হে অনাদি অসীম সুনীল অকূল সিন্ধু

বেলাল চৌধুরী
পূর্ববঙ্গের মানুষ হয়েও আমি কিন্তু প্রথম কলকাতায় নেমেছিলাম হাওড়া স্টেশন দিয়ে। সে একেবারে বাল্যবয়সের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। আমার এক জামাইবাবু সরকারি চাকরিসূত্রে পোস্টিং পেলেন সিভিল সাপ্লাইতে। যদিও তিনি ছিলেন জুডিশিয়ারি সার্ভিসের লোক। অফিস মানকুণ্ডুতে হলেও থাকতেন তিনি চন্দননগরে।  একেবারে স্ট্র্যান্ডের কাছাকাছি। নৈহাটি হয়ে গিয়েছিলাম চন্দননগর। চন্দননগর তখনো ফরাসি উপনিবেশ। ডুপলে কনভেন্টে পড়ানো হতো ফরাসি ভাষা। সেই বাল্যবয়সেই আমি দুটো ছায়াছবি দেখেছিলাম, শ্রীদুর্গাতে গৃহলক্ষ্মী, আর জ্যোতিতে ভাবীকাল। পুলিশের পোশাক ছিল নীল রঙের। সোনার বরণ চাঁপা বালা, আলোকে আলোকময় সাড়ম্বর জগদ্ধাত্রী পুজো। চন্দননগরে স্মৃতি বলতে ওইটুকুই। আর কলকাতার – কলকাতার কতটুকুই বা জেনেছিলাম বা দেখেছিলাম। ট্রামে চড়ে হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে বড়বাজার হয়ে ধর্মতলা অবধি মনে আছে বড়জোর।
আর এর প্রায় দুই যুগ বাদে জীবনসমুদ্র মন্থন করে পশ্চিম বাংলার কলকাতায় যখন নোঙর ফেললাম ষাটের দশকের শুরুতে ইংরেজদের স্মৃতিবহ কলকাতায়, তখন আবার স্মৃতির সরণি বেয়ে চন্দননগর গেছি কাজে-অকাজে বেশ কবার। একবারের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। নিতান্ত এক আলস্যমেদুর দিনে অকুণ্ঠ প্রশ্রয়দাত্রী এক বউদির সঙ্গে সুন্দর, হৃদিরঞ্জন সারাদিন কাটানোর স্মৃতিতে আজ এত বছরের দূরত্বে এসেও ‘হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভেসে যায়…’
এর মধ্যে পৃথিবীর নদ-নদী, সমুদ্রগুলো দিয়ে বহে গেছে বহু জল আর পানি। যে-যারটা নিজের মতো করে বেছে নিন। এরপর আমি প্রথম যখন কলকাতায় নামি, পকেটে তখন জাপানি ট্রলারে চেপে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও মাছ বেচার সুবাদে দেদার কাঁচা টাকা। কফি হাউস চেনার আগে কদিন বিভিন্ন বার এবং হোটেলে সে বয়সে যা-যা করা যায় সবই হলো। এরপর সব পথ যেরকম একই বিন্দুতে গিয়ে মেলে, তেমনই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওয়েলিংটনের খালাসিটোলা এবং আরো বৃহত্তর কলকাতা শহরের ঠেকগুলিতে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগেনি।
কলকাতায় আমি যেমন হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়িনি, তেমনই মাটি ফুঁড়েও বেরোইনি।
তাহলে?
ভাসতে-ভাসতে গিয়ে ঠেকেছিলাম কলকাতা বন্দরে হুগলি নদীর চড়ায়।
আগেই বলেছি, সাহিত্য ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। আমরা নির্বিবাদী পড়–য়ারা ধ্র“বজ্ঞান করতুম কলকাতাকে। কলকাতার কত মজা। ক্রমে মজে গেলাম কলকাতার প্রেমে। সে কিন্তু যে-সে মজা নয়, সুখে-দুঃখে জড়িয়ে পড়ার মতো এক নিবিড় বন্ধন আষ্টেপৃষ্ঠে। ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলাম রেল ইঞ্জিনের ড্রাইভার কিংবা নীল পোশাক পরা নাবিক। তা শেষ অবধি ধীবরের কাজ করতে-করতে হতে হলো শব্দের নগণ্য ঠুকঠুক কারিগর, না শব্দঠোকরা। এখানে তারই বহুকাণ্ডের এক কাণ্ডমাত্র।
আমি যখন যে শহরে গেছি চিরাচরিত অভ্যেস অনুযায়ী প্রথমেই পত্র-পত্রিকার স্টল থেকে ধীরে-ধীরে পুরনো বইয়ের দোকান অবধি পৌঁছতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি। আগেই বলেছি একসময় ঢাকাতে বসেই কলকাতার পত্র-পত্রিকার মধ্যে অধিকাংশের সঙ্গেই পরিচিত ছিলাম। পরিচয়, চতুরঙ্গ, নতুন সাহিত্য, অগ্রণী, চতুষ্কোণ, অনুজ, ময়ূখ, কবিতা, পূর্বাশা, কৃত্তিবাস। রাজনৈতিক কারণে সোমনাথ লাহিড়ী, যিনি পরে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হয়েছিলেন, তাঁর ‘কামরু আর জোহরা’ গল্পের জন্য পরিচয় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্বাশা, নতুন সাহিত্য, কবিতা এবং কৃত্তিবাসে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ ও ওমর আলীর কবিতা ছাপা হতে দেখেছি। ঠিক তার আশেপাশেই ইঙ্গিত, ইদানীং, রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা, অচলপত্র, মনের মতো কাগজে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। ওর মধ্যে দীপ্তেন্দ্র কুমার স্যানাল বা দী কু সার অচলপত্র, শচীন ভৌমিকের মনের মত কাগজ গোগ্রাসে গিলতাম মনে পড়ে। তবে নির্ভেজাল সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে পরিচয়, নতুন সাহিত্য, চতুরঙ্গ, কবিতা ও তরুণ কবিদের অনিয়মিত কবিতা পত্রিকা কৃত্তিবাসের ছিল একটা আলাদা ভূমিকা এবং চরিত্র। একই সময়ে