নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

॥ ২৩ ॥

আধকোশার জল বড় শীতল মনে হয় বালক মুকুলের, চোখেমুখে সে জলের ঝাপট মারে, তারপর আঁজলা ভরে পান করে, তার ভেতরটাও শীতল হয়ে যায়। ভোরে জলখাবার তার জোটে নাই, মা আজ হেঁসেলে প্রবেশ করে নাই; আধকোশার জল তাকে ক্ষুধার মুখে তৃপ্তি দেয়, সে উদ্গার তোলে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে মইনুল হোসেন মোক্তার নদীর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে; রোজার মুখে তার ওই বালকের জলপান শিহর তোলে, তৃষ্ণা গজগজ করে ওঠে। – শালার শালা, কী হইবে মোর রোজ ারাখিয়া? কীসের আশায় রোজা? পরকালে বেহেশতে হামাক শরাবন  তহুরা পান করাইবে, তারে ঝইন্যে এই নিদয়া খরকালে খাদ্য পানি উপাস? পুটকি মারো মুই রমজানের!
আহা, আমরা মইনুল হোসেনের মনে ধর্মকর্মের এতবড় বিনাশ দেখে, খিস্তি শুনে, যেন চঞ্চল না হই। আমরা তার উষ্মার কারণটা বুঝতে চেষ্টা করি। এই নদী, এই আধকোশা, পাগলা পাহাড়ি এই নদী, ভরা বর্ষায় কলকল খলখল করে দুপাড় ভেঙে চলে ফি-বছর; ধপাস ধস পড়তে থাকে পাড় ভেঙে, ভাঙতে ভাঙতে জলেশ্বরী টাউনের বারো আনাই তো গেছে আধকোশার গর্ভে, দু-দুবার মইনুল হোসেনের বাড়ি গিলেছে আধকোশা; এখন তো সে নিরাশ্রয়, বন্ধু দেবদত্ত মোক্তার যদি না তাকে আশ্রয় দিত, তবে তো তাকে টাউনই ছাড়তে হতো। ছাড়ে নাই সে, কারণ তার মনে এক আতঙ্ক কাজ করে Ñ আধকোশা নদী বছর-বছর যে করাল মূর্তি ধরে, মাটি যেভাবে গিলে খায়, নদীর সেই খাওয়াও যদি বিরাম না আসে, বাধা যদি না দেওয়া যায়, তবে হয়তো একদিন বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজারটাই ভাঙনের মুখে পড়ে যাবে। আর মাজার যদি নদীগর্ভে চলে যায়, তবে আর আশা কী!  শহরটি উৎসন্ন হয়ে যাবে, বসত উঠে যাবে, মানুষেরা অন্যত্র ঘর তুলবে, জনপদ বসাবে, আর তখন বিরান এই শহর থেকে চলে যাবে কুতুবেরা Ñ শহরের সেই প্রহরীসকল, সেই যারা গভীর নিশীথে পথে বেরোয়, ভাগ্যবান নামাজিরাই কেবল যাদের দেখতে পায়, আর বাকি সকলের কাছে যারা শ্র“তকথা মাত্র।
তাই মইনুল হোসেন মোক্তার দেবদত্তর পরামর্শ সত্ত্বেও নতুন ভিটা রচনার জন্যে উন্মুখ হয় নাই; তার নিজের নতুন আশ্রয় রচনার চেয়ে অধিক হয়ে ওঠে আধকোশার হাত থেকে শহর রক্ষার চিন্তা। মইনুল হোসেন মোক্তার লাইব্রেরিতে দীর্ঘ বক্তৃতা করে। Ñ বাঁধ! বাঁধ দিবার দরকার! নদীকে শাসন করিবার দরকার! শোনেন নাই, প্রকৃতির ওপর বিজয় করিয়াই মানুষ এতদূর আসিয়াছে? ইতিহাসে দেখা যায় সেই জাতিই উন্নতির ধাপে পা রাইখছে ঝেই জাতি প্রকৃতির কাছে হার মানে নাই, বরং প্রকৃতিকে বশ করিয়াছে। এলায় হামার দরকার এক জোট হয়া আধকোশা নদীতে বাঁধ দিয়া উয়ার গতি স্তব্ধ করিয়া শহর রক্ষা করা। বাবা কুতুবুদ্দিনের নিজের শহর জলেশ্বরী। কোন ইরান তুরান আরব মুলুক হতে বাবা আসিলেন এই তল্লাটে, আসিয়া তাঁই হুজুরার পত্তন করিলেন, হেথায় গোক্ষুর সর্পের রাজত্ব, সেই সর্পকে বশ করিলেন, বলিলেন কি, বাবারা দূর পাহাড়ে যাও, হেথায় মানুষের জাগা মানুষের হাতে ছাড়ি দেও। মনে