথম বই শ্যারন অ্যান্ড মাই মাদার-ইন-লর (২০০৬) প্রচ্ছদে।
গ্রন্থের ধারণা আসে তখন, যখন আমিরি তাঁর বন্ধুদের কাছে ই-মেইল পাঠাতে থাকেন ২০০১ সালে রামাল্লায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং ইয়াসির আরাফাতের প্রধান কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা জানাতে। তারপর ১৯৮১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়-পরিসরজুড়ে ডায়েরির আকারে আসে, তাঁর আম্মান থেকে রামাল্লায় গমনের কাল থেকে। আমিরি পেশায় স্থপতি, বড় হয়েছেন আম্মান, দামেস্ক, বৈরুত ও কায়রোয়। ১৯৪৮ সালে জাফা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তাঁর পিতামাতার শরণার্থী হিসেবে পরিব্রাজকের জীবনযাপনের ফল এটা। একটা প্যালেস্টাইনি পরিচয়পত্র পাওয়ার সমস্যা দূর হচ্ছে না।
সূচনায় আমিরি তাঁর গ্রন্থের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এভাবে ¬ – ‘এটা হচ্ছে সময়ের অর্থহীনতা দেখার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা, এটা আমাদের জীবন ও আত্মার পরাধীনতার বিরুদ্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ আত্মরক্ষার উপায়। ‘পাশে একধাপ’ গিয়ে কেবল আমি আমার এবং অন্যদের জীবনের অলীকতা অনুধাবন করতে পারি।’ ‘এ ডগস লাইফে’ আমিরি যে-হাস্যকর পরিস্থিতির বর্ণনা দেন, সেটা তাঁর পোষা কুকুরের জন্যে অতিকাঙ্ক্ষিত জেরুজালেম আইডি পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে যেসব অদ্ভুত শর্ত দেওয়া হয় সে-সম্পর্কে। আমিরি দ্রুত পরিকল্পনা করেন, তিনি স্বয়ং কুকুরের আইডি ব্যবহার করে জেরুজালেমে যাবেন আর বাস্তবেও যান একটা ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট দিয়ে, ব্যাখ্যা দেন এই বলে : ‘আমি কুকুরটার ড্রাইভার। তোমরা তো দেখছ, তার জন্ম জেরুজালেমে; কিন্তু সে গাড়ি চালাতে পারে না বা নিজে-নিজে জেরুজালেমে যেতে পারে না।’ তিনি তাঁর কাহিনিতে এমন এক কৌতুককর মোচড় দেন যে, তিনি যে আস্তিত্মিক ধোঁয়াশার বর্ণনা দিচ্ছেন তা তীক্ষ্ণতা লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনার কথা বলা যায়। সেটা তার ১৫ বছরের প্রতিবেশী রামির সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটা ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের অভ্যুত্থানের সময় (সেটা প্রায় ছয় বছরব্যাপী চলেছিল)। তাঁর চরিত্র হচ্ছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতাকারী একজন প্যালেস্টাইনি। তারপরও তিনি আখ্যান গড়ে তুলতে তার মধ্যে হাস্যকর দৃষ্টিকোণ খুঁজে পান, ঠিক শুকাইরের ‘শাকিরার ছবি’র মতো। ঘটনাটা শুরু হয় পরাধীনতার মধ্যে দৈনন্দিন অস্তিত্বকে স্বস্তিদায়ক করতে একটা মানুষ কতদূর যেতে পারে, সে-ব্যাপারে গভীর চিন্তা হিসেবে : ‘যাতে বৃষ্টির মধ্যে এবং উত্তপ্ত গ্রীষ্মের সূর্যের নিচে লাইনে দাঁড়াতে না হয়… সব ধরনের অনুমতিপত্র পাওয়ার চেষ্টা করার জন্যে যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে না হয়।’ সেজন্যে তিনি যখন রামির কাছ থেকে শোনেন কীভাবে ইসরায়েলিরা তাকে একজন ইনফরমার হিসেবে তালিকাভুক্ত করে – তারা তার ভাই ওয়ালিদকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, তাছাড়া তাকে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেওয়া হবে, সে ‘সত্যিকারের চমৎকার মেয়েদের’ সঙ্গ পাবে, তাকে ইসরায়েলি অফিসারদের ফোন নম্বর দেওয়া হবে, তাদের কাছে তার খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য – বাচালের মতো তিনি যা কিছু চিন্তা করেছেন তার মূল হচ্ছে এই ‘অবিশ্বাস্য’ তথ্য যে, তার ইসরায়েলি অফিসারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, যারা ঘটনাকে সহজ করতে সক্রিয় হবে : ‘এটা চিত্তাকর্ষক’, আমি মনে মনে ভাবলাম। ওই একটা সুবিধাই আমাকে কারো দালাল বানানোর জন্য যথেষ্ট।’ জানা যায়, রামির গোটা পরিবারই দালালি করছে। আমিরি লেখেন, ‘তার জন্য আমার ভয় হয়, এবং তাকেও আমার ভয় করে। তার ওপর আমার রাগ হয় কিন্তু তার জন্যেও… আমি তাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম তার নিজের কাছ থেকে, তার পিতার কাছ থেকে, তার মায়ের কাছ থেকে, শুয়োর ইসরায়েলিদের খপ্পর থেকে এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা প্যালেস্টাইনিদের প্রতিশোধ থেকেও।’
রামির ঘটনাটা শেষ হয় তার ভাইয়ের অতিরিক্ত ড্রাগ নিয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্য দিয়ে – দালালিতে প্রলুব্ধ করার আরেকটি ইসরায়েলি অস্ত্র এটা। তারপরই শুরু হয় ওই একই পরিবারকে নিয়ে ১০ বছর পরের একটা কাহিনি, যা ঘটছে তাকে নাটকের মতো বর্ণনা করে এবং তার প্রতিবেশীদের সেই ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি আখ্যানকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে সিদ্ধহস্ত। যখন আমিরিকে উম্মে জাহি (তার মা) জরুরিভাবে ডেকে পাঠালেন, সেটা দিয়ে দৃশ্যের আরম্ভ। প্রতিবেশীর বাড়ির কাছ দিয়ে ছুটতে গিয়ে সে রামি এবং তার ভাইকে তাদের বাবার দোকানে দেখল (ইতোপূর্বে এটাকে ‘প্রতিবেশীদের ওপর নজরদারির জানালা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে), তারা দাঁড়িয়ে ছিল খন্ডবিখন্ড কাচের জানালার সামনে (প্রতিবেশীদের প্রতিশোধের ফল এটা), তাদের ‘রাগান্বিত মুখমন্ডল’ তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। বাড়ির দরোজা হাট করে খোলা। সে দেখল, তার পিতা (আবু জাহি) একটা লোকের (তার পোশাক ‘ঢলঢলে পেট’ ঢেকে রেখেছে) সঙ্গে সিমেন্ট, পাথর এবং ইস্পাত নিয়ে দরকষাকষি করছে। উম্মে জাহি শোয়ার ঘরে, তার দরজাও খোলা। যৌন-দুর্ব্যবহার সংক্রান্ত উদ্ভট অভিযোগ-পালটা অভিযোগ (তার এবং তার পুত্র রামির মধ্যে) নিয়ে উন্মত্ত সে। কেবল তখনই সে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়, যখন আবু জাহি তাকে তার শার্টের ভেতর থেকে টাকা আনতে বলেন। এটা একটা বিশৃঙ্খল পরিবার এবং বিকৃত পারিবারিক সম্পর্কের হাস্যকর দৃশ্য, যারা তাদের বিবেক শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে; কিন্তু ধর্মের মাধ্যমে পাপমোচন করতে চায়। আমিরি এ-ঘটনা শেষ করেন ওই দম্পতির মধ্যেকার হজে যাওয়া নিয়ে উচ্চকণ্ঠ আলাপ দিয়ে : ‘কয়েক মাস পরে আমি উম্মে জাহিকে শহরে হেঁটে যেতে দেখলাম। সে জালাবিয়্যাহ এবং বোরকা দ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত।’