আরেকটি পত্রিকার কথা খুব মনে পড়ে। নাম ছোটগল্প। একঝাঁক তরুণ লেখক সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী গল্প লিখতে শুরু করে বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেবেশ রায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শংকর চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য, মতি নন্দী, বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে লিখতেন বিমল রায় চৌধুরী এবং এরকম আরো অনেকে। পরবর্তীকালে এঁদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল পরম হৃদ্যতা। আবার এঁদের অনেকে আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমার জীবনে এঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।
কলকাতায় ভেসে বেড়াতে-বেড়াতে আমার ছন্নছাড়া জীবনের জন্যেই হয়তো এমন একটা সময় এলো যখন আর শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজতে চাইছিল না। পাশাপাশি দুটি দেশ একই ভাষাভাষী, প্রায় একই গাত্রবর্ণের, শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই যা কিছু ফারাক Ñ এক সময় যা ছিল অখণ্ড এবং উপনিবেশ, তা-ও কুচক্রী ইংরেজদের শাসনাধীন; তারাই প্রত্যক্ষ ইন্ধনে প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি আর কাটাকাটি লাগিয়ে একের বিরুদ্ধে অন্যকে এতই সন্দিহান আর অবিশ্বাসী করে তুলেছিল যে, মনে হতো, প্রত্যেকের হাতেই বাঘনখ রয়েছে। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের পোড়ার কথা বলছি।
এদিকে হলো কী, হঠাৎ পয়সাকড়িতে টান ধরাতে আমার এক সম্পর্কিত দাদু আবদুর রশীদ খান সাহেব, যিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বিশেষ েস্নহভাজন হিসেবে কলকাতা করপোরেশনে প্রথম মুসলিম এক্সিকিউটিভ পদে অধিষ্ঠিত হন। পার্ক সার্কাস ময়দানের সামনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির লাগোয়া তাঁর নিজস্ব পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন আমার এক মামা, যিনি করপোরেশন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাঁর ওখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। আর সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাড়িটি ছিল তখন পাকিস্তানি হাইকমিশনারের সরকারি আবাস। মামার পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী এবং লেখক বুলবুল চৌধুরীর শাশুড়ি মিসেস মোদক, যাঁকে আমরা নানি ডাকতাম। আর ছিলেন হাসান সাহেব বলে এক ভদ্রলোক, যাঁর সুবাদে পরিচিত হয়েছিলাম ডুয়ার্সের নিউ প্লেঙ্কো নামে এক চা বাগিচার মালিকদের ছেলে শামসের আনোয়ারের সঙ্গে। শামসের তখন প্রায় কিশোর। মা, নানি, দুই মামা-মামির সংসারে একমাত্র আদুরে ছেলে। বিচ্ছেদ না হলেও ওর বাবার সঙ্গে ওর মায়ের বনিবনা ছিল না। আদতে ওরা মুর্শিদাবাদের লোক হলেও ভাগ্যান্বেষণে ওরা জলপাইগুড়ির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। শামসেরকে প্রথম যখন দেখি তখন লেখালিখি তো দূরের কথা, বই-টই পড়াতেও ওর তেমন একটা আগ্রহ দেখিনি। পয়সাঅলা ঘরের ছেলের যা হয় তার ব্যতিক্রমী কিছু ছিল না।
যার ফলে ওর নিকটজনেরা প্রথম-প্রথম আমাকেও একটু ব্যাঁকা-ট্যারা চোখে দেখছিলেন। কিন্তু যখন আমার পারিবারিক পরিচয় পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন যে, তাঁদের জন্য আমি তেমন ক্ষতিকর নই, তখনই তাঁরা আমার সঙ্গে অনেক সহজ হয়ে এলেন। শামসেরের মায়ের আস্থার সঙ্গে যোগ হলো ওর প্রায় নিরক্ষর কিন্তু সুন্দরী, ভালো রাঁধুনী, সহৃদয়া নানির। একান্ত ব্যক্তিগত সাংসারিক চিঠিপত্র মুসাবিদার কারণেই হোক চাই অন্য কারণেই হোক নানা সদ্গুণের অধিকারিণী, বিচক্ষণ ওই মহিলা আমার ওপর খানিকটা সদয় হয়ে উঠলেন। এই সময় থেকে নানির রান্নার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে-ধীরে।
একবার এই প্রবাদপ্রতিম নানির অনুরোধের ঢেঁকি গিলে দিন সাতেকের জন্য আমি কলকাতার বাইরে ওঁদের তালিবপুর গ্রামে গিয়ে কাটিয়ে ফিরে এসে শুনি আমাকে নিয়ে নানা রোমহর্ষক গল্পগাথার অবতারণা। আমার বালিশের তলায় নাকি লাখ লাখ টাকার ছড়াছড়ি দেখা গেছে। তখন কলকাতার বাজারে পাকিস্তানের স্পাই আর মধুচক্রের গরমাগরম সব খবরাখবর আমজনতা খুব খাচ্ছে। দুদেশের মধ্যে যাচ্ছে এক কঠিন সময়। দেখলাম এ তো এক ভারী বিপদ! তখন চলছে পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু উৎখাত নিয়েও নানান রটনা। তখন আমার চৈতন্যোদয় হলো – সত্যি তো আমার আসল পরিচয়টা কী!