নাই? বাবা আসিলেন বলিয়া হেথা হতে কলেরা দূর হইলো! খরার জমিতে সোনার ফসল হইতে লাগিলো! দূরদূরান্ত হতে মানুষেরা আসিয়া গঞ্জহাট রাজ্যপাট গড়ি তুলিলো। আলো জ্বলিলো। আর তারে ঝইন্যে শহরের হিন্দু-মোছলমান বাবাকে আইজো শিন্নি দেয়, আইজো তাই তাঁর বরষীকালে ওরছ মোবারকে হিন্দু-মোছলমান যোগ দেয়। পাকিস্তানের আন্দোলনে মোছলমান যোগ দেয় জিন্নার দলে, ভারত স্বাধীনের আন্দোলনে গান্ধীর ডাকে হিন্দু হয় আরেক জোট, দুই দলে ভাগ করিতে চায় জিন্না আর গান্ধী, কিন্তু বাবা কুতুবুদ্দিনের কারণে ভাই ভাই এক ঠাঁই। আসেন তবে এই জুটি না ভাঙি হামরা। আসেন তবে এক জোটে এক কাতারে খাড়া হয়া আধকোশাকে বাঁধ দিয়া বান্ধিয়া জলেশ্বরী রক্ষা করি।
হাঁ, আমরা দেখতে পাই মইনুল হোসেনের বক্তৃতায় জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হয়, শহররক্ষা কমিটি গঠিত হয় সেইদিনই; রাত জেগে দীর্ঘ এক আবেদনপত্র রচনা করে মইনুল; পরদিন সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে শহরের উকিল মোক্তার মাস্টার আর বাজারের বড় বড় মার্চেন্ট; কেবল মাড়োয়ারিদের স্বাক্ষর পাওয়া যায় না। মাড়োয়ারিরা এলাকার পাটের মহাজন একচেটিয়া; সুদূর রাজপুতানা থেকে তারা এদেশে এসেছে পাটের টানে; বড় বড় গুদাম তাদের; গুদামের সমুখে পাট ওজনের বিপুল মাপের পাল্লা; গরুর গাড়ি করে চাষিরা পাট আনে, গরিবেরা মাথায় করে, ওজন হয়, গুদামজাত হয়, তারপর একদিন সমুদয় পাট যায় রেল ইস্টিশানে, সেখানে বিশাল মেশিন, সেই মেশিনে পাটের গোছা তুলে চাপ দিয়ে চৌকা টাইট গাঁট বাঁধা হয়, সেই গাঁট তোলা হয় মালগাড়িতে, সেই মালগাড়ি জোতা হয় প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সাথে, কলকাতার দিকে রওনা হয়। মাড়োয়ারিদের কথা হচ্ছে জলেশ্বরী শহর যদি ভাঙনে শেষ হয়ে যায়, তাই বলে তো পাটের চাষ এলাকা থেকে উঠে যাবে না! চাষ হতেই থাকবে! জলেশ্বরী না থাকে তো বুড়িরচর আছে, রাজারহাট আছে, নবগ্রাম আছে, সেখানে তারা নতুন আস্তানা গাড়বে। না, নদীর বাঁধ নিয়ে তাদের হুজ্জতে যাবার দরকার নাই।
মইনুল হোসেন মোক্তার বলে, তারা বিদাশী, নিদয়া নির্মম তারা গরিব চাষীকে ঠকায়া দৌলত গড়িবে এই ধ্যানে আছে। বাঙালিকে শোষণ করিয়া দ্যাশে মহল গড়িবে, এই তাদের নীতি। তারা হামার সাথে আসিবে কেনে? তারা হাগিয়া শুচিবার ঝইন্যে পানি ইস্তক হেথায় খরচ করে না!  দ্যাখেন নাই, মাড়োয়ারির দল ভোরসকালে ছোট্ট একখান করিয়া লোটা হাতে দলে দলে জঙ্গলের দিকে যায় হাগিতে। অ্যাতো ছোট লোটা যে উয়াতে কাকের তিয়াস পরযন্ত মিটিবার নয়, উয়াতেই তারা পুটকি শোধন করে। এমন জলজ্যান্ত একটা উদাহরণের উল্লেখে হেসে ওঠে সবাই। দেবদত্ত মোক্তার বলে, আরে, টাউন হামার, নদী হামার, নদী হতে টাউন রক্ষা করিবার দায়িত্বও হামার। তুমি আগাও ভাই, হামরা তোমার পাছে পাছে আছি। – না, পাছে থাকিলে চলিবে ক্যান? সাথে থাকিবে। সকলকে সাথে নিয়াই আইজের দিনে এতবড় একটা কাজ করিবার, আধকোশাকে বাঁধ দিবার, গরমেন্টকে বলিবার যে কলিকাতায় বসি আছেন! অ্যালায় হামার দিকে নজর দ্যান!