তার দ্বিতীয় বই নাথিং টু লুজ বাট ইওর লাইফ (২০১০, এটাও ননফিকশন), এতে আমিরি অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েলে কাজ খুঁজতে যাওয়া তরুণ প্যালেস্টাইনিদের সঙ্গে ১৮ ঘণ্টা ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন। ২০০০ সালে, দ্বিতীয় প্যালেস্টাইনি অভ্যুত্থানের সময়, ইসরায়েলে কাজ করতে যাওয়া প্যালেস্টাইনি শ্রমিকদের অনুমতিপত্র দেওয়া বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল; এদের অনেকেই ১৯৬৭ সাল থেকে ভালো (পশ্চিম তীরের পেশাজীবীদের তুলনায়ও বেশি) আয় করত। এক খড়্গের আঘাতেই দেড় লাখ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্য জীবিকার সংস্থান হারায়। সেখানে কাজ অব্যাহত রাখতে এখন তাদের অবৈধভাবে সেদেশে ঢুকতে হয়, তাতে তাদের গ্রেপ্তার, মারধর এবং জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়।
আমিরি যে-অভিযাত্রার বর্ণনা দেন, কখনো ইঙ্গিতময়তার সঙ্গে, কখনো পরাবাস্তবতার ছোঁয়া দিয়ে, তা তার জন্যে হারানো প্যালেস্টাইনে প্রত্যাবর্তনের ভ্রমণ হিসেবে প্রতিফলিত হয়। যদিও ভৌগোলিক দূরত্ব খুব কম। তবু ইসরায়েলের অভ্যন্তরে যাওয়ার জন্য চরিত্রগুলোকে গোটা বই জোড়া বিস্তৃতি নিতে হয়েছে। সাধারণ অবস্থায় এ-ধরনের পারাপার করতে লাগে কয়েকটি মিনিট মাত্র, ১৫ ঘণ্টা অবশ্যই নয়। মুরাদ পরিবারের বাড়িতে সন্ধ্যা কাটিয়ে আমিরি তার এবং তার ভাইয়ের সঙ্গে বাস ধরেন শেষ রাতে। তারপর তার অনুভূতি ও ইন্দ্রিয় উত্তেজনায় টানটান :
অাঁকাবাঁকা সড়কে বাসের এঞ্জিন যখন খটমট করছিল তখন মাঝে মাঝেই আমি দূরবর্তী পাহাড়ের ওপর মৃদু আলো বিচ্ছুরণকারী আরব গ্রামগুলোকে শনাক্ত করতে পারছিলাম, ইসরায়েলি বসতিগুলোর আলো তীক্ষ্ণ কমলা রঙের। যদিও আমরা চলেছি পশ্চিম তীরের একেবারে কেন্দ্র দিয়ে, তাত্ত্বিকভাবে যেটা ‘প্যালেস্টাইনি এলাকা’, তবু সেখানে কমলা রঙের আধিপত্য। কোনো না কোনোভাবে, মনে হচ্ছিল যেন আরো উজ্জ্বল তারকারাজি আরব গ্রামগুলোর মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছিল।
বাসে, পুরুষদের বন্ধুত্বপূর্ণ তর্ক-বিতর্ক এবং লেবাননি গায়ক-গায়িকা ও ফুটবল ম্যাচ নিয়ে আলাপের মধ্যেও, তিনি প্যালেস্টাইনি শ্রমিক এবং তাদের ইহুদিবাদী চাকরিদাতাদের সম্পর্কে গল্প শুনতে পাচ্ছিলেন, সে-শ্রমিকের কাহিনি যে পশ্চিম তীরের ইহুদিবাদী বসতি স্থাপনকারীর অধীনে কাজ করতে করতে হতাশ হয়ে ভাবতে শুরু করেছে ‘দখলদারিত্বের অবসান আর হবে না’, তখন সে মিশ্রণে সিমেন্ট কম দেয়। যখন তার মধ্যে আশাবাদ জেগে ওঠে, তখন সে ‘এই বাড়িগুলো যেন চিরকালব্যাপী টিকে থাকে সেজন্য বেশি বেশি সিমেন্ট ঢালতে থাকে’, তার যুক্তি হলো ‘কোনো দখলদারিত্বই চিরস্থায়ী হয় না। একদিন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তুলে নেওয়া হবে, বসতি স্থাপনকারীরা চলে যাবে। তখন এ-বসতিগুলো কালক্রমে আমাদেরই হবে।’ তারপর দুই তরুণের গল্প যারা তাদের মায়ের দেওয়া পনিরের স্যান্ডউইচ, শুকনো ডুমুর এবং কমলাওয়ালা বাদামি ব্যাগ অন্য জায়গায় রেখেছে, তারা ইসরায়েলে একটা সম্মেলনকক্ষে থাকে। সেখানে তাদের কাজ হচ্ছে বাস এবং টেবিল পরিষ্কার করা। তাদের বাদামি ব্যাগ পরিচালকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করল। তারা দেখল সেগুলোকে ‘বিস্ফোরিত’ করার জন্য রোবট আনা হয়েছে।