আমার প্রতি সন্দেহের তির যে একেবারে অমূলক তা-ই বা বলি কী করে! যখন পাকিস্তান থেকে দলে-দলে হিন্দুরা চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে তখন মুসলমান পরিচয়ধারী একজন উটকো লোক কেন কলকাতায়! কী তার পরিচয়! রটনাকারীদের ভেতরে যে কোনো অসূয়া ছিল তা-ও নয়। একধরনের নিস্তরঙ্গ জীবনে দারুণ চাঞ্চল্যকর এবং উত্তেজক কৌতুকে তারা নিছক মজার জন্যেই ঢিল ছুড়েছিল হয়তো। মূর্তিমান সারল্যের প্রতীক আমার অগ্রজতুল্য বন্ধু পুরনো দু®প্রাপ্য বইপত্র থেকে পুরাতত্ত্ব বিষয়ক সামগ্রীর কারবারি এবং কমল কুমার মজুমদারের নিত্যসহচর ও সাগরেদদের একজন তো বটেই উপরন্তু অঙ্ক ভাবনার প্রকাশক। সেই ইন্দ্রদা যখন সরলভাবে ঘটনাটা আমাকে অবহিত করেন তখন আমার ভেতর একটা জেদ চেপে গেল। এই আইডেনটিটি ক্রাইসিসকে যে কোনো উপায়ে অতিক্রম করতেই হবে। একে বাঙালি, তায় মতি নেই ধর্মেকর্মে। শরাব শূকরসহ বিভিন্ন মকারের একনিষ্ঠ সেবক। জয়বাংলা বলে হাতে তুলে নিলাম কলম।
এতো তো পড়েছি, দেখাই যাক না কিছু লেখাজোখা করা যায় কি-না! ও হ্যাঁ, এর মধ্যে আমার প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়ালেন কমলদা। ইন্দ্রদার মুখেই শোনা, কথাটা পাড়তেই কমলদা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তুড়ি মেরে বলেছিলেন, যে ছেলে পারলে সারাক্ষণই কাটায় আমাদের সঙ্গে সে কি-না যাবে স্পাইগিরি করতে! বলে, স্পাইগিরির পূর্বাপর সম্পর্কে ঝাড়া এক বক্তৃতাতে সব ঠান্ডা! কমলদার যে কোনো উদ্যোগে ছিল ইন্দ্রদার নেপথ্য, নীরব আনুগত্য। যার ফলে ‘অঙ্ক ভাবনা’র মতো কাগজের কাজও চলেছিল খালাসিটোলাকে আবর্তিত করে।
ঢাকাতে বসেই আমি প্রথম পড়ি কমলকুমার মজুমদারের সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাহাদের কথা। লেখকের ভাষারীতি আমাকে প্রবলভাবে আগ্রহী করে তোলে তাঁর আরো লেখা পড়ার জন্য। এক ধরনের প্রাচীন গদ্যভঙ্গিই হয়তো তার প্রধান কারণ। এমন সময় ঢাকার বইয়ের বাজারেই পেয়ে গেলাম অন্তর্জলী যাত্রা। ঠিক যেরকমটা চাইছিলাম বা ভেবেছিলাম তার সঙ্গে মিলে যাওয়াতে আমার পাঠস্পৃহা যেন আরো উসকে উঠল। প্রথম বাক্য ‘ক্রমে আলো আসিতেছে’ থেকে শুরু করে শেষ শব্দটি পর্যন্ত একটা নিজস্ব অন্বয়ে আলাদা জলছাপ। বিষয়বস্তু যত প্রতিক্রিয়াশীলই হোক না কেন, একটা ধ্রুপদী স্বভাব সহজেই আমাকে আকৃষ্ট করার মূলে ছিল। বাবু শ্রীরাধাপ্রসাদ গুপ্তকে অক্ষর আজ্ঞা করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যে উৎসর্গপত্রটি ছিল তাতেও একটা স্বকীয়তা জ্বলজ্বল করছিল যেন। আর গোটা উপন্যাসটাকেই মনে হয়েছিল মস্তবড় একটা তৈলচিত্র। প্রথম পঙ্ক্তির শুরু হতে শেষ পঙ্ক্তি অবধি যেন একটা অন্তর্লীন কাব্যগাথা।
সুতরাং যখন শুনলাম কফি হাউসেও নাকি দু-একবার তাঁকে দেখা গেছে এবং অনেকেই তাঁকে চেনেন। গুণমুগ্ধরা তো বটেই এবং প্রায় রোজই ওয়েলিংটনের সামনে একটা বিশেষ জায়গায় তাঁকে দেখা যায়, তখন এহেন মানুষকে চাক্ষুষ করার সুযোগ সে কাঁচা বয়সে কে ছাড়ে! একদিন সন্ধ্যার ঝোঁকে এক গ্রীষ্মসন্ধ্যায় তাঁর খোঁজে কার বা কাদের সঙ্গে যেন ওই খালাসিটোলা বাকায়দা করে যাকে কে টি বলা হতো সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। ঢুকতেই ইয়া বড়-বড় ড্রাম আর একটা কালো রঙের পুরনো মডেলের মোটরগাড়ি। সে এক এলাহী কাণ্ড!
