সুনীলদা

সমরেশ মজুমদার
ইদানীং সুনীলদাকে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। একটি তরতাজা শরীর ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। মুখ, চোখ, কাঁধ থেকে শুরু করে চাহনিও বদলে যাচ্ছে, কিন্তু সেই শরীরের মালিক চেষ্টা করছেন আগের মতো কথা বলতে, হাসতে। ফোন বাজলেই জানান দিচ্ছেন নিজের গলায়। মন খারাপ হয়ে যেত।
আনন্দবাজারের কলমে প্রায়ই লিখে ফেলতেন, তিনি আর বেশিদিন নেই। পড়ে খারাপ লাগত। টেলিফোনে সেটা বলতেই হাসতেন, চলে তো যেতেই হবে সমরেশ। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবরটা কলকাতার একটি কাগজ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল, অন্যেরা উদাসীন। টেলিফোনে অভিযোগটা ওঁকে জানিয়েছিলাম। সুনীলদা হেসে বলেছিলেন, ‘কী করবে বলো! আমি চলে গেলে দেখো, এইরকমই হবে।’
এখানেই বিরাট ভুল করেছিলেন সুনীলদা। তাঁর চলে যাওয়ার খবর প্রচারিত হওয়ামাত্র যেভাবে বাঙালির বৃহৎ অংশ নেমে পড়েছিল তা ওঁর অনুমানে বোধহয় ছিল না। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কারণে ফোন আসতে লাগল সিডনি, নিউইয়র্ক, লন্ডন থেকে, ‘খবরটা কি সত্যি?’ বাংলাদেশের পাঠকের কাছে হুমায়ূনের পরেই সম্ভবত জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গদ্যে এবং পদ্যে। তাঁরা যে গভীর শোকাহত তার প্রমাণ পাচ্ছিলাম দিনভর। সেখানকার প্রায় প্রতিটি কাগজ, টিভি চ্যানেলে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। পৃথিবীর যেখানেই দুজন বাংলাদেশি আছেন সেখানেই শোকের কথা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর সময় এতো কাগজ বা টিভি চ্যানেল ছিল না। আমি তাঁদের মৃত্যুর পরে জন্মেছিলাম। গত ষাট বছরে পশ্চিমবঙ্গের আর কোনো লেখক মৃত্যুর পরে এমনভাবে মানুষের বুকে কান্না তৈরি করে যেতে পারনেনি, আর কেউ এমন ভালোবাসা পাননি!
জানি না কেন, মৃত্যুর আগের দিন বিকেলে সুনীলদার কথা মনে হয়েছিল। দেখলাম ফোন বন্ধ। পত্রভারতীর ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে ফোনে বললাম সুনীলদার খবর নিতে। সেও জানাল, ফোনে পাচ্ছে না। সুনীলদার খুব ঘনিষ্ঠ দিব্যেন্দু চক্রবর্তী জানাল, ‘শরীরটা ভালো নেই বলে ফোন বন্ধ করে সুনীলদা ঘুমাচ্ছেন।’ সেই ঘুম যে কয়েক ঘণ্টা বাদে শেষঘুম হয়ে যাবে তা কে জানত!