হাঁ, কলিকাতা! কলকাতা! কইলকাত্তা! ইংরেজ লাটসাহেব লর্ড কেসি তখন বাংলার গভর্নর। মইনুল হোসেন মোক্তার ঘোষণা করে, দরকার পড়িলে লাটসাহেবের দরবারে যাওয়া চাই। জলেশ্বরীর হাকিম আর রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট তো সাগরের চ্যাং মাছ, পুঁটি মাছ, তাদের কাছে অনুনয়-বিনয় করিয়া লাভ নাই। মুসলিম লীগের নজির হোসেন পরামর্শ দেয়, এলা জিন্নার কথায় ইংরাজ ওঠে বসে, তারে কাছে ধন্না দিলে হয়! কথা আছে, জিন্না সাহেব সিরাজগঞ্জে আসিবে জনসভা করিতে, আধকোশা বাঁধ দিবার পিটিশনখান তারে কাছে পেশ করা ভালো। জিন্নার উল্লেখে জলেশ্বরীর কংগ্রেস নেতা শ্রী রাজেন্দ্রলাল চক্রবর্তী ঘনঘন মাথা নেড়ে ওঠে। – আমার কথা, আমার আপত্তি, মইনুল মোক্তার যে কইলে জিন্নার কথায় ইংরাজ ওঠে-বসে, সত্য নয়! জোর যদি কারো থাকে তবে ইন্ডিয়ায় অ্যালা মহাত্মা গান্ধী মহারাজের! হয় কি নয়? রাজেনবাবুর এ-কথায় হিন্দু উকিল-মোক্তারেরা মাথা নেড়ে সায় দেয়, অচিরে তারা সরব হয়ে ওঠে, তুমুল একটা গোলযোগ শুরু হয়ে যায়। মইনুল হোসেন মোক্তার হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করে হিমশিম খায়, শেষে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, নদীর ভাঙন আর হিন্দু-মোছলমানের ভাঙন একে কথা! জিন্না গান্ধী ভুলি যান, জলেশ্বরী হিন্দু মোছলমানের, আধকোশার ভাঙনে কেবল হিন্দুর বাড়ি নদীর গর্ভে যায় এমন তো নয়! মোছলমানের বাড়িই কেবল বাছিয়া বাছিয়া আধকোশা গ্রাস করে, তাও তো নয়। বিনাশ হামার সকলের। বিনাশের বিরুদ্ধে হিন্দু-মোছলমান একজোট না থাকিলে নদী কাউকে ছাড়ান দিবার নয়। গান্ধী রাখেন, জিন্না রাখেন, দ্যাশে এলাও ইংরাজ আছে আর ইংরাজেরই শাসন চলিচ্ছে। বাংলার ইংরাজ লাট, তারে কাছে পিটিশন! আর কারো কাছে নয়। আর, পাকিস্তান হইবে কি হইবে না, এলাও তার নিশ্চয় নাই। ইংরাজও দ্যাশ ছাড়ি যাইবে তারও কোনো সংবাদ এলাও নাই। যুদ্ধ ক্যাবল শ্যাষ হইছে। জাপান সারেন্ডার কইরছে। ইংরাজের কোমরের জোর দুনিয়া দেইখছে। লর্ড কেসি জলেশ্বরী আসিচ্ছে সামনের মাসে। তার কাছে পিটিশন দেওয়াই এলা হামার উচিত মনে হয়। আমরা দেখতে পাই, এই সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয় যে, আধকোশা নদীতে বাঁধ দিয়ে জলেশ্বরীকে রক্ষা করবার আকুল আবেদন বাংলার লাট লর্ড কেসির কাছেই করা হবে।
শহরে সাজ-সাজ পড়ে যায়। না, পিটিশন দেওয়ার জন্যে আপাতত নয়, লর্ড কেসিকে স্বাগত জানানোর জন্যে। মহকুমা হাকিম নেয়ামতউল্লাহ শহরের গণ্যমান্যদের নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং করতে থাকেন। একমুহূর্ত সময় তাঁর নাই। জানা যায়, তিনি যে ট্রেনে আসবেন সেটি ডাকবাংলোর কাছে এসে থামবে, ডাকবাংলোতেই তিনি আলাপ-আলোচনা শেষে আবার ট্রেনে গিয়ে উঠবেন। মাত্র দু-ঘণ্টার জন্যে তিনি আসছেন, এর মধ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে, আর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের তিনি দর্শন দেবেন, আর মাড়োয়ারি ও অন্যান্য মার্চেন্টের সঙ্গেও তাঁর কথা