পর্বত থেকে পতন : জীবনের ট্র্যাজেডি

হাসিন অনুপমা আজহারী
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা

সৈয়দ আনওয়ারুল হাফিজ

শুদ্ধস্বর
ঢাকা, ২০১২

১৭৫ টাকা

সৈয়দ আনওয়ারুল হাফিজ-রচিত তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা বইটিতে মূলত পর্বতারোহীর জীবনচিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। বইয়ের যে-দিকগুলো আমার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে, সেগুলো আমি নিম্নে বর্ণনা করছি। আমরা অনেকেই প্রায়শ পর্বতারোহণের কল্পনা করেছি। যে-কোনো কার্য সম্পাদনের পূর্বে প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে, যেটি পর্বতারোহীর ক্ষেত্রেও সত্যি। এই বইটিতে পর্বতের ওপরে অক্সিজেনের স্বল্পতা, তার প্রতিকার, শরীরের রক্ত চলাচল কম হওয়ার সঠিক ব্যবস্থাপনা, কী ধরনের পোশাক পরতে হয়, কীভাবে তাঁবু খাটাতে হয়, কীভাবে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকতে হয়, অতিরিক্ত বরফের মধ্যে কীভাবে টয়লেট ম্যানেজ করতে হয়, কেমন স্পেশাল জুতো পরতে হয়, এসব ব্যাপারে যে পর্বতারোহীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে তা আলোচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে শরীরের ফিটনেস হলো সবচেয়ে বেশি দরকার। ধূমপানকারীরা এ-প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
যেটি আমার চোখে পড়েছে, পৃথিবীর সর্বস্থানেই মানুষের মধ্যে জাতিধর্মবর্ণের ভেদাভেদ রয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণীত হয়। কিন্তু পর্বতের ওপর ওঠার পর সকলে এ ভেদাভেদ ভুলে যায়। লেখক সাবলীলভাবে বলেছেন যে, ওখানে মানুষ খুব একা। জাতিবর্ণ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত কোনোভাবেই মানুষ পরিচিত নয়। একটি কথা সবার মনে থাকে যে, সবাইকে সবার প্রয়োজন। এ-মানসিকতার চিত্রটি যদি আজ আমরা সর্বস্থানে প্রয়োগ করতাম তাহলে পৃথিবীতে হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা সবকিছুর মাত্রা কমে আসত।
এখানে লেখক শিয়া-সুন্নি মুসলমানদের দুটি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। গল্পে উল্লিখিত দুটি চরিত্রের একজন পাকিস্তানের ফরিদ আল্লাওয়ালা এবং তার প্রেমিক রাজিয়া। এদের মিলনের বাধাই ছিল এই শিয়া-সুন্নি সাম্প্রদায়িকতা। আমরা যতই নিজেদের আধুনিক হিসেবে পরিচয় দিই না কেন, সমাজকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, নিজের ক্ষেত্রে আবার সে-কুসংস্কারকেই টেনে আনি এবং প্রয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করি না। রাজিয়ার বাবা একজন শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিয়েছেন, যার ফলে রাজিয়া ও ফরিদের মিলন তো অনেক দূরে, অবশেষে ফরিদ মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
লেখক গল্পের প্রথমে বন্ধুত্বের অপূর্ব নিদর্শন দেখিয়েছেন, যা এ-জগতে বিরল। পাকিস্তানের ফরিদ আল্লাওয়ালা এবং বাংলাদেশের রেজা আলীর দেখা একটি স্পোর্টসের জুতোর দোকানে। সেখান থেকে কফি খাওয়া এবং পরিচয়, দুজনেই জিওগ্রাফির মানুষ এবং ইচ্ছা মূলত একই। রেজা আলী কল্পনায় মাউন্টেনিয়ার আর ফরিদ বাস্তবক্ষেত্রে অভিজ্ঞ মাউন্টেনিয়ার। এ-পরিপ্রেক্ষিতে রেজাকে কারাকোরাম পর্বতে আরোহণের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফরিদ তার বাড়িতে তার অনুপস্থিতিতে তার শয়নকক্ষে অবস্থান করতে দিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের যে বিষয়, ফরিদ তার প্রেমিকা রাজিয়ার সঙ্গে তাকে সাক্ষাৎ করতে বললেন এবং তার হাতে একটি উপহার দিলেন রাজিয়াকে দেওয়ার জন্য। এ-ধরনের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে এ-জগতে ঘটতে দেখা যায় না; কিন্তু লেখক এর মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন যে, বন্ধুত্বের প্রারম্ভের সময় স্বল্প হলেও গভীরতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, যদি একের ওপর অপরের বিশ্বাস থাকে।