খায়রুল আনাম শাকিল
‘তোমার গানের মধ্যে বেণুর গানের প্রভাব আছে বোঝা যায়। এটা স্বাভাবিক আমরাও জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কাউকে না কাউকে অনুকরণ এবং অনুসরণ করেছি। তুমি একটা কথা মনে রাখবে। তুমি ধীরে ধীরে নিজের মতন করে নিজের গায়কী দিয়ে গাইবার চেষ্টা করবে। তোমার কণ্ঠ ভালো তবে সেটাই যথেষ্ট নয়। চর্চা করবে আর নিজস্ব ভঙ্গিতে গাইবার চেষ্টা করবে।’
ছায়ানটের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড আনতে গিয়ে দেখি সোহরাবভাই শিক্ষকদের নির্ধারিত চেয়ারে বসা। আমাকে ইঙ্গিতে ডাকলেন। কাঁধে হাত রেখে বারান্দার এক কোনায় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হয়েছে পরীক্ষা, তারপর আমার সংগীত জীবনের এ মহামূল্যবান উপদেশ দিলেন, যা আমার চলার পাথেয়।
মাহমুদুর রহমান বেণু আমার অন্যতম গুরু এবং মামা, যাঁর হাত ধরে আমার সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ছায়ানটে ষাটের দশকের শেষদিকে (১৯৬৮-৬৯) আমি যুক্ত হই একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থী হিসেবে। আমার বেণুমামা তাঁর পরিবারের সব ছেলেমেয়েকে ছায়ানটমুখী করবেন বলে যেন পণ করেছিলেন – এবং সে-থেকেই সম্ভবত আমাদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য জোর করেছিলেন। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়েই
তখন ছায়ানট স্থানান্তরিত হয়েছিল। আমার স্মৃতিতে অগ্রণী বিদ্যালয় কেবলমাত্র একটি লম্বা বারান্দা আর একটা বড় মাঠের মাঝখানে বড় একটি কামরা, যেখানে জাহেদুর রহিম ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’ আর আরো একজন ওস্তাদ, যার নাম মনে নেই, শেখাতেন, ‘তু আব ইয়াদ কারোরে বন্দি আপনি আল্লাহ কো’ (শাস্ত্রীয় ভৈরব রাগের বন্দিশ)।
আমার তখন যে-বয়স, সে-বয়সে শিক্ষক যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝার ক্ষমতা জন্মায়নি।
কেবল ক্লাসে যাওয়া, খাতায় গান লেখা আর তোতা পাখির মতো শিক্ষককে অনুকরণ করা। সে-সময়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম আর শুনতাম সোহরাবভাইয়ের দক্ষ হারমোনিয়াম-বাদন। শিখতাম তাঁর ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, জাহিদভাইয়ের শেখানো ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’, সন্জীদা আপার শেখানো ‘হারে রেরে রেরে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে’। সোহরাবভাইয়ের সে-বয়সে কণ্ঠ ছিল চমৎকার সুরেলা আর নজরুল-উপযোগী মুড়কিতে সমৃদ্ধ। ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গানে ‘মায়ের কোলে’ অংশটি কয়েকবার দেখাতেন। একটা ছোট্ট মুড়কি বা অলঙ্কার ছিল এ-জায়গাটিতে। কণ্ঠে যেমন সুন্দর দেখাতেন, হারমোনিয়ামেও তেমনি। দক্ষ অঙ্গুলিচালনার কারণে মুড়কির কাজটি বেশ ফুটে উঠত।
সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে সে-সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসহযোগ আন্দোলন, ভয়াবহ ২৫ মার্চের কালরাত, সবমিলিয়ে একটা ছেদ পড়েছিল ছায়ানটের সঙ্গে। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর তার ফলে স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশ।
যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ ছায়ানটের কার্যক্রম আবার শুরু হলো। প্রথমে অস্থায়ীভাবে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাড়ি ‘বাস্তুকলাবিদে’ আর তার কিছুদিন পর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। নতুন করে আমি আবার ভর্তি হলাম ছায়ানটে। ধীরে-ধীরে উঁচু ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয় বর্ষে এসে শিক্ষক হিসেবে পেলাম সোহরাবভাইকে। এই সোহরাবভাই ছায়ানটের জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। শুনেছি, প্রথমদিকে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে এই বিদ্যায়তনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তাঁকে দেখেছি একভাবে। স্বাভাবিক কারণেই মনে কিছুটা সঙ্কোচ, ভয়ভীতি কাজ করছিল। সোহরাবভাই হারমোনিয়ামে হাত রাখতেই আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সেই হারমোনিয়াম-বাদন, সদাহাস্যময় সেই মুখ অতি আপন করে নিল ক্লাসের সকলকে। প্রথমেই একটি বর্ষার গান, ‘রিমঝিম রিমঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে’ লিখিয়ে দিলেন আর বললেন, ‘নজরুলের গানের একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে। তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুনবে আর ভালো করে মুড়কির কাজ আর অলঙ্কারগুলো কণ্ঠে ধারণ করার চেষ্টা করবে। প্রতিটি শব্দ যেন স্পষ্ট থাকে। ঠিকমতো গানের লয় বুঝে নিয়ে গান করবে।’ এভাবেই তার ক্লাস চলতে থাকল। হঠাৎ-হঠাৎ ক্লাসে কাউকে-কাউকে গান ধরতেন। ভালোমন্দ বুঝিয়ে দিতেন।