হবে। কে কার আগে লাটসাহেবের কাছে পেশ হবে, কে তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবে, এ নিয়ে ধুন্দুমার লেগে যায়। হাকিম সাহেবকে রাজেনবাবু বলে, জানেন নিশ্চয় কংগ্রেস ইন্ডিয়ার সবার হতে বড় দল, হিন্দু মোছলমানের মিলিত দল, অতএব কংগ্রেসের তরফ হতেই লাটসাহেবকে পরথম সম্মান জানানো উচিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁ-হাঁ করে ওঠে মুসলিম লীগের নজির হোসেন, এগুলা কোনো কথা নয়, কাঁই বড় কাঁই ছোটো, সামনে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ভোট, তখন বোঝা যাইবে, ইন্ডিয়ার কথা ছাড়েন, বেঙ্গলে যে মুসলিম লীগ মেজরিটি হইবে, বিপুল ভোটে পাশ হইবে, ইয়াতে কোনো ভুল নাই। রাজেনবাবুর মুখ লাল হয়ে যায় নজির হোসেনের এ-ভবিষ্যদ্বাণীতে। পাশ ফিরে সে বলে ওঠে, নজিরমিয়া ওকালতি ছাড়ি এলা গণককারী ধইরছে মনে হয়! – কী! কী কইলেন! – না কিছু নয়! – আলবত কিছু! মুই কানে শুনিলোম, সব্বায় শুনিলো, আমি উকিল নই আর, গণক! ইতিহাসের গতি লক্ষ করেন রাজেনবাবু! মোছলমানের হাত থেকে ইংরাজ দ্যাশ নিছে পলাশীতে, মোছলমানের হাতেই দ্যাশ আবার আসিবে!
এই বিবাদ বিতর্কে আধকোশা নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্যে লাটসাহেবের কাছে পিটিশন পেশ করার কথা কোথায় তলিয়ে যায়! মহকুমা হাকিমের সঙ্গে মিটিংয়ে মইনুল হোসেন মোক্তারের আসন সামনের সারিতে ছিল না; মোক্তার হিসেবে তার দাপটের পসার থাকলেও, কোনো রাজনৈতিক দলের মানুষ সে নয়, শহরের বড় ব্যবসায়ীও নয়, নিতান্তই এক মোক্তার। পেছনের সারিতে বসে কেবলই উসখুস করতে থাকে মইনুল। শেষ পর্যন্ত, লাটসাহেবের আগমনের ঠিক আগের দিনে সে মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ায়। – হাকিম সাহেব, আমার একখান কথা! লাটসাহেব কেন জলেশ্বরী আসিচ্ছেন, কোনবা জরুরি মিটিং তার, আপনি জানেন। তবে সবার চ্যায়া জরুরি আধকোশা! আধকোশার ভাঙন। বছর বছর ভাঙন। সেই ভাঙন রোধ করিবার কথাখানই আপনি ভুলি যাইচ্ছেন।
কিন্তু রাজেনবাবু আর নজিরমিয়ার তর্কাতর্কিতে মইনুল হোসেনের গলার স্বর তলিয়ে যায়। হাকিম নেয়ামতউল্লাহ চেঁচিয়ে বলেন, বসেন, বসেন, পিছন থেকে গোলমাল করবেন না। – হামার আধকোশা! হাকিম বিদ্রƒপ করে বলেন, আপনার আধকোশা! আপনার! – হয়, হয়, হামার! হামার আধকোশা! – আরে, আগে ফুলের মালা! রাজেনবাবুর জেদি গলা। – আর, হামার ঝাউ গাছের গেট, গেট কোনখানে হইবে! নজিরমিয়ার উচ্চকণ্ঠ। নজির হোসেন এরই মধ্যে আধকোশার পাড় থেকে ঝাউগাছের ডাল এনে ডাকবাংলোর মাঠ ভরে ফেলেছে; কেবল লাটসাহেবের ট্রেনটি ঠিক কোন জায়গায় এসে থামবে সেটা নির্ণয় করা যায় নাই বলেই গেট বাঁধার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। রাজেনবাবু পালটা গলা চড়িয়ে বলে, মাল্যদান পরথমে করিবে কংগ্রেস, হাকিমস্যার আপনি এই কথাটা আগে ঘোষণা করেন। – মালা! – গেট! – মালা! – গেট! – আগে কংগ্রেস, তারপরে গেট! – আগে হিন্দু না মোছলমান? হাকিম সায়েব, আপনি তো মোছলমান, আপনি বলেন মোছলমান আগে কিনা! কোরানের সাথে বেইমানি না করেন!