কমলদার সঙ্গে প্রথম দেখার ক্ষণ থেকেই কেন জানি মনে হলো মানুষটি বড় আপনকার। স্বর্ণযুগের খালাসিটোলায় ওই গাদাগাদি ভিড়, কোলাহল-কলরব আর পেচ্ছাপের গেঁজে ওঠা গন্ধের ভেতরও উনি আমার সঙ্গে সহাস্যে কথা বলছিলেন। উপস্থিত কেউ এরকম ব্যাপারটার প্রতি কটাক্ষ করে কিছু বলে উঠলে কমলদার উক্তিটি ছিল স্মরণীয়, ‘আরে বাবু, তুমি এর বুঝবে কী? এ যে দূরের ভালোবাসা বলে কথা।’ একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম, গেলাস হাতে তার ভেতরে আঙুলের ডগা চুবিয়ে সামনের দেয়ালে ঝোলানো মাকালীর প্রতিকৃতির দিকে এক ফোঁটা ছিটিয়ে তারপর নিজের কপালে ছুঁইয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিকভাবে এক চুমুকে গেলাস সাবাড় করে আবার কথা বলতে শুরু করলেন। আরেকটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগল যে, তাঁর হাতের আঙুলে আরবি হরফে লেখা বেশ চওড়া একটা রুপোর আংটি। পরে দেখেছি কারুর গায়ে হাত তোলার প্রয়োজন হলে আংটিটি খুলে নিতেন।
খালাসিটোলার নাম করলেই স্বাভাবিক নিয়মেই অদূরের বারো দরোজা বিশিষ্ট বারোদুয়ারির নামও এসে যেতে বাধ্য, একসময় যা ছিল রানী রাসমনির খাসতালুক।
খালাসিটোলা যদি হয় বাবু কমলকুমার মজুমদারকে কেন্দ্র করে সপারিষদ সাগরময় ঘোষ, সমরেশ  বসু, সুনীল, শক্তি, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, ইন্দ্রনাথ মজুমদার, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, পাপ্পা, কাজী সব্যসাচী, আবুল কাশেম রহিমুদ্দিন, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেতা মমতাজ উদ্দীন আহমদ, হলিউডফেরতা হরিসাধন দাশগুপ্ত বা হ্যারি এস, প্রমোদ লাহিড়ী, সৌম্যকান্তি টাকমাথা শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি আজীবন আনন্দবাজারে  কাজ করেও আদর্শগত অমিলের জন্য সে-কাগজে এক লাইনও মৌলিক লেখা লেখেননি। বারোদুয়ারি আলো করে থাকতেন। হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, গোপাল ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সত্যিকারের মদুরেদের আখড়া, তাতে কোনো লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন হাংরি জেনারেশনের বালখিল্যরা গোকুলে বাড়ছে। শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব, সুবিমল, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্যরা ওসব জায়গায় আনাগোনা করতে শুরু করেছে ঢের পরে।
প্রায় প্রতিদিনই খালাসিটোলার সান্ধ্যসঙ্গী হতেন ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র উৎপল কুমার বসু, ‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র মোহিত  চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ‘বিজনের রক্তমাংসে’র সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অরূপরতন বসু এবং ‘ফিরে এসো ঢাকা’র বিস্ময়কর কবি বিনয় মজুমদার ছিলেন অন্য ধাতের। কফি হাউসে  অন্য কেউ থাকুক-না-থাকুক বিনয় মজুমদারের উপস্থিতি ছিল সার্বক্ষণিক।
বিনয়দাকে নিয়ে শুধু গল্পই নয়, রীতিমতো অনেক রোমহর্ষক ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল আমাকে। একবার তাকেও আমি নিয়ে গিয়েছিলাম কেটিতে। এক পাত্তর চড়াতে না চড়াতেই বলতে লাগলেন – ‘এ কী! মাথা ঘুরছে যে!’ তারপর আমিনিয়ায় নিয়ে গিয়ে প্লেটভর্তি বিরিয়ানি আর  পাসিন্দা কাবাব খাইয়ে তবে নিষ্কৃতি! খালাসিটোলাকে কেন্দ্র করে শুধু আমার কেন আমাদের পুরো কৃত্তিবাসীদেরই জীবনের অনেকখানি।
এদিকে আমিও দেখলাম কবিতা লেখা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও একবার আড় ভেঙে গেলে আর কোনো চিন্তা থাকে না। আর একবার ছাপার হরফে বেরিয়ে গেলে তো আর কথাই নেই। কমপক্ষে অন্তত পাঁচজনের মধ্যে দুজন তো ভালো বলবেই। প্রথমে শান্তি লাহিড়ীর সুদৃশ্য বাংলা কবিতা দিয়ে শুরু করে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত কৃত্তিবাস এবং আরো বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে-লিখতে দেখা গেল বাল্মীকি না হতে পারলেও নিদেনপক্ষে রতœাকর তো হওয়াই যায়। তবে হৃদিরতœাকরের অথৈ জলে ডুব দেওয়াটাই যা  কঠিন! উৎপলকুমার বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, তারাপদ রায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত তো বটেই, এমনকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুমোদন না পেলে কী যে হতো জানি না!