ভ্রমণটা সংঘটিত হয় একটা চাঁদবিহীন রাতে, এবং বিপদ ও মূঢ়তায় পূর্ণ। ‘আমার চারপাশের কিছুই অর্থদ্যোতক নয়। তাহলে আমি কেন হবো?’ আমিরি কতক বিষয়ে বিস্মিত, বিশেষভাবে যখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, ইসরায়েলি সৈন্যরা অন্ধকারে যে ভয়ার্ত আতঙ্ক এবং সন্দেহ ছড়ায়, সেটা আসলে ঘটে যখন তারা আট মিটার উঁচু দেয়ালের প্যানি পাশেই থাকে। দীর্ঘ ভ্রমণ এবং দেয়ালের মুখোমুখি হওয়ায় ক্লান্ত ও নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন আমিরি। তখন তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে বিভ্রমে ভোগেন : ‘কিছু লোক এর মধ্যে দিয়ে সোঁ-সোঁ করে যায়, কিছু তার ওপর লাফালাফি করে, আর কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার সঙ্গে আটকে থাকে। কিছু লোক যখন ‘তাদের দিকে’ পতিত হয়, অন্য কিছু লোক তখন ‘নো ম্যান্স ওয়ালে’র সঙ্গে আটকে যায়।’
২৮ বছর ধরে ইসরায়েলে কাজ করা একজন লোক তিক্তস্বরে বলে, ‘আমি আমার গোটা জীবন তাদের জন্য কাজ করে কাটালাম, এখন আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন, চোরের মতো আমি অন্ধকারে আমার জীবিকা চুরি করছি… ওদের কোনো দয়া নেই, ওরা খোদা বলে কিছু মানে না, আর কী বলতে পারি আমি?’ ১৫ ঘণ্টা ভ্রমণের পর আমিরি এবং তার সঙ্গীরা দেয়ালে একটা ফাটল খুঁজে পেলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে ওপারে চলে গেলেন। কিছু সমস্যা হলেও (ইসরায়েলি বাসড্রাইভাররা আইডি দেখানোর জন্য পীড়াপীড়ি করে), তারা একটা বাসে চড়তে সমর্থ হলেন – যদিও ততক্ষণে দিনের কাজ শুরু করার জন্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা গন্তব্যে পৌঁছলেন, পিতা টিকভায়, একটা শিল্প-এলাকা সেটা, এখানে কয়েকটা বহুজাতিক কোম্পানির ইসরায়েলি প্রধান কার্যালয় অবস্থিত, এটা আরব গ্রাম মিলাবিসকে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
আমিরির ‘প্রত্যাবর্তন’কে বিশেষায়িত করা হয়েছে এক ধরনের প্রবল বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা : ‘এই গ্রহে এমন আর কোনো জায়গা নেই, যেখানে এতটা স্থান ও কাল থেকে বাইরে ছিটকে পড়ার অনুভূতি হয়, এতটা ইতিহাসের বাইরে, অর্থের অতীত, যুক্তির বাইরে, সুতরাং আমার ত্বকের বাইরে, আমার ঐতিহাসিক ‘স্বদেশভূমি প্যালেস্টাইনে’ গিয়ে আমি ভীষণ ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলাম।’ প্রত্যেকটা ভৌগোলিক সত্তা, বাস্তব কিংবা ধারণাগত যা-ই হোক, তাকে লেখা হয়েছে উদ্ধৃতিচিহ্নের মাঝখানে, মাটির ওপরের বাস্তবতার সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়াতে না পেরে লেখক যে যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট পান, তাকে নাটকীয় করে তুলতে এটা করা হয়েছে, সকল প্রজন্ম এবং পরাধীন প্যালেস্টাইনিরই আবেগ এটা। একটা জায়গার রূপান্তর এমন কিছুতে, যা তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, তার সম্পর্কে আমিরি লেখেন :
যেটা আমাকে সবচেয়ে বিরক্ত করছে সেটা হলো চারিত্র্য এবং আত্মার অভাব; জায়গাটার অবস্থান না এখানে না সেখানে। নতুন এবং আধুনিক শহরের আভিজাত্যও এর নেই, আবার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবান স্থানের চমৎকারিত্বও এর নেই। এর আমেরিকান উপশহরগুলোর মতো অবর্ণনীয় শূন্যতা আছে কেবল। এর অবয়বে না আছে ইউরোপীয়, না আরবীয় ছাপ। আমি যা বুঝছিলাম এটা দেখতে স্রেফ ইসরায়েলি। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইন এত দ্রুত কীভাবে তার মূল আরব অধিবাসীদের কাছে এমন অপরিচিত হয়ে গেল?’