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা বেতারের অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়ল। একধরনের অস্বাভাবিক শিল্পীশূন্যতা দেখা দিলো। দেশভাগ এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক নিজের ভিটাবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। সোহরাবভাইও এ-সময় ভারত থেকে চাকরির option হিসেবে পাকিস্তানকে বেছে নিলেন এবং ঢাকায় চলে এলেন। চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বেতারে শিল্পী হিসেবে যুক্ত হলেন। ঢাকা বেতারে এ-সময় সোহরাবভাইসহ অন্য অল্পসংখ্যক কণ্ঠ ও যন্ত্রশিল্পী অক্লান্ত পরিশ্রম করে রেডিওর কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখেন। সে-সময় এমন পরিস্থিতি ছিল যে, একই শিল্পীকে সকাল-বিকেল একের অধিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতে হতো। সোহরাবভাই আধুনিক লোকসংগীত, নজরুলসংগীত, সব ধরনের গানেই পারদর্শী ছিলেন। বাংলা আধুনিক গানে সুর করেছেন এবং চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গাওয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক গান সে-সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এ-সময়ে বাংলা গান প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য যাঁদের নাম বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে অপরিমোচনীয় অক্ষরে লেখা থাকবে, সোহরাবভাই অবশ্যই তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
ষাটের দশকে এসে সোহরাবভাই প্রায় সম্পূর্ণভাবেই নজরুলের গানে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর সকল ধ্যানপ্রাণ হয়ে উঠলেন নজরুল। পুরুষকণ্ঠে তাঁর আর জুড়ি ছিল না। একদিকে মুসলমান গায়িকা ফিরোজা বেগম দাপটে নজরুলের গান গাইছেন আর পাশাপাশি সোহরাব হোসেনের নাম সর্বস্তরের সংগীতপ্রেমীদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। সোহরাব হোসেন একজন অতিপরিচিত নাম হয়ে উঠলেন, লোকে তাঁকে আজ একনামে চেনে।
সোহরাবভাই নজরুলের গান যা গাইতেন তা আদি রেকর্ড অনুসরণ করে গাইতেন। নজরুলের গান সত্তরের দশকের পর এক প্রকার অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। যে যেমন খুশি গাইছে। বাণী বদলে দিচ্ছে, সুর বদলে দিচ্ছে। গাওয়ার ভঙ্গিতেও অতি-আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করল।
নজরুলের গানের যে বিশেষ গায়নভঙ্গি আছে, সেটা যেন প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পী ভুলতে বসলেন।
বাংলাদেশে নজরুল একাডেমী আদি রেকর্ড থেকে স্বরলিপিকরণের কাজ শুরু করল।
পরবর্তীকালে সে-কাজ নজরুল ইনস্টিটিউট হাতে নেওয়ার ফলে আরো বিস্তৃতি লাভ করে। সোহরাবভাই স্বরলিপি সত্তায়ন বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হলেন। আরো যারা সদস্য হলেন, তাঁদের মধ্যে সুধীন দাস, ফেরদৌসী রহমান, ফিরোজা বেগম অন্যতম। কিছুকালের মধ্যে নজরুল ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণশালার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানেও অন্যান্যের পাশাপাশি জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক হিসেবে সোহরাবভাই যোগ দেন। সংগীত শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি তার সংগীতজীবনের নানান অভিজ্ঞতার কথা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিনিময় করতেন। একজন শিল্পী নিজেকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করেন, এই অমূল্য শিক্ষাটি গ্রহণ করার সৌভাগ্য শিক্ষার্থীদের হয়েছিল। সোহরাবভাই তাঁর জীবনে কতটা কষ্ট স্বীকার করে সংগীতশিক্ষা লাভ করেছিলেন সে-কথা বারবার বলতেন। বলতেন, বিশালমাপের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে তিনি সংগীতের নানা দিক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কীভাবে একজন শিল্পী নিজেকে উপস্থাপন করবেন, কীভাবে মাইক্রোফোন ব্যবহার করবেন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি সব সময় তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-কথাটি তিনি বলতেন তা হলো, নজরুলকে আরো ভালোভাবে চেনার চেষ্টা করো, তাঁর জীবনদর্শন বোঝার চেষ্টা করো। নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্ম পুরোপুরি গুছিয়ে যেতে পারেননি আর তাই তাঁর অনেক সৃষ্টিকর্মের ওপর যথেচ্ছাচার হয়েছে। তিনি বলতেন, এই গোছানোর দায়িত্ব তোমার, আমার এবং নজরুলপ্রেমী সকলের।
তিনি ছায়ানটের সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমৃত্যু এ- সংশ্লিষ্টতা বজায় ছিল। ছায়ানটে অগণিত ছাত্রছাত্রীকে গান শিখিয়েছেন তিনি পরম মমতায়। তাঁরা সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে সংগীতে দীক্ষা পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর জীবনের উপান্তে ছায়ানটও তাঁকে সম্মানিত করেছে সংগীতগুরু হিসেবে।
সোহরাবভাই ছিলেন চিরতারুণ্যের প্রতীক। গায়নে, ব্যক্তিগত আচরণে, েস্নহ-মমতায় ভরা এক সত্যিকার শিল্পীর প্রতিকৃতি।
সংগীতের প্রতি ছিলেন পুরোপুরি নিবেদিত। সাধনা করে গেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে – কী পেলেন বা কী হারালেন, এসব তাঁকে তাড়িত করত না।
তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। রেখে গেলেন সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার দীক্ষা। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। শুদ্ধ সংগীতশিল্পী হওয়ার যে-শিক্ষা তিনি দিয়ে গেলেন, এবং সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার যে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ রেখে গেলেন, তা যদি আমাদের মাঝে ধারণ করতে পারি তাহলেই এই সংগীতগুরুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
আমরা সচেষ্ট থাকব তার শিক্ষাদান অন্তরে ধারণ করতে। আমরা সে-শিক্ষা ছড়িয়ে দেব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আমাদের কর্মের মধ্যেই তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.