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, কোনো উপন্যাস বা গল্পে সুন্দরী রমণীর ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন – তন্বী, সুনয়না, ফর্সা প্রভৃতি। কিন্তু লেখক এখানে নায়িকা রাজিয়াকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী হিসেবে বর্ণনা করেছেন একটিমাত্র বাক্যের মাধ্যমে, সেটি হলো ‘ঠান্ডি ঠান্ডি আগ’- যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এমন তাপ নেই তাতে, যা পুড়িয়ে দেয়। এ এক ভিন্নতর অপূর্ব সুন্দরী রমণীর চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন।
গল্পের শেষ অংশে মনোনিবেশ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন পর্বতারোহীর ক্ষেত্রে। এখানে একজন শিক্ষানবিশ মাউন্টেনিয়ার রেজা আলী আর একজন অভিজ্ঞ ফরিদ পর্বতে ওঠার সময়ে দুজনেরই মনোনিবেশের অভাব ছিল কারণ দুজনেই পর্বতে ওঠার আগে রাজিয়ার ছবি দেখছিলেন। একজনের মনে মিলনের অভাবজনিত বেদনা এবং আরেকজনের (রেজা) মনে না পাওয়ার বেদনা। এই মনোকষ্টের জন্য দুজন পর্বতারোহীর পাহাড়ে ওঠার সময়ে পা ফস্কে গিয়েছিল। বলা যায় যে, অভিজ্ঞ মাউন্টেনিয়ার ভুলে গেছে, পর্বতে আরোহণের সময়ে যেখানে পা রাখবে সেখানে আগে স্কি-স্টাফ দিয়ে জায়গার অবস্থান বুঝে নেবে। অবশেষে ফরিদের মৃত্যু ঘটল পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে পড়ে গিয়ে, এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে, অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র সফলতার চাবিকাঠি নয়, কাজে মনোনিবেশ এবং সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন অনভিজ্ঞ লোকও সফলতা লাভ করতে পারে প্রতিদিন দৈনন্দিন কাজে তার নিয়মানুবর্তিতা যদি থাকে।
নায়িকা রাজিয়ার একটি ছবি তুলেছিলেন রেজা। সেই ছবিটি প্রথম থেকে রেজা চেষ্টা করছিল ফরিদ, রাজিয়ার দাদি এবং রাজিয়াকে দিতে। কেউই ছবিটি গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি। নায়ক ফরিদের মৃত্যুর পর ছবিটি সম্পর্কে রাজিয়ার দাদি রেজাকে বলেছিলেন, ছবি তিনি রাখবেন না। ‘আমার শাস্তি আমি আমার পোতি রাজিয়ার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি।’ এই ছবি যতদিন রেজার কাছে থাকবে ততদিন সে নিজেকে দায়ী মনে করবে ফরিদের মৃত্যুর জন্য। ছবি সবাই সাধারণত ভালো স্মৃতির জন্য সংরক্ষণ করে; কিন্তু এ-গল্পে লেখক দেখালেন শাস্তির রূপক হিসেবে ছবির ব্যবহার।
পরিশেষে বলতে হয় যে, কাহিনির এই নামকরণ লেখক গল্পে কীভাবে সার্থক করেছেন। বইটি সম্পূর্ণভাবে একজন পর্বতারোহীর ঘটনা। গল্পের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে লেখক তার নামকরণ করেছেন রেজা কর্তৃক একটি চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে। যেখানে নায়িকা রাজিয়ার চিত্র তুলেছিল রেজা আলী এমন একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমন্বয়ে যা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের চরণ ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একেবারে অবিকল।
পরিশেষে বলতে হয়, লেখক এই কাহিনিতে প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, বৈজ্ঞানিক, সবকিছু ধারণার সমন্বয়ে একটি সুন্দর গল্প রচনা করেছেন। 