কোরানের কথা উঠে পড়ায় যতটা না, হাকিম নেয়ামতউল্লাহ মনে মনে ত্রস্ত হয়ে ওঠেন তিনি মুসলমান কিনা এই প্রশ্ন অকস্মাৎ উত্থাপিত হওয়ায়। নেয়ামতউল্লাহ নিজে জানেন তিনি মুসলমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, কোরান পড়েন, কিন্তু তিনি চার মজহাবের কোনোটাতেই নেই; তিনি কাদিয়ানি! এবং কাদিয়ানিরা আসলে মুসলমান কিনা এ নিয়ে বাংলা মুলুকে যতটা না তার অনেক অধিক পাঞ্জাব ও দিল্লি অঞ্চলে বাহাস আছে। এমনও বলা হয়, ভারতবর্ষে মুসলমানদের বিভক্ত করবার জন্যেই কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের জন্ম দেয় ইংরেজ। তারা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়াসাল্লামকে শেষ নবী না মেনে তাঁর পরে পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রামে জন্ম নেওয়া একজনকে নবী মানে। খাঁটি মুসলমানের কর্তব্য হয় এ-কথা শোনামাত্র নাউজুবিল্লাহ পড়া। কিন্তু অতটুকুতেই শান্ত নয় অনেক মুসলমান, এরা কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা তথা এদের খতম করার কথাও বলে; ফলে বেশ কয়েকবার দাঙ্গা-হত্যাও হতে থাকে। নেয়ামতউল্লাহ ঈষৎ নয় যথেষ্টই শংকিত হয়ে পড়েন Ñ জলেশ্বরীর মানুষ কি জানে তিনি কাদিয়ানি? দ্রুত হাত তুলে তিনি বলেন, থামুন আপনারা! আসছেন লাটসাহেব, তিনি রাজপ্রতিনিধি, রাজার চোখে হিন্দু-মুসলমান এক, আপনারা এ নিয়ে তর্ক তুলবেন না। আমি গেটের জায়গাও দেখিয়ে দিচ্ছি। আর ফুলের মালা নজির হোসেন সাহেব ও রাজেন্দ্রলালবাবু দুজনেই দেবেন। কে আগে দেবেন? হিন্দু মুসলমান বা কংগ্রেস মুসলিম লীগ বিচারে নয়, দুজনের মধ্যে যিনি বয়সে সিনিয়র, তিনিই আগে মালা পরাবেন লাটসাহেবকে। ব্যাস! এই পর্যন্ত! বলেই তিনি খাস কামরায় চলে যান দ্রুত পায়ে। সভা শেষ, কিন্তু শেষ হয় না, সভাপতি চলে যাওয়ার পর সভা লাগামছাড়া হয়ে পড়ে, হিন্দু মুসলমান নেতাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। ব্যাপার দেখে মইনুল হোসেন মনে মনে উভয়পক্ষকে পুটকি মারো বলে বাইরে বেরিয়ে যায়। এবং মনে মনেই সে বলতে বলতে কাছারির মাঠে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে, শালার শালা! শহরের চিন্তা কারো নাই। শহর থাকে কি না থাকে তারে ঠিক নাই, ইয়ার মইধ্যে লীগ আর কংগ্রেস! জিন্না শালা কি যে শল্লা দিছে মোছলমানের কানে, আর গান্ধীর নেংটিতে যে কোন জাদু হিন্দুরা দেইখছে, সব শালার শিক্ষা হইবে যেদিন আধকোশা আসি তামাম ধ্বসি নিয়া যাইবে!