প্রতিষ্ঠাবিরোধী অ্যালেন গিনসবার্গরা তখন ঝড় তুলে ফিরে গেছেন নিজ নিকেতনে। ঢাকায় বসে ওঁদের ভারতভ্রমণ বিশেষ করে কলকাতা বিচরণের খবরাখবর আমরা পড়ছিলাম। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর লেখায়। একদিকে ইউরোপে বিটলসদের উত্থান অন্যদিকে মার্কিন দেশে বিট জেনারেশনদের তুলকালাম কাণ্ডকারখানা এবং তারই তরঙ্গ বিভঙ্গ নিয়ে যখন কলকাতা তোলপাড় ঠিক তখনই ভাসতে-ভাসতে কলকাতায় আমার নোঙর ফেলা। আর তারই পাশাপাশি পরে অস্বীকৃতি দিলেও হাংরি জেনারেশনের প্রবর্তকই বলা যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে।
এখানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে একটু আলাদা করে বলতেই হয়। সেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই জমে গেল যে, রোজ দুবেলা কফি হাউস তো বটেই এছাড়া আজ এখানে কাল সেখানে নিত্তনৈমিত্তিকতায় পর্যবসিত হতে দেরি লাগল না। শক্তিদা থাকতেন উল্টোডিঙিতে, অধর দাস লেনে এককামরার ঘরে, মাসিমা আর অনুজ রতন বা ভক্তিকে নিয়ে। আকণ্ঠ পানাসক্তি নিয়ে শক্তিদার ওপর তখন ভর করেছে কবিতা আর গদ্য। দুহাতে লিখে চলেছেন, ‘অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে,’ ‘বুকের মধ্যে জেগে ওঠে গ্রীস’, ‘মন বলে চাই-বাসা, চাই-বাসা’,  ‘উটের মধুর আরব এসেছে কাছে,’ ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যানে’র মতো সব কবিতা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ হে প্রেম হে নৈঃশব্দের  আগেই বেরিয়ে গেছে তুমুল শোরগোল তোলা লিরিক সংগ্রহ ‘ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি।’ এ সময় কুয়োতলা ছাড়াও লুসি আর্মানির হৃদয় রহস্য আর তোমার পায়ের পাতার রঙ লেগেছে নামে দুটি নাতিবৃহৎ উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন।
এর মধ্যে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দেখলাম আমেরিকা থেকে ফিরে এলেও কোনো রকম সাহেবিয়ানা তো দূরের কথা, একেবারেই যে নিখাদ খাঁটি বাঙাল তা তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণে টের পেতে দেরি হয় না। এমনকি খালাসিটোলার তরল গরলও দেখা গেল অমৃতজ্ঞান করছেন। খালাসিটোলা, কমলদা এবং কৃত্তিবাসের বন্ধুবান্ধবের প্রতি তাঁর সজল সম্পর্ক।
মার্কাস স্কয়ারে বঙ্গ সংস্কৃতির মাঠে কবিতা পাঠ, সুনীলের মায়াময় কণ্ঠে অবিস্মরণীয স্মৃতিচারণ প্রথম দিনই আমাকে দারুণ টেনেছিল। এছাড়া তুমুল হই-হুল্লোড়, কবিতা সিংহ-বিমল রায়চৌধুরীদের সঙ্গে মিলে পনেরো দিন ধরে একনাগাড়ে দৈনিক কবিতা বের করে যাওয়া, সারাদিন প্রেসে কাটিয়ে গভীর রাতে ঘরে ফিরে এক পাতে খাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
একটা সময় খুব সম্ভবত ২৫ নম্বর সংখ্যা থেকে সুনীলদা ঘোষণা দিয়ে কৃত্তিবাস বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। হঠাৎ কী খেয়াল হলো আমি আর আমার তখনকার প্রায়  সার্বক্ষণিক সঙ্গী খণ্ডকালীন কবি নিমাই চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলাম আমরা আবার চেষ্টা করে দেখি না কেন! আমাদের আরেক বন্ধু অমল লাহিড়ী পেছনে থেকে করতালি দিতেই সুনীলদা বললেন, তথাস্তু। আসলে সুনীলদা মানুষটার শব্দভাণ্ডারে ‘না’ শব্দটির ব্যবহার নেই বললেই চলে। যে- কথা সেই কাজ, আমরা লেগে গেলাম কৃত্তিবাসের জন্য লেখা আর বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে। কবিদের লেখা পেতে কোনো অসুবিধেই হলো না। একটা প্রেসও পেয়ে গেলাম। খুবই হেলায়-ফেলায় সামনে রাখা একটা কাগজের টুকরো ছিঁড়ে সামান্য কাটছাঁট আর আটা দিয়ে জুড়ে তুলির কয়েক আঁচড়ে আমাদের সামনে বসিয়েই পুর্ণেন্দুপত্রী করে দিলেন একটি মানানসই প্রচ্ছদ। নিজের কবিতাও দিলেন একটা। গর্হিত কাজ হয়ে গিয়েছিল নিজেরই অজান্তে, প্রথম