একথা বলা দরকার, আমি কখনই সুনীলদার নিয়মিত আড্ডায় যেতাম না। তাঁকে ঘিরে যে কবিদের ভিড় ছিল অথবা বুধসন্ধ্যার আসর বসতো, সেখানে কোনো কারণ ছাড়াই যাওয়া হতো না। তাই দেখা হতো খুব কম। কিন্তু কথা হতো প্রায় প্রতি সপ্তাহে। নানান সমস্যা নিয়ে কথা। কথার শেষে বলতেন, ‘একদিন এসো।’ বলতাম, ‘যাবো।’ যাওয়া হয়নি।
কিন্তু কলকাতার বাইরে বহুবার দিনরাত ওঁর সঙ্গ পেয়েছি। একবার আমি বিখ্যাত লেখকদের নিয়ে জলপাইগুড়িতে গল্প পড়তে গিয়েছিলাম। দুদিন পড়ার শেষে রাত সাড়ে নটায় ১০০ কিলোমিটার দূরের মধু চা-বাগানে গেলাম বিশ্রাম নিতে। এক গাড়িতে আমি সুনীলদা আর সমরেশ বসু। অন্য গাড়িগুলোতে বাকিরা। চলন্ত গাড়িতে সুনীলদা জলের বোতল উঁচু করে ধরে মুখে ঢালছিলেন। পরিষ্কার জল। পেছনে গাড়িতে বসে হেডলাইটের আলোয় আর একজন বিখ্যাত লেখক তাই দেখে ভাবলেন তাঁকে বঞ্চিত করে আমরা ভদকা খাচ্ছি। তখন সমানে হেডলাইট জ্বালিয়ে-নিভিয়ে হর্ন দিয়ে আমাদের গাড়ি থামাতে বলতে লাগলেন তিনি। সুনীলদা হেসে বলেছিলেন, ‘খুব রেগে গিয়েছে ও। গাড়ি থামিও না।’ গন্তব্যে পৌঁছার পর সেই লেখক যখন আমার ওপর ভয়ংকর রেগে গেলেন তখন তাঁকে বোতলটা দেওয়া হলো। স্বাদ নিয়ে তিনি লজ্জিত হলেন, একি! এ তো শুধুই জল। সুনীলদা ততক্ষণে সরে গেছেন সামনে থেকে। খুব মজা হয়েছিল সে-যাত্রায়।
সুনীলদার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ বেরিয়েছিল আমার প্রথম উপন্যাসের ১০ বছর আগে। তাঁর আগে যেসব বিখ্যাত লেখক দারুণ-দারুণ লেখা লিখে গেছেন তাতে মুগ্ধ হতাম কিন্তু আত্মপ্রকাশ পড়ে মনে হয়েছিল, এই হলো আমার জন্য লেখা। আমাদের সময়ের কথা বলেছেন লেখক নতুন ভাষায়। স্বীকার করছি, একটা পথ পেয়ে গিয়েছিলাম আত্মপ্রকাশ পড়ে। একথা প্রকাশ্যে বহুবার বলেছি, সুনীলদা হেসে বলতেন, ‘একটু বেশি বলছো!’
ঢাকা বা নিউইয়র্কে ওঁর সঙ্গে বহুদিন কাটিয়েছি। কিন্তু কখনই কারো বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বলে শুনিনি। কয়েক বছর আগে সানফ্রানসিসকোতে এক অনুষ্ঠানের পর ওঁকে বলেছিলাম, ‘আপনি শুধু সেই সময় নিয়ে লিখে যাচ্ছেন কেন? এই সময় নিয়ে লিখুন। যেমন আত্মপ্রকাশ, সাদা গাড়ি কালো রাস্তা, একা এবং কয়েকজন।’
সুনীলদা অনেকক্ষণ ভেবে বলেছিলেন. ‘দেখি!’
কে বড়? গদ্যকার সুনীলদা, না পদ্যকার সুনীলদা – এর বিচার পণ্ডিতরা করবেন। পাঠক দুজনকেই এক করে নিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা জয় গোস্বামী উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে সাফল্য পাননি। রবীন্দ্রনাথের পরে একমাত্র সুনীলদাই সব্যসাচী ছিলেন।
আনন্দবাজারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর মরদেহ রবীন্দ্রসদনে পৌঁছার পরে কবি-সাহিত্যিকদের পেছনে সরিয়ে রাজনীতির মানুষদের দখল নেওয়া আমার ভালো লাগেনি।
আমার বিশ্বাস, তাঁর শেষযাত্রা ওইভাবে হবে তা সুনীলদার কল্পনাতেও ছিল না।