তারপর সেই দিন আসে। বাংলার গভর্নর লর্ড কেসি সাহেবের ট্রেন এসে জলেশ্বরীর ডাকবাংলোর সমুখে থামে। ডাকবাংলোর পাশ দিয়েই ট্রেনের লাইন ইস্টিশান পর্যন্ত গেছে; আজ রোজকার প্যাসেঞ্জার ট্রেন বন্ধ, তিস্তায় অপেক্ষা করছে যাত্রী নিয়ে, লাটসাহেবের ট্রেন ফিরে যাওয়ার পর তবে সে ট্রেন আসবে। আর কী শোভা লাটসাহেবের ট্রেনের! অন্য সকল ট্রেন লাল রঙের, লাটসাহেবের ট্রেন শাদা রঙের। মাত্রই তিনটে বগি। ট্রেনের এঞ্জিনের মুখে বসানো ঝকঝকে রাজমুকুট, আসলে পেতলের তৈরি, জলেশ্বরীর মানুষের চোখে – সোনারই বুঝি! ভিড়ে ভিড়াক্কার ডাকবাংলোর চারদিক। পুলিশ তাদের ঠেকিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। পুলিশের পাশে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের ছেলেছোকরারাই সামাল দিচ্ছে ভিড়।
লাটসাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। মানুষেরা তাঁকে দেখে সম্ভ্রমে গুঞ্জন করে উঠবে কি বড় হতাশ হয় তারা। ছাইরঙা সাধারণ স্যুট পরা এ কোন সাহেব? এই কি লাটসাহেব? ইংরেজ রাজার প্রতিনিধি? ধড়াচূড়া কই? লাল মখমলের জামা কই? হাতে তলোয়ার কই? – আরে, ওইগুলা যাত্রাপালার রাজার হয়! ইংরাজ না জরির জামা পরে! হাতে তলোয়ার নয়, বন্দুক! দেখিস না কেনে বন্দুক হাতে সান্ত্রী নামিলো!
নামুক সান্ত্রী, হোক জরির জামা ছাড়াই ইংরেজ রাজার লাটসাহেব, বাংলার গভর্নর ফুলের মালা গলায় পরলেন বটে, পরক্ষণেই খুলে ফেললেন, তারপর অবাকের পর অবাক! বাংলায় বললেন, কেমুন আছেন আপনারা! আরে, ইংরাজ দেখি বাংলাও কয়! – হঠো! হঠো! লাটসাহেব ডাকবাংলোর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কি প্রায় লাফিয়েই ঘরে ঢুকলেন। ঘরের ভেতরে একে একে পেশ হতে লাগলো শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। মইনুল হোসেনের সুযোগই হলো না নেতাদের সঙ্গে সেও ঢুকে পড়ে ডাকবাংলোর ঘরে। হাতে তার পিটিশন। শহর রক্ষার পিটিশন! আধকোশা নদীকে বাঁধ দিয়ে জব্দ করার পিটিশন। – মহামহিম বাংলার লাট শ্রীল শ্রীযুক্ত লর্ড কেসি সমীপে জলেশ্বরীর প্রজাবৃন্দের আকুল আবেদন।
কে শোনে কার আবেদন! ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে মইনুল হোসেন মোক্তার ঘামতে থাকে। আজ সূর্যটাও কড়া। ইংরেজের দাপটে এই শ্রাবণ মাসেও আকাশে মেঘ নাই, ঝকঝক করছে আকাশ, সূর্যের তেজ কীরে বাবা! কে বলে ইংরেজ বিদায় হবে ইন্ডিয়া থেকে! গান্ধী যতই বলুক – কুইট কুইট ইন্ডিয়া, আর জিন্না যতই লাফাক Ñ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, জলেশ্বরীর সাধারণ মানুষের প্রত্যয় হয় না ইংরেজের রাজত্ব কোনোদিন শেষ হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই জলেশ্বরীতে তারা গোরা সোলজারদের দাপট দেখেছে, তারা এখানে ছাউনি গেড়ে বসেছিল জাপানিদের ঠেকাতে Ñ সেই গোরার দল আর ট্যাংক কামান লরি আর মাথার ওপরে চিলের মতো হুই দূর দিয়ে বিন্দুপ্রায় জঙ্গিবিমান উড়ে যেতে দেখেছে জলেশ্বরীর মানুষ, আর এখন এই তাদের সমুখে উপস্থিত স্বয়ং লাটসাহেব, গোরা সাহেব, ইংরেজ রাজার নিজ প্রতিনিধি, হলেওবা জরি নাই মুকুট নাই কেবল ছাইরঙা স্যুট পরা, লোকেরা মুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে ভিড় রচনা করে থাকে লাটসাহেবের ট্রেন ঘিরে, ডাকবাংলোর মাঠ ভরে, সড়ক উপচে।
ডাকবাংলোর বন্ধ বৈঠকখানা ঘরে দর্শন সাক্ষাৎ শেষে ফেরার সময় হয় লাটসাহেবের। আবারও সেই দৃশ্য দেখা যায়, প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ডাকবাংলো থেকে নেমে আসেন লর্ড কেসি, মিছিল করে পেছনে পেছনে হাকিম সাহেব, পুলিশের বড় দারোগা, বাজারের মাতবর মার্চেন্ট কয়েকজন আর কংগ্রেস লীগের নেতারা; ওই ঝাউগাছের গেটের তলা দিয়ে শাদা ট্রেনের কাছে এসে গেছে তারা, গেট পার হলো, লর্ড কেসি ট্রেনের পাদানিতে পা রাখলেন, দরোজা পর্যন্ত উঠে গেলেন তিনি, তারপর জনতার দিকে হাত তুলে ধরলেন, ঠিক সেই সময়! মইনুল হোসেন মোক্তার ভিড় ঠেলে একেবারে লাটসাহেবের প্রায় কাছে পৌঁছে যায়। – ছার! ছার! মাই লর্ড! অধীনের এই পিটিশন! মইনুল হোসেন দরখাস্তের কাগজটা, আধকোশাকে বাঁধ দিয়ে শহররক্ষা করার সেই পিটিশন, শহরবাসী শতেক মানুষের স্বাক্ষর সংবলিত সেই আর্জিখানা লাটসাহেবের সমুখে পতাকার মতো তুলে ধরে; কবেকার সেই রানী ভিক্টোরিয়ার প্রতি জাতিস্মর নাম ধরে ডেকে ওঠে, মহারানীর দোহাই! অধীন ভারতবাসী জলেশ্বরীর অধিবাসীকে দয়া করেন!
পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে মইনুল হোসেনের ওপর। কিন্তু লাটসাহেব হাত তুলে ধরে উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠেন, লেট হিম! লেট হিম! ভিড়ের ভেতরে এবার এগোতে পায় মইনুল হোসেন। – ইয়েস, মাই ফেলো! হোয়াট ইজ ইট! হাকিম নেয়ামতউল্লাহ মইনুল হোসেনের হাত থেকে প্রায় ছোঁ মেরে কাগজখানা নিয়ে একপলক চোখ বুলিয়েই লাটসাহেবকে বিষয়টা অবগত করান। – স্যার ইট ইজ অ্যা পিটিশন টু ইয়োর লর্ডশিপ টু সেভ দি টাউন ফ্রম দি রিভার! – সেভ দি টাউন ফ্রম রিভার? হোয়াট রিভার? – রিভার আডকুশা, মাই লর্ড। – হোয়াট অ্যাবাউট ইট? কাম, মাই ডিয়ার ফেলা, কাম টু মি! লেট মি হিয়ার ফ্রম ইউ!