সংখ্যা থেকে নিয়মিত লিখে আসা কবি শংকরানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় প্রথম ছেদ পড়ল আমাদের হাতে। পরে জেনে খুবই খারাপ লেগেছিল ব্যাপারটা। সে-সংখ্যায় বেশ কজন মহিলার কবিতা ছিল। যাঁদের মধ্যে কবিতাদি, দেবারতি, সাধনা মুখোপাধ্যায় ছাড়া অলকা চৌধুরী, নীতি নন্দী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সুনীলদা দিয়ে ছিলেন ‘উত্তরাধিকার’ নামে অসাধারণ সেই কবিতা, যা একমাত্র আত্মজনকেই দান করা যায় অনায়াসে। কবিতাটি সুনীলদার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বন্দী, জেগে আছোর ৬৪ পৃষ্ঠায় ৪৬ সংখ্যক কবিতা। শক্তিদা দিয়েছিলেন ‘শব্দ গুলিসুতো’। আলোকরঞ্জন, শঙ্খ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুর লেখাও পেয়ে গেলাম।
এত কিছুর ভেতর কখন যে কৃত্তিবাসের একজন হয়ে  গেছি আমি নিজেও টের পাইনি।
সুনীলদা আনন্দবাজারে প্রতি শনিবার ‘দেশ বিদেশ’ বলে একটি ফিচারের পাতা দেখতেন। আমি তার নিয়মিত লেখক হয়ে গেলাম। এছাড়া তখন প্রতি সোমবারে ‘কলকাতার কড়চা’ও দেখতে শুরু করলেন সুনীলদা।
তাঁর প্রশ্রয়ে সেই কড়চায় কত কিছুই না লিখেছি। মজা লাগত, কুড়ি টাকার বিল আনতে গিয়ে মহী (গাঙ্গুলি) দার মুখে নিদেনপক্ষে টপ্পার এক কলি না শুনে আসা যেত না। একসময় আমি আর পাপ্পা, মানে প্রয়াত শুদ্ধশীল বসু তো কড়চার বিল অ্যাডভান্স পর্যন্ত নিয়েছি।
এরপর কৃত্তিবাসের দায়িত্ব নেন সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। সমরেন্দ্রদার সম্পাদনা ছিল ঢের বেশি মনস্ক, পরিণত এবং মূল্যবান। ধারে এবং ভারে খাপ খোলা তরবারি। কিছুদিন বাদে আবার নতুন কলেবরে নতুন সাজে বেরোয় আমার পূর্বপরিচিত গণেশ দের তরুণ প্রেস থেকে। সে এক মহা হুল্লোড়ই বটে।
শক্তিদাকে নিয়ে এত গল্প আছে এত স্মৃতি আছে সব লিখে শেষ করা বেশ দুরূহ কাজ। প্রথম যখন কফি হাউসে পা রাখি তখন পর্যন্ত মোটামুটি নারীবর্জিত নাটকেরই চরিত্র ছিলাম আমরা। ব্যক্তিগতভাবে কারুর সম্পর্কিত কেউ থাকলেও তাদের কখনো টেবিলে এসে বসতে দেখা যেত না। অবশ্য এরই মধ্যে আমি যে আমি, আমার সঙ্গেও অনেকের চেনাজানা হতে লাগল। সেসব এখানে নয়, আমি ঢাকায় থাকতেই শক্তিদার উপন্যাস কুয়োতলা পড়েছিলাম। এবং পরে এর ভাষা আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে যথারীতি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাষাটাকে আদ্যন্ত আঞ্চলিক ভাষাই মনে হয়েছিল, তবে তা যে দখনে, মানে সুন্দরবন অঞ্চলের যে সেটা জানতাম না। তবে তার বর্ণনা যে একজন প্রকৃত কবি ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। শক্তিদা বলে বেড়াতেন, অবশ্যই তাঁর অনুরাগিনীদের কাছে যে, বেলাল তো কুয়োতলা পড়েই ঘর ছেড়েছিল। শক্তিদার কথা এতো বিশদ করে বলার কারণ নিঃসন্দেহে এত বড় কবি কিন্তু মদ্যসঙ্গীর ব্যাপারে ছিলেন নির্বিচারী এবং নির্মম ও স্বেচ্ছাচারী। প্রথমদিকে প্রায় রোজই আমরা গোটা কলকাতা বলতে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম চষে বেড়াতে গিয়ে কত না প্রাণসংশয়ী ঠেকে নিজেদের সঁপে দিয়েছি। সে হাওড়ার নেবুলালের চুল্লুর ঠেক থেকে গড়িয়ার পুষ্পবালা, হাজরার যক, শ্যামবাজারের কার্তিক, কালীঘাটের ভবতারিণী, গাঁজা পার্কের আশেপাশে সর্দারজি-ড্রাইভারদের আখড়া, কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পেছনের বস্তিতে আইয়ুবের কার্বাইড-মেশানো চুল্লু, ছাতাওয়ালা গলির পার্শি মালিক সোরাবজির বিশুদ্ধ দিশিমদের দোকান, বালমুকুন্দ মক্কর লেনের কালোয়ার পট্টি, হিন্দি কবি সিদ্ধেশের সঙ্গে স্ট্র্যান্ড রোডে গঙ্গার পারে অনেকটা ঘূর্ণায়মান বাংলুমদের দোকানের দ্বিতলে বসে খেতে-খেতে যেখান থেকে সূর্য ডোবার খুনোখুনি আর হাওড়া রেলস্টেশনের অশেষ চাঞ্চল্য দৃষ্টিগোচর হতো। এছাড়াও ব্রহ্মপুর, বাঁশদ্রোণী, কুদঘাটা, বেহালা, মধ্য কলকাতার চিনে হেডমাস্টারের বাসাবাড়ি, ওয়েস্টন স্ট্রিটের হিজড়ে ক্যাবারে, কমবেশি চার-পাঁচটা খুনের আসামি পোড়াকাঠ কমলা আর সাক্ষাৎ যম সোনার দাঁতঅলা বশির মিয়া – যাদের এক চিলতে বারান্দায় মদ্যপানের আর পাটনাই রামছাগলের সঙ্গে তরল আগুন গলাধঃকরণ, সাধু খাঁদের তেলকলের পিছনের উড়েদের ডেরায় এক ধরনের প্রাণঘাতী মাদক, তারই কাছাকাছি এক কানাগলিতে ব্যাটারি পচানো এনটি যা খেলে দুচোখই নষ্ট হয়ে যেতে পারে, শ্রীমানি মার্কেটের রকে সিনেমাটোগ্রাফার বারীণ সাহার সঙ্গে লেড়ে বিস্কুট সহযোগে  রাম, মানিকতলা বাজারের মেছোহাটার দেবেন্দ্রর সঙ্গ ছাড়াও আরও কত-কত জায়গায় যে গেছি তার ফিরিস্তি দিতে গেলে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির সম্ভাবনা আছে বলে বিরত থাকাই মঙ্গল।
শ্যামবাজারের অদূরে গ্যালিফের কাছাকাছি ভবনাথ সেন স্ট্রিটের এক ঠেকে এক রাতে স্পিরিট মেশানো বিষাক্ত মদ খেয়ে একশো এগারোজনের প্রাণহানি ঘটেছিল। প্রতিভা বসু বলেছিলেন পরদিন আনন্দবাজারে মৃতদের তালিকায় চেনা কেউ আছে কিনা খুঁজছিলাম তন্নতন্ন করে। বিশুদ্ধ বাঙাল ভাষায় তিনি বলতেন, ‘যা দস্যি পোলাপান এগুলান।’
এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়। কৃত্তিবাস কাণ্ডারিদের অনেকেরই গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ এবং প্রবাসী হয়ে যাওয়াটাও ছিল অনিয়মিত হয়ে পড়ার একটা প্রধান কারণ।
সে সময় আমি যদি আর একটু যতœবান হতে পারতাম তাহলে তিন ফর্মার মতো ছাপা হওয়ার পর পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত চমৎকার প্রচ্ছদ সংবলিত সংখ্যাটি ঠিক বেরিয়ে যেত। কেন যে আর বের করা গেল না বোঝা যাচ্ছে না। সর্বোপরি সুনীলদার কাছ থেকে কাগজের নাম  বাবদ ৮০ টাকাও নেওয়ার পরও।
আর একটা ব্যাপার যদ্দুর মনে পড়ে সেই সময় ক্লদ লেভি স্ট্রস নামে একজন ফরাসি লেখক দার্শনিক আমার বাউন্ডুলেপনার ওপর একটা প্রভাব ফেলার কারণেই কিনা জানি না সাময়িকভাবে আমার সমস্তয় উৎসাহ-উদ্দীপনা কিছুদিনের জন্য উবে গিয়েছিল।
এছাড়া গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে হুজুগ তখন শ্রেণিশত্র“ খতম করার। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ স্লোগান তুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তরুণ বয়সীদের। নেপথ্যে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন চারু মজুমদারের মতো কিছু রক্তলাল জ্ঞানাঞ্জনশলাকারা। তা নেতাদের নেতৃত্বে যত ভুলচুক এবং যত উদ্ভ্রান্তি থাকুক না কেন সে সময় এই আন্দোলনের সঙ্গে যারাই যুক্ত হয়েছিল তাদের অধিকাংশেরই চোখে ছিল নিখাদ দেশপ্রেমের মায়াঅঞ্জন, তরুণ বয়েসিদের জঙ্গি উদ্দীপনা আর সমাজবদলের স্বপ্ন।
প্রথম দেখাতে একবারও যাদের অচেনা মনে হয়নি তাদের নামই আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে কৃত্তিবাস অধ্যায় নিয়ে বলতে গেলে অনেক প্রসঙ্গই এসে যায়। আলাদা করে বলাও সম্ভব নয় এতো ঘটনার ঘনঘটা, এতো এতো মানুষের আনাগোনা।
ভাসমান জীবন হলে যা হয়।
শক্তিদাও শেষমেশ মাঝরাতে ফুটপাত বদল করতে করতে উদ্বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলেন মীনাক্ষী বিশ্বাসের সঙ্গে। ওঁরা শিলচরের রুচিরা শ্যাম, কৃষ্ণা আর প্রণতি এই চারবন্ধু মিলে বের করেছিলেন সখী সংবাদ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন।
এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল শঙ্কর দে বলে এক তরুণ কবির সঙ্গে। চিৎপুর ফায়ার এলার্ম নামে একটা কবিতার বইও বের হয়েছিল তার। তারপর একসময় কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমরা ভার নেওয়ার আগেই কৃত্তিবাস পুরস্কার প্রবর্তনা হয়। প্রথম বছর দেওয়া হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমে শামসের আনোয়ারকে।
পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল আমাদের শিল্পীবন্ধু অকালপ্রয়াত নিখিল বিশ্বাসের একটি অত্যন্ত মূল্যবান চিত্রকর্ম, যেটি বিক্রি করে পরে শামসেরকেই দাফন করা হয়েছিল। পরের বছর শিলচরের কবি শান্তনু ঘোষকে। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম দেবারতি মিত্রের নাম। তবে আমাদের ঘোষিত সে পুরস্কার প্রদান কিন্তু আর সম্ভব হয়নি।
এই তো হয়! তরুণ বয়সের উৎসাহ-উদ্দীপনায় একদিন ভাটা পড়তে বাধ্য। সে নিয়ম কিন্তু কৃত্তিবাসের বেলা খাটেনি চিরসবুজ ও বন্ধুবৎসল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এক মহাবনস্পতির কল্যাণে। অবশ্য সঙ্গে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পল্লবিনী লতেব স্ত্রীরতœ এবং কেবল অমিতাক্ষর কাব্যই নয়, কথায় কথায় ব্ল্যাঙ্ক চেক কাটার মতো বন্ধুভাগ্যও থাকতে হয়। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে কৃত্তিবাস অজর, অমর এবং জন্মান্তরবাদী হলেও কিছু বলার থাকে না।
এরপরের ইতিহাস, আমার নিজেরটা আমি বলতে পারি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – ‘তুই রে বসন্তসমীরণ।/ তোর নহে সুখের জীবন।’ আবার যে-জীবনকে বিদায় দিয়ে এসেছিলাম সে যে ফিরে ফিরে আসে আবার কবির ভাষায় আশ্রয় নিয়ে বলতে হয় – ‘বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেম বারে বারে।/ ভেবেছিলেম ফিরব না রে ॥’/ এই তো আবার নবীন বেশে/ এলেম তোমার হৃদয়দ্বারে।’
সুতরাং জীবন তার নিজের নিয়মে দেশকালপাত্রভেদে প্রবাহিত হতে থাকলেও হাজার কাঁটাতারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আত্মিক বন্ধন কি আর সহজে বিচ্যুত হয়?
যাদের ছেড়ে এসেছি তাদের মধ্যে কারুর না কারুর সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে যোগাযোগ অবিছিন্ন থেকেই গিয়েছিল। নাম করে বলতে গেলে অনেকের কথাই বলতে হয়। এখানে পরিমিত পরিসরে সেটা সম্ভব নয়।
অন্যদের কথা বাদ দিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই বিশেষ করে বলতে হয়। অবশ্য তাদের মধ্যে শক্তি ঢের আগেই বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আর অতি সম্প্রতি চলে গেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যার সঙ্গে বাংলাদেশের খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী থেকে কবি, লেখক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী অনেকের সঙ্গেই প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সুনীল ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশবান্ধব। কোনো রাখঢাক না রেখে তিনিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন, বাংলা ভাষা চর্চা, লেখালেখি অর্থাৎ সার্বিকভাবে বাংলাদেশই হবে বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি আনিসুজ্জামান, ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা,  হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন,  রফিক আজাদ. রবিউল হুসাইন, শামা রহমান, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, শেখ হাসিনা, মাহমুদুল হক, ড. মুহাম্মদ সামাদ, তারিক সুজাত, অদিতি মহসিন, সন্জীদা খাতুন, লাইসা আহমেদ লিসাসহ আরো অনেকানেক তরুণের গুণগ্রাহী ভক্ত ছিলেন।  এই বাংলাদেশবান্ধব যিনি পরিচিতজনদের  সর্বদাই কুশল কামনা করতেন, তিনি এখন আর নেই কথাটা বিশ্বাসই হতে চায় না। শিরোনামের পঙ্ক্তিটির বাকি অংশ, ‘আমি ক্ষুদ্র অশ্র“বিন্দু – তোমার শীতল অতলে ফেলো গো গ্রাসী,/ সব নীরব শান্তিরাশি -/ তারপরে শুধু বিস্মৃতি আর ক্ষমা/ সুধাবো না আর কখন আসিবে অমা, – কখন গগনে উঠিবে পূর্ণ ইন্দু।…’