মাহমুদ দারবিশের পরে শহর খলিফাই সর্বাধিক অনূদিত হয়েছেন। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালে, নাবলুসের এক রক্ষণশীল পরিবারে। তিনি দশটি উপন্যাসের স্রষ্টা। তাঁকে বলা হয় প্যালেস্টাইনি সাহিত্যের ভার্জিনিয়া উলফ, তবে অধিকতর রাজনীতিপ্রবণ। খলিফা তাঁর উপন্যাসে প্রায়শই সেসব প্যালেস্টাইনি চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেন, যারা তাদের অবস্থার তাৎপর্য অনুধাবন করতে অসমর্থ। আত্ম-নিরীক্ষণের একই মনোভাব তাঁকে প্যালেস্টাইনি সমাজে নারীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লড়াই সম্পর্কে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস মেমোইরস অব অ্যান আনরিয়েলিস্টিক উওম্যানে (১৯৮৬) এমন একটা জগৎ সৃষ্টি করেন, যেখানে পাঠককে ছুড়ে দেওয়া হয় আবদ্ধাতঙ্ক ও সংস্কারমূলক অন্তঃশীল চেতনাপ্রবাহের মধ্যে, যা মূর্ত হয় একাকিত্ব এবং তার অমতে বিয়ে হওয়া স্বামীর নিষ্ঠুর আধিপত্যের চিত্রের মধ্যে দিয়ে।
শুকাইর এবং আমিরির রচনার বিপরীতে, খলিফার সর্বসাম্প্রতিক বই হুবিব আল-আওয়াল (মাই ফার্স্ট লাভ, ২০১০) একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস, যা প্যালেস্টাইনি জীবনের বড়মাপের বদলে তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এর প্রেক্ষাপট নাবলুস এবং বর্তমান থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠাপূর্ব ১৯৩৯-৪৮ সময়-পরিসরের অতীতের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। প্রধান চরিত্র মহিলা, নিদাল (আরবিতে এই নামের অর্থ ‘প্রতিরোধ’)। সত্তর বছর বয়সী শিল্পী সে, নির্বাসন থেকে ফিরে পশ্চিম তীরে এসেছে নতুন পারিবারিক বাড়ি খোলার জন্যে; কিন্তু তার অনুভূতি হচ্ছে, সে যেন ‘এয়ারপোর্টে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো মানব-বোঝা’। বাড়ির কাছে যেতে যেতে বহু স্মৃতি এসে ভিড় করে, সে তার কৈশোরকাল, প্যালেস্টাইনি বিপ্লবী ইজ্জ আল-দিন আল-ক্কাসিম ১৯৩৬ সালে মারা যাওয়ার পরবর্তীকালে, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের অব্যাহত নড়বড়ে প্রতিরোধের কথা বিস্তারিত মনে করতে পারে। সেকালে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের বসতি স্থাপন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, বৈষম্যমূলক শ্রমনীতির মাধ্যমে প্যালেস্টাইনি কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমি ‘ইহুদি ন্যাশনাল ফান্ডে’র জোরে কিনে নিচ্ছিল ইউরোপীয় ইহুদিরা।
নিদাল যখন তার দাদি এবং বিপ্লবী চাচার সঙ্গে তার স্মৃতি রোমন্থন করে, তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে ইসরায়েলিদের পশ্চিম তীর দখলের রক্তাক্ত বর্ণনা শোনে, তখন খলিফা দক্ষতার সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে অন্তর্বয়ন করেন, এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবেন। ইতিহাসের করুণ আঘাত এবং মূল্যবিচারী আরব বিশ্বাসঘাতকতা ও অযোগ্যতা সত্ত্বেও, প্রধান চরিত্রটির নাবলুস প্রত্যাবর্তন উপন্যাসের কেন্দ্রে একটি ইতিবাচকতাময় ইঙ্গিত। নিদাল নিজেকে বলছে :
আমার এখন কোনও বন্ধু কিংবা আশ্রয় নেই। আমি হয়ে গেছি একটা তরবারির মতো, একাকী। আমার মতো আমার আত্মীয়রাও যদি চলে যায়, এবং অন্যদের মতো আমিও যদি চলে যাই, তাহলে কে থাকবে এখানে? এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছু থাকবে না এখানে। সেই কারণেই আমি এখানে ফিরে এসেছি, নতুনভাবে, এই বাড়িটাকে আমার পারিবারিক বাড়ি হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে, আমার প্রথম এবং শেষ বাড়ি, এখানে থাকবে একটা গ্যালারি, একটা জাদুঘর, ছবি, চিত্রশিল্প এবং ফ্রেম, একটা প্রদর্শনীর মতো।’