এ একটা গল্পকথাই হয়ে আছে জলেশ্বরীতে – লাটসাহেব নিজে ডেকে কাছে নিয়েছেন মইনুল হোসেন মোক্তারকে, আর মোক্তারের ব্যাটা কী দাপটেই না ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বর্ণনা করেছে আধকোশা নদীর ভাঙনের ইতিহাস। এমনকি খোদ হাকিম সাহেব তার বাংলা বয়ানকে ইংরেজি করে লাটসাহেবকে মুহুর্মহু শুনিয়েছেন! বোঝো তবে! সাহসখানা একবার দ্যাখো মইনুল হোসেন মোক্তারের! রাজেনবাবু না তল পায়, নজিরমিয়া না সেলামের অধিক না বক্তব্য দিবার পায়, মইনুল হোসেন মোক্তার এক নয় দুই নয় দশমিনিট লাটের সাথে আলাপ করে! Ñ ওয়েল, আই উইল টেক দি পিটিশন। আই উইল সি টু ইট। ঘাবড়াও নেহি। – বলিছে কি বলে নাই লাটের ব্যাটা! বলিতে তাকে বাইধ্য করিছে মোক্তার, হামার মইনুল হোসেন মোক্তার। আর ঝা বলিছে লাটসায়েব, হাকিম তার বাংলা বয়ানও দিছে কি দেয় নাই! কইলকাতা যায়াই মুই দেখমো ইয়ার ব্যবস্থা কী করা যায়! কাতারবন্দি দুনিয়ার মানুষ নিজকানে শুনিছে লাটসায়েবের ওয়াদা।
এই ঘটনা যত চমকপ্রদ আর মইনুল হোসেনের পক্ষে যত সাহসেরই বলে আমরা মনে করি না কেন, এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্যে; শহরের গণ্যমান্য সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। আমরা সহজেই লক্ষ করি মানুষের ঈর্ষা! নেতা নয়, মার্চেন্ট নয়, নিতান্তই এক মোক্তার, সে কিনা সকলের ওপরে এতবড় বাহাদুরিটা নিয়ে গেল! বাজারঘাটে যত প্রশংসাই সাধারণ লোকেরা করুক না কেন, দোকানে দোকানে মইনুল হোসেনের সঙ্গে লাটসাহেবের বাতচিত নিয়ে যত কথাই পল্লবিত হোক না কেন, কাছারির মোক্তার বার, উকিলদের বার, লীগের অফিস, কংগ্রেসের অফিস, সব জায়গায় একই রব – মইনুল এটা কী করলো! দেশে যখন স্বাধীনতার আন্দোলন, এতকাল পরে যখন ইংরেজ পড়েছে কেঁচিকলে, সারা ইন্ডিয়া যখন ইংরেজের রাজত্ব শেষের জন্যে আন্দোলনের রাস্তায়, গান্ধীর অনশন, জহরলালের কৌশল, জিন্নার মুখে পাকিস্তান-পাকিস্তান এই এক কথা, তখন কিনা কোথাকার কোন মফস্বল এক জলেশ্বরী আর তার একখান নদী আধকোশা, তাই নিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি! ইংরেজের লাটের কাছে পিটিশন! – আরে, ইংরাজ তো এমন মওকাই চায়! স্বাধীনতার ঝইন্যে আন্দোলন না করো, নদীর কথা চিন্তা করো! ইন্ডিয়ার কথা না ভাবো, জলেশ্বরী রক্ষায় মাতোয়ারা থাকো! আধকোশা! কত আর ভাঙিবে!
সেই আধকোশার দিকে অপলক চোখে এখন মইনুল হোসেন মোক্তার তাকিয়ে আছে। এই সেই নদী! এরই জন্যে এত তার চিন্তাভাবনা দরখাস্ত! ইংরেজের বন্দুক উপেক্ষা করে লাটসাহেবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দরখাস্ত পেশ করা। এই নদীর জন্যে? আর এই নদী, আজ চোদ্দই আগস্টের পরে আর তার নয়, পাকিস্তানের নয়, হিন্দুস্থানের নদী! হা-হা করে হাসে ওয়াহেদ ডাক্তার। পাগলা মোখলেছ কাছারির মাঠে জামগাছ তলায় বসেছিল। ওয়াহেদ ডাক্তার তাকে বলে, এই যে বিটিশ দ্যাশ হতে চলি গেইলো, এই যে হাকিম সায়েবে কইলো আজ ছে আপলোগ আজাদ হ্যায় – কথাটা কী বুঝিলো তুঁই? কিছুক্ষণ থম্ ধরে থেকে মোখলেছ বলে, যা বোঝার তা বুঝিছোঁ। – না, তুই বুঝিস নাই। বুঝিবি দুইদিন বাদে। আমি হরিষাল ফিরি যাই। সেথা হতে আজাদির নয়া ঘোষণা মুঁই দেমো। আমরা আতান্তরে পড়ে যাবো ওয়াহেদ ডাক্তারের এ-কথা শুনে। পাগল কি মোখলেছ না ওয়াহেদ ডাক্তার – আমরা অচিরেই দেখে উঠবো। আর আমরা কুসমির ঘরে সাইদুর রহমান কন্ট্রাক্টরের মুখে যে-গল্প শুনছিলাম – বুঝলু রে কুসমি, তোমার তখন তো জন্ময় হয় নাই, সে বড় পাগলা সময় গেইছে! বলিলেও না প্রত্যয় হয়! হবার কথাও নয়। ওয়াহেদ ডাক্তার তো জলেশ্বরী হতে হরিষাল গেইলো ঝ্যান পঙ্খির পাখায় ভর করিয়া নদী পার হয়া। মনে পড়ি যায়! সে একসময় গেইছে রে, কুসমি! (চলবে)