হুবিব আল-আওয়াল এবং পশ্চিম তীরের লেখকদের অন্যান্য সম্প্রতি প্রকাশিত রচনায় একধরনের আত্ম-প্রতিফলন এবং নিজেদের সঙ্গে, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সঙ্গেও, স্থান ও সময়ের সম্পর্ককে বোঝার চেষ্টা লক্ষযোগ্য। ২০০৮ সালে কায়রোয় এক সাহিত্য সম্মেলনে শহর খলিফা তাঁর এবং অন্যদের সংশয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন :
আমাদেরকে বলা হয়েছে যে সমস্যা আমাদের নয়, বিজেতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত, সুতরাং আমরা নিজেদের ওপর নজর দিতে লজ্জা বোধ করেছি, সে কারণে ওই বিজেতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোর ওপরেও নজর দিতে পারিনি আমরা। সেজন্যে আমরা জানি না আমাদের বিজেতা কে এবং আমাদের নিজেদেরও আমরা জানি না; আমরা আমাদের পরাজয়ের কারণগুলো জানি না। অন্য কথায়, আমরা বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারি না।
রাজা শাহাদাহ, পশ্চিম তীরের আরেক লেখক, যিনি সুয়াদ আমিরির মতো ইংরেজিতে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তিনিও বর্তমানের বোধকে অর্থময় করে তুলতে অতীতে প্রবেশ করেন।
পেশায় আইনজীবী শাহাদাহ ২০০৮ সালে ‘অরওয়েল প্রাইজ’ লাভ করেন। রাজনৈতিক লেখালেখির জন্য এটি ব্রিটেনের সম্মানজনক পুরস্কার। তিনি এ-পুরস্কার লাভ করেন প্যালেস্টিনিয়ান ওয়াক্স : ফোরেজ ইনটু অ্যা ভ্যানিশিং ল্যান্ডস্কেপ (২০০৮) গ্রন্থের জন্য। প্যালেস্টিনিয়ান ওয়াক্সে শাহাদাহ কাল ও স্থানের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন প্যালেস্টাইনি পাহাড়ের ওপর সাতটা পদব্রজে ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন; এগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত ‘সম্ভবত খ্রিষ্টের পরিচিত’ ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢল এসে ‘মরুভূমি’কে কংক্রিট ও নিয়ন লাইটে প্রস্ফুটিত করে তুলতে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থ করে তুলেছে।’ বেড়াতে বেড়াতে এবং সেগুলোকে বর্ণনা করতে করতে শাহাদাহ যা হারিয়ে গেছে তাকে স্মরণ করেন :
প্যালেস্টাইনে, প্রতিটি নদী-অববাহিকা, ঝরনা, ক্ষুদ্র পর্বত, খাড়া পাহাড়, এবং পাহাড়চূড়ার নাম আছে, সাধারণত বিশিষ্ট অর্থবোধক সেগুলো। কতকগুলো নাম আরবি, অন্যগুলো ক্যানানাইট বা অ্যারামিক, এই ভূমি কত প্রাচীন এবং কীভাবে এখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ অব্যাহতভাবে বসবাস করে এসেছে তার সাক্ষ্য এগুলো। আমি এসব নাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে বড় হয়েছি। এ ব্যাপারে আমি অনন্যসাধারণ নই। যারা এই পাহাড়গুলোতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে খুব কম লোকেরই এই ধরনের স্থানিক জ্ঞান আছে। কামাল আবদুল ফাত্তাহ এবং তার ছাত্রদের সাহায্যে এসব দীর্ঘকাল-বিস্মৃত নামগুলোর কয়েকটা পুনরুজ্জীবিত হয়, তারা প্রবীণ পুরুষ ও নারী, যাদের এ-সম্পর্কে কিছু স্মরণ আছে, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।
১৯৯৩ সালে, অসলো চুক্তির ফলে, ‘এরিয়া এ’ নামে পরিচিত পশ্চিম তীরের জনবহুল এলাকায় একটা বেসামরিক প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়, যেখানে প্যালেস্টাইনি জনবসতিকে ঘিরে চারপাশে রয়েছে ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি ‘বসতি’, এগুলো বহুবিস্তৃত সড়কজালের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত। শাহাদাহ অসলো চুক্তি এবং সেটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে পার্থিব দিকগুলোকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তার বর্ণনা দেন :
আমি অসলো চুক্তি ভালো করে পড়েছি কেন সেটা গোলমাল তৈরি করল তা অনুধাবন করার জন্য। সুতরাং যা আসন্ন বলে আমি নিশ্চিত তার মোকাবেলা করার প্রস্ত্ততি নিতে চেষ্টা করলাম। আমি আমার বাড়ি তৈরি করলাম রামাল্লার সীমানার ভেতরে, যেটা ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ বলে আমার মনে হলো, আমি আমার বাগানে চাষ করতে শুরু করলাম এবং একটা স্মৃতিকথার গ্রন্থ প্রণয়নে হাত দিলাম যেটার নাম স্ট্রেঞ্জার ইন দ্য হাউস, এটা নিয়ে অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম আমি। পাথরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আমি পরিবর্তনের ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যেটা ‘পবিত্র ভূমি’র একটা সম্মানীয় ঐতিহ্য, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী কত মিশন, ধর্মপ্রচারক, এবং ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী আশ্রম, স্কুল, প্রতিষ্ঠান স্থাপন করল, এবং যখন খারাপ সময় এসেছে তখন তারা হয় তার মধ্যে বন্দি হয়ে থেকেছে, নয়তো স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছে।’
আজকাল, এবং অতীতেও, প্যালেস্টাইনি লেখালেখি আবশ্যকীয়ভাবে স্থাপিত হয়েছে তার ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর। প্যালেস্টাইনি জীবনের অবস্থা কেবল যে অসাধারণ তা-ই নয়, স্বয়ং স্থানটাও অসাধারণ। ‘প্যালেস্টাইন কোনো সাধারণ স্থান নয়’, বলেছেন এডওয়ার্ড সাঈদ, মুরিদ বারগুতির বাস্ত্তচ্যুতি সম্পর্কিত প্রচন্ড কাব্যিক রচনা আই স রামাল্লার ভূমিকা লিখতে গিয়ে। সাঈদ বলেন, ‘সকল জ্ঞাত ইতিহাস এবং একেশ্বরবাদের ঐতিহ্যের মধ্যে এর স্থান রয়েছে, সব ধরনের বিজেতা এবং সভ্যতাকে আসতে-যেতে দেখেছে এই ভূমি।’
দখলদারিত্ব এবং নিপীড়নের নিষ্ঠুর বাস্তবতা যখন মাটির ওপরের সত্যকে তুলে ধরে তখন বহু প্যালেস্টাইনি লেখকই আর তাদেরকে তাঁদের ওপর আপতিত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার স্রেফ দর্শক এবং প্রতিবেদকের ভূমিকায় দেখতে চান না। তাঁরা তাঁদের মিশনকে দেখেন একটা জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলা এবং তাকে সংরক্ষণ করার ভূমিকায়, যা ষাট বছরের পরাধীনতা ও পরাজয়ের বাধাহীন শৃঙ্খলে আহত। প্যালেস্টাইনিরা তাঁদের সাহিত্যে যা বর্ণনা করেন তার আস্তিত্মিক জগতে প্রবেশ করে এ-লেখকরা পাশ্চাত্যের পাঠকদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেন যে, সাহিত্যের মূল কাজ হচ্ছে তাদের বাস্তবতার ওপর ‘আলো ফেলা’। তাঁরা তাঁদের এবং তাঁদের চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে যে-পদ্ধতিতে ভাবেন, তাকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার করে তোলা।

[রাইমা নাজার মেরিম্যান আল-কুদস ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। অনূদিত প্রবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার প্রকাশনা ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডের মে ২০১২ সংখ্যায় ‘নো অর্ডিনারি প্লেস : রাইটার্স অ্যান্ড রাইটিং ইন অকুপায়েড প্যালেস্টাইন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।] 